রিনি গঙ্গোপাধ্যায়-এর গল্প
কিছু অসংলগ্ন সংলাপ
একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। না, মানে ঘটতে চলেছে; মানে ঘটে গেছে…না, এখনও ঠিক ঘটেনি; ঘটবে।
সামনে বসে থাকা কনস্টেবলের ভুরু কুঁচকে উঠেছে ইতিমধ্যেই। কোনো কথা না বলে সে আগন্তুকের দিকে একগ্লাস জল এগিয়ে দেয়।
আগন্তুক মধ্য বয়স্ক লোকটি গ্লাসের দিকে চমকে তাকায়। তারপর গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে গ্লাসে কোনো বুদবুদ উঠছে কি না!
কনস্টেবল একটুক্ষণ অপেক্ষা করে গলা ঝাঁকারি দেয়।
আগন্তুক আরো খানিকটা চমকে বিস্ফারিত চোখে কনস্টেবল কে দেখে। তারপর হঠাৎই চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রায় দৌড়ে পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।
কিন্তু কনস্টেবলের চোখের ইশারায় গার্ড তাকে ধরে ফেলে। টেনে হিঁচড়ে তার ভয়ার্ত চোখ দুটিতে কানায় কানায় রহস্যের আভাস পেয়ে তাকে আবার জোর করে কনস্টেবলের সামনে বসানো হয়। কনস্টেবল প্রায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের মতো টেবিলে মোটা লাঠি দিয়ে আওয়াজ করে। লাঠির আওয়াজে ভয় পেয়ে সে এবার আড়ষ্ট হয়ে বসে।
কি ব্যাপার বলুন তো? ঝেড়ে কাশুন। আমাদের সময় কম।
আগন্তুককে যেন বোবায় ধরেছে। সে গঙিয়ে গঙিয়ে কি বলে কনস্টেবল বুঝতে পারে না।
কনস্টেবল সামনে ঝুঁকে বলে,কে আত্মহত্যা করেছে ঠিক করে বলুন।বডি কোথায়? আপনার বাড়িতে?সদর হাসপাতাল থেকে তো আজ এরকম কোনো রিপোর্ট আসেনি।
না, মানে এখানে তো নয়!
এখানে নয়,তাহলে কোথায়? আপনার বাড়ি কোথায়?
আমার বাড়ি… বলে আগন্তুক আবারও গভীর চিন্তায় ডুবে যায়।
কনস্টেবল এবার ভালো করে দেখে আগন্তুক কে। দেখে তো ভদ্রলোক ই মনে হয়। গালে অবশ্য কয়েকদিনের না কাটা দাড়ি। শার্ট প্যান্টটাও পরিস্কার নয়। তবে কি পাগল! বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে! কনস্টেবল আবার প্রশ্ন করে, কি মশাই, নিজের বাড়ি কোথায় বলতে পারছেন না?
আগন্তুক একদৃষ্টে টেবিলে রাখা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রশ্ন শুনে আবারও চমকে ওঠে। নিন, জলটা খান। কনস্টেবল জলের গ্লাস টা আবার এগিয়ে দেয়।
নাঃ, নাঃ, আগন্তুক চেয়ারের মধ্যেই কেমন গুটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
কনস্টেবল এবার নিশ্চিত হয়ে যায় আগন্তুক আসলে পাগল। আজকের খোরাকি তবে পাগল। আর কিছুটা পরেই একে একে বড় অফিসার, ছোটো অফিসার টিফিন করতে জড়ো হবেন। আড্ডাটা আজ জমবে ভালো। এমনিতেই এই গন্ডগ্রামের থানায় তেমন একটা কাজের চাপ নেই। দু একটা রেপ বা মার্ডার কেস হলেও এফ আই আর করা ছাড়া তাদের খুব বেশি কাজ থাকে না। বাকিটা পার্টির ছেলেরাই সামলে নেয়। শুধু এই নতুন অফিসার আসাতে এখন নিয়মিত থানায় আসতে হচ্ছে এই যা! নইলে আগে তো সপ্তাহে এক-দুদিন এসে সারা সপ্তাহের সই করে দিলেই চলতো।যাই হোক, খানিকটা মজা করে খেলিয়ে দেখার জন্য কনস্টেবল উত্তর পাবে না জেনেও জিজ্ঞেস করে, আপনার নাম কি? কোথায় থাকেন?
আমি, আমি একটা রিপোর্ট লেখাতে এসেছি।
সে তো বুঝলাম। কিসের রিপোর্ট?
সুইসাইড..
কে করেছে? আপনার বাড়ির কেউ?
না ,মানে.. হঠাৎ আগন্তুক বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে চারপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে ওঠে… ষড়যন্ত্র,সব ষড়যন্ত্র। আসলে মার্ডার। আমি জানি মার্ডার।
রগড় করার নেশায় কনস্টেবল এবার বলে, তা কে কাকে মার্ডার করল!
কে করল! জানি না তো! আপনি ধরবেন তাকে? কঠিন শাস্তি হওয়া চাই। কঠিন শাস্তি। বলে আগন্তুক নিজেই হাত মুঠো পাকাতে থাকে।
কে মার্ডার হয়েছে? ও মশাই?
জানেন ও খুব সরল, নিষ্পাপ। ওকে দেখলেই যে কেউ বলবে ও এমন করতে পারেই না! ঠিক জানেন তো ওই যে অভিনয় করে রাজকিরণ না কি নাম, তার মতো!
রাজকিরণ! সে তো বহু কাল আগে অভিনয় করতো!তাকে এখন কোথায় পেলেন?
আগন্তুক ঝোঁকের মাথায় কি বলতে গিয়ে থেমে যায়। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে, বহুকাল, বহুকাল আগে…
কি বলছেন? ও মশাই?
আগন্তুক এবার তেড়েফুঁড়ে বলে ওঠে, অথচ দেখুন জামাইবাবু সেই তখন থেকে ডায়রি ঘেঁটেই চলেছে! বলছে ডায়রিতে কিছু পাওয়া যাবে নিশ্চিত।
তা কিছু পেলেন?
এ্যাঁ, কি পাবেন? আগন্তুকের দৃষ্টি আবার ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
ওই যে, আপনার জামাইবাবু খুঁজছিলেন, পেলেন?
না, না ওরা যতই বলুক। আমি জানি ওর সঙ্গে কোনো মেয়ে-ফেয়ের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ও,ও তো বড্ড লাজুক!
কে লাজুক? সে আপনার কে হয়?
সে আমার কে হয়! আগন্তুক যেন কিছু মনে করার চেষ্টা করে। তারপর বলে, জ্যাঠা খুব কাঁদছিল জানেন! জ্যাঠা বারবার বলছিল, কি করলি বাবু!কি করলি!
আপনার জ্যাঠা! জ্যাঠার ছেলে সুইসাইড করেছে?
ঠিক আপনার মতো জানেন! আমার জ্যাঠা! এরকম জামা-প্যান্ট; গটগট করে অফিস যায়! কিন্তু কি ভালো!কি নরম!
আপনার জ্যাঠা পুলিশে চাকরি করেন? কনস্টেবল এবার একটু নড়েচড়ে বসে। কি হয়েছিল খুলে বলুন তো? কোন থানায় আছেন আপনার জ্যাঠা?
আগন্তুক খানিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। একবার গ্লাসের দিকে, একবার লাঠির দিকে তাকায়। পা দুটো ভাঁজ করে গুটিয়ে টেনে আনতে চায়।
কনস্টেবল অধৈর্য হয়ে পড়ে…কি হলো? উত্তর দিন?
আগন্তুক কেঁপে ওঠে। তোতলায়; বলে একটা রিপোর্ট লেখাতে… গলার স্বর ডুবে যায়।
কনস্টেবল বোঝে এ লোককে প্রশ্ন করে লাভ হবে না। তার থেকে নিজে যেটুকু বলে তা থেকেই কি হয়েছে বুঝতে হবে। কনস্টেবল চেয়ার ছেড়ে এসে এবার আগন্তুকের পিছনে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, আপনি রিপোর্ট লেখাবেন তো! আমি লিখব।আপনি বলুন।
আগন্তুক কে দেখে মনে হয় সে এবার খানিক ভরসা পেয়েছে। পা দুটো কিছুটা ছড়িয়ে সে ঈষৎ উজ্জ্বল চোখে কনস্টেবল কে দেখে। বলে, জানেন তো বড় জামাইবাবুও বলছিল, ও হয়তো এমন কিছু দেখে ফেলেছিল… তাই ও…
কনস্টেবল প্রশ্ন না করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়…
আগন্তুক আবারও এগিয়ে এসে ফিসফিস করে, ওরা খুব নোংরা তো! বাজে কথা বলে! থেমে গিয়ে চারপাশে আবারও একবার চোখ বোলায় আগন্তুক। তারপর চাপা গলায় বলে, জ্যাঠাইমা আর কাকাকে নিয়ে ওরা বলে না!
কি বলে?
ওই যে নোংরা কথা…আপনাকে বললাম না!
কনস্টেবল পরিস্কার বুঝতে পারে না। কিন্তু আর প্রশ্নও করে না।
আগন্তুক বলে, ওরা অনেক খুঁজল জানেন। কিন্তু পেল না। কিছুতেই পেল না।
কনস্টেবলের এবার বিষয়টা একটু গুলিয়ে যায়। সে মনে মনে আওড়ায়, এই লোকটির জ্যাঠার ছেলে সুইসাইড করেছে বলে এ রিপোর্ট লেখাতে এসেছে। এর জ্যাঠা খুব সম্ভবত পুলিশে চাকরি করে। তাহলে হারিয়ে গেল কে? কাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কনস্টেবল এবার একটু ঔৎসুক্য নিয়ে প্রশ্ন করে, আপনার বাড়ির লোক কেউ এসেছে আপনার সঙ্গে?
হ্যাঁ, এসেছে তো। ও সব সময় আমার সঙ্গে থাকে। সবসময়; কখনো আমাকে ছেড়ে যায় না।
কে তিনি? কোথায়? ডাকুন তাকে এখানে।
এই তো, এখানেই… আগন্তুক পিছন ফিরে ইশারা করে। ডাকে আয়, আয়, লজ্জা কি! আয়?
কনস্টেবল আগন্তুকের পিছনে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পান না। কোথায়? কে? আপনি কাকে ডাকছেন?
আগন্তুক বেশ খুশি খুশি মুখে বলে এই যে,ওর জন্যেই তো এখানে এসেছি।ও বললো, এখানে আপনারা আছেন। আপনারা ঠিক খুঁজে দিতে পারবেন।
মধ্য দিনের টাকফাটা রোদে চারপাশের ভিড় উপেক্ষা করে কনস্টেবলের পিঠ দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। ঘাবড়ে গিয়ে গ্লাসের জলটা নিজেই ঢকঢক করে খেতে থাকে।
আগন্তুক তাই দেখে প্রায় চিৎকার করে ওঠে… কনস্টেবলের হাত থেকে গ্লাস ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর কনস্টেবলকে জড়িয়ে ধরে হিসহিসিয়ে ওঠে,বাপী,আমি অ্যাসিড খেয়ে ফেলেছি। অ্যাসিড খেয়ে ফেলেছি।
কনস্টেবল বিষম খেয়ে তাড়াতাড়ি আগন্তুকের হাত ছাড়িয়ে ছিটকে সরে আসে। ওঘর থেকে বড়বাবু বেরিয়ে আসেন। গার্ড ও ছুটে আসে।
কনস্টেবল কোনোরকমে বড়বাবু কে সেলাম ঠুকে আগন্তুকের কথা ব্রিফ করে। আগন্তুক ততক্ষণে মাটিতে ছিটিয়ে থাকা জলে হাত বোলাতে থাকে।টুকরো হয়ে যাওয়া গ্লাসের কাঁচে তার আঙুল কেটে যায়। জলের রঙে রক্ত মিশে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। বড়বাবু নির্দেশ করায় গার্ড আগন্তুককে মেঝে থেকে ওঠাবার চেষ্টা করে। আগন্তুক বিড়বিড় করতে থাকে, বমি,বমি…. রক্ত বমি করছে… রক্ত বমি… শিগগির ঠান্ডা জল দে… হ্যাঁ হ্যাঁ, ফ্রিজের ঠান্ডা জল…বরফ… গার্ড বহু কষ্টে আগন্তককে টেনে তোলে; সামনে খাঁকি জামা দেখে আগন্তুক ছুটে যায় বড়বাবুর দিকে, খুঁজে দেবেন আপনি, খুঁজে দেবেন দয়া করে! ও বারবার জানতে চাইছে! আমিও খুঁজছি; হন্যে হয়ে খুঁজছি। কিন্তু পাচ্ছি না। কিছুতেই পাচ্ছি না।
বড়বাবু নিজের হাতটা আগন্তুকের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন, আপনি বসুন, বসুন। আপনার হাত কেটে গেছে। ওষুধ লাগানো প্রয়োজন। একটু শান্ত হয়ে বসুন।
একটা বিড়ি দেবেন! এমন অপ্রত্যাশিত চাওয়ায় কনস্টেবল বড়বাবুর দিকে তাকান। বড়বাবু নিজের পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে আগন্তুকের হাতে দেয়। আগন্তকের চোখ চকচক করে ওঠে, সিগারেট! আমি খেয়েছি আগে…সেই যে স্টেশনের লোকটা ফেলে দিয়ে ট্রেনে করে চলে গেল…আমি কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। তারপর জামাইবাবু খুব মারল…. এখানে, এখানে… আগন্তুক হাত দিয়ে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গা দেখাতে থাকে…
বড়বাবুও বোঝেন আগন্তকের কোনো মেন্টাল প্রবলেম আছে। লোকটিকে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। জিজ্ঞাসা করেন, কোন স্টেশন?
এ্যাঁ! আগন্তুক বড়বাবুর প্রশ্নটি আওড়ায়। তারপর বলে নাগপুর। না, ভেলোর; না শিয়ালদা; হ্যাঁ শিয়ালদা, না মাদ্রাজ! পরপর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের স্টেশনের নাম বলতে থাকে আগন্তক। নিজের মন হাতড়াতে থাকে।
বড়বাবু বলেন, আপনি এসব জায়গায় গেছেন?
আগন্তুক এবার ভীষণ উৎসাহ নিয়ে উত্তর দেয়, হ্যাঁ,গেছি তো। অনেক জায়গায় খুঁজেছি; ও যেখানে যেখানে বলেছে সব জায়গায় খুঁজেছি… কিন্তু পাইনি জানেন!
কনস্টেবল আবার একবার আগন্তকের পিছনের শূন্যতার দিকে আড়চোখে তাকায়।
আগন্তুক বলতে থাকে, আমার তো টাকা নেই ওর মতো। ও টিকিট কেটে আরামে যায়! আর আমি চুপিচুপি… আগন্তুক লুকিয়ে থাকার ইশারা করে।
কাকে খুঁজছেন আপনি? কে হারিয়ে গেছে?
নাঃ, কেউ হারিয়ে যায়নি তো!
তাহলে? বড়বাবু আগন্তুককে দুহাতে ধরে থাকে।
তাহলে! ওই যে ও বলল খুঁজতে! সেই কবে থেকে… দাঁড়ান, ১৯৯৭,৭ জুন।
কি হয়েছিল সেদিন?
সবাই খুব কাঁদছিল। ও আর আমি দেখছিলাম।
তারপর?
তারপর সবাই খুব খুঁজতে লাগল!
কি খুঁজতে লাগল?
কেন খুঁজতে লাগল।
বড়বাবু এবার খানিকটা বোঝে। জিজ্ঞেস করে খুঁজে পেয়েছিল?
নাঃ, আগন্তুক যেন গভীর নিদ্রা ঠেলে উত্তর দেয়।
তারপর?
তারপর ও বলল খুঁজতে!
ও কে?
ওই যে চলে গেল! আগন্তুক ঘোরের মধ্যে ডুবে যায় আস্তে আস্তে…
ও কি খুঁজতে বলল?
কেন কে খুঁজতে বলল… আগন্তুকের মাথা ক্রমশ নিচের দিকে নামতে থাকে…
ও জানতো না কেন!
আগন্তুক ফিসফিস করে বলে, জানি না… তারপর শুধু ঠোঁট নড়তে দেখা যায়। আগন্তুক বলতে থাকে কেন…. কেন… কেন… ও জানে না… জানে না…