সুবর্ণরেখার তীরে দ্বিতীয় পর্ব  <br /> ছন্দা বিশ্বাস

সুবর্ণরেখার তীরে দ্বিতীয় পর্ব
ছন্দা বিশ্বাস

ছাদে অস্থির ভাবে পদচারণা করছে রাজকন্যা চিত্রলেখা। তার মন ভাল নেই। সোমদেবের চিত্র দর্শনের পর থেকে তার চিত্ত ব্যাকুল হয়েছে। কোনো কিছুতেই তার মন বসছে না। বড়ই অস্থির হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে মেঘমালাকে তার খুব দরকার। কিন্তু মেঘমালা আছে মাতুলালয়ে। সুবর্ণরেখার তীরে। ধারাবাহিক উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব। ছন্দা বিশ্বাস একজন পত্র বাহককে পাঠান হয়েছে। দ্রুত চলে আসার জন্যে। নইলে চিত্রলেখার জীবনে নেমে আসবে ঘোর অশনি সংকেত।

এই উপন্যাসের প্রথম পর্ব– প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তিন

উদাসী রাজকন্যাঃ

সেদিন প্রাসাদের ছাদের উপরে অস্থির ভাবে পদচারণা করছিল রাজকন্যা চিত্রলেখা। মল্লরাজ জগৎনাথ দেবের একমাত্র কন্যা স্নেহের দুলালী চিত্রলেখা। তেরো বছর পার করে সবে চোদ্দতে পা রেখেছে। শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতোই সুন্দরী। স্বর্ণ মোড়কে ঢাকা একখানি পুতুল যেন। প্রাসাদের ছাদে এসে সে প্রত্যহ বৈকালিক শোভা উপভোগ করে। এটা তার দৈনদিন কাজের তালিকার ভিতরে পরে। দুপুরে খাওয়ার পরে কিছুটা সময় সে সখীদের সঙ্গে গল্প করে। খানিক বিছানায় গড়িয়ে উঠে পড়ে। দুপুরের সাজ পাল্টে নতুন সাজে সাজিয়ে দেয় সখীরা। কখন বুনো ফুলের মালায়, কখনো বা স্বর্ণ আভরণে সে সজ্জিত হয়। আজ সে বাহুতে জড়িয়েছে বকুল ফুলের মালা, মাথায় বকুলফুলের সিঁথীপাটি। সিঁথিপাটীর প্রান্তে কপালের উপরে বড় একটি কদম ফুল শোভা পাচ্ছে। খোঁপায় জড়িয়েছে কুন্দ ফুলের মালা। এই ফুল তার বড়ই প্রিয়। তাদের প্রাসাদের বাগানে নিত্য ফোটে এই ফুল। নিত্য ঝরে পড়ে বকুল ফুলেরা। সখীরা ভোর হলে বকুল ফুল কুড়িয়ে আনে, পিতলের সাজি ভরে ওঠে সেই ফুলে। তারপরে সেই ফুলগুলো জলে ভিজিয়ে রাখে। রাজকন্যার শোওয়ার ঘর সুগন্ধে ভরে ওঠে। এই সময়ে যুথী আর কুন্দ ফুল ফোটে। রাজকন্যা এক এক দিন এক এক ফুলের আভরণে সজ্জিত হয়। দুপুরে চলে মালা গাঁথা পর্ব। রাজকন্যাকে সাজিয়ে তার সখীরা সুখ পায়। রাজকন্যাকে সাজান হয়ে গেলে বাকি ফুল দিয়ে নিজেরাও সাজগোজ করে। চিত্রলেখাই সখীদের বলে, এবারে তোরা সেজে নে, সখী। বেলা যে গড়িয়ে গেল।

একা সেজে সুখ নেই, সেটা রাজকন্যা জানে। তার সমধুর কথায় সখীরা খুশী হয়।

রাজকন্যার সেগুন কাঠের পালংকের এক দিকে লাগানো রয়েছে দামী আয়না। সেই আয়নায় বসে সে সাজ দেখে। এই পালংক বহুকালের পুরানো। তার মা ঠাকুমারা এই পালংকের উপরে বসেই সাজতেন। কয় পুরুষের পুরানো সে কথা রাজকন্যা নিজেই জানে না। মধ্যপ্রদেশের বহু মূল্যবান সেগুন কাঠ দিয়ে বানান হয়েছিল এই পালংকটি। তখনকার দিনের রাজ্যের সেরা শিল্পী এর নকশা এঁকেছিলেন। নিপুণ হাতে পালংকটি নির্মাণ করেন একজন শিল্পী। রাজপ্রাসাদের বহু আসবাব এই কাঠেরই তৈরী। স্বয়ং রাজা জগৎদেবের সিংহাসন এই কাষ্ঠদ্বারা নির্মিত। যার উপরে অপূর্ব কারুকাজ করা আছে। সোনার পাত আর মিনে করা বহুমূলের এই সিংহাসনটি বর্তমান রাজা জগৎদেবের পূর্ব পুরুষ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। নিজ দেশভূমি ত্যাগ করে আসার সময়ে যতটা সম্ভব প্রিয় জিনিসগুলো সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সে আজ বহুকাল আগের কথা।

বৈকালিক শোভা উপভোগ করার সময়ে প্রাসাদের ছাদে রাজকন্যার সঙ্গে অন্যান্য সখীরাও থাকে। তাকে সঙ্গ দেয়। কখনো আলসেতে ভর দিয়ে রাজপুরীর পিছনের দিকের বাগানে আম গাছে বসে থাকা পাপিয়ার পিউ কাহা ডাক শোনে। তাদের সঙ্গে গলা মেলায় যখন মনে আনন্দ থাকে। কখনো বা উদাস নয়নে সামনের নদীটার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রাসাদের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী সুবর্ণরেখা। স্বচ্ছ তার জল। উপল খন্ডের ভিতর দিয়ে সে রিনিঝিনি ছন্দে বয়ে চলেছে। যেন রূপোর ঘুঙুর পরা কোনো কিশোরী ছুটে চলেছে আপন খেয়ালে। তার থামার বালাই নেই। কোনো বাধা তার চলার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করলে সে যেন কিছুর তোয়াক্কা না করে স্বচ্ছন্দে বাধা ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে চলেছে। দুর্মর তার জেদ। বড়ো বড়ো পাথর খন্ড টপকে অনায়াসে ছুটে চলেছে। অনেকটা রাজকুমারী চিত্রলেখার মতোই অনমনীয় তার জীবন প্রবাহ।

বেলা পড়ে এসেছে। সূর্য হেলে পড়েছে দিগন্ত রেখার দিকে। বিদায়ী আলো জলের উপরে মায়াবী পরশ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বড়ো মায়াময় সেই স্পর্শ। ঢেউয়ের উপরে রঙের কারিকুরি। বাতাসে বহমান স্রোতের সঙ্গে রঙ্গের খেলা চলছে। নদীটা যেন আলস্যে গা ভাসিয়ে দিয়েছে সেই মোলায়েম আলো ছায়ায়। নদীর দুই তীরে গভীর জঙ্গল। বিচিত্র গাছেদের সহাবস্থান। নদীতীরের কিছু কিছু গাছ ঝুঁকে এসে পড়েছে নদীর বুকে। গাছেদের ছায়া জলে নানা রঙ্গের আঁকিবুকি কেটে চলেছে। বহমান জলধারা স্থির কোনো ছবি আঁকতে পারছে না। গোধুলির বিচিত্র রং গুলে গুলে যাচ্ছে রাজকন্যার অনুভূতির মতোই।

স্বর্ণরেণু মাখা সুবর্ণরেখা। নদীর ছল ছল শব্দের সঙ্গে রাজকন্যা চিত্রলেখার নিজের হৃদয়ের শব্দ মিশে যাচ্ছিল। বিশাল জলরাশি নদীর বুকে স্থিত পাথরে বাধা প্রাপ্ত হয়ে শতধারায় বিশ্লিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাজকন্যার হৃদয়ও তেমনি ভেঙ্গে চূরমার হয়ে যাচ্ছে। তার হৃদয়ের এই ভাঙ্গনের শব্দ সে কাউকে শোনাতে পারছে না। তাই সে আরো ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। কিছুদিন হল তার এই ভাবান্তর দেখা দিয়েছে। থেকে থেকে সে উদাস হয়ে যায়। মন কেমন করে। কিচ্ছু ভালো লাগে না। উদাস ব্যাকুল মন। চিত্রলেখা এক দন্ডের জন্যে স্থির থাকতে পারছে না। যেদিন থেকে সে যুবক সোমদেবের চিত্র দর্শন করেছে তার পর থেকে তার এই ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেছে। এই মুহূর্ত্যে প্রিয় সখী মেঘমালাকে তার ভীষণ প্রয়োজন। তিন দিন হল সে সখী মেঘমালার কাছে পত্র লিখে একজন পত্র বাহককে পাঠিয়েছিল।

মেঘমালা এক মাসের জন্যে মাতুলালয়ে যাবার কথা বলে তিন মাস কাটিয়ে দিল। যদিও পরের দিনগুলি ইচ্ছাকৃত ভাবে নয়। কঠিন এক জ্বর তাকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছিল যে সে কিছুতেই উঠে হাঁটা চলা করা দূরে থাকুক বসতে পর্যন্ত পারছিল না। অনেক ডাক্তার কবিরাজ তান্ত্রিকের মন্ত্রপূতঃ জল খেয়ে তবে সে সুস্থ হয়েছে। দুই এক দিনের ভিতরেই চলে আসবে জানিয়ে দিয়েছে পত্র বাহককে। এই জঙ্গল মহল থেকে বিশ ক্রোশ পথ হবে মেঘমালার মাতুলালয়।

সখী বিরহে তার কাতরতার কথা অনুধাবন করেই মেঘমালা দ্রুত মাতুলালয় ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা ছাড়া রাজকন্যাকে ছাড়া সেও কখনো এতোদিন দূরে থাকেনি। রাজকন্যার আরো দুইজন সখী বর্তমান কিন্তু মেঘমালা তার বড়ো আপনার। এমন কোনো কথা নেই যা মেঘমালা জানে না।

অথচ মেঘমালার সঙ্গে তার আবাল্যের সম্পর্ক নয়।

সে এই জঙ্গল মহলের ভূমিকন্যা। এখানেই বংশ পরম্পরা ধরে বাস তাদের। রাজকন্যা তথা মল্ল রাজারা এসেছিলেন সুদূর ভারতের মধ্য পশ্চিম অঞ্চল থেকে। এখানকার জায়গা মানুষ জন রীতি নীতি সম্মন্ধে অনেক কিছুই তাদের জানা ছিল না। ক্রমে তারা সমস্ত কিছু জেনেছেন। এই অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে ক্রমে তাদের পরিচিয় ঘটে। মল্ল রাজাদের সঙ্গে আরো যে সকল প্রজারা এসেছিল তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। এই জনজাতিদের নিয়েই মল্লরাজ গড়ে তুললেন তার নতুন সাম্রাজ্য। এরা হলেন তাঁর প্রজা, তাঁর সহায়ক। বিশ্বাসী কর্মঠ সৎ মানুষগুলো অচিরেই রাজ অনুগ্রহ লাভ করল। আদিবাসি মহিলারা রাজ অন্তঃপুরে নানাবিধ কাজে নিযুক্ত হল।

চিত্রলেখা তখন শিশু। সখী মেঘমালার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল তারও অনেক পরে। শৈশব অতিক্রম করার পরে যখন সে বালিকা বয়েস পা রাখে তখন তার পরিচয় ঘটে মেঘমালার সঙ্গে।

মেঘমালার বয়েস বেশি নয়। ত্রয়োদশ বৎসর উত্তীর্ণ করেছে সবে। কিন্তু তার বুদ্ধি যথেষ্ঠ পরিণত।

আগেই বলেছি মেঘমালা আদিবাসী সন্তান। তার বাবা মা দিন মজুরের কাজ করে। আগে নিজেরাই নদী থেকে পাথর তুলে সেই পাথর ভাঙ্গার কাজ করত। বিনিময়ে যৎসামান্য পারিশ্রমিক পেত। এখন সকলেই রাজার অধীন। রাজকোষ থেকেই তারা বেতন পায়।

একদিন পার্বণে রাজকন্যার সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে। রাজকন্যা চিত্রলেখা সেদিন প্রাসাদে বৈকালিক ভ্রমণ করছিল। আলসেতে ভর দিয়ে দূরে সুবর্ণরেখার দিকে তাকিয়েছিল। নদীর অপর পাড়ে যেখানে সবুজ গাছদের কাঁধে মাথা রেখেছে নীলাকাশ সেইদিকে সে তাকিয়ে আছে। তার সখীর অভাব নেই। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু বলতে একজনই, মেঘমালা। তাই অনেকের ভিতরে থেকেও সে যেন একা। বন্ধুহীন, তার একাকি যাপন নিদারুণ কষ্টের বলে মনে হচ্ছে। মেঘমালার পথ চেয়ে তার দিন কাটছে। কবে যেসবে সেটাও অনিশ্চিত।

এদিকে সে যে কি ভয়ানক সমস্যার ভিতরে দিন কাটাচ্ছে সেটা তো মেঘমালার জানার কথা নয়।

তার মায়ের মুখে সে শুনেছে তাদের মান্ডু রাজ্যের গল্প। তার মা আবার তার শাশুড়ি মায়ের মুখে শুনেছে সেই গল্প। সে কত দিন আগের কথা। বংশ পরম্পরা ধরে তার এখানেই বাস করছে। এই স্থান তাদের কাছে প্রবাসই। কিছুতেই মন থেকে তাদের পুরাতন বাসভূমিকে তারা ভুলতে পারে না। তখন প্রবাসে এসে তাদের মন কেমন করত। এখানে থাকলেও তাদের মন পড়ে থাকতো সেই মান্ডু রাজ্যে। মান্ডু তাদের পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান, তাদের এক সময়ের বাস ভূমি। কপালের লিখন বলে কথা, ভাগ্যদোষে সব কিছু ত্যাগ করে এই স্থানে চলে আসতে বাধ্য করেছে। এক অশুভ শক্তি তাদেরকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করিয়েছে। সেই অশুভ শক্তি হল সুলতান আলাউদ্দিন খলজী। দুর্দমনীয় এই দিল্লীর সম্রাট যে তাদের মান্ডু ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।

যে এক করুণ কাহিনি। সমগ্র মান্ডুবাসীর জীবনে সেদিন ঘোর অমানিশা নেমে এসেছিল।

এরপরে কেটে গেছে বহুকাল। সেই দুর্ভাগ্যের কথা মনে পড়লে বুকের গভীরে আজও চিন চিনে ব্যথা অনুভূত হয় রাজা জগৎদেবের। মান্ডু রাজাদের বংশ গরিমা, তাদের বৈভব, সুনাম প্রতিপত্তি, আভিজাত্য সে সব যেন রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়।

রাজকন্যা ছোটবেলা থেকে সেই সব কথা শুনেই বড়ো হয়েছে। তার মার মুখে, ঠাকুরমা-দিদিমাদের মুখে মুখে। দাস- দাসী চাকর- বাকর যারা ও দেশ থেকে রাজার সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল সেই সময়ে তাদের মুখ থেকে শুনেছে।

রাজকন্যা বিকেলে যখন প্রাসাদের ছাদে উঠে চারিদিক অবলোকন করত, তখন দেখত তারই বয়সী কিশোর- কিশোরীর দল এই পথ দিয়েই গাইতে গাইতে গৃহাভিমুখে চলেছে। তাদের কারো কোলে ছাগল ছানা, কারো কোলে মেষ শাবক। সঙ্গে দুগ্ধ ধবল গাই বাছুর এবং মহিষ, তাদের শাবক নিয়ে ধীর পায়ে ঘরে ফিরছে। দলের কিশোরেরা বাথানে নিয়ে যেতো এই পশুগুলোকে। সারাটাদিন চরে বেড়াত গরু বাথান মহিষ বাথানে। বিকেলে সূর্যাস্তের আগেই গরু -মহিষদেরকে একত্র করে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। রাজকন্যা ছাদ থেকে দেখত পাহাড়ি পথ ধরে নেমে আসছে সারি দিয়ে যত গরু- বাছুর ছাগল- ভেড়ার পাল। পিছনে টোকা মাথায় গান গাইতে গাইতে আসছে উদ্যম কিশোর- কিশোরীরা। বিকেলের কমলা রাঙ্গা রোদ্দুর তখন আলস্য ছড়াচ্ছে পাহাড়ি উপত্যকায় মালভূমির গায়ে। ফুরফুরে বিকেল দুপুরের আলস্য কাটিয়ে মায়াবী হয়ে উঠত। রাজকন্যার মনে হতো এক ছুটে যদি ওদের দলে ভিড়ে যেতে পারত। ওদের সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে পারত। শ্যাম বর্ণ কিশোরের হাত থেকে বাঁশিটি নিয়ে যদি একটিবার তাতে ফুঁ দিতে পারত। কিশোরীর চলার ছন্দে যদি পা মেলাতে পারত। তবে বুঝি সুখ হতো।

পাহাড়ি বাঁশের সরু কঞ্চি হাতে তখন দামাল পশুদের নিজেদের আয়ত্বে আনছে দুরন্ত কিশোর। দল ছুট ছাগল আর ভেড়ার পাল নিয়ে হিম শিম খাচ্ছে তারা। ভেড়ার পাল থেকে কিছু দুষ্টু এবং দুর্বিনীত ভেড়া দল ছেড়ে পথ পাশের ফসলের ক্ষেতে ঢুকে যেত তখন সেই দৃশ্য দেখে রাজকন্যা হেসে গড়িয়ে পড়ত। কখনো বা পড়ন্ত বিকেলে কিশোরের বাঁশির সুরে আনমনা হয়ে পড়ত। দিক থেকে দিগন্তে ভেসে যাওয়া সেই বাঁশির সুরে সে কোথায় যেন হারিয়ে যেতো। তার মনে হতো কী যেন সে ফেলে রেখে এসেছে তার মাতামহী পিতামহীদের মতো সুদূর মান্ডুতে।

কতবার মহারাজ জানতে চেয়েছেন, তোমার মুখে হাসি নেই কেন? সব সময়ে কী এতো ভাবো বলত?

এমন উন্মনা হলে চলে?

সে সত্যিটা বলতে পারেনি। বলতে পারেনি, এই নব নির্মিত শহর তাদের দেশ নয়, তাদের দেশ হল মান্ডু। তার মা দিদিমা ঠাকুরমাদের মুখে মুখে মান্ডুর গল্প শুনেছে। সে বড়ো বিচিত্র জায়গা। সে কল্পনায় ঘুরে বেড়ায় মান্ডুতে।

কতদিন রানিমা আদর করে কোলে বসিয়ে সোহাগ করেছে। চুমু খেয়ে বলেছে কী হয়েছে তোমার? আমাদের একমাত্র সন্তান তুমি তোমাকে এমন মনমরা দেখতে কি আর ভাল লাগে?

রাজকন্যা নীরব থেকেছে।

কীভাবে সে বলবে সুখের ঠিকানা এক এক জনের কাছে এক এক রকমের।

সেই কিশোর আর কিশোরীরা অবাক চোখে রাজকন্যাকে দেখত। তার রূপ দেখে মুগ্ধ হতো। নিজেদের ভিতরে বলাবলি করত, এই না হলে রাজকন্যে! একেবারে পরীর মতো সুন্দরী। তারা পরী দেখেনি, কিন্তু মা ঠাকুরমাদের মুখে শুনেছে দুনিয়ার সব চাইতে সুন্দরী হল পরীরা।

স্বর্গ আর মর্ত্যের ঠিক মাঝখানে কোনো এক জায়গায় বাস করে পরীরা। কল্পনায় তারা নিজেদের মতো করে পরীদের ছবি আঁকতো। তাদের বাস স্থান , তাদের জীবন যাপন কল্পনা করে নিত। আর এখন এই রাজকন্যেকে দেখে তারা মিলিয়ে নিচ্ছে পরীরা আদতে দেখতে কেমন। কীভাবে তাদের দিন কাটে। এত কাছ থেকে আগে কখনো রাজপরিবারের মানুষদের দেখার সুযোগ ঘটেনি। তাই রাজ বাড়িতে যারা কাজকর্ম করত ফাই ফরমায়েশ খাটত তাদের মুখ থেকে শোনা কথাগুলো নিজেদের কল্পনার রঙ্গে রাঙ্গিয়ে তুলত।

রাজকন্যা ছাদের আলসেতে ভর দিয়ে হাত নেড়ে তাদেরকে ডাকত। ডেকে ডেকে সকলের সঙ্গে কথা বলত। অবশ্যই দূর থেকে। কারণ রাজ প্রাসাদের চারিদিকে ছিল সু- উচ্চ প্রাচীর। বক্তা এবং শ্রোতা কেউই একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারত না। তবে তাদের কথা বলা থেমে থাকত না। তারা আকার ইঙ্গিতে ঠিকই বুঝে নিত পরস্পরের ভাষা। কিছু না বোঝা বাক্যবন্ধ আর হাসি দিয়ে বাকীটা পূর্ণ করত।

রাজকন্যা যেদিন খুব খুশী থাকত সেদিন হাতের বালা নয়ত কংকন খুলে ছুঁড়ে দিত তাদের দিকে। কখনো হীরে বসানো সোনার আংটি উপহার দিত কোনো বংশীবাদক রাখাল ছেলেকে। কখনও গলা থেকে মুক্তা মালা দেখিয়ে বলত এই নাও মালা পরিবর্ত্যে তোমার বাঁশিখানি আমায় দিয়ে যাও।

তারা ভয় পেত, কুড়িয়ে নিয়ে আবার জমা দিয়ে যেত প্রাসাদের দ্বাররক্ষীর নিকটে। দ্বাররক্ষী সে সমস্ত অলংকার আবার পৌঁছে দিত অন্দরে।

সকলে জানতো রাজার একমাত্র আদরের দুলালীর এসব খামখেয়ালী।

কিশোর বংশীবাদক সুন্দরী রাজকন্যার উদ্দেশে বাঁশিতে সুর ধরত। সেই সুরে কাঁপন ধরত বাতাসে, কাঁপন লাগত সুবর্ণরেখার বুকে। উদ্যানের ফুলগুলো আনন্দে মাথা দোলাত তখন। জুঁই, বকুল, হাস্নুহানা, অশোক গাছে দোলা লাগত। ছাদের আলসেতে ভর দিয়ে নিচু হয়ে রাজকন্যা মুগ্ধ হয়ে শুনত সেই বাঁশির সুর।

ক্রমে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসত। রাখাল বালকের সঙ্গে বংশী বাদক কিশোর রাজকন্যার কাছ তেহেক বিদায় নিয়ে ঘরের পথে পা বাড়াত।

রাজকন্যা বিমর্ষ মুখে তাকিয়ে থাকত সেই রাঙ্গা ধূলোর পথের দিকে। বাঁশীওয়ালা চলে গেলেও তার সুর যেন এখন ঘুরে ঘুরে কেঁডে বেড়াচ্ছে প্রাসাদের চারিদিকে। রাজকন্যার অন্তর বিদীর্ণ হচ্ছে। চোখে জল ভরে উঠলে তালু দিয়ে সে জল মুছে ফেলছে।

এই ভাবেই একদিন এক কিশোরীর সঙ্গে চিত্রলেখার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মেঘমালা তার নাম।

বিত্ত দিয়ে তো আর বন্ধুতা বিচার হয় না। মনকে যে টানে সেই তো পরম বন্ধু। তো মেঘমালার সঙ্গে রাজকন্যা চিত্রলেখার সুন্দর এক সখ্যতা গড়ে উঠল। আস্তে আস্তে সে অন্দরে প্রবেশের অনুমতি পেল এবং ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠল চিত্রলেখার প্রধান সহচরী।

মহারাজ জগৎ সিং মেঘমালার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছেন মেয়েটি কেবল মাত্র সুন্দরীই নয়, সে প্রখর বুদ্ধির অধিকারিণী। দরিদ্র পরিবারে নিত্য ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে বড় হতে গিয়ে সে যেমন সহনশীলতা অর্জন করেছে তেমনি বিভিন্ন ধরণের মানুষ এবং জায়গা সম্মন্ধে তার বেশ জ্ঞান। এইটুকু বয়েসে সে অনেক কিছু জানে এবং বোঝে। বয়সের তুলনায় যথেষ্ঠ পরিপক্ক। কিন্তু চতুর কিম্বা শঠতার লেশ মাত্র তার ভিতরে নেই। সে সৎ এবং স্নেহশীলা। রাজকন্যাকে সে শুধু মাত্র সখী হিসাবেই নয়, তাকে সময়ে সময়ে নানা উপদেশ প্রদান করে যা শুনে মনে হবে কোনো বয়স্কা কেউ পরামর্শ দান করছে। আর সে পরামর্শ মোটেও হাল্কা নয়। রাজকন্যা তাই মেঘমালার মতের গুরুত্ব দেয়। সংকট জনক পরিস্থিতিতে যখন নিজের বুদ্ধির উপরে ভরসা করতে পারে না তখন চিত্র লেখার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, দেখ তো রে সখী, তুই যেটা ভালো বিবেচনা করিস সেটাই হবে। আমার মাথাতে কিছুই আসছে না।

আসার কথাও নয়, এটা মেঘমালা ভালোরকম বোঝে। রাজার ঘরের এক মাত্র আদরের দুলালী, তার উপরে নতুন পরিবেশে এসে পড়েছে। এখানকার হাল চাল মানুষজনের গতিবিধি সবই নতুন।

মানুষ সম্পর্কে রাজকন্যার জ্ঞান খুবই সীমিত। কেউ যদি ভালো বলে, সে তাকে ভালো মনে করে আর খারাপ বললে খারাপটাই ধরে নেয়।

মেঘমালা তাকে শিখিয়েছে নিজের চোখে দেখতে, অন্যের চোখ দিয়ে নয়। নিজের মনকে প্রশ্ন করতে কে ভাল আর কে মন্দ।

তার জন্যে তো মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, কথা বলতে হবে। কিন্তু তার মেশার মানুষের সংখ্যা তো খুবই কম। তাই তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ভাল উদাহরনোটাই বেশি। অশুভ, খারাপ, কুজন, মন্দমতি, লোভী, অসৎ চত্রিত্রের মানুষ সম্মন্ধেতার তেমন কোনো ধ্যান ধারণাই নেই। মেঘমালা যেমন কোনো পুরুষের লোভী চোখ দেখলেই ধরে ফেলতে পারে এন নিমেষে। কুচক্রীর কথা বলার ধরণ দেখলে সে বুঝতে পারে এই মানুষটার খারাপ মতলব আছে।

রাজকনায় মেঘমালার কতাহ শুনে গালে হাত রেখে বলেম সখী, তুই এতোসব কীভাবে বুঝতে পারিস? আমার তো সবাইকে এক রকম মনে হয়।

মেঘমালা নীরবে মৃদু হাসে।

মহারাজ মহারানী, নিকট আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্দরের দাস দাসী আর রাজ পরিবারের অন্দরে প্রবেশের অনুমতি আছে এমন কিছু মানুষ। তাদের ভিতরে প্রায় সকলেই মহিলা। পুরুষ সম্পর্কে রাজকন্যার জ্ঞান খুবই সীমিত। তাই যখন তার হাতে একখানি চিত্র এসে পড়েছিল ভুষো কালি দিয়ে আঁকা চিত্রখানি সেই চিত্রপটের দিকে সে অনেক সময়ে তাকিয়েছিল। এমন সুন্দর কি মানুষ হতে পারে?

দেব দেবতাদের মধ্যে এমন রূপবান দেখা যায়।

সে চিত্রখানি হাতে নিয়ে বসেছিল কখন সখী মেঘমালা আসবে তাকে দেখাবে।

চার

এক কঠিন সিদ্ধান্তঃ

আগামীকাল কৌশিকী অমাবস্যা। আজ কৃষ্ণা চতুর্দশী। সন্ধ্যে নামতে আর খুব বেশী সময় বাকী নেই। মল্ল রাজকন্যা চিত্রলেখা তার শয়ন কক্ষের জানালা দিয়ে ঘন ঘন বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছে। বড়ই উতলা সে। চোখে মুখে নিদারুণ সংশয়। সখী মেঘমালা লক্ষ্য করল রাজকন্যা চিত্রলেখার এই মানসিক অস্থিরতা। সবেমাত্র সে পা রেখেছে প্রাসাদে। ধীর পায়ে এসে ঢুকল রাজকন্যার শয়ন কক্ষে। এই প্রাসাদে মেঘমালার অবারিত দ্বার। রাজকন্যার প্রিয় সখী দুইজনের একজন সে। বয়সে চিত্রলেখার সমসাময়িক। ত্রয়োদশ বছর সবে অতিক্রান্ত হয়েছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মাঝারি উচ্চতার ক্ষীণকায়া কিশোরীর পটল চেরা চোখ দুটি বড়ই মায়াবী। তবে তার দিকে সকলের নজর পড়ে তার ঘন কালো কুঞ্চিত কেশরাশির জন্যে। মেঘের মতো কালো কেশরাশি মাথার উপরে চুড়ো করে বেঁধে সে সামনে এসে দাঁড়ালো চিত্রলেখার। রাজকন্যার কাছ থেকে কোনোরকম সাড়া না পেয়ে সে মৃদুস্বরে ডাকল, সখী?

রাজকন্যা ঘাড় ঘুরিয়ে মেঘমালার দিকে একনজর তাকিয়ে বললে, বল?

নির্লিপ্ত সেই স্বর। চিত্রলেখার পক্ষে যা একেবারেই বেমানান।

আমায় ডেকেছিলে?

হ্যাঁ। তুই মাতুলালয় থেকে ফিরেছিস অথচ আমার কাছে আসিস নি কেন?

রাজকন্যার গলায় অভিমানী সুর।

এই তো একটু আগেই ফিরলাম। খুব পরিশ্রান্ত ছিলাম। পথের অবস্থা খুবই শোচনীয়। গো শকটে এতো মাইল পথ আসা তো মুখের কথা নয়। তার উপরে যে রকম প্রচন্ড গরম। পথে কয়েক বার গাড়োয়ান গাড়ি থামিয়ে গরুগুলোকে বিশ্রাম করাল এবং জল খাওয়ালো। বেচারা গরুগুলোর সে কি কষ্ট। একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। পা চলছে না। গাড়োয়ানের সেই একই দশা। একেবারে গলদ ঘর্ম পরিস্থিতি। পথে কতবার যে বেচারা গামছা ভিজিয়ে চোখ মুখ মুছছে তা যদি দেখতে। আগুনের হল্কা ছুটছে বাতাসে। এদিকে আমাকে দিনে মানে ফিরতে হবে। দুদন্ড যে জিরোবে তারও উপায় নেই। একটানা বেশীক্ষণ পথ চলাও যাচ্ছে না সেই আগুনগলা রোদের ভিতরে। আকাশটাকে মনে হচ্ছে যেন কামারশালা। এই ছায়া ঘেরা প্রাসাদে কিচ্ছুটি বোঝা যায় নাকো। কেমন বাতাস খেলছে। নদীর মিঠে বাতাসে শরীর জুড়িয়ে আসছে। অথচ বাইরে কী পরিস্থিতি। ফিরতে ফিরতে তাই বেলা পড়ে এল।

একেবারে গলদ ঘর্ম হয়ে দারুণ ক্লান্ত বোধ করছিলাম। আমি তখনি আসতাম কিন্তু ঘরে ফিরে স্নান সেরে বিছানায় শরীর ফেলতেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো চোখে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ দাসী নিমকির গলা শুনে ধড়পড় করে উঠে পড়ি। নিমকির মুখে শুনলাম তুমি ডেকে পাঠিয়েছ। কী ব্যাপার সখী? আজ তোমায় এতো উতলা দেখাচ্ছে কেন বলতো?

চিত্রলেখা জানালার পর্দা নামিয়ে বিছানার উপরে এসে পা তুলে বসল। সেগুন কাঠের উপরে অপূর্ব কারুকাজ করা পালংকে ঠেস দিয়ে বসল। মাথাটা পিছনের দিকে যতটা সম্ভব হেলিয়ে দিয়ে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করছে যেন। পাশে মেঝেতে দাঁড়িয়ে সখী মেঘমালা। চিত্রলেখার ঘাড়ে হাত রেখেছে।

চিত্রলেখা চারিদিক এক নজর দেখে নিয়ে বলল, তোকে আজ আমার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে।

তবে খুবই গোপনে।

কখন?

সন্ধ্যের পরে।

কোথায়?

সুবর্ণরেখার তীরে।

‘সুবর্ণরেখার তীরে! কিন্তু কী উপলক্ষ্যে? আজ তো কৃষ্ণা চতুর্দশী। আগামীকাল কৌশিকী অমাবস্যা। সখী তুমি জানো না সে কথা? এই সন্ধ্যা রাতে নদীর পাড়ে যাবে কম সাহস তো নয় তোমার? ভুলে গেছে সেই তান্ত্রিকের কথা? আজ সেই পূণ্য লগ্ন, তান্ত্রিকের সাধনার বিশেষ দিন। কঠোর তপস্যায় বসবেন তিনি। মহুয়া গাছের নীচেয় পাতা আছে পঞ্চ মুন্ডির আসন। সেখানেই ধ্যানে বসেন তান্ত্রিক বামা চরণ। সাপ, ব্যাংঙ, শিয়াল, বেজি আর নরমুন্ড পোতা আছে সেই পঞ্চমুন্ডি আসনের নীচেয়। সামান্যতম অসাবধান হয়েছে কি তান্ত্রিকের আসন টলে যাবে। এই দিনে দেবী রংকিণীর কাছে যা চাওয়া যায় তাই নাকি পাওয়া যায়।

একটা কথা সে বলল রাজকন্যার কানে কানে।

কথাটা শোনা মাত্র রাজকন্যা চমকে উঠল। দ্রুত পালংক থেকে নেমে সটান মেঝেতে দাঁড়িয়ে পড়ল। খাতের বাজু ধরল কম্পিত হাতে। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে সখী মেঘমালার মুখের দিকে। দুই পা সরে এসে আর্তকন্ঠে বলল, তুই কী করে জানলি?

জানলাম। আরো কত কি শুনলাম। ভয়ে তো আমার রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। আমি ভাবছিলাম কতক্ষণে তোমার কাছে কথাগুলো বলব।

বল, কে বলেছে তোকে এই কথা?

আমি আজ আসার পথে শুনলাম গো। নদী তীর ধরে আসার পথে গাড়োয়ান কিছুক্ষণের জন্যে গাড়ি থামিয়েছিল। আর তো চলতে পারছি না যাই একটু ডুব দিয়ে আসি বলে নদীতে গিয়েছিল আনতে। তখন শুনেছে কয়েকজন আদিবাসী বালক নাকি বলা বলি করছিল গালুডির শাল পিয়ালের জঙ্গলের ভিতরে মহুয়া গাছের নীচেয় যে থান আছে আর হাঁড়ি কাঠ রাখা আছে ওখানে আজ নরবলি হবে। পুরোহিত বাবা নাকি জায়গাটা জল দিয়ে ধুয়ে পরিপাটি করে রেখেছে। আজ গভীর রাতে বলি দেবে এবং সেই নর রক্ত দিয়ে রংকিনী মাতার পূজা করবে। আজ তান্ত্রিকের মহা যজ্ঞ আছে। একশ আটটা নরবলি সম্পূর্ণ হবে নাকি। কিছুদিন ধরে গ্রামে বাল বাচ্চারা কেউই নাকি বাইরে বের হচ্ছে না পাছে তাদের ভুলিয়ে শাল পিয়ালের জঙ্গলে ধরে নিয়ে যায়।

এবারে তাহলে কার কপালে এমন দুর্ভোগ লেখা আছে? কার ধড়ে দেবী রংকিনীর খড়্গের কোপ পড়বে?

সখী মেঘমালা শুনেছিল সে কথা বলতেই রাজকন্যার দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করল মুহূর্ত্যের ভিতরে। আর্দ্র স্বরে বলল, চুপ কর সখী, চুপ কর, আমি আর নিতে পারছি না। থর থর করে কাঁপতে লাগল চিত্রলেখা। তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে চিবুক গন্ডদেশ ভিজে গেল। মেঘমালা চিত্রার্পিতের ন্যায় রাজকন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে বুঝতে পারছে না রাজকন্যার এত বিগলিত হওয়ার কী কারণ ঘটল।
কাঁদতে কাঁদতে চিত্রলেখা বলল, তুইও তো থাকবি আমার সঙ্গে।

ও মা, রক্ষা করো। আমি কিছুতেই এই ঘোর অমাবস্যায় নদীর পাড়ে যাবো না। সন্ধ্যের পরে মেয়ে মানুষের আজ বাইরে বের হতে নেই।

জানি আর সেই জন্যেই তো আমি সেখানে যেতে চাইছি।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, কেন বলতো?

আমার বড়ো বিপদ সখী। আমাকে আজ সেখানে যেতেই হবে।

চিত্রলেখার গলার স্বর সহসা রুদ্ধ হয়ে আসে অশ্রু বাষ্পে।

বিপদ?

সখী মেঘমালার ভ্রু-জোড়া সংকুচিত হল। সেই সঙ্গে শুরু হল হৃদ কম্পন। রাজকন্যা কোন বিপদের কথা বলছে কে জানে। যাতে তাকে এই ঘোর অমাবস্যার আগের রাতেই সকলের অগোচরে নদীর পাড়ে যেতে হবে। মাত্র এক মাস হল সে মাতুলালয়ে গিয়েছিল। তার ভিতরে কী এমন ঘটতে পারে যে রাজকন্যার এমন মনের অবস্থা। কেমন যেন পাগল পাগল দেখাচ্ছে। ভয়ানক উদবিগ্ন, এক বিন্দু স্থির থাকতে পারছে না। অস্থির পায়ে ঘরের ভিতরে পাক খাচ্ছে। নিজের মনে কথা বলছে আর মাথা নাড়ছে। কী কারণে সে এতো উতলা হয়ে পড়েছে।

মেঘমালা প্রচন্ড বুদ্ধিমতী। চিত্রলেখা কিছু বলার আগেই সে অনেক কথা বুঝে নিতে পারে। অথচ আজকের ব্যাপারটা তার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। মহারাজের একমাত্র আদরের দুলালী সে যেমন জেদী তেমনি অভিমানিনী। রাণিমার নয়নের মণি। রাজা কিম্বা রাণি তাকে এক মুহূর্ত্য না দেখে থাকতে পারেন না। কী এমন ঘটল এই কয়েক দিনে যে তার ভিতরে এতো অস্থিরতার জন্ম হল।

এরপরে রাজকন্যা চিত্রলেখা যে কথা শোনালো মেঘমালাকে তাতে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। অবাক নয়নে চেয়ে আছে চিত্রলেখার চোখের দিকে। ভয়শূন্য এবং অনমনীয় দৃষ্টি চিত্রলেখার।

এ কী ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে রাজকন্যা!

(ক্রমশ)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
410 Gone

410 Gone


openresty