
তিরন্দাজির পথে, জেন
তৃতীয় পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ
‘জেন’- শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে চলা রহস্যময়, মিস্টিক এক সাধনপদ্ধতি; প্রাচ্যের সুগভীর দর্শনের একটি ধারা, যে ধারার মধ্যে মিশে রয়েছে পারমিতার ছায়া, ‘না-জানা’র মধ্য দিয়ে জানার গূঢ় পদ্ধতি। একটি সুবিখ্যাত জেন-কবিতায় পাওয়া যায়, ‘Sitting quietly, doing nothing / Spring comes, and the grass grows itself’। এই ‘কিছুই না-করা’র পদ্ধতি অর্জন করতে হয় দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের এই ধারার সঙ্গে তিরন্দাজির মতো একটি শৌর্যময় বিষয়ের কি কোনও সংযোগ থাকতে পারে? তিরন্দাজি কি শিল্প? এই শিল্পের মধ্যে দিয়ে কি প্রবেশ করা সম্ভব জেন-এর মিস্টিক পৃথিবীতে? আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অয়গেন হেরিগেল-এর ‘Zen in the Art of Archery’। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এ কাহিনি যেন এক রোমাঞ্চকর শান্ত থ্রিলার, ইউরোপের চোখে ‘জেন’ দর্শন অথবা ভিন্নধারার ডিসকোর্স। তৃতীয় পর্ব
গুরু কেনযো আওয়া’র কাছে ‘শিল্প-শূন্য’ শিল্প-শিক্ষা শুরু হয়েছিল, প্রথম দিনের স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করছে।
গুরুজি একে একে আমাদের বেশ কয়েক ধরনের জাপানি ধনুক দেখিয়ে ছিলেন, সবই বাঁশ থেকে তৈরি। তাদের নমনীয়তার পেছনে রয়েছে এই বিশেষ ধরনের বাঁশ।
বিভিন্ন ধরনের ধনুক দেখানোর পর তিনি ধনুকের ‘রাজকীয়’ আকৃতি দেখিয়ে ছিলেন। প্রায় ছয়-ফুট লম্বা বিশাল ধনুক, ছিলা টান করা অবস্থায় দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ছিলা টেনে ধরে গুরুজি বলেছিলেন, ‘ধনুক’কে যখন এভাবে টেনে ধরা হয় তখন ধনুক নিজের মধ্যে ‘সর্বস্ব’কে ধারণ করে… দেখে নাও, আর মনে রেখো এই কথাটা।’
কথাটা বলে গুরুজি একটা লম্বা আর শক্তপোক্ত তির তুলে নিয়েছিলেন, সম্ভ্রম জাগানো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ধনুক হাতে। বেশ কয়েকবার ছিলায় টান দিয়েছিলেন, ছিলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছিল অদ্ভুত টংকার। সে শব্দ যে কী তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, একটানা হালকা কর্কশ অথচ ছন্দবদ্ধ ধ্বনি…একবার শুনলে সারা জীবনে সে শব্দ কেউ ভুলবে না। শব্দ বুকের ভেতর পর্যন্ত ঢুকে যাবে; হয়তো এ কারণেই ধনুকের ছিলার শব্দে ভূতপ্রেত পালিয়ে যায় – এমন একটা বিশ্বাস প্রাচীণকাল থেকে দানা বেঁধেছে রয়েছে অনেক জাপানির মনে।
মূল মন্দিরে প্রবেশ করার আগে শুদ্ধ হতে হয়, ক্লেদ ধুয়ে বাইরে রেখে তবেই মন্দিরে প্রবেশ করা যায়। ধনুক সম্পর্কে এ ধরনের আশ্চর্য কথা ও টংকার শুনে আমরা যেন শুদ্ধ হচ্ছিলাম। এরপর ধনুকে তির যুক্ত করে গুরুজি আমাদের তাঁর দিকে তাকাতে বলেছিলেন। তিনি ছিলা টেনে চলেছেন ক্রমাগত, ধনুক প্রসারিত হচ্ছে…আমাদের মধ্যে অনেকেই ভাবছিলাম যে ধনুক এতটা টান সহ্য করতে পারবে না হয়তো। কিন্তু গুরুজির কোনও হেলদোল নেই, তিনি খুব সাবলীলভাবে শর-সঞ্চার করছেন।
গুরুজি তারপর আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘এবার তোমাদের পালা, এভাবে ধনুকে তির সংযোগ করতে হবে তোমাদের; কিন্তু মনে রেখো, তিরন্দাজি মাংসপেশি ফোলানোর খেলা নয়। এখানে ওই পেশিশক্তির কোনও ভূমিকা নেই। যখন ছিলা টানবে শরীরের সর্বস্ব শক্তি ব্যয় করবার কোনও দরকার নেই, শুধু দু’হাতের শক্তি ব্যবহারের দিকে নজর দেবে। হাতের আর কাঁধের পেশিগুলোকে শিথিল করে রাখবে; মনে করবে ওই পেশিগুলি যেন উদাসীন ভাবে কাজ করে চলেছে। তিরন্দাজি এক ঐশ্বরিক জিনিস; এই কাজটা হল তার কাছে পৌঁছানোর প্রথম ধাপ’।
এ কথা বলে গুরুজি হঠাৎ আমার হাত ধরেছিলেন, ধীরে ধীরে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন তির সংযোগ আর ছোড়ার সময় হাতের চলন ঠিক কেমন হবে। পরে হাজার হাজার বার ঠিক সেভাবে আমি হাতের চলনের দিকে নজর দিয়েছি, কিন্তু গুরুজির স্পর্শ যেন আজও আমার হাতে লেগে আছে।
তারপর শুরু হয়েছিল তির ছোড়ার পালা; আমি একটা মাঝারি-আকৃতির ধনুক নিয়ে শুরু করেছিলাম। গুরুজির স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গি তো দূরের কথা, দেখছিলাম আমাকে বেশ জোর খাটাতে হচ্ছে ধনুক বাঁকাতে। এর সব থেকে বড় কারণ জাপান আর ইউরোপে ধনুক ধরার পদ্ধতি’ই আলাদা। ইউরোপে কাঁধ-বরাবর ধনুক ধরা্র রীতি। জাপানে ধনুকে তির সঞ্চার করার পর হাত দু’টি উপরের দিকে প্রসারিত করে ধনুক ধরতে হয়।
এরপর ধনুর্ধরের হাত টানটান অবস্থায় শুধু উপর-নীচে ধীরে ধীরে দুলতে শুরু করে, ধনুক-ধরা বাম হাতটি চোখ বরাবর নেমে এসে স্থির হয়ে যায়। ছিলা টেনে রাখা ডান-হাত ডান কাঁধের উপরে, তিন-ফুট লম্বা তিরের ফলার মুখটি বেরিয়ে থাকে। ধনুকটি এতটাই বেঁকে থাকে যে তিরের ফলার সামান্য অংশ দেখতে পাওয়া যায়। এ অবস্থায় ধনুর্ধর বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর লক্ষ্যের দিকে তির ছুড়ে দেন।
আমি বেশ মুশকিলে পড়েছিলাম, এভাবে ধনুক ধরার অভ্যাস নেই। হাতের পেশিতে এত চাপ পড়ত যে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাত কাঁপতে শুরু করত। হাপরের মতো নিঃশ্বাস পড়ত। বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল, অবস্থার বিশেষ কিছু উন্নতি হচ্ছিল না। এ পদ্ধতি’তে তির সংযোগ করে ধনুক টানা বেশ কঠিন কাজ, অনেক চেষ্টা করেও আমি আধ্যাত্মিক বিশেষ কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না বিষয়টির মধ্যে। মাঝে মাঝে ভাবতাম, নিশ্চয় একটা কৌশল আছে; গুরুজি কোনও কারণে আমাকে সে কৌশল শেখাচ্ছেন না। মনে মনে ভাবতাম, একদিন ঠিক খুঁজে পাব কৌশল।
দিনের পর দিন অনুশীলন চালিয়ে যেতাম, গুরুজি আমার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। পরিশ্রমের প্রশংসা করতেন, ছোটখাটো ভুল শুধরে দিতেন; বেশি শক্তি ক্ষয় করে কিছু করলে বারবার সেটা পরিবর্তন করে দিতেন। যখন তির সঞ্চার করতাম তিনি বেছে বেছে কয়েকটি পেশিতে হাত রাখতেন, জাপানি ভাষায় বলতেন ‘শান্ত হও…আরও শান্ত হও…।’
একটা দু’টো জাপানি শব্দ ততদিনে শিখে ফেলেছি। আমি বারবার ভুল করতাম, কিন্তু গুরুজিকে কোনওদিন মেজাজ হারাতে দেখিনি।
গুরুজি মেজাজ হারাননি, কিন্তু আমি একদিন মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলাম। সোজা গুরুজির কাছে গিয়ে বলেছিলাম, ‘যেভাবে আপনি শিখিয়ে দিয়েছেন সেভাবে আমি কিছুতেই পারছি না… কোথাও একটা কিছু ভুল হচ্ছে আমার’।
গুরুজির মুখ প্রসন্ন, তিনি শান্ত গলায় বলেছিলেন, ‘তোমার পক্ষে এখনও পারা সম্ভব নয়, কারণ তোমার শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া ঠিক নেই। প্রথমে বুক ভরে শ্বাস নাও… বুকের পাঁজর বাতাসে ভরে উঠবে এমন শ্বাস নাও… শ্বাস ধরে রাখো কিছুক্ষণ। তারপর খুব ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়তে শুরু করো; বারবার এই প্রক্রিয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া চালিয়ে যাও। দেখবে, এই ছন্দ একদিন রপ্ত হয়ে যাবে। যদি এই শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াটা ঠিক মতো করতে পারো তো দেখবে দিন দিন তিরন্দাজি তোমার কাছে সহজ হয়ে আসছে। কারণ শ্বাস-প্রশ্বাসের এই ছন্দের মাধ্যমে তুমি ঐশ্বরিক এক শক্তির সন্ধান পাবে, সে শক্তি তোমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে; তোমাকে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী করে তুলবে’।
গুরুজি কথাগুলি বলে একটা বড় ধনুক তুলে নিয়েছিলেন, তাঁর পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে বলেছিলেন। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন তাঁর মাংসপেশির চলন; দেখেছিলাম গুরুজির হাতের মাংসপেশিগুলি শিথিল হয়ে রয়েছে, যেন কোনও কাজই করছে না তারা।
গুরুজির কথা মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার নতুন পদ্ধতি শুরু করেছিলাম, প্রথম প্রথম তিরধনুক ছাড়াই অভ্যাস করতাম। শুরুর দিকে হালকা অস্বস্তি কাজ করত, পরের দিকে সেটি দূর হয়ে যায়। গুরুজির সতর্ক নজর ছিল শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া যেন শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক ভাবে মেনে চলা হয়, তিনি মৃদু সুরে তাল ঠুকে যেতেন। গুনগুন সুর বন্ধ না-হওয়া পর্যন্ত আমাদের নিঃশ্বাস ছেড়ে যেতে হত; তারপর আবার শ্বাস নেওয়া যেত। গুরুজির মত ছিল, বুক-ভরে পূর্ণ শ্বাস নেবার ফলে শিক্ষার্থীদের সমস্ত বিষয় শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে চলে। আর ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ার ফলে শিক্ষার্থীরা সমস্ত প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তি পায়। সে সময়ে গুরুজির কথার মর্মার্থ বোঝার সামর্থ্য ছিল না আমাদের।
কিছুদিন এভাবে শ্বাস নেওয়া ও ছাড়া অনুশীলন করার পর গুরুজি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিরন্দাজিকে মেলাতে শুরু করলেন। ধনুকে তির সংযোজন ও তির ছোড়ার প্রক্রিয়াটিকে গুরুজি ছোট ছোট কয়েকটি পর্বে ভাগ করেছিলেন। তির হাতে তুলে নেওয়া, ধনুক হাতে তোলা ও ধীরে ধীরে দু’হাত প্রসারিত করে মাথার উপর তুলে আবার কিছুটা নামিয়ে আনা, লক্ষ্যের দিকে তাকিয়ে একাগ্র হওয়া ও তির ছোড়া – প্রতিটি এক একটি ভাগ। প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন হত প্রশ্বাস নেওয়া, শ্বাস ধরে রাখা ও ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ার মধ্যে দিয়ে। কয়েক দিনের মধ্যে ঠিকঠাক জায়গায় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস পড়তে শুরু করেছিল। সমস্ত প্রক্রিয়াটি হয়ে উঠছিল ছন্দবদ্ধ, আমরা যে কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিলাম তাদের ক্ষমতা মতো শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার মধ্যে দিয়ে নিজস্ব ছন্দ গড়ে নিয়েছিলাম। ছোট ছোট নানা ভাগে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র প্রক্রিয়াটি ছিল ভীষণ জীবন্ত, সমস্তটা যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। পরের দিকে অনেক’কে এটির সঙ্গে জিমন্যাস্টিকের তুলনা করতে দেখেছি; আমার অভিমত, জিমন্যাস্টিকে ছোট ছোট নানা কসরত থাকে। সেগুলির কোনওটিকে যে কোনও সময়ে আলাদা করে নেওয়া যায়, কোনও কসরত যোগ বা বিয়োগ করা যায়। তিরন্দাজিতে সেটা সম্ভব নয়, কোনও একটি ভাগকে আলাদা করলে তিরন্দাজির গোটা বিষয়টাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
প্রথম দিকে ঠিকঠাক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্থায় পড়তাম। প্রায়ই এক অদ্ভুত সমস্যার মুখোমুখি হতাম। হয়তো আমি গুরুজির কথা মতো ঠিকঠাক শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি কিন্তু হাত আর কাঁধের মাংসপেশিগুলিকে হালকা আর সাবলীল রাখতে পারছি না কিছুতেই; তির তোলার সময় পায়ের মাংসপেশি অসম্ভব শক্ত হয়ে পড়ছে। যন্ত্রণায় মাটির উপর পা চে্পে ধরতাম, মনে হত প্রাণ যেন বেরিয়ে যাবে। এক এক সময়ে তো নিজেকে সেই গ্রিক পুরাণের অ্যন্টেয়াসের মতো লাগত, মাটি থেকে শক্তি সংগ্রহ করা ছাড়া যেন এক মুহূর্ত বাঁচব না। মাঝে মাঝে গুরুজি এসে পায়ের পেশিতে খোঁচা মারতেন, আমার যন্ত্রণা আরও বেড়ে যেত। একদিন বলে ফেলেছিলাম, ‘আমি নিজেকে চিন্তামুক্ত, হালকা রাখতে চাইছি, কিন্তু পারছি না।’
গুরুজি যেন এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, বলেছিলেন, ‘এটাই তোমার সব থেকে বড় সমস্যা, তুমি নিজেকে চিন্তামুক্ত আর হালকা রাখার কথা সচেতনভাবে ভাবছ, চিন্তা করছ। এর বদলে তুমি তোমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে নজর দাও; ভাবো শুধু এটা করা ছাড়া তোমার আর অন্য কোনও কাজ নেই।’
বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল গুরুজির এই কথাটি বাস্তবায়িত করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুরুজির কথা রাখতে পেরে আমি তৃপ্তি পেয়েছিলাম। এক এক সময়ে এত সাবলীলভাবে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতাম যে মনে হত আমি শ্বাস নেওয়া আর ছাড়ার কাজটা করছিই না। মনে হত, আমাকে কে যেন শ্বাস নিইয়ে দিচ্ছে; সে আমি নয়, অন্য কেউ।
মাঝে মাঝে নিজের মনে ভাবতাম, গোটা প্রক্রিয়াটিকে যুক্তিবাদের দিক থেকে প্রশ্ন করতাম; কিন্ত, কী আশ্চর্য, আমার কোনও সন্দেহ ছিল না যে গুরুজির বলা শ্বাস-প্রশ্বাসেই আসল খেলা আর রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। গুরুজির পথ অনুসরণ করে সাবলীলভাবে তির হাতে তুলে নিয়ে, ছিলায় সংযোজন করে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে ছুড়তে পারতাম। যেন কোথাও কোনও তাড়াহুড়ো বা কষ্টকর প্রয়াস নেই, কিন্তু কীভাবে এটা হত আমি যুক্তগ্রাহ্যভাবে বিশ্লেষণ করতে পারব না। আমার আগের দিনগুলির ব্যর্থতা আর এখনকার তির ছোড়ার সাবলীলতার মধ্যে গুণগত পার্থক্য এতটাই স্পষ্ট ছিল যে বুঝতে পেরেছিলাম তিরন্দাজির মধ্যে নিশ্চিতভাবে লুকিয়ে রয়েছে আধ্যাত্মিকতার জগৎ।
শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করবার প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল না, আমি তার মধ্যে সুদূরপ্রসারী আরও নানা দিক খুঁজে পাবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু একটা প্রশ্ন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত; কখনও কখনও এমনও তো হয়, কোনও অপরিচিত, চটকদার জিনিসকে আমরা অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। গুরুত্বের থেকেও তার চটক আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে; এও এক ধরণের আত্মপ্রতারণা। এটাও কি তেমনই একটা বিষয়? শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের ফল আমি হাতেনাতে পাচ্ছিলাম; অনায়াসে গুরুজির মতো বিশাল তির ছুড়তে পারছিলাম হাতের পেশি শিথিল রেখে। কিন্তু এ সবের পরেও মাঝে মাঝে দ্বন্দ্বে ভুগতাম; যদিও আমার মধ্যে যে দক্ষতার জন্ম হয়েছে তার দিকে তাকিয়ে দ্বন্দ্ব কেটে যেত।
অন্য একটা খটকা মনের মধ্যে ছিলই; গুরুজি সেই প্রথম দিন থেকে দেখছেন ধনুক চালানোর সময় বহু কাঙ্ক্ষিত ‘আধ্যাত্মিকতা’ আমার উপর ভর করছে না। তা হলে তিনি শুরুতেই কেন ত্রুটি শুধরে দেননি? একদিন এটা নিয়ে প্রফেসর কোমাচিয়ার সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি এক অদ্ভুত করা বলেছিলেন, ‘গুরুজিরা সব লক্ষ করেন, নজরে নজরে রাখেন। আপনার ভাবার কোনও কারণ নেই যে গুরুজি আপনার ত্রুটি নজর করেননি। কিন্তু তিনি যদি প্রথমেই শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি শিখিয়ে ক্লাস শুরু করতেন আপনি কিছুতেই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারতেন না। ডুবন্ত নৌকার যাত্রী হাবুডুবু খাওয়ার পর উদ্ধার পেলে, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলে তবেই বুঝতে পারে জীবনের মাহাত্য। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমরা নিজেরা নিজেদের যতটুকু জানি গুরুজি আমাদের তার থেকেও বেশি জানেন…শুধু তাই নয়, আমরা যতটা প্রকাশ করি, তিনি তার থেকেও বেশি দেখতে পান।’