পাবলোর ডায়েরি <br /> সম্রাট সরকার

পাবলোর ডায়েরি
সম্রাট সরকার

প্রকৃত কৃষক, প্রকৃত পাহাড়ি, প্রকৃত সামান্য

“সারাদিন ধানের বা কাস্তের শব্দ শোনা যায়।
ধীর পদবিক্ষেপে কৃষকেরা হাঁটে।
তাদের ছায়ার মত শরীরের ফুঁয়ে
শতাব্দীর ঘোর কাটে – কাটে

মাঝে মাঝে দু-চারটে প্লেন চ’লে যায়।
একভিড় হরিয়াল পাখি
উড়ে গেলে মনে হয়, দুই পায়ে হেঁটে
কত দূর যেতে পারে মানুষ একাকী।“
দক্ষিণের মাঠে এই কবিতাটা পড়া হচ্ছে। মা পড়ছে। পটলমাচার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি আর বাবা আলের ওপর বসে শুনছি। জীবনানন্দ দাশের কবিতা। কিছুই বুঝতে পারিনা। থেমে থেমে, ধীরে ধীরে বয়ে চলা কবিতা। শীতকাল আসছে আমাদের দক্ষিণের মাঠে। মাঠটা আরো আপন হয়েছে। বাবা আর মা বহু কষ্ট ক’রে এই জমিটা কিনেছে। আমাদের চাষ করতে হবে। গত শতাব্দীতে আমাদের চাষ ছিল। তারপর শূন্য। অফিস-কাছাড়ি, হিল্লি-দিল্লি। তারপর ঘোর কেটেছে। আবার চাষ ফিরিয়ে আনবে ব’লে বাবা জেদ ধরেছিল। চাষ ছাড়া নাকি জীবন অর্থহীন। বাবা সবার জলের হিসেব ক’রে দিত। মানে শ্যালো মেশিন থেকে কে কত জল নিচ্ছে তার হিসেব। এখন নিজেরটাও করতে হবে। কেমন মজা। দূর থেকে হিসেব করা আর তারপর নিজেই সেই হিসেবের মধ্যে গিয়ে পড়া।
পটলের মাচার নীচে গামছা পেতে হামিদচাচা খালি গায়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মাচার নীচে খুব ঘাস তাই আলো একদম নেই। চাচা হয়ত গরুর জন্য ঘাস কাটছিল। ঘুম এসে বিশ্রাম দিয়ে গেছে হামিদচাচাকে। ঘাসের ডাঁই, হেঁসো সব প’ড়ে। মাচার নিচে বেশ গরম। বাইরে বেরিয়ে এলে শীত শীত করে। হামিদচাচার ঘামে ভেজা গেঞ্জিটা মাচার ওপর থেকে ঝুলছে। শেষ বিকেলের আলো বয়সা বিলের রাস্তা ধরেছে। শিশিরের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার সময় এখন। হামিদচাচাকে দেখছি আর একটা লাইন মনে পড়ছে। “আমার জটিল দেহ জামা খুলে দীর্ঘ পড়ে আছে”। চাচার নাকের ওপর একটা ফড়িং বারবার ঘুরে ঘুরে এসে বসছে আর উড়ে যাচ্ছে। খসখসে কালো হাতদুটো পেটের ওপর জড়ো করা। নিঃশ্বাসে সঙ্গে সঙ্গে উঠছে, নামছে। দুহাতের আঙুলের শৃঙ্খল আলতো খুলছে, আবার এঁটে বসছে। হামিদচাচা যেন মাচার নিচের ঘাসের অন্ধকারের ভেতর ডুবে গেছে। বাবা যদি পাঠ শোনায় ব্যস্ত না থাকতো তবে নির্ঘাৎ বলতো – ঘাসের নিবিড় আয়োজনের ভেতর কেমন সামান্য হয়ে আছে চাচা। আমি আর বাবা অনেকবার পটলমাচার নিচে ঘাসের মধ্যে শুয়েছি। এইরকম শীতের শুরুতে ‘তুলিকা’ নামে এক পাখি দল বেঁধে মাচার নিচে ঘাসের মধ্যে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ায়। ওদের ইংরেজি নাম ‘অলিভ ব্যাকড পিপিট’। খঞ্জনাও আসে। ওদের কাছ থেকে দেখার জন্য বাবা আর আমি ঘাসের মধ্যে শুয়ে প’ড়ে হারিয়ে যেতাম। দুহাতের ওপর থুতনি রেখে বাবা হঠাৎ ব’লে উঠতো “সুরঞ্জনা/ তোমার হৃদয় আজ ঘাস”। বাবা খুব হেঁড়ে গলায় কবিতা পড়ে। চাচার ঘুম ভেঙে যাবে। তাই মা পড়ছে। আজ আমাদের নিজেদের জমিতে প্রথম দিন। তাই কবিতাপাঠ।
“এখন অনেক দূরে ইতিহাস – স্বভাবের গতি চ’লে গেছে।
পশ্চিম সূর্যের দিকে শত্রু ও সুহৃদ তাকায়েছে।
কে তার পাগড়ি খুলে পুব দিকে ফসলের, সূর্যের তরে
অপেক্ষায় অন্ধকার রাত্রির ভিতরে
ডুবে যেতে চেয়েছিল ব’লে চ’লে গেছে।“
এই লাইনগুলো পড়া শেষ হতেই হামিদচাচা উঠে বসল। চোখেমুখে লজ্জা। চাচার জমির পাশেই আমাদের এই জমি। চাচাই যোগাযোগ ক’রে এই জমি আমাদের কিনে দিয়েছে। হামিদুর রহমান। বাবার ছোটবেলার বন্ধু। সবাই সুহৃদকে পাশে চাই। তাই বাবার জমি নিজের জমির পাশে। এভাবে কবিতার কয়েকটা শব্দ ছিটকে আসে আমার মনের ভেতর। সামনের মাঠ-ঘাট, বিল-বাঁওড়ের ভেতর। যেমন ‘শতাব্দীর ঘোর’, ‘জটিল দেহ’, ‘সুহৃদ’। পুরো কবিতাটা আসে না। আমরা বাড়ি ফিরে আসি আলের ওপর দিয়ে হেঁটে। সামনে মা, তারপর বাবা, পেছনে আমি আর হামিদচাচা পাশাপাশি। আমরা আলের ওপর আর চাচা নিচ দিয়ে। অর্থাৎ আলের ওপর শখের এবং আলের নিচে প্রকৃত কৃষক। পাড়াগাঁয়ের কৃষক হামিদুর রহমান আধোপথ দিয়ে একলা হাঁটে। মাথায় ঘাসের বিরাট বোঝা। আমি কি এখন বলবো জীবনানন্দের মত, চাচার মাথায় ‘একভিড় ঘাস’? ঠিক তখন দু-একফোঁটা জল ঝরে পড়ে সেই বোঝা থেকে – আমার মাথায়, কাঁধে, পিঠে। যে জল সন্ধ্যের ব্যর্থ শিশির। এভাবে সমস্ত শিশির নয়, বিচ্ছিন্ন সংক্ষিপ্ত ছিটকে আসে আমার ভেতরে।
এখন সিটং এসেছি। দার্জিলিং জেলা। কি উঁচু পাহাড়। চারিদিক পাহাড়ে পাহাড়ে ছয়লাপ। কুয়াশা। কি শীত। পাহাড়ের ওপরের গাছগুলো কুয়াশার ভেতর দিয়ে মেঘে চলে গেছে। শিকড় পাহাড়ে আর মাথা মেঘে। বাবা আর মা চা-বাগান আর গাছপালার মধ্যে দিয়ে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আমার সঙ্গে যাচ্ছে হিমাংশু। আমার থেকে ছোটো। হাওয়াই চটি প’ড়ে যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে। রাস্তাটা সরু। আমি রাস্তার ওপর আর হিমাংশু পাশে ঘাসঝোপলতার মধ্যে দিয়ে। আমাকে ভালো রাস্তা ধরে হাঁটার সুযোগ ক’রে দিয়ে নিজে ঝোপের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। অর্থাৎ রাস্তার ওপর শখের আর রাস্তার নিচ দিয়ে প্রকৃত পাহাড়ি। আমার জোঁক-ঠেকানো জুতো। ওর নাক থেকে পাকা সর্দি বেরোচ্ছে। ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে না। খালি টেনে টেনে নিচ্ছে। আমার মা হলে নাক ঝাড়তে বলতোই বলতো। হিমাংশুর টাইটেল গুরুং। আমি তো “গুরুং…” বলে একটা শব্দ করে ডাইনোসরদের গুলি করতাম। সেইটা ওর টাইটেল। হিমাংশু নেপালি বলে আর আমি বাংলা বলি। কেউ কারোর কথা বুঝতে পারছিনা। তাই ওরও যা ইচ্ছে হচ্ছে আমারও তাই ইচ্ছে হচ্ছে। হাতের ইশারায় ও দেখালো নীচে একটা কাঠের বাড়িতে একটা লোমওয়ালা কুকুর আছে। আমাদের দেখে ডাকছে। আমাকে নিচে সেই বাড়িটায় নিয়ে গেলো। কুকুরটা কি কথা শোনে! হিমাংশু নমস্কার করতে বলছে আর কুকুরটা সামনের দুটো পা উঁচু করে, জড়ো করে নমস্কার করছে। আমি চাইছি ওকে আরো ওবিডিয়েন্ট করতে। একটা গাছের ডাল ভেঙেছি। ওর পাশে একটা পাথরে ডালটা জোরে জোরে ঠুকছি আর শুয়ে পড়ে নমস্কার করতে বলছি। কিছুতেই করছে না। কিন্তু করা উচিৎ। আমি তো হিমাংশুর থেকে বড়। ওকে জোড়হাত করলে আমাকে তো গড় হয়ে নমস্কার করতেই পারে! আসলে আমি বাংলাতে বলছি তো! তাই হয়ত বুঝতে পারছে না। আমি হিমাংশুকে নেপালিতে বলতে রিকুয়েস্ট করবো কি দেখি বাবা আর মা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
এমনিতে আমি দুষ্টুমি করা অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি। সন্ধ্যেবেলায় হোটেলের ঘরে হালকা দুষ্টুমি করছি। আমাদের ড্রাইভার দাওয়া কাকু এসেছে। বাবা-মা কথা বলছে। আমি দাওয়া কাকু যেভাবে ফোনে ‘হ্যালো’ বলে তার নকল করছি। বাবা ঠিক শুনতে পেয়েছে। ইশারায় চুপ করতে বলছে। দাওয়া কাকু শুনতে পেলে কি বলবে? নেপালি আর বাংলা, দুটো ভাষাতেই ‘হ্যালো’ বোঝা যায়। দেওয়ালের দিকে মুখ করে ঠোঁট টিপে হাসতে যাব, অমনি দেখি আমাদের ব্যাগের কাছে একটা শামুকের মত। দেওয়াল বেয়ে উঠছে। আমি চিনি। ওটা তো ‘স্লাগ’। শামুকের মত পিঠে শক্ত খোলটা নেই। ঠিক যেন পিঠে বইয়ের ব্যাগ ছাড়া আমি ইস্কুলে যাচ্ছি। আমি আর বাবা মানসের জঙ্গলে স্লাগ দেখেছি। যে আস্তে আস্তে যায়, কাল সকাল পর্যন্ত বড় জোর বাথরুমের দরজা অবধি যাবে। আর আমাদের লাগেজ, জুতো, ডাস্টবিন যদি ঘেঁটে দেখতে চায় তো হয়ে গেলো। তাহলে, খুব বেশি হলে কাঁচের টেবিলটা অবধি।
সকালে স্লাগটাকে কাঠি দিয়ে নিয়ে উপরে চা-বাগানের রাস্তায় ছেড়ে দিলাম। একটা পাথরের ওপর। ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না। ও পাথর থেকে নেমে চা-বাগান, ঘাস-জঙ্গল, পাইন গাছের মধ্যে হারিয়ে যাবে। ঠিক যেভাবে হামিদচাচা হারিয়ে যায় ঘাসের ভেতর। সামান্য এক স্লাগ – একাকী স্লাগ কত দূর যাবে? চা-বাগানের নিচে যা অন্ধকার, যা হাবিজাবি জঙ্গল, ও বড়জোর এক জীবনে এই চা-বাগানটাই পেরোতে পারবে। আমার মত বয়সা বিলের সন্ধ্যে, মন্ডল দাদুর গোরু কারোকেই দেখতে পাবে না। আর ভুল করে যদি হোটেলের সামনের রাস্তাটা ক্রস করার ডিসিশন নেয়, নির্ঘাত গাড়িচাপা খাবে। ভবলীলা সাঙ্গ। আমি ওর মত স্লো হতে চাই। ওর মত প্রকৃত সামান্য। আচ্ছা, আমি যদি এখন বলি জীবনানন্দ দাশের মত – ‘ধীর পদবিক্ষেপে’ স্লাগ হাঁটবে? কেমন হবে? কিন্তু হায়! ওর তো পা নেই! বুকটা টেনে টেনে নিয়ে যায়। চা-গাছের নিচের সুদূর গভীরে যে ঘাস – তার নিচের অলিন্দ শধু সেই-ই দেখে। সে অলিন্দ ডিঙিনৌকোর নীচের অন্ধকারের মত নিঝুম। অথবা এই কুয়াশায়, ঠান্ডায়, আবছা আলোয় চা-গাছের ডাল একটা একটা করে মন দিয়ে আবিস্কার…. পাতার অজানা খোঁচায় ভয় পেয়ে সেই ডালটাকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে মাখামাখি…. এক জীবনে বড় জোর একটা চা-বাগান।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes