
চন্দনপিঁড়ি একটি মগ্ন প্রকৃতিপাঠ — মানবীপ্রেম থেকে ঈশ্বরসম্পৃক্ত একটি যাত্রা
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
নববর্ষ পাঠচক্র চন্দনপিঁড়ি / মণিশংকর বিশ্বাস/ ভাষালিপি /প্রথম ভাষালিপি সংস্করণ ২০১৯ / ১৪০ আলোচনায় কুন্তল মুখোপাধ্যায়
একটি পোর্ট্রেট তো শুধু ছবি নয় । একজন সচেতন শিল্পী সেই ছবি আঁকলে পোর্ট্রেটটি ছবির মানুষটিকে ইন্টারপ্রেট ও রিইন্টারপ্রেট করে ।কবিতাতেও শুধু বর্ণনা এবং বর্ণনাকে এলোমেলো ভাবে ভেঙে দেওয়ার অভিঘাত কখনও শুন্যে পৌঁছায় , কারণ সেই নিসর্গবর্ণনার সঙ্গে কবির ভাবনাটিও পাঠক হিসাবে আমরা পড়তে চাই। শুধুমাত্র প্রকৃতিবর্ণনা অর্থহীন যদি না সে কবিমনের বা সত্য উন্মোচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনও ঈশারা সুচিত করতে পারে । শুধুমাত্র নিসর্গবর্ণনার কবিতাও,তাই, এক ধরণের চালাকিই । দৃশ্য ও দৃশ্যন্তর আমাদের যে অন্যভাবে ভাববার সুযোগ করে দেবে এধরনের ‘চালাক’ কবিতার সে ক্ষমতা নেই । উৎপলকুমার বসুর কবিতায় আমরা কখনও বস্তু ও বস্তুগ্রাহ্য অবস্থানের ঊর্ধ্বে এক অপরিসীম ব্যাখ্যাতীতের সন্ধান পাই ।যদিও সেই আনন্দ এসেছে দৃশ্যাংশ নিজের মতো করে দেখবার প্রবণতা থেকেই। মূলত দেখার ক্ষেত্রে প্রদর্শকের এইরকম ভূমিকা পাঠককে শিক্ষিত করে , দেখা থেকে দর্শনের দিকে তাকে নিয়ে আসতে চায় । রবীন্দ্রনাথের ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’র থেকে জীবনানন্দের seven sleepers den এর মিথপ্রয়োগের সফলতা এতটাই আলাদা যে আমাদের ‘নিরভিসন্ধি’ কেঁপে ওঠে । একটি জায়গার ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন তো হয়েই থাকে । তবু সেই পরিবর্তন কোনও দর্শকের সামনে তার সবিস্ময় উপস্থিতি নিয়ে হাজির হলে কী আশ্চর্যভাবে ‘যেইসব শেয়ালেরা’ মনে পড়ে যায় । দেখার এই ভিন্নরুচি ও তার অনস্বাদিতপূর্ব-ব্যবহার শিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলে । মণিশংকর বিশ্বাস-এর ‘চন্দনপিঁড়ি’ ( ভাষালিপি ২০১৯) আশ্চর্যভাবে আমাদের আঙুল ধরে নিয়ে যায় জীবনের কাছে , প্রকৃতির কাছে । মূলত প্রেমের এই লেখাগুলো নিসর্গ ও ঈশ্বরের দিকে হেঁটে যায় । মানবীপ্রেম থেকে এইরকম উত্তরণ এসময়ের কবিতায় বিরল ।
খুব দূরে , যেখানে ওড়ে চিল, ঝুঁকে পড়া ডাল , জলবৃত্ত রচনা করে কোনও ঢিল — তেমন উধাও কোনও বনানীমোহিত প্রান্তরে যেখানে ‘পশুপালকের তামাটে গ্রাম’ আর দলছুট ভেড়ার আর্তনাদ-খচিত নৈঃশব্দে এই যে কবির মনে পড়লো ‘এ বস্তুত আমাদেরই প্রেম’ , এও যেন খুঁজে পাওয়া নিজেকেই । অথচ এখানে প্রথম এসে সে ভেবেছিল “এখানে তোমার কথা বলে না কেউ” ! নাস্তি থেকে অস্তি-র এই যাত্রার মাঝখানে আসলে রয়ে গেছে আদিগন্ত প্রকৃতি । আর এইজন্যই তাঁর কবিতা আকর্ষণ করে পাঠককে । কারণ তা এক নির্দিষ্ট কিছু বলতে চায় । সে অকথা হতে পারে অবলা হতে পারে কিন্তু তার এই বলে ওঠা আর তামাটে গ্রামের মধ্যে প্রেম খুঁজে পাওয়া এতটাই ইউনিক যে পাঠককে একথা মনে করিয়ে দেয় যে আসলে যতদূরেই সে যাক বহিঃপ্রকৃতি আর অন্তপ্রকৃতির সম্মেলনই কেবল জন্ম দিতে পারে গভীর কোনো শিল্পের । ফলে যার কাছ থেকে দূরে যেতে চাই ,দূর কাঠবাদামের দেশে ঘননীল টিলার উপরে গিয়েও সে তার নিজস্ব ঘুড়ির কাছেই পৌঁছে যায়। পাহাড় আর তার নীরবতা তাকে মুছিয়ে দেয় মলিন অক্ষর দিয়ে — সে যার থেকে দূরে আসতে চেয়েছিল তার কাছে বেশি বেশি করে ফিরে যায় । সেতু বা কোনো বিকল ঘড়ি — সমস্তই ‘তোমার’ দিকে নিয়ে যায় ।
এই তুমিময়তা নিয়ে কবি ফিরছেন কোনও জঙ্গলে বা ঘনঘোর রিট্রিট-এ । ধোঁয়া রক্ত গাড়িহর্ণ বা চকচকে যৌনতার থেকে দূরে নিজস্ব ‘তুমি’-কে আবিষ্কার করার এই বই ভারী কোমল স্বর নিয়ে লেখা । মূলত প্রেমের কবিতা । কিন্তু তার উদাসীনতার চরিত্র নিয়ে সে এক স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ করে চলে । এই প্রেমে একে অপরকে পাওয়ার উন্মাদনা নেই , এই প্রেম একজনের আরও একজনকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার । এখন , এই তুমিটি কে ? বইটির চোদ্দ পাতায় একটি কবিতার শেষে একটি বাক্য এসে ঠেকে গেল ‘ঈশ্বরের মতন কেউ না’ । ফলে পাঠকহৃদয় প্রশ্নাতুর হয় এই প্রেম, এই ‘তুমি’ কি ঈশ্বর হতে পারেন এই ভেবে । আর কী আশ্চর্য পনেরো পাতায় এসে গেল আরও একটি শব্দ ‘করুণা’ –
” যা কিছু লেগেছে ভালো সব তোমার করুণা
দুপুরে জলের মধ্যে স্থির গাছপালা — একটি ফড়িং
কাঁটাতার পার করে চলে আসে এইদিকে–
যেন শিশুকাল, আমার, তোমার
গাছে গাছে নোনাজল উত্তাপে ধূসর
হাতচিঠির মতন ছোট্ট মেঘ, মনে পড়ে
দারুন গম্ভীর ছায়া ফেলে যেত কাজুবাদামের ঝোপে ——
বহুদিন সবুজ চিনির দানা ছিল তিতো
আর ছিল আয়না দোদুল্যমান
ফলে ভ্রাম্যমান মনে হয়েছিল আমাদের প্রতিবিম্ব
ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল না তেমন…
সুবিধাজনক সেই পাঠশালা মনে এলে
মনে পড়ে সব: তোমাকে লেগেছে ভালো—
বাকি সব ভালো নয়, প্রেম নয় ,
বাসনার কালো ”
এবং এরপরের কবিতার প্রথম দুই লাইন ‘কোথাও যেও না তুমি/আমার হৃদয়ে থাকো’ । এই কবিতাটি শেষ হয় ‘এই ধর্মবোধ’ শব্দটি দিয়ে । বইটির অন্যান্য কবিতায় বারেবারে ‘সেতু’ শব্দটি আসছে । কিসের সেতু ? এ কি মানবপ্রেম থেকে ঈশ্বরের প্রেমে হেঁটে যাওয়ার পথবন্ধন? এবং রহস্য করে কি তার কথাই বলা হচ্ছে? রহস্য কেন আসছে এখানে? প্রেমে কি রহস্য নেই? ঠার বা ইশারা নেই ? আছে তো !! তাহলে কি পাঠককে আহবান করা হচ্ছে রহস্যভেদ করার ? তাহলে ঈশ্বরচেতনার কবিতা পড়ি –
শান্ত হয়ে আসে মন, দূরে মেহগনি ছায়ার মতন ।
অদূরে ঝরছে নীল, জলের উপর
ওইখানে ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব কাঁপে
অথবা
যখন ঈশ্বরও ভুলে গেছে দেখে নিতে
এইসব চোখের জল, পুরুষ চখের জল
সূর্যাস্ত চিহ্ন রেখে গেছে মুখে….
অথবা
মৃত্যুর পরে আরো ক’টা দিন
আমি বেঁচে থাকব ।
সন্ধ্যাতারা ভোরের শেফালী হ’য়ে
যেরকম ছুঁয়ে গেছে মাটি ।
দূর হতে আমাকেও ডাকে, ওইপারে….
প্রতিটি শেফালীর পাশে….
কিংবা
তুমি ঘন নীল অথবা সোনালী
অলৌকিকতা
এখনো শুয়ে আছো
ধাবমান কার্তুজের খোলে
পাখির ঝাঁকের প্রতি
একটি পাখির টানে
অন্যদিকে মানবীপ্রেমের সাক্ষ্য নিয়ে আসে কয়েকটি কবিতা –
নক্ষত্রজাহাজে এসেছিলে , নীল …. গম্ভীর…. উপত্যকার
যে সব ফুলের কথা লিখি
তারা সব কুয়াশার সন্তান, মৃত ।
এখন তোমার মুখ ঝাপসা, কান্নার মতো ।
তবু ভালো লাগে সব — ফেরিঘাট —
সুখী বাঁধাকপি বোঝাই ট্রাক —- মিনারের নীচে পায়রার ঝাঁক —
তোমাকে যে অবিস্মরণীয় করেছে সে এই মন
অথবা
…. গোলাপের মতো অসম্ভব মেয়েটি এখন
দলছুট, রাস্তা পার হয় ….
যেইভাবে মৃত মথ
ঘুমায় পুরানো বইয়ের পাতার ভিতর
আমিও বাইরে থেকে আজ
ওরকম শান্ত ।
‘দুর্গানগর’ ও ‘যাত্রাবাড়ী’ নামের কবিতাটিতে এক শাশ্বত মানব-মানবী প্রেমের ও বিচ্ছেদের কথা । অথবা ‘শেষ ট্রেন’ যে কবিতাটিতে আমরা দেখতে পাই শালবন আর সূর্যাস্তের কাছে হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটি ! আরও একখানা বিচ্ছেদভাষ্য রচিত হয়ে যায় । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে এই মানব-মানবী বিচ্ছেদভাষ্যেও স্থির ধ্রুবতারার মতো দাঁড়িয়ে থাকে ‘অতিদূর শ্রাবণের মতো নীল’, ‘কাচফুল’ আর ‘রাত্রির অসামান্য আয়োজন’ । যেন বিচ্ছেদক্লান্ত হয়ে শুশ্রূষার আর্তিতে কবি চলে গেছেন কোন সবুজ মখমলের ভিতর অথবা কোনও পাহারতলীতে । সেখানে তাঁকে মানবীপ্রেমের বিচ্ছেদ পৌঁছে দিচ্ছে গভীর ঈশ্বর চেতনায় । যেন তিনি মনে মনে তরঙ্গ পাঠাচ্ছেন সেই শাশ্বত আর অমোঘ এক উপস্থিতির দিকে । কবি ও তার মানবীপ্রেম বিচ্ছেদের মাঝখানে যে প্রকৃতি যে অনন্তধারক সেই অনন্তধারকই যেন তাঁকে ঈশ্বর-স্পর্শঘন রহস্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ।
আর প্রকৃতির মধ্য দিয়ে যেহেতু এই ক্রম-উত্তরন সম্পন্ন হচ্ছে , আমরা পাঠকেরা তাই নিসর্গকে ইন্টারপ্রেট এবং তার রিইন্টারপ্রেট করার অজস্র উপাদান পেয়ে যাচ্ছি । ‘চন্দনপিঁড়ি’ মূলত প্রেমের কবিতার বই যা আমাদের নিসর্গ চেনায় । এই বই মূলত ঐশ্বরিক ভাবনার কাছে নিয়ে যায় । যে ঈশ্বর কোন বিশেষ গ্রন্থবদ্ধ নয় , যে ঈশ্বরকে একদিন জীবনদেবতা-রূপে পেতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ …এই বই আমাদের শেখায় কীভাবে ব্যর্থ হলে প্রকৃতির কাছে যেতে হয় । সেই প্রকৃতি যেখানে মানুষের যেকোনো ধরণের বিষাদের সমাধান আছে ।
অনবদ্য গ্রন্থনির্মাণ ভাষালিপি । প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন সঞ্জীব চৌধুরী । ভাষালিপির যেকোনো প্রযোজনায় এই নরম মনের মানুষটির ভালবাসার ছোঁয়া থাকে । প্রচ্ছদে ও বিষয়ে এই বই ভবিষ্যৎ পাঠকের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাবে , আশা করা যায় । নিবিড় কবিতার পাঠক বারেবারে পড়তে চাইবে অনন্য এই বইটি ।
যাকে এতক্ষণ গুপ্ত-ঘাতক মনে হয়েছিল
কাহিনীর শেষে বোঝা যায় সে আসলে
ভালো মানুষের পো
অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে, সরলাবালা বালিকা বিদ্যালয়ের মতো ।
ভিজে আকাশের নীচে খুব আস্তে
ফুটে উঠছে এক দুঃখী রাজপুত্র, একা, অবুঝ…
বড় মায়াময় একটি কবিতাবইয়ের
শান্ত ভিতরবাড়ির
দরজা খুলে দেওয়া
স্তব্ধতা-মুখর আলোচনা ।