অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br />  ষষ্ঠবিংশতি পর্ব  <br />  তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
ষষ্ঠবিংশতি পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ২৬ তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।

২৬

পদ্মনাভকে পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু ঠিক কবে থেকে যে তিনি বেপাত্তা, সেটা কিছুতেই খেয়াল করতে পারছেন না শতরূপা।ব্যাপারটা শোনাচ্ছে একটু অদ্ভুত, কিন্তু এটাই সত্যি। এই কোটি যোগিনীর গলিতে পদ্মনাভ যেচে এসে ধরা দিয়েছিলেন, কিংবা নিয়তি মানলে নিয়তিই তাঁকে এখানে টেনে এনেছিল, যেন আস্ত একটা গ্রিক ট্র্যাজেডি। কিন্তু তিনি নিজেই আসুন বা ভাগ্য তাঁকে এখানে নিয়ে আসুক, শতরূপার আচরণে মনে হতে পারত, পারত কেন হয়েইছে, যে শতরূপার যেন জানাই ছিল পদ্মনাভ এখানে আসবেন। আর যেটা মনে হয়েছে, সেটা একশ ভাগ সত্যি। শতরূপা জানতেন পদ্মনাভ এখানে আসবেন, তাঁকে আসতেই হবে। কারণ শতরূপা বিশ্বাস করেন, জীবন হিসেব নিকেশ ঠিক করে নেবার সুযোগ দ্যায়, সবাইকেই দ্যায়, কিন্তু অনেকে সেটা বুঝতে পারে না, কারণ তারা নিজেদের প্রতিটা কাজ নিয়ে খুঁটিয়ে ভাবে না, লুক ব্যাক করে না। শতরূপা ভাবেন আর তাই তিনি জানেন এই জীবনে, তিনি পাপ কিছু করেননি। যে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করেছেন, তাকে রক্ষা করার জন্যে, নিজের সর্বস্ব দিয়েছেন, শরীর, সময়, সব। শেষ অব্দি অস্তিত্বটাও দিয়ে দিতে হল। তিনি যে এই কলকাতা শহরেই আছেন, কেউ জানে না সেটা। নিজের মাও না। মা জানলে তাঁর এই অজ্ঞাতবাস চাউর হয়ে যেত। তবে মার কানে এই কথাটা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে তাঁর মেয়ে বেঁচে আছে, কিছুদিন পরেই দেখা করবে তাঁর সঙ্গে। কিন্তু তিনি যেন মেয়েকে খোঁজাটা চালিয়ে যান। যাকে দিয়ে এই খবরটা দেওয়া হয়েছিল, সে একটুখানি থমকে গিয়ে বলেছিল, ‘কিন্তু শতরূপাদি, আপনার এই অজ্ঞাতবাসের এখন কি মানে? শাসক তো বদলে গেছে।’
শতরূপা ওর দিকে স্থির চোখে এক মুহূর্ত চেয়ে শান্ত গলায় বলেছিলেন ‘শাসক কখনো বদলায় না। নামটা অন্য হয়তো, পতাকার রঙ আলাদা, কিন্তু বাদবাকি সব এক। আমার আর একটু কাজ বাকি আছে। সেইটুকু হয়ে গেলেই আমি সামনে আসব। আমার আর কাউকে ভয় নেই। ওরাই বরং আমাকে ভয় পায়’
‘ওরা কারা?’
‘যারা ত্রাসের রাজা’
‘আপনার কাজটা ঠিক কী বলবেন আমাকে? আমি তো দেখছি যত অদ্ভুত অদ্ভুত লোকজনকে আপনি এ বাড়িতে টেনে আনছেন।তাদের দিয়ে ঠিক কী করতে চাইছেন আপনি?’
‘সময় বলবে সে কথা। ওসব ভাবতে হবে না তোমায়। এখন যে কাজ দিয়েছি সেটা করো’

ছেলেটি শরীরে অস্বস্তি নিয়ে চলে গেছিল. একটা কথা ও ঠিকই বলেছিল, বিচিত্র রকমের মানুষ জমাচ্ছেন শতরূপা, পুরনো কয়েন বা স্ট্যাম্পের মতো আর স্ট্যাম্প বা কয়েনের মতো এই মানুষগুলোরও আশ্চর্য ইতিহাস আছে। মানুষ নয়, শতরূপা জমাচ্ছেন আসলে সেই সময়টা। একদিন এই জোর করে , ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা ইতিহাসই কথা বলে উঠবে। সেই স্বরগুলোকে একজায়গায় করাই তাঁর কাজ, না, এসব বুঝবে না এই ছেলেটি। তবে না বুঝলেও তাঁর আদেশ পালন করবে সে চুপচাপ। এই মুহূর্তে সেটাই দরকার তাঁর।
কিন্তু এই যে পদ্মনাভকে যে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা ? আরে, পদ্মনাভ তো তাঁর সংগ্রহশালার একটা সামগ্রী ছাড়া কিছুই নয়, জমিয়ে রেখেছেন, ঠিক সময়ে খরচ করবেন, হয়তো একটু বেশি মনোযোগ দিয়েছেন তাঁকে। কারণ এঁর সঙ্গে তাঁর অনেক হিসেব চুকোনো বাকি। কিন্তু দিনদিন আরও সামগ্রী জমা হতে লাগল। মানুষরতন, এক এক করে এসে জুটতে লাগল এই কোটি যোগিনীর গলিতে, আর তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শতরূপা।মাঝেসাঝে দেখা করতেন পদ্মনাভের সঙ্গে, সেটা তো একা তাঁরই উৎসাহে, পদ্মনাভর দিক থেকে কোন আগ্রহ ছিল না তাঁর সঙ্গে দেখা করার বা কথা বলার। বনের পশুও পোষ মানে, কিন্তু পদ্মনাভ কোনদিন পোষ মানলেন না। একদম একলষেঁড়ে লোক। বছরের পর বছর কেউ কথা না বললেও চলে যাবে, যদি নিজের প্রিয় কফি, প্রিয় ব্র্যান্ডের সিগারেট, প্রিয় সিনেমা আর গান পান। খাওয়া দাওয়া নামমাত্র, তবে লুচি মাংস পেলে চোখে একটা ঝিলিক মারা খুশি দেখতে পান। কয়েকদিন শতরূপা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন তিনি দেখা না করলে পদ্মনাভ নিজে থেকে ডাকেন কিনা। ডাকেন নি। একদিন সকালে এসে দেখলেন লোকটা নেই। সব আছে, বই, স্টিরিও, প্লে স্টেশন, শুধু পদ্মনাভ নেই। শেষ কবে দেখা হয়েছিল?
সেই পেছনে কলের জল পাম্প করতে করতে বালিকাটির কাঁধ থেকে বারবার নেমে যাওয়া ফ্রক টেনে তোলার দিন? সেই কি শেষ দেখা? মনে পড়ল না শতরূপার।
সেইদিন খুব মুষড়ে পড়েছিলেন পদ্মনাভ তা বেশ মনে আছে, শতরূপাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন, কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন ‘আমরা ওদের কাছে পৌঁছতেই পারিনি, কিচ্ছু করতে পারিনি, কিচ্ছু না’
সেদিন কিন্তু পদ্মনাভর কান্নাকে কুম্ভীরাশ্রু মনে হয়নি শতরূপার। পদ্মনাভ যে বরাবর ওঁর সঙ্গে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করেছেন, সেটাও বা কী করে বলা যায়, উনি তো শতরূপার দিকে তাকাননি পর্যন্ত, চরম উপেক্ষা করেছেন, একটা নরকের কীট যেন শতরূপা, পাশ দিয়ে চলে গেছেন, যেন হাওয়ার দেওয়াল ভেদ করে, সেই পদ্মনাভর কান্নায় তাঁরও চোখের কোল ভিজে এসেছে, তাঁরও মনে হয়েছে সত্যিই কিছুই করা হয়নি মানুষের জন্যে। আর সেই না করার জন্য কাউকে দোষ দেবার নেই, নিজেদের ছাড়া। তাঁর সঙ্গে পার্টি এরকম করল, তাঁকে মুছেই দিল তাঁর চাকরি, সমাজ, সংসার থেকে, তাঁর বন্ধু, প্রেমিক সব এক মুহূর্তে নেই করে দিল, সেই আগের দিন, সেই যে একটা নতুন ছেলে, ওকে বলেছিলেন খুব শিগগির সারাদিনের জন্যে কোথাও চলে যাবেন ওকে নিয়ে, কী যেন নাম, হ্যাঁ মনে পড়েছে সুমন, সেই সুমনের শরীর যে গলে গলে যাচ্ছিল ওঁর কাছে বসে, ওর সব প্রতিরোধ, উপেক্ষা ভেঙে পড়ছিল, কি থ্রিল সেইসব মুহূর্তের, একটি পুরুষকে জয় করেছেন তিনি, সেসব মুহূর্ত একদিনেই নেই হয়ে গেল, যারা এরকম করল, তাদের জন্যেও এত মায়া রয়ে গেছে এখনো! এক পরিবারের মতো, যত দূরেই থাকা যাক না, টান থেকে যায়, বরং দূরে থাকলে টান বাড়ে, যাদের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি নেই দীর্ঘকাল, তাদের জন্যেও বুকে কষ্ট জমা হয়। তাদের নামে কেউ কিছু বললে সোজা বুকে এসে লাগে।পদ্মনাভ যখন বললেন ওদের জন্য কিচ্ছু করতে পারেননি, তখন সেই কিছু না করার দায় নিজের বুক পেতে নিলেন শতরূপা।এ আমার, এ তোমার পাপ। তিনিও তো কিচ্ছু করতে পারেননি তার মানে। তিনিও তো পদ্মনাভের মতো নিজের চারদিকে ঊর্ণনাভ রচনা করে গেছেন, ভেবেছেন বিরাট কিছু করছেন, আসলে কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। শুধু ক্ষমতার অলিন্দে থেকেছেন, শুধু গেট মিটিঙের জন্যে নিজের রূপ ভাঙ্গিয়ে লোক জড়ো করেছেন, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টির ক্ষমতাকে, শিক্ষাক্ষেত্রে তার সর্ব ময়তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোন দিকে না তাকিয়ে কাজ করে গেছেন, সেটা নিশ্চয় জরুরি কাজ, কিন্তু সেটা তো পিরামিডের একদম ওপরের তলা। একদম নিচে, পায়ের কাছে যারা আছে, যারা স্কুল অব্দি পৌঁছতেই পারেনি, যাদের ন্যূনতম শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান দেওয়া যায়নি, তাদের এই অবস্থার জন্যে তিনিও কি সমান দায়ী নন?
তাই সেদিন পদ্মনাভর মাথা বুকে চেপে তিনিও অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন, কতদিন, কতদিন এভাবে কাঁদতে পারেননি তিনি, যেদিন ইউনিভার্সিটির পেছনের রাস্তায় একটা বইয়ের দোকান থেকে বেরোবার সময় প্রসাদবাবু গাড়ি থামিয়ে বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম একটু আসুন, জনবার্তা ভবনে একটা সভা ডেকেছি, কাল বলেছিলাম, আপনার মনে নেই বোধহয়’ তাঁরও মনে হয়েছিল ইস, এই সভার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল কীভাবে, আসলে জয়েনিংর উত্তেজনায় মনে ছিল না হয়তো, তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়িতে উঠেছিলেন, মানিকতলায় জনবার্তা ভবন, অল্প রাস্তা, উঠে ক্লান্তিতে চোখ বুজে এসেছিল, প্রসাদবাবু ফ্লাস্ক খুলে কফি এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন ‘নিন ম্যাডাম কফি খান, ভাল লাগবে, আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে’ কফির কাপ নিতে নিতে তাঁর মনে হয়েছিল, সত্যিই তিনি খুব ক্লান্ত, একটু এলোমেলোও নন কি? নইলে আজ জয়েনিংর মতো একটা বিশেষ দিনে তিনি পরে আছেন কালকের লাট খাওয়া শাড়িটা, নতুন একটা ইক্কত বেছে রেখেছিলেন, কালো আর হলুদের কম্বিনেশন, সঙ্গে দস্তার গয়না, কিন্তু রাতে ফোনটা এসে সব এলোমেলো হয়ে গেছিল, একটা হিমস্রোত বয়ে গেছিল শিরদাঁড়া দিয়ে। রাতে এমনিতেই হালকা খান, ক্লিয়ার চিকেন সুপ আর টোস্ট, নয়তো খই দুধ কলা, মাঝে মাঝে মুড়ি বেগুনিটাই তাঁর রাতের খাওয়া। সেটা সাড়ে আটটা থেকে নটার মধ্যেই খাওয়া হয়ে গেছিল, তারপর মার সঙ্গে কথা হচ্ছিল একটু মার ঘরে বসে। দীপন সেদিন ফিরবে না মার কাছেই জেনেছিলেন, দীপন আজকাল তাঁকে কিছুই জানায় না। ফিরবে কি ফিরবে না, সেটা মাকেই ফোন করে জানিয়ে দ্যায়, এ নিয়ে কিছু বললে বলে ‘মাকে ফোনে পাওয়া যায়, তুমি কখন কোথায় থাকো কী করে জানব।’
‘দীপনের সঙ্গে সম্পর্কটা আর টানা যাবে না মা, ও খুব বিটার হয়ে গেছে’। এই কথা বলে তিনি এক কাপ কফি নিয়ে বসেছিলেন, কফি আর একটা সিগারেট খেয়ে বই পড়তে পড়তে ঘুমনো অভ্যাস, কিন্তু তখনই মা বলল ‘তোর ফোন’
‘কে?’
‘নাম বলছে না, বলছে বিশেষ দরকার, একটু খসখসে গলা, হাঁফাচ্ছে, অ্যাজমা আছে মনে হয়’
বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরতে গেছিলেন সে রাতে, আর ওপার থেকে খসখসে ঠান্ডা গলায় কেউ একজন বলেছিল ‘কাল বেরোবেন না মিসেস ব্যানার্জি, কাল দুপুর থেকে আপনার খারাপ যোগ আছে’
সময়, যোগ, শুভ অশুভ- এইসব তিনি কি বিশ্বাস করেন ? না করেন না? কিন্তু এটা তো ঠিক, তিনি অনেকের সঙ্গে সেই মানুষটার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন, গ্রহ নক্ষত্র যিনি পকেটে পুরে রাখার কায়দা জানেন। এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেলেন তিনি। কিন্তু তিনি তো শতরূপা ব্যানার্জি, দমতে জানেন না, তিনি বললেন ‘আপনি কে জানতে পারি? এত অযাচিত উপকার করতে চাইছেন’ ফোন কেটে দিয়েছিল লোকটা। ফিরে এসে দেখলেন কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে, তাই আর এক কাপ বানিয়ে নিয়েছিলেন, এটা একটা আমেরিকান ব্র্যান্ড, তাঁর এক দূরের প্রেমিক পাঠায় মাঝে মাঝে, পাউচের ওপরের কভার খুলে গরম জলে মিনিট খানেক চুবিয়ে নিতে হয় ফিল্টার টা। এক বাক্সে অনেকরকম ফ্লেভার থাকে, ফ্রুটি, নাটি, চকোলেটি, স্ট্রং। শতরূপা একটা স্ট্রং পাউচ কেটেছিলেন এখনো মনে আছে, সাধারণত রাতের কফিটা একেবারেই স্ট্রং খান না তিনি। ঘুমের দফা রফা হয়, মাঝে মাঝে শুধু রাত জেগে কোন কাজ শেষ করার ডেডলাইন থাকলে অন্য কথা। না, সেই রাতে তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না, যাতে না হয়, তার জন্যে আগে থেকে তিনি সব কাজ সেরে রেখেছিলেন। সেই রাতটা তিনি একটা নিটোল ঘুম চেয়েছিলেন, একদম যতিচিহ্ন হীন, ঝাঁকুনিহীন একটা ঘুম, যাতে পরেরদিন সকালটা পরিপূর্ণ প্রশান্তিতে শুরু করতে পারেন। হ্যাঁ, পরের দিনটা তাঁর জীবনের একটা বিশেষ দিন ছিল। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ থেকে অ্যাকাডেমিক্সে সরে আসার স্বপ্ন বহু বছর ধরে তিনি লালন করেছিলেন।কিন্তু প্রচণ্ড বাধা আসছিল, ভেতর থেকেই। অনেকেই চাইছিল না তিনি লেকচারার পোস্টে যোগ দেন। সেই সময় একটা কোথাও সমীহ ছিল, অধ্যাপকদের দিয়ে যে সব কাজ করানো যাবে না, এটা তখনো সমাজের মানসে কাজ করত ভেতরে ভেতরে। শতরূপা অধ্যাপক হয়ে গেলে পার্টির কি কোন কাজে লাগবেন আদৌ? পলিতকেশ বুড়োর দলই তো পার্টি, সেখানে উত্তরের জানলা সবসময় বন্ধ রাখাই দস্তুর। সেই ‘এদিকে তাকিও না, ঘাড় বেঁকিও না’-র আবহে শতরূপা একটা দমকা হাওয়ার মতো।ওঁর পোশাক আশাক, চলাফেরা, মেলামেশার বৃত্ত কোনটাই টিপিকাল পার্টি করা মেয়েদের মতো নয়। নাকি তিনি নন্দিনী, যে বারবার জালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে ‘জাল ছেড়ে বেরিয়ে এসো রাজা’। রাজা শোনেননি, শুনলেও বুঝতে পারেননি সময় বদলাচ্ছে।শতরূপার কাছে সেই সময়ের ডাক এসে পৌঁছেছিল, ওঁর শরীর, মনে, চিন্তা চেতনায় যে হিল্লোল জেগেছিল তা নতুন বিশ্বায়িত পৃথিবীর। সেটা নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল অন্যদের। যারা খরগোশের মতো বালিতে মুখ গুঁজে ভাবছিল কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না। ওদের কাছে মেয়েদের, বিশেষ করে অধ্যাপক মেয়েদের একটা ধাঁচা ছিল। সাদা খোলের তাঁত, মোটা চশমা, খিটখিটে অসুন্দর চেহারা, কপালে কোনরকমে একটা আঠা খুলে আসা টিপ। যারা বইয়ে ঘাড় গুঁজে থাকবে, নোটস তৈরি করবে, বাড়িতে গেলে হাতের তেল হলুদ আঁচলে মুছতে মুছতে দরজা খুলে দেবে। সেখানে শতরূপার অলৌকিক সৌন্দর্য, সর্ষেক্ষেতের মতো খোলা পিঠ, বহু পুরুষ অনুরাগী, এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট দেখে আঁতকে উঠেছিল অনেক সাম্যবাদীই। তাদের দিক থেকে প্রবল বাধা আসছিল। সেইসব বাধা পেরিয়ে কাল তিনি লেকচারার পোস্টে জয়েন করতে যাচ্ছেন। একটা বিশেষ দিন তাঁর জীবনে। তাই ঘুম খুব জরুরি ছিল। কিন্তু ফোনটা পেয়ে ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগছিল। কফিও ঠান্ডা হয়ে গেছিল। তাই আরেক কাপ কফি বানালেন। এই কফির একটা অদ্ভুত পোড়া পোড়া গন্ধ আছে, ভেজালেই সারা বাড়ি সেই গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ে আর একটা চনমনে ভাব আসে। মনে হয় বাড়ি ভর্তি অনেক বন্ধু, আড্ডা, হইচই। কফি খেতে খেতে তাঁরও মন খারাপ কেটে যাচ্ছিল। কোথাকার একটা উড়ো ফোন, তাকে এত গুরুত্ব দেবার কী আছে? কফি শেষ করে রাত পোশাক পরে শুয়ে পড়লেন, নেহাত অভ্যেস হয়ে গেছে, তাই নাইট ক্রিম মাখা আর চুল আঁচড়ানোও বাদ গেল না। একটা বই নিয়ে শুয়েছিলেন রোজকার মতো। অসহ্য লাগতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। তারপর ঘুমের চেষ্টা করলেন। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। উঠে দেখে এলেন পাশের ঘরে মা ঘুমোচ্ছে। কেমন বাচ্চা মেয়ের মতো লাগছে মাকে। মা কি একটু শ্রিংক করে গেছে? সেই প্রথম মনে হল মার চেহারা বেশ ভেঙে গেছে। তাঁর আর দীপনের এইভাবে দূরে সরে যাওয়াটা মা মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু তিনি কীই বা করতে পারেন? তিনি এত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেছেন, এত পুরুষ তাঁর চারপাশে- এইজন্যেই কি দীপন সরে গেছে? নাকি দীপন সরে গেছে বলেই তিনি এইসবে জড়িয়ে পড়েছেন? কে দেবে এর উত্তর? এ যে ডিম আগে না মুরগি আগে-র মতো প্রশ্ন। শুধু এটুকু জানেন, তিনি জীবনের যে রাস্তায় এগিয়ে গেছেন, তার থেকে সরে এলেও দীপন আর তার কাছে ফিরবে না। ও একটা ছোট মনের সন্দিগ্ধমনা পুরুষ, যে চায় বৌ চাকরি করবে, কিন্তু তার বাইরে তার কোন জগত থাকবে না। সে ওর কথায় উঠবে বসবে, কার সঙ্গে মিশবে, কার ফোন আসবে বাড়িতে, সব সে নিয়ন্ত্রণ করবে, সব। তাঁর পার্টিও সেটাই চায়। শতরূপার মনে হল তাঁর চারদিকে যেন একটা লোহার জাল নেমে আসছে। অনেক রাত অব্দি ছটফট করলেন তিনি। উঠলেন, টয়লেটে গেলেন, জল খেলেন বারবার। শেষ রাতে হয়তো সাড়ে চারটের পর ঘুম এসেছিল, আর ঠিক তার আগে কি আশ্চর্য, তাঁর দীপনের কথাই মনে পড়েছিল। মনে হয়েছিল, ও যদি থাকত পাশে, এই বিছানায়, তবে রাতটা এত দুঃসহ কাটত না।
ঘুম ভাঙল নটার পর। উঠেই রেগে গেলেন মার ওপর। কেন ডাকেনি মা, আজ তো সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছতে হবে তাঁকে। কালকের পরা শাড়িটাই পরলেন তাড়াহুড়োয়, মার ওপর রাগ দেখিয়ে ভেবেছিলেন কিছু খাবেন না। মা জোর করে খাইয়ে দিল, ইলিশের তেল দিয়ে গরম ভাত দু মুঠো, আর ইলিশের ডিম ভাজা। তাঁর অল টাইম ফেভারিট। সেই তাঁর বাড়ির শেষ খাওয়া।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes