মলয়ালম গল্প <br /> শয়তানের বাণী <br />  ই সন্তোষ কুমার <br /> অনুবাদক- তৃষ্ণা বসাক

মলয়ালম গল্প
শয়তানের বাণী
ই সন্তোষ কুমার
অনুবাদক- তৃষ্ণা বসাক

ই সন্তোষ কুমার মালয়ালম ভাষার এই প্রজন্মের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য লেখক। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা পনেরোর বেশি। সেরা গল্প সংগ্রহের জন্যে এবং উপন্যাস অন্ধাকরানঝি –র জন্যে দুবার পেয়েছেন কেরালা সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার যথাক্রমে ২০০৬ আর ২০১২ সালে। এই উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ- আইল্যান্ড অফ লস্ট শ্যাডোজ ২০১৫ সালের ক্রসওয়ার্ড পুরস্কারের জন্য বাছাই করা হয়েছিল। তাঁর দুটি গল্প থেকে মালয়ালম সিনেমা হয়েছে। তাঁর লেখা অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি, তামিল, হিন্দি এবং জার্মান ভাষায়। বাংলায় অনুবাদ এই প্রথম।

সাউথ সেন্ট্রাল স্টেশনে সকাল ৯ টা ২০ র শতাভরী এক্সপ্রেস। ঠিক সময়ে ছাড়ছে।

যখন আমি এতে লাফিয়ে উঠলাম, ট্রেন ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। তাড়াহুড়োয় রিজার্ভড সিট খুঁজে পেতে খানিকটা সময় লাগল। গাড়ির দীর্ঘ সারিতে রাস্তায় নড়াচড়ার জায়গা ছিল না।যে ক্যাবটা আমি নিয়েছিলাম, সেটা ফাঁদে আটকানো জন্তু যেভাবে পালাতে চেষ্টা করে সেইভাবে যাচ্ছিল।যতক্ষণে সে ঘোঁত ঘোঁত করে স্টেশনে পৌঁছল ততক্ষণে ট্রেনের শোকার্ত বাঁশি বেজে গিয়েছে। আমি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলেছিলাম আমাকে পার্কিং লট পার করে নামাতে, নেমেই আমি সুটকেস নিয়ে দৌড়তে শুরু করলাম। আর কয়েক সেকেন্ড হলেই ট্রেন ছেড়ে বেরিয়ে যেত।

যেন এই দৌড়ঝাঁপের সঙ্গে তাল মিলিয়েই বাকি কিছুই ঠিকঠাক নেই। যে কোচে উঠে পড়েছি সেটা আমার কোচ নয়। টিকিট পরীক্ষক আমাকে সিট থেকে, কোচ থেকে চলে যেতে বললেন ‘বার্থ ৩৬ তো ঠিক আছে। কিন্তু কোচ এটা না। প্লিজ এস সিক্স-এ চলে যান।’ অগত্যা দোদুল্যমান ভেস্টিবিউল দিয়ে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে পরের কোচে। আপার বার্থে ব্যাগটা তুলতে গিয়ে হাত ফসকে লোয়ার বার্থে বসা ভদ্রলোকের ওপর পড়ল। ভাগ্য ভালো বলতে হবে ভদ্রলোক চেঁচালেন না, শুধু কটমট করে তাকালেন।

সিটে ধপ করে বসে চোখ বুজে সকালটা ভাবার চেষ্টা করলাম। খুব অল্পসময়ের মধ্যে পরিকল্পিত এই যাত্রা। খবরটা এসেছে জাস্ট কাল সন্ধেয়। ট্রাভেল এজেন্সির পরিচিত একজন টিকিট বুক করে দিয়েছে।সকালে ব্যাগ গুছিয়েছি। সব কাগজপত্র নিয়েছি তো? সব জরুরি কাগজ ছাড়া ওখানে গিয়ে কোন লাভ নেই। এই সব তাড়াহুড়ো, দৌড়ঝাঁপ সব ফালতুই হচ্ছে ভেবে আমার অস্থির লাগছিল। সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে আমি চোখ খুললাম।

আমার উল্টোদিকে বসা তরুণটি আমার দিকে চেয়ে হাসছিল। এ কে? আমি কি একে আগে দেখেছি?আমি মনে করতে পারলাম না। তার পরনে দাগহীন সাদা পোশাক, লম্বা হাতার কলার ছাড়া কুর্তা আর লাট খাওয়া পাজামা। চওড়া কপাল, জ্বলজ্বলে চোখ, ছোট ছোট করে কাটা চুল, বুদ্ধের মতো বড় বড় কানে রুপোর রিং। কালো রঙ, যোগীর মতো পেশীবহুল চেহারা। বছর ৩৫ বয়স হবে। চোখ দুটোর মধ্যে যেন সম্মোহন আছে।

‘আপনি মনে হচ্ছে খুব তাড়ায় আছেন। কোথায় যাবেন?’
আমি আমার গন্তব্য বললাম।
‘বাহ। আমিও সেখানেই যাচ্ছি’ তিনি হেসে বললেন
যদি ট্রেন ঠিকঠাক যায়, তাহলে পৌঁছতে পৌঁছতে কাল সন্ধে। একটা কথা বলার সঙ্গী পেলে তো ভালই।
‘আপনার নাম কী?’ আমি জিগ্যেস করি।
‘কুমার’ তিনি বললেন ‘পুরো নাম কুমার সাধু। আপনি আমাকে সাধু বলে ডাকতে পারেন’
‘আপনি একজন সন্ন্যাসী?’ আমি জিগ্যেস করি, কারণ নামটা একটু অদ্ভুত লাগে।
‘শুধু নামেই’ তিনি হাসলেন ‘তবে ভবিষ্যতে হব কিনা বলতে পারছি না’
তিনি আমার নাম জানতে চাইলেন না, আমিও বললাম না।
‘মনে হচ্ছে আপনার বেশ ধকল গেছে’ হেসে বললেন তিনি।
‘একদম। নেহাত ভাগ্যের জোর। ট্রেন চলতে শুরু করেছিল, আমি লাফিয়ে উঠলাম’
‘জ্যামে পড়েছিলেন, তাই না?’ সাধু ঠিকই আন্দাজ করেছেন।
‘আশ্চর্য। এদিকে রাস্তা চওড়া হচ্ছে ওদিকে ট্রাফিকের গতি মন্থর হচ্ছে’
আমি খেয়াল করলাম ওঁর কথাগুলো খুব নরম। খুব নিচু স্বরে কথা বলেন, কেবল আমার শোনার মতো। মুখে গভীর প্রশান্তি।
‘ট্রেন মিস করলে খুব ভুগতে হত, তাই না?’
আমি ঘাড় নাড়ি। সত্যিই খুব বিপদে পড়তাম।
‘দেখুন মাঝে মাঝে আমাদের কিছু সোজাসুজি হস্তক্ষেপ করতে হয়। সব কিছু তাদের মতো হতে দিলে জটিলতা বাড়তে পারে।’
একটু থেমে তিনি আবার বলতে শুরু করেন ‘যেমন ধরুন স্টেশনে ঠিক সময়ে পৌঁছনোর জন্যে আপনার আরও সাবধান হতে হত।’
‘আমি কী করতে পারতাম’ আমি ভাবলাম। ‘আমি বাড়ি থেকে খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়েছি। সময় বাঁচাবার জন্যে বাস না ধরে ট্যাক্সি নিয়েছি’
‘এটা ঠিক, যে আপনি ট্র্যাফিক জ্যাম আটকাতে পারবেন না’ যেন আমার মনের কথা পড়েই সাধু বললেন।
‘কিন্তু আপনি যতক্ষণ না পৌঁছন ততক্ষণ যাতে ট্রেন না ছাড়ে সেটা করতে পারতেন।’
‘ট্রেন আটকে রাখা!’ আমি আশ্চর্য হয়ে যাই।
‘কেন নয়? আপনি এই জার্নির জন্য সবরকমের প্রস্তুতি নিয়েছেন। আপনি টিকেট রিজার্ভ করেছেন, তৈরি হয়ে সময় থাকতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। তারপরেও জ্যামে পড়লেন। আর সেই জ্যাম আপনার তৈরি না। তাহলে ট্রেনকে দেরি করানো ছাড়া আপনি আর কীইবা করতে পারেন?’
একটা প্যাসেঞ্জার স্টেশনে এসেছে, তখন সিগনাল সবুজ হয়েছে, তখন সে ট্রেনে উঠবে না ট্রেনকে আটকাবে? এ লোকটা বলছেটা কি?
‘না না , আপনাকে আগে থাকতে ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি একটু ছাড়া ছাড়া ভাবে বললেন ‘যতক্ষণ না স্টেশনে পৌঁছচ্ছেন ততক্ষণ অপেক্ষা করে কোন লাভ নেই। অনেক দেরি হয়ে যাবে’
কীসের কথা বলছে লোকটা?
‘বেশি কিছু না। একটা ব্যস্ত টেলিফোন বুথ থেকে একটা লোকাল কল করা। ব্যস এইটুকুই’
‘আর কাকে কল করব আমি?’
‘পুলিশকে। সেটাই সোজা। আপনি যদি রেলে ফোন করেন, তারা আবার পুলিশকেই ফোন করবে। ঘুরপথ,’
আমি বুঝতে পারলাম না লোকটা কী বলতে চাইছে।
‘দেখুন, আপনি কী চান? ট্রেনটা কিছুক্ষণ দাঁড়াক, এই তো? দরকারটা আপনার। কিন্তু কিছু বাধা, যেগুলো আপনার তৈরি নয়, সেগুলো কাটিয়ে উঠুন’
‘কীভাবে?’

‘আজকাল এগুলো কোন ব্যাপার নয়। এমনকি বাচ্চারাও বোঝে। জাস্ট বলুন যে ট্রেনে একটা বোমা রাখা আছে। কী সোজা! পুলিশ আর কুকুর যতক্ষণ তল্লাসি শেষ করবে, ততক্ষণে আপনি হেলতে দুলতে স্টেশনে পৌঁছবেন। কিন্তু আপনাকে সতর্ক হতে হবে। একটা খুব ব্যস্ত টেলিফোন বুথ চাই। এইটা খুব জরুরি। কেউ যেন আপনাকে না দেখে। আরেকটা জিনিস, তাড়াহুড়ো করে স্টেশনে ঢুকবেন না। এমন ভাব দেখাবেন যেন আপনি বরাতজোরে ট্রেনটা পেয়েছেন। আর সাবধানতা হিসেবে, আপনার বুক করা সিটের কাছে না যাওয়াই ভালো।‘
এই লোকটা, যাকে দেখে শান্তশিষ্ট মনে হয়, বেপরোয়া বিপজ্জনক পরামর্শ দিচ্ছে। আমি দেখলাম সে ভাবলেশহীন ভাবে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমাদের কথা অন্য কেউ শুনল কিনা তা নিয়ে ওর একটুও হেলদোল নেই।
দ্রুতগতির ট্রেন ছিল, কয়েকটি মাত্র স্টেশনে দাঁড়াচ্ছিল। সাধু ছাড়া বাকিরা সবাই ঘুমোচ্ছিল। আমার সিটে ঝুঁকে আমিও ঢুলছিলাম।
যখন ঘুম ভাঙল, ট্রেন একটা ব্যস্ত স্টেশনে দাঁড়িয়ে।

‘কোন স্টেশন এটা?’ অনেক প্যাসেঞ্জার প্লাটফর্মে নামছিল। কয়েকজন কোচের সীমিত জায়গায় পায়চারি করতে করতে সেলফোনে কথা বলছিল।চা, ফল, জল নিয়ে ফেরিওলারা কামরায় ঘুরছিল। দুজন নারী পুরুষ এক বয়স্ক লোককে হুইল চেয়ারে বসিয়ে পাশের কামরায় নিয়ে যাচ্ছিল। অন্য লাইনে ট্রেন আসা যাওয়ার শব্দে চারদিক ভরে ছিল।
সাধুকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। হয়তো প্লাটফর্মে নেমেছে। আমিও ভাবছিলাম নামব, কিন্তু তখনি একটা ছেলে একগাদা বই নিয়ে হাজির হল, উলটোদিকের সিটে সেগুলো সাজিয়ে দেখাল। পুরনো উপন্যাস, মেয়েদের পত্রিকা, বাচ্চাদের কার্টুন আর ছবিওলা গল্পের বই… আমি ওগুলোর পাতা উল্টোতে লাগলাম, আর বাইরে গেলাম না।
আমি ছেলেটার কাছ থেকে গান্ধীর ‘মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ’-র এক কপি কিনলাম। বেশ সস্তায় পেলাম। ভাবলাম বাচ্চারা যদি পড়ে তো ভালো। প্রথম পাতা পড়তে পড়তে ট্রেন চলতে শুরু করল।

ভূমিকার পর কয়েক পাতা পড়ে বন্ধ করে দিলাম। হালকা মাথা ধরেছে। উলটোদিকে সিটে সাধু পা মুড়ে বসে বিভোর হয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে।
বইয়ে ডুবে থেকে ওর কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম।
‘মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ, আপনি দেখবেন নাকি একবার?’ আমি বইটা বাড়িয়ে জিগ্যেস করি।
‘আমি দেখেছি’ বইটা আমার হাত থেকে না নিয়ে সে বলল ‘বোধহয় বাচ্চাদের জন্যে কিনেছেন?’
আমি ঘাড় নাড়লাম। ‘কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে এমন একটা বই যা বড়রাও পড়তে পারে। অনেকেই এর নাম শুনেছে, কিন্তু পড়েনি। যেমন আমি’

‘যদি বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিয়ে থাকেন তবে আমার মতে এতে বিশেষ কিছু লাভ নেই।’ হেসে বলল সাধু। ‘শুধু তাই নয়, এইসব নীতির গল্প পড়লে লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি হবে’

‘এমন বলছেন কেন?’ আমি তর্ক করি। ‘গান্ধীজীর বই বাচ্চাদের ভালো করতে বাধ্য। আমি এর উল্টো কথা কখনো শুনিনি’
সাধু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল ‘প্লিজ এর ব্লার্বটা একবার পড়ুন। কী লেখা আছে?’
আমি বইটা উল্টিয়ে পড়তে শুরু করি
‘সত্য এবং অহিংসা অনেকদিন ধরে আছে। তারা পর্বতের মতো পুরনো। এটাই বলা আছে, তাই না?’
‘হ্যাঁ, এটা কি সত্যি নয়?’ আমি জিগেস করি। কিন্তু সাধু কোন উত্তর দ্যায় না।
দীর্ঘ নীরবতার পর সে বলতে শুরু করে, যেন অনেকক্ষণ ধরে বলেই চলেছে।
‘বেশ, এইসব ভালো আইডিয়া বাচ্চাদের দেওয়া! কিন্তু কী ধরনের পৃথিবীতে আপনি আপনার বাচ্চাদের বড় করে তুলছেন? আপনি কি আশা করেন পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে তারা বাঁচবে? যদি তাই হয়, তবে এই নীতিশিক্ষা আর সত্য পথ ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে?’
সাধু কী ইঙ্গিত করছে সে নিয়ে আমার কোন ধারণাই ছিল না।
‘আপনি কি সত্যি মনে করেন এই আদর্শ সময়ে তারা বাস করবে? তারা তো বাঁচচ্ছে তীব্র প্রতিদবন্দিতার সময়ে। এটা ভবিষ্যতে আরও বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। একজনের হার আরেকজনের জিত। সত্যি বলতে কি আপনি কি আপনার বাচ্চাদের হিংস্র জন্তুদের গুহায় ঠেলে দিচ্ছেন না? একজন পড়ে গেলেই আরেকজনের পা রাখার জায়গা তৈরি হবে। এই দুনিয়াটা কি সত্য আর ন্যায়ের ওপর ভর করে এগোচ্ছে? আপনার কি মনে হয় আমাদের সমাজ এসব মেনে চলে? কিংবা কোনদিন মেনেছে? সেক্ষেত্রে বলুন এইসব বই আর তার নীতিশিক্ষার কি মূল্য আছে?’
‘তাহলে আপনি কোন ধরনের বই সাজেস্ট করেন?’ আমি চেপে ধরি ওকে। কিছু লোক আছে যারা সবকিছুর বিরুদ্ধেই মত দ্যায়। সাধু মনে হচ্ছে সেরকম একজন ।
‘আমার কথায় আপনার অস্বস্তি হচ্ছে তাই না?’ সাধু হাসে। ‘আপনি প্লিজ পড়তে থাকুন। আমি কিছুদিন আগে পড়েছি। এগুলো কয়েকটা সাধারণ পর্যবেক্ষণ।’
কিন্তু আমি আর পড়লাম না, তার বদলে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই ভালো লাগল। আমার কয়েকজন সহযাত্রী তাদের সঙ্গে আনা খাবার প্যাকেট খুলল। আমি কিছু নিয়ে আসিনি, কেটারারদের কাছ থেকে নিলাম।
লক্ষ্য করলাম সাধু লাঞ্চ খাচ্ছে না। খাওয়া শুরুর আগে আমি জিগ্যেস করলাম ‘ লাঞ্চ করবেন না?’
‘না, আমি সাধারণত বাইরের কিছু খাই না’ সে ব্যাগ থেকে একটা কলা বার করল আর জলের বোতল থেকে জল খেল।
‘শুধু এইটুকু?’
‘যথেষ্টর বেশি। খিদে তো মনের ব্যাপার, তাই না?’ আমায় অবাক করে জিগেস করে সে।
ট্রেন পতিত জমির ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। ফেলে রাখা চাষের জমিতে ক্যাকটাস জন্মেছে। বেশ কিছুক্ষণ এই একঘেয়ে দৃশ্য চলল। কোথাও একটা মানুষও দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন কয়েকটা ছোট সেতু পেরল। সেতুর তলার নদী আর স্রোত একদম শুখনো।হয়তো সাধুর বক্তৃতার জন্যেই, ওর ঠিক সামনে বসে আমার আর মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ পড়ার ইচ্ছে হয় না। ওর কথাগুলো অল্প হলেও আমার ওপর প্রভাব ফেলেছে। একদিক থেকে দেখলে ওর কথায় কিছু সারবত্তা আছে। মানুষ কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য ছাড়াই তাড়াহুড়ো করে দৌড়চ্ছে। কারুর দিকে তাকানো বা কারুর কথা ভাবার সময় নেই। এসবের মধ্যে এই নীতি আর জ্ঞানের কি মূল্য আছে? কিন্তু তর্ক করে বলা যায়, আর কী-ই বা করার আছে? এমন বই দরকার যা এই প্রতিযোগিতা আর ব্যস্ততার ভবিষ্যতে মানুষের কাজে আসবে। সেইটা কোন বই? কোথায় পাওয়া যাবে?
‘আমার মনে হয় এমন বই আছে। কোথাও অবশ্যই থাকতে হবে। আর যদি নাও থাকে, তবে লেখার বেশি দেরি নেই’ সাধু বলল, যেন আমার মনের কথা টের পেয়ে।
অসাধারণ! ওর কি মন পড়ার ক্ষমতা আছে? আমি আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকাই, উত্তরে ও শুধু শান্ত হাসি হাসে। ট্রেনের গতি কমে এসেছে। সামনে কোন স্টেশন নিশ্চয়।
‘শয়তানের বাণী বলে একটা বই বেরোবে। তেমন সম্ভাবনা খুব বেশি’ সাধু বলে
‘শয়তানের বাণী?’
‘কিংবা এইরকম নামের কিছু, এইরকম একটা বই দরকার যা এই পৃথিবীকে ভবিষ্যতের দিশা দেখাতে পারে।কিন্তু আপনি খুব মাথা খাটিয়েও কি শয়তানের বাণী ছাড়া অন্য নাম দিতে পারবেন?’
সে অবশ্যই এর কোন উত্তর আমার কাছ থেকে আশা করেনি।
কয়েক মিনিট পরে ট্রেনটা একটা খুব বড় না, খুব ছোট না, এমন একটা স্টেশনে পৌঁছল। এখানে কোন হল্ট ছিল না, তাই খানিকটা গতি কমিয়ে স্টেশনটা দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেল। প্লাটফর্মের লোকজন ছুটন্ত ট্রেনের দিকে হাঁ করে তাকাল, যেন দূর পাল্লার যাত্রীদের সমীহ করে।

‘সত্যি বলতে কি, আমি বেশ অনেকদিন ধরেই এর খোঁজ করছি।’ যেখানে শেষ করেছিল, সেখান থেকেই শুরু করল সাধু। ‘শয়তানের বাণী। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ধরা দেয়নি’
কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি ‘কীসের জন্যে খুঁজছেন?’
‘আমি কিছু অনুমানের ভিত্তিতে এগোচ্ছি। কিছু লোক, সংস্থা, এমনকি কোন সম্প্রদায়, আমি নিশ্চিত তাদের কাছে আছে এই বই। তাদের কাজের ধরন আর প্রক্রিয়া দেখলে বোঝা যায়। নইলে তারা কী করে একটাও ভুল পা না ফেলে এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগোতে পারে? আমি তাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়েছি আর তাই নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি ওদের কাছে এই বই আছে। তাই আজকাল…’ সে থেমে সাইড ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে এক চুমুক খেল।
‘আজকাল আমি এমন একটা বইতে কী কী থাকবে ভাবছি। এর বিষয় কী হবে? কী ধরনের অভিজ্ঞতা এতে তুলে ধরা হবে? স্টাইল কী হবে… সব মিলিয়ে আমি গভীরভাবে ভাবছি এ নিয়ে। আমার চিন্তা আর আজ পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে বলা যায় আমার চিন্তা ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।’

‘আপনি কি বোঝাতে পারবেন…?’
‘ধরা যাক, জীবনের কোন এক পর্যায়ে বইটা আমার হাতে এল, এতে এমন কিছু থাকবে না, যা আমি ভাবিনি। অন্য কোন ভাবে শয়তানের বাণী লেখা অসম্ভব।‘
ও কী বলতে চাইছে তার পুরোটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। শুধু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে একটা বই নিয়ে বলে, সেটা কল্পনা করা, ভবিষ্যৎ বাণী করা যে ভবিষ্যতে কোন একদিন বইটা তার হাতে আসবে… আর তার সূচী সম্পর্কেও পরিস্কার ধারণা- আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল।
‘আমি বইটার কন্টেন্ট আর ফরম্যাট নিয়ে এত বেশি ভাবি যে মাঝে মাঝে মনে হয় আমিই হয়তো বইটা লিখব’
বলে সাধু জোরে জোরে অনেকক্ষণ ধরে হাসল। সারাক্ষণই সে মৃদু বা আওয়াজ করে হাসছিল কিন্তু এমনভাবে হাসতে আমি দেখিনি। এটা যেন একটা জলের অবাধ স্রোতের মতো নরম। এর পর সে সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে গেল। তার কপালের ভাঁজগুলো উধাও হয়ে গেল।
যেই রাত হল, আমি আমার সুটকেস খুলে, মিনারেল ওয়াটারের বোতল বার করলাম, যার মধ্যে ভদকা মেশানো ছিল, আর কয়েক চুমুক খেলাম। এইসময় একবারও সাধুর দিকে তাকাইনি। দূরপাল্লার ভ্রমণে একঘেয়েমি কাটাবার জন্যে সঙ্গে মদ নেওয়ার অভ্যাস আমার আছে। আর যদি ভদকা হয়, তবে অন্যদের তা খেয়াল করার সম্ভাবনা খুব কম।
‘আপনি অবশ্যই সুটকেস লক করবেন আর চেন দিয়ে বাঁধবেন’ শুতে যাবার আগে সাধু মনে করাল আমাকে। ‘আফটার অল ট্রেন, তাই না? আমাদের ঘুমের সময় কে উঠবে কে নামবে বলা তো যায় না।
‘আমার সঙ্গে তো চেন নেই। আনতে ভুলে গেছি’
‘ওহ, খুব রিস্কি। আপনার সঙ্গে তো টাকা আর কাগজপত্র আছে, তাই না? নজর তো রাখতে হবে।‘ এরপর সে কাঁধের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা চেন তালা বার করে আনল। সে আমাকে চেনটা সিটের নিচের হুকে আটকাতে সাহায্য করল, তারপর আমায় চাবিটা দিয়ে দিল। ওর চেন, ওর তালা, এখন আবার চাবিও দিয়ে দিচ্ছে।। আমার দ্বিধা হচ্ছিল।
‘না, না, চাবিটা আপনার কাছে রাখুন। অচেনা লোককে বিশ্বাস করা কোন কাজের কথা নয়।’ সে বলল।
আমি চাবিটা ওর হাত থেকে নিয়ে হাসলাম।
‘এটা একটা শিক্ষা।‘ আমার সঙ্গে হেসে সাধু বলল ‘ডেভিলস গসপেলে এটা একটা জরুরি শিক্ষা। ‘কাউকে বিশ্বাস করোনা’। সম্ভবত সেটাই প্রথম অধ্যায়’
তারপর সে আমাকে ফিসফিস করে বলল ‘আরেকটা হচ্ছে অপরিচিত জায়গায় থাকলে মদ না খাওয়া। সাময়িক ভাবে হলেও মদ আমাদের যুক্তিবুদ্ধি নষ্ট করে দ্যায়’
আমি চমকে গেলাম। এই লোকটা সব দেখতে পায়!

‘আমি বলছি না যে কেউ মদ খাবে না। ঐ গসপেলে মদ এবং মাতলামোর ভীষণ গুরুত্ব আছে, যার কথা আমি বলছি। এগুলো সংকটজনক পরিস্থিতিতে আপনি কৌশল হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন।’ সে বলে চলে। ‘যারা বুঝে গেছে মদ আসলে কী জিনিস, তারা ড্রিংক করে না। তারা বরং অন্যদের খেতে পীড়াপীড়ি করে। যদি আদৌ তারা ড্রিঙ্ক করে, তবে তা কেবল অন্যদের প্রলুব্ধ করে ফাঁদে ফেলতে।’

আমি বার্থে শুয়ে লোকটা কী বলেছে ভাবতে থাকি। মাঝে মাঝে ট্রেনের দুলুনি খুব বেশি হচ্ছিল। যে স্টেশনগুলো আমরা পেরিয়ে যাচ্ছিলাম, সেখান থেকে আলোর রেখা এসে অন্ধকার কামরায় উঁকি দিচ্ছিল। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওপরের বার্থে থাকলে কোন উৎপাত হয় না। আমি আস্তে আস্তে ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
যখন ঘুম ভাঙল তখন বেশ আলো। ট্রেন খুব জোরে যাচ্ছে। আমি বার্থ থেকে নেমে আসি।
আগের সন্ধেয় যারা ছিল তাদের অনেকে নেই, তাদের জায়গায় নতুন নতুন মুখ। বাইরের দৃশ্যও বদলে গেছে। আর সবুজ নেই। শুধু পতিত চাষের জমি। তবু কিছু চাষিকে বলদ আর লাঙ্গল নিয়ে দেখা গেল। সারি সারি সাইকেল পার্ক করা ছোট ছোট স্টেশনে। কিছু দূরে এক সারি কুটির। বঞ্চনা আর ক্ষয় চারদিকে।
টুথব্রাশ আর পেস্ট নিতে হবে। কিন্তু সুটকেসটা কোথায়? যেখানে লক করে রাখা ছিল, সেখানে নেই। কুমার সাধুও তার সিটে নেই। সে আমাকে বলছিল আমার গন্তব্যেই সে চলেছে। এখন আমি সুটকেস ছাড়া কী করব? যদি টাকা আর কাগজপত্র হারিয়ে যায় তো কাকে অভিযোগ করব? আমার অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিল।
‘আমি ওটাকে সিটের নিচে সরিয়ে দিয়েছি। আমরা ওটা দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম, আর ওটা কাঁপছিল।’ সাধুর গলা শুনে আমি ঘুরে তাকাই। তার স্নান সারা হয়ে গেছে, পরনে ধোয়া সাদা পোশাক।একইরকম শান্ত হাসি ঠোঁটে। আমি ওকে সন্দেহ করেছি ভেবে খারাপ লাগল।
ব্রাশ করতে করতে আমি অন্য যাত্রীদের কথাবার্তা থেকে জানলাম ট্রেন চার ঘণ্টা লেট চলছে। আরও দেরি হতে পারে দিনের বেলার কিছু নিয়মিত ট্রেনের চলার জন্যে। আমার মনে পড়ল রাতে ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।
‘মনে হচ্ছে একটা দাঙ্গা লেগেছে। নিশ্চয় সেই স্টেশনের কাছের শহরে, যেখানে আমাদের ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল।সবই ভয় করছিল দাঙ্গাবাজরা ট্রেনকে অ্যাটাক করবে’ আমি সিটে ফিরে আসার পর সাধু বুঝিয়ে বলল।
‘আমদের সাংঘাতিক দেরি হয়ে যাবে’
‘আর কোন রাস্তা নেই, তাই না?’ তার মুখে দুশ্চিন্তার কোন ছাপ নেই।
‘শেষ স্টেশনটা কী ছিল?’ আমার উল্টোদিকের ওপরের বার্থে ঘুমোনো লোকটা নিচে তাকিয়ে জিগেস করল। সাধু ওপরদিকে তাকিয়ে স্টেশনের নাম বলল।
‘ওহ, সর্বনাশ হয়ে গেল’ সে চিৎকার করে, নিচে লাফিয়ে পড়ে জানলা দিয়ে তাকাল নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে।
‘আপনার কি ওখানে নামার কথা ছিল?’ আমি জিগ্যেস করি।
‘হ্যাঁ। ট্রেনের তো ওখানে ভোর চারটেয় পৌঁছনর কথা ছিল। এখন যেহেতু ট্রেন লেট করেছে, টিটি বলেছিল অন্তত সাতটা বাজবে। ওহ, কি সাংঘাতিক।’ মনে হল লোকটা কেঁদে ফেলবে।
‘আপনি পরের স্টেশনে নামতে পারেন। ‘সান্ত্বনা দিয়ে বলি।
‘সে তো হবে না। আমাকে নটার মধ্যে পৌঁছতেই হবে। আর এই হতভাগা ট্রেন আরও একশো কিলোমিটার পরে দাঁড়াবে। আমি কী করব? হায় ভগবান!’ লোকটার কাজে লাগে এমন কোন আইডিয়া আমার মাথায় খেলছিল না।
সাধু উঠে দাঁড়াল। ‘চিন্তা করবেন না। আমরা হয়তো আর পাঁচ কিলোমিটার এসেছি, এইটুকুই। আপনি যদি এখানে নেমে যান, তবু আপনার জায়গায় নটার মধ্যে পৌঁছতে পারবেন।’ সঙ্গে সঙ্গে সে অ্যালার্ম চেন টানল আর নিজের জায়গায় নির্বিকারভাবে বসে পড়ল।
ট্রেনের গতি ধীর হতে হতে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা ছোট গ্রাম।ছোট ছেলেরা গরু ছাগল চরাতে চরাতে অবাক চোখে ট্রেনের দিকে চেয়ে ছিল। এত কাছে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে- এ নিশ্চয় তাদের কাছে খুব বিরল দৃশ্য।
সাধু লোকটাকে তাড়া দিল ‘নেমে যাও বন্ধু, পুলিশ আসার আগেই তোমায় নেমে পড়তে হবে’
লোকটা নিজের ব্যগপত্র নিয়ে লাফিয়ে নেমে সরু রাস্তা দিয়ে এমনভাবে ছুট লাগাল যেন কেউ তাকে তাড়া করেছে।
একটু পরেই দুজন গার্ড এল কোচে। তাদের যথেষ্ট বিরক্ত মনে হচ্ছিল।
‘এমনিতেই ট্রেন লেট যাচ্ছে। এখন আবার কী হল?’ প্রশ্নটা বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া নয়। কেউ উত্তর দিল না।

একজন গার্ড চেঁচিয়ে বলল ‘কে চেন টেনেছে?’ তখনও কেউ উত্তর দিল না।
‘একজন যাত্রী’ সাধু তাদের দৃঢ়ভাবে বলল ‘এখুনি নেমে ছুট লাগাল’
‘চুলোয় যাক। এইসব লোক চায় এক্সপ্রেস ট্রেন তাদের দরজায় দাঁড়াবে’ তারা ক্ষেপে চলে গেল। খুবই আশ্চর্য লাগল যে কামরার আর কেউ কোন কথা বলল না।
‘দাঙ্গার আ্গুন লাগানো ওর কাজ ছিল না’
ট্রেন ছাড়তে সাধু হেসে বলল।
আমি যেমন ভয় করেছিলাম, ট্রেন আরও লেট করল। মাঝে মাঝেই এর গতি মন্থর হয়ে আসছিল, এমনকি কয়েকটা স্টেশনে দাঁড়িয়েও থাকছিল অন্য ট্রেনকে পাস করানোর জন্য।
বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করলাম। একজনের কাছে এক প্যাকেট তাস ছিল আর আমরা সুটকেস দিয়ে কাজ চালানর মতো টেবিল তৈরি করে নিলাম। যখন একজন আউট হয়ে গেল, সাধুকে ডাকা হল কোরাম করার জন্যে। আমি কখনো ভাবিনি যে সাধুর মতো লোক তাস খেলবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে সে খুব উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিল।
তার খেলার ধরন ছিল একদম অন্যরকম আর খুব আশ্চ র্যজনকও। তাসের ব্যাপারে সাধু ছিল ওস্তাদ। যদিও সে নিজের হাতের তাসেই মনোযোগী ছিল, তবু সে অন্যদের হাতে কী আছে তাও বুঝতে পারছিল। সে জিতেই চলছিল, যদিও এ নিয়ে তার কোনরকম উল্লাস ছিল না।
একজন খেলুড়ে তার ব্যাগ থেকে ফ্রুটির টেট্রাপ্যাক বার করে সবাইকে অফার করল, সে নিজেও একটা খেতে শুরু করল।
‘আমি এটা খাই না’ সাধু ফিরিয়ে দিয়ে বলল ‘আমার মত হল কারোই সহযাত্রীদের কাছ থেকে ড্রিংক নেওয়া উচিত না’
আমার মনে হল এই উপদেশটা আমাকে উদ্দেশ্য করে। যাই হোক, যখন আমিও ফ্রুটি নিলাম না, তখন সে আবহাওয়া হালকা করার জন্যে সে এটা হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল। মনে হয় আগের দিন যে শয়তানের বাণীর কথা বলছিল, এটা তার দ্বিতীয় পাঠ- কখন কারো কাছ থেকে কিছু নিও না।
আমরা আরও কিছুক্ষণ তাস খেললাম। হামাগুড়ি দিয়ে বিষণ্ণ সন্ধে এল। এই সময়টা আমি ঘুমিয়ে চা খেয়ে আর দুনিয়ার সমস্ত বিষয়ে গল্প করে কাটালাম।আমাদের স্টেশনে যখন ট্রেন পৌঁছল তখন রাত এগারোটা। প্রায় সাত ঘণ্টা লেট। ঘুম চোখ যাত্রীরা রাতের অন্ধকারে নেমে গেল।
কামরাটা খালিই বলা চলে। আমরা ধীরেসুস্থে নামলাম।
‘আপনি কোনদিকে যাবেন?’ আমার সুটকেস নামাতে সাহায্য করতে করতে সাধু জিগেস করল।
‘কলসপুরীর গিরিনগর’
‘ওহ, এখান থেকে ২০ কিলোমিটার তো হবেই। এত রাতে কি আপনি বাস পাবেন?’
‘হয়তো,কলসপুরী অবদি…’ আমি বলি ‘হয়তো কোন দূর পাল্লার বাস যায় ওর ওপর দিয়ে’
হুইলচেয়ারে বসা এক বৃদ্ধ লোক, যাঁকে ট্রেনে দেখেছি, দেখলাম তাঁকে সেই দম্পতি স্টেশনের বাইরে ট্যাক্সির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
সাধু আমার সঙ্গে বাস স্ট্যান্ড অব্দি এল, যেটা প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। সে আমার সুটকেস অনেকটাই বয়ে আনল। হয়তো জার্নির ধকলের জন্যে, আমার সুটকেসটাকে বেশি ভারি লাগছিল।
বাস স্ট্যান্ড আর চারপাশ একদম পরিত্যক্ত মনে হচ্ছিল। পার্ক করা বাসের একটাতেও আলো জ্বলছে না। আশপাশের সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। দূর পাল্লার বাসের কোন চিহ্ন নেই।
‘আমি কি একটা রিকশা বা ট্যাক্সির চেষ্টা করব?’ আমি সাধুকে জিগ্যেস করলাম।
‘আমার মনে হয় না কেউ আপনাকে নিয়ে যাবে।’ সাধুকে চিন্তিত দেখাল। ‘আর যদি নিয়ে যেতেও চায়, তবু আমি বলব আপনার যাওয়া উচিত নয়।’
‘কেন?’
‘আপনাকে একদম নির্জন জায়গা দিয়ে যেতে হবে। খুব ঝুঁকি হয়ে যাবে। সময়টা খুব ভালো নয়। প্রায়ই যেসব গল্প কানে আসে, খুব ভালো নয় সেগুলো। সাবধান হওয়াই ভালো’ তারপর সে খানিকটা ইতস্তত করে জিগ্যেস করল ‘ এইসব বলার পর আমার পক্ষে আপনাকে আমাকে বিশ্বাস করতে বলা খুব সোজা নয়। যাই হোক, আজ রাতটা আমার বাড়িতে থেকে গেলেই ভালো নয় কি?’
আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। সেই একইরকম প্রশান্তি। তাছাড়া আমার আর কোন উপায়ও ছিল না।
আমরা একই রাস্তা দিয়ে ফিরে এলাম। এত রাতেও স্টেশনের কাছে কয়েকটা লোক ছিল। কিন্তু ওইটুকু বাদ দিলে সবটাই নির্জন রাস্তা। রাতটা ছিল মেঘাচ্ছন্ন। কয়েকটা ল্যাম্প পোস্ট ছিল, দুএকটারই বাল্ব জ্বলছে। যেন ছায়ার এলাকা দিয়ে হাঁটছি মনে হচ্ছিল।

কিন্তু সাধু জায়গাটার সঙ্গে খুব পরিচিত। সে দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটছিল যেন আলোকিত রাস্তায় চলেছে। ওর সঙ্গে তাল মেলাতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। রাস্তা সরু গলির দিকে নেমে গেল। সাধু আমার সুটকেস নিয়ে হাঁটছিল।
একটা বিশাল ফ্ল্যাট চত্বরের পাশে এক ফুট ট্র্যাকের ওপর হোঁচট খেতে খেতে সে আমার দিকে ঘুরে সাবধান করে বলল ‘সাবধান। একটা ভুল পা ফেললেই সোজা খালে পড়বেন। এটা এই বিল্ডিং-র নালা। যথেষ্ট গভীর।
আমি যতক্ষণ না পৌঁছই ততক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর আমার হাত ধরে এগোতে থাকল।
ওহ ভগবান, এই লোকটা আমাকে এই নোংরা নালা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনে আসতে আসতে সে আমাকে যেসব ইঙ্গিত দিয়েছে আর তারপর শয়তানের বাণীর প্রসঙ্গ আমার মনে ভিড় করে এল। আমি ভয় পেলাম।
একদল রাস্তার কুকুর ঘেউঘেউ করে তেড়ে এল। সাধু থেমে ওদের দিকে হাত তুলল। ঘেউঘেউ থেমে গেল। যেন সাংঘাতিক আঘাত লেগেছে, এইভাবে তারা গজরাতে লাগল। পুরো ব্যাপারটাই গা ছমছমে মনে হল।
আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা একটা ছোট সাঁকোর কাছে পৌঁছলাম। সাঁকোটা এই বিশাল নালা আর ওপাশের দুনিয়াকে জুড়ে ছিল। নালা থেকে মারাত্মক দুর্গন্ধ আসছিল।আমরা ওপাশের একসারি ছোট বাড়ির সামনে পৌঁছনোর পরেও দুর্গন্ধটা যেন আমাদের তাড়া করে আসছিল। সব ঘরগুলোর টিনের ছাত।ভেতর থেকে সবগুলো বন্ধ। কোথাও কোন আলো ছিল না। বোঝা যাচ্ছিল বারান্দায় অনেক লোক গাদাগাদি করে শুয়ে আছে।
সাধু সুটকেসটা নামিয়ে রেখে কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা চাবি বার করল আর একটা ঘরের দরজার তালা খুলল।
সে দরজাটা খুলল। কাঠের দরজার ওপর লোহার ঘষটানির আওয়াজ অন্ধকারে অদ্ভুত একটা আওয়াজ তুলল।
একটা ঘুমন্ত লোক মুহূর্তে জেগে লাফিয়ে উঠল। সাধুকে চিনতে পেরে সে মাথা নিচু করে একপাশে সরে গেল। তার শতচ্ছিন্ন পোশাক, উসকোখুসকো চুল, এক মুখ দাড়ি। দেখে মনে হয় ভিখারি।
‘ঘুমিয়ে পড়ো আবার। আমার একটু দেরি হল আসতে’ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সাধু বলল।
সাধু আলো জ্বালিয়ে কয়ারের খাটে আমাকে বসতে বলল। ছোট ঘর। একটা জানলা, যেটা আবার বন্ধ, সেই জানলা ঘেঁষে একটা ছোট চেয়ার আর একটা টেবিল। খাটের নিচে গটান তোশক।এক কোণে কয়েকটা কলসী, দেওয়ালে পেরেক থেকে কিছু বাটি ঝুলছে। বাকি জায়গা জুড়ে বই আর বই, পুরনো, নতুন, পত্রিকা, ডায়েরি, লেখা নোট…
‘কাল সকালে স্নান করলে অসুবিধে নেই তো?’সাধু জিগ্যেস করল। ‘আমি জানি আপনি ক্লান্ত, একটু স্নান করতে পারলে ফ্রেশ হতে পারতেন। কিন্তু এখন অল্পই জল পড়ে আছে।এটা আমরা কিছু খাবার তৈরি করতে ব্যবহার করতে পারি’ সে আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেল সঙ্গে একটা ছোট কলসী নিয়ে। কলসীতে ট্যাপ থেকে জল পড়ার ক্ষীণ আওয়াজ পাওয়া গেল। আমি বই আর নোটস উল্টেপাল্টে দেখছিলাম, নোটসগুলোর হাতের লেখা পড়া যাচ্ছিল না।
‘এগুলো বিভিন্ন লোকের হয়ে করা অভিযোগের দরখাস্ত’ সাধু বলল। সে নির্ঘাত আমাকে নোটস উল্টোতে দেখেছে। কিন্তু এ নিয়ে তার কোন আপত্তি আছে বলে মনে হল না। কিন্তু আমি একটু লজ্জায় পড়লাম। এগুলো তো ব্যক্তিগত কাগজ হতে পারত, এসবে আমি উঁকি দিচ্ছিলাম।
সাধু স্টোভ জ্বেলে জল গরম বসাল। কেরোসিনের গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। সে মেঝেতে বসে রুটির জন্য আটা মাখল। আলু কেটে তরকারি বানাল। ঝটিতি ডিনার তৈরি হয়ে গেল। আমরা মাদুর পেতে খেতে বসলাম।

‘এত বই কাগজ… আপনি কী ধরনের কাজ করেন?’
‘নির্দিষ্ট করে কিছু না, সবরকম কাজ করি’ সাধু অবশ্যই উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছিল। আমার মনে পড়ল সে একজন তাস খেলুড়েকে বলছিল সে কাজ খুঁজছে।
ডিনার শেষ হলে সাধু একটা ধোয়া চাদর খাটের ওপর পেতে দিল ‘এখানে শুয়ে পড়ুন’ সে আমাকে বলল।
‘আমায় কয়েকটা কাজ শেষ করতে হবে। ট্রেন দেরিতে এল বলে আমার সব প্ল্যান আপসেট হয়ে গেল। আমি জানি না আমি এটা আজ শেষ করতে পারব কিনা নাকি কালকের জন্যে মুলতুবি রাখব’
সে টেবিল থেকে বইয়ের স্তূপ মেঝেতে নামিয়ে রাখল।জানলা খুলে একটা রাইটিং বোর্ড নিয়ে লিখতে শুরু করল।
‘আপনি যে বইটার কথা বলেছিলেন, সেটা নিয়ে ব্যস্ত , তাই না?’ ট্রেনে হওয়া আমাদের কথাবার্তা মনে করে বললাম।
সে একটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল।
‘সেই যে সেই বইটা। শয়তানের বাণী…’
সাধু শুধু হাসল, কিছু বলল না।
‘আপনি লাইট নিভিয়ে দিতে পারেন। ক্যালেন্ডারের ঠিক নিচে সুইচটা। আমার এখানে একটা টেবিল ল্যাম্প আছে।’ আমি উঠে ওর দেখানো মতো জায়গায় গেলাম কিন্তু সুইচটা খুজে পেলাম না। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশিরভাগ তারিখের নিচে সাধুর নোট লেখা, লোকের নাম, জায়গার নাম এইসব। মনে হয় ওর প্রোগ্রাম চার্ট।ক্যালেন্ডার তুলে একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ দেখতে পেলাম। এক গ্রাম্য নারী পুরুষের ছবি। বয়স্ক দম্পতি। লোকটার মুখের সঙ্গে সাধুর মুখের আবছা মিল।
‘আপনার বাবা মা?’ আমি জিগ্যেস করি? সাধু যে মাথা নিচু করে লিখতে ব্যস্ত ছিল, ঘুরে মাথা নেড়ে আবার লেখায় মন দিল।
‘ওঁরা কোথায়?’
‘কোথাও না। দুজনেই মারা গেছে’ সে মাথা না তুলে বলে চলল। ‘ওদের মারা যাবার পর এই ছবি তোলা হয়েছে। খুঁটিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন।’
মারা যাবার পরের ছবি দেওয়ালে টাঙ্গানো- আমার অদ্ভুত লাগল।
‘আগের কোন ছবি ছিল না।’ সাধু বলল, যেন আমার সন্দেহ দূর করতে।
‘ওঁরা কি একসঙ্গে মারা যান? কিন্তু তা কেমন করে হবে? আত্মহত্যা?’
‘ওদের গুলি করে মারা হয়েছিল।‘ রাইটিং বর্ড থেকে মাথা না তুলেই সাধু বলল।
‘কারা মেরেছে?’ আমি উদবিগ্ন হয়ে জিগ্যেস করি
‘পুলিশ। সেদিন শহরে একটা দাঙ্গা বেঁধেছিল’ সাধুর গলায় আবেগের ছিটেফোঁটাও ছিল না।
আমি আলো নিভিয়ে দিলাম।
শুধু জেগে থাকল টেবিল ল্যাম্পের বৃত্তাকার আলোয় সাধুর ঝুঁকে পড়া মাথা, একটা বাঁধানো ফটোর মতো।

ক্লান্তিকর ট্রেন জার্নি আর ধকলের ফলে আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। একবার ঘুম ভাঙলে দেখলাম টেবিল ল্যাম্প তখনও জ্বলছে। সাধু নিজের কাজে ডুবে আছে। আমি পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
আবার কিছুক্ষণ পর জেগে উঠলাম। তখন পুরো অন্ধকার। কটা বাজে বুঝতে পারলাম না। আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেলে আমি চারদিকে তাকালাম। কোথাও সাধুর চিহ্ন নেই। কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছ না। আমি খাট থেকে নামলাম।
আমার পায়ে কিছু লাগল। আমি ঝুঁকে পড়ে দেখলাম।
সে মাদুরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। বাঁহাত মাথার নিচে রাখা বালিশের মতো। তার মুখ একজন যোগীর মতো শান্ত।
আমি শব্দ না করে টেবিলের কাছে গেলাম। রাইটিং বোর্ডে কাগজ সাঁটা।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। রাস্তার মলিন আলোয় সরু গলিগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম, গত রাতে আমরা যেগুলো দিয়ে এসেছি, তার পর আকাশ ছোঁয়া বাড়ি, নালা, সাঁকো, ছোট দোকানের সারি,দাঁড় করানো রিকশা, ছোট গাড়ি। যেন শহরের প্রান্তরেখা।
চারদিকে নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে।
এই রহস্যময় নৈঃশব্দের মধ্যে, আকাশের বিষণ্ণ আলোর নিচে আমি দেখতে পেলাম পৃথিবী একটা ছেঁড়া বইয়ের মতো ঘুমোচ্ছে।

(মূল মালয়ালম থেকে ইংরেজি অনুবাদ- বেণুগোপাল
ইংরেজি থেকে অনুবাদ- তৃষ্ণা বসাক)

অনুবাদক পরিচিতি-তৃষ্ণা বসাক এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ কবি ও কথাকার। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কল্পবিজ্ঞান, মৈথিলী, হিন্দি ও মালয়ালম অনুবাদকর্মে তিনি প্রতিমুহুর্তে পাঠকের সামনে খুলে দিচ্ছেন অনাস্বাদিত জগৎ। জন্ম কলকাতায়। শৈশবে নাটক দিয়ে লেখালেখির শুরু, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘সামগন্ধ রক্তের ভিতরে’, দেশ, ১৯৯২। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘আবার অমল’ রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯৯৫।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.ই. ও এম.টেক তৃষ্ণা পূর্ণসময়ের সাহিত্যকর্মের টানে ছেড়েছেন লোভনীয় অর্থকরী বহু পেশা। সরকারি মুদ্রণ সংস্থায় প্রশাসনিক পদ, উপদেষ্টা বৃত্তি,বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শী অধ্যাপনা, সাহিত্য অকাদেমিতে আঞ্চলিক ভাষায় অভিধান প্রকল্পের দায়িত্বভার- প্রভৃতি বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর লেখনীকে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। বর্তমানে কলকাতা ট্রান্সলেটর্স ফোরামের সচিব।
প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- পূর্ণেন্দু ভৌমিক স্মৃতি পুরস্কার ২০১২, সম্বিত সাহিত্য পুরস্কার ২০১৩, কবি অমিতেশ মাইতি স্মৃতি সাহিত্য সম্মান ২০১৩, ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ) ২০১৩, ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার ২০১৫, সোমেন চন্দ স্মারক সম্মান (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি) ২০১৮, সাহিত্য কৃতি সম্মান (কারিগর) ২০১৯, কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন স্মৃতি সম্মান ২০২০, নমিতা চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য সম্মান ২০২০ ও অন্যান্য আরো পুরস্কার।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes