
গৌতম বসুর ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’
স্বপন চক্রবর্তী
বাংলা কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে বিষ্ণু দে—অনেকের কবিতাতেই এই আখ্যানমূলের সরাসরি অথবা তির্যক প্রয়োগের সঙ্গে আমরা পরিচিত। গৌতম তাঁর ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’ শীর্ষক পঙ্ক্তিমালায় এই প্রসঙ্গটিকে অবিন্যস্ত করেছেন সচেতনভাবে। স্বর্ণগরুড়ের শীর্ষে উঠতে চাইছেন কথক, যেন বা এক ঘোরের মধ্যে। মিথের মিশ্র প্রয়োগ, শব্দানুষঙ্গে অতীত কাব্যের স্মৃতির দেওয়াল হাতড়ে আপাতদৃষ্টিতে অসতর্ক চলন, সাধু ও চলিত ক্রিয়াপদের সমবায়—সব অচেনা রীতিই এই ঘোর লাগানোর কাজে সুকৌশলে প্রযুক্ত। গৌতম বসু-র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। অর্পণ করলেন অধ্যাপক লেখক শ্রী স্বপন চক্রবর্তী।
গৌতম বসুর কবিতায় একটি আখ্যানমূল, কিংবা কবির নিজের ভাষায় বলা যায় ‘চিত্রসারি’, ঘুরেফিরে আসে। নদী পেরোনোর কথা পাই তাঁর বেশ কিছু কবিতায়। কখনও তা অন্য তটভূমিতে বা অন্য কোনও ভুবনে গিয়ে পৌঁছোনোর কাহিনি, কখনও তা বিস্তীর্ণ জলের বুকে কেবলই সংশয়াকুল ভেসে চলার বোধ। সেই নদী পেরোনো প্রায়শই এক তমসাঘন অভিজ্ঞতা, যেন বা ভিন্ন এক নিরালোক আকাশের দুর্বহ স্মৃতি, প্রায় আবছা হয়ে আসা দুঃস্বপ্নের মতো। অস্তিত্বের এক স্তর থেকে আর এক স্তরে অতিক্রমণের পরিচিত রূপক হল নদীর এক তীর থেকে অন্য তীরে পাড়ি—পৃথিবীর বহু সংস্কৃতির অতিকথায় এই মোটিফটির সঙ্গে দেখা হয়েছে আমাদের।
বেশিরভাগ সময়েই এই পাড়ি স্রেফ পাড়ি, তাকে পারাপার বলা যাবে না ঠিক। আর গন্তব্যও হতে পারে অনির্দেশ্য, অতিকথার অভিযান ঘিরে যে দৃঢ় আধ্যাত্মিক আশ্বাস থাকে তাকে অগ্রাহ্য করেই। রবীন্দ্রনাথের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাটির কথাই ধরি। কবিতাটিতে বর্ণিত হিরণ তরণী যে লক্ষ্যে চলেছে সেখানে জলোচ্ছ্বাস আছে, ঊর্মিমুখর সাগর আছে, রয়েছে সংশয়ঘন নীল জল। কিন্তু সাগরের পারে মেঘচুম্বিত অস্তগিরির চরণপ্রান্তে, যেখানে অচেনা নেয়ের ঘর, সেখানে কী যে আছে তা জানার সাধ্য নেই প্রশ্নাতুর যাত্রীর। নবীন জীবন থেকে স্নিগ্ধ মরণ—সব সম্ভাবনার কথাই পাড়েন কথক। উত্তর মেলে না, যেমন মিলবে না কবির জীবনের শেষে ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতার আর্ত প্রশ্নেরও।
বলছিলাম যে, সব জলযান যাত্রীকে ফিরিয়ে দিতে না-ও পারে, পাড়ি সবসময়ে খেয়া-পারাপার হয়ে ওঠে না। যাত্রা নাহয় নিরুদ্দেশ নয়, তবুও নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছোনোর পর যাত্রীর প্রত্যাগমন সম্ভব হয় না আর। অতিকথায় অবশ্য অন্যথা হতে পারে, হয়ও। অরফিউস উঠে আসেন অধোভুবন থেকে দয়িতাকে উদ্ধার করে, কিন্তু মুহূর্তের ভ্রমে অয়রিডিকেকে ফের হারান; যমলোক থেকে নচিকেতা ফিরে আসেন অপরাবিদ্যায় উদ্ভাসিত হয়ে; ভার্জিলের এনিয়েড কাব্যের ষষ্ঠ সর্গে এনিয়াস মর্তলোকে ফেরেন পাতালে মৃত স্বজন ও অনুরাগিনীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর, তার নিজের অদৃষ্ট ও ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্পর্কে স্থিরনিশ্চিত হয়ে; সেই ভার্জিল আবার পথ চিনিয়ে জীবিত দান্তেকে নিয়ে যান খ্রিস্টান নরকে যেখানে পুৎ, কুম্ভীপাক, রৌরবের মতোই পাতকভেদে দণ্ডভেদ আছে; ভেলায় সর্পবিষে নীল হয়ে যাওয়া স্বামীর শব নিয়ে বেহুলা ভেসে চলেন ছয় মাস, মনসার পালক মাতার করুণায় পৌঁছে যান দেবলোকে, আবার মনসার কৃপায় লখিন্দরকে বাঁচিয়ে তুলে তিনি ফিরে আসেন আমাদের এই আটপৌরে বাংলায়।
সব গল্পে নদী নেই, আর সকলেই নদী পেরোয় না। তবে প্রতীচ্যের কল্পনায় পাতাললোকে লিথি বা স্টিক্স নদী না পেরিয়ে এই ইহলোকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না সাধারণতঃ। অপরাজ্ঞানের স্বার্থে নিষিদ্ধলোকে এই নামা-ওঠার নাম আছে গ্রিক ভাষায়—অবতরণ অর্থাৎ ‘কাতাবাসিস’, এবং অতঃপর সেখান থেকে উত্তরণ, তথা ‘আনাবাসিস’। কাতাবাসিসের নমুনা আমরা পাই প্রাচীন ও দূর অতীতের বহু কবির লেখায়—হোমর, ভার্জিল, ওভিদ, দান্তে, তোরকোয়াতো তাস্সো, লুইশ ভাজ দে কামোয়েশ, এডমান্ড স্পেন্সার। উদাহরণ সাম্প্রতিকতর কাব্যেও কিছু কম নেই। এজরা পাউন্ডের চতুর্দশ ও পঞ্চদশ ক্যান্টো-র সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে তাঁরাই চিনবেন প্রাচীন আখ্যানের এই চলনটির প্রয়োগ। আধুনিক কবিদের মধ্যে আর্তুর রাম্বো, রেইনার মারিয়া রিল্কা, টি. এস. এলিয়ট, ওসিপ মান্ডেলস্তম, আন্না আখ্মাতোভা, শেমাস হিনি, ডেরেক ওয়ালকট—অনেকের একাধিক লেখায় এই প্রসঙ্গের রকমফের দেখি। এঁদের মধ্যে হিনি আবার ভার্জিলের এনিয়েড-এর সেই ষষ্ঠ সর্গের পাতালের আলাপের অনুবাদও করেছিলেন। চিত্রনির্মাতা এবং কবিতনয় আন্দ্রেই তারকভস্কির ছবিতেও অনেকে কাতাবাসিসের ছায়াপাত খেয়াল করেছেন। মার্টিন থার্সটন একটি আস্ত বই লিখেছেন বিষয়টিকে নিয়ে, পলগ্রেভ ম্যাকমিলান ২০০৯ সালে সেটি প্রকাশ করে। বইটির নাম দি আন্ডারওয়ার্ল্ড ইন টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি পোয়েট্রি: ফ্রম পাউন্ড অ্যান্ড এলিয়ট টু হিনি অ্যান্ড ওয়ালকট । বিশদ ব্যাখ্যায় আগ্রহী পাঠক বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
অন্য সংস্কৃতিতে এবং অন্য গোত্রের লেখায় এই আখ্যানমূলের দেখা পাই—মিশরীয় ওসাইরাসের গল্পে, মৃতদের জগৎ হেডিস থেকে সেমিলিকে দিওনিসুসের কীভাবে উদ্ধার করলেন সেই গ্রিক আখ্যানে, মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের নরকদর্শনে, বোধিসত্ত্ব-কথায় পরিত্রাতা অবলোকিতেশ্বরের অবীচি নরকে প্রবেশের বিবরণে, ক্রুশে ‘মৃত্যু’ ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে জিশুর নরকের জঠর থেকে সাধু আত্মাদের উদ্ধারের কাহিনিতে, কুরান-হাদিসে মহম্মদের ইসরা ও মিরাজের নৈশ অভিযানের বৃত্তান্তে ও রূপকে। প্রাচীন সুমেরের গিলগামেশ কাব্য থেকে উত্তর ইওরোপের নর্স পুরাণে, নাইজেরিয়ার ইয়োরুবা মিথে থেকে জাপানি শিন্টো ইতিবৃত্তে মৃত ইজানামির অন্ধকার প্রেতলোক ইয়োমিতে প্রস্থান ও জীবিত ইজানাগির তাঁকে অনুধাবনের অতিকথায়—সর্বত্র এমন লোক থেকে লোকান্তরে চলাচলের কথা শুনি।
বাংলা কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে বিষ্ণু দে—অনেকের কবিতাতেই এই আখ্যানমূলের সরাসরি অথবা তির্যক প্রয়োগের সঙ্গে আমরা পরিচিত। গৌতম তাঁর ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’ শীর্ষক পঙ্ক্তিমালায় এই প্রসঙ্গটিকে অবিন্যস্ত করেছেন সচেতনভাবে। স্বর্ণগরুড়ের শীর্ষে উঠতে চাইছেন কথক, যেন বা এক ঘোরের মধ্যে। মিথের মিশ্র প্রয়োগ, শব্দানুষঙ্গে অতীত কাব্যের স্মৃতির দেওয়াল হাতড়ে আপাতদৃষ্টিতে অসতর্ক চলন, সাধু ও চলিত ক্রিয়াপদের সমবায়—সব অচেনা রীতিই এই ঘোর লাগানোর কাজে সুকৌশলে প্রযুক্ত। দান্তের কম্মেদিয়া কাব্যে ‘ইনফার্নো’ অংশের মতো যাত্রীর সামনে রয়েছে পর্বতের বাধা। তবে দান্তের কাব্যে যেমন চিতাবাঘ, সিংহ ও নেকড়ের মতো হিংস্র পশু ছিল পথ আগলে, এখানে তেমন রাস্তা আটকে নেই কেউ, যদিও হিন্দু ও বৌদ্ধ বেশ কিছু কাহিনিতে সোনার বরন পা ও বহুযোজনবিস্তৃত পাখা নিয়ে গরুড় সুমেরু পর্বত কিংবা বিষ্ণুর অন্য কোনও আবাসের রক্ষী হয়ে অবাঞ্ছিত আগন্তুকের গতিরোধ করে থাকেন। সেই পাহাড়ে ওঠার জন্যে এবং সেখান থেকে মৃত্যুপুরীতে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে নেই ভার্জিলের মতো কোনও সিদ্ধ বাক্পতি। বরঞ্চ এক প্রশ্নোত্তরের কথা আঁচ করতে প্ররোচিত হই আমরা, যেমন শোনা যায় অনেক প্রাচীন কাহিনিতে—যুধিষ্ঠির ও বকরূপী ধর্মরাজের সাক্ষাতে, কঠোপনিষদে নচিকেতার পরীক্ষা পর্বে, অথবা স্ফিংসের ধাঁধার সম্মুখীন অয়েদেপউসের গল্পে। তবে উত্তরমাত্রই ক্ষণকালের, প্রশ্নসকলের পরমায়ু অনিঃশেষ। ভ্রষ্ট শপথ বিষয়ে আরো এক প্রশ্ন ধেয়ে আসে কথকের দিকে: ‘এত যে শপথগ্রহণ করিলে ইহজীবনে, কী পরিণতি হইল তাহার?’ স্পষ্টত আমরা ঐহিকতার স্তর পেরিয়ে চলেছি অন্য কোনও লোকে, যেখানে যাওয়ার অধিকার আমাদের নয়, কেবলই কবির, ‘এই একযানে প্রবেশ করবার অধিকার, একমাত্র তোমার’। সুর্য, চন্দ্র, মেঘ, বৃষ্টি—এদের সকলের সম্মিলিত প্রহার কবির মাথায় পরিয়ে দেয় কাঁটার মুকুট, সমস্ত ক্ষতচিহ্নজর্জর ভাষার প্রহরণে সজ্জিত সশস্ত্র কবির ওপরে চাপায় উত্তর জোগাবার দায়। কিন্তু কবির উত্তর অস্পষ্ট, তার ভাষার মতোই মেঘাবৃত। অরক্ষিত শপথগুলি মৃত্যুমথিত লোক থেকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেও লাভ নেই। সতৃষ্ণ প্রেতের মতো অনেক খুঁজেও তাদের জোটেনি এক আঁজলা জল, যদিও সজল মেঘ ঢেকে রেখেছে এই অদ্ভুত অন্তর্বর্তী ভুবনের আকাশ, ঢেকে রেখেছে পাহাড়। এই পর্বত প্রেমিক-যক্ষের ঠিকানা নয়, শাপভ্রষ্ট দ্রষ্টাবৎ শব্দসৃজনকারীর আবাস নয়। সেখানে পাহাড়ও ঢেকে রেখেছে মেঘ। এই দ্বৈত আড়ালে শেষ পর্যন্ত ধ্বস্ত আজকের কবিতার ভাষা, তা স্পষ্টতই লোকোত্তর উৎস থেকে উৎসারিত সত্য উচ্চারণের অসম্ভব গৌরবের ভার বহনে অসমর্থ।
পাহাড়ের কোল থেকে নীচে যে দৃশ্য দেখা যায় তা ভয়ানক—সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে এমন ভয়াবহতার বোধ দুর্লভ। অথচ চোখ বন্ধ করার অনুমতি নেই। মৃত্তিকা সেখান থেকে মনে হয় স্বেদ-শোণিতে সিক্ত। সে আর আকাশের প্রণয়ী নয়, কথকের শপথগুলি, তাঁর বাক্যস্রোত এক হয়ে যাচ্ছে সেই ঘাম-রক্ত ভেজা মাটিতে। এ কি শব্দরাজির নিষ্ফলতা, নাকি কাব্যের এক বিকল্প নিয়তি? কথক তো বলছেন যে, এ একরকম পরাজয়: ‘তুমি কি এইভাবে ফিরিয়ে আনলে আমায় / পরাজয়ে, স্বর্ণগরুড়চূড়ায়? / আমার মস্তিষ্ক মেঘাচ্ছন্ন, চারপাশে ঘোর অন্ধকার।’ মনে হতেই পারে, গৌতম এখানে যেন ইচ্ছে করেই কাতাবাসিসের চেনা রীতিতে নিয়ে আসছেন এক মোচড়। দান্তের নরক ঠিক অন্ধকার নয়, সেখানে রয়েছে এক ঠান্ডা আলো যা উজ্জ্বল ম্লানতার কাছাকাছি। ‘ইনফার্নো’-র দমবন্ধ অন্ধকারে সেই ম্লান উজ্জ্বলতার উৎস পাতকীদের পীড়নের নিমিত্ত জ্বলতে থাকা আগুনে। আর এদিকে গৌতমের কবিতায় তুলনারহিত আঁধার এক মেঘাবৃত ধাঁধার মতো। কাতাবাসিসে আমাদের নেমে যাওয়ার কথা টেক্সটের এক ফোকর দিয়ে অস্তিত্বের ভিন্ন এক স্তরে। অথচ কথকের দৃষ্টি নীচে, পৃথিবীরই দিকে। পাহাড় থেকে গৌতম নীচে, বহু নীচে তাকিয়ে আবিষ্কার করেন এই চেনা সংসারের এক রণরক্তে ক্লান্ত, বিফল রূপ। এই স্থান-বিপর্যয় নিজের বেঁচে থাকার মধ্যে নিয়ে আসে অপরিচয়ের ব্যবধান, ঠিক যেমন কবিতায় ভাষার প্রয়োগ জীর্ণ শব্দ আর রীতির মধ্যে নিয়ে আসে অপরিচয়ের বন্ধুরতা।
এর পরেই শুনব নদী পেরোবার কথা। গুহার ভিজে দেওয়ালের মতো নির্বাক মাঝির শীতল পিঠে ভর দিয়ে উঠে পড়লেন কথক নৌকোতে। তখন আকাশ তারকাহীন, অথবা অন্তর্হিত, ঠিক দান্তের নরকের মতো। যাত্রীর চেতনা ক্রমশ বিপর্যস্ত, তাঁর শরীর কম্পমান, কণ্ঠস্বর অপহৃত, হৃদ্পিণ্ড যেন শরীর থেকে বাইরে বেরিয়ে অস্থির ছন্দে স্পন্দিত হচ্ছে। এই দুঃস্বপ্নের মধ্যে সে ডেকে ওঠে” ‘ফ্লেগয়াস! ফ্লেগয়াস! রক্ষা করো!’ দান্তের ‘ইনফার্নো’-র অষ্টম সর্গে আমরা দেখা পাই ফ্লেগয়াসের, যিনি আপোলোর মন্দির রাগে জ্বালিয়ে দেওয়ার অপরাধে নরকের পঞ্চম চক্রে নিক্ষিপ্ত হন, যা ক্রোধী ও হঠকারীদের জন্যে বরাদ্দ। ফ্লেগয়াসকে জীবিত দান্তে ও তাঁর পথপ্রদর্শক মৃত ভার্জিলকে স্টিক্স নদী পার করে নিয়ে যাওয়ার কাজ দেওয়া হয় কম্মেদিয়া-তে। আজকের কথক তাঁর নাম জানেন বই পড়ে, ঠিক যেমন দান্তে প্রয়াণোত্তর লোকের অনেক অধিবাসীর নাম জেনেছিলেন ভার্জিলের কাব্য পাঠ করে। স্টাসিউসের থেবাইড এবং ভার্জিলের এনিয়েড কাব্য দুটিতে এই ফ্লেগয়াসকেই দেখি নরকে দণ্ডভোগ করতে। ঠিক এলিয়টের ‘হলো মেন’-দের মতো পাপমুক্ত হয়ে নদীর ওপারে যেতে চাইলেও কথকের উদ্ধার নেই, তাঁর সময় এখনও আসেনি। দাম্ভিক ও মূর্খ কথক কেবল গ্রন্থ সম্বল করে বেঁচেছেন, তিনি এখানে আসতে চেয়েছিলেন বলেই আসতে পেরেছেন। এসে দণ্ডিত দাম্ভিকদের কদর্য কুণ্ডলী থেকে ভেসে আসা অশ্রাব্য কান্নার শব্দ শুনে বুঝেছেন যে, অহংকারীদের নরকে খাদ্য, পানীয়, গ্রন্থ—কোনও ত্রাণই কাজে লাগে না আর। এর আগেই মাঝির পিঠে মুখ রেখে শুরু হয়েছিল তাঁর অশ্রুমোচন, এই উপলব্ধির পর তিনি জানলেন যে, এই ভয়াবহতার সমাপ্তিরেখার শেষ দেখার সাধ্য তাঁর নেই।
এটিই গৌতমের পঙ্ক্তিমালায় আনাবাসিসের মুহূর্ত। এর পরেই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি, সেই কোমল পাহাড়ি মেষের অলস ঘাস খাওয়ার মায়াময় দৃশ্য। এবারে কথক শেষ পর্যন্ত আকাশ দেখতে পাবেন, যেমন দেখতে পেয়েছিলেন দান্তে ‘ইনফার্নো’-র চৌত্রিশ সংখ্যক সর্গের ১৩৪-১৪০ সংখ্যক ছত্রগুলিতে। এই আকাশ মৌন, গম্ভীর, উদার, প্রশান্ত, বিনম্র গৌরবময়: ‘মানুষের মতো নয়, মানুষের শপথবাক্যের মতো বিবিক্ত নয় কখনও / প্রতারক নয়, দম্ভযুক্ত নয়, নয়, নয়, / এই অবধি, এমন অমল, এমন প্রকাণ্ড আকাশ সে যে কেন দেখে নাই!’
‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’-য় বেশ কিছু জীর্ণ শব্দবন্ধের প্রয়োগ আছে (‘অনাবিল উদার-গম্ভীর’, ‘আকাশের প্রকাণ্ড
প্রান্তর’, ‘অমল’), কিন্তু সমস্তটাই যেন অসম্ভব এক দূরত্ব থেকে শুনি আমরা। আনাবাসিসের স্বস্তির মুহূর্তে চেনা শব্দের সঙ্গে যেন নতুন করে পরিচয় ঘটে আমাদের। কথকের গ্রন্থপাঠ, বাক্যরাজি অথবা ইতস্তত উচ্চারিত শপথের অসহায়তা নয়, কাব্যের পরাভব নয়, গৌতমের কাব্যদৃশ্যে মিথের পুনর্বিন্যাসের উদ্দেশ্য ভিন্ন বলে মনে হয় আমার। এখানে কথকের যে প্রজ্ঞার ভূমিতে উত্তরণ দেখি অধোভুবনে নিষিদ্ধ সফরের পরে, সে স্থানটি কবির আপন কবিতা থেকে নিষ্ক্রমণস্থল। দান্তে বা এলিয়টের মতো ক্যাথলিক কবির নৈর্ব্যক্তিকতা নয়, গৌতম তাঁদের বহুচর্চিত আখ্যানরীতি প্রয়োগ করতে চাইলেন নচিকেতার মতো দৈনন্দিনে লিপ্ত থেকেও একরকমের অপরাজ্ঞানের সন্ধানে, যা কবি-বিদ্বানকে বন্ধ্যা আত্মাভিমান থেকে মুক্ত করতে পারে। স্বর্ণগরুড়ের দুঃস্বপ্ন থেকে নিষ্ক্রমণ ঐহিক জীবনের সংক্ষোভের প্রতি বিরাগজনিত আত্মপ্রত্যাহারের দলিল বলে মনে হয় না আমার। যাঁরা গৌতমকে চিনতেন, তাঁরা জানেন যে অহংমুক্তিকে তিনি বৈরাগ্যের সঙ্গে একাকার করে দেখতেন না আদৌ।
গভীর তাৎপর্যময় আলোচনা ।ভাল লাগলো
পান্ডিত্যপূর্ণ আলোকপাত,কিন্ত সৃষ্টির স্বাদের তারতম্য বিষয়ের উপর না পড়ে অনুপুঙ্খ উল্লেখ বিষয়ের পরিচয় কেন্দ্র হল