
খনা এক সত্য
জয়তী রায়
'খনা নামের সেই মেয়েটিই শুধু রক্তক্ষরণে মরলো'। লিখেছিলেন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। খনা-- এক চিরকালীন রহস্যাবৃত চরিত্র। কিন্তু এই চরিত্রের সন্ধানে যেতে গিয়ে সময় থেকে সময়ের গূঢ় অলিগলির ভিতর ডুব দিয়েছেন লেখিকা। গল্প, ইতিহাস, ফিকশন পরস্পর মিলেমিশে তৈরি করেছে এক আশ্চর্য কথন, এক নিরুচ্চারিত আখ্যান।
এক
প্রায়ান্ধকার ছোট্ট কক্ষটির একমাত্র ঘুলঘুলি দিয়ে ,বাইরের একটুকরো আকাশে সূর্য ডুবে যাচ্ছে দেখছিল খনা। কি সুন্দর দৃশ্য। সংকীর্ণ ঘুলঘুলিতে চোখ আটকে নিঃশেষে পান করছিল প্রকৃতির অপরূপ শোভা। একটুকুই দেখা যায়। আকাশের বিশালতাকে ছোঁয়া, ওই টুকু ছিদ্র দিয়ে সম্ভব না।
অসহায়ের মত চোখ বন্ধ করলো খনা। কয়েকদিন আগেও সে ছিল ভারতের প্রথম মহিলা জ্যোতির্বিদ, নির্ভুল গণনা সেই সঙ্গে কৃষি বিদ্যায় অগাধ জ্ঞানের ফলে, দিক দিগন্ত থেকে বিপন্ন মানুষ ছুটে আসত তাঁর কাছে। স্বয়ং মহারাজ বিক্রমাদিত্য তাঁকে আহবান করলেন , নবরত্ন সভার এক রত্ন হবার সম্মান দেবার জন্য।
শূন্য ঘরে চোখ ফেটে জল আসতে চায় । ওই জ্যোতিরত্ন উপাধির তো দরকার ছিল না কোনো ? স্বামী শ্বশুর নিয়ে সুখে ঘরকন্না করা ছাড়া আর কিছু চায় নি সে। আবার ঘুলঘুলি দিয়ে অন্ধকার অঙ্গনের দিকে তাকাল সে। প্রদীপ জ্বলে উঠেছে গৃহের কোণে কোণে। হঠাৎই চোখে পড়ল, শ্বশুর বরাহদেব এক মৃতপ্রায় ব্রাহ্মণ পুত্রের পিতাকে হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলে চলেছেন। কান মন একাগ্র করে শুনতে চেষ্টা করল শ্বশুরের কথা খনা, মনে হল যেন নিশ্চিন্ত থাকতে বলছেন ব্রাহ্মণ পিতাকে, এই বলে যে ,পুত্রের কোনো মৃতুযোগ নেই। ব্যাকুল খনা প্রানপনে বলতে চেষ্টা করলো–
‘ ,ভুল করছেন পিতা। এ সম্ভব না।
জন্ম মৃত্যু বিয়ে / তিন বিধাতা নিয়ে। যত বড় জ্যোতির্বিদ হোন না কেন ? এই তিন বস্তু নিয়তি নির্ধারিত। ‘ গলা দিয়ে গোঙানীর মত আওয়াজ এলো কেবল, কথা আর কোনোদিন বলতে পারবে না খনা। ধীরে ধীরে মেঝেয় বসে পড়ে খনা। মাত্র বাইশ বছর বয়স তাঁর। সব শেষ হয়ে গেল? শূন্য অন্ধকার ঘরে কে যেন বলে ওঠে
“ তুমি তো ভবিতব্য জানতে খনা। তবে কেন বিবাহ করলে মিহির কে?
বিষণ্ন ক্লান্ত হেসে মাটিতে আঁক কষতে কষতে নিজেকে উত্তর দেয় নতমুখী নারী
ভালোবেসেছিলাম যে। একসঙ্গে বড় হয়েছি দুজনে। ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ভালোবাসা আর নিয়তি –দুটিকেই লঙ্ঘন করা বড় কঠিন।’
ঘরের কোনো এক অন্ধকার কোন থেকে টিকটিকি বলে ওঠে–” ঠিক ঠিক ঠিক।” খর চোখে তাকায় খনা, জিহ্বা বিহীন ঘড় ঘড়ে গলায় বলে ওঠে –” চুপ কর। তুই কী জঞ্জাল থেকে চুরি করে আমার জিহবা খেয়েছিস? যদি তাই হয়, তবে শুনে রাখ ,একদিন তুইও আমার মত নির্ভুল সত্য বলতে পারবি।’ টিকটিকি আবার বলে ওঠে –,ঠিক ঠিক”
প্রেতিনির মত খিল খিল করে হেসে ওঠে খনা। মৃত্যু আসন্ন জেনে খুব হাসতে ইচ্ছে করছে আজ। কেউ আসবে না আর তাঁর কাছে, সারা অবন্তী নগর জানে সে চলে গেছে সিংহল। তাঁর পিতৃভূমির দিকে। সাধারণ কৃষক থেকে রাজসভার জ্ঞানী গুণীর হাহাকার কানে এসেছে তাঁর, কে করবে আর তেমন ভবিষ্যদ্বাণী? যার ফলে জানা যাবে কোন ঋতুতে, কোন সময়ে, কোন আলোতে, কোন বাতাসে–বীজ রোপণ করলে ,জমি ভরে উঠবে ফসলে! আকাশের নক্ষত্রের চলন দেখে কে আর প্রজাদের আগাম সাবধান করে দেবে ভূমিকম্পের ব্যাপারে? মা হারা শিশুর মত অসহায় দেশবাসী আজ। কে বলবে তাদের কখন আসবে মড়ক? কখন সাবধান হতে হবে তাদের আসন্ন খরা থেকে?
নাঃ। আর ভাবতে চায় না খনা। মৃত্যুকালে মনে পড়ে , তাঁর গুরু, তাঁর আচার্যের স্নেহ ভরা মুখটির কথা। বড় হতে হতে জেনেছিল, তাঁর পিতা মাতাকে হত্যা করা হয়েছে। সিংহলদেশে রাজনৈতিক গন্ডগোল তখন তুঙ্গে। দ্রাবিড়দের নিজেদের মধ্যে লড়াইএ , খনার পুরো পরিবারকে শেষ করে দেওয়া হল। রাক্ষস জাত তাঁকেও ছেড়ে দিত না। রক্ষা করলেন ওই গুরুদেব। অটনাচার্য। সিংহলদেশে ওনার কথা ছিল শেষকথা। মায়াজাদু থেকে শুরু করে জ্যোতিষবিজ্ঞানে উনি ছিলেন পন্ডিত। একটি একটি করে নিজের অধীত বিদ্যা খনাকে শিখিয়ে উল্লসিত হয়ে উঠতেন তিনি
“ পুত্রী ,তুমি অসাধারণ। জ্বলন্ত সূর্যের মত তোমার মেধা। পৃথিবী জয় করবে একদিন তুমি পুত্রী খনা।”
—” আর মিহির? “মুখ টিপে হেসে, কৌতুকের স্বরে বলে খনা আর মিহির? সে কি করবে ? গুরুদেব? “
গৌরবর্ণ সুদর্শন মিহির,লজ্জায় আরক্ত। সেদিকে তাকিয়ে ঈষৎ ভর্ৎসনার সুরে গুরুদেব বললেন –ছিঃ খনা। মিহির একটু ধীরে শেখে। কিন্তু কালে একদিন সে ও অঙ্ক শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করবে।
— এই কথা তো ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি গুরুদেব। সহজ সপ্রতিভ স্বরে জবাব দিল খনা। সে এমনই সপ্রতিভ। একলা শৈশব তাঁকে পরিণত করেছে অনেকটাই। বড় হওয়া ইস্তক মিহিরকে দেখছে আশ্রমে। শুনেছে, সদ্যোজাত শিশু মিহির ভেসে যাচ্ছিল সাগর জলে, গুরুদেব তাঁকে উদ্ধার করে আশ্রমে নিয়ে আসেন। খনা আর মিহির একসঙ্গে বড় হচ্ছে আশ্রমে, আজ দুজনেরই বয়স প্রায় আঠারো। দুজনের মধ্যে গড়ে উঠেছে সুন্দর স্বাভাবিক ভালোবাসার সম্পর্ক। খনা রূপসী নয়। সিংহলী কন্যা। মজবুত শরীর, উজ্জ্বল শ্যাম শরীরের বর্ণ, সরল মুখটি ঘিরে একরাশ কোঁকড়া চুলের রাশি, বড় বড় দুটি শান্ত মায়াময় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ– নক্ষত্র বিদ্যা, কৃষিকাজ ফলিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান, মনস্তত্ব, আবহ বিদ্যা, ভূ তত্ত্ব– সবেতেই খনা আশ্রমে সকলের সেরা। এর মধ্যেই গণনা করে সে জেনে ফেলেছে, মিহিরের পরিচয় –’তুমি ব্রাহ্মণ পুত্র মিহির। তোমার পিতা ,উচ্চ বংশীয় জ্ঞানী পুরুষ। ভারতবর্ষের মধ্যপ্রদেশে তোমার পরিবার আছে।”
মিহির যে সিংহলী নয়, তা তাঁর সোনার মত উজ্জ্বল গৌর গাত্র বর্ণ, দীর্ঘ প্রশস্ত চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। এক তামার তৈরি হালকা পাত্রে করে ভাসতে ভাসতে, সিংহলের সমুদ্র উপকূলে এসে ,গুরুদেবের চোখে পড়ে যায়, তাই বেঁচে যায় সে। কেন বিসর্জন দেওয়া হল তাকে? অভিমান বিদ্ধ সরল যুবকটি বলে–
আমি জানতে চাই না খনা , আমার পরিচয়। এই বেশ আছি। আমাকে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল মৃত্যুর কোলে। এ আমার নতুন জন্ম। তার উপর অধিকার কেবল তোমার!”
তা হোক। শিক্ষা সম্পন্ন হলে ফিরে যাব তোমার ঘরে। কত সুখী হবে তারা তোমাকে ফিরে পেলে।”
–আর তুমি? তোমার এই এত বিদ্যা? তার কি হবে!
“তুমি আছো। ভয় নেই আমার। তোমার উৎসাহে নতুন করে সব শুরু হবে।
*
শীতের শান্ত ভোর। শিপ্রা নদীর উপর দিয়ে তর তর করে বয়ে চলছে এক যাত্রী বাহী বড় নৌকা। লক্ষ্য অবন্তীর ঘাট। এত ভোরে ঘাট সংলগ্ন অন্যান্য নৌকা, ছোট জাহাজ সব ঘুমন্ত। তবু তার মধ্যে বিদেশী যান দেখে কেউ কেউ হাঁক দিল
কন দ্যাশ?
গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর এল
লঙ্কা প্রদেশ। যাত্রী আছে গ।
লাগাও লাগাও ঘাটে লাগাও। নগরে সবুর করে পাড়ি দেবে জাহাজ আবার।
ভোরের ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগা মাত্র শীত করে উঠল খনার। লাল রঙের উষ্ণ কাপড়টি গায়ে মাথায় ভালো করে মুড়িয়ে নিয়ে, পাশে স্বামী মিহিরকে ও ইঙ্গিত করল গরম কাপড়ের উত্তরীয়টি জড়িয়ে নিতে। মিহিরের চলার ভঙ্গিতে যথেষ্ট জড়তা, সেই তুলনায় খনা অনেক সহজ ভঙ্গিতে আসে পাশে দেখছিল। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি চোখে মুখে লেগে থাকলেও, আটো করে বাঁধা চুল, সিংহলী কায়দায় পড়া কাপড়, কপালে টিপ, অঙ্গে কিছু সোনা রুপার গহনায়– বেশ লাগছিল খনাকে। মিহির বারে বারে মুগ্ধ চোখে স্ত্রীকে দেখে যাচ্ছিল, সেটা লক্ষ্য করে মৃদু অনুযোগে স্বামীকে সতর্ক করে খনা বলল–
“ এত বড় শহর। এখানে খুঁজে বার করতে হবে তোমার পিতৃ গৃহ। কঠিন কাজ। চলো, কোথাও বসে বিশ্রাম আর কিছু খাবার খাওয়া যাক।”
অবন্তী ভারি সুন্দর রাজ্য। বড় বড় অট্টালিকা , প্রশস্ত পথ ঘাট, উদ্যান , নাটশালা, পাঠশালা, পাথরে মোড়া দেউল ও মন্দির। নদীর ঘাট, পাথরে নির্মিত। প্রত্যেক গৃহ চূড়ায় কারুকার্য করা বিচিত্র ধাতুর কলসে রাজ্যের উপাস্য দেবতা মহাকালের মূর্তি খোদাই করা, রাজ্যের সমৃদ্ধি ও শক্তির প্রচার করে। খনা এ ও জানে, জ্ঞান বিজ্ঞান জ্যোতিষ চর্চায় জগৎ বিখ্যাত এই রাজ্য, দেবভূমিও বলা হয়ে থাকে। এখানে সারাদিন ঈশ্বরের আরাধনা হয়। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের সু শাসনে রাজ্যে সর্বদাই সুখ শান্তি বিরাজ করে। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ–বুদ্ধিমতী খনা , এখানে আসবার আগে বহু পড়াশুনো করে এসেছে।
একটি দুটি করে দোকান পাট খুলতে শুরু করেছে। দূরে একটি মিঠাইয়ের দোকান দেখে, খনা এগিয়ে এসে সেখানে বসল। সৌম্য দর্শন বয়স্ক ভদ্রলোক, কপালে চন্দন তিলক – খনা এগিয়ে গিয়ে নমস্কার জানাল। প্রতি নমস্কারে দোকানী বলল
বসো মা। বিদেশী বলে মনে হচ্ছে। তা জল টল খেয়ে বিশ্রাম করো। কোন ঘরে যাবে?
খনা সময় নষ্ট করতে চায়না। এক জায়গায় যদি কাজ না হয়, অনেক খুঁজতে হয়, তবে গাল গপ্পে কোনো লাভ নেই। সে সরাসরি কথা পাড়ল
— আমার স্বামী মিহির কে জন্মের পরেই তামার পাত্রে করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সম্ভবত মৃতুযোগ অনুমান করে। গণনা করে আমি দেখেছি, মিহিরের জন্মস্থান ভারতবর্ষের মধ্যপ্রদেশে। গণনা যখন করেছিলেন, তখন মিহিরের পিতা বড় গণিতজ্ঞ হবেন। এমন ঘটনা আপনার জানা আছে কি?”
দোকানের সামনে কৌতূহলী লোক জমা হতে লাগল ক্রমশ। মিহিরের অস্বস্তি বাড়লেও খনার হেল দোল নেই। দেখা গেল, প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা হলেও, সবার মনে পড়ে গেল, তার কারণ বড় পরিবারের কাহিনী কেউ ভোলে না। তিনি যে গণনা করে দেখেছিলেন পুত্রের আয়ু মোটে এক বছর, তাই তাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন জলে — এমন ঘটনা অবন্তীতে আর কটাই বা হয়েছে? খনা বলল– আচার্য বরাহ? এমনটাই অনুমান করেছিলাম আমি। মিহিরের প্রতিভা গণন শাস্ত্রে দক্ষতা এই কথাই বলে। আচার্যের গৃহ ঠিক কোনদিকে যদি একটু বলেন?”
জনগণ এমন সুযোগ ছাড়ে কখনো? এমনিতেই বরাহের অহংকারী স্বভাবের জন্য তাঁকে কেউ পছন্দ করে না, আর আজ তো বৌমার হাতে শ্বশুরের পরাজয়! এমন আমোদ রোজ রোজ জোটেনা শান্ত শহর উজ্জয়িনীতে। উল্লসিত জনতা, মিহির আর খনাকে নিয়ে বরাহের অট্টালিকার দিকে রওয়ানা হল। খনা সন্তর্পণে নিজের পুঁটলির মধ্যে সযত্নে রক্ষিত তামার বাসন টি, শিশুমিহিরের কোমরে বাঁধা ছিল একটি মহাকালের মূর্তি খোদাই ছোট গোল চাকতি –সেগুলির উপর হাত রাখল। আচার্য বরাহ নিশ্চয় জনতার মত আবেগ প্রবণ হবেন না। তাঁকে মানাতে প্রমাণ লাগবে। মৃদু হাসল খনা। কি মনে হতে, প্রবীণ ব্রাহ্মণ দোকানীটিকে প্রণাম করল। সস্নেহে তিনি আশীর্বাদ করে বললেন
“ ভয় পেওনা মা। আচার্য বরাহ ,লোক সুবিধার নয়। যদি একান্তই না পারো, এই খানেই চলে এস। কিছু ব্যবস্থা হবেই।”
খনার চোখে জল এল। লড়াকু মেয়ে সে। লড়াই করতে ভয় পায়না। সে কেবল ভয় পায় ছলনাকে।
দেখা যাক।
*
কিশোরী খনার তীক্ষ্ণ অনুমান ক্ষমতা দেখে ,গুরুদেব অটনাচার্জ সস্নেহে বলতেন–”মা তোমার তৃতীয় নয়ন আছে। তুমি অনেক দূরের ছবি দেখতে পাও। তোমার এই অস্ত্র পরে কাজে লাগবে।
আজ আচার্য বরাহের সামনে এসে সেই কথা কেন জানি না মনে পড়ে গেল। ওনাকে দেখে , খনা চমকে উঠল। প্রৌঢ় অভিজাত ব্রাহ্মণ মানুষটির সর্ব অবয়বে, শুষ্ক দীর্ঘ শরীর, খড়গ নাসা, প্রশস্ত ললাটে বিদ্যার অহংকার জ্বল জ্বল করছে। কিন্তু ,ঠোঁটের বক্র হাসিটিতে ধরা পড়ে মানুষের প্রতি তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা। জ্ঞানের অন্য নাম আলো। কিন্তু, জ্ঞানী বরাহের মনে এত অন্ধকার জমে আছে? খনা মিহিরের দিকে তাকাল। মিহিরের পিতা এমন? তবে কি তাঁর এই ভালোমানুষ স্বামিটির রক্তের মধ্যেও সুপ্ত আছে ওই অহংকারের বীজ?
“ কি চাও তুমি ? জনতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আচার্য , গৃহ ভৃত্যদের আদেশ দিলেন বাইরের দরোজা বন্ধ করে দেবার জন্য। প্রশস্ত অঙ্গনে মিহির আর খনা আর তিনি। খনা মৃদু কণ্ঠে বলল
– একটু বসতে পারি কি? কথাটি সাধারণ নয়।”
— সে তো তোমার আগমনের ভঙ্গিমাতেই বোঝা গেছে বৎসে। “ বিদ্রূপে বেঁকে গেল বরাহের ঠোঁট
একেবারে রণ সজ্জায় সাজিত হয়ে উপস্থিত।”
–”না না পিতা। আপনি ভুল বুঝেছেন।”
–”থাক। আমাকে বোঝানোর দুঃসাহস করতে যেওনা হে অল্প বুদ্ধি। আর পিতা কেন? আমি আচার্য বরাহ। কারো পিতা নই। পুত্রহীন আমি।” গলা সামান্য কেঁপে গেল কঠিন মানবের।
এই বার খনার মুখে খেলে গেল বিদ্যুৎ। সামান্য সরে গিয়ে, পিছনে ভীত খরগোশের মত দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ মিহিরকে সামনে এনে মৃদু স্বরে বলল:
আমাদের প্রণাম নেবেন পিতা। আপনি ভুল করতেই পারেন না। সে কথা বলার আস্পর্ধাও আমার নেই। কিন্তু পুত্র হীন আপনি নন। এই মিহির আপনার পুত্র। “
“মূঢ় নারী। “কঠিন গলায় বলে উঠল বরাহ
আমার গণনায় পরিষ্কার দেখেছি পুত্রের মৃত্যু যোগ, তার জন্মের এক বছর পরেই। সে কথা ভুল হতেই পারে না।
একটু একটু রোদ্দুর উঠেছে । বাড়ির উঠোন জুড়ে পাখ পাখালীর ভিড়। খুব জল পিপাসা পাচ্ছিল মিহিরের। যদিও একটু আগে সুস্বাদু মিষ্টি জল খেয়ে এসেছে। তবু যা ধকল গেছে গত তিনদিন ধরে, তার তুলনায় ওই টুকু কিছুই না। সিংহল থেকে বিনা অনুমতিতে পালিয়ে এসেছে তারা। গোপণে। কিছু শুকনো খাদ্য, অর্থ নিয়ে এক কাপড়ে , ছদ্মবেশে। গুরুদেব তাদের জাহাজে তুলে দেন। এখন সে ক্লান্ত খুব ক্লান্ত। খনা এ সব কি করছে? কেন করছে? সিংহলের সমুদ্র উপকূল, নারিকেল গাছের ছায়া ঘেরা আশ্রম — খুব মনে পড়তে লাগল তার। সে আর পারল না। ওই খানেই গাছের নীচে বসে পড়ল। বিরক্ত লাগছিল। খনার সবটাতেই বাড়াবাড়ি। কে পিতা? কিসের পিতা? এত দূর দেশে এসে কি প্রমাণ করবে ওই নারী? বলে কি না– :
তুমি অনাথ নও গো। কেন তবে এমন জীবন হবে তোমার? প্রাপ্য মর্যাদা তোমাকে ফিরিয়ে দেবই আমি।”
খনা আর আচার্য বরাহ — তাকিয়ে আছেন পরস্পরের দিকে। জ্ঞান পূর্ণ মানব হল সূর্যের আলোর মত। যে কোনো অন্ধকারের ভিতর সে প্রবেশ করে অনায়াস। এখানে দুজনেই জ্ঞানী। সূর্যের গায়ে রাহুর মত, বরাহের জ্ঞান ঢাকা অহংকারে, আর খনার জ্ঞান মানুষের আশ্রয়।
আত্মবিশ্বাসী খনা , ধারাল কিন্তু নম্র গলায় বলে উঠল:
হে পিতা! জন্ম মৃত্যু আপনি বিচার করতে পারেন না। জন্ম মৃত্যু আর বিবাহ– আমাদের গণনার মধ্যে নেই। আপনাকে আমি বোঝাই? ভুল কোথায় ছিল?
বরাহ একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। এই মেয়ের এত দুঃসাহস? কে এই নারী? শিক্ষিতা বিদুষী তাতে সন্দেহ নেই। দুঃসাহসীও বটে। সেই সুদূর সিংহল থেকে চলে এসেছে। সিংহলী হয়েও অনর্গল শুদ্ধ বাংলা বলছে ? তাঁর রাগ হচ্ছে। কিন্তু যুক্তিকে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। এইরকম অশান্ত ভাবনার মাঝেও থিরথির করে এক আনন্দের স্রোত বয়ে গেল, বরাহের শুষ্ক হৃদয়ে। গাছতলায় এলিয়ে পড়ে থাকা ওই সুকুমার যুবকটি যদি সত্যি তাঁর পুত্র হয়? ঢোঁক গিলে গম্ভীর কণ্ঠে তিনি আদেশ করলেন:
যদি প্রমাণ হয়, আমার পুত্র জীবিত, তবে তুমি যা চাও তাই পাবে নারী। এবার বলো।
খনা স্থির স্বরে বলল–
আপনি বলেছিলেন যে পুত্রের আয়ু এক বছর। কিন্তু জন্ম নক্ষত্র অনুযায়ী এক পলকের আয়ু বারদিন।
কিসের তিথি কিসের বার
জন্ম নক্ষত্র করো সার।।
এই ভাবে হিসেব করে দেখুন পিতা, মিহিরের আয়ু এক বছর না, একশ বছর। “
হাঁফিয়ে গেছিল খনা। মাঘ মাসের ঠান্ডা বাতাসে হাড়ে কাঁপন ধরে যাচ্ছিল। অকথ্য চাপ যাচ্ছে মনের উপর দিয়ে। সে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল বরাহের মুখের দিকে। মেঘ ভাঙা সূর্যের আলোর মত একটুকরো হাসি খেলে গেল বরাহের মুখে। ক্লান্ত বিদ্ধস্থ খনার দিকে একবারও না তাকিয়ে তিনি সোজা চলে গেলেন গাছ তলায়, যেখানে মিহির শুয়ে আছে। এবার শুধু পিঠের লাল জরুল টা মিলিয়ে নিলেই সব শঙ্কার অবসান !
দুই
——-
রাজা বিক্রমাদিত্যের সভায় নয়টি রত্ন। দেশ বিদেশে যাদের খ্যাতি ছড়ান। অমরসিংহ, কালিদাস, ক্ষপণক, ঘটকপর, ধনন্তরি, বরাহ ,বররুচি ,বেতালভট্ট ও শঙ্কু– এঁদের মহারাজ যত্ন করে রেখেছেন। তিনি সুশাসক। তবে কৃষি নির্ভর রাজ্যে সমস্যা লেগেই থাকে। কখনো খরা, কখনো অতিবৃষ্টি। কৃষককে আগে থেকে অনুমান করে ফসল ফলানো? নিতান্ত অসম্ভব। তাই আশানুরূপ ফসল হয়না । রাজকোষ খুলে দিয়ে , কৃষকদের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশে দাঁড়ান রাজা। শ্বাস ফেলে ভাবেন, নবরত্নের এই সভায়, থাকত যদি একজন ভূতত্ববিদ? ,আবহাওয়া বিশারদ? তবে কৃষিকাজের অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারত সহজে। সুদর্শন সুমিষ্ট ভাষী রাজার মুখভঙ্গিমার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিচিত বয়স্য বিদূষক নবীনচন্দ্র। লম্বা টিকি নেড়ে , খাটো ধুতি সামলে, সহজ সহাস্য মুখে নবীন্চন্দ্র বললেন
“ পূর্ণিমা চন্দ্রমা মেঘাচ্ছন্ন? “ নিজের আসনে সগৌরবে বসা, কবিবর কালিদাস টিপ্পনী কাটলেন
“ উপমা ভুল। মহারাজের ক্ষেত্রেও বটে, ব্যাকরণের জন্যে ত বটেই।”
“ইচ্ছাকৃত ভুল কবিবর। নতুবা আপনার মৌনতা ভঙ্গ হত না। নিজ আসনে বসে,একটি সঠিক শব্দের খোঁজে সারাদিন কাটিয়ে দিতেন। নতুবা , এই নবরত্ন সভার মাহাত্ম্য এমনই যে, ছোট পাখিটিও ব্যাকরণ শিখে যায়।” নতুবা –এই শব্দটিকে খেলিয়ে খেলিয়ে ছন্দে এনে বাক্যটি বলেন।
সভাস্থ সকলে সাধু সাধু বলে ওঠে। মহারাজ নিজের গলা থেকে বহুমূল্য রত্ন হার খুলে , বিদূষককে পরিয়ে দিয়ে বললেন
–” আমার সভা সত্যি অমূল্য। আচার্য অমরসিংহ ,সর্বশ্রেষ্ঠ অভিধান রচয়িতা। মহাকবি কালিদাসের কাব্য রচনার কথা মুখে বলে শেষ করা যায় না।
ক্ষ পণক একজন জ্যোতির্বিদ, ঘটকপর আমার প্রিয় বাস্তুশিল্পী, ধন্বন্তরির মত একজন আয়ুর্বেদ ও শল্য চিকিৎসক খুঁজে পাবে না কেউ।
–”ঠিক ঠিক মহারাজ” –দ্রুত ঘাড় নাড়ে বিদূষক,
“ আচার্য বরাহ কেবল অকারণে গম্ভীর থাকেন এই যা, কিন্তু ওনার মত একজন দার্শনিক গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী সারা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।”
সিংহাসনে সোজা হয়ে বসে , গর্বের সঙ্গে রাজা বিক্রমাদিত্য বললেন:
— আচার্য বরাহর লেখা পঞ্চসিধান্তিকা গ্রন্থ আজ গ্রীক, মিশর , রোমান সব জায়গায় সমাদৃত। সারা পৃথিবী জানে ওনার কথা। ভারতীয় পঞ্জিকায় উনিই বৈশাখ কে প্রথম মাস বলেন। গণিতশাস্ত্রকে নতুন রূপ দিয়েছেন আপনি।” জোড় হাতে সসম্মানে বলে উঠলেন রাজা।
–” আজকাল অমাবস্যায় চাঁদের আলোর মত, বরাহদেবের শুষ্ক মুখে একটু হাসির রেখা দেখা দেয়। সে কি ওনার অকস্মাৎ পুত্র রত্ন ফিরে পাবার জন্য? কি বলো হে বিদূষক?”
—”তাতো বটেই। শুনেছি, বৎস মিহির নাকি গণিত শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে এসেছে ? “ বিদূষক নবীনচন্দ্রের প্রশ্নটি বরাহের উদ্দেশে করা। এতক্ষণ নিজ আসনে চুপ করেই বসে ছিলেন বরাহ। ওটাই ওনার স্বভাব। সভায় রসের ফোয়ারা ছুটলেও, তাঁর হেলদোল নেই। আড়ালে এ নিয়ে আলোচনাও চলে বইকি। কিন্তু আজ পুত্রের প্রসঙ্গে নড়েচড়ে বসে বললেন:
সংবাদ সত্য। মিহির উচ্চশিক্ষিত হয়ে ফিরে এসেছে। মহারাজ অনুমতি দিলে আগামীকাল থেকে সে আসতে পারে সভায়। সেক্ষেত্রে পিতপুত্রের বিষয় যেহেতু গণিত, তাই আমরা বরাহমিহির নামে কাজ করতে পারি। “ মিহিরকে রাজসভায় নিয়ে আসার কথা আজ বলবেন বলে, বরাহ প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন।
‘উত্তম প্রস্তাব। সাধু সাধু।’ রাজার সঙ্গে সকলেই বলে উঠল সাধু সাধু। কোলাহল থামলে বিদূষক বলে
‘ ,শুনেছি, আপনার বৌমাটিও ভারি শিক্ষিতা গুণবতী ?’
—,তা হবে। এখন সে আমার সংসারের কর্ত্রী। অন্যদিকে মন দেবার মত সময় কই?’
–’ শুনেছি, সে নাকি ভুতত্ববিদ ? আমার রাজ্যে একজন এমন গুণীর বড় প্রযোজন, হে আচার্য। রাজ্যের কৃষকরা নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার গতি প্রকৃতি বুঝবার মত জ্ঞানী ,খুব প্রয়োজন রাজ্যের।’ হর্ষ বিক্রমাদিত্যকে বেশ হতাশ মনে হল। মনের ক্রোধ মনে চেপে, বরাহ সভা শেষ হবার অপেক্ষা করতে লাগলেন। এসেছেন পুত্রের আসন পাকা করতে, তা নয়, সবাই করছে বৌমাকে নিয়ে মাতামাতি! আবহাওয়াবিদ? যত সব। ‘ কিছুক্ষণ আগের সেই খুশি মূর্তি উধাও পরিবর্তে মুখে তীব্র বিরাগ, বরাহদেবের। যথেষ্ট বুদ্ধিমান রাজা হর্ষ, বরাহের মনের ভাব বুঝে দৃঢ় নিশ্চিন্ত হলেন যে, খনা সম্পর্কে যা শুনেছেন — সব সত্য। তবে, বরাহ সহজে খনা সম্বন্ধে কিছু বলবেন বলে মনে হয় না। এর জন্য চাই কৌশল। মনে মনে হেসে , তিনি কোমল সুরে বললেন–
সভার কাজ শেষ হবার আগে, একটা কথা বলতে চাই আপনাকে আচার্য। আকাশে কতগুলি নক্ষত্র আছে, সেটি গণনা করে আপনার পুত্র মিহিরকে বলতে হবে। তবেই সে নবরত্ন সভার উপযুক্ত বিবেচিত হবে। ‘
মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ল বরাহদেবের। গণিতশাস্ত্রে অগাধ ব্যুৎপত্তি আছে বলেই তিনি জানেন – নক্ষত্র গণনা অসম্ভব। মহারাজ কোনো কূট চাল দিলেন কী? ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না ! একরাশ চিন্তা নিয়ে নিজ গৃহে প্রবেশ করলেন তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নগর জুড়ে শুরু হয়ে গেছে মহাকালের আরতি। ঘন্টা, শঙ্খ, ভেরী বেজে উঠেছে। একটি একটি করে নক্ষত্র ফুটে উঠছে সন্ধ্যার আকাশে। দেখে গা চিড়বির করে উঠল বরাহের। নক্ষত্র গণনা? আজকের মধ্যে? নতুবা মিহিরের ঠাঁই হবে না , রাজসভায়– প্রাকান্তরে এমন হুমকিই যেন শোনা গেল রাজার কণ্ঠে?
বিষতেতো মন নিয়ে গৃহে ঢুকে রাগ আরো বেড়ে গেল। কোথাও কোনো সন্ধ্যারতির চিন্হ মাত্র নেই। উঠোন জুড়ে সাদা আলপনা আঁকা। চাঁদের আলোয় কেমন মায়াবী লাগছে ঘর দুয়ার। আর তার ছেলে বৌমা পড়াশুনো করছে। বলা ভাল, ছেলেই পাঠ নিচ্ছে খনার কাছে বসে। আর খুনসুটি করছে। খোলা চুল ছড়ান পিঠময়, পাট পাট করে শরীরে জড়ান লাল টুকটুকে কাপড়, শ্যামলা উজ্জ্বল মুখ, স্বল্প স্বর্ণালংকার –ঋজু হয়ে বসা খনার কোলে শুয়ে মিহির। পূর্ণিমার আলো লুটোপুটি খাচ্ছে দুজনের শরীরে। মিহিরের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে এত কি বলছে খনা? কান পেতে শুনলেন ,সে বোঝাচ্ছে চার্বাক দর্শনের কথা। নিরাকারবাদের কথা। ঈশ্বর আসলে মানুষের মন নিজেই, বাইরে থেকে পুজো পাঠ করার কোনো দরকার নেই।
মাথাটা চড়াৎ করে গরম হয়ে গেল আচার্যদেবের। রাক্ষসপুরী থেকে রাক্ষসী ধরে নিয়ে এল মিহির? শুদ্ধ ব্রাহ্মণের বাড়ি বসে, ব্রাহ্মণত্ববাদকেই নস্যাৎ করতে চায় এই নারী? পূজা পাঠ, যাগ যজ্ঞ মিথ্যা হলে , ব্রাহ্মণ থাকবে কি নিয়ে ? এদিকে নক্ষত্র গণনা অন্য দিকে চার্বাক দর্শণ– খনা তাঁকে আর বাঁচতে দেবে না!
,পাথরের পাত্রে ঠান্ডা জল, মধু ঘৃত চাল গুঁড়ো দিয়ে বানানো এক রকম সুস্বাদু সিংহলী মিষ্টি– নিয়ে শ্বশুরের সামনে এল খনা। খুব ধীরে প্রশ্ন করল–
সমস্যা জানলে চেষ্টা করব সমাধান করতে। বুঝেছি, কোনো কারণে আজ মন ভালো নেই আপনার। আপনি আমাকে পছন্দ করেন না পিতা, তবু, আমি এখন এই পরিবারের একজন। পরিবারের সুখ সুবিধা দেখা আমার কর্তব্য ।
তুমি কোন সাহসে চার্বাক দর্শণ পাঠ করছ? জানো না? ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে ওই চার্বাক ? কর্কশ স্বরে বলে উঠলেন বরাহ।
পিতা। ব্রাহ্মণ্যবাদ একপেশে। কালের চাপে মলিন। তাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তর্কের সময় এ নয়। আপনি ক্লান্ত। বিশ্রামের সব কিছু প্রস্তুত।
বরাহ ভিতরে ভিতরে অবাক হয়ে গেলেন। ওইটুকু মেয়ের এত ব্যক্তিত্ব? তিনি আর কিছু বললেন না। পুত্র মিহিরকে ইশারায় সঙ্গে আসতে বলে , বিশ্রামকক্ষে চলে গেলেন।
রাত অনেক। গৃহ ঘুমন্ত। খনা জেগে আছে। নক্ষত্র গণনার জটিল সমস্যা সমাধান করছে। বরাহের কক্ষ থেকে বেরিয়ে, মিহির কাতর সুরে খনাকে ঘটনাটা সব বলার পর থেকে, খনা বসে আছে নানা জটিল অঙ্ক নিয়ে। মিহির ,সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল। খনাই বারণ করল। আগামীকাল রাজসভায় প্রথমবার যাবে মিহির। রাত্রি জাগরণ উচিত না। মিহিরের কথা মনে পড়তেই বুকের মধ্যে হিল্লোল জেগে উঠল। সেই ছোটবেলা থেকে মিহির, খনার মধ্যেই নিজের আশ্রয় খুঁজে পায়। এটা বোঝে বলেই অগাধ মায়ায় সে আচ্ছন্ন থাকে। নক্ষত্র গণনা করে দিলে, মিহির নবরত্ন সভায় যোগ দিতে পারবে। এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কি আছে? যে ভাবেই হোক, আজ রাতের মধ্যে গণনা শেষ করতেই হবে। রাত কত হবে? অবন্তী নগরে মধ্যরাতেও মহাকালের পুজো হয়। ক্ষীণ হলেও শঙ্খ ঘন্টার আওয়াজ কানে আসে। খনার মনোযোগ ব্যাহত হয়না তাতে। যে কোন কাজের ব্যাপারে,সে স্বভাবতই মনোযোগী এবং বাস্তববাদী। আর আজকের কাজ কঠিনও বটে।
প্রায় উড়তে উড়তে গৃহে ফিরল মিহির। সে সসম্মানে স্থান পেয়েছে সভায়, কারণ অবশ্যই নক্ষত্র গণনার অসামান্য কাজটি।
“ তা কেন স্বামী? ওই কাজটি কঠিন ছিল মানি, কিন্তু তুমি তো কোনো অংশে কম নও। রাজার সভায় তুমি নিজ গুণেই জায়গা করে নেবে।
খনা দৃঢ় স্বরে বলে। নিবিড় আলিঙ্গনে স্ত্রীকে শরীরে মিশিয়ে ফেলে মিহির। গাঢ় চুম্বনে শুষে নেয় খনার দুটি ঠোঁট। আশ্লেষে ডুবে যেতে যেতে খনা ,অস্ফুটে বরাহের কথা বলার চেষ্টা করে। পিতা এখনো রাজসভায়–বলে , খনাকে পাঁজাকোলে তুলে শয়নকক্ষের দিকে নিয়ে যায় মিহির।
পর্ব ৩
————–
মাঘ মাস শেষ হতে চলল। প্রায় একমাস হতে চলল ,খনা অবন্তীপুর এসেছে। মিহির রাজসভায় যাতায়াত শুরু করেছে। ভালোই লাগছে তাঁর। বুধবার দিন রাজসভা বন্ধ থাকে। পিতা পুত্র দুজনেই বাড়িতে। তার ফলে খনার আজ শ্বাস নেবার সময় নেই। দাস দাসী নিয়ে সে ব্যস্ত ,সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে রাতের আহার– খনা বৈচিত্র আর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার বানাতে আগ্রহী। দাসী প্রধানা বল্লভা বেশ অসন্তুষ্ট ,মোটেও ভাল চোখে দেখেনা–তার এতদিনকার রাজপাটে খনার অধিকার। সে মাঝে মাঝেই ঝংকার দিয়ে উঠে বলতে চায় –খনা তো বাপ মা মরা, গুরুগৃহে পালিতা অনাথ এক মেয়ে। সে কি করে জানবে? রন্ধনের হাজার প্রণালী। মিহিরের মার আমল থেকে যা চলে এসেছে ! সে পাল্টাতে চায় সব? এখন ওই এক ফোঁটা মেয়ে বলে কিনা মহিষের দুধের সঙ্গে মাংস আহার করা যাবে না! তিল ভক্ষণ করতে হবে রোজ। হরিদ্রা গ্রহণ করতে হবে খালি পেটে –গজগজ করতে করতে দুই হাত চালিয়ে চালুনী চুপড়ি কাটারি কাঠ দা সব ধুতে থাকে ঘসঘস করে। এখুনি মহারানী এসে এমন গম্ভীর হয়ে দাঁড়াবে ,যে, পিলে চমকে যাবে। রাককসের দেশের মেয়ে বাপু। অন্য দাসীরা কুলকুলিয়ে হাসে। তন্ডুল বাছতে বাছতে সুবর্ণ দাসী বলে—
চিরকাল সমান যায় না কারো। বাড়ির গিন্নী এসে গেলে আর কারো দাপরাপ চলে নাকি?
— গিন্নী? ওরে ও রাককসের মেয়ে। গায়ের বন্ন দেখেছিস? চোখক্ষু জোড়া পাকানো পাকানো।
বল্লভা বামনী ,রান্নার জোগাড় করতে করতে বলে। বয়স্ক স্থূলকায় শরীর নড়তে চড়তে কষ্ট। যদিও গুটিকয়েক তরুণী ব্রাহ্মণ বিধবা আছে সাহায্যের জন্য। এরা সকলেই অকাল বৈধব্যের শিকার। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। বরাহদেবের আশ্রিতা।
—ওমন বল না বল্লভা দিদি। মিহির দাদা শুনলে তোমার গদ্দান নেবে। আর সত্যি কথা বলো তো দিদি–কোমর উঁচু করে, সুবর্ণা বলে–বউমার কথামত নিত্য খাবার খেয়ে আমাদের কবরেজ খরচ তো নেই বললেই চলে। ঠিক কিনা? বিদ্যের জাহাজ -সবার দিকে তাকিয়ে সুবণ্ন বলে
বৌমা আমাদের বিদ্যের জাহাজ ,বুঝলি কিনা? তবু দ্যাখ, সব ত্যাগ দিয়ে শুধুই সংসার করছে।
পাকশালার দিকে দ্রুত পা চালিয়ে আসছিল খনা। দাসীর শেষ কথাটি কানে যেতে থমকে দাঁড়ায়। ধাক্কা লাগে। বিদ্যের জাহাজ হয়ে ,সব কিছু বাদ দিয়ে সংসার করছে–কথাকটি বহন করে আনে গুরুদেবের মুখ, তাঁর বাণী–খনা ,তোমার অধীত বিদ্যা সাধারণ মানুষের জন্য খুব কার্যকরী। সাধারণ মানুষের কল্যাণে এই বিদ্যা প্রয়োগ করা উচিত। হঠাৎ কেমন ক্লান্ত লাগে তাঁর। বাইরের আকাশের দিকে চোখ পড়ে। ঘন মেঘে ঢেকে এসেছে আকাশ। বৃষ্টি এল বলে। উঠোনে কাজ করছিল কিছু মুনিষ । ধান ঝাড়াই বাছাই পর্ব চলছিল। তারা তাড়াতাড়ি ওই গুলোকে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত। একজন চেঁচিয়ে বলল –একে ঠান্ডা তারপরে বৃষ্টি। ‘
খনা ধীরে ধীরে বলল
যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।
কি বলেন গ মা ঠাকুরুন? অবাক স্বরে বলে মুনিষের দল।
এবার ফসল ভালো হবে। মাঘের শেষে বৃষ্টি হলে ফসল ভালো হয় ।
মা , আমাদের তো সমস্যা অনেক। বৃষ্টি, অতি বৃষ্টি , খরা –কখন যে কি হয় মা! ফসল অনেক নষ্ট হয়। আপনি কি পতিককার কিছু জানেন? পুজো আচ্চা?—-সপ্রশ্ন ,সরল চোখে গরিব মানুষগুলো দেখে খনার দিকে। ভাবে, বিদেশী মেয়ে। জানে বুঝি মন্ত্র তন্ত্র।
না গো। পুজো আচ্চা করে চাষ বাসের উন্নতি করতে আমি জানি না। কিন্তু ,এমন কিছু জানি, যাতে তোমরা নিজেরাই প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে ফসল ফলাতে পারবে। তোমরা এসো। গাঁয়ে খবর করো। আমি তোমাদের পাঠ দেব।
কখন যেন মিহির এসে খনার কাঁধে হাত দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে —খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিলে তুমি। এর চেয়ে মহৎ কাজ আর হয়না। আমি আছি সঙ্গে।
স্বামীর দিকে ঘুরে গেল খনা। তীব্র খর চোখে তাকিয়ে বলল
–কাজটা সহজ না মিহির। আমার যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ নেই। দেশের জন্য তা দরকার, তাও জানি। সমস্যা সেখানে নয়। সংঘাত হবে আমার দর্শণ ,আমার বিশ্বাস আর ব্রাহ্মণ্যবাদের ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে। অনুমান ভিত্তিক , অপ্রত্যক্ষ–কোনো কিছুতেই আমার বিশ্বাস নেই ,মিহির। অলৌকিকত্ব ,অলীক তত্ত্ব –দেবতা তুষ্টিতে দেশের উন্নতি –এমন তথ্যে আমি থাকব না। তখন? মিহির , তুমিও যে ব্রাহ্মণ। গোষ্ঠীর উর্ধে গিয়ে কিছুতেই পারবে না আমাকে সমর্থন করতে– এ আমি জানি।
বিস্মিত হয়ে গেল মিহির। সে বড় সরল। বড় হওয়া ইস্তক খনাই তার সঙ্গী। সে তেমন চতুর নয়। তার অবলম্বন প্রয়োজন হয়। সিংহলী সমাজের কোনো দায় তার ছিলনা। সেই সমাজ নিয়ে সে মাথাও ঘামায় নি। কিন্তু ,ভারতবর্ষের চিত্র সম্পুর্ন আলাদা। তার পিতা ব্রাহ্মণ সমাজের পুরোধা। পুরো রাজ্যই ব্রাহ্মণ শাসিত। অনুচ্চারিত এক শৃঙ্খল সমাজের সর্বস্তরে। বিশেষতঃ জাতিভেদ প্রথা বড় কঠোর।
— খনা। ভীত স্বরে মিহির বলে–তুমি ঠিক কি ভাবে ভাবছ বলো ত?
মৃদু মিষ্টি হেসে স্বামীকে ঠেলা মেরে খনা বলে
স্নান করে পরিপাটি হয়ে আছো। এখুনি যদি খিদে পায়- কোথায় পাবো খাদ্য? কিছুই তৈরি হয় নি এখনো। পাকশালে যাই নি এখনো।
মিহির গাঢ় স্বরে বলে– না গেলেই কি নয় ? চলো ,দুজনে বসে কাব্য পাঠ করি ?
খনা খিলখিল করে হেসে উঠে, এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে চুম্বন এঁকে দেয় স্বামীর গালে। মিহির চমকে আরক্ত হয়ে চারিদিক দেখে বোঝে যে, ভয়ের কিছু নেই। সবাই যে যার মত ব্যস্ত, তখন খনার দিকে তাকায়। সে ততক্ষণে পাখির মত উড়ে গেছে পাকশালের দিকে। মন্দিরে শঙ্খধ্বনি শোনা যায় ওই। আচার্য বরাহদেবের পুজো পাঠ সাঙ্গ হল।
খনা ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
পর্ব ৪
——–
অন্ধকার জমাট বাঁধছে ক্রমশ। জোর করে টেনে ধরেও ,চোখ খুলে রাখতে পারছে না। চেতন অচেতনের ঘোরে ডুবে যাচ্ছে সে। গলা শুকিয়ে কাঠ। জল আছে এক কোণায়। পাথরের মত ভারি শরীর, তাকে একচুল নড়ানোর ক্ষমতা নেই খনার। রক্ত মূত্র মেশান তীব্র দুর্গন্ধে ভরা ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে খনা। মাথার চুলগুলি খোলা। একদিকে ফেরানো মুখের পাশে জমাট বেঁধে আছে, রক্ত মেশান লালা। মাথার ভিতর স্নায়ু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক নিকষ কালো গহ্বরের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে সে। মৃত্যু কি তবে আসন্ন? বোধ আর কাজ করছে না। একটু জল ! একটু জল পেলে বড় ভালো হত। মা গো। একটু জল।
খুব নিঃশব্দে যেন বাতাসের চেয়েও হাল্কা , অতি সন্তর্পণে দরজা খুলে কেউ ঢুকল। এক রমণী। ভীত বোঝা যাচ্ছে। হবারই কথা। খনার ঘরে কেউ ঢুকেছে বা তাকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করছে জানাজানি হলে মৃত্যু অনিবার্য। প্রাণ ভয় তুচ্ছ করেই মেয়েটি এসেছে। না এসে পারেনি। সে এক শুদ্রা রমণী। একবার ছোঁয়াচে রোগের শিকার হয়েছিল সে আর তার পরিবার। এমন যখন হয়, প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায় নিচু জাতের মানুষগুলি। গ্রামের বাইরে শুদ্র পরিবার গুলি বেঁচে থাকে দৈব ভরসায়।
নিজ অধীত বিদ্যা নিয়ে,কাজ শুরু করার পরে, নিজের পছন্দমত কিছু নারী পুরুষ নিয়ে খনা একটি দল তৈরি করেছিল। তাদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষিপাঠ দেওয়া, বাড়ির পাশের লতা পাতার গুণ বোঝানো –এ সবের মধ্যে আরো একটি কাজ করত, নিচু অন্ত্যজ শ্রেণীর পাশে দাঁড়ান। কারণ খনা জাত মানত না। খনার চিকিৎসার গুণে ,অদ্ভুত ভাবে সেরে ওঠে এই রমণীর পরিবার। বিশেষতঃ তার শিশু পুত্রটি।
রমণী গুন গুন করে কাঁদছিল। তার মা, ভগবানের মত মাকে মেরে ফেলছে! মরে যাচ্ছে খনা দেবী! অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল সেই মেয়ে। ঘরে লোকের অস্তিত্ব টের পেয়ে নড়ে ওঠে খনার মৃতপ্রায় শরীর। সে একটু জল চায়। কর্তিত জিভ দিয়ে কথা আসেনা। অস্ফুট আওয়াজ কানে যায় মেয়েটির। সে বুঝতে পারে । ঘরের কোণে রাখা জলের পাত্র নিয়ে এসে, পরম মমতায় খনার মাথা নিজের কোলের উপর রেখে , তাঁর শুকনো ঠোঁটে ধীরে ধীরে বুলিয়ে দেয়, ভেজা আঙ্গুল। পরম মমতায় বিন্দু বিন্দু জল ঢুকিয়ে দেয় খনার মুখে। চেতন অচেতনের অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে খনার কানে ভেসে আসে সমুদ্রের কল্লোল। ছবির পর ছবি ভেসে যেতে থাকে। বালিয়াড়ি। উতল লোনা বাতাস। খোলা চুলের শ্যামলী কিশোরী, গৌরবর্ণ কিশোর– ছুটে যাচ্ছে হাত ধরাধরি করে। পায়ের ধাক্কায় শিউরে উঠছে জল। হঠাৎ যন্ত্রনায় বসে পড়ল কিশোর। পায়ে ঝিনুকের টুকরো ঢুকেছে। লোনা জল লেগে আরো জ্বালা করছে ক্ষতস্থান। কিশোরী অনায়াসে পাঁজাকোলা করে তুলে ফেলে ,পাতলা চেহারার ,মেয়েলী গড়নের কিশোরকে। নারকেল গাছের ছায়ায় বসিয়ে, পরনের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে বেঁধে দেয় ক্ষতস্থান। মাথা নিচু করে ,পায়ের উপর ফুঁ দিতে থাকে। কিশোরটি বলে –খনা । তুমি ছাড়া কেউ নেই আমার।
উত্তরে অনাবিল হেসে খনা বলে –আমি আছি মিহির। আমি আছি। তুমিও থেকো।’
গতপরশু মিহির ,একহাতে তাঁর জিভ টেনে ধরে অন্য হাতে ধারাল ছুরি দিয়ে, কচকচ করে কেটে দিল। পাশে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছিল শ্বশুর। যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতেও সে অবাক চোখে মিহিরকে দেখছিল। সে ই কিশোর প্রেমিক ? সে আজ এত্ত বড় হয়ে গেল! কখন হল? দেশের মানুষের কাজে এত ব্যস্ত ছিল খনা, যে টেরই পেল না –মিহির দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ।
টের যদি পেতে তবে কি করতে তুমি খনা? দূর থেকে প্রশ্ন ভেসে আসে –কি করতে তুমি খনা দেবী? আপামর জনসাধারণের ভরসার ,প্রেরণার , উৎসাহের একমাত্র জায়গা তাদের খনা মায়ের প্রবচন –যার মধ্যে লুকিয়ে থাকত –সমাধান। দারিদ্রতার সমাধান, জাত পাতের শোষণ থেকে রক্ষা, ব্রাহ্মণদের চাপিয়ে দেওয়া উটকো নিয়ম থেকে পরিত্রাণ– সব কিছুই তো লুকিয়ে থাকত তোমার প্রবচনের মধ্যে। পরিবারের সুখ শান্তির জন্য , বন্ধ করে দিতে প্রবচন? ছেড়ে দিতে দেশের অসহায় মানুষগুলোকে ?
পর্ব ৫
———-
“মিহির। তোমাকে কেন ডেকেছি জানো?
–’কারণ জানানোর প্রয়োজন নেই পিতা। আপনি ডেকেছেন, এই টুকুই যথেষ্ট।
—বৎস। এই খানে বসো একটু। আমার কাছে। এই উদ্যান তোমার মায়ের হাতে তৈরি। ওই যে দেখছো, এক চিরহরিৎ গাছ ,যার নীচে বাঁধানো মর্মর বেদী, সেখানে বসে থাকতাম আমরা দুজন। তখন তিনি তোমাকে গর্ভে ধারণ করে আছেন। সে বড় সুখের সময়—আর্ত বিষাদ ঝরে পড়ল বরাহের কণ্ঠে।
বিচলিত হয়ে উঠল মিহির। দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হয়ে গেল পিতার সঙ্গে সে আছে। যতটুকু বুঝেছে, অতন্ত্য শক্ত মনের মানুষ তাঁর পিতা। খনার ভাষায় কুটিল। না , সে নিজের পিতাকে কুটিল বলতে পারবে না। সে কোনো প্যাঁচের কথা বলতে শুনতে পছন্দ করে না। আসলে সে একটু একলা থাকা পছন্দ করে। নির্জনে বসে গান শোনা, কবিতা লেখা–এগুলো তাঁর প্রিয়, অথচ তাঁকে করে যেতে হয় কঠিন কঠিন অঙ্ক ! আজকাল খনা আর পিতা প্রায়শঃই বিবাদ করে। ভালো লাগে না তাঁর।
সে পিতাকে অনুরোধের সুরে বলে:
পিতা। খনাকে ভুল বুঝবেন না। সে আপনাকে অসীম শ্রদ্ধা করে। সে আপনার ভক্ত। আপনার প্রতিটি বই তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়া।
বরাহ স্নেহের হাত ছোঁয়ালেন মিহিরের শরীরে :
— বৎস। আমি বড় একলা হয়ে পড়েছিলাম। তুমি এসে সেই একাকীত্ব ঘোচালে।
–পিতা। আপনি ব্যাকুল হবেন না। আমি তো আছি।
মাথা নিচু করে ,উদ্যানের একটি আসনে বসে ছিলেন বরাহ। গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন। ছায়াঘন উদ্যানে গরম নেই। বরং ঝিরঝির হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। তারা বসে আছে দেখে, দাসী কাংস পাত্রে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে এসে হাজির করল। সঙ্গে কারুকার্য করা পাত্রে , টাটকা ফলের টুকরো।
এমন সময় এক শকট এসে দাঁড়ায় বরাহের গৃহের সামনে। দাসী তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে বরাহ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান তিনি। সসঙ্কোচে দাসী বলে
খনা মা বাইরে যাচ্ছেন। ম্লেচ্ছ পাড়ায়।
পানীয়ের পাত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ওঠেন বরাহ
ম্লেচ্ছ পাড়ায়? নিজাম পুর? এত সাহস খনার? মিহির, দেখো, দেখো –কাকে তুমি বিবাহ করেছ? এবার বুঝেছ? আমার কষ্ট কোথায়?
বলতে বলতেই দেখলেন ,অনুচর পরিবৃত , মাথায় কাপড়ের পাগড়ি বাঁধা, দীপ্ত ভঙ্গিতে খনা বেরিয়ে আসছে ভিতরের মহল থেকে। পিতা পুত্রকে দেখে অভিবাদন করে নিমেষেই আবার বেরিয়ে গিয়ে শকটে উঠে পড়ল সে।
ক্রোধে আগুনের মত জ্বলতে লাগলেন বরাহ। মিহির ভয় পেয়ে গেল। বয়স হয়েছে পিতার। কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে যায়। সে কাতর কণ্ঠে বলল
শান্ত হন পিতা, শান্ত হন।
–পুত্র মিহির। তুমি জানো, খনার এই ঔদ্ধত্বের পিছনে কে আছেন? স্বয়ং মহারাজ হর্ষ বিক্রমাদিত্য ! দিন দিন লোকের কাছে হেয় হতে হচ্ছে আমাকে, ওই রাজার প্রশ্রয় তার কারণ।’
সভয়ে পিতার মুখে হাত চাপা দেয় মিহির। দেয়ালেরও কান আছে। পিতার এখন হিতাহিত জ্ঞান নেই। প্রকাশ্যে রাজাকে দোষারোপ করা, রাজদ্রোহের নামান্তর।
পিতা শান্ত হন। চারিদিকে রাজার লোক। আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তুমি ঠিকই বলেছ মিহির –নিজের শ্রান্ত শরীরকে এলিয়ে দিলেন গাছের গুঁড়ির গায়ে —
“ আমি জানি পুত্র। খনাকে তুমি অতন্ত্য ভালোবাসো। দেখো, বিদেশি মেয়ে। আমি তো কোনো আপত্তি করিনি। কিন্তু আজ কি দাঁড়িয়েছে। রাজসভায় কেবল খনা খনা আর খনা। আমাদের দুজনের কোনো মূল্য নেই?
—পিতা। আমাদের বিষয় আলাদা। আপনি এভাবে কেন ভাবছেন না? খনা কৃষিবিজ্ঞান আত্মস্থ করেছে। তাই তাঁর কাজের উপযোগিতা বেশি।
—থামো । দেশের মানুষকে চার্বাক দর্শনে শিক্ষিত করছে সে। আর অনুসরণ করবে ব্রাহ্মণদের? পুজো পাঠ শিকেয় তুলে নাচবে সবাই। শোনো, আমি এক গোপণ মন্ত্রণাসভা ডেকেছি। সমাজের মাথা কয়েক জন ব্রাহ্মণ সেখানে থাকবে। রাজা কখনো দেশের বিধাতা হতে পারেন না।
–কি করতে চলেছেন পিতা?’ সভয়ে প্রশ্ন করল মিহির।
দেখতেই পাবে। ক্রুর হেসে বললেন বরাহ –আমার সঙ্গে বিরোধিতার ফল পাবে ওই মূঢ় নারী।
—,পিতা ,পিতা– কাতর হয়ে জমিতে পিতার পায়ের কাছে বসে পড়ল মিহির–খনা কখনো আপনার বিরুদ্ধে যায় নি। সে একটা আদর্শের জন্য লড়াই করছে। পিতা ,একবার গভীর ভাবে ভাবুন। ‘
—তুমি ভাবো। নির্বোধ। শুনে রাখো, মহারাজ আগামী বৎসর খনাকে একাদশ রত্ন উপাধিতে ভূষিত করতে চলেছেন। দশম রত্ন হবে সে। আর আমার পুত্র? সে বসে বসে দেখবে? –সাপের মত হিসহিস করে বরাহ বললেন
তোমাকে আমার পরিকল্পনার সঙ্গে থাকতেই হবে পুত্র। নতুবা আমি আত্মহত্যা করবো। উত্তেজিত বরাহের দিকে তাকিয়ে ভয় করতে লাগল মিহিরের। যেন এক সর্বগ্রাসী ঈর্ষার আগুন খেলা করছে তাঁর সর্ব অঙ্গে। সে ভাবল, খনাকে গিয়ে সাবধান করে আসে। কোথায় গেছে সে? নিজামপুর?
খনা : এক স্বপ্ন
————————
আদিগন্ত সবুজ মাঠ। লালে লাল শিমুল পলাশ। নীল আকাশ। বসন্ত অকৃপণ। সযাহ্ন তিন প্রহর। মাঠ জুড়ে বসে আছে অগুনতি খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের চোখে মুখে উৎসাহ, উদ্দীপনা, আনন্দ। উৎসুক চোখে বার বার দেখছে রাস্তার দিকে। চৈত্রের ধুলো উড়িয়ে খনার শকট এসে দাঁড়ান মাত্র জয়ধ্বনি উঠল গগনভেদী। কিছু পরে এসে দাঁড়াল আরো দুটি রাজকীয় রথ। তার মধ্যে থেকে নামলেন কিছু সম্ভ্রান্ত রাজপ্রতিনিধি। স্মিত হেসে খনা তাদের অভিবাদন করলে , তারাও প্রত্যাভিবাদন করে বলল
রাজ আজ্ঞায় আমরা সবসময় আপনার সঙ্গে আছি। অর্থ থেকে শুরু করে অন্য যা কিছু সহযোগিতা আপনার চাই , বলবেন।’
খনা বলল
আপাতত আমার কিছুই প্রয়োজন নেই। কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ওই দেখুন, আমার লোকেরা ছোট ছোট পাত্রে বীজ ধরে দিচ্ছে, কৃষকদের হাতে। সহজে ফসল ফলানো কি করে সম্ভব –বলতে বলতে নেমে গেলেন খনা ওই মানুষদের মধ্যে–
পূর্ব আষাঢ়ে দক্ষিণা বয়
সেই বৎসর বন্যা হয়।
পাঁচ রবি মাসে পায়
ঝরা কিংবা খরায় যায়।
শুন শুন কৃষক গণ
হাল লয়ে মাঠে বেরুবে যখন।
শুভ দেখে করবে যাত্রা
না শুনে কানে অশুভ বার্তা
ক্ষেতে গিয়ে করো দিক নিরূপণ
পূর্ব দিক হতে হাল চালন
নাহিক সংশয় হবে ফলন।
রাজপুরুষরা মুগধ হয়ে দেখছিল সেই অদ্ভুত দৃশ্য। হলুদ শাড়ি পরনে, লাল একটা কাপড় পাগড়ির মত মাথায় বাঁধা, শ্যামলা চেহারার নাতিদীর্ঘ মেয়েটি , মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যেন ভেসে ভেসে ,উড়ে উড়ে অনায়াসে চলা ফেরা করে বেড়াচ্ছে। মাঠ জুড়ে গর্জন উঠছে মানুষের। আশায় ভরসায় ভরে উঠছে তাদের কালো কালো ঝুঁকে পড়া শরীর।
‘ ভালো করে দেখ , মহারাজকে গিয়ে সব জানাতে হবে। –অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষটি বললেন।
‘ একটা খটকা লাগছে অমাত্য মশাই। সাহস করে বলি আপনাকে ?
–, বলো ,বলেই ফেল, যদি রাজদ্রোহী কোনো কথা না হয় ,তবে বলতেই পারো। হাসতে হাসতে বললেন বাসুদেব।
এনাদের জন্য সুখাসন পাতা আছে পিপ্পল গাছের নিচে। পরিবেশিত হচ্ছে , তেঁতুল আর পুদিনা পাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ পানীয়। যা ক্ষুধার উদ্রেক করে। নিদ্রা গভীর করে।
—’ বলছিলাম যে, খনা দেবী ,ঈশ্বর মানেন না, তবু মহারাজ রাগ করেন না। কেন? আর এই মাত্র যে শ্লোকটি উনি বললেন, তাতে এক শুভ শক্তির কথা আছে–ওটাই কি ঈশ্বর? তবে তো বলতে হয়, উনি দুরকম কথা বলছেন। ‘ কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়ে অল্পবয়স্ক রাজকর্মচারী বলে। সে নতুন ঢুকেছে কাজে। কিন্তু, শারীরিক প্রশিক্ষণের বিশেষ যোগ্যতা থাকায়, উচ্চপদস্থদের আস্থা অর্জন বেশ তাড়াতাড়ি করেছে।
–ওহে, খনা দেবীর বচন তুমি আগে কখনো শোনো নি বুঝি? এই প্রথম? তাই এত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা। দাঁড়াও, গুছিয়ে বসি একটু। সাদা ধপধপে পাশাক,মোটা গোঁফ, স্বাস্থ্যবান চেহারার বাসুদেব, পানীয়তে দীর্ঘ চুমুক দেন। তারপর আমুদে গলায় বলেন–
শুভ বলতে উনি বলেন নিজের ভিতরের ভালো ভালো দিক গুলি জাগাতে হবে। তবে অনেক কঠিন কাজও সহজ হয়ে যাবে। উনি বলেন যে, মানুষের মধ্যেই শুভ অশুভ দুই ই আছে। বুঝলে কিছু?
বিমূঢ় মাথা নাড়ে ছোট জন। বোঝে নি। ওদিকে মাঠের মধ্যে আনন্দের ফোয়ারা ছুটছে। প্রশ্নোত্তরের পালা চলছে, চলছে মাটিকে জানার চেনার প্রচেষ্টা। পাথুরে জমি। সেই মাটি থেকে কি করে, কি ধরণের ফসল ফলানো যায় দেখাচ্ছে খনা, সাধারণ চাষি শ্রেণীর লোক অতি উৎসাহে শিখছে ছোট ছোট জিনিষ–যা এতদিন তাদের সমস্যা দিত, তাই আজ সহজ মনে হচ্ছে। চারিদিকে এক আনন্দের পরিবেশ। খনা বলছে—
চৈত্রে দিয়া মাটি
বৈশাখে করো পরিপাটি।।
বাঁশের ধারে হলুদ দিলে
খনা বলে দ্বিগুন বাড়ে।।
শুনরে বাপু চাষার ব্যাটা
মাটির মধ্যে বেলে যেটা।
তাতে যদি বুনিস পটল
তাতে তোর আশায় সফল
সুপারিতে গোবর ,বাঁশে মাটি
অফলা নারিকেল শিকর কাটি।
বুঝলে গ–সুপারি গাছের মূলে গোবর ও বাঁশের গোড়ায় মাটি দেবে। নারিকেল গাছে যদি ফল না ধরে, তবে ,তার কিছু শিকড় কেটে দিতে হবে। পূর্ণিমা অমাবস্যায় হাল ধরবে না গ। চাষ ভালো হবে না। বলদের বাত হবে। তোমার অভাব বাড়বে।
— দেখেছ, দেখেছ –বাসুদেব তারিফের ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন –কত কঠিন তত্ত্ব, কত সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছে খনা দেবী। দেশের ,দশের কত উপকার করছে। তবু চারিদিকে অজগর সাপের ফনা দোলে। শত্তুরের জাল ঘিরে ধরতে চায়। –আফসোসে মাথা ঝুঁকে আসে। ছোট অমাত্য ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে কাছে সরে আসে
—এমন নাকি ? কেন এমন?
— অনেক কারণ ,অনেক। জাত পাত, ধর্ম –এই সবের ঝুঁটি ধরে নাড়া দিলে কেউ ছেড়ে দেবে। আরো একটা বড় কারণ ,খনা নিজেই।
—কেন কেন কেন?
—আরে–সস্নেহে অমাত্য মশাই বলেন–খনা যে নারী। এক নারী ,তাতে বাড়ির বউ–সে আজ হয়ে উঠছে দেশের প্রধান ভরসা– প্রাণ পুড়বে না?
—বুঝেছি। সেই জন্য খনাদেবীর সব সভাতেই মহারাজ লোক পাহারা রাখেন।
—মহারাজের চেষ্টার ত্রুটি নেই গো। তিনি জহুরী। রত্নের কদর জানেন। বাইরের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করবেন কিন্তু ঘর? সেখানে যে ঈর্ষার আগুন জ্বলছে, মহারাজ সেখানে কি করবেন? কেমন দুঃখ ঝরে পড়ে বাসুদেবের কথায়। অভিজ্ঞ ব্যক্তি তিনি। দুনিয়া চেনেন। বহুদিন ধরে দেখছেন বরাহদেবকে। সহজ মানুষ নন। আপন মনে মাথা নাড়েন বাসুদেব। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ,পিপ্পল গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলোর দিকে তাকান। বেলা পড়ে এসেছে। এখনই শেষ হবে খনার সভা। এর মধ্যে গরিব কৃষকদের মধ্যে, বিনা মূল্যে বীজ ধান, অন্যান্য শস্যর বীজ, সুস্বাদু পুষ্টিকর খাদ্যের মোড়ক –বিতরণ করা শেষ। এই ব্যয়ভার রাজাই বহন করে থাকেন। মাঠ জুড়ে আনন্দ কোলাহল চলছে, বিদায় বেলায় হুড়মুড় করে খনার শকটের কাছে পৌঁছুতে চায়। স্মিত হাসি, জোড় হাত, দীপ্ত মুখের খনার দিকে তাকিয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বাসুদেব তাড়া দেন অনুচরকে
—চলো হে, ওঠা যাক। মহারাজ অপেক্ষা করছেন খবরের জন্য। তবে আজ এক উপলদ্ধি হল ,বুঝলে হে–ছোট অমাত্যের কৌতূহলী মুখের দিকে তাকিয়ে, গাঢ় স্বরে বাসুদেব বলেন–
নারীর উন্নতি পুরুষের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। বরাহদেব শুধু নন, আমরাও পারব না। নারীর লড়াই চলতেই থাকবে যুগ যুগ ধরে।
প্রেমে আর সংঘাতে জীবনের পরাজয়
———————————————;——
আনন্দ ভাগ করলে বাড়ে, দুঃখ ভাগ করলে কমে–দুঃখ তবু চেপে রাখা যায়, কিন্তু আনন্দ উপচে পড়বেই। খনার মন আজ আনন্দে ভরপুর। তাঁর কাজ খুব সুন্দর করে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজ যখন আনন্দ থেকে হয়, কাজ যখন অপরের স্বার্থ রক্ষার জন্য হয় — তখন তাকে বলা হয় সাধনা। খনা এখন সাধনায় নিমগ্ন। সারা দিন রোদে ঘুরে ঘুরে পরিশ্রম করেও ক্লান্তি নেই। গৃহের দিকে নজর এখন তাঁর অল্প। কুশলী দাসী আছে। ঘরকন্নার নেশা কেটে গেছে। গভীর রাত পর্যন্ত , নিজের ঘরে বসে অধ্যয়ন করতে থাকে। আরো সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম তত্ত্ব, মানুষের মনের গভীর গোপন রহস্য– ছোট ছোট কাঁটা ঘিরে আছে মনকে, অহংকারের , লোভের , হিংসার , দুর্বলতার কাঁটা–যার ফলে শান্তি সুখ নষ্ট হয়, খনা সেই খানে আলো ফেলার চেষ্টা করে।
আজকেও দীপের প্রজ্জ্বলিত শিখার সামনে বসে নরনারীর যৌন সম্পর্কের উপর কতগুলি প্রবচন লিখছিল সে। এমন সময় ঘরে এক দীর্ঘ ছায়া পড়ল। মিহির। খনা চোখ তুলে তাকাল। মিহির! তাঁর স্বামী, তাঁর প্রিয়তম, তাঁর আবাল্য সঙ্গী। আহঃ। কতদিন ভালো করে দেখা হয় নি দুজনের! মিহিরকে বড় ক্লান্ত লাগছে যেন? মুহূর্ত যেন অনন্ত। দুজোড়া চোখ নিবদ্ধ হয়ে রইল পরস্পরের দিকে চুম্বকের মত। খনা সরিয়ে রাখল পুঁথি। আসন থেকে উঠে এগিয়ে গেল মিহিরের দিকে। মুগ্ধ চোখে দেখল পুরুষ শরীর। স্নান করে , সাদা ধুতি পরেছে সে, উর্ধাঙ্গ অনাবৃত, শুধু উপবিত ঘিরে আছে খোলা বক্ষদেশ। গৌরবর্ণ বক্ষদেশ, অল্প কয়েকটি লালচে রোম, সুকুমার মুখে বড় বড় দুটি চোখ, ভেজা চুল পাতলা লাল ঠোঁট—খনার মনে হল—বহুদিন ধরে সে তৃষ্ণার্ত। বুক জ্বলে যায়। চোখ শুষ্ক। খনার মাথার কোঁকড়া চুলগুলি সাপের ফনার মত দুলে দুলে উঠল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে । বাম হাতে নিজের উর্ধাঙ্গের বসন টান মেরে খুলে, ডান হাতে সবলে আকর্ষণ করল মিহিরকে।
মিহিরের ঘর সংলগ্ন খোলা ছাদ ভরা ফুলের গাছে। ছোট ছোট চিত্র বিচিত্র পাথরের টুকরো দিয়ে গাঁথা সারা জায়গায়, যার উপরে চাঁদের আলো পড়ে এক মায়াময় ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। খনা দুইহাতের অঞ্জলিতে মিহিরের মুখখানি ধরে নিবিড় চুম্বনে ভরিয়ে দিল।
রতিক্রিয়া খনার সহজাত। তাদের সমাজ শরীরের চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়। এই ব্যাপারে তাদের কোনো সংকোচ নেই। ভারতে এসে খনা অবাক হয়ে দেখছে , শরীর কামনা করা যেন অপরাধ। এই স্বাভাবিক চাহিদাকে বন্ধ করবার নানা উপায় কানুন বার করতেই ব্যস্ত এরা। খনা এসব মানে নি কোনোদিন। মিহিরের সঙ্গে তাঁর যৌন জীবন খুব স্বাভাবিক আর স্বচ্ছন্দ। এই সব সময়ে অগ্রণী ভূমিকা তাঁরই হয়।
মিহিরের শরীর জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। আধো অন্ধকারে ,খনার পিছলে যাওয়া তামাটে শরীর, খোলা কোঁকড়া চুলের নিচে ,গলার কাছে ছোট্ট কালো তিল, চিবুকের ঢেউ –সমস্ত শরীর যেন জীবন্ত প্রকৃতি। সিংহীর মত চলন এখন। মিহির শক্ত করে চেপে ধরে খনাকে। দুজনের ঘন নিঃশ্বাসে ঝড় বইতে থাকে। শীৎকার ধ্বনির আঃ আঃ শব্দ পাতাল ভেদ করে। খোলা ছাদে, উতল বাতাস আর পূর্ণিমার জোছনায় ,তারা ভেসে বেড়াতে লাগল কখনো মরাল মরালির মত, কখনো সাপের মত, কখনো হিংস্র চিতাবাঘের মত। জলের মত মসৃণ গতিতে বয়ে চলল সময়। শ্রান্ত শরীর দুটি এক সময় পরস্পরকে শিশুর মত আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল।
দূর থেকে জল কল্লোলের শব্দ শুনতে পেল খনা। সমুদ্র জেগেছে। ধেয়ে আসছে বিশাল ঢেউ। পাহাড়ের মত ঢেউ গুলি আছড়ে পড়ছে লোকালয়ের উপর। ভেসে যাচ্ছে, মানুষের আশ্রয় , স্বপ্ন , আনন্দ, দুঃখ —সব তলিয়ে যাচ্ছে মহা প্রলয়ের কোলে — মিহির কোথায় গেল? মিহির? তাঁর কাছেই তো ছিল! গেল কোথায়? তাঁর প্রথমেই মনে হল, মিহির সাঁতার শেখেনি। জল ভয় পায়। আতঙ্কে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল খনা–মিহির। মিহির। মিহির।
ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে জেগে উঠে দেখল, মিহির তাঁকে দুই হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে–কি হল? কি হল? এই ত আমি।
দুঃস্বপ্ন ছিল ভাগ্যিস। বড় এক শ্বাস ফেলে, মিহিরকে জড়িয়ে বলল খনা
কিছু না গো। আচ্ছা, এখন রাত্রি কত প্রহর?
–রাত প্রায় শেষ হতে চলেছে। তুমি এমন ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলে? সাধারণত তোমার ঘুম তো গভীর।
সত্যিই তাই। কিন্তু কয়েক দিন ধরে মন বড় উচাটন। কোথায় যেন ছন্দ ভুল হচ্ছে জীবনের। সকাল থেকে রাত– যেমন চলবার কথা, তাই ই চলছে—কিন্তু –খনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাঁকে সংকেত পাঠাচ্ছে সাবধান হবার জন্য। তবে এ সব কিছুই সে মিহিরকে বলবে না। মিহির এত গভীর ভাবে ভাবে না। সে শুধু গাঢ় আলিঙ্গন করে বলল
থাক। ওসব থাক। তুমি আমায় এমনি করে ভালোবাসবে তো মিহির?
—খনা। আমার সব কিছু তোমাকে ঘিরে। তোমাকে ছাড়া জীবন কিসের? কিন্তু,,,–দ্বিধাবোধ করে মিহির।
—আবার কিন্তু? কি হয়েছে?’
পরম স্নেহে খনার নগ্ন শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মিহির বলে—
খনা ,আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি। বলতে গেলে তুমিই আমাকে পালন করেছ। সব কাজে তুমি এতই পারদর্শী যে, তোমাকে উপদেশ দেওয়া ধৃষ্টতা বলে মনে করি।
—মিহির। তুমি আমাকে দেখো তোমার ভালোবাসার চোখ দিয়ে। ভালোবাসার চোখ হয় অন্ধ। তখনও যখন কিন্তু জেগেছে মনে, তার মানে কিছু এমন ঘটেছে, যা নিয়ে তুমি ভাবিত।
খনার বক্ষদেশ এখন শিথিল। তবু তার কত আকর্ষণ। মিহির জোর করে চোখ সরিয়ে নেয়। ঘন বাহুপাশে প্রিয়াকে বেঁধে ফেলে। খনা তাকে শিখিয়েছে, নারী পুরুষের সংযুক্ত রতিক্রিয়ায় উভয়ের চরম আনন্দ উল্লাস ,শরীর ও মনের জন্য প্রয়োজন। কাম দমন করা অপরাধ। অবদমিত কাম, মানুষকে হিংস্র করে তোলে।
খনা নাড়া দেয় মিহিরকে–কি হল? বলো?
সচকিত মিহির বলে—তুমি কিছু আন্দাজ করতে পারো না? তোমার উপরে পিতা বিরক্ত। তিনি অসন্তুষ্ট।
—কারণ? গম্ভীর কণ্ঠে খনা বলে।
—-খনা! মিনতি ঝরে পড়ে মিহিরের গলায়
তুমি খুব ভালো করেই জানো কারণ। তবু তুমি না জানার ভান করছ!”
—ভান! আমি ভান করতে জানি না। কারণ আমি আন্দাজ করতে পারি বইকি। কিন্তু এখন তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’
—তুমি রেগে যাচ্ছ। অসহিষ্ণু গলায় বলে মিহির।
— রেগে আমি যাই না। ভান আমি জানি না। তুমি আসল কথায় এস। কারণ ঠিক কি?”
—-খনা, তুমি জানো, আমরা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবার ।
–আমরা?
–হ্যাঁ আমরা। আমি এবং তুমিও। আমার স্ত্রী হিসেবে তুমিও তাই। ব্রাহ্মণ শুদ্র যাই হোক, প্রত্যেক পরিবারের নিয়ম কানুন থাকে। সেই নিয়ম মেনে চললে পরিবার সুশৃঙ্খল থাকে। তুমি সেটা বোঝনা? আমি তোমাকে সতর্ক করতে এসেছি খনা।
—সতর্ক করতে এসেছ? কেন মিহির?
—-’এটা কোনো প্রশ্ন হল? আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই।’ মিহির অবাক গলায় বলে।
—ভালোবাসা? মিহির, ভালোবাসা? তুমি তো ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিনিধির মত কথা বলছো? আমার আদর্শ থেকে আমাকে সরে যেতে বলছো। ভালোবাসা তো একে বলে না মিহির!”
—-আহ খনা। ভালো করে শোনো কথা। তোমার ঐ অনমনীয় মনোভাবের দরজা দূরে ঠেলে দিয়ে বোঝ বিষয়টা। তুমি যে রাস্তায় চলেছ, তাতে এক শ্রেণীকে তুমি শত্রু বানিয়ে তুলছ!
— কাউকে শত্রু বানাবার মত কাজ আমি কি করছি ? মিহির? তুমিই তো বললে ,নিজের অধীত বিদ্যা দেশের কাজে লাগাতে? তবে?
—-স্বীকার করছি ,বলেছিলাম। কিন্তু ,তুমি যে যেভাবে জাত পাত ঠেলে সরিয়ে , ব্রাহ্মণ শুদ্র একাকার করে দিচ্ছ, ম্লেচ্ছ পাড়াতেও যাচ্ছ, এ আমি সমর্থন কি করে করি ? তুমি বলো? আমার পিতার সম্মান নষ্ট হচ্ছে এতে!”
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল খনা। কথা বলতে প্রবৃত্তি হয়না। তবু কিছু অন্ধকার আজ দূর করা ভালো। সে কঠিন স্বরে বলল
—সমুদ্রে ভাসমান তোমার জাত ধর্ম তখন ছিল কি? মিহির শোনো–জাত বা ধর্ম মনুষ্য সৃষ্ট। যা দেখা যায়না, আমি তাতে বিশ্বাস করি না। মানুষের এত কষ্ট ,এত দুঃখ, মহামারী ,বন্যা, খরা—ঈশ্বর কোথায়? কোথায় ঈশ্বর? ঈশ্বর শুধু সাজানো পুতুল হয়ে বসে আছেন মন্দিরে?
—-খনা। খনা। চুপ করো। চুপ করো। সভয়ে মিহির বলে। বাস্তবিক সে ভয় পেয়েছে। ছোট থেকে খনা কে চেনে। সে সহজে কথা শুনবে না, তা বোঝা উচিত ছিল। আসলে ,পিতার ওই হিংস্র কঠোর মুখ–মনে হয়েছিল–খনা বিপদে পড়তে পারে। নিজের উপর বিরক্ত বোধ করল মিহির। যা খুশি হোক। সে আর কিছু করবে না।
—-আর তোমার পিতা? খনা গম্ভীর স্বরে বলল
তিনি আমাকে ঈর্ষা করেন। ভুলে যেওনা, মানুষের মন পড়তে পারি আমি। ঈর্ষা থেকেই উনি চান, আমি ঘর বন্দী হয়ে থাকি।
—খনা! স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে চিৎকার করে উঠল মিহির
—ভুলে যেওনা ,উনি আমার পিতা। উনি পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী। ভুলে যেওনা এ কথা!”
—-মিহির ! ক্লান্ত স্বরে খনা বলল–কিছুই ভুলিনি। ইচ্ছেমত ভুলতে পারলে ভাল হত। স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচে বলেই, মানুষ এত কষ্ট পায়। তবে শুনে রাখ, আমি যে দর্শনে বিশ্বাস করি, তাতে মানুষ নিজেই নিজের ঈশ্বর। ওই আচার বিচারের হাতের পুতুল আমি হবো না।
— এই অহংকার তোমার সর্বনাশ ডেকে আনবে , এই আমি বলে রাখলাম খনা। পিতা ঠিক ই বলেন
মহারাজের প্রশ্রয় পেয়ে এত বাড় বেড়েছ তুমি। ঠিক আছে। যা খুশি করো।” ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল মিহির।
ভোরের আলো সবেমাত্র ফুটছে। অল্প মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে। খনার কেমন শীত করতে লাগল। তাঁর শরীরে বসন ঠিক মত নেই। প্রতিদিন ভোরে কপালে এক চুম্বন এঁকে দেয় মিহির। স্থলিত বসন ঠিক করে দেয়। কেমন একলা বোধ হতে লাগল। বাতাসে তখনও মিহিরের গায়ের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। খনা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল। আজ দ্বিপ্রহরে মহারাজ হর্ষ বিক্রমাদিত্য দেখা করতে বলেছেন। কাজের ব্যাপারে কথা হবে। কিছু অর্থ প্রয়োজন। মহারাজ লোক পাঠাবেন তাঁকে নিয়ে যেতে। খনা প্রথম যাবে রাজসভায়। এ নিয়েও বিতর্ক হবে, বোঝা যাচ্ছে। শ্বাস ফেলল খনা–মনকে তার পবিত্র অকৃত্রিম আনন্দময় অবস্থায় রাখা যে কত কঠিন কাজ, তা সে প্রতিমুহূর্তে টের পাচ্ছে।
বাসুদেব ও খনা
————————
“ আচার্যা খনা, রাজসভায় আপনাকে নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমি পেয়ে ,ধন্য মনে করছি।’
–”এমন কেন বলছেন? বরং প্রয়োজনীয় কাজ ছেড়ে আপনি এসেছেন ,মহারাজ এত ভেট,উপহার পাঠিয়েছেন, সোনার রথ পাঠিয়েছেন –আমি কি যোগ্য?
— সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই, হে খনা। মহারাজ আপনার সব খবর রাখে। আপনার প্রত্যেক সভায় আমার উপস্থিতি এই কারণেই।
— আমি কৃতজ্ঞ। আমার এই সামান্য কাজ মহারাজকে খুশি করতে পেরেছে জেনে সত্যি আনন্দিত।
— আচার্যা খনা,,যত আপনাকে দেখছি, তত বিস্মিত হচ্ছি। উজ্জয়িনীতে জ্যোতিষ চর্চা, পূজা পাঠ, যাগ যজ্ঞ বহুল প্রচলিত। আপনি তো নিজেও জ্যোতিষ, অথচ শুনেছি , আচার বিচার, তাবিজ মাদুলি, যাগ যজ্ঞ– এসবের কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে? আপনি ভাগ্যও মানেন না?
—যা দেখা যায়না ,আমি তা মানি না। ভাগ্য মানি। কিন্তু কর্মকে তার চেয়ে বড় মানি। কর্মের ফল মিলবে এই জন্মেই। আগের জন্ম বা পরের জন্মে নয়।
—আচার্যা খনা! যত দেখছি তত বিস্মিত হচ্ছি।
—’ কেবল খনা বলে ডাকলেও হয়, বাসুদেব। অনেক দিন ধরে একসঙ্গে পথ চলছি। আমরা বন্ধু।
মৃদু হাস্যে মাথা নাড়লেন বাসুদেব —
বয়সে ছোট হলেও, সম্মানে আপনি অনেক উঁচু মাপের মানুষ ,খনা।
—বয়স, সম্মান–এই গুলি বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে কোনো মানে রাখে না। চিন্তনের মিল ঘটায় প্রকৃত বন্ধুত্ব। আমার মেধাকে, চিন্তনকে আমি ভাগ করতে পারি আপনার সঙ্গে। আপনি আমার বন্ধু, বাসুদেব।
শিহরিত হলেন প্রৌঢ় অমাত্য। নারী এমন হয়? এমন ঝকঝকে? এমন স্পষ্ট? তার মনের কথা বুঝেই খনা আবার বলে উঠল–
নারী বিধাতার অমূল্য সৃষ্টি। যেমন পুরুষ। দুজনের সহাবস্থান গড়ে তোলে সুন্দর পৃথিবী। মেধা থেকে শুরু করে শারীরিক ক্ষমতা–নারী কোনো অংশে অক্ষম নয়। তবে?
—তবে? তবে কি খনা?
—তবে কেন এই দূরত্ব বাসুদেব? কেন নারীকে শুধু কামনা মেটাবার যন্ত্র ভাবা হয়? কেন শুধুমাত্র সন্তানজন্মের উৎস ভাবা হয়? কেন ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়? কেন তাকে বন্ধু ভাবা হয় না?
বাসুদেব তাকালেন খনার দিকে। কোন সুদূরে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ। সে কোনো উত্তর আশা করে প্রশ্ন করেনি, জানেন বাসুদেব। আর ,উত্তর তিনি জানেন না। কেউই জানে না।
রাস্তার ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলেছে রক্তবর্ণের অশ্ব বাহিত স্বর্ণ রথ। সারথীর হাতে লাগাম শক্ত করে ধরা। পিছনে আরো দুটি রথে খনার কিছু নিজস্ব লোকজন চলেছে। নিজ আসনে সোজা হয়ে বসে আছে খনা। চুলগুলি উঁচু করে বাঁধা, পরণের কাপড়টি আঁট সাট করে জড়িয়ে আছে নাতিদীর্ঘ সুন্দর শরীরটিকে। সামান্য অলংকার। গভীর কালো টানা দুটি চোখ বুদ্ধি মেধা আত্মবিশ্বাসে জ্বল জ্বল করছে। বাসুদেব লক্ষ্য করলেন , চোখদুটিতে আজ যেন মেঘের ছায়া!
খনার মন ভালো নেই? আবার আঘাত করেছে তাঁর পরিবার? তাই হবে। পুরুষশাসিত সমাজ। এটাই স্বাভাবিক। অথচ কি সুন্দর করে খনা বোঝাল, নারী পুরুষ দুজনে দুজনের পরিপূরক।
কর্কশ শব্দ করে রাজসভার অদূরে, সিংহদুয়ারের সামনে এসে দাঁড়াল রথ। তেজি চঞ্চল ঘোড়া গুলি শান্ত হলে, রথ থেকে আগে নামলেন বাসুদেব। সিংহদুয়ার থেকে সভাগৃহে ঢোকার মূল দরোজাটি পর্যন্ত পথ, ফুলে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। চিত্র বিচিত্র রঙ্গীন রেশমী কাপড়, নিশান উড়ছে বাতাসে। চারিদিকে উৎসবের মহল। রথ ঘিরে দাঁড়িয়েছে সুন্দরী পুরনারীর দল। হাতে সোনার থালায় সুগন্ধী চন্দন, পুষ্প আর অগরু। ঋজু ভঙ্গিতে খনা রথ থেকে নামলেন হাত জোড় করে ,মুখে স্মিত হাসি। পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল খনার উপরে। ছিটানো হতে লাগল অগরু চন্দন। পিছনে আছে সহচর সহচরীর দল। পাশে আছে বাসুদেব। কিন্তু যার থাকার কথা ছিল, যার এই গৌরবে সবচেয়ে বেশি খুশি থাকার কথা ছিল–সেই মিহির সভাগৃহের মধ্যে আঁধার মুখে বসে আছে , পিতা বরাহের সঙ্গে। আসতেই হবে । রাজ আজ্ঞা লঙ্ঘনের উপায় নেই। ঈর্ষার বিষে নীল হওয়া দুটি মুখকে জোর করে ঝেড়ে ফেলে দিল খনা। তারপর মাথা উঁচু করে এগিয়ে গেল মূল সভা মণ্ডপের দিকে। পৃথিবী বিখ্যাত নবরত্ন সভার দিকে।
পুবে ধনু নিত্য ঝরা
পচ্চিমে ধনু নিত্য খরা
——————————-
অস্পষ্ট গোঙানীর আওয়াজে চমকে উঠলো মেয়ে। তার কোলের উপর খনার মাথা। সেই তখন থেকে বসে ঝিমুনি মত এসেছিল। খনার অসাড় দেহ থেকে একটা ক্ষীণ আওয়াজ আসছে। আরো একটু জল দিল। সম্পূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে , গাঁয়ের লোকেরা বরাহের বাড়িতে তাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। গত তিনদিন ধরে ,খনা মা হঠাৎ অদৃশ্য? এ কেমন কথা। তাদের গাঁ মূলত কলার চাষ করে। এই তো দুদিন আগেই , খনা মা এক সভা ডেকেছিলেন। সেদিন তিনি বার বার বলছিলেন , চাষ বাসের কাজে মেয়েদের লাগিয়ে দিতে।
সাত হাতে তিন বিঘাতে
কলা লাগবে মায়ে পুতে
কলা লাগিয়ে না কাটবে পাত
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।
ভাদরে করে কলা রোপন
স্ববংশে মরিলা রাবণ।
আগে আগে তেমন কি ই বা হত? চাষ হত ঠিক। কিন্তু ,ভাত কাপড়ের চিন্তা লেগেই থাকত। তার উপরে বামুন গুলার অত্যাচারের তো সীমা ছিল না। সেই সঙ্গে ওঝা ,পিশাচসিদ্ধ –গাঁয়ে দাপিয়ে বেড়াত। সমকু হল তার প্রেমিক। গাঁয়ের সবচেয়ে সাহসী ছেলে। খনাদেবী তাকে সঙ্গে নিয়ে ভোল পাল্টে দিলেন। সবার মনে জাগিয়ে তুললেন সাহস। বামুন দেখলে আর ভয় খায়না কেউ।
গতকাল সমকু খবর আনল –:
নিজ্যস কুনো বিপদ ঘটছে গ মায়ের। বাড়ি একদম চুপ গ কাকা।
মায়ের কুনো সাড়া শব্দ নাই।
গাঁয়ের মাতব্বররা মানতে চায়নি । বলে কিনা–
খনা মায়ের দল বল আছে রে সমকু। তেনারা ট্যার পাইল না! তুই কি ভাবস নিজেরে?’
সমকু সকলের আড়ালে আমারে বলল:
তুই পারবি রিকু। তুই পাতলা রোগা রোগা। তোরে পিঠে লইয়া আমি গাছের সরু ডাল বাইয়া ঠিক নামাইয়া দিমু , অন্ধকার উঠানে। তুই বিড়ালির মত দ্যখতে পাস। দেখবি, যেই ঘরখান সবচেয়ে অন্ধকার, ওতেই আছেন উনি। রিকুরে, আমার মন কয়, মা আমার ভালো নাই।”
মা আমার ভালো নাই—আমি আর দুই বার ভাবলাম না। জীবন আজ গেলেও যাবে, কাল গেলেও যাবে– যিনি আমাদের জন্য মরতে বসেছেন, তেনারে দেখব না?
মনের কোনে আশা ছিল, যা ভাবছি যেন ভুল হয়। এখন দেখলাম, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সমকু টা অন্ধকারে থাবা গেড়ে বসে আছে, তার মায়ের খবরের জন্য। আমি কি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠব? সকলে জানুক। গাঁ থেকে হাজার হাজার লোক ছুটে আসুক। লুকায়ে মায়ের শরীল লিতে দেব নাই। ওরে সমকু রে,,,,, মা আর নাই রে,,
গুড়াল মাঝিন, ননকু হাড়ি, সব ছুট্টে আয় রে। মা চলে যায় রে,,,,
রিকু গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে। কোলের উপর যত্নে রাখা খনার মাথা, মাথা ভর্তি সিঁদুর মাখামাখি হয়ে গেছে মুখের চারপাশের রক্তের সঙ্গে। অন্ধকার কেটে ভোর জাগছে। গাছের উপর বসে থাকা সমকু বনবিড়ালের মত নেমে এসে ঘরের দিকে দৌড়ে যায়। কেউ কোথাও নেই। কেউ কিছু বলে না। সমকু বন্ধ দরজায় ধাক্কা মারে–
রিকু রে রিকু, খোল দরজা। কেউ নাই রে। সব পলাইছে। খোল দরজা।
কি করো শ্বশুর লেখা জোখা
মেঘেই দেখ জলের রেখা।
———————————-
মহারাজ হর্ষ মানিক্যের সভাঘর। বিশাল সভাকক্ষে একসঙ্গে কয়েক শত লোক বসতে পারে। সভার বিশেষত্ব তার ঐশ্বর্যে নয়, জ্ঞান এবং গরিমায়। মহারাজ গুণের কদর করেন। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর সঙ্গে খনা যেভাবে মিশেছে, তাদের অবহেলিত জীবনে নিয়ে এসেছে আশার আলো– রাজা এতে বিশেষ ভাবে খুশি। কারণ ,একজন বুদ্ধিমান রাজা হিসেবে তিনি জানেন, রাজ্যের মেরুদন্ড হল সাধারণ মানুষ।
সভার দুই দিক ধরে ,নানাবিধ আসনে পাত্র মিত্র অমাত্য বসে আছেন। একেবারে শেষ প্রান্তে , সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোর নীচে , রত্ন খচিত সিংহাসনে বসে আছেন রাজা। তাঁকে অর্ধচন্দ্রাকিতি ভাবে ঘিরে আছেন , নয়জন রত্ন। বরাহ এবং মিহিরও সেখানে আছেন। বাসুদেবে র সঙ্গে খনাকে ঢুকতে দেখে , স্বয়ং রাজা উঠে দাঁড়াতে, সকলেই বাধ্য হল উঠে দাঁড়িয়ে খনাকে স্বাগত জানাতে। পাথরের মত থমথমে মুখে বরাহ আর মিহিরকেও উঠতে হল। অতন্ত্য সপ্রতিভ ভঙ্গিতে সকলকে অভিবাদন জানিয়ে, খনা নিজের আসনে গিয়ে বসলেন। আসনের সামনে পানীয়, তাম্বুল চূর্ণ, ফল ফলাদি রাখা আছে। আছে চামর হাতে দাসী।
মহারাজ আজ বিশেষ সভা ডেকেছেন। আমন্ত্রিত কিছু ব্রাহ্মণ প্রধান , কিছু উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারী। আর নবরত্ন পন্ডিতেরা ছাড়া বিশেষ কেউ নেই। প্রত্যেকের চোখে মুখে কৌতূহল। কেবল অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে আছেন ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের দল। বাসুদেব শঙ্কিত হলেন। উপর উপর কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু সভার মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে। তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে তিনি তা অনুভব করছেন। খনার উপর মায়া পড়ে গেছে, এ কদিনের মধ্যে। নারীদের দিকে নতুন চোখে তাকাতে বাধ্য হচ্ছেন। বুদ্ধিমত্তা সাহস জ্ঞান আত্মবিশ্বাস –খনার মধ্যে এগুলি পুরুষদের চাইতেও বেশি। অথচ, কোথায় যেন মেয়েটা ভারি অসহায়। মাঝে মাঝে কেমন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। হয়ত, দুপর রোদে পুড়ে যাচ্ছে প্রকৃতি, পাঠ নিতে নিতে ক্লান্ত সকলে বিশ্রাম- রত , খনা দূরে গাছ তলায় বসে তাকিয়ে আছে ধূ ধূ আকাশের দিকে। সাঁ সাঁ করে বাতাস উড়ে এল নদীর জল ছুঁয়ে, ধুলোয় ধুলো হয়ে গেল চারপাশ, সকলে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল, কেবল হুঁশ নেই খনার। সে কেমন এলোমেলো, কেমন করুণ ভঙ্গিতে বসে রইল গাছের নিচে।
এমন অনেক বার দেখেছেন বাসুদেব। কি একটা কুরে কুরে খাচ্ছে খনাকে। অসহায় বোধ করছেন ভিতরে ভিতরে।
বাসুদেব নিজেও বেশ চিন্তিত। আজ এই সভাঘর, খনার দৃপ্ত আচরণ –সব ঠিক আছে। কিন্তু ভয় পাচ্ছেন তিনি। ষড়যন্ত্রের গন্ধ নাকে আসছে । রাজনীতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলছে–খনার চারিদিকে বিপদ। সাবধান হতে হবে। চারিদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে। এতদিন রাজার নির্দেশে খনার সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন, কিন্তু এখন তাগিদ নিজের ভিতর থেকেই অনুভব করছেন। তাঁর বিশ্বাসী গুপ্তচরের দল ছড়িয়ে আছে রাজ্য জুড়ে, খবর পাচ্ছেন, সমাজের উচ্চশ্রেণীর মধ্যে ঘনিয়ে উঠছে অসন্তোষ। এঁরা এমনই ক্ষমতাশালী যে রাজাকেও পরোয়া করেন না। আর সবচেয়ে বড় বিপদ খনার নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে। সম্মান রক্ষার জন্য বাড়ির বৌমা হত্যা– নতুন ঘটনা নয়। কিছু তো একটা করতেই হবে। নিজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলেন –অল্পচেনা এই মেয়েটির প্রতি মমত্ব বোধ করছেন, রক্ষা করার একটা তাগিদ অনুভব করছেন। এমন কেন?
খনা বলে, শুনে কৃষকগণ
হাল লয়ে মাঠে বেরুবে যখন।
শুভ দেখে করবে যাত্রা।
না শুনে কানে অশুভ বার্তা।
ক্ষেতে গিয়ে কর দিক নিরূপণ।
পূর্ব দিক হতে হাল চালন
নাহিক সংশয় হবে ফলন।
———————-;;;—————
মহারাজ হর্ষমানিক্যে অতন্ত্য বুদ্ধিমান রাজা। রাজ্য চালাতে গেলে যা যা গুণাবলীর প্রয়োজন, সেগুলি ছাড়াও, ওনার চরিত্রের প্রধান দিক হল জ্ঞানের প্রতি লিপ্সা আর জীবনকে সুন্দর করে দেখা।
খনাকে আজ প্রথম দেখলেন হর্ষমানিক্য। অল্প বয়সে এমন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব –রাজা মুগ্ধ হলেন। জ্ঞান সমুদ্রে পারাপারের দক্ষতা এ মেয়ের অনায়াস। মৃদু হেসে তিনি বললেন
দেবী খনা, আপনার প্রতিটি কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর আমি রাখি। রাখতে বাধ্য হই। রাষ্ট্রের কারণে , সমাজের কল্যানে, জাতির উন্নতিতে –আপনি যে কাজ করছেন , তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
সঙ্গে সঙ্গে সভা জুড়ে সাধু সাধু রব উঠল।
সুবক্তা মহারাজ বলে চললেন —
আমার অনেক কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। সভাস্থ সকলের অনুমতি নিয়েই ,আমি এই আলোচনা সভার আয়োজন করেছি। তবু, যদি কারো সমস্যা হয়, তিনি সভা ত্যাগ করতে পারেন।
মিহির চোখের কোন দিয়ে পিতার দিকে তাকাল, তিনি বৈশাখী মেঘ মুখ নিয়ে বসে আছেন। তবে, নিজের ইচ্ছায় রাজ সভাগৃহ ত্যাগ করার মত মুর্খামি কেউই করবে না। সমস্ত সংসার আজ তেতো লাগছে মিহিরের। খনা তাঁর পত্নী। অথচ আজ যেন অচেনা কেউ। কেন এমন হবে? খনা তাদের সংসারের একজন হয়ে কাজ করতে করতে কখন এমন পৃথিবীর জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল, কে জানে? আজ রাজসভায় খনা আসতে পারত মিহিরের স্ত্রী হয়ে? মিহির খনা নাম দুটি অনিবার্য একসঙ্গে উচ্চারিত হতে পারত। অথচ , খনা আজ একক এক নাম। কারোর সঙ্গে যুক্ত হবার তার প্রয়োজন নেই। পিতা পুত্র দুজনেই আজ অবাঞ্ছিত খনার জীবনে এবং এই রাজসভাতেও বটে। চির অহংকারী পিতা , আজ মাথা নিচু করে বসে আছেন –দেখে ভিতর পর্যন্ত মুচড়ে ওঠে, সেই সঙ্গে নিজের উপর দুর্দম ক্রোধ আচ্ছন্ন করছে ।
–মহারাজ, খনা দেবীর কাজের যে বর্ণনা আমরা পাই, তাতে ওনাকে বিজ্ঞানী কম শিল্পী বা কবি মনে হয় বেশি! কালিদাস সহাস্যে বললেন
–এই হল যথার্থ কবির মত কথা। নিজের মত সকলকে ভাবা–বিদূষক বলে উঠলেন।
সভার রাশ ধরলেন মহারাজ
আসলে বিজ্ঞানী আর কবির মূলগত কোনো পার্থক্য নেই বলেই মনে হয়। আপনি কিছু বলবেন অর্যা খনা? এই ব্যাপারে?
সুস্পষ্ট ধারাল কণ্ঠে কথা বলে উঠল খনা
আমি এই সব কূট তত্ত্ব বুঝিনা মহারাজ। কাজ করতে ভালোবাসি ,তাই করি। আর গুরুদেব আমাকে যা শিখিয়েছেন, তাতে কৃষি ও আবহাওয়া বিদ্যা আমার করায়ত্ব। আমি মনে করি, রাষ্ট্রের মূল ভিত গড়ে ওঠে কৃষি ব্যবস্থার উপর। আমি কেবল ওই টুকুই করেছি মহারাজ। “
কোলাহল করে উঠলেন ব্রাহ্মণরা। ভ্রু কুঁচকে মহারাজ বললেন
–খনা দেবী আজ রাজ অতিথি। তাঁর মর্যাদা রক্ষার ভার আমার।’
—-কিন্তু মহারাজ—এগিয়ে এলেন ব্রাহ্মণ পন্ডিত শিরোমণি আচার্য শশাঙ্কদেব–দেবীখনা ,সমাজের নিম্ন শ্রেণীকে মাথায় তুলছেন। তাদের আস্পর্ধাও বেড়ে যাচ্ছে। পুজো আচ্চা যাগ যজ্ঞ কেউ মানতে চাইছে না। এতে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলার ক্ষতি হচ্ছে না?
রক্তবর্ণের সিল্কের ধুতি উত্তরীয়, নধর উদর, গৌরবর্ণ তেলাল শরীরের শশাঙ্ক টিকিতে হাত বোলাতে বোলাতে ক্রোধে বললেন—আমরা কি দেশের মানুষের ভালো চাই না? যাগ যজ্ঞ বন্ধ হলে, অনাবৃষ্টি, মহামারীতে ছেয়ে যাবে দেশ।’
—না। কখনই না। হোম যজ্ঞের সঙ্গে বৃষ্টি পাতের কি সম্পর্ক? আর যদি থেকেও থাকে, আপনাদের উদ্দেশ্য ওতো সরল নয়, নিম্নবর্গীয়দের শোষণ করাই কাজ আপনাদের।”
সভা চুপ। বাতাসের শব্দ শোনা যায় না। থেমে গেছে, চামর ব্যাজন। এ কেমন অদ্ভুত কথা? তা ও এক নারীর মুখে। বরাহদেব আর মিহির কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন। এত স্পর্ধা! মৌনতা ভঙ্গ করলেন খনা নিজেই
আমি আটনাচার্জের বেটি/ গণনায় কাকেই বা আঁটি?
মহারাজ, যা দেখা যায় না, তেমন কিছুতে আমি বিশ্বাস করি না। যে সূত্র ধরে আমি বিচার করি, তাতে অলৌকিকতার কোনো স্থান নেই।
— এ সম্পূর্ণ আসুরিক মতবাদ মহারাজ। ন্যায়রত্ন বলে উঠলেন –এই বস্তুবাদী দর্শণ আমাদের শাস্ত্র সমর্থন করে না। চার্বাক ঋষি প্রণীত এই মতবাদ, ইতরজনের জন্য।’
এইবার স্পষ্টতই হেসে উঠলেন খনা –সেই ইতর জনেরাই রাষ্ট্র কে ধরে রাখে , এ কথা ভুলে গেলে চলবে? ‘
—আমাদের শাস্ত্র,চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদকে সমর্থন করে না। মহারাজ, আত্মা অবিনশ্বর। মানব শরীর নষ্ট হয়, কিন্তু আত্মা? তার ক্ষয় লয় কিছুই নেই।’ মিহির বলে উঠল।
—আত্মা অবিনশ্বর হলে, তবেই মৃত্যুর পর আসে স্বর্গ নরক ভোগের প্রশ্ন, জন্মান্তর পূর্বজন্মের কর্মফল ইত্যাদি প্রশ্ন। মহারাজ, ভালো করে চিন্তা করুন, তার সঙ্গেই আসে ভয়। পাপের ভয়, মৃত্যুর পরে নরক ভোগের ভয়। এই সবের কি কোনো প্রমাণ আছে? এই ভয় দেখিয়ে, সমাজের অসহায় মানুষ গুলিকে শোষণ করা হয়ে থাকে।
খনার হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। শরীরটা জুতের নেই। ঋতুকাল চলছে। নিয়ম অনুযায়ী তাকে এক বস্ত্রা হয়ে, ঘরের মধ্যে বন্দী থাকা উচিত। তিনি তা কখনোই করবেন না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে, উপযুক্ত প্রতিরোধ নিয়েই এসেছেন, তবু আজকাল প্রচন্ড পরিশ্রমের ফলে, শরীরে ক্লান্তি অনুভূত হয়। কিন্তু তবু তিনি অকূটভয়ে তর্ক করে যাচ্ছিলেন।
—খনা দেবী–মহারাজ বললেন–আমার মনে হয়, এই প্রসঙ্গ এখানে প্রয়োজন নেই। কৃষি কাজ এবং তার সমস্যা নিয়ে আপনার কিছু বলা উচিত বলে আমি মনে করি।’
ম্লান হাসলেন খনা–মহারাজ, হাল বলদে হয়না চাষ, চাষ করে মানুষ , মানুষের মস্তিষ্ক। তাকেই যদি এভাবে কুসংস্কার দিয়ে শোষণ করা হয়, তবে তো—মহারাজ, মৃত্যু অমোঘ সত্য –ব্রাহ্মণ জীবিকা হেতু তৈরি শ্রাদ্ধাদি বিহিত
এছাড়া কিছুই নয় জেনো গো নিশ্চিত।
মহারাজ–যদি, শ্রাদ্ধকর্ম হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ
তবে, নেভা প্রদীপে দিলে তেল উচিত জ্বলন।
স্তম্ভিত সভাগৃহের দিকে, স্মিত হাস্যে তাকিয়ে খনা বলেন–চৈতন্যরূপ আত্মার পাকযন্ত্র কোথা?
তবে তো পিণ্ডদান নেহাতই বৃথা !
আত্মার কি পাকস্থলী আছে? যদি না থাকে, তাহলে তার উদ্দেশ্যে পিন্ডদান করলে সে কিভাবে খাবে?
সমস্ত সভাগৃহে নির্বাক। এমন কথা কে শুনেছে কোনদিন? জ্বলন্ত ক্রোধে চিৎকার করে উঠলেন বরাহদেব–এ সব রাক্ষস দর্শনের কথা। মহারাজ, ব্রাহ্মণ্যবাদকে অপমান করার চেষ্টা?’
অন্য আর এক ব্রাহ্মণ লাফ দিয়ে উঠে গলার উত্তরীয় আন্দোলন করতে করতে বললেন–ছারখার যাবে রাজ্য। মহারাজ ! প্রশ্রয় দিচ্ছেন এক অর্বাচীন নারীকে? আমরা সহ্য করবো না এই অপমান! সভাস্থ সমস্ত ব্রাহ্মণ একযোগে কলরোল করে উঠল। বাসুদেব ,নিজস্ব দুই অনুচর সহ , ছুটে খনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। চরম উত্তেজনার মধ্যেও মাথা ঠান্ডা রেখে, সকলকে শান্ত হতে অনুরোধ করলেন মহারাজ। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। হাত তুলে প্রধান অমাত্য বললেন–এ কেবল এক দর্শনের কথা বলা হয়েছে। কাউকে অপমান করা হয় নি।
মহারাজ, খনা এসেছেন ভূতত্ববিদ হিসেবে। উনি সেই বিষয়ে কথা বলুন। কি করে, কোন জমি , কোন মেঘ–বলুন–উনি ধর্ম নিয়ে কথা বলেন, কোন সাহসে?
—কেন? ধর্ম কারো নিজস্ব সম্পত্তি না কি? ধর্মের উপর কেবল ব্রাহ্মণদের অধিকার?
তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ উড়ে এল খনার আসন থেকে –ভূতত্ত্ব? কিসের ভুতত্ববিদ আমি? যদি না কৃষকের দুঃখকে নিজের বলে না ভাবি?
বিস্ময়ে ফিরে তাকালেন খনার দিকে, হর্ষ মানিক্যে। মেয়ের মুখের রেখায় কাঁপন নেই। উত্তেজনা নেই। অবয়ব জুড়ে খেলা করছে আত্মবিশ্বাস আর সাহস।
কিন্তু এদিকে যে বিতর্ক সভা পরিণত হচ্ছে লড়াইয়ের ময়দানে! মধ্যস্থ হয়ে হাল ধরলেন রাজা,
“ এটা আলোচনা সভা। হে ব্রাহ্মণগণ, আপনারা দলে ভারি, খনা একলা–এভাবে উত্তেজিত হয়ে আক্রমণ করলে, খনার পক্ষে নিজের বক্তব্য পেশ করাই মুশকিল হয়ে যাবে। ‘
—এই রাজাটাকে নিয়ে হয়েছে যত গন্ডগোল, বুঝলে ? ব্রাহ্মণরা একে অন্যের কানে কানে বলল
–এটাকে টেনে নামিয়ে দিতে হবে।
—ঠিক বলেছেন। ক্ষত্রিয়ের এত বাড় ভালো না।’ মিহির তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ উত্তেজিত গলায় বলে উঠল।
—’আমরা চাইলে সব কিছু করতে পারি। সেটা ওই মূর্খ রাজা বুঝবে কবে?
–শান্ত হন। শান্ত হন—,রাজার গম্ভীর গলা শোনা গেল—মহামতি খনা বলছেন–পাপ পুণ্যের ভয় দেখিয়ে, অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষকে ঠকানো হচ্ছে। স্বর্গ নরক বলেও কিছু হয় না। যা দেখা যায় না তা কখনো সত্য নয়। মানুষ নিজেই নিজের ঈশ্বর!
এবার আপনারা বলুন ,হে ব্রাহ্মণগণ। মনে রাখবেন , আমার রাজ্য বা আমি– কোনো ধর্মের দ্বারা শাসিত নই। প্রত্যেকের অধিকার আছে, নিজের স্বাধীন বক্তব্য খুলে বলার।
রাজার গলার স্বরে উষ্মা, চোখে একটু বিরক্তি, কিঙ্করীর বাড়ানো স্বর্ণপাত্রে মৈরেয় নিয়ে দীর্ঘ চুমুক মারলেন। অহংকারী ব্রাহ্মণদের আস্পর্ধায় ,তাঁর মত ধীর রাজার প্রশান্তিও নষ্ট হয়ে যায়। সেই সঙ্গে, ঈষৎ উদ্বিগ্ন বোধ করছেন। এনাদের চোখে মুখে অমঙ্গলের বার্তাই সূচিত হচ্ছে যেন!
ব্রাহ্মণদের পক্ষ থেকে বলতে উঠলেন মিহির। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। মিহির যথেষ্ট উপযুক্ত এমন বিতর্কে অংশ নেবার জন্য। তবু, খনার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। প্রবল ঝঞ্ঝা যাকে হেলাতে পারে না, ভালোবাসার ছোট্ট ছোঁয়াতে সে কেমন সূর্যতাপে রাখা ননীর মত গলে যায়। হৃদয়ের এমন অপার রহস্য খনার পক্ষে বোঝা ভার। কি সুন্দর দেখাচ্ছে মিহিরকে ! গৌরবর্ণ কৃশ শরীরে , গেরুয়া রঙের ধুতি উত্তরীয়। বুকের উপর আড়াআড়ি ভাবে চলে গেছে, সাদা ধপধপে পৈতে। মুন্ডিত মস্তকে, দীর্ঘ টিকি। তাতে একটি ফুল গোঁজা। কপালে চন্দনের টিপ। চোখ দুটি কঠিন। খনা মাথা নিচু করে ফেলল। কোনোমতেই তাঁর ভাবান্তর যেন কারো চোখে না পড়ে। অথচ তৃষিত চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ্য করছিল মিহিরকে। তাঁর সৃষ্ট মিহিরকে।
কঠিন নির্লিপ্ত কন্ঠে মিহির শুরু করল
মহারাজ! ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার মহিমা এক অসুর কন্যা বুঝবে এমন আমরা আশা করি না। সুপ্রাচীন বেদ–উপনিষদের অনুশাসন ,সমাজকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন। পাপ পুণ্য ,ইহলোক পরলোক –প্রমাণিত সত্য। ঋষিদের গভীর তপস্যার ফল হল, আত্মা তত্ত্ব। আজ যদি এই অনুশাসন না থাকত, দেশ পাপে ভরে উঠত। অসুরকন্য খনা, কতটুকু জানে শাস্ত্রের? সর্বোপরি, সে একজন নারী। নারী মাত্রেই বুদ্ধির স্বল্পতা থাকে–এ কথা সকলেই জানেন।’
দংশিতা সর্পের মত ফনা তুলে দাঁড়াল খনা। নারী হতে জন্ম, নারী হতে সর্ব সুখ , আর সেই নারীকেই এত অবহেলা? এত অপমান? তারপরেও তারা নিজেদের শিক্ষিত বলে? এক এক করে ধরে ধরে দেখাতে থাকে, ব্রাহ্মণ্যবাদের ত্রুটি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের উপর ধর্মের নামে জুলুম–সতীদাহ প্রথা, অকাল বৈধব্যের নামে শারীরিক শোষণ, বহু বিবাহ—সর্বত্র পুরুষ শোষক, নারী শোষিত—এ সব হচ্ছে ধর্মের নাম দিয়ে।
“ মহারাজ, পৃথিবীতে ধর্ম ততক্ষণই সুন্দর, যতক্ষন তা মানুষের কল্যাণ কামনা করে। নতুবা তা অবান্তর। অপ্রয়োজনীয়। মহারাজ, আমি আজ এখানে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে আসিনি। এসেছিলাম, কৃষিকাজের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করতে। সেই প্রসঙ্গে এসেছিল, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কথা। তারাই যদি ভালো না থাকে, তবে, কোন মেঘে বৃষ্টি হবে, কোন মেঘে ঝড়, কোন মাটিতে কি ফসল ফলবে, চন্দ্র সূর্যের কোন চলনে আসবে জোয়ার ভাঁটা—কি আসে যায় সে সব জেনে?
মহারাজ, আমি আজ ক্লান্ত। অনুমতি করুন, আমি ফিরে যাই? আজ এক বহুদুর গ্রামে যাবার কথা। সেখানে, ভূগর্ভের জলের স্তর নেমে গেছে– আমি সেখানে যাব আজ। মাটি পরীক্ষা করে দেখব, কারণ খুঁজব। না মহারাজ, কোনো যাগ যজ্ঞ নয়। কারণ খুঁজে পেলে উপায় বেরিয়ে আসবে। অনুমতি করুন মহারাজ।
নিস্তব্ধ সভাঘর। হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন খনা। হঠাৎ , বরাহ ব্যাতিত, বাকি নবরত্ন উঠে দাঁড়িয়ে সাধু সাধু উচ্চারণ করতে লাগলেন। নিজের থেকেই পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন দাস দাসীরা। তাদের চোখ ভিজে। খনা যে তাদের কথাই বলল –সে সত্য তারা বুঝতে পেরেছে।
সিংহাসন থেকে নেমে এলেন মহারাজ, দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করলেন–
আমি ধন্য। আমার সৌভাগ্য যে, খনা দেবী এখানে আছেন। এই রাজ্যের মঙ্গল সাধনের জন্য কাজ করছেন। করছেন নিরলস স্বার্থহীন পরিশ্রম। এই কারণে , আমি ,রাজা হর্ষ মানিক্যে বিক্রমাদিত্য ঘোষণা করছি: আগামী মাসে দেবী খনাকে ,আমার নবরত্ন সভার দশম রত্ন উপাধিতে ভূষিত করব।
সাধু সাধু রবের মধ্যে রাজা আবার ঘোষণা করলেন
দেবী খনা আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। এবার থেকে , সমাজে নারীদের ভূমিকা নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। কুসংস্কার, কু প্রথাকে দূরে রাখতে হবে। আশাকরি, দেশের ব্রাহ্মণ সমাজ আমাকে সম্পুর্ন সহযোগিতা করবেন।
আজকের মত সভা সমাপ্ত হল। প্রিয় বাসুদেব, দেবী খনাকে তুমি যথাযোগ্য সম্মান ও উপঢৌকন সহ নিজ গৃহে পৌঁছে দিয়ে এস।’
—যথা আজ্ঞা মহারাজ।
দৃশ্যত বাসুদেব সুখী অনুভব করছিলেন। এতদিনে, খনার লড়াই এক নোঙর পেল। রাজ স্বীকৃতি! কম কথা তো না। তিনি জোড় হাতে খনার আসনের সামনে এসে বললেন
–চলুন দেবী। খনা কেমন শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।। বাসুদেব আবার বললেন–চলুন দেবী।
অন্যমনস্ক খনা বলল–কোথায়?
বাসুদেব নিজের মত করে কিছু বুঝলেন , একটু ঝুঁকে এলেন আসনের কাছে। ফিস ফিস করে বললেন:
আপনার গৃহ। দেবী খনা। আপনার আবাসে।
গভীর দুটি চোখ মেলে তাকাল খনা বাসুদেবের দিকে। এ কি! কয়েক ঘন্টা আগের ওই ঝকঝকে চোখ দুটি কই? তার জায়গায় বিষাদের কালিমাখা, রাজ্যের ক্লান্তি বহন করা, এমন একলা দুটি চোখ? বুকের মধ্যে ঘুঘু ডেকে উঠল বাসুদেবের। যদি পারতেন দুহাতের আলিঙ্গনের ছায়ায় খনাকে ধরে রাখতে! যদি পারতেন, ওই তপ্ত চোখ দুটিকে ভালোবাসার চুম্বনে ভরে দিতে। তিনি বিবাহিত। এক রমণীর কাছে দায়বদ্ধ। আজ অনুভব করলেন,দায়বদ্ধতা থাকে শরীরের, সংসারের। মন মুক্ত। সেই মন আজ নতজানু হয়ে বসতে চাইছে খনার পায়ের কাছে।
হাত বাড়িয়ে দিলেন বাসুদেব–
: চলুন দেবী খনা। আপনাকে গৃহে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।’
অস্তমিত সূর্যের শেষ আভাটির মত, সভা ভঙ্গের রেশ রয়ে গেছে এদিক ওদিক । এখন যাত্রা শুরু না করলে দেরি হয়ে যাবে , বুঝেও উঠতে আর ইচ্ছে করেনা খনার। কোনোমতে টেনে তোলে শরীর। রথের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে অস্ফুটে বলে–:
কোথায় যাব বাসুদেব? নারীর নিজস্ব গৃহ বলতে কিছু হয় না। তার শৈশব কৈশোর যৌবন বার্ধক্য –গোটা জীবন পরিক্রমা তার অন্যকে ঘিরে। অন্য জীবন পূর্ন করলে, সুখী করলে–তবে সে মহান। সে পুরুষের ভালোবাসার যোগ্য।
রথ তৈরি ছিল। তেজী ঘোড়া দুটো পা ঠুকছিল ক্রমাগত। সারথীর ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র, জ্যা মুক্ত তীরের মত ছুটে চলল আচার্য বরাহের গৃহের দিকে। একসঙ্গে তিনজনে ফিরবে–এমন ক্ষীণ আশাটুকু করা বৃথা জেনে একলাই ফিরে এল খনা।
গৃহের দরজার সামনে নেমে দাঁড়িয়ে বাসুদেব বললেন,
“ সাবধানে থাকবেন। আপনি একলা। “
————————
এক ছিল মেয়ে, তার নাম খনা
তার জিব কেটে নিল পাঁচ জনা
জিব কেটে নেওয়া খনার বচন
সাগরে পাহাড়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল।
খনা নামের সেই মেয়েটিই শুধু
রক্তক্ষরণে মরলো।( মল্লিকা সেনগুপ্ত/ খনার গান)
———————————————
অতীতের কাহিনীকে ভিন্ন দৃষ্টিকোনথেকে বিশ্লেষণে জয়তী রায় মুনিয়া দারুন সফল একজন লেখিকা।খনার জীবনের করুন পরিনতির কথা কম বেশী সবারই জানা।কিন্তু তাঁর পারিবারিক,রাজনৈতিক,সামজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের মানষিক দ্বন্দ-সংঘাত, আবেগ, তাঁর শিক্ষাজীবন,সর্বোপরি পুরুষতন্ত্রের অহমিকার শিকার হয়ে করুন মৃত্যু এখানে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা অনবদ্য।
খনা এক সত্য-অতুলনীয়। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লাম