
গৌতম বসুর অগ্রন্থিত দীর্ঘ কবিতা
দীর্ঘ কবিতা
অনিকেত
‘নাও ইট লেবরস ইন দ্য টেম্পস্ট
বাট টুমোরো য়ু য়ুইল ফাইন্ড ইট ইন হারবর’
-লিওন বাতিস্তা আলবারতি
যে সমাপ্তি রচিত হয়, নিভে যায় কালস্পর্শে
এক মুহূর্তকাল, কেবল এক মুহূর্তকালের জন্য বিহ্বল
সেই অশ্রুতবাণী স্মরণ ক’রে বলি, প্রাণ আজও বহে,
শোনো একযোগে ভীষণ, ওই বহে মৃত্যুগীত, চূর্ণ অভিলাষ ;
দূরতম প্রান্তরে নেমে এসেছে সমূহ কৃষ্ণমেঘ, অপার্থিব আলোয়
মেঘের অপার্থিব অন্ধকার ঘূর্ণ্যমান, এগিয়ে চলেছে –
প্রান্তরেখা ক্রমে স্পষ্টতর, কাদাজল ও পাথরমাখা পথ দেখা যায়
তীক্ষ্ণ হাওয়া ভেদ ক’রে অগণিত ছায়ামূর্তির অবসন্ন সারি এগিয়ে আসছে
মন্থর ও মৌন, এই সংক্রান্তির বেদন যেন সন্তানে-সন্তানে প্রবাহিত।
একটি অন্তিম প্রজন্মের যাত্রাপথে আমি হই কাদাজল, আমি পাথর
জিজ্ঞাসা করি, কোথা যাও, তোমরা পথিক, না আগন্তুক ?
নিরুত্তর তারা, যুবা ও বৃদ্ধ একে -একে পার হয়ে যায়
এক নারীমূর্তি দেখে প্রবেশ করি স্রোতে, স্রোতের সঙ্গে চলি,
মা, কোথায় চলেছো তোমরা? তোমরা পথিক, না আগন্তুক ?
তার উত্তরের কিছু অধরে ফুটে উঠে মিলিয়ে যায়
কিছু ছিঁড়ে নিয়ে যায় পথের হাওয়া।
আমার অকূল প্রশ্নগুলি, মা, বিছানো রইল যে ঘোর তিমিরে
তাকে বরণ করবার অছিলায় তুমি মুছিয়ে দিও তার অনটন
মেঘরক্তে যদি ভেসে যাও, অসহ মনে হয় দিনমান
বেদনার টানে তবে নতশির সন্ধান ক’রে ফিরি অস্থির
ক্ষুরধার হাওয়া বহে অবিরাম কিভাবে আড়াল করি সম্বল
জলধর, স্থির হও, শোনো কথা, সবই যায় যায় না এ – বিফলতা
আগুনে শালুকে মেশে এ-জীবন, মিশে যায় ধূলিকণা, কলরব
কোথা রাখি মৃতমুখ, শবাধার, এ -জগৎ গতিশীল, প্রাণময়
তোমার অধীর রাত্রিতলে মা, হারালে যা দিলাম তুলে অখন্ড সংসারে
তোমার নামে রেখেছি নাম, তিরোভাব, অমরতা।
স্থির, ক্রন্দন স্থির হয় ; একটি কৃশ, নিষ্পত্র গাছ, আর
ওই পথের অবশেষ প’ড়ে আছে, যেন কোনোদিন
মানুষের, গৃহপালিত পশুদের পদচিহ্নে সে রাঙা হয়নি
সমুদ্রফেনার মতো নিজেরই পায়ে আছড়ে পড়েনি কোনোদিন,
পত্রহীন শাখার উপাসক, সতত একাকী সে, দিনের পর দিন
দেখেছে, ভেবেছে কোথায়, কোন বিন্দু হ’তে আকাশ আরম্ভ হয়
সে কি আমাদের সংসারের কেউ ? বর্ষণে, তাপে, মাঘব্রতে
জীর্ণ হয়েছি যারা, আকাশ কি আমাদের কেউ ?
ধ্রুব ও অচঞ্চল তুমি বৃক্ষশাখা, তার পরিচয় দাও
আস্বাদন করি তার দুঃখ, অনুৎসাহ, আরও একবার
পাতা হয়ে, হলুদ পাতা হয়ে, আকাশের গায়ে যেন কেঁপে উঠি।
কেঁপে ওঠবার আগে ঝ’রে পড়েছি পাথরে পাথরে
গৃহস্থের এক ঘটি জল হাতে খুঁটির পাশে এসে যদি দাঁড়াও
এই দোলাচলে নীরবে কিভাবে দেখা দেবে ?
কিভাবে বলি ঝরাপাতাদের দালান আজ ডাকে যদি,
যদি আবার ডাকে, বাতাস থেকে কুড়িয়ে নিতে হবে তার রক্তশূন্য স্বর
পাথরের কন্যা আমি, অন্তিমদশায়, চক্ষু দাও !
প্রাচীন মূর্তিগুলির কোলেপিঠে ছড়িয়ে ছিলাম, আজও তাই,
বৎসরের ফোঁটাগুলি শীতার্ত গা বেয়ে যখন নামে
ভাবি এ কোন্ অমল বৃষ্টিপাতে এসে দাঁড়িয়েছি, কোন্ সুরক্ষার
আড়াল থেকে আমার সন্তান চেয়ে আছে শেষতম পরীটির দিকে,
পরীদের দেশ মুছে যাওয়ার বহুকাল পর, কোন সৌভাগ্যবলে
সমস্ত বাহির তার নিঃসঙ্গ জানালায় স্থির,
যেন পৃথিবী কিছু নীরবতা গচ্ছিত রেখে গেছে উভয়ের কাছে।
( প্রথম প্রকাশ — মহাবাহু, জুন ১৯৯৩)
একটি মহাকবিতার খোঁজে জীবনানন্দের আশাবাদ ছিল … গৌতম বসু’র কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের এই স্বপ্ন ও ছবির সাথে দেখা হয়… একজন মৌলিক কবির জন্য এটা পরম আশীর্বাদ ❤️
এই লেখাটি আমাদের বন্ধু, অভিজিৎ-এর মহাবাহুতে পড়েছি আগে । আবার পড়লাম। এই কবিতাটিকে বলা যায়, unputdownable . অনেক লাইন কোট করতে ইচ্ছে করছে । “মন্থর ও মৌন এই সংক্রান্তির বেদন ( “বেদন” শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ) যেন সন্তানে সন্তানে প্রবাহিত ।” এছাড়াও, ” আমার অকূল প্রশ্নগুলি ( প্রশ্নের বিশেষণ,’অকূল’শব্দটির ব্যবহার একটা হাহাকারের জন্ম দিচ্ছে ।) , মা, বিছানায় রইল যে ঘোর /
তিমিরে/ তাকে বরণ করবার আছিলায় তুমি মুছিয়ে দিও তার অনটন ।”—- ইত্যাদি । এই কবিতা অমর হবেই ।