ধারাবাহিক উপন্যাস
মনে রবে কিনা রবে (৭ ও ৮ নং পর্ব)
মোনালিসা ঘোষ
সাত
কদিন পর ঘুম ভাঙল ঘোর ঘোর বিষণ্ণতা নিয়ে। খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, আগডুম বাগডুম ভাবার চেষ্টা করা, কিছু ওষুধ-পত্তর ওষুধ খাওয়ার মত করে গেলা, ঘুমিয়ে পড়া, কখনো বা ওষুধের ঘোরে আর কখনও বা শুধুই অভ্যেসে ঘুমিয়ে গেলে অস্বস্তিকর স্বপ্ন দেখা, এসব ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তার। তার মধ্যে যে বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন এই খোলা চোখের সামনেও নেমে বেড়াতে চাইছে মূর্তিমান বিপদের মতো, তার হাত থেকে মুক্তি পেতে গুটি গুটি রোদ পোয়াতে গেল ভুলোমনা । রোদে নানারকম ছায়ারা খেলা করে বেড়াচ্ছিল । সেখানে সেই বাড়িটার ছায়া দেখা গেল আবার যেটা স্বপ্নে ছিল। একটা বড় পাথুরে বাড়ি। পাথুরে রঙের। বাড়িটা দুর্গের মতো। ভুলোমনার মনে হল, বাড়িটাতে থাকা যায়। শুধু থাকা যায় এমনই না , থাকে সে। বাড়িটার গায়ে কুলুঙ্গির মতো ছোট ছোট জানলা। সন্ধ্যে হলে সে বাড়িটায় হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বেড়ায়। তখন বাড়ির বাইরে থেকে জানলাগুলো অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে আর দূর্গ বাড়িটার জানলাগুলো দিয়ে আলো দেখা যায়। দুর্গের বাইরে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে । সিঁড়ি থেকে শুরু হয়েছে বাড়ির ঝোপজঙ্গলে ভরা জায়গাটা। মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে গেট অবধি। লোহার বন্ধ করা গেট। এক চৌকিদার সেটা খোলা বন্ধ করে। দূর্গটাতে বড়জোর তিন চারজন লোক থাকে। সেদিন স্বপ্নে সন্ধ্যে হয়ে যাবার পর,গোটা পাহাড়ে যখন ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে,তখন জঙ্গল থেকে বেরোলো কিছু বুনো খরগোশ। ভুলোমনা ভয়ে চেঁচিয়ে চৌকিদারকে ডাকল। চৌকিদার সেগুলোকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। রাস্তাটার গায়ে তাদের রক্ত পড়ে থাকতে দেখা গেল। খরগোশগুলোকে যত না ভয় পেয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশী তাদের রক্ত এবং মৃত শরীরগুলোকে ভয় করল ভুলোমনার। শিরশিরিয়ে উঠল তার অন্তরাত্মা । স্বপ্নেই । আর ভীষণ অপরাধবোধ হল তার।
সারাদিন অপরাধবোধটা ভুলোমনার পেছন ছাড়ল না। ভয়ের জিনিস ধ্বংস-প্রাপ্ত হয়েছে। তবু মুক্তি পাচ্ছে না সে। কেন? তখন মায়া গ্রাস করছে মনকে। মায়া!! এই মহা মায়ার ভুলভুলাইয়ার কি শেষ নেই?
সম্ভবত মহা মায়ার কবলে পড়েই মিঠুয়া এককালে জড়িয়ে পড়েছিল ইন্দ্রনাথের সঙ্গে। “হাসছ যে” কথাটা আদ্যপ্রান্ত সেই মহা প্রকৃতির কারসাজি ছাড়া কি ছিল? দুটো শব্দের মধ্যে কি ছিল যে, এমন কিছু রাসায়নিক গোলযোগ ঘটে গেল মস্তিষ্কে, সে ক্রমশঃই ডুবে যেতে থাকল অতলস্পর্শী অস্তিত্ব উৎখাতকারী নিশিডাকের মধ্যে।
কোনো এক জায়গায় ভুলোমনা একবার পড়েছিল মেয়েরা প্রেমে পরে কানে শুনে। শ্রবণেন্দ্রীয়ের মাধ্যমে তাদের আবেগ জাগ্রত হয়। অথচ পুরুষ প্রেমে পড়ে চোখে দেখে। দৃষ্টিসুখ তাদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ।সাধারণত। ব্যতিক্রমের কথা আলাদা। সেই কর্ণ- ইন্দ্রিয় এমন বিশ্বাসঘাতকতা করল, কেবলই মনে হতে লাগল, সবই পূর্বনির্ধারিত।
একদিন ইন্দ্রনাথ ফোন করল রাত এগারোটায়। কি করছ?
– এই রাত্তিরে আমি কি করি? নাচি বোধহয়।
– নাচ জানো তুমি?
– নাহ্ । শিখলাম আর কোথায়? শিখলে নিশ্চয় শিবের রুদ্ররূপের তাণ্ডব নাচতাম। আমার বহুদিনের ইচ্ছে।
– তাই ?
– হ্যাঁ ।
– কি করছ এখন?
আবার প্রশ্ন করল ইন্দ্রনাথ। নিজের দু-হাতের দুটো পাতা উল্টে-পাল্টে দেখল মিঠুয়া।
– এই , বই পড়ছিলাম । আপনি কি ড্রিঙ্ক করেছেন?
– ড্রিঙ্ক ? করেছি। কি করে জানলে?
-মনে হল।
কেন মনে হল? গন্ধ পেলে?
– না ।
ফোনে কি করে গন্ধ পাবো? অদ্ভুত তো লোকটা! স্বগতোক্তি করল মিঠুয়া।
–দেখতে পাচ্ছ তাহলে আমাকে? ”
-না তো।
-আমি দেখতে পাচ্ছি তোমায়। আমি চেষ্টা করলে দেখতে পাই তোমায়? বলব কি পরে আছো?
-নাহ্।
-তাহলে তোমার ঠোঁটটা স্পর্শ করব একবার?
ফোনে আর কি করে স্পর্শ করবে, তাই নিশ্চিন্তে__’ হাঁ’ বলল মিঠুয়া।
-চোখ বোজো তবে?
-কেন?
-চোখ বোজো।
চোখ বুজল সে। আর একটা কম্পমান কিন্তু আত্মবিশ্বাসী চুন্বনের আওয়াজ পেল সে। মুহূর্তেই শিউরে
উঠল কেঁপে কেঁপে। তার একটা মন বলল, এতদূর? আর একটা মন বলল, অদ্ভুত !
দুদিন চুপচাপ। মোবাইল বাজলেই আঁতকে উঠছিল মিঠুয়া। এস.এম.এস.-এর আওয়াজে তার বুক ধকধক করত !
হঠাৎ রাত নটায় ফোন। ড্রাঙ্ক। – – -কি করছিলে ?
-রান্না!
– শোন, রান্না করে কেউ বড় হয় না। বড় হতে গেলে প্রেম করতে হয়। প্রেম ! তুমি তো প্রেম করবে না।তুমি তো প্রেম করবেই না। প্রেম না করলে কি করে বড় হবে, সোনা। আর যদি বড় হতে চাও, স্ক্যান্ডাল চাই, স্ক্যান্ডাল !! কি পাগলের মত বকছে। মনে বলল মিঠুয়া।মুখে বলল, হ্যাঁ।তারপরই হঠাৎ রেগেমেগে ইন্দ্রনাথ ঘোষণা করল, শনিবার তুমি আমার কাছে আসবে।
ঘাবড়ে গিয়ে মিঠুয়া বলে ফেলল, আচ্ছা।
কথাটা হচ্ছে সে ঘাবড়ালো কেন? রোদ পোয়াতে পোয়াতে ভাবল ভুলোমনা। উত্তরটা নিজেই দিল সে।সে ঘাবড়াতে চেয়েছিল বলেই ঘাবড়ালো।
রাতে আবার ফোন।
– আমায় একবার মেরেছিল ভীষণ।
-কে ?
-আমার স্কুলের ফাদার। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি।
-কেন ?
-আ্যালজেবরায় হায়েস্ট পেয়েছিলাম বলে।
-তার জন্য মারবে কেন?
-মেরেছিল আর বলেছিল, আ্যালজেবরা ভীষণ টাফ্ সাবজেক্ট।যে আলজেবরায় ভাল করবে, সে অন্য সাবজেক্টেও ভাল করতে পারে। তুমি অন্যগুলো ইচ্ছে করে ফাঁকি মেরে না পড়ে বাজে নম্বর পেয়েছ। বলেছিল আর মেরেছিল।
-তারপর ?
-তারপর। আমি সেই ফাদার যেদিন মারা যান, সেদিন ক্রিমেশনের সময় পৌঁছোই ।
-তারপর ?
-তারপর আর কিছু নেই। সব গোলমাল হয়ে যায় আমার।
-আপনার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
– আমার জীবনটাই যে জড়িয়ে গেছে গো !
-কেন কথা বলেন আমার সঙ্গে ?
-এক অমোঘ অনিবার্য আকর্ষণে।
অমোঘ শব্দটা চাবুক মারল মিঠুয়াকে। ওরা দুজনেই নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল। যেন বাক্রোধ হল ওদের। মিঠুয়ার কেবলই মনে হতে থাকল, কি অসুখী মানুষ একটা! কিসের অস্থিরতা মনে? সে কেবলই আঁকুপাঁকু করল আর চতুর্দিক হাতড়ে বেড়াল। যেন কি যেন একটা জিনিসের দরকার ছিল, সেটা পাওয়া গেলেই ইন্দ্রনাথকে ধরিয়ে দেবে ও। আর ইন্দ্রনাথের মন প্রশান্তিতে ভরে যাবে।
এসব সেই মায়া নামক মহামায়াবী বস্তুটার মহা খেলা ছিল না তো কি ? সে ছিল ত্রীড়নক মাত্র। হয়ত তার ঘাড় ধরে কিছু শেখাতে চাইছিল সেই চৈতন্যময়ী।
মিঠুয়ার একটা মন বলছিল, মুখ ফেরাও। অন্যদিকে তাকাও। আর একটা মন বলছিল, বিশ্বাস করি না ওকে, কিন্ত ফিরে আসব কি করে? এ যে ভবিতব্য। অতএব, অপ্রতিরোধ্য সেই ভবিতব্যের কবলে পড়ে ছারেখারে যাচ্ছিল মিঠুয়া একদিন।
ঘাসের ওপরে হাত বুলোলো ভুলোমনা। এখনও শিশিরভেজা হয়ে আছে ঘাস। কি মায়াময়! ঘাসগুলোয় আঁকিবুঁকি কাটল সে। একদিন এক ভয়ানক ঘটনা ঘটেছিল। সে এমন ঘটনা যার বরাতে ঘটে সেই বোঝে। সে বুঝেছিল বৃন্দাবনের শ্রীরাধিকা। কারণ তার বরাতে ঘটেছিল।
ঘটনাটা খুব সাধারণ, আকছার ঘটার মত একটা ঘটনা। দিনরাত এই পৃথিবীতে কারুর না কারুর সঙ্গে ঘটছে। আর যার সঙ্গে ঘটছে, সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।মিঠুয়াও পেয়েছিল।
ইন্দ্রনাথ তার নানান বন্ধুবান্ধবের কথা বলত। তার নাকি কাঁড়ি, কাঁড়ি বন্ধু-বান্ধব আর রাশি রাশি বান্ধবী। সেই সব বান্ধবীরা সবাই ইন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রেম করতে পারলে বাঁচে।
ইন্দ্রনাথের আবার নাকি প্রেম হয় না সহজে।কিন্তু ইন্দ্রনাথ তার বন্ধুদের সঙ্গে মিঠুয়ার আলাপ করাত না বড় একটা। একবার কি একটা নাটক দেখতে গেছিল। সারাক্ষণ হাইপার ভিজিলেন্ট হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বসেছিল। যখন নাটক চলছিল না,কে ঢুকছে আর কে বেরোচ্ছে উদ্গ্রীব হয়ে তাই লক্ষ্য করে বসেছিল । বুঝেই উঠতে পারছিল না, সে সহজ
স্বাভাবিক কেন নেই ! যত দেখছিল সে ইন্দ্রনাথকে, বিরক্তি উদ্রেক হচ্ছিল। গোটা সময়টাই একটা অস্বস্তিকর অমনোযোগী সময় ছিল সেটা। সারাক্ষণ ধরে ইন্দ্রনাথ ছিল অমনোযোগী আর সারাক্ষণ ধরে অস্বস্তিতে ভুগছিল মিঠুয়া।
একদিন শান্তনুদার বাড়িতে গেল মিঠুয়া। শান্তনুদার বাড়িতেই প্রথম দেখা হয়েছিল মিঠুয়ার ইন্দ্রনাথের সঙ্গে। মিঠুয়ার এক দাদা সৌমিত্র মিঠুয়াকে নিয়ে শান্তনুদার সঙ্গে আলাপ করিয়েছিল। শান্তনুদা ছিল সহৃদয়
মানুষ। তার বাড়িতে নানারকম লোকের আনাগোনা ছিল। ফিল্মমেকার, লেখক, কবি, নাট্যকার এইরকম অনেকের। কারণ শান্তনুদার প্রয়োজন ছিল কিছু মানুষের। যারা সে যা কথা বলতে চায়, সেই কথাগুলো যতই বোরিং লাগুক শুনবে ধৈর্য্য ধরে। বিনিময়ে শান্তনুদা তাদের ভালই আপ্যায়ন করত। যেদিন মিঠুয়া প্রথম যায়, সেদিন গাদা গুচ্ছের লোক বসেছিল। আর ভয়ঙ্কর রকম শুঁটকিমাছের গল্প চলছিল।
শিতল শুঁটকি বাজারে নাকি ন’শো টাকা কেজি। বাংলাদেশ থেকে আসছে। গরীব-গুর্বো, মানে একটু কমা টাইপের একটা লোক সেখানে বসে ফুক ফুক করে সিগারেট ফুঁকছিল। তার নাম…তার নাম…ভবানী। ভবানী
কাঁচুমাঁচু মুখ করে বলল, একটা কথা বলব? কোনদিন খাইনি, একটু দেবেন, খেয়ে দেখব?
তাই শুনে সবাই হাসল। কেন হাসল, মিঠুয়া বুঝতে পারেনি।কিন্তু ইন্দ্রনাথ হাসতে হাসতে তাকে জড়িয়ে ধরল। সেটা চোখে পড়ল মিঠুয়ার আর মনে রয়ে গেল ।
হ্যাঁ । সারাজীবনের জন্য । কারণ আ্যামনেশিয়ার পরও দিব্যি মনে আছে দেখা যাচ্ছে।
মিঠুয়ার মনে হল, লোকটা মানে ইন্দ্রনাথ লোকটা( তখনও ইন্দ্রনাথকে চিনত না মিঠুয়া) অবশ্যই সহৃদয়।
এই ঘটনাটার কোথায় যেন ছবি উঠে গেল, ক্লিক, ক্লিক , ক্লিক ।
পরবর্তীকালে ইন্দ্রনাথের বিভিন্ন কান্ড-কারখানায় যখন ইন্দ্রনাথকে আদ্যপ্রান্ত আত্মসুখী স্বার্থপর মানুষ ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না, তখনও এই শুঁটকিমাছের এপিসোডের দৌলতে মিঠুয়ার কোথাও একটা গাঢ় বিশ্বাস
রয়ে গিয়েছিল, মনের গভীর অতলে ইন্দ্রনাথের মধ্যে একটা ভালো মানুষের প্রবণতা লুকিয়ে আছে, যা কোন না কোনদিন প্রকাশিত হবে। আর যদি প্রকাশিত নাও হয়, তবুও সে যথার্থই ভাল লোক, কারণ, যাবতীয় দুষ্টুমি,
নষ্টামি স্বার্থপরতা, তার অপরাধবোধকে উসকে দেয়, সে নিদারুণ কষ্ট পায়, কোথাও যেন। সেগুলো ড্রাঙ্ক অবস্থায় উগরে উঠে আসে অসহায়তার মোড়কে ।
ভাবতে ভাবতে ভুলোমনা আবিষ্কার করল, সে এখনও নির্ঘাতভাবে বিশ্বাস করে ইন্দ্রনাথ একজন ভালো লোক। ইন্দ্রনাথকে ভালো ভাবতে ভাবতে ঘাসের ওপর বসে বসে রোদ পোয়াতে তার ভালই লাগল। কিন্তু তার শরীরের হাড়গোড় গুলো আটকে আটকে যাচ্ছিল। নড়াচড়া করা দরকার ভেবে ভুলোমনা উঠে দাঁড়াল।
গুরুংদের কাউকেই এদিক-ওদিক দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তারা নির্ঘাত হাত-পা চালিয়ে ভীষণ সব কাজেকর্মে ব্যস্ত। এরা কখনও শীতে জবুথবু হয়ে বসে থাকে না। এদের বুড়োরাও নয়। সব সময় নড়াচড়ার মধ্যে থাকে। ফলে এদের শীতে ধরে না। হাত-পা ছাড়াতে ছাড়াতে ভাবল ভুলোমনা, যত শীতে যেন ওকেই ধরে, শীতে ধরে যত , তত ঘুমেও ধরে।কাঁড়িখানেক ওষুধ খেতে হয় রাতে। মূর্তিমান আপদ ওগুলো। দূর হ।
ডিসোসিয়েটিভ অ্যামনেশিয়া !! মুখ ভ্যাংচালো ভুলোমনা নিজেকেই। জুতো মারি এমন আ্যামনেশিয়ার মুখে।
মাথার মধ্যে যেন চোকলা করে করে চুল উঠে টাক পড়েছে। কিম্বা গালের মধ্যে গোল গোল ছুলি হয়েছে।
এমনি হল গিয়ে ব্রেনের মধ্যে আ্যামনেশিয়া । কিন্তু, মুশকিল হল, কে ভুলে গেছে? ভুলে গেছে ভুলোমনার মন।
কেউ তো কখনও বলে না ব্রেন ভুলে গেছে। কষ্ট যখন কেউ পায় তার মনই তো কষ্ট পায়। কষ্ট পায় বলে ব্রেনের নিউরনগুলোর থেকে কিছু বিশেষ নিউরো ট্রা্ন্সমিটার বের হয়। ব্রেন থেকে কেমিক্যাল বেরোল বলে মনে দুঃখ হল এমন কি হয় ? তবে, ব্রেনে কিছু ঝামেলা হয়েছে বলে ডাক্তার তাকে কেন মুঠো মুঠো ওষুধ খাওয়াচ্ছে? ঝামেলাটা মনে হয়েছে না ব্রেনে হয়েছে এই নিয়ে সাতসকালে ভুলোমনা ভীষণ ঝামেলায় পড়ে গেল।
ব্রেন আর মন কি এক? মন কোথায় থাকে? মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার স্থুলদেহ পড়ে থাকে। স্থূল দেহই গিয়ে মেশে পঞ্চভূতে । কিন্তু মন যাকে যোগীরা বলেন, সূক্ষ্মশরীর তা নাকি সঙ্গে যায়। এইজন্যই যোগীরা চেষ্টা করলে পূর্বজন্মের কথা মনে করতে পারেন । রিমপোচে পারে। রিমপোচে জানে, তার আগের আগের আগের জীবনের কথা। এরকম তার কত জন্মের কথা রিমপোচে জানে ? আর ভুলোমনা কোন পাপে এ জন্মের কথাই ভুলে মেরে দিল তবে। কে ভুলে গেল? তার মন ? না তার ব্রেন ? ব্রেনকে তবু কতক আন্দাজ করা যায় !সে আছে ! সে যে আছে, তাকে যুক্তি বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয় দিয়ে বোঝা যায়, মাথার খুলি খুবলে দেখা যায়। কিন্তু মনকে দেখা যায় না। অথচ মন দিয়ে একজন আরেকজনের মনকে স্পর্শ করে। মন দিয়েই তো ইন্দ্রনাথ তাকে ধরেছিল ! মন দিয়েই ইন্দ্রনাথ তাকে গভীর আনন্দ দিয়েছিল, মন দিয়েই চরম দুঃখে ইন্দ্রনাথ তাকে ছুঁয়েছিল।
আবার তার মন নিয়ে ইন্দ্রনাথ অসংখ্য বার অর্বাচীনের মত….চূড়ান্ত নির্মমের মত খেলা করেছিল। যদি কথাটা এরকমভাবে বলা যায় যে ইন্দ্রনাথ তার ব্রেন নিয়ে খেলা করেছিল আর ব্রেনে কষ্ট দিয়েছিল, তবে সেটা কেমন
মজাদার বল লোফালুফির মত মনে হবে না ?
ভীষণ হাসি পেল ভুলোমনার। তাহলে ব্রেনে যদি কষ্ট না পেয়ে থাকে সে, আর কষ্টটা যদি মনেই পেয়ে থাকে, যার রেজাল্ট হল ট্রমা, স্ট্রেস, বার্ন আউট এবং ফাইনালি,
অ্যামনেশিয়া তাহলে ব্রেনের জন্য খামোখা এতগুলো ওষুধ সে খাচ্ছে কেন ?
গুড কোয়েশ্চেন। নিজের মনে নিজেকেই বলল সে। এর ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে।
এত কিছু খুঁজতে হবে কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করল সে।
খুঁজতে চাই বলে ?
খুঁজে পাবে ?
চেষ্টা চলুক ।
বেশ চলুক।
কতদিন ধরে চলবে এই চেষ্টা !
যতদিন না খুঁজে পাই।
অনন্ত অবসর থাকুক, কাজকম্ম থাকুক, দায়দায়িত্ব মাথার ওপর চিলের মতন চক্কর খাক , পাক মেরে মেরে নেচে যাক সুখ-দুঃখ, কান্নাহাসির মত দৈনন্দিন জীবনের হতচ্ছাড়া বিষয়গুলো , অসুখ-বিসুখ এবং সেরে ওঠা,
সেরে ওঠার পর আবার অসুখ এবং বিসুখ চলতে থাকুক মূর্তিমান উপদ্রবের মত, কিন্তু খোঁজা চলতে থাকুক বিরামহীন অবিরত।
কিন্ত নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ভুলোমনার মধ্যে থেকে। সে বলল, আর কতদিন?
সত্যিই আর কতদিন? প্রশ্নটা একটা বড়সড় বিদ্যুৎ ফলার মত আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল যেন। চতুর্দিক থেকে রোদ চলে গেল। একে একে মেঘ জমতে শুরু করল। যেন আজ মেঘেদের বিশেষ জমায়েত আছে। পঞ্চায়েত গুরুতর মিটিং ডেকেছে। ক্রমে মেঘ কালো হতে শুরু করল। কালো এবং গম্ভীর। দুশ্চিন্তায় ঘন হয়ে
এল মেঘের মুখ ! এত গভীর ছাইরঙা কালো হল সে রঙ, এখুনি যদি বৃষ্টি হয়ে ঝরে তারা না পড়ে যায়, জমে থেকে থেকে একসময় সে পাহাড় প্রমাণ ভারী হয়ে উঠবে আর বিস্ফোরণের মত ফেটে পড়বে প্রকৃতির বুকে।
ভুলোমনা দেখল, তার সামনে মেঘ, পেছনে মেঘ, ডাইনিং হলের লাগোয়া কলতলায় যেখানে বসে বাসন মাজে ঝি, সেই জায়গাটা ভ্যানিশ হয়ে গেছে। তার নাক, চোখ, মুখ দিয়ে ঢুকে পড়ছে মেঘ। মেঘ ঢুকে পড়ছে তার মাথার খুলির ভেতরে, যেখানে রয়েছে ঘিলু। ঘিলুর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে মেঘ। আর আরও বেশী করে সব কিছু ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে তার মাথার মধ্যে। ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যেন। রাস্তাটাই ভ্যানিশ, গোটা পথটাই মেঘ কবলিত আজ, সে তবে ফিরবে কিভাবে? কি যেন সব মনে পড়ার কথা ছিল, কিন্তু সব গভীর ধোঁয়ার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে এক এক করে। সে পাগলের মত হাত নাড়াল। চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে চাইল আরও কিছু মেঘ। হাতের আন্দোলনে কিছু সরে গেল, তার জায়গা ভরাট করে নিল অন্য কিছু মেঘ।
ভুলোমনা তড়বড় তড়বড় করে উঠতে লাগল, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ি বেয়ে সে পড়ল বারান্দায়।
বারান্দার কাঠের পাটাতনে শব্দ উঠল ঢ্যাব্ ঢ্যাব্। বারান্দা পেরিয়ে গেট পেরিয়ে সটান ঢুকে এল সে রিমপোচের ঘরে। রিমপাচে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। একজন দুঃখী মানুষ মনে হচ্ছিল তাকে। চোখ খুলে ভুলোমনাকে দেখতে পেয়ে তাকালেন তিনি। তাকালেন আর চেয়ে রইলেন। স্থানুর মত প্রস্তুরীবৎ হয়ে ঠায় চেয়ে রইলেন।
চেয়ে রইল ভুলোমনাও।
ঠোঁট সামান্যমাত্র না নাড়িয়েই মনে মনে ভুলোমনা রিমপোচেকে বলতে থাকল।
– যেদিন প্রথম ‘হাসছ যে’-এই কথাটা আমাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল, সেদিনই সম্ভবতঃ আমার বারোটা বেজে গেছিল।
কথাটা রিমপোচেকে বলার পরই তার মনে হল, রিমপোচে একটা প্রস্তরবৎ মূর্তিমাত্র যার নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা, তাও পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। রিমপোচে উপলক্ষ মাত্র। কিন্তু বমির মত করে মনে পড়ে যাওয়া কথাগুলো বমি করা দরকার। কোথায়? এই কার্পেটপাতা, নানা রকমারি জিনিসে ভর্তি ঘরের মধ্যেই। সামনে বসে থাকা এই মানুষটা মহা কৃষ্ণগহ্বর স্বরূপ হয়ে শুষে নেবে। আর একবার শুষে নিলেই ভুলোমনার আর কোনো দায় থাকবে না, কথাগুলো বয়ে বেড়ানোর। সে ভারমুক্ত হয়ে যাবে। এখন দারুণ বদহজমের সময়। তার এই কথার বদহজমে প্রকৃতিও ঘোরতর শ্বাসরোধী কৃষ্ণবর্ণ হয়ে উঠেছে। বিপদ আসছে…বিপদ।
এক মহাবিপদের হাতে
উলটপালট খেতে খেতে এদিক-ওদিক আছাড় খেয়ে পড়তে চাই না। বাঁচতে হবে। আমি বাঁচব।
ঘোর প্রত্যয়ের সাথে একথা নিজেকে বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে পড়তে লাগল-সেদিন ইন্দ্রনাথ অফিস বয় ছোকরাটাকে দিয়ে পঁচিশবার দরজা বন্ধ করাচ্ছিল এবং খোলাচ্ছিল।
-যাও, এটা জেরক্স করিয়ে আনো। আর শোনো যাবার সময় দরজাটা খুলে দিয়ে যাও।
– এনেছো জেরক্স করে? এবার এটা টাইপ করো ওঘরে বসে , আর দরজাটা বন্ধ করে দাও।
যত বার এই দরজা খোলা বন্ধের ঝকমারি ঘটছিল, এবং এত বেশিবার সেটা ঘটছিল, ততবারই ভুলোমনার সন্দেহ হচ্ছিল ইন্দ্রনাথের মনের মধ্যে কি যেন উঁকিঝুঁকি মারছে। কারণটা, যাইহোক এটা খুব স্বাভাবিক নয়। ইন্দ্রনাথ যেন অতিরিক্ত সচেতন হয়ে আছে যে, সে একটা মেয়ের সঙ্গে একা একটা ঘরের মধ্যে বসে আছে।তার বিরক্ত লাগা উচিত নাকি হাসি পাওয়া উচিত এই নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিল সে।
পরবর্তীকালে যখন ইন্দ্রনাথকে এই কথা বলেছিল সে, ইন্দ্রনাথ তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল।
– আপনি বেশ ঝামেলার মধ্যে ছিলেন।
-না, না। বাইরের দরজাটা যাতে দেখতে পাই, তাই আমি দরজা খুলে দিতে বলছিলাম। তোমাকে নিয়ে একা অফিসে বসে থাকার অস্বস্তিতে নয়।
-ও, তাই বুঝি।
নাহ্। মিঠুয়ার সিদ্ধান্তটা বদলায়নি।
সেসব দিনে ইন্দ্রনাথের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ইন্দ্রনাথকে সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা। এমনকি যখন দূরে থাকত, তখনও মিঠুয়া ইন্দ্রনাথের নীরবতাকে পর্যবেক্ষণ করত। যেন এক মজার টাইম পাস শুরু হয়েছে; যেটা আসলে একটা গোটা জীবনের পক্ষে একটা কাজের মত কাজ।
এইসব দিনে ইন্দ্রনাথ ওর বান্ধবী সর্বানীকে নিয়ে আদিখ্যেতা করত। একদিন মিঠুয়া শুনল, সর্বানী একটা টয়োটা না কি, দামী ধরণের গাড়ি কিনতে চায়। সেটা কেনার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করছে ইন্দ্রনাথ।
-আপনি কেন? ওর বর নেই?
-আছে।
-তবে, সে মাথা ঘামালেই তো পারে।
-সে, এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।
-আপনি বুঝি খুব করিৎকর্মা, এসব ব্যাপারে।
-অফ কোর্স।
ইন্দ্রনাথের সঙ্গে গাড়ি করে যাচ্ছিল মিঠুয়া। এমন সময় সর্বানীর ফোন এল। কিসব কথা বার্তা বলল। ইন্দ্রনাথ বলল, -হ্যাঁ, তাহলে বিকেল চারটে নাগাদই ফিক্স রাখো।
-আমার? তুমি যদি একটা সানগ্লাস দিতে পারো ভাল হয়৷
মিঠুয়া এত ভীষণ তাজ্জব হয়ে গেল। ইন্দ্রানাথ যে প্রচুর ভালবাসা, বন্ধুত্ব এসব নিয়ে বড় বড় লেকচার ঝাড়ে , এটা তাহলে কি হচ্ছে ! এই গাড়ি কিনিয়ে দেবার হ্যাপা পোয়ানোর জন্য সানগ্লাস? বড় কটকট করে লাগছে চোখে ঘটনাটা।
ছোটো থেকে শেখা এক কাঁড়ি জ্ঞানগমি পুরো পল্টন বেঁধে সার সার দাঁড়িয়ে গেল। কাউকে উপহার করে, বিনিময়ে কিছু আশা কোরো না। তখনই ,যারা এসব জ্ঞান বিতরণ করেছিল , মিঠুয়ার তাদের ওপর ঠাঁই করে রাগ হয়ে গেল। তারা ছিল মিঠুয়ার বাড়ির লোকেরা। আর তখনই তার মনে হল, কারুর উপকার করে বিনিময়ে কিছুই আশা করব না , নিদেন পক্ষে ভালবাসাটাও না, এত উদার ও সহ্যশক্তি সম্পন্ন তারাও ছিল না। তারা হয়ত ইন্দ্রনাথের মত নির্লজ্জ হয়ে সানগ্লাস চাইত না। কিন্তু তার ছিল হিপোক্রিট।
ইন্দ্রনাথটা হিপোক্রিট। আদিখ্যেতা করে বলে একরকম, আর করে আরেকরকম। ঠুসো মেরে দাঁত ভেঙে দিতে হয়। মিঠুয়ার ভেতরে আঁকুপাকু করে ,’ আমাকে বের কর আমাকে বের কর’ , বলে কুঁই কুই করছিল একটা শব্দ। শাল্লা।শব্দটাকে মিঠুয়া কোঁৎ করে গিলে ফেলল, কারণ আর কিছু না, ওই যত নষ্টের গোড়া সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞানগর্ভ বাতেলাগুলো, ছোটবেলা থেকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে। শাল্লা শব্দটা মুখ থেকে বার করলেই ব্যাটারা চোখ পাকিয়ে নির্ঘাৎ বলে বসত, কি অবনতি ! তোমার রুচিতে বাঁধলো না? চেপে গেল মিঠুয়া।
আরেকদিন ভীষণ হা-হা রবে হাসতে দেখল মিঠুয়া ইন্দ্রনাথকে ফোনে। এত হাসির কি আছে?
-ইনি যিনি ফোন করেছিলেন, ইনি একজন এম.এল.এ। আমাকে খুব স্নেহ করেন।
মিঠুয়া ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়েছিল ইন্দ্রনাথের দিকে। স্নেহ করার আবার কি হল? এম.এল.এ জাতীয় লোকেরা আবার স্নেহ করতে জানে নাকি, ধান্দা ছাড়া?
-ওহ্ ! কিরকম স্নেহ ?
এই ধর, হঠাৎ আজ আমার পঞ্চাশ হাজার টাকার দরকার হল, ইনি দিতে পারেন আমাকে।
ইন্দ্রনাথ স্নেহ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত নাকি, সেই জনৈক ব্যক্তির ক্ষমতায় মুগ্ধ, গণ্ডগোল হয়ে গেল মিঠুয়ার।
-ও।
হ্যাঁ, শুধু ‘ও’-ই বলেছিল মিঠুয়া, ভাবল ভুলোমনা।
আর তারপরই ইন্দ্রনাথের জন্মদিন এসে গেল। মিঠুয়া মনে মনে চাইল ইন্দ্রনাথ তার সঙ্গে সময় কাটাক।
আর ইন্দ্রনাথ কত বন্ধু-বান্ধব তাকে নিয়ে মাথায় তুলে নাচছে আর কারা সব তার বাড়িতে সন্ধ্যেবেলা খেতে আসছে, তাই জানাল। তাদের কারুর নাম সে জানাল না। সাধারণত, সে নাম জানাত না। মিঠুয়া প্রশ্ন
করত ,
-ওনার নাম?
তখন নেহাতই বাধ্য হয়ে বলার মত করে ইন্দ্রনাথ তার নাম জানাত। সবসময়ই সে আধ্যাখ্যাঁচড়া ইনফরমেশন দেওয়া পছন্দ করত। আর সবসময়ই সে কিছুটা ইনফরমেশন চেপে রেখে দিত।এগুলো হল গিয়ে তার ধাত, ভাবত মিঠুয়া। কিন্তু উদ্দেশ্যগুলো পরিষ্কার হত না, তার কাছে।
জন্মদিনে নেমন্তন্নের বহর ভালই হবে হয়ত। এমনটা ভাবল সে আর তার সঙ্গে ঘোরতরভাবে এটাও পরিষ্কার হয়ে গেল, সেই আনন্দযজ্ঞে তার নিমন্ত্রণ নেই।
কাঁদতে লাগল সে। অসহ্য ক্রোধ আর অসহায় কান্নায় মাখামাখি হয়ে সে বলল ইন্দ্রনাথকে , নকল নিয়ে পড়ে আছেন আপনি, আসলের কি বুঝবেন? আপনার কাছে তো ওইসব বাজে এম.এ.ল-রা জরুরী যারা কথায় কথায় আপনাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে পারে। আপনি ভাবেন, এরা সব আপনাকে ভালবাসে !
আপনমনে কাঁদতে লাগল মিঠুয়া।
খুব কাতর গলায় ইন্দ্রনাথ বলল, কেঁদো না, আজকের দিনে কাঁদতে নেই।
কতগুলো কথা আবার গিলে ফেলল মিঠুয়া। কেন আজকের দিনটা কি? আপনি কোন মহাপুরুষ জন্মেছেন বলে কৃতার্থ হয়ে থাকব? কি ন্যাকা রে বাবা! বেশ করব কাঁদব। আমার ইচ্ছে, আমি কাঁদব। দূর হোন, মূর্তিমান
বাজে লোক একটা।
এতগুলো-কথার কোনটাই তার মুখ দিয়ে বেরোলো না। বরং সে ফোন ছেড়ে উপুর হয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। কি ঘোরতর ছিল সেই উপেক্ষা ! কি ঠাণ্ডা নির্মমতায় মোড়া। আর কি নিদারুণ সেই দুঃখবোধের আচ্ছন্নতা। নিজের মনে মিঠুয়া বলতে লাগল ইন্দ্রনাথ অজ্ঞান। ওর ধারণা নেই, কি বোকামি ও করছে। ওকে
ক্ষমা করাই উচিত। কিন্তু মহান যিশুখ্রিস্টের মত, সে কিছুতেই ক্রুশবিদ্ধের মত হৃদয় যন্ত্রণায় মরতে মরতে বলতে পারল না, প্রভু, ওরা জানে না, ওরা কি করছে। তুমি ওদের ক্ষমা করে দাও।
তার বদলে সে একটা সময় উঠে দাঁড়াল, এই ভেবে যে, ইন্দ্রনাথ শিতল শুঁটকি খেতে চাওয়া লোকটাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তাই কোন না কোনদিন ওর হৃদয় সত্যের অনুসন্ধান করবেই করবে। মিঠুয়া বরং সেদিনের জন্য অপেক্ষা করবে।
তখন শুরু হল এক বিরাট অপেক্ষা, যার জন্য নিজেকে বাজী ধরল মিঠুয়া। তবে, এরপর থেকে জন্মদিনগুলো ভুলে যেতে থাকে সে। প্রায় সকলেরই। যাদের যাদের সে চিনত। নিজের জন্মদিনটাকে ঘোরতর বিচ্ছিরি বলে মনে হত ওর। কোন পদের দিন ছিল না ওটা, এরকমই বলত ও নিজেকে।
এইসময় একদিন ইন্দ্রনাথের সঙ্গে পার্কে বেড়াতে যায় ও। সেইসময় ইন্দ্রনাথের স্ত্রীর একটা ফোন আসে।
ইন্দ্রনাথ খুব অধিকারের সঙ্গে তাকে প্রশ্ন করে, কোথায় যাচ্ছ? তারপর বলে, শরীর খারাপ? এই প্রশ্নটা সে দুবার করে। মিঠুয়া জিজ্ঞেস করে, ওনার কি হয়েছে? ওনার দু-মাস আগেই হিস্টেরেকটমি হয়েছে। মিঠুয়ার মনে হল,এই কথাটা ইন্দ্রনাথ তো ওকে বলেনি! কি আশ্চর্য! সেদিন নানা কথার মধ্যে দুজনে হাঁটছিল অনেকটা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে। তখন ইন্দ্রনাথ ওর হাত ছুঁচ্ছিল-বারবার। ধরার জন্য ! মিঠুয়া দিচ্ছিল না। এরকম ঘোরাঘুরির পর ইন্দ্রনাথ গাড়িতে উঠল। মিঠুয়া বলল, -আপনি কি চান?
ইন্দ্রনাথ বলল, সেটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলার দরকার আছে?
-আছে।
-কেন?
-আমি জানতে চাই, কিসের অভাব আপনি পুরণ করতে চাইছেন? ঠিকমত ভালবাসা পাননি জীবনে?
-পেয়েছি। আবার পেতে চাই। এতে অন্যায়টা কোথায়?
-আপনার স্ত্রী আছে, সে কি করবে?
-সেও থাকবে। তুমি আর আমি যদি দুজনে ভালবাসি, তাহলে তাদের সঙ্গে ভালবাসার, কর্তব্যের, দায়িত্বের বিরোধ নেই।
-কেউ মেনে নেবে না।
-জানবে না।
-জেনে ফেলতে পারে। এসব যেন কি করে জানাজানি হয়ে যায়।
-মনে হয় না।
-কিন্ত…
-বল?
-এটা একটা ঠকানোর মত কাজ না?
-না।
এটা নিজের একটা ব্যক্তিগত জীবন নিজের মধ্যেই রাখা।
মিঠুয়া চুপ করে রইল।
তার কেন যেন মনে হতে লাগল, এভাবে দুজনকে সমান সমান ভালবাসা যায় না। কোন একজনের প্রতি ভালবাসাটা কম কম হয়ে যায়। সম্ভবত, সেটা পুরনোজনের প্রতিই হয়।
সে দোনামনা করে ইন্দ্রনাথকে বলল,
-আমার মনে হয়…আমার মনে হয়…
– বল…
-আপনি আমাকে নষ্ট করবেন।
গাড়িটা সাইড করে দাঁড় করানো ছিল। ইন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে জানলার কাঁচ তুলতে শুরু করল আর মিঠুয়া প্রমাদ গুণলো । মিঠুয়া বুঝতে পারল ইন্দ্রনাথ কি করতে চলেছে! কিন্তু সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
ইন্দ্রনাথ প্রথমে তার গালটা চেপে ধরল। তারপর আরেকটা হাত দিয়ে কাঁধটা জড়াল। কাঠ হয়ে গেল মিঠুয়া। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ঘাড়টা শক্ত করে মুখ ঘুরিয়ে নিতে চাইল অন্যদিকে। কিন্তু ইন্দ্রনাথ জোর করে টেনে নিল মুখটা। পেরেও গেল। এবং আর কোথাও নয়, শুধু কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল, ভয় পেয়ো না।
আমি নষ্ট করব না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ইন্দ্রনাথ! আর মিঠুয়ার ইচ্ছে হল, ইন্দ্রনাথ কাঁধের ওপর এলিয়ে পড়ে। কিন্তু তার ওই জ্ঞানদায়ী মনটা মূর্তিমান বেয়াক্কেলের মত বলে উঠল, উঁহু উঁহু। হাউ ডেয়ার ইজ হি টাচিং
ইউ? ওর বোঝা উচিত, তোমাকে ছোঁয়া যায় না। তোমাকে ছুঁলে হাত জুলে যায়। ওর বোঝা উচিত এসব। তখন ইন্দ্রনাথ মিঠুয়াকে বলল, হাসো।
মিঠুয়া হাসতে পারল না। একটা উচিত হয়নি, উচিত হয়নি বোধ তাকে ভয়ানক জ্বালাতে লাগল। সে দুশ্চিন্তায় ডুবে গেল। আর দরজা খুলে নেমে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল, একবারও পেছন না ফিরে।
সেদিন রাতে ফোন করল ইন্দ্রনাথ । মিঠুয়া বলল, ব্যস্ত আছি ।ইন্দ্রনাথ ফোন ছেড়ে দিল। মিঠুয়ার মনে হল, ইন্দ্রনাথ যদি জোর করে নিজেকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করত, এর চেয়ে ঢের ভাল হত। কিন্তু মিঠুয়া যেমনটা চায়, যেমন ব্যবহার করলে ঠিক ঠিক ভালবাসা হচ্ছে, বলে মিঠুয়ার মনে হবে, তেমনটা ইন্দ্রনাথ কখনই করে না। পরদিন সে ইন্দ্রনাথকে ফোন করে জানাল, আমাকে সেই শুধু স্পর্শ করবে, যে আমার হাজব্যান্ড হবে, এমন আমার ইচ্ছে। আমি চাই না অন্য কেউ আমাকে স্পর্শ করুক !
নিমেষে ইন্দ্রনাথ বলল, এরকম শারমন দেওয়ার মত করে কথা বলছ কেন?
মিঠুয়া চুপ করে রইল।
ইন্দ্রনাথ বলল, তুমি তোমার শরীরকে পিওর রাখতে চাইছ। তোমার মনের পিওরিটির কি হবে? বাঁচাতে পারবে তোমাকে আমার হাত থেকে?
গভীর রাতে ইন্দ্রনাথ ফোন করল আবার। বলল, আমি তোমার প্রতি এত বেশী প্যাশন অনুভব করি, মনে হয়, তোমাকে জড়িয়ে আমার শরীরের মধ্যে সম্পূর্ণ মিশিয়ে ফেলি।পরশু এসো শান্তনুদার বাড়ি। দেখা হবে।
শান্তনুদার বাড়ি যাওয়ার দিনটা ছিল ঘোর দুর্যোগের দিন। কি কারণে যেন ইন্দ্রনাথ ব্যাজার মুখে বসেছিল। দেখে মনে হচ্ছিল ওর কিছু ভাল লাগছে না। বাইরে বারান্দায় কৌশিক ওকে বোঝাচ্ছিল শোন, তুই খেয়াল রাখিস। তুই একরাশ হাঙর কুমীরের মুখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। এরা সবকটা ধান্দাবাজ। বেকায়দায় পেলেই তোকে খাবে। সাবধানে থাকিস। আসলে এই লেখালেখির লাইনটাই এরকম। এখানে শোয়াশুয়ি ছাড়া কিচ্ছু নেই।
-কেন বলত ?
-দেখছিস না, মেয়ে দেখলেই এরা কেমন খাবলাতে চায় ?
-কাকে খাবলেছে ?
-সকলের খাবলানোর পার্টিকুলার লোক আছে। তাছাড়াও অন্য কাউকে পেলে চুপচাপ খানিকটা খেলে নেয় ।
-কার কার পার্টিকুলার লোক আছে?
-সকলের।
-ইন্দ্রনাথ ?
মাথা নাড়ল কৌশিক, ইতস্তত হেসে।
-কে?
-নাম বলব না। জিজ্ঞেস করিস না।
কি করে ?
নানারকম কাজ আছে তার ?
-সে আবার কি ?
-হ্যাঁ , গেস্টহাউস চালায়। ইন্টিরিয়র ডিজাইনিং-এর কাজ করে।
-লিপি ?
আবার মুচকি হেসে সম্মতি জানাল কৌশিক।
রাশি রাশি মেয়ের ভিড়ে মাত্র একবার ছোট্ট একটা প্রসঙ্গে লিপির কথা উল্লেখ করেছিল ইন্দ্রনাথ। খুব সামান্য। যেন কিছুই না। অফিসের কাজে কিছু গেস্ট এসে যেখানে আছে , সেখানে যাচ্ছি।
-কোন গেস্ট হাউস?
-আছে একটা, নিউটাউনের দিকে।
-কাদের ?
-এটা লিপি মিত্র নামে একটা মেয়ে চালায়।
এটুকুই। কোনো আদিখ্যেতা নেই। প্রেম প্রেম ভাব নেই। কিছু না।
সেই লিপি !
মিঠুয়া ঘরে ঢুকে সকলের সামনে ইন্দ্রনাথের দিকে তাকায়। ইন্দ্রনাথ ওমনিই গুমসুম হয়ে আছে। কাল রাত্তিরের ফোনটা কি মিথ্যে ছিল? হতে পারে না ! একদিন হ্যাং-আউটে বসে আইমসক্রিম খাচ্ছিল মিঠুয়া।ইন্দ্রনাথ খাচ্ছিল কফি। চামচেটা রাখল মিঠুয়া।ইন্দ্রনাথ তুলে নিল সেটা। আইসক্রিম নিয়ে চামচেটা মুখে পুরল ।
ইন্দ্রনাথ মিঠুয়ার দিকে তাকিয়ে। যেন চামচেটা নয়। মিঠুয়ার জিভটাকে মুখে পুরেছে ইন্দ্রনাথ। মিঠুয়া ঘোরতর লজ্জা পেল। চোখ সরিয়ে নিয়ে সে বলল, গরম কফির সঙ্গে ঠাণ্ডা আইসক্রিম খেলে ঠাণ্ডা লাগে ! চোখ না সরিয়ে ইন্দ্রনাথ বলল, লাগুক।
-কাশি হয়।
-হোক।
মিঠুয়া লোকে গিসগিস করা ভরা হাটের মাঝে শান্তনুদার বাড়িতে মনে মনে প্রার্থনা জানাল, একবার বলুক ইন্দ্রনাথ। যা শুনেছি মিথ্যে।
ইন্দ্রনাথ গোমড়া হয়ে রইল।
আর তখনই পাহাড়ে দুদ্দাড় করে আওয়াজ হল। পরেরদিন সকালে মিঠুয়া যখন আয়নায় নিজের মুখ দেখেছিল , তখন তাকে গাধার মত লাগছিল, সে কথা মনে পড়ল ভুলোমনার। কি নির্বোধ, গবেট কোথাকার, বলেছিল সে নিজেকে। আবার সেই মুখটাকে উদ্দেশ্য করে ভুলোমনা বলল, গাধা।
এখন আবার রিমপোচের ঘরের মধ্যে , রিমপোচের সামনে ভুলোমনা মিঠুয়াকে বলল , গাধা , গাধা , গাধা ।
আর সঙ্গে সঙ্গেই রিমপোচের মুখ গাঢ় রক্তবর্ণ ধারণ করল। সেটা ক্রমে এত বেশী টকটকে লাল হয়ে গেল, মনে হল আগুন লেগে যাবে। হিমালয় ফুঁসে উঠে উগরে দেবে গরম লাভা চতুর্দিকে ত্রাহি ত্রাহি পড়ে যাবে। নির্দোষ মানুষজন সব ভয়ার্ত অবস্থায় ছুটতে শুরু করবে উদভ্রান্তর মত। চতুর্দিক থেকে শোনা যাবে ,‘আগুন আগুন’ । গোটা পাহাড়ের প্রকৃতি তখন যেন আকাশ পরিব্যপ্ত করে ছড়িয়ে দেবে তার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ জটা ! হা-হা করে ভীষণ শব্দে হাসবে সেই পাগলিনী ঘোরা, মহাঘোরা, রোষবর্ণা করালবদনা মহামায়া। মিঠুয়ার বিপুল দুঃখভারে অবনত, ভারাক্রান্ত ভুলোমনা অসহায়ের মত রোদন করতে লাগল। অকুল পাথারে পড়া মানুষের মত আকূল সে রোদন। ক্রমে ক্রমে রিমপোচের মুখ রক্তবর্ণ থেকে একটু একটু করে স্বাভাবিক সাদা হয়ে আসতে থাকল। তার চোখ হয়ে উঠল আর্দ্র! সেও অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকল ভুলোমনার সঙ্গে। বাইরে প্রকৃতিতে সদ্য শুরু হওয়া ঝড়ের তাণ্ডব হবার আগেই বিপুল পরিমাণে জমে থাকা মেঘেরা আরও নীচে নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গে এ ওর গায়ে ধাক্কা লেগে ভারসাম্য হারিয়ে ঝর-ঝর বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল পাহাড়ে। তুমুল বৃষ্টি
শুরু হয়ে গেল , কিন্তু বেঁচে গেল পাহাড়িরা একটা অবশ্যম্ভবী ধ্বসে বিপর্যস্ত হওয়ার হাত থেকে ! ঘরের মধ্যে জমে ওঠা গরম বাষ্প ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তবু রিমপোচের দিকে তাকিয়ে থাকা ভুলোমনা আর ভুলোমনার দিকে তাকিয়ে প্রস্তরীবৎ বসে থাকা রিমপোচে , তারা একে অপরের দিক থেকে চোখ সরাল না। তারা কেঁদেই চলল ততক্ষণ, যতক্ষণ বৃষ্টির বেগ কমে না আসল।
৮
মিঠুয়ার প্রথমে ভীষণ দুঃখবোধ হয়েছিল। অহোরাত্র একটা দুঃখের বলয় তাকে ঘিরে রাখত সর্বত্র। ক্রমশঃ তা থেকে জন্ম নিল রাগ। একধরনের ঠকে যাওয়ার অনুভূতি। তাকে ঠকানো হয়েছে। অতএব, সে কোনো প্রশ্ন করবে না। কারণ, প্রশ্ন করলেই উত্তর দেবার একটা বাজে ধরণের প্রচেষ্টা হবে অথবা এড়িয়ে যাওয়ার। যাইহোক না কেন, এই সুযোগ সে দেবে না। সে চুপ করে থাকবে আর প্রতিমুহূর্ত ইন্দ্রনাথের সংশয় হবে, সে কি জানে, কতটা জানে। আর তাকে যে ঠকানো হয়েছে এই কথাটা সে চিরকাল মনে রাখবে।
মিঠুয়ার অতীতের সংকল্পের কথা ভেবে ভুলোমনা মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, এরকম একটা কঠোর, কঠিন সংকল্প করা হয়েছিল বটে। ভাবতে ভাবতে চলতে শুরু করল ভুলোমনা। হঠাৎ কি ভেবে সে ঘরের দিকে গেল।আঠেরো টাকা হাতে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। এই হয়েছে এক জ্বালা! মাঠের দিকে পাহাড়ের বাঁকে গোটা ছয়েক কুকুরছানা হয়েছে। মা কুকুরটা বাচ্চা পেড়ে মাঝেমধ্যে ওদের খোঁজখবর নেয়। আর মজার ব্যাপার ছ’টা কুকুর দল বেঁধে খেলা করে বেড়ায়। ভুলোমনা ওদের রোজ দুধ খাওয়াতে যায়। চক চক আওয়াজ করে দুধ খায় ওরা। সাদা সাদা দুধ মুখে লেগে থাকে।এখন প্রথমে দুধ কিনবে সে, তারপর, কুকুরছানাদের কাছে যাবে।
হাঁটতে হাঁটতে সে গুণতে শুরু করেছিল টোয়েন্টি, নাইন্টিন, এইট্টিন , সেভেনটিন অ্যান্ড সিক্সটিন অ্যান্ড ফিফটিন ……থ্রি, টু, ওয়ান এন্ড জিরো! জিরো আসতে না আসতেই ভুলোমনার জিভ জড়িয়ে এল, চোখের মণি ওপরে উঠে গেল আর সে অতীতে প্রবেশ করল। গভীর অতীতে। যদিও তার পা দুটো সমানতালে চলতেই থাকল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গভীর রাত। ইন্দ্রনাথ ফোন করেছে। তোমাকে আদর করি ? -না।
-একটু করি?
-না।
-ঘুম আসছে না ?
-না।
-কেন? ঘুম আসছে না?
-এমনি
-কি মনে হচ্ছে?
-জানি না।
-আমার কাছে আসছে ইচ্ছে করছে?
-না।
-আমাকে জড়িয়ে ধরো।
-না।
-ধরো। ঘুম পাড়িয়ে দেব তারপর।
মিঠুয়া একমুহূর্ত ভাবল। ইন্দ্রনাথ লোমশ শরীর। খসখসে চামড়া। অথচ অসুবিধেজনক কোন শারীরিক গন্ধ নেই। ভাবতেই একরাশ কাম যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। কাম থেকে জাগল প্রেম! জগৎ ভুল হয়ে যাওয়া মোহময়, সর্বত্র উথাল পাথাল করা এক প্রেম। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মিঠুয়া ভাবল, ইন্দ্রনাথকে সে কি তীব্রভাবে ভালবাসে তবে!
-জড়িয়ে ধরেছো আমাকে?
-হুঁ।
অন্যমনস্ক ভাবে বলল মিঠুয়া।
-মাথায় হাত বুলিয়ে দি।
-হুঁ।
-চোখ বোজো। বুজেছো?
-হুঁ।
চুমুর আওয়াজ পেল সে! চমকে উঠে অসহনীয় অস্বস্তিতে বলে বসল,
-আমার ঘুম পেয়ে গেছে। রাখছি।
বলেই ফোন কেটে দিল মিঠুয়া!
ফোনটা কেটে যেতেই কেঁউ কেঁউ আওয়াজ পেল ভুলোমনা। দেখল
ছ-ছ’টা কুকুরছানা তার আশেপাশে নেচে বেড়াচ্ছে। সে বসে আছে যে বাড়িটার পেছন দিকে কুকুরছানাগুলো থাকে সেখানে। একটা কলের পেছনে পাথরের বেদিতে থম মেরে বসে আছে সে। তিড়িং তিড়িং করে নেচে
বেড়াচ্ছে ছানাগুলো। ভুলোমনার হাতে ধরা দুধের প্যাকেট তাই দেখে কেঁউ কেউ করে চ্যাঁচামেঁচি লাগিয়েছে।
ভুলোমনা কাঁসিটাকে খুঁজল।কাঁসিটা যেটাতে ওরা খায়। সেটা একটু দূরে ঘাসের ওপর একপাশে পড়েছিল।ভুলোমনা সেটাকে জোগাড় করে কল থেকে ধুয়ে নিল । দাঁত দিয়ে প্যাকেট কেটে দুধ ঢালল তাতে। তর সইছিল না ছানাগুলোর! চক চক আওয়াজ করে ছ’টা একসঙ্গে খাচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাওয়া শেষ করে মুখে গুচ্ছের দুধ মেখে লাফালাফি করতে লাগল ওরা। একটা আরেকটার ওপর চেপে বসবেই বসবে। সেও
দেবে না। আরেকটা ঢুকেছে একটা গাড়ির তলায়। তার ল্যাজ ধরে টানছে আরেকটা। কোথা থেকে আরেকটা জুটে তিনটেতে একসঙ্গে গুটলি পাকিয়ে উল্টে পাল্টে গেল। এ্যাই,এ্যাই, কি হচ্ছে এ্যাঁ! চ্যাঁচালো ভুলোমনা।
একসাথে সবকটা আসতে শুরু করল। ছোট ছোট মুখ, ছোট মায়াবী চোখ…কি অপূর্ব ! আর ছোট্ট টুকটুকে জিভ। ছানারা ছোট জিভ দিয়ে চেটে দিল ভুলোমনার হাত। এমনি সময়ে একটা লোক এসে হেঁকে হেঁকে বাচ্চাগুলোকে বলতে লাগল, বাউন্ডারিমে যাও। বাউন্ডারিমে যাও, রাস্তেমে খেলো গে, গাড়ি আ যায়েগা।
শুনেই বাঁশের বেড়া টপকে টপ টপ করে একেকটা বেড়ার ওধারে গিয়ে পড়তে লাগল।
-হ্যাঁ। উধার খেলো অব্।
খুশী হয়ে লোকটা চলে গেল ।
ভুলোমনা দেখল বেড়ার ওপাশে গিয়ে সবকটা আবার জড়ামড়ি করে পড়েছে। হুজ্জোতি করছে একে
অপরের সঙ্গে। ভয়ানক হাসি পেল ভুলোমনার। কিন্তু পাছে আবার ওকে দেখে সবকটা এপাশে চলে, আসে,তাই উঠে পড়ল ও।
তখন ইন্দ্রনাথের ফোন এল আবার মিঠুয়ার কাছে। মাতাল অবস্থায় ভুলোমনা আবার যেমন হাঁটছিল হাঁটতে লাগল।
-রোজ ড্রিঙ্ক করেন কেন?
– সঙ্গ পাবার জন্য।
-কার সঙ্গ?
-বন্ধুদের।
-তার মানে সঙ্গ পাবার জন্য আপনি সেইসব বন্ধুদের খোঁজেন যারা ড্রিঙ্ক করে ।
আই মিন যাদের আপনার বন্ধু বলে মনে হয়?
-যাদের আমি বন্ধু ভাবি।
– সত্যি জানেন, তারা বন্ধু কিনা?
– জানিনা। মেনে নিই। আমার মৃত্যু কিরকম হবে জানো?
-কিরকম?
-একটা ঘরে অনেক বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করব আমি। তারপর একসময় উঠে পাশের ঘরে চলে যাব।
মারা যাব।
-হঠাৎ অতগুলো বন্ধুর সঙ্গে হট্টগোল করতে করতে মরবেন কেন?
-সবাই দেখবে। যারা আমাকে ভালবাসে।
-ভালবাসা ব্যাপারটা আপনার খুব দরকার, তাই না?
-হ্যাঁ আমি ভয় পাই যদি একা হয়ে যাই।
-তাই কতগুলো লোক জুটিয়ে ড্রিঙ্ক করেন?
উত্তর দিল না। ইন্দ্রনাথ।
বলল,-বাড়িতে যখন ড্রিঙ্ক করে ফিরি, আমার বউ যা বলে আমি মেনে নিই। এই যেমন মিনতির মায়ের মাইনেটা একশো টাকা বাড়ানো যায় কিনা। অমুক এই চাইছে, দেব কিনা। আমি সব হ্যাঁ বলে দিই। তারপর সকালবেলা সব ভুলে যাই। তখন বলি, কই বলিনি তো? আমার বউ কপাল চাপড়ায় আর বলে এতগুলো বছর ধরে
একই ভুল করে আসছি আমি।
খিক খিক করে হাসতে থাকে ইন্দ্রনাথ ।
-আপনি এরকম করেন কেন?
– ধুর, মদ খেলে একরকম বলি। মদ না খেলে আরেকরকম।
-আপনি কি হিপোক্রিউ !
-শোনো। লাইফ ইজ নাথিং বাট হিপোক্রেসী।
চড়াং করে রাগ হয়ে গেল মিঠুয়ার।
-হ্যাঁ , তাতো বলবেনই। কারণ আপনি নিজে হিপোক্রিট !
-তাহলে, আমার সঙ্গে মেশো কেন?
-মিশি কারণ, আপনার মধ্যে কোথাও একটা জেনুইনিটি আনরিফাইন্ড অবস্থায় লুকিয়ে আছে দেখতে পাই।
-এরকম বোলো না। বলতে নেই। বরং বিশ্বাস করো, আমি ভাল লোক। যা বিশ্বাস করবে তাই দেখবে।বিলিভিং ইজ সিয়িং।
– না, বিশ্বাস করব না। সিয়িং ইজ বিলিভিং। আপনি ভালো লোক নন। কিন্তু ভালো হতে পারেন।
-কি করে ভালো করবে?
একমুহূর্ত ভাবল ভুলোমনা।
-নিজে ভালো থেকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ হয়ে।
-ওহ্।এইজন্য তোমাকে এত ভাল লাগে। সোনা, সোনা। মিঠ্ঠুমিয়া!
গোমড়া মুখ করে রইল মিঠুয়া।
বদমাইশ কোথাকার।যখন যেমন সুবিধে হবে বলবে। তারপর বলবে বিলিভিং ইজ সিয়িং। যেন ঈশ্বর !
পিছমোড়া করে ঠ্যাঙাই অমন ছাতার ঈশ্বরকে। সত্যি সত্যি মিঠুয়ার বেধড়ক ঠ্যাঙাবার জন্য হাত নিশপিশ করতে লাগল। আর যত ঠ্যাঙাবার ইচ্ছে হল, তত ওর মনে হল ও ইন্দ্রনাথকে কি যে ভীষণ ভালবাসে।
যে সময় মিঠুয়া জানল লিপির কথা, সে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে রইল। আর তার মনে হল, এমন অদ্ভুত ঘটনা পৃথিবীতে আর কোনদিন ঘটেনি। কোনকালে ঘটবেও না। সেই-ই একমাত্র মানুষ যার বরাতে এমন অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে।
সে ভুলে গেল, বেমালুম বিস্মৃত হল, কতবার রাধারাণীর সঙ্গে এমন ভাগ্য বিড়ম্বনা হয়েছিল। বিড়ম্বিত ভাগ্যে ও কপালে করাঘাত করে সে কলহান্তরিতা নায়িকার মত রোদন করেছিল। বুক ফেটে ছিল। চোখে বাণ ডেকেছিল। কিন্ত প্রেম প্রেমের জায়গায় দাঁড়িয়েছিল অটল।
মিঠুয়া গাল পাড়ল নিজেকে গণ্ডমূর্খ বলে, তার আয়নায় দেখা
নিজেরই গাধার মত প্রতিবিন্ব হাজারবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, তবু প্রেম টাল খেল না। আর ভালবাসব কি বাসব না এইরকম বিবাদ-বিতর্কে বাদী পক্ষের উকিল একনাগাড়ে প্রমাণ সহকারে সিদ্ধান্ত উপস্থিত করতে লাগল, ভালবাসার পাট চোকানো দরকার। আর সে কেবলই বিবশ-বিহ্বল হয়ে বলতে লাগল, ভালবাসা বা ভাল না বাসা কি আমার হাতে ? তর্কে বিতর্কে ক্রমাগত ভালবাসা জয়ী হতে লাগল। যতই ভালবাসা জয়লাভ
করল, মিঠুয়া দেখল সে নিজেই তার ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়ছে। অবশেষে আত্মসমর্পণ। ভালবাসার পায়ে। এই আগাগোড়া ঝামেলার সময়টায় ইন্দ্রনাথ কিসব মাথামুণ্ডু কাজে ব্যস্ত ছিল। মিঠুয়ার কাছে সেগুলো ছিল অল রাবিশ। তার ধারণা ছিল প্রেমের থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছুই জগতে থাকা উচিত না।
এদিকে তখন ছিল বিয়ের মরশুম। প্রাণপণে সানাই বাজছিল তখন। জোড়ায় জোড়ায় মানুষ একসঙ্গে সুখী হবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। সেইরকম একটা ঘোরতর কর্মযজ্ঞে ভরা বাড়িতে বসে মিঠুয়া আবোলতাবোল ভাবছিল। যাদের বিয়ে হচ্ছে, তাদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা বুঝি স্বর্গের চৌকাঠে পা রেঁখে দাঁড়িয়ে আছে।
আপনমনেই বলল মিঠুয়া, স্বর্গে পৌঁছেছো ? স্বর্গ কত দূর?
কাল অতিকষ্টে ইন্দ্রনাথ তাকে রাজি করিয়েছে দেখা করার জন্য। কারণ, ইন্দ্রনাথের বোধোদয় হয়েছে যে, এটা কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। ইন্দ্রনাথ একদিন খুব ভয় প্রকাশ করেছিল। তার ভয় তার কারণে মিঠুয়া যদি কোনো কষ্ট পায়। মিঠুয়া আকাশ-পাতাল ভেবেছিল।একটা মানুষ এরকম ভয় পায় কেন? সেও কি একটা সম্পর্কের হাত ধরে স্বর্গে পৌঁছোতে চায় ? পাছে স্বর্গ থেকে অধঃপতন হয়, তাই ভয় ? ইন্দ্রনাথের কাছে স্বর্গ মানে নীল মাঠ, হেমন্তের হলুদ শস্য, রামধনু রঙ, স্বর্গ মানে ছেলেবেলা, সন্দিগ্ধ চুন্বন, প্রথম। এক জীবনে কতবার স্বর্গে পৌঁছোতে হয় ? প্রত্যেকটা চুম্বন যদি প্রত্যেকটাই প্রথম চুম্বন হত…এমন সময় মোবাইলটা পিং করে। মিঠুয়া ইনবক্স খুলে দেখে, তিনটে শব্দ।
-কেন…কেন..কেন?
অর্থাৎ এই নীরবতার অর্থ কি?
মিঠুয়ার দিশেহারা লাগল।
সেই বিয়েবাড়ির প্রাণপণ কর্মযজ্ঞ হারিয়ে যেতে বসল, চোখের সামনে।
পরদিন যখন সে ইন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছেছিল সঙ্গে ছিল টিফিন ক্যারিয়ারে ফ্রায়েড রাইস । শরৎচন্দ্র মার্কা হয়ে যাচ্ছে। নিজের মনেই বলল মিঠুয়া। তবুও তার মধ্যে একধরণের শর্তহীন আবেগ কাজ করছিল।
ইন্দ্রনাথ তাকে আপাদমস্তক দেখল। সরেজমিনে তদন্ত করার মত। আর তারপর বলল, তোমাকে এমন লাগছে যেন, আজ তোমার বৌভাত। কিছুক্ষণ এলোমেলো কথা হল। তারপর ইন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করল, তোমার কি হয়েছে? প্রশ্নটা সে করল সরাসরি মিঠুয়ার দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি জানতে চাওয়ার ভঙ্গিতে। মিঠুয়া
ভাবল, এতদিন বাদে…? সে কথা খুঁজল। ঠিক কি বলবে সে? কি বলবে? সে কি বলবে, আপনি যা করেছেন, আমার ডিক্সনারিতে তাকে বলে ঠকানো । না কি সে চুপ করে থাকবে? কথা ঠিক কিভাবে শুরু করা উচিত।
প্রথম লাইনটা যদি ভেবে পাওয়া যেত! সে এদিক-ওদিক তাকাল। সারা ঘরে এ.সি.-র একটা ওঁ ওঁ শব্দ শোনা গেল। উত্তর পাওয়া গেল না। গোটা ঘরটা বোবা। গোটা ঘরের বোবা-ভাব সারা শহর ময় ছড়িয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে। কোথাও কোনো উত্তর নেই। চতুর্দিকে বিভিন্ন শব্দের ছড়াছড়ি আছে, অথচ একটা সঠিক শব্দ নেই যে শব্দটা মিঠুয়ার দরকার। ইন্দ্রনাথ মিঠুয়ার দিকে ঠায় চেয়ে ছিল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডই পার হয়েছে প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরিয়ে মিঠুয়ার কান অবধি পৌঁছোনোর পর। মিঠুয়া এপাশ-ওপাশ হাতড়া-হাতড়ি করে ইন্দ্রনাথের দিকে তাকাল। আর হঠাৎ কেঁদে উঠল।
তাতেই সব বলা হয়ে গেল।
ইন্দ্রনাথ উঠে এসেছিল চেয়ার থেকে। পকেট থেকে একটা রুমাল বার করছিল, কারণ সাধারণত সবাই সেটাই করে থাকে বলে। মিঠুয়া রুমাল নিয়েওছিল। কেন নিয়েছিল সে জানে না। না নিয়ে আর কি করা যেত?
রুমালটা কি ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল ঘৃণায় ? প্রত্যাখ্যানের মত ? কে জানে? ইন্দ্রনাথ একইসঙ্গে দুটো মানুষ হয়ে গেছিল। একজন ইন্দ্রনাথ ভাবছিল, যা হয়েছে তা ভাল হয়নি। সে কষ্ট পাচ্ছিল। সত্যি কথা বলতে কি, মিঠুয়ার কষ্ট দেখে তার বুকের ভেতরে হাঁচোড়-পাঁচোড় করছিল। আরেকজন ইন্দ্রনাথ তৈরি হচ্ছিল, যে ভাবছিল যা হবার তা তো হয়েছে । এবার মোকাবিলা করতে হবে শক্ত হাতে পুরুষকারের প্রচণ্ডতা দিয়ে । কিছুক্ষণ পর ইন্দ্রনাথ বলল, দুটো আলাদা কম্পার্টমেন্ট। একটার সঙ্গে আরেকটার বিরোধ নেই। তুমি দুটোকে মিশিয়ে ফেলছ
কেন ?
অনেক অনেক কথা গলগল করে বলা যেত। কথাগুলো সবাই জানে। জানা কথা। অধিকার বোধ, সততা,লয়ালটি, বেবফাঈ এসব নিয়ে আচ্ছা আচ্ছা ভাষণ দেওয়া যেত। কিন্তু মিঠুয়ার শুধু মনে হল, কি লাভ ? সে ইন্দ্রনাথের একটা যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে উঠতে পারল না কিছুতেই। একজনকে ভালবাসলে আরেকজনকে কি ভালবাসা যায় না ? মিঠুয়ার যুক্তি,বুদ্ধি আবেগ সবকিছু সায় দিয়ে বসে রইল। তা আর না যাবার কি আছে ? কিন্ত মিঠুয়ার ভেতরে জ্ঞানদায়ী মিঠুয়াটা ক্যাট ক্যাট করে উঠল । বলতে থাকল কিন্ত যে কোন একজনের প্রতি মনোযোগ কমে যাবেই যাবে। নরম মিঠুয়াটা আবার মুষড়ে পড়ে তা ঠিক, তা ঠিক , বলে ফেলল।
ইন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করল,
-তাহলে তুমি আর আমার সঙ্গে মিশবে না!
মিঠুয়া বলল, একটা সম্পর্ক সবসময় অনেক উত্থানপতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েও যদি টিঁকে থাকে, তবে বোঝা যায় সেটা খাঁটি কিনা। আমার মনে হয়, এরকম নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে এটা পরিক্ষিত হওয়া দরকার।
হায় কপাল!
সে এটা কেন বলল ? মরতে? সে কেন বলল সে নিজে কি জানত ! নাকি ধীরে ধীরে সে তার নিয়তি নির্ধারিত পথে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে পথ ছিল তার প্রতি ইন্দ্রনাথের আকর্ষণের মতোই অমোঘ,অনিবার্ধ। সেটা ছিল বিধাতার ডাক। নিশি পাওয়ার মতো সে ডাক। মিঠুয়া নিজের অজান্তেই পূর্বনির্ধারিত
বিধিলিপির টানে হয়ে পড়ল বিধাতার গ্রাস। ইন্দ্রনাথ ভ্যাবাচ্যাকার মত তার দিকে তাকিয়ে বলে বসল,
-তোমাকে আজ ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
সমস্ত অন্যায়,শঠতা, মিথ্যাচারের মধ্যে দিয়েও এই কয়েকটা কথার গভীর সত্যতা মন্দিরের গম্ভীর ঘণ্টাধ্বনির মত চরাচর কাঁপিয়ে শব্দ তুলল ঢং, ঢং, ঢং।
ইন্দ্রনাথ আবার বলল,
-সব তো ঠিকই ছিল। কি হয়ে গেল না? মিঠুয়া বলল,
– সব ঠিক ছিল না।
-কি ঠিক ছিল না গো?
মিঠুয়া চুপ করে গেল। এটা তোমার দায়িত্ব ইন্দ্রনাথ নিজের মুখে স্পষ্ট করে আমাকে সবকিছু অবহিত করানো। যতক্ষণ তুমি তা না করছ, আমি এই মুহূর্তে জেহাদ ঘোষণা করলাম, তুমি আমার কাছ থেকে যা চাও, তা পাবে না।
এক অসহনীয় ঠাণ্ডা লড়াই নিজে নিজেই শুরু করে দিল মিঠুয়া। সেই অসম অনাকাঙ্ক্ষিত ঠাণ্ডা লড়াইয়ে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ইন্দ্রনাথের আমিত্বকে ছোট করে ছেঁটে দিল সে। আর ইন্দ্রনাথ শুরুয়াৎ থেকে একটু একটু করে মিঠুয়ার আড় ভাঙিয়ে এগোতে এগোতে দুম-দাড়াক্কা একটা বাধার সামনে পড়ে গেল। ইন্দ্রনাথের
শরীর সর্বস্বতার মধ্যে ছিল আমিত্ব পরিপুষ্টির বন্দোবস্ত। সেইখানে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল মিঠুয়া। ইন্দ্রনাথ আবার বলল, -তোমাকে যেতে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
কথার মধ্যে মিথ্যে ছিল না। অথচ মিঠুয়া ভাবল, তার অপমানের কথা । যা তার প্রাপ্য ছিল না,কিন্তু তাকে পেতে হয়েছে। কিন্তু সে চলে গেল আপোষে।
-গাধী। জ্ঞানভাণ্ডার আগলে বসে থাকা মিঠুয়াটা ভেতর থেকে বলে উঠল।
– আসলে তুই মরেছিস।তুই দুর্বল হয়ে পড়েছিস এবং তুই সেকথা জানিস। দুর্বলতা ইজ ইক্যুয়াল টু ভয়, ভয় ইজ ইক্যুয়াল টু মরণ। যো ডর গ্যায়া সো মর গ্যয়া । মুই-মরবি। তুই মর। আফশোস করল মিঠুয়া।
আপোষ করা হয়ে গেল নাকি?
ভেংচি কাটল আরেকটা মিঠুয়া। গোল্লায় যা।
এইসময় ভীষণ চমকে উঠে ভুলোমনা ফিরে এল মিঠুয়া থেকে ভুলোমনাতে । পাহাড়ি ঠাণ্ডায় বসে বসে ভুলোমনা ভাবল, সামন্তটা এগজ্যাক্টলি কে? কিছুতেই মনে পড়ছে না। সামন্তও কি ইন্দ্রনাথের মত কেউ,যার সঙ্গে সে পরের এপিসোডে জড়িয়ে পড়েছে?
সামন্তও কি ইন্দ্রনাথের মত ভালবাসার মোড়কে আসলে শরীর চায় আর শরীর পাওয়া হয়ে গেলে কতগুলো দায়িত্ব পালন করে শোধবোধ করে নেয় ? শরীর এবং দায়িত্ববোধ, দায়িত্ববোধ এবং শরীর এই ব্যাপারটাই কি পুরুষ প্রজাতি? গোটা ব্যাপারটাই একঘেয়ে আর বিরক্তিকর।সামন্তই বা আর কত মহান হবে !
ভুলোমনার মনে হল, সামন্তের ব্যাপারে তার যথেষ্ট সাবধান হওয়া দরকার। এত যে দায়িত্ববোধ সামন্তের তার প্রতি তার বিনিময়ে সামন্ত কি আশা করে ? আশা তো নিশ্চয় কিছু করে।
পৃথিবীর এই আদান-প্রদান, বিনিময় মূল্যর বাইরে সে কি কোনদিন পৌঁছতে পারবে? সেইখানে ? যেখানে বিনিময়মূল্য নেই?
অষ্টম পর্ব সমাপ্ত
ইন্টিরিয়র মোনোলগের অসাধারণ নিদর্শন এই পর্বটি। কুন্দেরা জেমস জয়েসকে নিয়ে বলেছিলেন জয়েস সেট আ মাইক্রোফোন উইদিন ব্লুমস হেড। থ্যাঙ্কস টু দ্য ফ্যান্টাসটিক এসপিয়োনাজ অফ ইন্টিরিয়র মোনোলগ। সেকথা মনে পড়ল।
টাইপো রয়েছে।ঠিক করে নিতে হবে।