
কাব্যিক গদ্য এবং অনুবাদে– চিন্ময় গুহ
পারমিতা ভৌমিক
যদি চিন্ময়ের অন্তরাত্মাকে দেখতে পেতাম তাহলে বুঝতে পারতাম কী একটা গভীর ও কঠোর সত্য ঝড়ের মতো তাঁর সত্তার মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত বইছে―― এ একটা involved process...বলাবাহুল্য এরপরেও কোনো fatal facility তাঁর সৃষ্টিকে অসম্পূর্ণ করে রাখতে পারেনি। চিন্ময়, তাঁর লিপিত-সাহিত্যে সৌন্দর্য ও আশ্চর্যরস সৃষ্টি করবেন বলেই অনন্ত, অসীম এবং বৃহৎ-কে আঁকড়ে ধরেছেন। এছাড়াও এই আন্তর চেতনা ও ভাবকে প্রকাশ করতে তিনি গদ্যের রূঢ়তাকে পাশ কাটিয়ে কাব্যিক গদ্যকে বেছে নিয়েছেন।
চিন্ময় গুহর লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, প্রতিভা (genius) এবং গুণী( & talent)-র একত্র সমাবেশ ঘটেছে চিন্ময় গুহের রচনায়।
চিন্ময়কে নিয়ে কিছু বলার আগে তাঁর প্রাতিভতার স্বরূপটি একটু তো বুঝতেই হয়। তাঁর সৃজিত ভুবনের উপকরণগুলির সমাবেশ-কৌশলই তাঁর লিপিত-শিল্পকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে।
চিন্ময় গুহের প্রাতিভতার দিকে তাকালে দেখব, গোড়া থেকেই সবকিছু যেন ভেঙেচুরে তিনি অন্য এক জগতের উন্মোচন করতে চাইছেন যার আস্বাদন পাঠকের কাছে নতুন।গুণীর প্রকরণকৌশল আর প্রতিভার শক্তি একই সঙ্গে চিন্ময়ের লেখায় সমাহিত।তবুও একথা বলতে হয় যে স্রষ্টা-চিন্ময়ের মধ্যেই একটা মহত্তর বৃত্তি যেন তাঁর বুদ্ধিদীপ্র কারিগরিকে পিছনে ফেলে অন্য অভিমুখে যাত্রা করেছে। তাঁর শুদ্ধাবুদ্ধি কেবল রূপদর্শীই নয় ,গুণও তাঁর চৈত্যসত্তায় অধিক সমাদৃত। এরসঙ্গে পা মিলিয়েছে তাঁর অন্তরাত্মা।
প্রায়ই দেখেছি, চিন্ময় গুহের সৃজনী-ক্ষমতার পিছনে উঁকি দিয়েছে একটা বিজ্ঞান যাকে প্লেটোর ভাষায় বলা যায় arche-types…..
আইডিয়া বা ভাবের জগৎ। তাঁর সৃষ্টির পিছনেই রয়েছে এই ভাবের স্বরূপ।
চিন্ময়ের লেখায় সর্বত্রই রয়েছে তূরীয়ের মধ্যে অবস্থিত , অগোচর, অপ্রকাশ, গুহাহিত একেকটি ভাবশরীর যা শরীরগ্রহনের ব্যগ্রতায় আকুল। এই তূরীয় বিজ্ঞান থেকেই চিন্ময়ের আদিসত্যের অধিষ্ঠানটি চিহ্নিত হতে পারে।
যদি চিন্ময়ের অন্তরাত্মাকে দেখতে পেতাম তাহলে বুঝতে পারতাম কী একটা গভীর ও কঠোর সত্য ঝড়ের মতো তাঁর সত্তার মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত বইছে―― এ একটা involved process…বলাবাহুল্য এরপরেও কোনো fatal facility তাঁর সৃষ্টিকে অসম্পূর্ণ করে রাখতে পারেনি। চিন্ময়, তাঁর লিপিত-সাহিত্যে সৌন্দর্য ও আশ্চর্যরস সৃষ্টি করবেন বলেই অনন্ত, অসীম এবং বৃহৎ-কে আঁকড়ে ধরেছেন।
এছাড়াও এই আন্তর চেতনা ও ভাবকে প্রকাশ করতে তিনি গদ্যের রূঢ়তাকে পাশ কাটিয়ে কাব্যিক গদ্যকে বেছে নিয়েছেন।
কাব্যিক গদ্য বা poetic prose শিল্পী চিন্ময় গুহের জাদুময় হাতের গুণে লিপিত অক্ষরের সঙ্গে অনাহতের ইঙ্গিতকে মিশিয়ে দিতে পেরেছে, আর এভাবেই তাকে লঘুপক্ষ করে পাঠকের মনোলোকে ছড়িয়ে দিয়েছে অতিলৌকিক আলো। গদ্যের এটাই শ্রেষ্ঠরূপ বলে স্বীকৃত।
চিন্ময় গুহ কাব্যিক গদ্যের অনন্য তুলিকার।তাঁর বাংলায় লেখা যেকটি বই আছে, তার মধ্যে এই মুহূর্তে, “ঘুমের দরজা ঠেলে” “হে অনন্ত নক্ষত্র বীথি” “গাঢ় শঙ্খের খোঁজে” আমার পড়বার সৌভাগ্য হয়েছে।
আমার পড়তে পড়তেই মনে হয়েছে, ইংরেজির—- ম্যাথু আর্নল্ড, ওয়াল্টার পেটার, অস্কার ওয়াইল্ড, ফরাসির— রেনাঁ, ফ্লোব্যার , গ্রীসের—জেনোফোন, সিসেরো , প্লুটার্ক, লাতিনের তাসিতাস, সালাস্তাসের সঙ্গে চিন্ময়ের নামটি সার্থক কাব্যিক-গদ্যকার হিসেবে বাংলাসাহিত্যের পাঠক নিশ্চিত যুক্ত করবেন।
চিন্ময়ের বইগুলির প্রকৃত রসসম্ভোগ করতে গেলে তাঁর ব্যবহৃত শব্দবিন্যাসকে জানতে ও দেখতে হবে। এর মধ্যেই ধরা রয়েছে রম্যগতি, রয়েছে সুনিয়ন্ত্রিত যতির ব্যবহার,
রয়েছে ধ্বনির ওঠা-পড়া…..
এসবই চিন্ময়ের ছন্দসৌভিক সত্তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁর গদ্যে।
বলাবাহুল্য গদ্যকাব্যের কবিকে সতর্ক থাকতেই হয়। যথেচ্ছ অসম পংক্তিতে মামুলি বক্তব্য পরিবেশন করলে চলেনা। চিন্ময় গুহের কাব্যিকগদ্যে সেটা স্পষ্ট করে খুঁজে নিতে পারি।
আমি রূপ থেকে ভাবে যেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। তাই আগেই রূপকৃৎ চিন্ময় গুহকে খুঁজবো। এর সঙ্গে সঙ্গেই ভাব আপনিই এসে ধরা দেবে।
চিন্ময়ের গদ্যে পাই—-
যতির নতুন বোধ, যার দ্বারা লেখা গতিশীল হয়েছে।
ব্যাপারটি এরকম—
“অক্ষরের স্তূপ পেরিয়ে, অন্ধকারের মরাখাত পেরিয়ে, তিনি হাঁটছেন রক্তপায়ে। ‘যদি দু’একটা বীজ ভিজে ওঠে/ হাঃ হাঃ যদি দু’-একটা”
ঘুমের দরজা ঠেলে/পৃঃ১২১)
চিন্ময় লিখিত এই অংশটি কেবলমাত্র চিহ্নের যথাযথ ব্যবহারেই যথার্থতা পেয়েছে তা নয়, এ হল ‘চিহ্নবিজ্ঞান’, যার কার্যকরী কৌশলেই চিন্ময়ের রচনা সত্যকার রচনা হয়ে উঠেছে।
লেখকের যতিচিহ্ন ব্যবহারের কুশলতাই দ্যোতক থেকে দ্যোতিতে পৌঁছনোর পথ বলে দেয়।
কখনও কখনও লেখকের ভাষার মত তাঁর সৃষ্ট মানুষের জগৎকেও বহুস্বরিক (polyphonic)
বলে মনে হয়। চিন্ময় তখন তাঁর পরিচিত মানুষ গুলোর সঙ্গে একই সরলরেখায় এসে মুখোমুখি দাঁড়ান।বেশী ক্ষেত্রেই তাঁর স্বগতোক্তিতে ঐসব স্মৃতি-মানবেরা নতুনভাবে রক্ত মাংসে জীবন্ত হয়ে ওঠেন। এইখানেই চিন্ময়ের সাররিয়্যালের ব্যবহার লক্ষণীয় ও প্রশংসনীয়। সাররিয়্যালিস্ট
চিন্ময় গুহের প্রসঙ্গে পরে আসবো।
এছাড়াও দেখেছি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে চিন্ময় তাঁর শৈলী-সজাগ পারিপাট্যে কুশলী—–
একটা বিশেষ আবেগ ঠিক কতখানি একটা পংক্তির মধ্যে উচ্চারণ করা যাবে সেটির বিন্যাস-বিজ্ঞান জেনে পংক্তিবিন্যাসের নির্ধারণ ক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছেন তিনি।
এবং বলাবাহুল্য চিন্ময়ের গদ্যশিল্প এভাবেই বেশি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে।কোথাও তা উচ্ছৃঙ্খল নয়। এ দায়িত্ব তিনি সচেতনভাবে পালন করেছেন। তাঁর চলনে ভাবের অসংযত ঝোঁক বা দোলানি নেই বরং এসবের একটা পরিমিত মাত্রায় তাঁর লেখার চলনটি ফুটে উঠেছে।—–
“অনন্ত রাত্রির বুকে সমুদ্রে ভাসমান কয়েকটি কাগজের স্তূপে আগুন জ্বলছে।নক্ষত্রের নীল বর্শা ঝলসে উঠছে সেই আগুনে।
কে জ্বালিয়েছে আগুন? কী দোষ করেছে ঐ আয়তক্ষেত্রগুলো?
আমি হাত পুড়িয়ে একটি অগ্নিদগ্ধ বই তুলে নিই। আশ্চর্য, বইটি দাউদাউ করে জ্বলছে,কিন্তু একটিও অক্ষর পোড়েনি।তার সারা গায়ে আগুনের চুম্বন-চিহ্ন আর রক্তের দাগ”—–
( ঘুমের দরজা ঠেলে/পৃঃ৬)
এখানেই পাইনা কি সাররিয়্যালিস্ট চিন্ময় গুহ কে?
অনন্ত রাত্রি ছিল।
সমুদ্রের বুকে ভাসমান কয়েকটি কাগজের স্তূপ ছিল।
আগুন জ্বলছিল সেখানে। সে আগুনে আবার নক্ষত্রের বর্শা ঝলসে উঠছিল।
অথচ ঘটে গেল অন্যতর রূপান্তর।
গভীর আশাবাদ বা কাঁদিদ বেরিয়ে এল ঐ আগুন থেকে।
পাঠকের পরম্পরাবোধ তাকে জানিয়ে দেবেই যে এরপরে অনিবার্য ভাবে পুড়ে যাবার কথা ছিল। এ তো একটা ধ্বংসের কথা।
কিন্তু তা তো হলনা।
এইই চিন্ময়–চমৎকার। কৌশলে তিনি সরিয়ে রেখেছিলেন আশাবাদের চাবিটি। এই অগ্নিদাহের মুহুর্তে তাইইই রক্ষা করল নৈরাশ্যকে।
এক মুহূর্তে ড. রালফের ও ভলত্যেরের সঙ্গে চিন্ময় আইডেন্টিফায়েড হয়ে গেলেন গভীর আশাবাদে। ঠিক এজন্য তাঁকে শব্দ নির্বাচন ও প্রয়োগের ব্যাপারে সজাগ হতে হয়েছে।
কাব্যিক গদ্য বলেই স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তের ক্ষেত্রে যে নির্দিষ্ট পদক্ষেপের শৃঙ্খলা থাকে তাকে চিন্ময় পরিহার করেছেন এবং আরো অন্য এক শৃঙ্খলা অনুসারে তিনি কাব্যিকগদ্যের চলনটিকে সাজিয়েছেন। রসাত্মক বাক্যকে গদ্যে বলতে পেরেছেন বলেই চিন্ময় সার্থক গদ্যকাব্যের শিল্পী। তাঁর কাব্যিক গদ্যের মেরুদণ্ড হল তাঁর ভাবগৌরব এবং সেই গদ্যের পারিপাট্যে রয়েছে অভাবনীয় সংযম।
চিন্ময় পড়তে পড়তে আমার কেন জানি না, মনে পড়ে যায় রুশীয় কাব্যে তুর্গেনিভ, ইতালীয় নবদূত মন্তালে আর বাংলার রবীন্দ্রনাথের অলৌকিক গদ্যশিল্পের কথা। এলিয়ট তো আছেনই ।
আধুনিক বাংলা গদ্যকাব্যের এই প্রয়াসটুকু দিয়েই কি চিন্ময় ছাড়িয়ে যাচ্ছেন না এই কাব্যিক গদ্যের পরম্পরাকে?এ এক অন্য অনন্য জগতের ইশারা। আমরা জানি চিন্ময় গুহের গদ্যকাব্যের নতুন সুর ও স্বরায়ণে উন্মোচিত হতে চলেছে নতুন দিগন্ত। আমরা জানি তার তুলনা নেই।
যাঁরা চিন্ময় গুহ-র “ঘুমের দরজা ঠেলে” পড়েছেন তাঁরা জানেন —– এটি একটি কাব্য জার্নি।
এই বইটিতে একটা অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে চিন্ময় গুহ-র মনোভূমির অন্য মাত্রা উন্মোচিত হয়েছে। তিনি মূলতঃ কবিসত্তার অধিকারী ।
মনে হয় এজন্যই তাঁর সৃষ্টির মূলকথাও সৌন্দর্য।
তাঁর ভাষা ও শব্দলালিত্য যেন তাঁতেই পরাকাষ্ঠা লাভ করেছে। তাঁর রচনার ভাব সুন্দর, সুন্দর সেসব চিন্তার বৈদগ্ধ্যও। সুন্দর তাঁর কাব্যময় অনুভবের সৌকুমার্য ও তার বিচিত্রতা।
কি মনোহারিত্ব তাঁর প্রকাশধর্মে !! এমন কি আখ্যানের বিষয়বস্তু নির্বাচনও সুন্দর ও অভিনব।
অলক্ষে কোথায় যেন জাগ্রৎ স্বপ্ন সুষুপ্তি তূরীয় ও তূর্যাতীতের মণ্ডণ ছুঁয়ে হঠাৎই স্বপ্নময়তা নেমে এসেছে কবি চিন্ময়ের জাগ্রৎভূমিতে—- বিশেষত ঘুমের দরজা ঠেলে ,হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি ও গাঢ় শঙ্খের খোঁজে —–বইগুলিতে।
মনে হয় যেন চিন্ময়ের মধ্যেকার আসল মানুষটিই একজন ঐন্দ্রজালিক-রূপকৃৎ। রূপসৃষ্টিই তাঁর অন্তর-ধর্ম । সেই গুণেই তাঁর রূপকল্প নির্মাণে লেগে থাকে স্বপ্নের ঘোর—-
“এতরাতে এক বালক কাচের ওপর ধুলোর কুয়াশা মুছছে। সে কি কিছু ভুলে যেতে চায়, না কি নতুন করে দেখতে চায়? হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, ওপারে উৎকণ্ঠা, অসুখ, একাকিত্ব, মৃত্যু, বিশ্বাসঘাতকতা। যন্ত্রণা উপশমের জন্য এক দীর্ঘ নিঃশব্দ আর্তনাদ।যন্ত্রণার খোদাইচিত্র”—–
(ঘুমের দরজা ঠেলে)
আশ্চর্য এই যে বিমোহিত পাঠকরাও দেখছেন চিজেল হাতে চিন্ময় স্বয়ং যেন উপস্থিত হয়েছেন, যন্ত্রণা কুঁদে কুঁদে তিনি কি বার করে আনবেন জীবনের ফ্রোজেন মিউজিক?
হ্যাঁ। তিনি গদ্যশিল্পে মুক্তি দিতে পেরেছেন পাথরে নিহিত স্তব্ধ গানকে আর বলাবাহুল্য এখানেই তাঁর নিত্যসিদ্ধি।
আমরা বিমূঢ় বিস্ময়ে দেখেছি, চিন্ময়ের অন্তর পুরুষটি যেন নেমে এসেছেন এক অজ্ঞেয় গন্ধর্বলোক থেকে। তাঁর অন্তরস্থ এক অবিসম্বাদিত কবিপুরুষই যেন ছেয়ে আছেন তাঁর সত্তাকে আর স্বভাবতই তা তাঁর কাব্যিকগদ্য লিখনকে ঋদ্ধ করেছে।
প্রসঙ্গত বলি, কবিতা খুব কম লিখেছেন চিন্ময় যদিও তাঁর গদ্য স্বতন্ত্র কবিতাই । তাতে কি? তাঁর সমগ্র রচনাসম্ভারই তো একটি সম্পূর্ণ কাব্য বলে মনে হয়।
তাঁর গদ্য পড়লে মনে হয় তিনি এক সৌন্দর্যবিন্দু থেকে যাত্রা করে, সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে সৌন্দর্যের অভিমুখেই চলেছেন। চলেছেন ,”বিন্দু থেকে বিন্দু” ছুঁয়ে এক অনন্য ঐক্যের দিকে।
স্থূল বাক্যের অন্তরে যে ব্যঞ্জনা ও অশরীরী ভাব আছে চিন্ময় তাকেই সনাক্ত করতে চেয়েছেন। এ এক অলৌকিক বিজ্ঞান-সাধনা।।
চিন্ময় গতির উপাসক। তাঁর লেখায় পেয়েছি রূপের চলমূর্তি। রূপকে তিনি স্থির সমাধির বিষয় করে রাখেন নি। এই সচলতাই তাঁর লেখার আকর্ষণ।
আশ্চর্য এই যে, এই চলধর্মের ফাঁকে ফাঁকেই , কি যেন একটা ভাবের ঘোর , সুরের লয় ও মীড়ের টান , একটি নিবিড় শান্তরসের তটে গিয়ে মিশে যাচ্ছে। মৌন ও মুখর একসঙ্গেই চিন্ময়ের লেখনীতে কোলাকুলি করে আছে।
যত পড়ি ততই অবাক হই।
কিছুতেই যেন ঠিক করা যায় না এ লেখা গদ্য নাকি কবিতা ?
এত ছন্দিত , এত আবেশ, এত শাব্দিক মৃদুতা! অভাবনীয়!! —-
এই বইটি থেকে কিছু অংশ আস্বাদন করলেই একটি প্রত্যয় জন্মাবে।
কবি চিন্ময় একটা ট্রান্সের মধ্যে লিখেছেন এই “ঘুমের দরজা ঠেলে’—র রচনাগুলো।
শুরুতেই চিন্ময় গুহ স্বয়ং বলছেন——
” দর্শন আর সাহিত্যের সমুদ্রবেলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি এক জলকল্লোলকে ছুঁতে চেয়েছি যা কবিতার মতো, গদ্যের শরীরে মিশে গেছে।”
—-কবি-চিন্ময়ের এ এক বিস্ময়কর জার্নি !
এখানে তাঁর ট্রান্সই কি ঘুম? স্বপ্নময় অবস্থান? ঐ সম্মোহের জন্যই একটা ঘুমেল আবেশ লেখকের মধ্যে ভালো মিডিয়ার মতো কাজ করছিল। চিন্ময়কে কবি বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি।
কবি ঘুমের ভেতরেই দেখছেন —-“সুদূর ইতালির লেরিচির উপসাগরে ভেসে আসছে এক অবিশ্বাস্য রূপবান যুবকের শব।”——–
(ঘুমের দরজা ঠেলে/পৃঃ৯০)
ঠিক এইখানেই স্থিতি ও গতির দ্বন্দ্বে তৈরী হল কাব্যিক বৈপরীত্য , contrastivness…..মূল থীমের সঙ্গে গতি ও স্তব্ধগতির এক অদ্ভুত বিপ্রতীপতাকে লগ্ন করে দিলেন চিন্ময় এবং ব্যবহার করলেন একটি অলৌকিক উপমা—-“ঢেউয়ের মাথায় সাপের মণিতে ফসফরাসের মতো ঝলসে উঠছে তার মুখ ! এত রূপ?”―――
(ঘুমের দরজা ঠেলে /পৃঃ ৯০)
….. একে গদ্য নয় কবিতাই বলবো যদিও কবি স্বয়ং একে গদ্যকাব্য মনে করেছেন।
এই লেখার এই অংশটুকুতে ইংরাজ কবি শেলীর প্রায় সম্পূর্ণ একটা স্কেচ আমরা পাই। একখানা নিটোল মুক্তোর মত অক্ষরছবি। কবি চিন্ময় তাঁর মত করে সাজিয়ে দিচ্ছেন বক্তব্যকে—-
” গত ৪ঠা আগস্ট শেলি-র জন্মদিন ছিল। আর সেই দিনই ফরাসি কবি বোদল্যেরের সঙ্গে সমুদ্র-অভিযানে বেরিয়ে ইংরেজ কবি শেলির মৃতদেহকে আবিষ্কার করলাম আমি? অথচ শেলির মৃত্যুর সময় বোদল্যেরের বয়স মাত্র এক। “—-
(ঘুমের দরজা ঠেলে/পৃঃ৯০)
পরক্ষণেই চিন্ময়
বলছেন, ঘুমের মধ্যে এমন হয়। একটা ফিলোসফি যখন চূড়ান্ত কাব্য হয়ে ওঠে তখন তা কবি ও পাঠক উভয়কেই ড্রিমলাইক স্টেটে আটকে রাখে।
মানব মস্তিষ্ক অতি বিচিত্র । পর্বে পর্বে তার বিস্ময়। প্রতি পলে অনুপলে সে ডেটা সঞ্চয় করে অবচেতনের ঘরে। সে সব ডেটার-ই কিছু কিছু সেন্সর এড়িয়ে ঢুকে পড়ে স্বপ্নের প্রকোষ্ঠে। তারপর অন্য কোনো ডেটার সঙ্গে মিশে তৈরী করে দেয় একটি তৃতীয়ছবি। এজন্যেই চিন্ময়ের লেখায় পাই সাররিয়্যাল এর টাচ। অবচেতনের অবদমন থেকে বেরিয়ে আসে চিত্রকল্পরা,—- লেরিচি উপসাগরের ঢেউয়ের মাথায় সাপের মণিতে ঝলসে ওঠা ফসফরাসের মতো। সেই আলোতেই ঠিকরে ওঠে একটা প্রিয় মুখ, পুরোনো অভ্যাসের মত । জ্বেলে দেয় রূপের জৌলুসের অতিরেক। এ কোন্ মেটামরফোসিস যা সময়ের ও ভূগোলের ব্যবধানকে তালগোল পাকিয়ে দেয় মাদকতায়?
কি অসাধারণ রচনা ও তার উপস্থাপন দক্ষতা! যা দিয়ে চিন্ময় মুগ্ধ করে রেখেছেন পাঠককে।
এক অব্যক্ত মৃত্যুশিহরে চিন্ময় আনলেন পালতোলা “এরিয়েল”-এর বৈনাশিক ছবি। তিনি বললেন —-“প্রমিথিউস আনবাউন্ড-এর কবিকে কি জলের গুল্মগুহায় টেনে নিল দেবতার গ্রাস?”―――
ঘুমের দরজা ঠেলে/পৃঃ ৯০)
…. এখানে পেথস উঠল সান্দ্র হয়ে। সমুদ্রঝাঁঝিতে জড়িয়ে তলিয়ে গেলেন শেলি সবান্ধব।
এই দুর্মর ব্যথাময় ভাষ্য মনে করিয়ে দেয়—এই শেলিই তো কদিন আগে কীটসের অকাল মৃত্যুতে লিখেছেন এপিসাইকিডিয়ান। ইংরাজি সাহিত্যের ব্যুৎপত্তিদীপ্র ব্যক্তিত্ব, চিন্ময় গুহ, জানালেন —“সেই মৃত্যুকবিতা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে শিশির।”—ধ্বনাত্মক এই “টুপটাপ”,শব্দটি যেন শিশিরপতনের শব্দ হয়ে পৌঁছে গেল পাঠকদের শ্রবণে ও তন্ত্রীতে।এতক্ষণে শেলির চেষ্টাহীন মেলোপিয়া যেন স্থানান্তরিত হয়েছে চিন্ময় গুহের গদ্যকাব্যে। তাই বুঝি পাঠক হিসেবে আমার মনে হল শেষে ঐ একই শেলীয়-শক্তি গ্রস্ত করে ফেলেছিল আমাদের কবিকেও—- কবি চিন্ময়কে, কাব্য-গদ্যকার চিন্ময়কে।
চিন্ময় বারবার রাত্রির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। রাত্রিকালীন বিভিন্ন ইমেজ উপহার দিয়েছেন। ইম্প্রেশন অফ টাইম ব্যবহার করে চিন্ময় গুহ জীবনানন্দের মতোই তাঁর ইমেজারিকে সময়ের ফ্রেমে আটকেছেন। ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট দের মতোই চিন্ময়ের কাব্যে সময়ের ব্যবহার আবাক করে। রাত্রিই সেই সময়—-
“আমি এই মধ্যরাত্রে প্যারিসের পে ল্যাপেজ সমাধিক্ষেত্রে কী করছি?”
“অনন্ত রাত্রির বুকে সমুদ্রে ভাসমান কয়েকটি কাগজের স্তূপে আগুন জ্বলছে,”―――
(ঘুমের দরজা ঠেলে/পৃঃ৬)
“বালিকাঁকড়ায় কামড়ে ধরেছে আমার পা,” “ঘুমের মধ্যে টার্নারের ছবিতে আলো আর সমুদ্র ঝড়ের অনুপম রূপবিভা …..”
(ঘুমের দরজা ঠেলে?পৃঃ ৮৫)
“কেউ কোথাও নেই।এত রাতে জলের শব্দ? অশ্রুর মতো নিঃশব্দ সেই শব্দ মাঝরাতে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে।”―――
(ঘুমের দরজা ঠেলে/পৃঃ ৩১৫)
দেখেছি শেষ পর্যন্ত একটা গভীর আশাবাদে চিন্ময় গুহের লেখা শেষ হয়। মৃত্যুও সেখানে জীবনকে জেনে নেবার সুন্দর অবকাশ।
বাংলার কবিসাহিত্যিক,ইংরেজ কবি সাহিত্যিক, অ-ইংরেজ কবিসাহিত্যিক দের সঙ্গে চিন্ময় একাত্মতা খুঁজেছেন ঐ রাতের প্রেক্ষিত রচনা করেই।
সমগ্র “ঘুমের দরজা ঠেলে” বইটিতেই ঐ রাত এক অন্যতর আবহের মত ঘুরেছে ফিরেছে। সেপথে এসেছেন চিন্ময়ের ব্যক্তিগত অ-ব্যক্তিগত সব মানুষ যাদের স্মৃতি লেখক বহন করছিলেন চেতনে কিম্বা অবচেতনে—শেকসপীয়র, রবীন্দ্রনাথ, সিডনি, মার্লো,টলস্টয়, নীটশে, ভলত্যের , হ্যুগো, কোলরীজ, বোদল্যের….এক এক করে। এসেছেন কত কবি তাঁদের কবিতা নিয়ে। ব্যক্তিক সম্পর্কের চলনপথেও এসেছেন অনেকেই।
ঘুমের দরজা ঠেলে—(পৃষ্ঠা ৭২ থেকে ৭৮ )
Dadaism & surrealism এর কথা!….কি আশ্চর্য সুন্দর।।
চিন্ময় গুহর অনুবাদ-প্রসঙ্গ আমার এই আলোচনায় আসবেই। তাঁর অনুবাদ গুলো থেকে থেকে নাড়া দেয় আমাকে।প্রসঙ্গত বলতেই হয় চিন্ময় গুহের অনবদ্য অনুবাদের আমি মুগ্ধ ভক্ত।
অনুবাদক চিন্ময় গুহর নাগাল পাওয়া আমার পক্ষে কতটা সম্ভব, কিম্বা আদৌ তা সম্ভব কিনা তা ভাবতে ভাবতে যেমন মনে হল তেমন একটি “শুরুরকথা “…লিখলাম।
আসলে “ঘুমের দরজা ঠেলে” গ্রন্থটিতে অল্প স্বল্প যেটুকু অনূদিত অংশ পেয়েছি সেই তো মনে হয়েছে আয়তনে না হোক ওজনে পাহাড় সমান।
চিন্ময় গুহর অনুবাদের সবকটি বই আমার সংগ্রহে নেই। কিছু পড়েছি।
ইতিমধ্যে একটু মুখবন্ধ রচনা কি নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক হবে ? কোনো অনূদিত অংশ তুলছি না। সমস্ত বই একসঙ্গে পেলে সে কাজটি সম্পন্ন করাই শ্রেয়। পাঠক ইতিমধ্যে পড়েছেন এবং দেখেছেন “ঘুমের দরজা ঠেলে”—গ্রন্থখানিতে চিন্ময় গুহর অনেক অনুবাদ আছে। উদাহরণ কম হলেও পাঠকের ক্ষুধাহরন হবে তাতেই।
প্রথমেই বলি,
উপস্থাপনে ও মননে চিন্ময়ের অনুবাদগুলো স্বতন্ত্র। এই অনুবাদগুলো চিন্ময়ের কবিচিত্তের যেন আবিঃ বা দিব্যপ্রকাশের রূপ। অনুবাদকের মনীষার সঙ্গে অভিভাবকের শ্রদ্ধা ও প্রজ্ঞা যুক্ত নাহলে এমন সম্ভব হতো না।
অনুবাদ কি নিছকই ভাষান্তর?
আমার ধারণাতে, অনুবাদ হল দুটি প্রক্রিয়ার সম্পর্ক―――
প্রথমতঃ তা, রচয়িতা > রচনা > গ্রাহক সম্পর্ক
দ্বিতীয়তঃ তা, অনুবাদক > রচনা > গ্রাহক সম্পর্ক।
অনুবাদক কিন্তু একইসঙ্গে গ্রাহক এবং প্রেরক।
মূলতঃ অনুবাদকের ভেতরে সঞ্চারিত হয় প্রেরকের বার্তা।
অনুবাদককে বলা যেতে পারে “relay station”।যদিও কথাটি সীমিত অর্থে বললাম না। কেবল ক্রিয়াশীলতার পথটি চিহ্নিত করলাম।
এই Relay station―এর এক দিকে থাকে source text, source language
এবং source writer
আর অন্যদিকে থাকে গ্রাহক।
এখন অনুবাদের ক্ষেত্রে গ্রাহক কাকে বলছি, দেখে নিতে হবে।
সেই গ্রাহক হল অনুবাদকের নিজের দেশ। তাই নয় কি? যেমন ধরুন, ফরাসি সাহিত্য থেকে মণিমুক্তো তুলে এনে চিন্ময় তো আমাদের ,মানে বাংলাসাহিত্যকে অলঙ্কৃত করে দিচ্ছেন। এই ভাবে গড়ে ওঠে একটি অন্য অনন্য পাঠকৃতি ,নবীনতাই যার মূল আকর্ষণ। এই নূতনিত পাঠ তখন পরিণত হয় একটা ভিন্নতর সৃষ্টিকর্মে। সেটা ভাবেই হোক আর ভাষাতেই হোক কিম্বা এ দুয়ের সুসমঞ্জস কম্বিনেশনেই হোক , তা হয়ে ওঠে অন্যবিরল ট্রানস্ক্রিয়েশন।
চিন্ময় গুহর যেটুকু অনূদিত টেক্সট পড়েছি তাতে মনে হয়েছে,
চিন্ময়, source-text , source-language এবং source-writer―― এর কাছে পরম নিষ্ঠাবান।
যদি বলেন SourceText….এর কাছে এই নিষ্ঠার কথা আমি বুঝলাম কি করে???
তাহলে বলবো এর দুটো কারণ আছে――
১) ফরাসি অনুবাদক হিসেবে চিন্ময় ইতিমধ্যেই সর্বজন-স্বীকৃত।
২)তাঁর অনুবাদ পাঠ করলে প্রাণের আরাম হয়।
কোথাও বিন্দুমাত্র কোনো অসংলগ্নতা (oddity)থাকলে সংবেদনশীল পাঠকহৃদয়ে তা তরঙ্গকম্পনে ধরা দিতই।তা কিন্তু হয়নি। অনুবাদের মসৃণতাই বলে দেয় তার গুণাগুণ।
পাঠক বা গ্রাহকই যুগে যুগে সাহিত্যবস্তুকে ভালো ও স্থায়ী বলে সনাক্ত করেছেন।
অসাধারণ ধৈর্য সহিষ্ণুতা অভিনিবেশ না থাকলে অনুবাদ নিছক ভাষান্তর হতে বাধ্য। তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আমরা দেখেছি।
চিন্ময় কিন্তু অক্লেশে পার হতে পেরেছেন এই দুরূহ পথ। এখানে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন পরম রসিকসুজন।
বিশেষতঃ চিন্ময়, অনুবাদের কাজটি করতে গিয়ে জেনেছেন অনুবাদকের যন্ত্রণা ঝুঁকি ও বৈনাশিক আত্মলয়ের কথা।
তাঁর “ঘুমের দরজা ঠেলে”―অমূল্য গ্রন্থ খানির একটি অধ্যায়ে ব্যাপারটি অত্যন্ত সুন্দর করে বলেছেন চিন্ময়।
(পাঠকদের ,অধ্যায়/৪…পৃষ্ঠা-২৪ পড়তে অনুরোধ করছি।)
সেসব পড়ে পাঠক হিসেবে আমি কেবল স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম।
প্রসঙ্গত অরুণ মিত্রের অনুবাদ গুলোর কথা আসেই। সেগুলো যেমন শিল্পিত তেমনই সুন্দর। আমার মনে হয়েছে অরুণ মিত্রের দ্বারা চিন্ময় অধিকমাত্রায় প্রাণিত ,বিশেষত অনুবাদ বিষয়ে এবং কাব্যিক গদ্যশৈলীর ক্ষেত্রে।
আরো একটার উদাহরণ দিতে পারি—–আরাগঁ এর “আত্মহত্যা ” কবিতাটি….কি অদ্ভুত!
“ABCD
EFGH
IJKL
MNOP
QRST
UVWX
YZ”
একটি লেখায় কত আর বলা যায় ??? অনুবাদ অংশটুকু কেবলমাত্র ছুঁয়ে রাখলাম। পরে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইল।