মেরু-নিশীথের নাবিকেরা <br /> দশম পর্ব <br /> পার্থজিৎ চন্দ

মেরু-নিশীথের নাবিকেরা
দশম পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ

প্রথম অংশ

স্বপ্ন…

দিবাস্বপ্ন…

খোয়াব…

মুক্ত ‘সংযুক্ত-চিন্তাপদ্ধতি’…

নির্দিষ্ট অভিমুখে চালিত চিন্তা…

নির্দিষ্ট অভিমুখ ধাবিত অনুভূতি…

পর পর এই শব্দগুলি সাজিয়ে তাকিয়ে ছিলাম বহুক্ষণ; আরও কিছু শব্দ যোগ করা যায় এখানে… ফ্যান্টাসি, হ্যালুসিনেশন ইত্যাদি… কিন্তু তাদের সঙ্গে স্বপ্ন ও প্রায়-স্বপ্নের কাছাকাছি অবস্থান করা বিষয়ের খুব সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। স্বপ্ন ও তথাকথিত বাস্তব একে অপরের পেটের ভেতর ঢুকে যেতে যেতে বাস্তবতা ও স্বপ্নের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ মুছে দেয়। মানুষের ঘুম ও জাগরণের মধ্যে যে চিনের প্রাচীরের মতো কোনও বিষয় জেগে নেই; মানুষের ঘুম যে আসলে এই হিমশৈলের ভেসে থাকা চূড়া মাত্র… এবং জাগরণ’ও তাই… স্বপ্ন ও ‘বাস্তবতার’র দিকে তাকিয়ে সে বিষয়টি স্বচ্ছ হয়ে আসে। মানুষ তার জাগরণ, তথাকথিত সচেতন অবস্থা থেকে প্রবেশ করে স্বপ্নের মধ্যে… ক্রিস্টোফার কডওয়েলের মতে সেখানে আদানপ্রদান চলতে থাকে। ‘রিয়েলিটি’র সঙ্গে খুব গোপন, অথচ গূঢ় আদানপ্রদান।
রিয়েলিটির সঙ্গে ঘুমে-জাগরণে-খোয়াবে-দিবস্বপ্নে সত্তা’র এই সাংঘর্ষিক সম্পর্ক’ই কি মানুষ’কে বাঁচিয়ে রাখে? শিল্পে বাঁচিয়ে রাখে এবং শিল্পে বাঁচিয়ে রাখে বলেই আসলে রিয়েলিটি নামক অবস্থায় মানুষের বেঁচে থাকা সম্পন্ন হয়। অথবা স্বপ্নে বেঁচে থাকে বলেই মানুষের রিয়েলিটি মানুষের বেঁচে থাকা’কে সমর্থন করে।
মানুষের শিল্পে এই স্বপ্ন অতি-গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, বলাইবাহুল্য। এখানে যে স্বপ্নের কথা বলা হচ্ছে সে ‘স্বপ্ন’ মানুষের ইচ্ছাপূরণের উদ্দেশ্যে সচেতনভাবে নেওয়া শপথ বা পথের সমনাম নয়; এ স্বপ্ন মানুষের নিদ্রায় এবং কখনও কখনও ‘নিদ্রাহীনতার’ মাঝে থাকা একটি অনুভুতি।
কিন্তু যে মানুষ ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখেন ও যিনি জাগরণে স্বপ্নের ‘বাস্তবতা’ নির্মাণ করেন দু’জনে কি একই ব্যক্তি? অথবা, দু’জনের স্বপ্ন-দেখার পদ্ধতি কি এক? হয়তো স্বপ্ন-দিবাস্বপ্ন-খোয়াব ইত্যাদি নিয়ে স্নায়ু-দর্শন ও ব্যাখ্যার সমাপ্তি কোনও দিনই হবে না। কিন্তু ‘দিবাস্বপ্ন’ আরও অনেক বেশি জটিল, এমন মনে হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। খুব উল্লেখ্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুমের ভেতর যে স্বপ্ন আসে তাতে মানুষের সচেতন ভূমিকা থাকে না বলেই ধরে নেওয়া হয়। উল্লেখ্য ব্যতিক্রম বলার কারণ, ইচ্ছাধীন স্বপ্ন দেখার বেশ কিছু ‘কেস’ লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে পৃথিবীতে। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছা মতো স্বপ্ন দেখছে অথবা সিকোয়েন্স নির্মাণ্ করতে সমর্থ হচ্ছে।
কিন্তু যে স্বপ্ন ‘দিবাস্বপ্ন’ সেখানে ব্যক্তির ভূমিকা মুখ্য; সেখানে সে স্বপ্ন’কে আনয়ন করছে। এখানে একবার কডওয়েলের পর্যবেক্ষণটি দেখে নেওয়া যাক,
The day-dream is characteristically a more ‘civilised’ form of phantasy. It is the expression of man as an individual plastic in reality, just as the dream is the expression of reality plastic in the man. One expresses man’s power over Nature derived from altering himself: the other man’s power over himself by altering Nature. In the day-dream, man experiments with adapting himself to reality; in the dream, with adapting reality to himself; both these characteristics are carried over into their respective arts. (Illusion and Reality / A Study of the Sources of Poetry – Christopher Caudwell)
দিবাস্বপ্ন’কে কডওয়েল ফ্যান্টাসির থেকে কিছুটা বেশি ‘সিভিলাইজড’ ফর্ম হিসাবে উল্লেখ করছেন। ঘুমের ভেতর স্বপ্নের ক্ষেত্রে মানুষ ‘রিয়েলিটি’কে ‘অ্যডাপ্ট; করতে চায়; কিন্তু জাগরিত মানুষ দিবাস্বপ্নের ক্ষেত্রে নিজেকে ‘রিয়েলিটি’র মধ্যে (হয়তো কিছুটা নতুন ভূমিকায়) প্রোথিত করতে চায়। একবার সে নিজেকে দুমড়েমুচড়ে তার ‘পৃথিবী’কে ছুঁতে চায়, আর একবার সে নিজেকে ‘শেষ’ করে দিয়ে সাবমেরিনের গতি’তে তার চারপাশের পৃথিবী’র ভেতর প্রবেশ করতে চায়।
শুধু তাই নয়, কডওয়েল আরেকটি মারাত্মক কথাও বলেছেন; যার সামনে আমাদের দীর্ঘ দীর্ঘ দিন বিমূঢ় হয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর হয়তো কিছুই করার থাকে না। তিনি বলছেন, ‘It is the expression of man as an individual plastic in reality, just as the dream is the expression of reality plastic in the man.’
ব্যক্তিমানুষ ও রিয়েলিটির এই ‘আপেক্ষিক’ সান্দ্র-অবস্থা (আপেক্ষিক, কারণ ভূমিকা বদল হওয়াই নিয়তি দুটি ক্ষেত্রে) চির-কুহকের; চির-রহস্যের।
ডে-ড্রিম বা দিবাস্বপ্ন’কে কডওয়েল ‘লেস-প্রিমিটিভ’ এবং ‘মোর-অর্ডারলি’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতার ক্ষেত্রে কি বিষয়টি বিপরীত প্রবণতা বহন করেছে? যে প্রত্ন-জগৎ থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে ‘ডে-ড্রিম’, সে নিরাপদ দূরত্ব’কে কি ভেঙে দিয়েছিলেন জীবনানন্দ? এবং বিষয়টি শুধুমাত্র ওই ভেঙে দেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আরও একটি মাত্রা যুক্ত হয়ে রয়েছে সেখানে- জীবনানন্দের মতো এক ভারী কৃষ্ণতারকা কি ‘ডে-ড্রিম’-এর মধ্যে দিয়ে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে দুমড়েমুচড়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ‘স্বপ্ন’ ও ‘বাস্তবের’ দ্বিমেরু বাস্তবতার বাইরেও রয়ে গেছে আরেকটি বাস্তবতা!
জীবনানন্দ তাঁর ডে-ড্রিম’গুলিকে প্রচলিত ধারণা ও প্রথা ভেঙে আরও বেশি ‘প্রিমিটিভ’ (প্রত্ন) করে তুলেছিলেন। কী যেন এক অজ্ঞাত ‘সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে’ তিনি ডে-ড্রিমের শরীর থেকে ‘অর্ডার’-এর সমস্ত সংযোগগুলিকে ছিন্ন করতে করতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ঘুমের ভেতর স্বপ্নের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিষয়টির থেকে এ পদ্ধতি অনেক বেশি সন্ত্রাসের ও রক্তপাতের।
এই প্রত্ন-সন্ত্রাসের খেলা দেখতে পাওয়া যায় ‘হাওয়ার রাত’ কবিতাটিতে; ‘আট বছর আগের একদিন’-এ যিনি ‘চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা’র কথা লিখবেন তিনিই ‘হাওয়ার রাত’-এ লিখছেন মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো ফুলে ওঠা মশারির কথা। ‘মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো’- এই চারটি শব্দের মধ্যে গর্ভিণী নারীর ইশারা রয়েছে। কিন্তু ড্রিম, ডে-ড্রিম ও জাগরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচিলটিকে ভেঙে দিয়ে রহস্যময় এক জগৎ নির্মাণ করলেন জীবনানন্দ। তিনি লিখলেন, ‘এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার – আধো ঘুমের ভিতর হয়তো – / মাথার উপরে মশারি নেই আমার,।’
যদিও ‘আধো ঘুমের ভিতর’-এর পর তিনি ‘হয়তো’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তবু এখানে নিঃসংশয়ে বলা যায়, আসলে ‘হাওয়ার রাত’ একটি ডে-ড্রিম। এখানে ‘হয়তো’ শব্দটি পোয়েটিক লাইসেন্স নিয়ে ‘অনিবার্য’কে চিহ্নিত করেছে। এবং যারা কবিতায় শব্দের পুনরাবৃত্তি’কে আক্রমণ করেন তারা একবার লক্ষ করতে পারেন ‘এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার’ এবং ‘মাথার উপরে মশারি নেই আমার’ প্রয়োগের দিকে। ‘স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো’ মশারির ওড়া পর্যন্ত শব্দ প্রয়োগের মধ্যে, সৃষ্ট ইমেজেসের মধ্যে জীবনের নীল রঙ খেলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এরপর জীবনানন্দ তাঁর ডে-ড্রিমের মধ্যে আনয়ন করবেন এক আশ্চর্য মৃত্যুর জগত’কে; যা মৃত, অথচ মৃত নয়। তাকে জীবিত হিসাবেও গণ্য করা যায়। মৃত নক্ষত্রেরা জেগে উঠেছিল- এর মধ্যে সূক্ষ্ম ইশারা রয়েছে, সে জগৎ হয়তো মৃত নয়। জেগে ওঠার ক্রিয়া তাকে জীবন্ত করছে। অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো ঝলমল করা নক্ষত্রের মধ্যেও রয়েছে জীবনের ইশারা।
এবং এখানে আবার জীবনানন্দের অকল্পনীয় নির্মাণ ও গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে যাবার অমোঘ চিহ্ন- পর পর দুটি পঙক্তি’তে তিনি ‘মতো’ ব্যবহার করে ক্যানভাস নির্মাণ করলেন; ‘অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো’-র পরের পঙক্তি’তে তিনি লিখছেন, ‘জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ।’
এরপরের অংশে এসে দুরূহ একটি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন জীবনানন্দ; এ প্রশ্ন হয়তো আবহমানকালের। মাতৃপ্রশ্ন। কে কাকে ধারণ করে থাকে আসলে? আধার-আধেয় যা কিছু তা কি আপেক্ষিক? নক্ষত্রেরা মরে গেছে আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে; কিন্তু ‘কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে’ তারা। প্রতিটি নক্ষত্রের মৃত্যুর সঙ্গে কি মৃত্যু ঘটে ছিল এক একটি আকাশের? অথবা, প্রতিটি নক্ষত্রের ব্যক্তিগত আকাশের? যে আকাশ আমাদের কাছে ‘একক’ বলে মনে হয় তাও কি আসলে খণ্ড খণ্ড? প্রতিটি নক্ষত্র তার নিজস্ব আকাশ নিয়ে অবস্থান করে হয়তো।
তবু কি মৃত্যুর থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে ‘জীবন’? ডে-ড্রিমের ভেতর জীবনানন্দ দেখতে পাচ্ছেন সীমানার কুয়াশায় কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা এশিরিয়ার, মিশরের, বিদিশার মরে যাওয়া সুন্দরীদের- তিনটি সম্ভাবনার কথা মনে এসেছে তাঁর;
‘মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
জীবনের গভীর জন্য প্রকাশ করবার জন্য?
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?’
-ডে-ড্রিমের ভেতর যে অর্ডারের কথা বলেছিলেন কডওয়েল জীবনানন্দের ক্ষেত্রে তার ঠিক বিপরীত প্রবণতা লক্ষ করা যায়; সিংহের হুংকার, অজস্র জেব্রা, সবুজ ঘাসের গন্ধ, মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জন, অন্ধকারের সজীব রোমশ উচ্ছ্বাস- সব কিছু মিলিয়ে প্রিমিটিভ জগৎ নির্মাণ করেছিলেন জীবনানন্দ।
‘বনলতা সেন’-এর আরেকটি কবিতা, ‘অন্ধকার’ জীবনানন্দের দিবাস্বপ্ন দেখার নিজস্ব পদ্ধতির প্রকাশ। ‘গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দ জেগে উঠলাম আমার;’ পাঠ-করবার সময়ে পাঠকের মনে হবে অন্ধকার ঘুম থেকে জেগে উঠছেন কবি। কিন্তু একদিন আবিষ্কার করা যাবে, সে জাগরণ অন্ধকারের ঘুম থেকে জেগে ওঠা। এর পর কি তিনি মেতে উঠেছিলেন সেই আদিম, প্রত্ন, নিজস্ব ডে-ড্রিম নিয়ে? দিবাস্বপ্নের থেকে সমস্ত নঞর্থক ধারণা শুষে নিয়ে তিনি অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছিলেন। শূকরের প্রসববেদনার আড়ম্বরময় পৃথিবীর থেকে তিনি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন দীপটিকে। কিন্তু কেন এখানে ডে-ড্রিমিং-এর কথা বারবার মনে হচ্ছে? হচ্ছে, কারণ কবি নির্দিষ্ট করে বলছেন, ‘কোনোদিন আর জাগব না জেনে।’ এই জানার পরেও তাঁর জেগে ওঠা এবং চিন্তনপদ্ধতির মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ডে-ড্রিমিং-এর ইশারা রয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর কাছে চারপাশের পৃথিবী অতিচেনা ও অচেনা। এ তীব্র কন্ট্রাস্ট বহন করে চলেছেন তিনি। তিনি জানেন, ‘হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে / রয়েছে যে অগাধ ঘুম / সে আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই।’
এমনকি তিনি এও জানেন যে ‘তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও-।’ রক্ত-ক্লেদময় পৃথিবীর বিভৎসতাকে তুলে ধরা এবং মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে বুঝতে পারা- এ দুই-এর মধ্যে ডে-ড্রিম ও পূর্ণ-জাগরণের পদ্ধতি রয়েছে। জীবনের বৃহত্তর সত্যের কাছে এসে যে ম্লান হয়ে যায় রক্তপাতময় ‘সারভাইভ্যাল’ পদ্ধতি সে দিকে তাকিয়ে ঘৃণায়, বেদনায় ও আক্রোশে ভরে যাওয়াই স্বাভাবিক। মর-পৃথিবীর উৎসব ও উৎসবের ইনফার্নো থেকে মুখ ফিরিয়ে ‘অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে / আবার ঘুমোতে’ চেয়েছেন জীবনানন্দ।
জীবনানন্দ কি তথাকথিত ‘পলায়নবাদী’ শব্দটির দিকে চেয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠেছিলেন? পরপর চারটি পঙক্তি’র কাছে ফিরে যাওয়া যাক, ‘কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি। / হে নর, হে নারী, / তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন; / আমি অন্য কোন নক্ষত্রের জীব নই।’ একই সঙ্গে দুটি পরস্পরবিরোধী ফ্যাক্ট জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি। একই সঙ্গে ঘোষণা করছেন, তিনি ‘তোমাদের’ পৃথিবীকে চেনেননি এবং তিনি অন্য কোনও নক্ষত্রের জীব নন।
এই পদ্ধতির ভিতর সচেতনভাবে স্বপ্ন দেখার গুরুত্ব কি অপরিসীম? গভীর ঘুমের আস্বাদে লালিত আত্মার জেগে ওঠা ও আর জেগে না-ওঠার সুতীব্র ইচ্ছার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে ওই ‘স্বপ্ন’; জাগরিত অবস্থায় দেখে চলা স্বপ্ন। যে স্বপ্নের ভেতর থেকে জাগরণের লক্ষণ বিলুপ্ত হয়েছে, অথচ যে স্বপ্নকে আনয়ন করছেন কবি। করছেন, কারণ সে স্বপ্ন ব্যক্তি ও পারিপার্শ্বিক- উভয়কে একে অপরের সাপেক্ষে দুমড়মুচড়ে দিয়ে একটি স্পেস নির্মাণ করতে সক্ষম হবে। যেখানে অবস্থান করবে শিল্পের বৃহত্তর সৌন্দর্য ও রহস্য।
কবিতাটি বারংবার পাঠ করার পর আরেক অস্বস্তি গ্রাস করে, ডে-ড্রিমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘অর্ডার’ ও ‘ডিজঅর্ডার’-এর প্রশ্নে। কডওয়েল ব্যক্তি-মানুষের দ্বারা আনয়ন করা ডে-ড্রিমের ভেতর অর্ডারের কথা বলেছেন। নির্মাণের ক্ষেত্রে, জীবনানন্দের কবিতায় অন্তত তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। ‘অন্ধকার’ কবিতাটির শুরু হচ্ছে ‘গভীর অন্ধকার’ শব্দ-দুটি দিয়ে। শেষের দিকে এসে জীবনানন্দের হাতে সে অন্ধকার রূপান্তরিত হচ্ছে ‘অরব’ অন্ধকারে। মৃত্যুর ছায়া গাঢ় থেকে গাঢ়তর হবার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো এই রূপান্তর। তাঁর নির্মাণের আরেকটি অসামান্য নিদর্শনের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়।
বৈতরণী ও কীর্তিনাশা- শব্দ দুটির মধ্যে রয়েছে মৃত্যু ও অবলুপ্তির ইশারা। কবিতাটির শুরুতে কবির মনে সংশয় ছিল; পাণ্ডুর চাঁদ তার অর্ধেক ছায়া প্রকৃতই গুটিয়ে নিয়েছে কি না। সে কারণেই ‘যেন’ শব্দটি ব্যবহার করলেন জীবনানন্দ। মৃত্যুর (বৈতরণী) দুয়ার অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি’র কীর্তি-সমূহ কি কালের নিয়মে ধূসর থেকে ধূসরতর হতে থাকে?
কিন্তু শেষের দিকে সে সংশয় আর নেই; কবির নিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে- ধানসিড়ি নদীর ধারে শুয়ে থাকা এবং কালের নীরব প্রবাহের সাপেক্ষে ব্যক্তির কীর্তি-সমূহ নশ্বর। পাণ্ডুর চাঁদ এখানে এসে নির্জন হয়েছে; সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি বিশেষণ, ‘বিমিশ্র’। জীবনানন্দ সেই কবি, যিনি ডে-ড্রিমিং-এর ভেতর সাধারণ প্রবণতা ভেঙে ফেলে প্রত্ন, আদিম, চিন্তনপদ্ধতির ‘ডিজঅর্ডার’ তৈরি করেন। অথচ কবিতার শরীরে ছড়িয়ে থাকা যে আপাত-আলুলায়িত ভঙ্গি তার ভেতর যে কী পরিমান ঐশ্বরিক ‘অর্ডার’ বুনে দিয়ে গেছেন তা আবিষ্কার করবার জন্য তাঁর কবিতার কাছে দিনের পর দিন বসে থাকতে হয়। হয়তো একটি শব্দ… একটি মাত্র শব্দ… সেখান থেকেই শুরু হতে পারে বিস্ফোরণ।

(ক্রমশ)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS Wordpress (0)

demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes