জরাবর্গ  ও কবিতার জরামুক্তি <br /> গৌতম চৌধুরী

জরাবর্গ ও কবিতার জরামুক্তি
গৌতম চৌধুরী

একটি নির্ভার নিষ্পাপ সরলরেখায় ভর করিয়া বিবেচনার এক বিন্দু হইতে অন্য বিন্দুতে পৌঁছাইবার অনায়াস ভ্রমণের ফুরসত বসুর কবিতায় শুরু হইতেই কম। তবু তাহাদের ভাবনাবিস্তার নানা ডালপালায় আকাশনীলিমাকে ছুঁইতে চাহিলেও, মর্মশাঁস যেন আপন আপন ভ্রমরকৌটায় লীন। হয়তো, স্বর্ণগড়ুরচূড়া (২০১৩) বা মঞ্জুশ্রী (২০১৬)-র কিছু কবিতা বাদ দিলে, তাঁহার প্রায় সমস্ত রচনাই যেহেতু মিতায়তন, তাহাদের ভিতর বহুস্তরীয় প্রতিসরণের বর্ণচ্ছটা ধরা পড়িলেও একটি কেন্দ্রীয় সংহতি যেন তাহাদের বহুমেরুগামী করিয়া তুলে নাই। এমনকি, ওই দুইটি পুস্তকের দীর্ঘতর কবিতাগুলিতে কবি নানা আখ্যানিক বা নাট্যিক ঢঙ এস্তেমাল করিলেও, তাহাদের বিবিধ বিস্তার বাহিয়া বহমান বসুধারাটিকে আমরা একভাবে শনাক্ত করিতে পারি। সেই দিক দিয়া ভাবিলে, জরাবর্গ (২০১৮)-তে আসিয়া যেন এক নতুন কবিতাজন্ম ঘটিয়া গেল তাঁহার প্রকাশের। গৌতম বসুর 'জরাবর্গ' নিয়ে গৌতম চৌধুরী

সময় এক নিরবয়ব প্রবাহ। সেই ঢেউয়ের ছোট্ট এক টুকরায় লগ্ন হইয়া আছে মানুষের নাজুক অস্তিত্ব। তাহার প্রতি রোমকূপে আসিয়া পড়িতেছে সেই খণ্ড সময়ের গভীর সেঁক ও দংশন। মাতৃগর্ভের মতো আপন সময়ের গোলক তাহাকে হরদম পুষ্টি জোগাইতেছে। আবার, রেণু রেণু করিয়া তাহাকে ধ্বংসও করিতেছে। সে কি তবে এই বয়মের ভিতরেই হাত-পা ছুঁড়িয়া যাইবে, ধারাবিবরণী দিয়া যাইবে সেই বুদ্বুদের মতো কালপরিসরের? তবে পিছনের এত লক্ষ বছরের ইতিহাস তাহার মগজের ভিতর বিজবিজ করে কেন? কেনই বা এক কল্পবিশ্ব হইতে তাহার দিকে ডানা মেলিয়া দেয় অজানা আগামী? ‘তিন সহস্র ভুবন, মিহি তুষারপাতের মধ্য থেকে এগিয়ে আসছে/ এবং সেই মিহি তুষারকণা, যা তিন সহস্র ভুবনের ’পরে পড়ছে ঝ’রে। / কী এর মর্মার্থ, কে জানাবে, এক, দুই, তিন সহস্র ভুবন!’
অতীত ও আগামী বিশ্বের সেই চলচ্ছবির মাঝে কম্পমান আমাদের আস্তিত্বিক অসহায়তার উষ্ণীষ ও বর্ম, পরাজয় ও প্রত্যয়, রোদন ও আনন্দধ্বনিগুলি, যা একই সঙ্গে অকিঞ্চিৎকর ও গৌরবময়, তাহার ক্ষীণমাত্র অনুভব যেন আমাদেরই গভীর অস্মিতার অন্ধকারে ঢাকা ছিল। হয়তো আমাদেরই কোনও বুকচাপা আকাঙ্ক্ষায় বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ সত্য হইয়া উঠিল একদিন। অন্ধকার সেই গুহার দেওয়ালে ফুটিয়া উঠিতে লাগিল আগুনের হরফ। নাজেল হইল অন্নপূর্ণা ও শুভকাল (১৩৮৮)। প্রণেতা, গৌতম বসু। বাংলা কবিতায় একটি নতুন সময়ের মহরত হইল বলা যায়। তবে সে কোনও সহজ গান নয়।
তাই, সেই বছর চল্লিশ আগে যে-কবি শুরু করিয়াছিলেন ‘জলের পরিবর্তে এই শ্রাবণ/ আর সহজ নয়’ বলিয়া, তাঁহাকে বাঙালি পাঠক যথেষ্ট সমীহভরেই মাথায় তুলিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার শর্তেই তাঁহাকে ভালো বাসিয়াছিলেন। কোনও সারল্যের দাবি ছাড়াই তাঁহার ক্ষীণতনু বহিগুলি ধীরে ধীরে আমাদের হৃদয়ে ও মগজে সিঁধাইয়া গিয়াছে। তিনি জানিতেন, ‘একজন শক্তিমান কবি কোনো ভাষায় যখন আত্মপ্রকাশ করেন, তখন, প্রাথমিক অনিশ্চয়তার পর ভাষা তাঁকে অনুসরণ করে’। প্রকৃত কবিজনোচিত আত্মজ্ঞান তাঁহার সূচনা হইতেই ছিল। তাই সারল্যের ছলনার তাঁহার দরকার পড়ে নাই।
প্রিয় পাঠিকা প্রিয় পাঠক, এখানে সারল্য বলিতে সততা বুঝিবেন না দোহাই। তাঁহার মতো পুরাদস্তুর সৎ কবি এবং সৎ জন আমরা কমই দেখিয়াছি। আবার, সারল্যের অনুপস্থিতি বলিতে কোনও চেষ্টাকৃত দুরূহতাও নয়। এক নিজস্ব ধরনের সাঁট বসুর রচনায় অবশ্যই আছে। তাহা ছাপাইয়া আছে শব্দসংস্থানের সাংগীতিক রহস্যময়তা। আবার সেই সংগীত-সুষমাটুকুই তাঁহার কবিতার একমাত্র প্রাপ্তি নয়। ভাবনার জগতে খুব নিঃশব্দে অন্তর্ঘাত ঘটাইয়া শেষ তক আমাদের এক অতিজাগতিক স্তব্ধতার মুখোমুখি দাঁড় করাইয়া দেন তিনি –
১. সবই আছে, কিন্তু এমনভাবে, / ভাতের হাঁড়ির নিচে আগুন নেই, জল / নদীতে জল নেই, আগুন; উদ্বেগ এই জন্য।
২. সকলেই যদি চক্ষুষ্মান, তবে পাষাণযোনিসম্ভূত এই জীব / কার কোপতলে চিড়ে গুড় মাথায় ফেরে?
৩. গোধূলিবেলায় সেই নিশ্চল মূর্তির সম্মুখে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থেকেছি, এক আলোকময় সিংহদ্বারের দুই জন্মান্ধ প্রহরী।
৪. পাগলের চটিজুতো মাথায় পরিয়ে দিয়ে / যারা আমায় নিয়ে চলেছে, তাদের কীভাবে / বোঝাই, আমিই বধ্যভূমি, আমিই শ্মশান।
৫. আমার রূপে মুগ্ধ কদম্ববন, বারবার ঝলসে উঠছে / তাণ্ডবনৃত্য, আহা মরণের সুগন্ধ, আহা আশ্রমকন্যারা / এত এত কবিতার বাতাস আমি যে আর সইতে পারি না।
৬. পুত্র, বাশো-র ন্যায় সংক্ষিপ্ত হতে শেখো, / কারণ, প্রাণ ওষ্ঠাগত, সময় অল্প।

একটি নির্ভার নিষ্পাপ সরলরেখায় ভর করিয়া বিবেচনার এক বিন্দু হইতে অন্য বিন্দুতে পৌঁছাইবার অনায়াস ভ্রমণের ফুরসত বসুর কবিতায় শুরু হইতেই কম। তবু তাহাদের ভাবনাবিস্তার নানা ডালপালায় আকাশনীলিমাকে ছুঁইতে চাহিলেও, মর্মশাঁস যেন আপন আপন ভ্রমরকৌটায় লীন। হয়তো, স্বর্ণগড়ুরচূড়া (২০১৩) বা মঞ্জুশ্রী (২০১৬)-র কিছু কবিতা বাদ দিলে, তাঁহার প্রায় সমস্ত রচনাই যেহেতু মিতায়তন, তাহাদের ভিতর বহুস্তরীয় প্রতিসরণের বর্ণচ্ছটা ধরা পড়িলেও একটি কেন্দ্রীয় সংহতি যেন তাহাদের বহুমেরুগামী করিয়া তুলে নাই। এমনকি, ওই দুইটি পুস্তকের দীর্ঘতর কবিতাগুলিতে কবি নানা আখ্যানিক বা নাট্যিক ঢঙ এস্তেমাল করিলেও, তাহাদের বিবিধ বিস্তার বাহিয়া বহমান বসুধারাটিকে আমরা একভাবে শনাক্ত করিতে পারি। সেই দিক দিয়া ভাবিলে, জরাবর্গ (২০১৮)-তে আসিয়া যেন এক নতুন কবিতাজন্ম ঘটিয়া গেল তাঁহার প্রকাশের।
এখানে বসুর পূর্ববর্তী বহি মঞ্জুশ্রী-র আখেরি কবিতাটি (সাপুতারা-র পথে) মনে করিতে পারি। ‘প’ড়ে রইলাম, অরণ্যশোভার শেষ ক্রোশে। / মানচিত্রনির্মাতাদের ভেঙে-পড়া যন্ত্রাদি, / তোমাদের পানে চেয়ে বিলক্ষণ বোঝা যায়/ সত্যের নিকটবর্তী হওয়ার পরিণাম। / জলদগ্ধ শিলালিপি হয়ে প’ড়ে রইলাম।’ আর, জরাবর্গ শুরু হইতেছে, ‘সব প্রশ্ন থেকে ভীষণ প্রতিহত, ফিরে আসছিলাম’, এমন একটি উচ্চারণের ভিতর দিয়া। যেন, যেসব প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা ‘অরণ্যশোভার শেষ ক্রোশ’ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়াছিল, পরিণামে দিয়াছিল ‘জলদগ্ধ শিলালিপি’ হইয়া পড়িয়া থাকিবার অভিভাব, সেসব হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া চলাচলের এক নতুন শুরুয়াতের বিবরণ শুনা গেল এইবার। সেই চলনকে অনুসরণ করিলে অচিরেই টের পাওয়া যায়, এই অমসৃণ বন্ধুর গ্রহত্বকের মানচিত্র রচনায় আজ কবির অবলম্বন পুঞ্জাক্ষির বহুমাত্রাময় অবলোকন। তাঁহার মুঠিতে-ধরা চকখড়ির ওঠানামায় কেবলই বঙ্কিম ভঙ্গুর বহুকৌণিক মোচড়। তাবৎ প্রয়াসের অজস্র রক্তপাতের ভিতর দিয়া সামান্য দু’দণ্ডের শান্তি, আবার শান্তির তালাশে প্রহরব্যাপী রক্তমোক্ষণ – ফিলহাল ইহাই যেন হইয়া দাঁড়াইয়াছে কবির নিয়তি। তবু তো শ্রান্তি নাই। শান্তি নাই, তবু শ্রান্তি নাই। শান্তি নাই, তাই শ্রান্তি নাই।
শান্তির একটিও মুহূর্ত, মহানিয়তি, ফিরে আসে না।
রৌদ্রদগ্ধ অলিন্দ, শান্তির একটিও মুহূর্ত, তোমায়
একা ফেলে যাবে না। তোমার সাহস ধ’রে রাখো, অলিন্দ।। (৮ম স্তবক, নীরবতা পালনের সারিতে)

শেষ তক খুঁজিয়া কিছু মিলিবে না জানিয়াও, চলে আপ্রাণ তত্ত্বতালাশ – ‘ধ্বংসের পল্লবছায়াশূন্য পথ ধ’রে আরও কিছু দূরে, / আরও অনেকটা এগিয়ে গিয়েও, তার দেখা মেলে নাই। / ভাবি, কত-না সংবাদ হারিয়ে, পথের ধারে ব’সে আছি।।’ (৬ষ্ঠ স্তবক, কী-বা দুলিছে ভুবনমোহন)। তবু সেই সন্ধিৎসা জাগিয়া উঠিতে থাকে, প্রাণের আদিমতা হইতে বর্তমানতা হইতে আগামীর অনপনেয় স্বপ্ন হইতে। প্রশ্নের কোনও উত্তর নাই জানিয়াও জাগে প্রশ্ন – ‘চতুর্থ প্রহরীকে দেখামাত্র বুঝলাম, সব সমাপ্ত। / চতুর্থজন জানে না, কোথায় বজ্র নেমে আসবে, / বজ্র, শক্তিপুঞ্জের অপার গুম্ফা, আপনিও কি জানেন?’ (৩য় স্তবক, মাথা নীচু ক’রে ফিরে আসছি)। তবু সেই জিজ্ঞাসা জাগিয়া উঠিতে থাকে, মননের বিমূঢ়তা হইতে বিহ্বলতা হইতে বিস্ময় হইতে।
সন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা, অনুজ্ঞা, আত্মানুসন্ধান, আত্মপ্রশ্ন, প্রশ্নহীনতা, সমর্পণ – একেকটি নিরুপায় তৎপরতায় উচ্চারণের নানান স্থানাঙ্ক – বিবৃতি, সম্বোধন বা স্বগতোক্তি। কিন্তু হায়, ইটের মতো ইহাদের গাঁথিয়া গাঁথিয়া চতুষ্কোণ কামরা তৈয়ার করিবার অনুক্রমিক নকশা তো ইতোমধ্যে উধাও। চেতন ও অবচেতনের বহুস্বর ও বহুস্তরকে ভাষার ভিতর দিয়া কিছুমাত্র উদ্ঘাটিত করিতে গেলে, প্রাণের সকল লহর এ-উহার সহিত জড়াইয়া লেপটাইয়া যায়। সেই সংশ্লেষ অবশ্য কোনও পরিবাহী-অপরিবাহী মাধ্যমের অর্থহীন পিণ্ডের সৃষ্টি করে না। তাহাদের অভাবিত বিন্যাসের ভিতর দিয়া হয়তো তাপ বা তড়িৎপ্রবাহের বদলে আমরা টের পাই এক মহাজাগতিক বিকিরণ। সেই বিকিরিণের কোমল আভা অজ্ঞাত শুশ্রূষার মতো রিনরিন করিতে থাকে আমাদের চিরপিপাসু অস্তিত্বে। আমরা, যাহারা দর্শক বা শ্রোতা বা পাঠক, সময়ের সেই মহাভাষ্যের। যে-ভাষ্যের নাম কবি দিয়াছেন, জরাবর্গ।

২.
জরা শব্দটি উচ্চারণ করিলেই, হয়তো আমাদের সংস্কারবশতই পিছু পিছু আসিয়া পড়ে মৃত্যু শব্দটি। মনে পড়ে, ‘শেষের সেদিন ভয়ংকর’-এর কথা। বসুর পূর্বাপর কবিতায় এই বৈনাশিকতার বহু স্মারক ছড়াইয়া আছে। বিশেষত তাঁহার মধ্যবয়সে রচিত নয়নপথগামী (২০০৮) কবিতাবহির রচনাগুলিতে জড়াইয়া-থাকা নিবিড় অবসান-কামী আবহ আমাদের স্তব্ধ করিয়াছিল। এখনকার পাঠিকা পাঠকদেরও একই প্রতিক্রিয়া জাগিবে মনে হয় –
১. এসো অগ্নি, প্রেতলোকের হাওয়া, ব্যাধিদের অধীশ্বর এসো, / তোমাদের পাব বলে করজোড়ে ফিরিয়ে দিয়েছি প্রক্ষালন, / এসো নগ্নবেশে, দুই হাতে তুলে নাও, এই কারাগার।
২. আমার শবাধারে অজস্র পেরেক গাঁথার / অবিরাম ধ্বনি আকাশ জুড়ে খেলে বেড়ায়
৩. ম্লান হেসে এগিয়ে এসেছে আমার বিনাশ
৪. খর্বকায় আমার এ-মরদেহের শিয়রে / কে এসে দাঁড়ালেন? কে আপনি, দিন না রাত্রি?

এমন কি তাঁহার পরবর্তী গ্রন্থগুলিতেও কখনও কখনও আমরা পাই এমন সব পঙ্‌ক্তির বেদনা –
১. বিয়োগব্যথা সংবরণ করা কঠিন, তাই চোখ বুজে থাকি
ভয়ানক রশ্মি এবং তাপ থেকে রক্ষা পাবার দুরাশায়
সভয়ে চোখ বুজে আছি, শীতলতা কোথায়, কোথা ইষ্টনাম,
শরীরকাণ্ড থেকে আমার দক্ষিণ বাহুটিরে বিযুক্ত ক’রে
ভূতলে নামিয়ে রাখলাম। – স্বর্ণগড়ুরচূড়া
২. পায়ে খস্‌ খস্‌ শব্দ, লাঠি ঠুকতে-ঠুকতে
সে এগিয়ে আসছে আমার শাস্তিগ্রহণের
মুহূর্তের দিকে; মুহূর্ত, না ঘণ্টা, না শতাব্দী,
শুয়ে-শুয়ে অনুমান করার চেষ্টা করছি।
শুনেছি, জীব, অতিশয় ভীত হয়ে পড়লে,
মোচনের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় কখনও-কখনও
জড়িয়ে পড়ে আপনার রোদনের জটায়;
বিলাপ করতে থাকে নীচুস্বরে, এমন কি,
ঘন-ঘন মূত্রত্যাগের ইচ্ছা জাগতে পারে। – মঞ্জুশ্রী

পড়িতে পড়িতে কাহার না গা শিরশির করিয়া উঠিবে! কাজেই এইসব পুরানো কবিতার পাঠ-অভিজ্ঞতার বশে যখন আমরা জরাবর্গ-এ পড়ি – ‘সামান্য বাতাস চাই, সামান্য ভ্রান্তি, সমাপনের নূপুরধ্বনি শোনার সামান্য জ্ঞান!’ তখন এই সমাপনের প্রসঙ্গটিকে বিশেষভাবে এই কবিতাবহিরই দ্যোতকচিহ্ন, এমন ভাবিতে পারি না। এখানে দীর্ঘ পথিকতার পর্যবেক্ষণ অবশ্যই আছে, আছে পরিণত অভিজ্ঞতার দৃঢ় দস্তখতও – ‘সহস্র বৎসরব্যাপী খেদ, প্রহরী, বহে নিরন্তর / সহস্র বৎসরব্যাপী জ্ঞান, প্রহরী, বহে নিরন্তর’। কিন্তু কখনই সেই প্রবীণতা জ্ঞানীর আসন হইতে কিছু বিশুষ্ক তাত্ত্বিকতা পরিবেশনের কোশেশ করে না। বরং, এই ‘বৃষ্টিপতন, ভীষণ ঝড়, আগুনের ঠিক মাঝখানে’ দাঁড়াইয়াও কবি যে-প্রখর রসবোধ, যে-আত্মকৌতুকের সামর্থ্য বহাল রাখিয়াছেন, তাহাই আমাদের বিস্মিত ও আনন্দিত করিয়া রাখে। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক –
১. পুব হাওয়াকে দোরে বসিয়ে মিষ্টান্ন কিনতে এসেছি।
আহা মূর্খ, নিজেই সুদীর্ঘ হাসি হাসলাম, উচ্চস্বরে,
পুব হাওয়াকে দোরে বসিয়ে মিষ্টান্ন কিনতে এসেছি!

২. রোজ ভোরে সে আমায় ঘুম থেকে তোলে, নিয়ে আসে এই
প্রান্তরে আর বলে, বালক, নাতিদীর্ঘ বিবরণ লিখ।
একদিন হুঙ্কারিলাম, যাও, হবে না, এটা অন্ধযুগ।।

৩. সমুখে এসে দাঁড়িয়েছেন দিকশূল, তাঁকে বললাম,
সবই পুঁটুলিতে, বার করুন দুর্ভাগ্যের সমস্ত শ্লোক,
ভয় পাই না এতটুকু, শোনা রয়েছে দক্ষিণারঞ্জন।।

আমরা জানি, বসু একজন বিপুল পড়ুয়া। মনে হয়, পাঠসূত্রেই তিনি কালক্রমে বৌদ্ধ সাহিত্য ও দর্শনের চর্চাকারী ও অনুরাগী হইয়াছেন। বুদ্ধের নিজের মুখের কথা লিপিবদ্ধ আছে ধম্মপদ গ্রন্থে। ইহাতে ২৬টি বর্গ বা অধ্যায়, যাহার অন্যতম হইল জরাবগ্‌গো। সেই সূত্রেই জরাবর্গ নামটির এস্তেমাল। ইহার ঠিক আগের বহিটি হইল মঞ্জুশ্রী, যে-মঞ্জুশ্রী কিনা অন্যতম একজন বোধিসত্ত্ব এবং মহাযান ও বজ্রযান পন্থার অনুসারী বৌদ্ধদের জ্ঞানের দেবতা। চিনে তাঁহার মর্যাদা পুরুষ সরস্বতীর মতো। তাঁহার এক হাতে একটি দ্বিফলা তরবারী, যাহা দিয়া তিনি অজ্ঞানতাকে ফালা ফালা করেন। আর অপর হাতে একটি পদ্মফুল, যাহার উপর রাখা আছে প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থ, যাহা সকল জ্ঞানের আকর। আমাদের প্রিয় জ্ঞানপিপাসু কবি যে মঞ্জুশ্রীর অনুরক্ত হইবেন, তাহা তো স্বাভাবিক। ওই বহির কিছু কবিতায় আমরা বৌদ্ধ উপকথার প্রশ্রয়ও দেখি।
মঞ্জুশ্রী-র পর জরাবর্গ। এই বহিটির পাঠে ঘনিষ্ঠ হইবার আগে আমাদের ক্ষুদ্র বুঝ মোতাবেক বৌদ্ধ দর্শনের কিছু বুনিয়াদি কথা আওড়াইয়া লইতে হইতেছে। ধম্মপদ-এর ধম্ম শব্দের প্রতিশব্দ ধর্ম বটে, কিন্তু বাংলায় ধর্ম বলিতে ইদানিং আমরা যাহা বুঝি, ধম্ম ঠিক তাহা নয়। ধম্মপদ গ্রন্থের পহেলা পদেই ধম্ম বিষয়ে বলা হইয়াছে – মনোপুব্‌বঙ্গমা মা ধম্মা মনোসেট্‌ঠা মনোময়া (যমকবগ্‌গো ১)। অর্থাৎ, মন ধর্মের আগে চলে (পূর্বগামী), মন [ধর্মের চেয়ে] শ্রেষ্ঠ, [ধর্ম] মনোময়। বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী, আমাদের পাঁচ ইন্দ্রিয় মারফত বাইরের দুনিয়ার সাথে আমাদের যে-যোগ, তাহাতেই দুনিয়া বিষয় আমাদের জ্ঞান গড়িয়া উঠিতেছে। এই সংযোগসূত্রটি কিন্তু অবিচল নয়, প্রতি মুহূর্তে তাহাতে বদল ঘটিতেছে। বাহিরের সাথে সংযুক্ত হইয়া জ্ঞান আহরণ করিবার ইন্দ্রিয়ের এই শক্তিটিই হইল ধর্ম। প্রতি মুহূর্তে এই ধর্ম জন্মাইতেছে ও মরিতেছে, আবার জন্মাইতেছে। এই সূত্রে আমাদের মনে পড়িয়া যায় বসুর আখতারী বাই কবিতার (অগ্রন্থিত কবিতা, কবিতাসংগ্রহ, ২০১৫) দুইটি লাইন – ‘যা কিছু হারালো সমাপ্তির আগেই, তা যেন জন্মায়, মরে, জন্মায় / যা-কিছু লাভ করেছি, তা যেন হারাতে পারি।’ এই অপূর্ব নিরাসক্তির কেন্দ্রে আছে বিশ্বের অনিত্যতা তবু প্রবহমানতায় আস্থা, যাহাকে বৌদ্ধ দর্শনে বলা হইয়াছে প্রতীত্যসমুৎপাদ।
প্রতীত্যসমুৎপাদের এই তত্ত্বটি ব্যাখ্যাত হইয়াছে মজ্ঝিমনিকায় গ্রন্থের একটি পদে (১। ৪। ৮) – ‘অস্মিন্‌ সতি ইদং ভবতি’, অর্থাৎ ইহা ঘটিবার পর উহা ঘটিতেছে। ঘটা বলিতে একটি ক্রিয়া বা ঘটনার সম্পূর্ণতা। অর্থাৎ, একটি ঘটমানতার সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটিলে তবেই পরবর্তী ঘটমানতার জন্ম। কোনও প্রদীপশিখার একটি অগ্নিবিন্দু জ্বলিতেছে, সেটি সম্পূর্ণ জ্বলিল, নির্বাপিত হইল, তাহার পর পরবর্তী অগ্নিবিন্দুটি জ্বলিল। গোটা প্রক্রিয়াটি অবশ্যই কার্যকারণের একটি প্রবাহ। কিন্তু তাহা কোনও অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ নয়, ধারাবাহিকভাবে জায়মান এবং বিচ্ছিন্ন একটি প্রবাহ। ইহাই হইল প্রতীত্যসমুৎপাদ, যাহা বুদ্ধের দর্শনের আধার। ইহার উপর ভিত্তি করিয়াই পরে নাগার্জুন তাঁহার শূন্যবাদ বিকশিত করেন। প্রতীত্যসমুৎপাদ অর্থ, প্রতীতি হইতে, কোনও বস্তু বা ঘটনার সমুৎপাদিত হওয়া। অপরাপর ভারতীয় দার্শনিক ঘরানাগুলি প্রতীতি বা প্রত্যয় বলিতে হেতু বুঝান। কিন্তু বুদ্ধ অতীত অর্থে প্রতীতিকে বুঝিতে ও বুঝাইতে চাহিয়াছেন। তাঁহার বিবেচনায়, একটি বস্তু বা ঘটনা অতীত বা ধ্বংস হইয়া গেল, সেই বিনষ্টির সূত্রে পরবর্তী বস্তু বা ঘটনার প্রাদুর্ভাব।
আমাদের মনে হয়, বুদ্ধ উপস্থাপিত প্রতীত্যসমুৎপাদের বিচ্ছিন্ন প্রবাহের এই তত্ত্বটিকে গৌতম বসু তাঁহার জরাবর্গ গ্রন্থের কাব্যশরীরে অত্যন্ত নিপুণভাবে প্রয়োগ করিয়াছেন। এই বহির প্রতিটি কবিতা, যে যেমনই আকারের হউক, বেশ কয়েকটি ত্রিকে (তিন পঙ্‌ক্তির স্তবক) বিন্যস্ত। বহিতে মোট আটটি কবিতায় ত্রিকগুলির সংখ্যা এই রকম –
ক্রম শিরোনাম ত্রিক সংখ্যা
১ ছায়া ঘনাইছে বনে বনে ১০
২ কী-বা দুলিছে ভুবনমোহন ১০
৩ সেই তরবারির খোঁজে ১০
৪ কিছুটা বিনাশের ধ্বনির মতো ১০
৫ নীরবতা পালনের সারিতে ৮
৬ মাথা নীচু ক’রে ফিরে আসছি ৪
৭ ভোরের পাখিকে জিজ্ঞাসিলাম ৯
৮ সমুখে এসে দাঁড়িয়েছেন দিকশূল ৯
কবিতাগুলিতে প্রতিটি ত্রিক তাহার অব্যবহিত পরের ত্রিকের সাথে হয়তো বা সাবেকি কার্য-কারণ সূত্রে কঠোরভাবে বাঁধা নহে। হয়তো সেই জন্যই প্রতিট ত্রিকের মাঝে একটি করিয়া চিকন তারকাচিহ্ন মুদ্রিত আছে। তবে সব কয়টি ত্রিক মিলাইয়া প্রতিটি কবিতায় একটি ভাবপ্রবাহ আমরা টের পাই। আবার সবকয়টি কবিতা মিলিয়াও একটি প্রবাহ। প্রবাহ, কিন্তু তাহা যেন কোনও পরম্পরায় শৃঙ্খলিত নয়। যেন, প্রতীত্যসমুৎপাদের তত্ত্ব মোতাবেক এক জায়মান অথচ বিচ্ছিন্ন প্রবাহ গ্রন্থটিতে আমাদের নিবিষ্ট করিয়া রাখে।

৩.
কবিতা যেভাবেই কথিত হউক, তাহার একজন কথক থাকেন। সেই কথক কখনও শূন্যতার নিরুদ্দেশে (হয়তো কখনও পাঠকই সেই শূন্যতা), কখনও নিজের উদ্দেশে, আবার কখনও কোনও শ্রোতার উদ্দেশে (হয়তো কখনও পাঠকই সেই শ্রোতা) কথা বলেন। কথায় কখনও থাকে বিবরণ, কখনও প্রশ্ন, কখনও অনুরোধ, কখনও শুধুই স্বগতোক্তি। আমাদের সংস্কার, এসবের একটি ঐক্যে হেলান দিতে চায়। জরাবর্গ-এর কবিতায় বসু খুব সযত্নে সেই অভ্যস্ত তাকিয়াটি আমাদের পিছন হইতে সরাইয়া লইয়াছেন। তিনি সংলাপ অসম্পূর্ণ রাখিয়া শুরু করিয়াছেন বিবরণ, আবার বিবরণ কখন চলিয়া গিয়াছে স্বগতোক্তিতে। তাঁহার প্রশ্ন বা অনুরোধের ওপারের তুমি-কে হরবকত শনাক্ত করা মুশকিল। কখনও এই উদ্দীষ্ট এক ছায়ামূর্তির প্রায়, কখনও যেন নির্মিয়মাণ, কখনও আবার এক সত্তা হইতে আর এক সত্তায় প্রতিসৃয়মান।

অন্তত একটি কবিতার নিবিড় পাঠপ্রয়াসের এন্তেজাম না-করিলে আমরা এই বহির সেই প্রয়োগবৈচিত্র্য ঠিক আমলে লইতে পারিব না। প্রিয় পাঠিকা প্রিয় পাঠক, আসুন, আমরা বরং কী-বা দুলিছে ভুবনমোহন শীর্ষক কবিতাটির অন্দরমহলে প্রবেশ করিবার খানিক কোশেশ করি। কবিতাটি শুরু হইতেছে কথকের তরফে একজন তুমি-কে বলা কিছু কথায়। পাঠকের সাথে সেই তুমি-র পরিচয়-পর্ব ঘটে নাই। সেই অপরিচয়কে পাশ কাটাইয়া আমরা কথকের কথায় কান পাতি –
স্পর্শ করলাম তোমায় নয়, তোমার অতল সামগ্রী,
তিলার্ধ ক্ষতি নেই আমার, ছাই হয়েছে বসন্তকাল,
কী-বা দুলিছে ভুবনমোহন, কী-বা অমূর্ত আশঙ্কায়।। ১

দেখি, বাক্যের অপর পারে থাকা তুমি-কে স্পর্শ না-করিয়া, তাহার ‘অতল সামগ্রী’ বা গহনতাকে স্পর্শ করিয়াছে কথক। এ যেন সেই বাউল সাধনার অভিব্যক্তি – ‘চুল ভিজাব না আমি বেণী ভিজাব না / জলে নামব জল ছড়াব জল তো ছোঁব না।’ কিন্তু কাজটি যে ভয়ঙ্কর তাহা পরিণাম হইতেই বুঝা যায়। বসন্তকাল, যাহাকে ঋতুরাজ বলা হয়, পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে। কথক অবশ্য ঘুরাইয়া খানিক অহঙ্কারই প্রকাশ করে যে, এমন ঘটনায় তাহার বিন্দুমাত্র ক্ষতি নাই! তাহার তো ক্ষতি নাই, তবু ভুবনমোহন দুলিয়া উঠিল কেন! সে-দোলার ভঙ্গিটি অব্যক্ত (কী-বা), কিন্তু প্রবর্তনা এক অজানা ‘অমূর্ত আশঙ্কা’। সবকিছু যদি ঠিকঠাক, তবে আশঙ্কা কিসের? এই ভুবনমোহনটিই বা কে? প্রথম ত্রিকে জাগিয়া-উঠা এইসব রহস্যের মীমাংসার জন্য আমাদের প্রতীক্ষা রহিল।

কিন্তু সে-প্রতীক্ষা আপাতত মিটিবার কোনও সম্ভাবনা নাই। শুনা যাইতেছে রাতের পাখিদের অসহায় কিন্তু দুরূহ কিছু প্রশ্ন। যেসব প্রশ্নের সাথে আগের ত্রিকের উপস্থাপনার সরাসরি কোনও সম্পর্ক নাই –
রাতের পাখিরা সকাতরে শুধায় অতন্দ্র ধাত্রীদের,
না যুদ্ধ, না মৃত্তিকা, না বায়ুস্তর, না প্রগাঢ় শব্দকোষ
অজ্ঞাত সেই ভাষার কিছু চিহ্ন, কি প’ড়ে রইল, পুথি? ২

এই ত্রিকে কথক নিজে গরহাজির। তাহার ভূমিকা একজন প্রতিবেদকের। প্রতিবেদনের ভিতর হইতেই উঠিতেছে কিছু প্রশ্ন। রাত্রিপ্রহরের তমসায় সবারই ঘুমের অবকাশ আছে। কিন্তু যাহারা ধাত্রী, তাহারা অতন্দ্র। নতুন একটি দিন আসিবে বলিয়াই হয়তো। আর জাগিয়া থাকে নৈশ পাখিরা, তাহাদের বিপন্নতা লইয়া, ধাত্রীদের কাছে আর্ত প্রশ্ন লইয়া। মৃত্তিকা আর বায়ুস্তরের মাঝখানে চলে এক নিরন্তর যুদ্ধ। সে-যুদ্ধের আখ্যান রচনার শব্দ ঝরিয়া পড়ে এক প্রগাঢ় শব্দকোষ হইতে। কিন্তু এই আকাশ এই মাটি, মধ্যবর্তী পরিসরের এই যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের আখ্যান – ইহাদের কোনও কিছুই কি আদৌ টিকিয়া থাকে! কোনও গোপন কোণে নিঃশব্দে পড়িয়া-থাকা কোনও পুথি কি বহন করিয়া লইয়া চলে ‘অজ্ঞাত সেই ভাষার কিছু চিহ্ন’, যাহাতে সেসবের সামান্যতম স্বাক্ষর রহিয়া যায়?

তৃতীয় ত্রিকে আমরা কথককে আবার পাইতেছি, এবং বেশ সক্রিয়তার সাথেই পাইতেছি। কিন্তু সেই সক্রিয়তার পরিণতি কি সবকিছু আশাব্যঞ্জক হইল? –
শব্দের সারি নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম, আঃ নশ্বর!
নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলাম তোমায়, সুতীব্র বাঁশরি,
তবু, নিজের দিকে ফিরে এল না কাঁকর বিছানো পথ।। ৩

এই ত্রিকে পরপর দুই লাইনে আমরা কথকের দুইটি তৎপরতা পাইতেছি। দুইটিই অভিমুখ বদল সংক্রান্ত কাজ। লক্ষ করিবার, কাজ দুইটির অভিমুখ কিন্তু বিপরীত – ‘ঘুরিয়ে দিলাম’ আর ‘ঘুরিয়ে নিলাম’। কিন্তু ‘শব্দের সারি’-তে শূন্য বিভক্তি সাঁটানো থাকায়, তাহার ঘুরিবার অভিমুখ লইয়া একটি মৃদু ধন্দ তৈয়ার হইতেছে। সহসা মনে হইতে পারে, তুমি আর শব্দের সারি এই দুই অস্তিত্বকেই বুঝি কথকের নিজের দিকে ঘুরানো হইল। সেইভাবে পাঠ করিলে অর্থের তুমুল এদিক-ওদক হইয়া যায়। কিন্তু আমরা ‘ঘুরিয়ে দিলাম’ আর ‘ঘুরিয়ে নিলাম’-এর প্রয়োগ-বৈপরীত্যকেই গুরুত্ব দিলাম। যাহা হউক, শব্দসংস্থানকে তো আপন কক্ষপথে ফিরত পাঠাইয়া দেওয়া হইল। অর্থাৎ তাহারা কোনও না কোনওভাবে অভিমুখ-ভ্রষ্ট হইয়াছিল। শব্দ সবসময়ই প্রতারক। তাহারা বিপথে গিয়া আমাদের বিভ্রান্ত করে। আত্মজ্ঞান সম্পন্ন শব্দকুশলীই পারেন শ্রেষ্ঠ বিন্যাসের ভিতর দিয়া তাহাদের প্রকৃত নির্যাস নিষ্কাশিত করিতে। এহেন কাজের ভিতর দিয়া কবিতার কথকের একটি আত্মপরিচয় এইভাবে ধরা পড়িল। সেই পরিচয় কোনওভাবে কবিতাটিকে মর্মে ধরিতে আমাদের সহায় হয় কিনা দেখা যাক।
এইবার বিপরীতমুখী আর এক ঘুর্ণন। এক মধ্যম পুরুষকে এইবার কথকের নিজের অভিমুখে ঘুরাইয়া লইবার উদ্যম। সেই মধ্যম পুরুষ, তুমি, এক নশ্বর অস্তিত্ব যদিও। তবু সেই নশ্বরতা লইয়া কথকের স্বস্তি মুগ্ধতা ও বিহ্বলতার অভিব্যক্তি ফুটিয়াছে একটি ধ্বনিতে – আঃ! সেই তুমিটি হইল এক সুতীব্র বাঁশরি। শব্দকে প্রতিস্থাপিত করিয়া তবে প্রাণের অলিন্দে সুর তুলিয়া লইল কথক। কিন্তু… কিন্তু এই সমস্ত উদ্যোগ কি কোনও ইতিবাচকতায় পৌঁছাইল? তাহা টের পাইতে গিয়া আমরা আসিয়া পৌঁছাইলাম এই ত্রিকের অন্তিম রহস্যে – ‘তবু, নিজের দিকে ফিরে এল না কাঁকর বিছানো পথ’। কথকের নানা কিসিমের তৎপরতা সত্ত্বেও পথ নিজের দিকে ফিরিল না। কোন্‌ পথের কথা উঠিল? যে-পথই হউক, পথ তো কেবল চলিতেই থাকে। সে কি কখনও নিজের দিকে ফিরে? এখানে উল্লেখিত পথটি আবার কাঁকর বিছানো! তবে কি সাধনার দুর্গম পথের দিকে ইশারা করিতেছে কথক? সেই পথ বাহিয়া চলিতে চলিতে সাধককে কখনও কখনও তো নিজের দিকেও ফিরিতে হয়। সেই প্রত্যাগমনই কি আরব্ধ রহিয়া গেল?

কথা বলিবার জন্য কথকের শ্রোতা লাগে। শ্রোতাকে আড়ালে রাখিয়াও তাহার সহিত সংলাপ চলে। কখনও কখনও আবার নিজেই সেই আড়ালে-থাকা শ্রোতা হইয়া উঠে কথক। ৪র্থ ত্রিকে আমরা যে-মধ্যম পুরুষটির উদ্দেশে বলা কথা শুনি, সেই তুমি যেন নিজেরই আত্মবিশ্লিষ্ট এক সত্তা –
এতদিনে তোমায়, তোমারই নরকাগ্নির মতো দেখাল।
বিমর্ষ কারিগর, পরিণাম এমনই, কৃতি ও অকৃতি
বিশুদ্ধ হাস্যরস এসো, বলো, কৃতি অকৃতি সমান।। ৪

হয়তো ইতোমধ্যে সময় বহিয়া গিয়াছে ঢের। হয়তো শুভ কিছুর জন্য এন্তেজার ছিল। কিন্তু আজ , ‘এতদিনে তোমায়, তোমারই নরকাগ্নির মতো দেখাল’। তুমি-রই গহনতম ভয়াবহ কোনও এক রূপ তাহার এই নরকাগ্নি। যে-তুমি একজন কারিগর, যে হয়তো বা নিজেকে কৃতি ভাবিত, আজ সে ঠাহর করিতেছে, তাহার অকৃতিগুলিই যেন তাহার নরকাগ্নি হইয়া উঠিয়াছে। এহেন পরিণতি দেখিয়া স্বাভাবিকভাবেই সে বিমর্ষ। ইত্যবসরে তাহারই কোনও প্রতিসত্তা আসিয়া যেন পরিহাসের ছলে মনে করাইয়া দেয় – উদাসীন মহাসময়ের দাঁড়িপাল্লায় কৃতি-অকৃতি দুইই তুল্যমূল্য। এই পুরা আলাপটি কোনও এক সৃজনশীল মনের অহম-প্রতিঅহমের সংলাপ না-হইয়া যায় না।

সংলাপ হইতে আবার স্বগতে ফিরিতে হয়। কথক কি কিছুটা বীর-রসাত্মক ৫ম ত্রিকে! তাহার আত্মোপলব্ধি ঘোষণা দেয় যে, সে এক বজ্ররব। জলভরা ঘনদেয়া ঘনাইয়া উঠিয়াছে তাহার অন্দরে –
আমি বজ্ররব, উদরে ঘনিয়ে উঠেছে বাদলমেঘ,
সমস্ত বর্ণ চিরতরে হারাবার পর, কম্পন কেন,
শীতের প্রবল দংশনে কাঁপছে কেন, গাছের পাতারা।। ৫

বজ্রনাদ সত্ত্বেও প্রশ্ন কিন্তু থামিয়া থাকে না। হয়তো বা আত্মপ্রশ্নই তাহা। কথকের মনে পড়িয়া যায়, ‘সমস্ত বর্ণ চিরতরে’ হারাইয়া গেছে। আমাদেরও মনে পড়ে, ১ম ত্রিকে বলা হইয়াছিল – বসন্তকাল পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে। এই ঘটনা কি তাহারই জের? তবু এত ধ্বংসের পর অস্তিত্বের ভিতর এখনও যে কিছু অনুরণন জাগে, সে এক বিস্ময়। শীতের কামড়ে গাছের পাতারা যে আজও কাঁপে, সে কি আবার কোনও বসন্তের স্বপ্নে! একটি ধ্বংসের পর, আবার একটি জন্ম?

৬ষ্ঠ ত্রিকেও স্বগতকথন চলিতে থাকে। ধ্বংসের পথ ধরিয়াই চলিতে হয় আরও বহুদূর –
ধ্বংসের পল্লবছায়াশূন্য পথ ধ’রে আরও কিছু দূরে,
আরও অনেকটা এগিয়ে গিয়েও, তার দেখা মেলে নাই।
ভাবি, কত-না সংবাদ হারিয়ে, পথের ধারে ব’সে আছি।। ৬

এই ত্রিকে আসিয়া বুঝা যায়, কথক এক পথিকতায় লিপ্ত। এবং, সে-পথিকতা নিরুদ্দেশ নয়। বিধ্বস্ত বৃক্ষছায়াহীন পথ ধরিয়া কাহাকেও একটা খুঁজিতে বাহির হইয়াছে সে। কিন্তু পথ এমন বিধ্বস্ত কেন! তবে কি ২য় ত্রিকে যে-যুদ্ধের প্রসঙ্গ আসিয়াছিল, এই ধ্বংস তাহারই অনিবার্য পরিণাম? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। তবে যাহার তালাশে এই পথচলা, ‘অনেকটা এগিয়ে গিয়েও, তার দেখা মেলে নাই’। মনে হয় সমস্ত সংযোগসূত্র আজ হারাইয়া গেছে। এখন শুধু দিশাহীন এন্তেজার। কিন্তু কাহার জন্য? রহস্য মুলতুবি রাখিয়াই আমাদের আগাইতে হয়।

৭ম ত্রিকে আসিয়া মনে হয় এই কবিতার আরোহণ পর্বটি বুঝি এইবার পার হইয়া আসিলাম। কারণ ছয়টি ত্রিক পার হইয়া আসিয়া কথকের জবানে এইখানে আবার ফিরিয়া আসিয়াছে ১ম ত্রিকের অনুষঙ্গ, সেই ভুবনমোহনের কথা –
কী-বা দুলিছে ভুবনমোহন, কেন ব’লে উঠেছিলাম।
আপনি শান্ত, ভাষার সূর্যাস্তের পানে চেয়ে রইলেন,
দণ্ডপ্রাপ্তদের একজন, না ঘাতক, অস্পষ্ট রইল।। ৭

হ্যাঁ, কথা আবার উঠিয়াছে বটে, কিন্তু সে যেন পুরানো এক ভুল শুধরানোর অসিলায়। ভুবনমোহনের যে-অব্যক্ত দোলনভঙ্গিমা লইয়া ১ম ত্রিকে বিস্ময় বা প্রশ্ন তুলা হইয়াছিল, এখন কথকের জবানে তাহার জন্যই আফসোস! আমাদের মনে পড়ে, ভুবনমোহনের সেই দোদুল্যমানতা ছিল এক অজানা ‘অমূর্ত আশঙ্কা’ জনিত কারণে। এখানে সেই অংশটির পুনরাবৃত্তি করা হয় নাই বটে, কিন্তু মনে হয় সাবেক সেই পর্যবেক্ষণটিও কথকের বর্তমান অনুতাপের অন্তর্গত। এই ত্রিকের ২য় পঙ্‌ক্তির সম্মানসূচক সম্বোধন তো মনে হয় ভুবনমোহনকেই করা। কথকের চোখে এখন ধরা পড়িতেছে, তিনি শান্ত। তাহা হইলে, কোনও এক অজ্ঞাত বিপদের সম্ভাবনায় তিনি ভীত হইয়া দোদুল্যমান হইয়া পড়িয়াছিলেন, এমন ধারণা কতই না ভুল ছিল! কিন্তু শুধুমাত্র ভুল মেরামতেই এই ত্রিক ফুরায় না। দেখা যায়, প্রশান্ত ভুবনমোহন ‘ভাষার সূর্যাস্তের পানে’ চাহিয়া রহিয়াছেন। ভাষার সূর্যাস্তের কথা শুনিয়া আমরা একবার ২য় ত্রিকে চোখ ফিরাই। সেই ত্রিকের আর্ত রাতপাখিরা কোনও এক ভাষার চিহ্ন কিছু অবশিষ্ট রহিয়া গেছে কি না, এই প্রশ্ন তুলিয়াছিল। ভুবনমোহন কি সেই ভাষারই সূর্যাস্তের দিকে চাহিয়া আছেন? তিনি হয়তো সমস্ত সংক্ষোভের ঊর্ধ্বে এক অপার শান্তি অর্জন করিয়াছেন। কিন্তু ভাষার সূর্য ডুবিলে তো মানবিক সংযোগের আর কোনও মাধ্যম থাকে না। শব্দের তাবৎ বোধ ভাষাহীন অন্ধকারে অস্পষ্ট হইয়া বিলকুল মুছিয়া যায়। ভুবনমোহনও অস্পষ্ট থাকিয়া যান। তিনি ঠিক কে বা কী? তিনি কি স্বেচ্ছায় ভাষার ঘাতক, না কি ভাষাহীনতায় দণ্ডপ্রাপ্ত একজন – সেকথা মীমাংসারও কোনও সূত্র থাকে না।

অবশ্য ভাষা প্রপঞ্চটিও রহস্যময়। মানুষের বুঝও বদলের মুখোমুখি হয়। কথকের স্বগতভাষ্যে ধরা পড়ে, গুহাহিত আপ্তবাক্যের মতো ধ্বংসদিনের যে-সরল অর্থ একদা কবুল হইয়াছিল, আজ তাহাতে হেরফের ঘটিয়া গিয়াছে –
একদা শুনেছিলাম গোপনে, প্রলয়ের অর্থ প্রলয়।
এখন, কি আশ্চর্য রঙ দেখছি, পুথির সূক্ষ্ম ভাষায়,
যেমন ভেবেছিলাম, তেমন নয়, তরবারির হাস্য।। ৮

সেই ঋতুবদলের জেরে ৮ম ত্রিকের আবহাওয়া জুড়িয়া যেন শান্তরসের স্রোত। টীকাভাষ্য-নির্ভর শব্দবীজের একমাত্রিকতা আজ উধাও। ২য় ত্রিকে রাতপাখিরা যে-পুথির উল্লেখ করিয়াছিল, বুঝিবা সেই পুথিখানি ভাসিয়া উঠিয়াছে দিগন্তসীমায়। সেখানে ভাষার ভিতরের অন্তর্লীন কারুকার্য ধরা পড়িতেছে কথকের চোখে, ধরা পড়িতেছে সে-ভাষার ‘আশ্চর্য রঙ’! তাই বলিয়া উপলব্ধির সেই ভিন্নতায় যে সব রহস্য উধাও হইয়া যাইবে এমন নয়। রহস্য নতুন করিয়া তৈয়ার হয় শেষ পঙ্‌ক্তিতে ব্যবহৃত একটি কমা (,)-য় – ‘যেমন ভেবেছিলাম, তেমন নয়, তরবারির হাস্য’। যদি লিখা হইত, ‘যেমন ভেবেছিলাম, তেমন নয় তরবারির হাস্য’, তবে, তরবারির হাসির মর্মার্থ উপলব্ধিতে রদবদল ঘটিয়া গিয়াছে, সরাসরি এমন অর্থ করা যাইত। কিন্তু ‘তেমন নয়’-এর পর ওই অর্ধযতিটির (,) প্রয়োগে আর একটি সম্ভাবনার ফটক খুলিয়া গেল। এমন একটি অর্থও আভাসিত হইতে থাকিল যে, (তাহাকে) যেমন ভাবিয়াছিলাম, (সে) তাহা নয়, (সে যেন) তরবারির হাস্য। সে বা তাহা যে প্রলয়, এটুকু স্বতঃসিদ্ধ। কারণ, প্রলয়ের অর্থেই তরমিম ঘটিয়াছে। প্রলয় বলিতে গুপ্তবিদ্যায় যাহা শুনা গিয়াছিল, যাহা ভাবা গিয়াছিল, সে তো তেমন নয়। সে যেন তরবারির হাসি! প্রশ্ন উঠিতেই পারে, তরবারির মুখে হাসি কেন! সে কি কোনও জল্লাদের ক্রুর হাসি। না কি সে এক বিদগ্ধ হাসি, যাহার উৎস সেইসব আকাট মানুষের মূর্খতা, কেয়ামতের ভিতর দিয়া নতুন দুনিয়া পয়দা হইবে ভাবিয়া যাহারা উল্লসিত? কথক তাহা বিস্তারিত করে নাই।

৯ম ত্রিকে কথকের মন এইবার চলিয়া যায় অতীতে। সব কিসিমের প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসাকে দূরে সরাইয়া রাখিয়া, সে যেন সেই সময় একবার জান বাজি রাখিয়াছিল। নিজের প্রাণ সে রাখিয়া আসিয়াছিল রোহিণীর কুশাসনের নিচে –
না প্রশ্ন, না জিজ্ঞাসা, তোমার কুশাসনের তলে, রোহিণি,
আমার ক্ষুদ্র প্রাণ রেখে এসেছিলাম; ওই যে গুঞ্জন
শুনেছিলে, তা কি আর হ্যাজাকের শব্দে ধ’রে রাখা যায়? ৯

সেদিনের সকল প্রয়াস ছিল প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার ঊর্ধ্বে। কিন্তু কথককে আজ আবার প্রশ্নে ফিরিতেই হয়। কারণ মনে পড়ে, তাহার সেই অসমসাহসিক তৎপরতা সেদিন কিছু মৃদু জনরব তৈয়ার করিয়াছিল, যাহা হয়তো কোলাহল নয়, কিন্তু ‘গুঞ্জন’। আজ প্রশ্ন জাগে – ‘ওই যে গুঞ্জন শুনেছিলে, তা কি আর হ্যাজাকের শব্দে ধ’রে রাখা যায়?’ অবশ্য প্রশ্ন পেশ করিবার তরিকাতেই বুঝা যায় তাহার ভিতর বেশ খানিক পরিহাস মিশিয়া আছে। গুঞ্জনের শব্দ ধরিয়া রাখার ব্যাপারে শ্রোতাই যেন আগ্রহী, আর কথক কিছুটা নির্বিকারভাবে তাহাকে নিবৃত্ত করিতে চাহিতেছে। কিন্তু হ্যাজাকের শব্দের কথা কেন! হ্যাজাক বলিলেই ভাসিয়া উঠে একটু অতীত বাংলার কোনও যাত্রা বা কবিগানের আসর। বা, হয়তো কোনও নাটমন্দির, যেখানে বসিয়াছে কোনও পূজার আয়োজন। হ্যাজাক জ্বালা হইত জোরালো আলোর জন্য। আলো ছাড়াও উপরি পাওনা ছিল তাহাদের শব্দ। সেই একটানা সোঁ সোঁ শব্দ গোটা পরিবেশকেই এক উচ্চগ্রামে বাঁধিত। তেমনই এক আয়োজন বুঝি কথকের অগোচরেই তৈয়ার হইয়াছে – একটু চড়া আলো, একটু কোলাহল। সেই সাবেক ‘গুঞ্জন’-এর ধারাবাহিকতা রক্ষার অসিলায়।
কিন্তু কথকের এত অন্তরঙ্গ কথা কাহার সঙ্গে? সেই রোহিণী কি এখন আবার সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে? রোহিণীই বা কে? সে কি কোনও বিদ্যুৎলতা? কোনও বিদ্যাধরী? কোনও আরোহণকারিণী? আমাদের মনে পড়ে, অন্নপূর্ণা শিবের উপর আরোহণ করেন, তাই ভারতচন্দ্র তাঁহার অন্নদামঙ্গল কাব্যে অন্নপূর্ণাকে একজায়গায় শিবরোহিণি বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন –
শিবগেহিনি শিবদেহিনি
শিবরোহিণি শিবমোহিনি
শিবসোহিনি গো।।

তবে কি এই কবিতার উপান্তে আসিয়া এইভাবে আমরা শুভকালের অন্নপূর্ণাকে প্রত্যক্ষ করিলাম! আর কথকের সাঁটের আড়াল হইতে কি সহসা উঁকি মারিল আমাদের প্রিয় কবিরই আত্মজীবনীর আভাস? মনে পড়িয়া যায়, কবিতার ৩য় ত্রিকে আত্মজ্ঞান-সম্পন্ন শব্দকুশলীর মতো কথক বলিয়া উঠিয়াছিল – ‘শব্দের সারি নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম’। মনে পড়িয়া যায়, কবিতার ৪র্থ ত্রিকে কথকের বয়ানে ফুটিয়া উঠিয়াছিল সৃজনশীল মনের অহম-প্রতিঅহমের সংলাপ। সেখানে নিজেকে সে বলিয়াছিল এক ‘বিমর্ষ কারিগর’। এই ‘আবিষ্কার’-এর আনন্দ লইয়া আমরা এই কবিতার আখেরি ত্রিকের দিকে তাকাই।

দুইজনের উদ্দেশে দুইটি না-বলা কথার উচ্চারণ দিয়া গড়িয়া উঠে এ-কবিতার ১০ম ত্রিক। দুইটি বাক্যাংশের ভিতর দিয়াই যেন অনুমতি চাওয়া হইতেছে কথকের পুরা আকাঙ্ক্ষাটি পেশ করিবার, তবু তাহা যেন অনুচ্চারিতই থাকিয়া যাইতেছে। দুইটি বাক্যাংশের ভিতর দিয়াই যেন প্রত্যাশা করা হইতেছে শ্রোতার কোনও সুস্পষ্ট উত্তরের, অথচ সে-প্রত্যাশা অর্ধস্ফুটই রহিয়া যাইতেছে –
অনন্তশায়ী, যদি বলি, তোমার পালঙ্কের পাশ দিয়ে
হেঁটে আসতে-আসতে একটা জীবন শেষ হয়ে এল;
যদি বলি, অন্তরীক্ষ, তিলেক দাঁড়াও এই বাতায়নে।। ১০

কথকের দুইজন উদ্দীষ্ট এই ত্রিকে – অনন্তশায়ী আর অন্তরীক্ষ। অনন্তশায়ী বলিতে এই মৃত্তিকাকেই বোধ হয়। তাহা হইলে, নিচে ভূমি আর উপরে আকাশ – দুইবার দুইদিকে তাকাইয়া কথকের দুই অর্ধস্ফুট কথা। যেন, পৃথিবীকে জানিতে জানিতেই পুরা আয়ুষ্কাল খরচ হইয়া গেল কথকের, তাই আজ তাহাকে মহাশূন্যের দিকে ফিরিয়া তাকাইতে হয়, আরও আরও নতুন পৃথিবীর নতুন জীবনের সন্ধানে। কারণ, জীবন একদিকে যেমন অবচ্ছিন্ন, তেমনই তাহা আবার প্রবহমান।
কিছুটা অন্যভাবেও ভাবা যায়। অনন্তশয়নের অন্যতম আভিধানিক অর্থ মৃত্যু। সেই অর্থটি আমলে লইলেও চিন্তাসূত্র কিন্তু একই দিকে গড়ায়। কথক হয়তো অনুভব করে কোনও মৃত্যুপুরুষকে পরিক্রমা করিতে করিতে ঘনাইয়া আসে এই জীবনের অবসান! মহাকালের প্রেক্ষিতে তো জীবন একটি মুহূর্ত মাত্র। প্রাণের এই যে অগ্নিবিন্দুটি সেখানে জ্বলিতেছে, মুহূর্তের অবসানেই সেটি নিবিবে। তবে আবার মহাশূন্যে জ্বলিয়া উঠিবে কোনও নতুন বিন্দু, সেই একই প্রত্যাশা এইভাবেও। সেই প্রতীত্যসমুৎপাদ!
কিন্তু ইহা তো গেল দর্শনের পাঠ, কবিতা রহিয়াছে ওই ‘যদি বলি’-র ভিতর। এই যে সুবিনীত দ্বিধা – আমি কি বলিব আমার সামান্য কথাখানি? বলিলে তুমি কি শুনিবে, সাড়া দিবে? সমস্ত শূন্যতার সামনে দাঁড়াইয়া নিঃসঙ্গ নিরহঙ্কার মানুষের এই যে আবহমান আকুতি, ইহাই হয়তো এই কবিতার সকল ছেদবিন্দুর ভিতর দিয়া বহিয়া আসা এক প্রাণময় প্রবহমানতা। জরামুক্তির প্রার্থনায় যে-প্রবাহের সামনে ঝুঁকিয়া পড়িয়া আমরাও দিগন্ত পার হইয়া যাই। পিছনে পড়িয়া থাকে আমাদের ছিন্নছেঁড়া কম্পমান মুখচ্ছবিগুলি।

৪.
এই সামান্য গদ্য এইখানেই শেষ করি। ইহার যাবতীয় অতিকথন ও উনকথনের জন্য যাঁহার কাছে গিয়া ক্ষমাপ্রার্থীর মতো দাঁড়াইতে পারিতাম, তিনি আজ নাই। প্রিয় পাঠিকা প্রিয় পাঠক, আপনাদের কাছেই নিজেকে জামিন রাখিলাম।

আষাঢ় ১৪২৭

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (5)
  • comment-avatar

    সেলাম দুই “গৌতমদা” কেই!!!

  • comment-avatar
    স্বপন নাথ 2 years

    কে কার জন্যে অমর , গৌতম বসুর জন্য গৌতম চৌধুরী নাকি গৌতম চৌধুরীর জন্য গৌতম বসু ? কি অসাধারণ বিশ্লেষণ! চোখ সরাতে পারছি না।শ্রদ্ধায় নতজানু হয়ে যাচ্ছে দুই গৌতমদার জন্য ।ধন্যবাদ আবহমান ।

  • comment-avatar
    Anup Sengupta 2 years

    কবিতা সম্পর্কিত এমন আলোচনা পড়ার অপেক্ষাতেই থাকি। গৌতম বসুর কবিতার অতল গভীরে লাফ দিয়েছেন গৌতম চৌধুরী। আলোচকের গদ্যভাষার ধ্রুপদী দীপ্তি,সেইসঙ্গে অনুধ্যিত বিশ্লেষণে সম্মোহিত না হয়ে উপায় নেই।

  • comment-avatar
    উজ্জ্বল ঘোষ 2 years

    অসামান্য রচনা! কী গভীর অভিনিবেশ! কী অতুলনীয় গদ্য শৈলী!

  • comment-avatar
    সায়ন রায় 2 years

    একটি নিবিড় পাঠ মনকে এক উচ্চতায় নিয়ে গেল।ধন্যবাদ।