
চেতনার চৈতন্যে উত্তরণ
পীযূষ কান্তি মজুমদার
নববর্ষে পাঠচক্র/ বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত / মণি ভৌমিক / অনু: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় / ২০১১/আনন্দ পাবলিশার্স /আলোচনায় পীযূষ কান্তি মজুমদার
বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী মনি ভৌমিকের ‘বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত বইটি বারংবার অধ্যয়ন করে আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে,বৈজ্ঞানিক গবেষণার পিছনে সব থেকে প্রবল এবং মহৎ চালিকাশক্তি হলো মহাজাগতিক ধর্মবোধ।সব যুগে এমনই এক ধর্মীয় অনুভুতির প্রকাশ ঘটেছে যার মধ্যে কোন বদ্ধমূল ধারণার গোঁড়ামি নেই,নেই মানুষের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট কোনও ঈশ্বরের উপস্থিতি।এই মহাজাগতিক ধর্মাচরণে পূজা-অর্চনা,কোনও ধর্মগ্রন্থ অথবা ধর্মীয় তত্বকথার প্রয়োজন হয় না।মহাজাগতিক ধর্মীয় চেতনা সবরকম ধর্মমত বা ধর্মীয় গোঁড়ামির একেবারে উর্ধ্বে। স্রষ্টার সাথে একাত্ম হওয়া এই ধর্মাচরণের একমাত্র লক্ষ্য।তবে যে ব্যক্তির মধ্যে এই মহাজাগতিক চেতনা নেই তার কাছে এই অনুভূতি ব্যাখ্যা করা বড়ই দুঃসাধ্য।
মহাজাগতিক ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনাকে সমৃদ্ধ করে।এর ফলে মানুষের মধ্যে অতীন্দ্রিয়বোধ জাগ্রত হয়।এই অতীন্দ্রিয়বোধ দ্বারা আমাদের উপলব্ধি হয় সারা মহাবিশ্ব জুড়ে রয়েছে এক বিমূর্ত বুদ্ধিমত্তা।যাকে একই সাথে বলা যায় স্রষ্টা ও ধারক। ‘বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত’ গ্রন্থে লেখক এই বিমূর্ত সত্ত্বাকে ঈশ্বর রূপে উপলব্ধি করেছেন।প্রাচীন ভারত এই নিরাকার সত্ত্বাকেই উপলব্ধি করেছিল ব্রম্হ নামে।ইনি নন কোনও মানবাকৃতি ঈশ্বর যিনি দেখান তাঁর ক্রোধ,শাসন করেন বা দাবি করেন তাঁর আনুগত্য।উল্লিখিত গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই,এক্সিমার লেজার নিয়ে গবেষণা করে সাফল্য লাভের পর লেখক অকল্পনীয় অর্থ,নাম,যশ,খ্যাতি ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েছিলেন।এর পর তিনি বেশ কিছুদিন ভোগবিলাস ও কামনাবাসনার অতলান্ত গভীরে নিমজ্জিত হয়েছিলেন।তবে অচিরেই তিনি সেসবের অসারত্ব অনুভব করেন এবং উপলব্ধি করেন প্রকৃতির কার্যকলাপ ও বিশালতায় আছে মহত্ত্ব,উদারতা ও অকল্পনীয শৃঙ্খলা। এই শৃঙ্খলা রয়েছে লেজারের মধ্যে উপস্থিত ফোটন কনাগুলির মধ্যেও।তাইতো তারা বিক্ষিপ্ত না হয়ে একই অভিমুখে পৃথিবী থেকে সুদূর মহাশূন্যে পাড়ি দিতে পারে।লেখকের সম্বিত ফিরল।তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত সৃষ্ট বিভিন্ন ভাবনার তরঙ্গ গুলোকে একসূত্রে বাঁধবেন অর্থাৎ সুশৃঙ্খল করবেন।লেখক বাড়ির নির্জন স্থানে ধ্যানযোগের আশ্রয় নিলেন।এই ধ্যানের জগৎকে উপভোগ করার জন্য তাঁকে সম্পূর্ণ অহংবোধ মুক্ত হতে হয়েছিল।সুতরাং আলোচ্য গ্রন্থ থেকে আমাদের অমূল্য প্রাপ্তি হলো-একজন মানুষের প্রকৃত মূল্য নির্নীত হয় সে কতখানি আত্মমুক্ত তার দ্বারা।উল্লিখিত গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই,ধ্যানের মাধ্যমে লেখকের মন এমন এক আধ্যাত্মিক উচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছিল যার থেকে তিনি পেয়েছিলেন কর্মের প্রতি স্থির সঙ্কল্প এবং অচঞ্চল মানসিক প্রশান্তি।এই প্রাপ্তিকেই তো তিনি বলতে চেয়েছেন ঈশ্বর প্রাপ্তি।ধ্যানের মাধ্যমে মানুষের মনের মধ্যে বিভিন্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গগুলো একই কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট তরঙ্গে রূপান্তরিত হয়।এর ফলে মনের মধ্যে যে সুর বেজে ওঠে সেই সুরের কম্পাঙ্ক মহাজাগতিক সুরের(মহাজাগতিক স্পন্দনের)কম্পাঙ্কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং বিশ্বপ্রকৃতির ঐক্যতানের প্রতি আমরা সবিস্ময়ে সানন্দে তাকিয়ে থাকি।এই অধ্যাত্মবোধ,আবেগ ও অনুভূতি আমাদের সমগ্র সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দেয়।আমাদের মধ্যে সমস্ত চেতনা,চিন্তা ও বোধের অতীত এমন এক মহত্তর জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটায়,যার কাছে আমাদের সাধারন বুদ্ধি একেবারেই তুচ্ছ। প্রশ্নাতীত ভাবে বলা যায়,সর্বযুগে ধর্মীয় মহাত্মাগণ যে অনুভুতি লাভ করে থাকেন,এই অভিজ্ঞতা তার খুবই কাছাকাছি।