কাব্যনাট্য
পাঞ্চজন্য কথা
বেবী সাউ
পটভূমি
(চারপাশে ভাঙা অস্ত্র। সূর্যও রক্তিম। কাটা হাত, মুণ্ডু ছিন্ন… শেয়ালেরা ফেরেনি এখনও…
অসহায় দৃশ্য ও দর্শক। অসহায় ন্যায়, ধর্মবোধ
ছনছন করে ওঠে রাজ্নীতি… কূটনৈতিকের ছল
দো-মনা কথার অর্থ বোঝাতে পারেনি স্নেহ, মায়া…
তাই প্রতিহিংসা আজ সবলের তলোয়ার হয়ে ওঠে…
গাণ্ডীবের তূণ খালি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে
এই কুরুক্ষেত্র, এই ভারতের ভূমি…
পার্থ এবং পার্থসারথি)
কৃষ্ণ, পার্থর প্রতি ঃ
কাকে তুমি ধর্ম বলো! কাকে তুমি ভেবে নাও আপনার!
যে তোমাকে বারবার হিংসায় আহ্বান করে?
যে তোমাকে মেরে দিতে চায় জতুগৃহ দ্বারে?
এসমস্তই ক্ষণিকের। মায়ার আঁচড়।
ঝেড়ে ফেল! ঝেড়ে ফেল! ওঠো! পার্থ! অস্ত্র তুলে নাও…
পার্থঃ (বিমর্ষ ভাবে)
তবুও পারিনা আমি…
সেখানে পথের খেলা, যেখানে মিশেছে প্রেম, ভ্রাতৃবোধ
একসঙ্গে সময়ের হাত ধরে হেঁটে গেছি পথে
স্নেহ ভালবাসা প্রেম বারবার আমাদের কথা বলে গেছে।
জনগণ আজ দেশ রাজনীতি ভুলে ছিছিকার দেবে…?
আমি তো এ রাষ্ট্র চাইনি কখনও! সম অধিকার বলে
ন্যায় ও সত্যের পথে প্রতিটি মানুষ
নিজেই দাঁড়াবে এসে আলো হাতে
ভালোবেসে… বুঝে নেবে নিজ ভালোটুকু
( অল্প মুহূর্ত চুপ)
এই অসহায়, এই মৃতপ্রায় দেশ আমি চাইনি কখনও
যার চাকা বসে গেছে…
কৃষ্ণঃ
এ চাকা আসলে মহাকাল।
সময় ঘনিয়ে আসে
চারপাশে কুকুরের, শকুনের ঠোঁটে দেখো মৃত্যু হাসে
এ সময় প্রকাশের। নিজ অধিকারটুকু
বুঝে নাও শুধু ।
তারপর সরে পড়। অর্থ, ক্ষমতার প্রতিপত্তি…
নিজে প্রকাশিত হও…
নিজেকে প্রকাশ করো! তুলে ধরো মূর্খ মানুষের কাছে
তারাই সামান্য জাদুবলে
তোমাকেই ঈশ্বর সাজিয়ে
হাততালি দেবে! পুজো দেবে। প্রসাদেও তুলে
দেবে নিজ মাথা খুলি…
এগোও অর্জুন! তুলে নাও গাণ্ডীবের ছিলা
বধ করো এই ভারতের ভূমিকায় অবতীর্ণ গোলাম কর্ণকে
রথ ভঙ্গ, সারথিও মৃত… গতি নেই চাকা বসে গেছে…
অর্জুনঃ
যার রথ নেই! অস্ত্র নেই। অসহায় বেচারা নাবিক
তাঁকে এ মুহূর্তে খুন করি? রণনীতি ত্যাগ করি?
অসম্ভব! অসম্ভব!
কৃষ্ণ-
কেন অসম্ভব?
অর্জুনঃ
ধর্মের কর্মের পিতা! তুমি পুজো পাও রক্ষক হিসেবে… পৃথিবী পালক কৃষ্ণ
এই কথা তুমি বল!
কৃষ্ণ-
বুঝিনি এখনও
অর্জুনঃ
অস্ত্র নেই যাঁর কাছে…ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর…
কৃষ্ণ-
তুমি ভীরু। চিরকাল পলায়ন করেছ সবখানে।
অর্জুনঃ
ভীতু নই আমি! আমি বীর! বীরধর্ম সরাসরি মোকাবিলা করে
সত্যের জন্যই লড়ে আজীবন
আজ তাঁকে ভীরু হতে বল! কারুপুরুষের কার্যে!
কৃষ্ণঃ
হাসালে অর্জুন! ধর্ম কাকে বলে? কাকে বলে সংসারের মায়া!
আজ তুমিও মূর্খের মত কথা বল
এই ভারতের বুকে বহুকাল ধরে
বিশ্বাসের কোনও মূল্য নেই
কোনও রাস্তা নেই খোলা
ভাইয়ে ভাইয়ে জ্ঞাতিদের
রক্তে ভিজে গেছে ভূমি
রক্ত দিয়ে আঁকা এই সীমারেখা,মানচিত্র!
আবার ভাইয়ের রক্তে মুছে গেছে সে নো বর্ডার ল্যান্ডস…
আমাদের ধর্ম আজ শুধু হত্যা লীলা, খেলা।
গোলকিপারের মত হও…
ছিটকে পালাবে শত্রু, ন্যায় ধর্ম পরে হবে…
আগে রাজ্য, সিংহাসন তারপর এইসব নীতিকথা
নিজেরই প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কোনও পথ নেই…
নিজেকে প্রকাশ্য ছাড়া কোনও ধর্ম নেই
নিজেকে ঈশ্বর ভাবো, ভাগ্যবিধাতার মত
তুলে নাও কোটি কোটি ভারতবাসীর ভাগ্যের দায়িত্ব…
ওঠো, এই নাও অস্ত্র! হত্যা করো ওই অসহায় ভারতের জারজ কর্ণকে…
অর্জুনঃ
কর্ণ বীর! কর্ণ সহযোদ্ধা! সামান্য রাজ্যের লোভে
সামান্য ক্ষমতা লোভে আজ অসহায়ভাবে বধ করি!
কিন্তু সনাতন ধর্ম… শাশ্বত মন্ত্রের ধ্বনি… সব মিথ্যা হবে?
কৃষ্ণঃ
আমি ধর্ম! আমি ভাগ্য! এ ধর্ম – অধর্ম বোধ তোমরাই দিয়েছ আমাকে
আমিই শাসক আজ! মহানির্দেশক…
মেনে নাও অর্জুন তুমিও… যা নির্দেশ করি
অধিকার পাবে তুমি। রাজ্য পাবে তুমি। শাসন ক্ষমতা
শাসন নিয়মে নেই, শাসকের ধর্ম নেই কোনও
হত্যা হত্যা আর হত্যা…
রক্তপথে হেঁটে যাও… বীর বলে মেনে নেবে সমগ্র ভারত…
অর্জুনঃ ( স্বগত)
কোনদিকে যাব আমি! কোনওদিকে পথ নেই
অসহায় চারপাশ… আমার ফেরার পথ বন্ধ
দিনরাত কানে বাজে মানুষের ক্ষুধা… ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে গণতন্ত্র…দেশ, রাষ্ট্র, নারী…
বিশ্বাসের সঙ্গী নেই কেউ!
প্রিয় পুত্র মৃত! সখা পরিজন মৃত। সুভদ্রার চোখে অবিরল ধারা…
আমাকে কে বলে দেবে পথ! এই হত্যা, এই খুনোখুনি খেলা…
ধর্মের রক্ষক হয়ে ক্ষুধার্ত ভক্ষক—
কাকে মেনে নেব! কাকে তুলে দেব পুজাপাত্র! বিশ্বাসের ডালি!
প্রেম নেই, প্রীতি নেই এ কোন কৃষ্ণ!
একে তো চিনিনা আমি… যাঁর শুধু ক্ষুধা আর ক্ষুধা…
দেশ যাকে নির্বাচিত করে, সেই আজ হত্যা করে সংবিধান! গণতন্ত্র!
( হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে)
মধুসূদন! দেখাও পথ!
কৃষ্ণঃ ( প্রতিহিংসার হাসি হেসে, আদেশের সুরে)
অর্জুন! আমিই পথ। আমিই আশ্রয় দাতা।
এই পথ পার্থ! রক্ত ধোয়া! এই পথে হেঁটে যেতে হবে তোমাকেও
এই সনাতন রীতি! এই ধর্ম! এই সত্য!
আর এ পথের নাবিক আমিই
আমার দেখানো পথে শুধু হেঁটে চল! আসলে সমস্ত মায়া…
কেউ কারো নয়… হাঁটো… হত্যা করো বিধর্মী, বিশ্বাসহীন আত্ম পরিজনদের
রাজা হবে! এই দেশ, রাষ্ট্র তোমাকেই নাচবে মাথায় তুলে
তোমার সমস্ত বাক্য বেদবাক্য ভেবে মূর্খ জনগণ
পুজোর আসন পেতে দেবে…
আর তুমি মুখোশের দরবারে পেতে দেবে তোমার নায়কতন্ত্র…
কিন্তু তার আগে প্রস্তুতির প্রয়োজন… হত্যাকারী হও, ধ্বজাধারী হও…
রঙ মাখো শরীরের আনাচে কানাচে… মেনে নাও আমাকে…
এসো যোগ দাও…
তারপর হত্যা করো এ জংধরা, মৃতপ্রায় ভারতবর্ষকে…
দ্বিতীয় পর্ব
(সূর্যাস্ত হয়েছে বহুকাল আগে। চারপাশে নিকষ আঁধার। শেয়ালের চোখ জ্বলে। কুকুরেরা করে চিৎকার মাংসের লোভে। তবুও এইই প্রকৃত সময়…)
অর্জুনঃ ( ভয়ার্ত ভঙ্গিতে)
ওঠো কর্ণ! ওঠো!
আমাদের ধ্বংস আজ বেজে ওঠে ক্ররতার স্বরে
আমাদের চারপাশে পিশাচেরা ন্যায় নীতি ভুলে
হত্যাকারী হয়ে ওঠে। গোপনে এসেছি ভ্রাতা
তোমাকে জাগাতে। ওঠো। এই নাও পানীয়ের জল
পান করো। তারপর উঠে বসো! রথ ছেড়ে দাও… চাকা বসে যাক
আবার গড়বো নতুন ভারত… গণতন্ত্র… এই নাও রক্তের নিশানা
শত্রুর হত্যায় ধৌত! নাও ভর দাও এই পতাকায়
ওঠো! জোট বাঁধি চল! দশজন একত্রিত হলে
আমারাই জিতে যাব! মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে
আর গণতন্ত্র, ভোট, রাজনীতি…
কর্ণঃ
হা হা! হাসালে অর্জুন! কার প্ররোচনায় এসেছ এই অসহায় কর্ণের সমীপে!?
যার গতি নেই, রথ নেই। অস্ত্র নেই।
তাকে আজ দয়াপরবশ হয়ে জাগাতে এসেছ!
তোমাকে বিশ্বাস? পার্থ, আর কত নীচু হবে আর কত ছোট হবে…
কৃষ্ণের পদলেহন শেষ বুঝি?
আমি কর্ণ… কারো দয়া! দাক্ষিণ্য চাইনা আমি!
যতক্ষণ শ্বাসটুকু আছে… যতক্ষণ এ দেহ জীবিত
জনগণ হয়ে, গণতন্ত্র নিয়ে বাঁচতে চাইব আমি।
সম অধিকার দিয়ে যাব… শূদ্র ও ব্রাহ্মণে
ফিরে যাও… পার্থ… ফিরে যাও…
এই মুখোশের রাজনীতি চাইনা কখনও…
অর্জুনঃ
ভুল সব ভুল কর্ণ! দেশ আজ বহিরাগতের
এই রাজনীতি, রণনীতি বাইরের শত্রুদের নিরুপণ করা
দেশে কেনাবেচা, বন্টন সব তো তাহাদের হাতে
আমাদের দেশের কৃষক মৃতপ্রায় আজ… খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই
একমাত্র আত্মহত্যা আছে… তাই পতঙ্গের মত নিজেই নিজের মৃত্যু বেছে নিচ্ছে জনগণ
অসহায় তারা, পাথরের মূর্তি পুজো করে…
ভাবে সেই মূর্তি প্রাণ পেয়ে, জান পেয়ে বাঁচাবে তাদের
অথবা মুখোশধারী নেতাদের বলে বাঁচবে অধিককাল
তাদের বিশ্বাস আছে… কানাকড়ির বিশ্বাস… অন্য কোনও অস্ত্র নেই…
কে জাগাবে আজ!
ওঠো কর্ণ… হাত ধরো…
কর্ণঃ
জানিনা কে সত্য! কার নীতি সত্য! বিশ্বাস হয়না আর কাউকেও
তুমিও অর্জুন জানি না কোন লোভে পড়ে এই কূটবুদ্ধি খেলো…
অর্জুনঃ
ক্ষমতার লোভ বড় ভয়ঙ্কর কর্ণ!
আরও ভয়াবহ এই রাজনীতি, রণনীতি
মুখোশের কথা আজ পণ্য হয়ে ঘোরে…
বড় অসহায় এই দেশ, জনগণ
নিজেই নিজেকে বিক্রি করে
আর পণ্য ভেবে ক্ষমতালিপ্সুর দল
কাড়াকাড়ি করে, শকুনের মত, প্রণামী খুচরো
আমিও ছিলাম অন্ধ এতদিন। আজ চোখ খুলে গেছে
ঘৃণ্য শাসকের রূপ ধরে বসে আছে কৃষ্ণ, ভক্ষকের বেশে
নিজেকে ঈশ্বর ভাবে সেও, নিজেকে ক্ষমতা…
কর্ণঃ
এতদিনে এতটা সময় পর, বুঝেছ তুমিও!
যাক! সত্য তবে প্রকাশিত হল…
কিন্তু আজ সময় যে অসহায় বড়!
তাকে কে জাগাবে মহাকাল!
তারচেয়ে ধ্বংস হয়ে যাক সব। মৃত্যুর করাল ছায়া
গ্রাস করে নিক ওই যুবতীর দেহ।
শিশুরা আগেই মৃত
অতীত বিকৃত, বর্তমান বলে কিছু নেই… ভবিষ্যতে কালো ছায়া ভাসে…
মুছে যাক! মুছে যাক!… তারপর নতুন আলোর খোঁজে
জন্ম নিক দেশ, রাষ্ট্র, ভাষা…
যে দেশের ঈশ্বর নেই কোনও, ধর্ম নেই… শুধু মানুষের ঢল…
অর্জুনঃ
জানি সব মৃত! জানি দেশ নেই,জনগণ নেই…
তবু মনে আশা জাগে…
যে দেশের জন্য এত রক্ত… এত তাজা প্রাণ ঝরেছে অকালে
শুধুমাত্র সেই স্মৃতি নিয়ে জেগে ওঠা যেতে পারে…
কিন্তু… কিন্তু…
কর্ণঃ
বহুদিন আগে এসব বুঝেছি আমি…
হয়ত এ বিধিনির্ধারিত… এইই হওয়ার ছিল…
এ ভূমি বিপ্লব শূন্য… কে তাকে শেখাবে আজ তলোয়ার খেলা…
কে তাকে বোঝাবে আজ নিজ অধিকার কেড়ে নিতে হয়!
ফিরে যাও তুমি! আমি ক্লান্ত! পরিশ্রান্ত আমি…
অর্জুনঃ (স্বগত বিলাপ)
নীরবতা ভাষা দেবে? নেশাখোর রাত ভেঙে যারা হেঁটে যায়…
ওপাশে মেঘের রাজ্য, ওপাশে নক্ষত্রদের আগুনের স্বর
আমাদের হাত নেই, পাও নেই… অথর্ব ও পঙ্গু
আমরা অপেক্ষা করি কেউ এসে ভেঙে দিক দরজা জানালার গ্রিল
বন্দুকের নল তুলে কেড়ে নিক এই কৃষিজমি, জলাশয়…
আর তাদেরকে ঈশ্বর, দেবতা মেনে তুলে দিই নিজের সর্বস্ব…
কর্ণঃ ( মৃত্যুতে আচ্ছন্ন আজ ভারতের ভূমি/ আধামৃত,সুষুপ্ত সময়ে স্বপ্ন আসে/ ভেসে আসে দ্রৌপদীর ছায়া)
তারপর আমরা হাঁটবো চাঁদ! ঘর ভেঙে গেছে, ছাদ নেই…
পথও নেই। রূপবতী আকাশের নীলে আমরা মেলাব হাত
তখনই হাতের পরে হাত পেতে হেঁটে যাব বিপ্লবের দিকে…
সমস্ত প্রেমের কথা ছড়াবে রক্তের দাগ গোলাপের মত
জ্যোৎস্নার মায়াবী ফাঁদ ভেজাবে আকুল হৃদপিণ্ড, ফুসফুস
ধ্বনিতে ধ্বনিতে মিশে যাবে অলিখিত বিরহমঙ্গলকাব্য
আরও ফিসফিস স্বরে দেখাবে গোপন সুড়ঙ্গের জাদু! তার
ঘাস ও রোদের রঙ কর্পোরেট দুনিয়ায় নিলামে চড়াবে
অর্জুনঃ
তবে কথা হয়ে ভাষা হয়ে শব্দ ও ধ্বনি মৃদু বালিকার মত
চই চই সুরে ডাক দেবে হাঁসেদের! আর মাঠের ওপার থেকে
আমানি দু’মুঠো তুলে দেবে মুখে স্নিগ্ধ নরম আদুরে মুখ
এখানে বিপ্লব নেই, এখানে এখনও জন্মায়নি সিরিয়াও
তারাফেণী নদীটির কাছে এখনও বেড়াতে আসে বুলবুলি
চিল্কীগড় রাজবাড়ি হেসে ওঠে জ্যোৎস্নার স্রোতে
ইহুদির মেয়েটি কী এই পথে,পথ ভুলে দাঁড়াবে দুদণ্ড!
অধ্যুষিত ভূমি… এলাকায় লোধাদের বাস… শেয়ালের ডাক ভাসে
কৃষ্ণঃ
যেদিকে শত্রুর রাজ্য, যেখানেই মৃত ভাইয়ের শোক জমা
চিলেদের লোভ থেকে সেই রাজ্য সেই ভূমি কাশ্মীরের দেহ
আমরা ছিনিয়ে নেব! হাজারো মানুষ মরে পতঙ্গের মত
সেখানে ভোরের সূর্যে ঝরে ঝরে পড়ে রক্তাক্ত শরীর
বরফও রঙিন! লাল চিহ্ন বুকে নিয়ে বারোমাস হাঁটে লুনি
রক্ত দাগ কৃষিক্ষেতে ফোটা ফোটা… ফুল হয়ে ফুটে থাকে
ওপাশে মাতাল রাত নগ্ন দেহ, নগ্ন নারী ভাসাবার দিনে
যব বজরার শবে সাজিয়ে তুলেছি অধিকার…দেশ রাষ্ট্র
(তারপর হাত তুলে আদেশ ভঙ্গিতে)
অর্জুনকে হত্যা করো..
গোপনে খাওয়াও শেয়ালে কুকুরে…
তৃতীয় পর্ব
দৃশ্য পালটায়, পালটায় গতি ও প্রকৃতি
নিবিড়তা মিশে যায় আলো ও আঁধারে
ক্ষণজন্মা তরুণের দল ডেকে তোলে ঘুম
এপাশে ওপাশে খেলে মৃত্যু, জন্ম
তারমাঝে অর্জুনের হার ঘোষিত হয়…
নত ভাবে ধুলোবালি, সফরের রঙ
শহর ঘুমিয়ে পড়ে। নিশিডাক হাঁটে
কোথাও কী জেগে আছে পাড়া
অনিয়ম ধার নিয়ে জাগাবে তাকেই…
আর রণক্লান্ত, পরিশ্রান্ত রাধেয়র রথ
মিশে গেছে কালের বলয়ে
কুরুক্ষেত্র, তার মাটি সেই দাগে ভারাক্রান্ত
অর্জুন হতাশা, দৈন্য… মুখ নীচু করে আছে
চারপাশে কেউ নেই তাঁর…
কৃষ্ণ আজ রাষ্ট্র, দেশ, অধিকার
ক্ষমতা চূড়ান্ত
রাষ্ট্রনায়কের বেশে বিদেশ ভ্রমণে গেছে
দ্রৌপদীঃ ( যেরকম হেরে যাওয়া প্রেমিকের প্রেমিকারা হয়…
ধীরে ধীরে দ্রৌপদীর ছায়া ভেসে ওঠে)
কোনদিকে যাবে তুমি, প্রিয়তম! কোথায় বান্ধিবে ঘর ছায়ানীড়
এখানে রাতের চাঁদ ইস্পাতের মত… অধিকার লোভী, তীক্ষ্ণ
এখানে নদীর জল আর্সেনিক মেশা…পানশালা থেকে ভাসে
আর্তচিৎকার… সহজে খুন হয় ভ্রাতা, বোন, আত্মীয় স্বজন…
এসব সহজ বড়… মেনে নাও… এই বিপ্লবের দিনে
কিছুতো করার নেই… এই নাও ঠোঁট, তৃষিত, চুম্বন করো…
অর্জুনঃ
ওই দেখো, হায়নার উল্লাস জেগেছে বনে
ওই শোনো, রাতের তারারা আজও আলোময়ী
নির্বাচন কমিশন মানি না, মানিনা এ বিকৃত রাজনীতি
একদিন ফেরাবো ঠিক, উড্ডীন সময়ে
অধিকারবোধ, গণতন্ত্র, দেশ, রাষ্ট্র…
প্রেম, তুমি শুধু সাথে থেকো! ভালোবাসাটুকু দিও! পথ আমি খুঁজে নেব…
চতুর্থ পর্ব
ফিসফিস জনপদ মৃত পাতাদের শব্দ ভাসে
শুনশান পথে ভেসে ওঠে ইঙ্গিতের শব্দ ধ্বনি
জড়ো হয় তারা, তারা জড়ো হয় দিকে দিকে
মাংস নেই, হাড় দিয়ে বানিয়েছে অস্ত্র
শরীরের খাঁজে পোষে বোমা, বারুদের গন্ধ…
জানালার দিকে চেয়ে থাকেন দ্রৌপদী…
গলিপথে হেঁটে যায় সশস্ত্র বাহিনী…
অস্থির সময় কাল
মৃত্যু যেন ওৎ পেতে আছে রাজপথে
ইতস্তত, দিকভ্রান্ত…
অর্জুনঃ ডকুমেন্ট গুলো কোথায় যে রাখলাম…
দেখেছ দ্রৌপদী?
দ্রৌপদীঃ কথা দাও! ফিরবে এ ঘরে…
তারপর সব দেব… প্রেম দেব, আলিঙ্গন
শুধু কথা দাও…
অর্জুনঃ (মৃদু হেসে)
সুখী হব আমি, যদি ফিরে আসি…
জানো দ্রৌপদী! কর্ণের ছায়া আসে রোজ অন্ধকারে
চোখ নেই তাঁর, ফলত দৃশ্যও নেই
ঘুণ ধরা দেহ… উই পোকা চোখের কোটরে
বীরপুরুষের রূপ দেখে শিউরে উঠেছি…
কী যে চায় রোজ আমার সকাশে
দ্রৌপদীঃ
সেই কর্ণ! সুতপুত্র! ম্লেচ্ছ হীন!
আমার হাতের লোভে যে শুধু আফশোষ করে গেল!
তাকে তুমি বীর বল! সেই আসে? ও তো মৃত!
(অথচ স্বগত ভাবে)
মৃত মানুষেরা স্বপ্নে আসে কেন! তবে কি… তবে কি!
(সংশয় কালে স্মরণ করে শনিমন্ত্র, হনুমান চালিশা)
( আর তখনই বাইরে থেকে ডাক ভেসে আসে)
অর্জুনঃ
যেতে হবে… যেতে হবে যাই…
আমার ভারত ভূমি কাঁদে!
কর্ণ আজ তুমি সত্য বড়…
তোমাকে ভারত মনে হয়… তোমার কালের চাকা ছিল ইঙ্গিতবহন কারী
আমরা অবুঝ… আমরা কখনও ক্ষমতাকে ছেড়ে ভাবি না নিজেকে
কী তুচ্ছ সংযম এই… চিরটা সময় শুধু লোভে পড়ে রাজ্য চেয়ে গেছি
আর রাজার আসন
দেশ মানে আমাদের কাছে সামান্য জমিন। মাটি। জনগণ নয় কখনোই
তাই এই দ্বিধা… এত দ্বন্দ্ব…
প্রবল ঝড়ের বেগে সব উড়ে গেছে…
কূটনীতি খেলা করে দেশের সর্বত্র
সহজ মাথায় ঘোরে ভ্রান্ত ধর্ম, ভ্রান্ত বোধ… ভ্রান্ত সামাজিক চিত্র
কে তাকে ভাঙবে আজ! কে যে তাকে দেখাবে সুদূর ভবিষ্যত
কৃষ্ণঃ
বেঁচে আছে! থাক…
বিরোধিতা না হলে খেলাতে মজা নেই
আমার তো কাজ মিটে গেছে। প্রয়োজনে কাছে টানো তারপর ছুঁড়ে ফেলে দাও
রাজনীতি বোঝেনা আবেগ মায়া দয়া
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা কাজ তার…
কর্ণ মৃত… সমস্ত বিরোধী শক্তি মৃত
যুদ্ধে নামবে কে! কার এত সাহস কৃষ্ণকে অবজ্ঞা করবে!
হা হা হা হা…
পাগলের বেশে
অর্জুনঃ
শূন্যতার অস্ত্র জানি আমি
হে বীর সকল আমাকে সাহায্য করো
সবার সাহায্য নিয়ে একজোট হতে চাই
ভেঙে ফেলে দিতে চাই…এই সহিংস নীতির ছলা কলা…
একজোট হও একজোট হও…
(ফিসফিস শব্দ ওঠে… ঘরে বাইরের শব্দ, হাঁটাচলা ভেঙে কারা যে মিলিয়ে যায়
কালের গভীরে…)
কবিতার মত ভেসে ওঠে কান্নার আওয়াজ…
কারবালার প্রান্তরে ভাসে তৃষ্ণা…
ততক্ষণে অর্জুন নিহত…ফেনা ওঠে মুখে…
ধ্বজাধারী শাসকের দল হেঁটে আসে… জয়ধ্বনি দেয়…শকুনের চোখ নিয়ে জরিপে রেখেছে চারপাশ…
আর সেই অন্ধকার দিক থেকে উঠে আসে জন্ম… গান…)
কিশোর বয়েস তার অস্ত্র তুলে নেয়… ভালোবাসে দেশ, রাজনীতি
সব অন্ধকার হয়ে যায়। আস্তে আস্তে যখন আলো ফুটে উঠছে তখন শোনা যাচ্ছে নানান শব্দের ক্যাকোফনি। আকাশবাণীর আওয়াজ, উইন্ডোজ-এর শব্দ, বাস ট্রাম মেট্রোর অ্যানাউন্স। নানান খবর-এর মন্তাজ, বিমানের শব্দ, সাইরেনের শব্দ। জয় শ্রী রাম- আল্লা হো আকবর ধ্বনি। তার পর সব শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকে। একজন তরুণ পদচারণা করতে করতে আসে। আলো পড়ে তার মুখের উপর। তিনি পরীক্ষিৎ।
পরীক্ষিৎ ঃ
দেখেছি যুদ্ধের হৃদয় কিছু নেই, ওই তো পড়ে লাশ, ওই আগুন
মানুষ মরে যায়, ক্ষমতা বেঁচে থাকে; অন্ধকার তার হে প্রিয়জন
ভাবে সে শুধু কেন অপেক্ষায় আছে, কেন এ হিংসার অন্ত নেই
শাসক শাসকের রক্ত নিয়ে যায় মানুষ চিরকাল শাসনাধীন
কে তুমি ধর্মের, কে তুমি যুদ্ধের, কে তুমি ক্ষমতার ধ্বজা ধর
মানুষ মরে যায়, ক্ষমতা টিকে থাকে, এ কোন ধর্মের কোন শাসন
ওই তো পড়ে আছে ভারতবর্ষের মৃত্যু, মৃতদেহ, মা ভাই বোন
ওই তো পড়ে আছে মানুষ, তারা কোনও ধর্ম চাইনি তো, অধর্মের
লাশের জনাদেশে কেউ তো ফুল নয়, কেউ তো নয় কোনও কবর হায়
অন্ধ লিখে যায় অন্ধ ইতিহাস, মানুষ ভাবে জয় অবতারের
আবহমান তবে মানব, ক্ষমতার? আবহমান তবে গুপ্ত মন?
আবহমান তবে রক্তনদী ধরে সভ্যতার সেই আর্তনাদ?
কোথায় মানুষের দুঃখযন্ত্রণা, কোথায় মানুষের স্বপ্নগান
কোথায় মানুষের জীবন দাগ কাটে, কোথায় মানুষের চোখে বাগান
আমি তো আঁধারের কেবল ডাক শুনি, হৃদয়ে কে যে কাঁদে কে যে আবার
আমাকে করে তোলে নিপুণ মানবের হৃদয়ে শুয়ে থাকা শিশুঘাতক
আমাকে করে তোলে ধর্মব্যবসায়ী, আমাকে করে তোলে পোড়া মানুষ
আমাকে করে তোলে প্রমোদ তরীখানি, আমিই নাবিকের ভবিষ্যৎ
আমিই দুর্লভ প্রেমের কবিতায় লিখেছি চিঠিখানি, শান্তি চাই
আমিই ঝাঁপ দিই, নতুন অধিকারে কেড়েছি মানুষের খোলা আকাশ
আমাকে ক্ষমা করো, মানুষ, ক্ষমা করো, হে শিশু ক্ষমা করো, হে নদীজল
ক্ষমতা পুড়ে যায়, ক্ষমতা জেগে ওঠে, মানুষ পড়ে থাকে মাটির গায়ে
যুদ্ধ বেঁচে ওঠে, যুদ্ধ করে খায়, যুদ্ধ শ্বাসরোধী, ক্ষমতা নীল
বিষের ভিতরেই রয়েছে স্বপ্নের অমৃতের কথা হে ঈশ্বর
এ দেশ আমি গড়ি, এ দেশে আমি মরি, এ দেশ নই আমি, এ দেশ নই
কান্না ভেসে যায়, কান্না পড়ে থাকে, জীবন দুঃখেই আবহমান
আলো ফুটে উঠছে একটু একটু করে। আলো ফুটছে। পাখির গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। পরীক্ষিৎ তাকান সামনের দিকে
পরীক্ষিৎ ঃ
কৃষ্ণ, তোমাকেও জানাই অবসাদ। ক্ষমতা মৃত্যুর দোসর আজ।
মানুষ একদিন হবেই মুখোমুখি। সেদিন দেখা হোক, হে রণসাজ
মানুষ ও ক্ষমতার যুদ্ধে শান্তির ধর্ম কার হবে, দেখাই যাক।
আগামী প্রস্তুতি আবার শুরু হোক, শান্তিকল্যাণ বন্ধ থাক।
এখনও রক্তের ফিনকি গায়ে লেগে। পিপাসা লেগে আছে জীবনে তাই।
তোমার অবতার তোমাকে খাক তবে। আমার অবতার এখন চাই।
মানুষ মানুষের নীরব অবতার। মানববন্ধনে সুপ্রভাত।
আঁধার কেটে যাক। অনেক যুগ হল।
আসুক আলো তবে। মেটাব রাত।
লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক