
একটি একমাত্রিক দেখা
ধৃতিরূপা দাস
বিন্দু নয় রেখা নয় দেবদাস আচার্য শোভন পাত্র আদম ১৫০/-
১
অস্তিবিন্দু
‘বিন্দু নয় রেখা নয়’— একটা বইয়ের নাম। শুনে প্রথমে সন্দেহই হয়। বিন্দু, রেখা ব্যতীত আর কী! এর উত্তর পাওয়া যায় দেবদাস আচার্য প্রণীত বইটার নাম-কবিতায় এসে পৌঁছলে—
“প্রতিদিন একটা করে ফুরিয়ে
ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে ফুরিয়ে চলেছি
সাদা পাতা, বিন্দু নয় রেখা নয়
একা মাঝি নৌকা বায়,দেখি
একা হাওয়া বয়ে যায়,
শিউলি ফুল কুড়ায় বালিকারা…” (কবিতার নাম- বিন্দু নয় রেখা নয়, পৃষ্ঠা ৫৪)
এখানে দেখা যায়, কেউ,হয়ত আরেকটা বিন্দু বা রেখা, ডায়েরি ছিঁড়ে ফুরিয়ে চলেছে স্রেফ সাদা পাতা, বিন্দু নয় রেখা নয়। বোঝা যায়, আসলে বিন্দু এবং রেখাই, বহুমাত্রিক অস্তিত্বে বহুমাত্রার প্রকাশে বিম্বিত, যার এতোটুকুও, ওই একজন, ফুরিয়ে ফেলতে পারছে না। এই বুঝটা যে নিতান্ত অযৌক্তিক নয়, প্রমাণ করে কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের ওই চূড়ান্ত শেষ লাইনের পরেও, আরও একটা গোটা স্তবকের উপস্থিতি, যেখানে ওই ‘মাঝি’ ‘হাওয়া’ ‘একা’, তারপরেই শিউলি ফুল কুড়ানো বালিকারা, আর মাঝপথে কমা দিয়ে একটু থেমে ‘দেখি’— এই সমস্ত পড়ে আছে। একটা অস্তিত্ব তার ফুরিয়ে চলার পথে দেখছে রোজ পড়ে থাকছে অগণন স্থান কাল পাত্রের যোগাযোগ, তৈরি হচ্ছে অস্তিত্ব, বা তার প্রতিবিম্ব, বা তার সম্ভাবনা।
এই যোগাযোগ কে ঘটায়? নিশ্চিত করে বলা না গেলেও তাকে একটা কবিতাই ধরে নেওয়া যায়। আচার্য লিখছেন —
টুকরো কাগজে লেখা কবিতা
জমল না বলে
হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম
হাওয়া সেটি কুড়িয়ে নিয়ে
উড়তে উড়তেই
পড়ে ফেলল
পড়ে ফেলার পর
হাওয়া
নাচতে শুরু করল
আহা, কী নাচ!
গাছের পাতা ঝোপের মাথা
কুয়োর ব্যাঙ, ফড়িংয়ের ঠ্যাং
হাওয়ার তালে তালে
সবাই নাচল
বেশ জমে গেল ব্যাপারটা
এরপর থেকে কবিতা লিখে
হাওয়ায় উড়িয়ে দিই
এবং
জগতের নাচ দেখি
(কবিতার নাম- উড়ে যা… পৃষ্ঠা ২১)
কী অসম্ভব রোমান্টিক স্পর্ধা এই উচ্চারণে! মনে পড়ে, খুব জনপ্রিয় একটা সিনেমা, Lucy তে, Scarlett Johansson অভিনীত চরিত্রটি, নাম Lucy, মগজের শত শতাংশ ব্যবহারে সক্ষম হবার পর, তাকে দেখতে পাচ্ছে না কেউ, অথচ বন্ধুর মোবাইলে সে লিখছে, “I am everywhere.” তার শরীরের সম্পূর্ণ বিশ্লিষ্ট হয়ে তখন মিশে গেছে সবকিছুতে, অথচ তার একক চৈতন্য তখনো জাগ্রত। উল্লেখিত উচ্চারণ যেন তেমন কোনও চূড়ান্ত মুহুর্তের প্রকাশ।
এ সূত্রেই আরেকটা কবিতা—
“চোখে পড়ল
এক ফালি রোদ
সুপুরি গাছের পাতার পোষাক পরে
সুপুরি গাছের ডালে বসে
হাওয়ায় দোল খাচ্ছে
অন্য একটি পাতা থেকে
তাকে ধরার জন্যে
অন্য একফালি রোদ
হাত বাড়াচ্ছে
হয়ত ওদের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে
সর্বত্রই দেখি আমি এ প্রকার
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে
সম্পর্কের স্পৃহা
জীবে-জড়ে
অখণ্ড ও অনিঃশেষ
বহমান”
(কবিতার নাম – পাতায় পাতায়, পৃষ্ঠা ২০)
এই যে ‘সম্পর্কের স্পৃহা’, যা হয়তো সৃষ্টির মূল, হয়তো তাকে কবিতাই বলতে চাইছেন এ গ্রন্থকার, প্রচলিত এনট্রপির ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসে না কি! বিশৃঙ্খলার উৎসে যে শৃঙ্খলা– এ যেন সেই উৎসমুখের ভাষাটিকে মুখে করে এনে মা পাখি ভরিয়ে দিচ্ছে ছানাদের হাঁ। অনুদিত হচ্ছে এক ঈশ্বর-অণু—
“এই আমি ঈশ্বর-অণু
বিশ্বময় হয়ে
চলাচল করি অদৃশ্য তনুতে” (কবিতার নাম: দেখি, দেখার অধিক, পৃষ্ঠা ১৬)
এই কবিতাটির ঠিক পরের কবিতা ‘অননুমেয়’। সেখানে এক টুকরো দুপুরের ছবি। সেখানে, ‘শব্দ- ধ্বনি -হাওয়া -বাতাস নিয়ে’ একজনের একা থাকা। সেই একজন, উত্তম পুরুষের বয়ানে, বলছে—
“এই একাকিত্বের মধ্যে
একটু একটু ছড়িয়ে গিয়ে বুঝি
এই আমিও চিন্তার অতীতে এক
মহা-আমি” (কবিতার নাম- অননুমেয়, পৃষ্ঠা ১৭)
এ কবিতায় ‘চিন্তার অতীত’ শব্দজোড়া খুব রোমাঞ্চের হয়ে দাঁড়ায়, কেননা পরের লাইনেই দেখব কথকের হাতে রয়েছে ‘মহা-আমি’ নামক একটা পরিণামের ধারণা। এই পরিণাম যদি জানাই ছিল তো খামোখা ‘চিন্তার অতীত’ বলে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করে দেয়া কেন! কারণ কী এই যে, ‘মহা-আমি’ শব্দবন্ধ পড়ে ফেলার পরেও যাতে ফিরে ফিরে যেতে হয় ঠিক আগের লাইনে ওই ‘চিন্তার অতীত’-এ, তারপর তলিয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারা যায়, ঠিক তার আগের লাইনে, ‘একটু একটু ছড়িয়ে’ যাওয়ার বিশদ! এই ফিরে যাবার অবকাশ যেন আলোর চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন সেই tachyonic particle যার পিঠে চেপে ভবিষ্যতের বিন্দুটা অতীতের বিন্দুকে সম্ভব করছে, অস্তিমান করছে। তীব্র সংলগ্নতার আনন্দ সৃষ্টি, এ কবিতায়, এই অবকাশ নির্মাণের যুক্তি হতেই পারে।
উপরে উল্লেখিত প্রতিটি কবিতার ক্ষেত্রেই একটা বিশেষ সাদৃশ্য লক্ষ্যনীয় যে এখানে অস্তিত্বের ‘প্রকাশ’ই প্রধান। ‘বটের ঝুরির ভিতর’ ‘এইখানে, জ্যোৎস্নায়’, এ পৃথিবী সেই অস্তির কাছে ধরা দেয় ‘মহাকাশে ভাসমান একটি প্রণাম’ হিসেবে সুনির্দিষ্ট আদলে (কবিতার নাম- দেখি, অলৌকিক, পৃষ্ঠা ৬৯)। একটা number line – এর ওপর এ সেই ০ বা ১। তাদের মাঝখানে উহ্য থেকে যাওয়া অনন্ত বিন্দুর অতলতা এ নয়। একক কোষের উদ্দেশ্য যেমন অভিজ্ঞতা লব্ধ ধারণাকে পরবর্তী কোশে সঞ্চারিত করা, তেমনই এক প্রাথমিকের ভাষ্য, তাগিদ আমরা যেন টের পাই এখানে–
“ওটা সজনে গাছ, ওটা কাঁঠাল গাছ
চেনা, কিন্তু অচেনা প্রাণের লাবণ্য
দুলে দুলে আত্মপ্রকাশ করছে
প্রকাশিত হলো একটা কাঠবিড়ালি
কোটর থেকে
এক ঝাঁক বুনো টিয়া পাখি
উল্লাস প্রকাশ করে চলে গেল” (কবিতার নাম- অতীন্দ্রিয়, পৃষ্ঠা ২৬)
উপরন্তু, সেই অস্তির ‘অণু’ থেকে ক্রমাগত zoom out করতে করতে ‘মহা’ পর্যন্ত আরোহন এবং ফের অবরোহন। নিরবিচ্ছিন্ন এই যাতায়াত। তুর্য থেকে তুর্যাতীতে এই সাবলীল যাওয়া আসার নিরবিচ্ছিন্নতা কেবল শিল্পীর পক্ষে সম্ভব,কবিতার পক্ষে সম্ভব। সাধকের থেকে তিনি এখানেই পৃথক যে সাধক রসাস্বাদনের তুর্যাতীত স্তরে অবস্থান করেন, কিন্তু শিল্পী, শিল্প, কবিতা, অবিশ্রান্ত যায় আসে যায় আসে। এই পার্থক্য এমনকি স্বীকার করে নিচ্ছেন স্বয়ং কবি দেবদাস আচার্য। বান্ধবনগরের পক্ষ থেকে একটি আলাপচারিতার সূত্রে আচার্য জানাচ্ছেন, “আমি লিখেছি একান্তই অন্তরের টানে লেখা। সেটা বাইরে থেকে সাধনার মতো মনে হলেও আমি তো সাধক নই সে অর্থে। আমি কবিতারই সাধক।” (সূত্র: বান্ধবনগর সপ্তম সংখ্যা,ক্রোড়পত্র: দেবদাস আচার্য)।
“আমিও উচ্ছল এক কণা
মৌলজীবন
অফুরন্ত জীবন প্রবাহে মিশে
প্রকাশিত আছি”
(কবিতার নাম: প্রকাশ, পৃষ্ঠা ৫৩)
একক অস্তির নিবিড় সংলগ্ন এক প্রকাশ,প্রকাশের তাগিদ— এই সুর-সিদ্ধান্তে হয়তো গেঁথে নেয়া যায় এ লেখায় এ পর্যন্ত উদ্ধৃত কবিতাগুলোকে। হয়তো এ দর্শন সেই ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ জাতীয় অদ্বৈতবাদের মহাবাক্যের সীমানায় আপাত স্বস্তি পেতে চায়। কেননা মানুষের পক্ষে অনন্তকে কল্পনা করা অসম্ভব, কেননা তার কোষের সীমাবদ্ধতা সেই অবধি। তাই, সে কেবল অনন্তের ছায়া নিয়ে খেলা করে শিশুর আনন্দ বুকে বাজিয়ে দেখতে চায়। ছোটখাটো ‘a trip to infinity’ আর কি!
২
শূন্যবিন্দু
তবু, অস্তিই শেষ কথা নয়—
“যা-কিছু অস্তিত্ব, সকলেরই
না-দেখা অস্তিত্ব আছে, পরতে পরতে
বর্ণময়”(কবিতার নাম- খুলে খুলে দেখি, পৃষ্ঠা ৬১)
Matter থাকলে তার anti matter, dark matter-ও আছে। এবং কবি, কবিতা কোনও এক জায়গায় থেমে যেতে পারে না।
“জীবন এমনই, যেন
মৃদু-স্বরে নিয়মিত
আত্মমোচন” (কবিতার নাম – আত্মমোচন, পৃষ্ঠা ৩২)
সব্যসাচী মজুমদার লিখছেন ‘একটি জীবনের শ্লোক’ প্রবন্ধে(বান্ধবনগর সপ্তম সংখ্যা,বর্ষা), “কবিকে কিন্তু সবসময়ই পরিস্থিতির ঘটমানতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হচ্ছে, এটাই দেখতে পাচ্ছি। থামবার, নিজের নির্মিত দর্শনের প্রেমে পড়বার কোন উপায় থাকে না সম্ভবত তাঁর।”
আবার, এই অস্তি, শুরুর কথাও নয়। অর্থাৎ, নির্ধারিত সে বিন্দুর আগে পরে কিছু আছে। সেই কিছুর, সেই অপরের সঙ্গেও কিছু আলাপের আভাস দিচ্ছেন, ‘বিন্দু নয় রেখা নয়’ বইটির কথক। কবিতাগুলোর নামের দিকে তাকালে দেখব, ‘প্রকাশ’ নামে যেমন একটা কবিতা আছে, তেমনি ‘অপ্রকাশ’ নামেও একটা কবিতা আছে। আছে ‘না-থাকার পর থাকাটুকু’, ‘বিনির্মাণ’, ‘আছি যেমন’, ‘অপূর্ণ রইল’, ‘থাকল’ ইত্যাদি। এইভাবে একটা তলের পরে একটা অতল, একটা অতলের পরে একটা তল— এও এক ধরনের শৃঙ্খলা, continuum। স্ববিরোধী, এবং বিপরীত বৈদ্যুতিক আধানের মতোই স্বাভাবিক, আদানপ্রদানময়।
এই অনস্তি বা অতলকে, রঙের নানান ছায়ায় দেখবার একটা চেষ্টা আমরা লক্ষ্য করি কাব্যগ্রন্থটিতে। চেতনা-সীমার মধ্যে কখনো তাকে অস্তির সাপেক্ষে দেখা, কখনো শূন্যে শূন্য হয়ে দেখা। এমনকি কখনো কখনো এই দেখা, চৈতন্যের একেবারে বাইরের কিছুর স্পর্শে, দেখাশূন্যও করে তোলে। এমনই বিশাল বিস্তার এ দৃষ্টির। নাকি, মাহাত্ম্য আসলে দৃশ্যের, কবিতার! সেও এক রহস্য।
কয়েক টুকরো কবিতা পড়া যাক—
“গত পাঁচ দিন
চুপচাপ বসে রইলাম
একটা শব্দও খুঁজে পেলাম না
…ধ্যানমূর্তিকে বাণীমূর্তি দেওয়ার
শব্দ খুঁজে পাই না
রঙ-চটা বা পানসে মনে হয় শব্দ
ধ্যানভ্রষ্ট হয়ে পড়ি
এই দ্বন্দ্বে দিশাহারা
দিন কাটে” (কবিতার নাম- অপ্রকাশ, পৃষ্ঠা ১১)
এখানে যিনি ‘আমি’, তিনি রাধাঅঙ্গে বিচ্ছেদ-অনল পোহাচ্ছেন। একটা নির্দিষ্ট মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে, স্নায়ুগ্রাহ্য বিশেষ মাত্রার একটা আলো। এ যেন শূন্যের পাড়ে বসে, নিজের মুখের প্রতিবিম্ব তাতে দেখা। দেখতে দেখতে আজীবনের একমাত্র ভূতের সঙ্গে মোলাকাত। তাই, ‘ধ্যানভ্রষ্ট হয়ে পড়ি’ এবং ‘এই দ্বন্দ্বে দিশাহারা’র ভিতরে যে ‘আমি’ সূচক বাচনভঙ্গি, তার ঠিক পরেই, ‘দিন কাটে’, মানে যেন, আর তত নির্দিষ্ট করে, বিস্তৃত করে বলা হলো না, দিনগুলো কীভাবে, কেমন কাটে। কারণ, হয়তো ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে সেসব খুঁটিনাটি দিশাহারা আমিটি জানে না। আবার এখানেই খুব সূক্ষ্ম একটা মজা, সে জানে এবং জানান দেয় যে, সে জানে না। অর্থাৎ শূন্যে শূন্য ঠিক নয় এ মুহুর্ত, শূন্যের পাড়ে বসে খানিক শূন্য, খানিক বিচ্ছেদানন্দ…
সবটাই বোধের মুঠোর ভেতর।
আবার, এক অপর অপ্রকাশের মুহুর্তে—
“গত দশদিন ধরে
দুপুরের পর কিছুক্ষণ
টেবিলে বসি
চুপচাপ বসে থাকি
বসেই থাকি
তারপর বিকেল হয়
চা তৈরি করতে যাই
ওই যে কিছুক্ষণ
শূন্য
সাদা পাতার ওপর
কলম হাতে
শূন্য
শূন্যে শূন্য হয়ে
ডুবে থাকি
সুখ-দুঃখের বাইরে”
(কবিতার নাম- কখনো, কখনো ; পৃষ্ঠা ২৭)
এই কবিতাকে যেন, আর ভেঙে বলা যায় না। মানে যেমন, বিজ্ঞানে quark এবং lepton এর ধারণা, ‘they are not made up of any smaller particles’, সাধারণের ভাষায় তাকে তো made up of nothing বলা ছাড়া উপায় নেই! charge, mass, energy বা point particle-এ ভেঙে যাবার পর তারা এতটাই মৌলিক যে সে মৌলিকতাকে ভেঙে, ব্যাখ্যা করে বলা, আমাদের, সেপিয়েন্স প্রজাতির পক্ষে একটু কঠিনই! হতে পারত যদি প্রতিটি একক কোষ তাদের সমস্ত স্মৃতি উজাড় করে ভরিয়ে তুলতো মানুষের মগজকে! আদি পর্যন্ত, অনাদি পর্যন্ত স্মৃতি!
এবার ধরা যাক, সত্যিই সেই স্মৃতি এলো কোনও এক মুহূর্তে ঘটমান হয়ে। আমাদের মগজ, আমাদের ভারসাম্য ততটা ধারণে প্রস্তুত না হলেও, এলো। তখন—
“মাথা নিচু করে হাঁটি
শূন্য থেকে শূন্যের দিকে
এই ভ্রমণ নিরুত্তাপ, নিষ্কলঙ্ক
ধর্ম-কর্ম পাপ-পুণ্য
ফলাফলমুক্ত
এই শূন্য-ফল ওঁ বলে
গলাধঃকরণ করি
সুখেও থাকি না
দুঃখেও থাকি না” (কবিতার নাম- মুক্ত ভ্রমণ, পৃষ্ঠা ৩০)
এই যে, শূন্য-ফল হাতে অসহায় ফ্যাল ফ্যাল চোখে বসে থাকা ভারসাম্যের কাঠামো আমাদের! তার তো গলাধঃকরণ করা ছাড়া উপায় নেই। তাই, যিনি সকল জানেন, সেই সর্বজ্ঞ ওঁ স্মরণ করে, নিষ্ঠা সহকারে সেটুকুই করা। রোমাঞ্চ হয় ভাবলে, করুণাও হয়। সুখও হয়, দুঃখও হয়। তারপর একসময়, আর কিছুই হয় না। কারণ অনুভূতিও যেন বড়ো বাহুল্য তখন।
“অতলে সাঁতার কাটি
কিছুক্ষণ
অফুরন্তে মিশে
প্রশ্নোত্তরহীন
ভেসে উঠি
ভাত খাই
ঘুমাতে যাই” (কবিতার নাম- দ্বিচারণ, পৃষ্ঠা ৪৮)
এই শূন্যের প্রসঙ্গে আরেকবার ফেরা যাক number line-এ। Point zero, দুপাশে দুটো অনন্ত রশ্মি, ডাইনে ধনাত্মক আর বামে ঋনাত্মক সংখ্যার অনন্ত, ছবিটা আশা করি সকলের মনে পড়বে। এবার, দেবদাস আচার্যের ‘বিন্দু নয় রেখা নয়’ বইটির একটা কবিতা পড়া যাক। কবিতার নাম ‘যোগফল'( পৃষ্ঠা ৩৯)—
“লিখতে লিখতে রিফিল ফুরিয়ে গেল
অর্ধেক লেখা হল, বাকি অর্ধেক
খেই-হারা হয়ে থেকে গেল
এরকম হয় মাঝে মাঝে
কী ছিল সেই খেই-হারা থেকে যাওয়াগুলি
কোথায় থাকল, নাকি থাকলই না
পূর্ণতা পেত কি তারা, আলোয় আসত? ভাবি
চিন্তায় থাকি
যা থাকল ঠিক ততটাই
থাকল না, এও ভাবি
যা পেলাম ঠিক ততটাই
পেলাম না শেষাবধি
জীবন ক্রমশ হয়ে ওঠে একদিন
পাওয়া-না পাওয়ার সমতায়
শূন্য জীবন”
কী প্রবল সিদ্ধান্ত এ কবিতায়! প্রবল সাম্যের সিদ্ধান্ত! দুটো অনন্তকে ধারণ করে এই সরলতম অংকের বিস্ময়! এ কবিতা-ভাষার রচয়িতা যিনি, সেই আচার্যকে, প্রণাম…
যেন কবিতার বক্তা আদিতম,অনাদিতম ধ্বনি, তত্ত্বে ফিরে যেতে চাইছেন। নতুন কোনও বক্তব্য, বক্তব্যের বাহুল্য তাঁর নেই। এই এত তথ্য আমাদের চারপাশে, হঠাৎ এই অসংখ্য তথ্যের বিস্ফোরণ, অথচ একই কথার পুনঃ পুনরাবৃত্তি মাত্র, মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। এতই প্রাথমিকের ভাষ্য তাঁর!
বিজ্ঞানীরা ধরে নেন, ব্রহ্মাণ্ডের বিস্তৃতির সময় যে বেগ ছিল তার সাংখ্যমান নিশ্চয়ই একটা Irrational number, যেমন √2(1.41421356…), যেমন π(3⋅14159265…)। কারণ, এই সংখ্যা গুলো নির্দিষ্ট সংখ্যা-চিহ্নের ভেতরে এক অনন্তের ধারণা বহন করে। এইভাবে আসলে চিহ্নের, সত্তার মাঝেই সেই অনন্তের হাহাকার! প্রচন্ড সেই শূন্যের হাঁ! তীব্র ‘চোরাটান’…
“সীমানার সীমা নেই
মনে মনে
যত যাই
ততই সে দূরে সরে যায়
মনের এই চোরা-টান
কোথায় যে শেষ!”
(কবিতার নাম – চোরাটান, পৃষ্ঠা ৩৩)
৩
কবিতাবিন্দু
কিন্তু এতদূর অস্তিত্বে এসে, এতদূর শূন্যতায় এসেও, পড়ে থাকে ‘আত্মমোচন’, যেমনটা আগেই উল্লেখ করেছি যে কবি তাঁর নির্মিত দর্শনে থামতে পারেন না। মনে হয়, তার চেয়েও বড়ো কথা, বা তার কারণ, কবিতা থামতে পারে না। একটা বস্তুকে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাক্সে অনেক অনেক বছর রেখে দিলেও, আস্তে আস্তে তার উপাদান গুলো একসময় অস্তি থেকে বিশ্লিষ্ট হবে, এলোমেলো হবে, তারপর আবার অনেক অনেক বছর ধরে সেগুলো এক জায়গায় হয়ে, ওই বস্তুকেই, আরো একবার তৈরি করবে, তারপর আবার বিশ্লেষণ, তারপর আবার…
এখন মজাটা এখানেই যে, গোটা প্রক্রিয়াটা একক কবিতা—
“এক ও শূন্য
এক ও তার পিঠে শূন্য
এক ও তার পিঠে পর পর শূন্য…
বেলা তিনটে থেকে শুরু করেছি
একের পিঠে পর পর শূন্য বসিয়েই চলেছি
ভাবছি
এটা চালিয়ে যাব
দিন মাস বছর
আজীবন
এক আমি
আর আমার শূন্য
আমি অদ্বিতীয়, আর
আমার অসীম অনন্ত শূন্য…
অদ্বিতীয় ও অনন্ত
এই আমার সত্য এই আমার সারাৎসার”(কবিতার নাম- বিস্তার, পৃষ্ঠা ৬৭)
এই ‘আমি’র সত্য এবং সারাৎসার নিয়ে যে বিস্তার তা তো আসলে এক সীমাহীন শূন্যেরই বিস্তার। অথচ এ আসলে ওই ‘আমি’র-ই শূন্যতা, অস্তিরই শূন্যতা। এবং এ কবিতার ঠিক পরেই যেন ভেঙে যাবে একটা continuum। এই সেই ন্যূনতম ফাঁক যেখানে একটা নির্ধারিত ভারসাম্য, কাঠাম, ধারাবাহিকতা খসে পড়ে। এর পরেই যেন পা পিছলে বলে ফেলা যায়, শূন্যই চূড়ান্ত সংখ্যা, শূন্যই সমগ্রের একক। দারুণ paradox- এর মতো! অনন্ত+অনন্ত=অনন্ত, তাই, সমান চিহ্নের দুপাশে দুটো অনন্ত কেটে দিলে থাকে পড়ে থাকে ‘অনন্ত = ০’!
এ কবিতা, এইভাবে, ঠিক তার পরের আরেকটা সম্ভাবনাকে উসকে দেয়। চেপে বসে একটার পিঠে একটা, তার পিঠে আরেকটা কবিতা। পাঠক গ্রস্ত হয়ে পড়েন, পাঠকের ভেতরে যে লেখক, তিনিও গ্রস্ত হন। কত কথা বলতে সাধ হয় এই কবিতা পড়ে! অথচ, ‘আমি কী বলিব কার কথা! কোন সুখ, কোন ব্যথা…’
আসলে কবিতা যখন আসে, তখন প্রতিটি থাকা বা না-থাকাই হয়ে ওঠে এক বাকরুদ্ধ পিণ্ড, যেমন বর্ণিত হয়েছিল প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের আশ্চর্য প্রাণী গল্পে!”সেই বালির উপর একটা চ্যাপটা আঙুরের মতো জিনিস নির্জীবভাবে পড়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে দেখলাম, তার মধ্যে একটা মৃদু স্পন্দনের আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে।”
কবিতা যখন আসে, সেই ঘটমানতায়, যখন মুহূর্ত সৃষ্টি হয়, তখুনি তার অনুবাদ সম্ভব না। কিছুটা সাপেক্ষিক ব্যবধান চাই তার জন্য। বয়ে যেতে দিতে হয় সময়কে, তার জন্য। তাই, ‘সেই কবে থেকে ‘,
“সময়কে আমি
নিজের বুকে পুষে নষ্ট করি না
আনমনাও থাকি না, তাকে
মেঘের ভ্রমণের মধ্যে কিছুটা
কিছুটা নদীর ঢেউয়ে
পাখির উড়ন্ত ডানায় কিছুটা
ফেরিওয়ালার ডাকের মধ্যে একটু
ছাদেরালির সঙ্গে গল্প করে কিছুটা
বাজার করার সময় দরদাম করে চমৎকার একটু
খাতার সাদা পাতায় ডেকে এনে নাচতে থাকা বেচাল শব্দের সঙ্গে কিছুটা
এমনকি, ডিম মুখে হেঁটে যাওয়া পিঁপড়েসারিতেও একটু…”
এভাবে, নানাভাবে
সকাল থেকে বিকেল অবধি
পরম মগ্নতার মধ্যে সময়কে বয়ে যেতে দিই
সময় আসে আর চলে যায়
আসে আর চলে যায়
কবে থেকে, কতকাল থেকে…”
(কবিতার নাম- সেই কবে থেকে, পৃষ্ঠা ১৪)
কবিতা এসে পৌঁছানোর পর যখন তা মূর্তি পায়, তার কোষ যখন তৈরি হয় কবির রক্ত-মাংসে, সেই পাওয়া বা হওয়াটুকুও কবিতা-বিন্দুর নিরবিচ্ছিন্ন চ্যুতি মাত্র, যা একমাত্রিক রেখার জন্ম দেয়। আর এই সূত্রে, আলোচ্য বইটার নাম প্রসঙ্গে ফিরলে আবারও বোঝা যায় যে, বিন্দু এবং রেখাই। যারা ওই বিন্দু এবং রেখা চিহ্নের সীমার ভেতরেই অসীম। কেবল বিন্দু নয়, কেবল রেখাও নয়, সেইখানে ০ ও ১ এর মধ্যে উহ্য থেকে যাওয়া অনন্ত বিন্দু ও রেখার অতল। অতএব স্থানচ্যুতি সেখানেও। ‘ভাবি/ আসে, এসে/ ছিটকে চলে যায় নিরন্তর/ কোথা থেকে কোথায়’! (কবিতার নাম- আলোকিত চ্যুতি, পৃষ্ঠা ৩৪)
এ যেন সেই রুশ Matryoshka doll, একটার পেটে আরেকটা মেয়ে।
এইভাবে কবিতা যখন এসে চলে যায় তখন সেই না-মুহূর্ত, অসম্ভভাবনাও কবিতারই প্রকৃতি, যেভাবে, ‘উবে যাওয়া কর্পূর’এর গন্ধ হয়ে থাকা ‘কিছুক্ষণটুকুই প্রকৃত কর্পূর'(কবিতার নাম– না-থাকার পর থাকাটুকু, পৃষ্ঠা ৫৮)!
৪
বিন্দু নয় রেখা নয়!
দৃশ্যের সাপেক্ষে দ্রষ্টাকে দেখবার একটা চেষ্টা লক্ষনীয় এ বইতে। কবিতার সাপেক্ষে অস্তি, কবিতার সাপেক্ষে শূন্য, গেঁথে গেঁথে বৃত্ত সম্পূর্ণ হলে, বইটার শেষে, পৃথিবীর হলধর নাগের জন্য প্রণাম হয়ে পড়ে থাকে ‘অশংশোধিত’ কবিতার প্রার্থনা —
“অসংশোধিত থাকার আরাম ভুবনে জাগ্রত হোক…” (কবিতার নাম- অসংশোধিত কবিতা, পৃষ্ঠা ৭১)
এবার,এ পর্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে কবিতা গুলোর যে পৃষ্ঠা সংখ্যা উল্লেখিত হয়েছে, সেগুলোকে একটু লক্ষ্য করলে দেখব, কীভাবে কোনও ক্রমবিন্যাস ছাড়াই, অবাধে, বিশৃঙ্খলায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাদের। অস্তিবিন্দু ও শূন্যবিন্দুগুলো— যেখান থেকেই পড়া হোক না কেন, ততই অগোছালো মনে হয়। Plank length-এর পর যখন continuity of space,time ভেঙে যায় বলে ধরে নেয় বিজ্ঞান, সেই ন্যূনতম ফাঁকটুকুকেই কী এভাবে ‘মৃদু প্রকাশ’ করেন কবি? অথচ এ আলোচনার শুরুতে আমরা কতই না সংলগ্নতা ও তার সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলাম!
তবে কি সত্যিই বিন্দু নয় রেখা নয়— এমনটাই,এতটাই নিশ্চিত করে বলে দেয়া হচ্ছে!
হলে, সমস্যা এখানেই যে আমরা সেই নেইটুকুকে দেখতে পাচ্ছি না!
এতদূর অস্তিত্বে, এতদূর শূন্যতায়, এতদূর কবিতা ও বহমানতায় এসে, তারপরে এই সূক্ষ্ম মজাটুকুর সূত্রে, এই তীব্র দ্বন্দ্বটুকুর সূত্রে, এ আলোচনার অন্তিমে পড়ে নিতে পারি
‘বিন্দু নয় রেখা নয়’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা—
“মৃদু হাওয়ায় কথা বলি
পাতার নিস্বনে তার শ্বাস
টের পাই
…
নিঃশব্দে কথা বলি
কাঁপা-কাঁপা
ভাঙা-ভাঙা
দূরে খোল বাজে— ধিন
তা-কিটি তা-কিটি”
(কবিতার নাম- মৃদু প্রকাশ)
ভীষন ভালো লাগলো এই বিশ্লেষণ।
খুব ভালো লাগলো এই বিশ্লেষণ।