
অনুপ সেনগুপ্ত-র কবিতা
দশটি কবিতা
গোধূলি
গাছের মধ্যে লুকিয়ে আকাশ
ঝাঁকুনি দিলে
ঝরে পড়ে গোধূলি মেঘ
এক সময়ের নীচে
আরেক সময়
এক নদীর নীচে
আরেক নদী
সর্বদাই বয়ে যায়
ডানার বেগবত্তায়
পাখির নীড়
সর্বদাই স্থির
এই আকাশের পর
পাশের আকাশে
সূর্যাস্ত এবার
যাত্রা
একাকিত্ব থেকে এবার বেরিয়ে পড়তে হবে
যেসব রাস্তা আমার অন্তর্ভুবনে
কোনও একটাকে হাঁটার জন্যে বের করে আনি
একটি নক্ষত্র অপেক্ষা করছে জানলায়
এই কোথাও-এর না-কোথাও যাত্রায়
আমার সঙ্গী হবে
আর দশমীর যে চাঁদ
বহুকাল ডুবে আছে পাশের ঝিলে
একাকিত্বকে সঙ্গ দিতে ওকেই
রেখে আসি
বিরহ
ভালোবাসা শব্দটি থেকে
একদিন ভালোবাসা চলে গেল বহুদূর
কিন্তু কখনও ফিরে এসে দেখতে পায় –
তার রিক্ত অনর্থ কেমন ডালপালা মেলেছে ভাষায়
অসংখ্য বিরহ কেমন ফুটেছে ডাল জুড়ে
অপেক্ষা করছে তারা:
মৌমাছির মতো ভালোবাসা তাদের নিষিক্ত করবে
কিংবা ঝরে পড়লে
কুড়িয়ে নেবে মানুষের মতো
ভার
তারা ভাবে, দস্যুদের মতো
বাঁটোয়ারা করে নেবে প্রেম
কিন্তু বালি খুঁড়ে
পায় কিছু সূর্যাস্ত
সেইসব সূর্যাস্ত
হাতে নিলেই আবার রাত্রি
তাই ফিরে আসে খালি হাতে
প্রেম ও সূর্যাস্ত ছাড়াই
কিন্তু টের পায় বুকের মধ্যে
অনস্তিত্বের ভার
তা না কি কখনও বেশি হয়
অস্তিত্বের চেয়ে
চোখ
তোমার চোখের মধ্যে বেজে ওঠে গান
আমার নিশ্চুপ চোখ শ্রবণ উন্মুখ
হাততালি
কখনও বর্তমানে নিজেকে মনোমত না পেয়ে
অতীত কিংবা ভবিষ্যতে বেরিয়ে পড়ি
আর আমারই মতো অন্য কাউকে ধরে আনি
সে হুবহু আমার অভিনয় করে
আমি হাততালি দিই
তারপর তাকে আমার জায়গায় রেখে
অতীত কিংবা ভবিষ্যতে উধাও হই
সেও একদিন আমায় ধরে নিয়ে আসে
আমি হুবহু তার অভিনয় করি
সে হাততালি দেয়
আমি তার জায়গা নিই, সে উধাও হয়
এইভাবে চলতে চলতে
একদিন কে অভিনেতা, কে দর্শক
আর বোঝা যায় না
তখন হাততালি দিই না কেউ
দুজনেই উধাও হই
শুধু পড়ে থাকে
একজনের পরিচয়ে দুজনের অনুপস্থিতি
অন্দরসজ্জা
আকাঙ্ক্ষিত ঘরের সবকিছুই নিখুঁত:
দেওয়ালচিত্রের সূর্যাস্ত
পর্দার তরঙ্গমালা
বইয়ের তাক, বইয়ের প্রতিটি বাক্য
সোফা, কার্পেট, পায়চারিঘোর
কথার টুকরো
শয্যাভিযান, রতিশৃঙ্গ, নিদ্রাকুসুম
ঘড়ির হৃৎস্ন্দন
অনস্তিত্বের উৎকন্ঠা…
এমনকি নিখুঁত না হওয়ার আকাঙ্ক্ষা
গানাহার
উত্সর্গ: বিটলস
চার কাপ ভায়োলিন
দু-কাপ ভায়োলা
আর দু-কাপ চেলো মিশিয়ে
সেই তরলে একাকিত্ব ভেঙে
টুকরোগুলো ফেলি
ডোরিয়ান মোডের ধিকিধিকি আঁচে
সিদ্ধ হয় এই গান
আর তা চেটেপুটে খেতে
মৃত্যুর ভিতর থেকে এলিনর রিগবি
একটি হাত বাড়িয়ে দেয় জীবনে
একটি কবিতার গল্প
| ১ |
কবি একটি শব্দ ভেঙে
টুকরোগুলো ছড়িয়ে দিলেন কবিতায়
শব্দটি হতে পারে – তুমি
হতে পারে – আমি
কবি আমি, তুমি দুটি শব্দ নিয়েও
লীলাখেলা করতে পারেন
কবিতায় আমি শব্দের বৃষ্টি শুরু হলে
ভিজে যায় তুমি শব্দের ঘাস
যদি গোলাপ শব্দটি প্রস্ফূটিত করেন কবি
সেই গোলাপ অমরতায় ঝরে পড়ে
| ২ |
একটি অর্ধদগ্ধ কবিতার মুখোমুখি কবি
যেখানে ফুলের মতো ফুটে ওঠা রাতে
কিছু কীট খেয়ে নিচ্ছে চাঁদ
এই কবিতার ক্ষতের সুড়ঙ্গে
এবার তাঁকে নেমে যেতে হবে
একের পর এক শব্দের মৃতদেহ টপকে
নৈঃশব্দ্যের চাবি দিয়ে
এই ঝলসানো মুখরতার দরজা খুলছেন কবি
এখন তাঁর অননুভূতিই
কাব্যিক মৃত্যুকে কিছু দূরে ঠেলে দিতে পারে
গৃহ
তুমি ঘুমিয়ে পড়লে তোমার স্বপ্ন থেকে
একটি গৃহ তুলে আনি
অসীম থেকেও দু-কাঠা পরিসর তুলে এনেছি
গৃহটি সেই পরিসরে মাপে মাপে বসতে পারে
জেগে ওঠো যদি স্বরূপে –
যেভাবে দিন জেগে ওঠে আলোয়
আর রাত অন্ধকারে
যেভাবে দেবতা জেগে ওঠে অনুপস্থিতি থেকে
নিজের উপস্থিতির পরিসরে
এভাবেই বসবাস করতে শিখি
আলাদাভাবে নয়, সবকটা লেখা মিলে একটা অসম্ভব অভিঘাত তৈরি করে। নিবিড় অন্তর্ঘাত করবে বলে সেই বিকেলবেলা থেকে বসে আছে প্রেত। এই শহরের সব ল্যাম্পপোস্টের মাথায় তখন আকাশগঙ্গা ভেঙে একঝাক নক্ষত্র খসে পড়ে।
দেবরাজ চ্যাটার্জির কবিতা আবহমান কবে পাবে?
তাড়া তাড়ি তাড়া তাড়ি।
এই কথাটার মানে কী
অসাধারণ কবিতাগুচ্ছ।