
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পর্ব ৩
তৃষ্ণা বসাক
‘প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব।
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন —> প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন —-> দ্বিতীয় পর্ব
-কটায় রিহার্সাল?
ফাইল থেকে মুখ না তুলেই বললেন মোহরমালা। তূণীর বসে আছে ওভাল টেবিলের ডানদিকের একদম শেষ চেয়ারে। এখান থেকে সে মোহরমালার সাদা পেট দেখতে পাচ্ছে, তাঁর নীল রঙের শাড়ির আঁচল কীরকম কায়দায় তাঁর বাঁদিকের বুকটিকে নীলপদ্মের মতো ফুটিয়ে রেখে কাঁধে গিয়ে পড়েছে, সব, সব দেখতে পাচ্ছে সে। মোহরমালার পারফিউমের গন্ধে তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে। সে কোনরকমে বলতে পারল ‘ছটায় ম্যাডাম’
‘এহেঃ আর তো হাফ অ্যান আওয়ারও নেই। এইরে, আমার মেয়ে আসবে তো এক্ষুনি। আচ্ছা একটু পিছনো যায় না রিহার্সালটা?’
তূণীর কোন উত্তর দিল না, দিতে ইচ্ছে হল না। রেজিস্ট্রার ম্যাম বললে রিহার্সাল পেছোবেই, তাই এ কথার আর কী উত্তর দেবে সে? সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। মাঠটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। ফুটবল খেলছে ছেলেরা। মাঠ ঘিরে গাছ। বকুলগাছের নিচে বাঁধানো বেদীতে দুজনে বসে আছে- রিনি আর আকাশ। দেখে একটুও কষ্ট হল না তূণীরের। ছমাস আগেও রিনি আর তূণীর ওখানে বসেছে। অন্ধকার হয়ে গেলে ঝিলের ধারে… মেহগনি গাছদুটো কি ঝিলের ধারের দুটো?
মোহরমালা চশমা তুলে একবার তূণীরের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, ‘দেখো তো, কটা বাজে?’
কোন মানে হয় না এ কথার। মোহরমালা ঘড়ি পরেন না যদিও, কিন্তু মোবাইল তো রয়েছে। সামনে কম্পিউটারও খোলা। তবু তূণীরকেই বললেন। তূণীরের গাটা শিরশির করে উঠল। তূণীর তো পার্সোনেলের এক সামান্য ক্লারিকাল স্টাফ। তাও মাস কয়েক হল ঢুকেছে, এখনো কনফার্মেশন হয়নি। সে মোহরমালা ধরের এত কাছাকাছি আসতে পারল, শুধু তো এই গানের কারণে। সে তো এখানকারই ছাত্র। ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের। আগে সে গীতি সংসদের সদস্য ছিল। রিনি, ইতিহাসের রিনি, সেও তো ছিল। ওদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন, এম ফিল- সব সমান্তরাল ভাবে বয়েছে, আর ওদের প্রেমও। কিন্তু অ্যাসিস্টেন্ট রেজিস্ট্রারের কাছে পি এইচ ডির রেজিস্ট্রেশন করার পর থেকে রিনি দূরে সরতে শুরু করল। তূণীর নাকি ছক কষেই পি এইচ ডির রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে। শাসক দলের ছত্রছায়ায় থেকে সে তার কেরিয়ার গড়তে চায়। তারপর ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরিটা পেয়ে যেতে সে আরও দূরে সরে গেল। এই চাকরির পক্ষে সে ওভার-কোয়ালিফায়েড। এম এ-র সার্টিফিকেট সে শো করেনি ইন্টারভিউতে। খারাপ লেগেছিল খুব। কিন্তু এখন এটাই তো হাতের সামনে পাওয়া যাচ্ছে। লেকচারারের পোস্ট কবে বেরোবে, তাছাড়া সেখানে আরও ভিড়, তার ওপর শাসক বদলালে সেটা তো আর জুটবে না। তাই যা পাওয়া যাচ্ছে হাতের সামনে। বাবা নেই, মা ক্যানসার পেশেন্ট, বোন টুয়েলভ পড়ছে। আর কি ঝুঁকি নিতে পারে তূণীর?
রিনি সরে গেলেও, রিনিকে সে মুছতে পারেনি। একসময়ের প্রিয় একটা গান, পরে হয়তো সেভাবে শোনা বা গাওয়া হয় না, কথাগুলো পুরো মনে নেই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে গানটা যেমন থেকে যায়, পুরোপুরি মরে যায় না, সেইরকম রিনি থেকে গেছে তার ভেতরে। আর এই গানই তাকে নিয়ে এসেছে মোহরমালা ধরের এত কাছে।
‘এই তূণীর, এই যে দেখো আমার মেয়ে। এই তূণীর, এই ছেলে’
তূণীর চমকে তাকায়। মোহরমালা ধর হাসি হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। ও লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়াতে যায়। অমনি কে যেন হাসিতে ফেটে পড়ে। তূণীর দেখে লাল টপ আর জিনস পরা একটা মেয়ে, যাকে দেখেই সেক্স বম্ব ছাড়া কিছু ভাবা যায় না, সে হাসছে ওকে দেখে।
‘তূণীর, এই দেখো , আমার মেয়ে কিঞ্জলকিনি, আজ পি এইচ ডি সাবমিট করল।’
মেয়েটা ওর দিকে হাত নেড়ে বলল ‘হাই’
তূণীর কোনরকমে বলল ‘কনগ্র্যাটস’। তারপর বলল ‘ম্যাম, ছটা থেকে রিহার্সাল, পাঁচ মিনিট বাকি ছটা বাজতে।’
মোহরমালা ঠোঁটে একটা অপরূপ অসহায়তার ভঙ্গি করে বললেন ‘কী করি বলো তো? এখনই, সেই গাছ কাটা নিয়ে পরিবেশবাদীরা আমার মাথা খেতে আসবে, এত সেন্সিটিভ একটা ইস্যু’
কিঞ্জলকিনি ফোন করছিল কাকে, ফোনটা হোল্ডে রেখে মোহরমালাকে বলল ‘ও, কাম অন মা! ইউ আর ফ্রম রুলিং পার্টি! ইউ মাস্ট নো হাউ টু হ্যান্ডল দিজ কিড়ে মকিড়ে’
তূণীর এই চাকরিটায় খুশি নয়। রিনি তাকে ছেড়ে চলে গেছে, যেন তূণীর একটা ঘৃণ্য জীব। আজকাল তূণীরেরও নিজেকে তাই মনে হয়। সে সারাক্ষণ নিজের থেকে পালিয়ে বেড়ায়। শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে হয়- এটাই তার মনে হয়। আজ এই মেয়েটা যেভাবে সেটাকে বুক বাজিয়ে বলল, বিশেষ করে মায়ের অফিসে দাঁড়িয়ে, যেভাবে দম্ভ আর নির্লজ্জতা ফুটে উঠল তার কথায়, এতগুলো স্টাফ এখানে, বাইরের ভিজিটর আসা যাওয়া করছে। তূণীরের মনে হল মোহরমালা নগ্ন হয়ে গেলেন চোখের সামনে। একমুহূর্তের জন্যে তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে মেয়েকে বললেন ‘তুমি কিছু খাবে? আনাবো?’
‘না না। আমি তোমার ওই বাঁটুল মতো স্টাফটা আছে না, হারাধন, ওকে নিচ্ছি একটু। এই থিসিসগুলো আমার গাড়িতে তুলে দেবে। বাব্বা, কী ভারি’
সেইমুহুর্তেই পর্দা সরিয়ে অজিত সিং আর চন্দন ঘোষ ঢুকল। কিঞ্জলকিনি ফোন করতে করতেই হাত নাড়ল। অজিত সিং বলল ‘কি? জমা হয়ে গেছে? ওই সামনে গায়েনের নাম লিখেছো তো?’
‘সামনে মানে?’
‘আরে ওই’
ঠিক কথাটা খুঁজে পাচ্ছিল না অজিত সিং। তূণীর আন্দাজ করে বলল ‘অ্য্যাকনলেজমেন্ট?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। লিখেছো?’
কিঞ্জলকিনি ফোন ধরে রেখেই কাঁধ শ্রাগ করে বলল ‘ এবাবা!’
‘সেকি! লেখো নি? চটে যাবে তো?’
‘ও আঙ্কল!’ গলায় আদর ফুটে ওঠে কিঞ্জলকিনির। সে এগিয়ে এসে অজিত সিং -র কাঁধে হাত দিয়ে বলে ‘ওঁর কপিটার অ্যাকনলেজমেন্ট পেজে নাম লিখে প্রিন্ট করে ঢুকিয়ে দেব। স্পাইরাল তো’
অজিত হাসতে হাসতে বসে পড়ে, চন্দনও বসে। ওদের বসার ভঙ্গি দেখে মনে হয় খুব অল্প সময়ে হবে না। তূণীর ছটফট করে উঠে পড়ে।
মোহরমালা হাসি হাসি মুখেই বলে ‘কী হল, যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ ম্যাম, ছটা বেজে গেছে। আমি না গেলে অসুবিধে হবে। আপনি যদি পারেন, পরে’
‘শিওর। এদেরটা মিটিয়েই। ধরে ফেলব তোমাদের’
তূণীর বেরিয়ে আসতে আসতে শোনে মোহরমালা ওদের বলছেন ‘আজ কি আসবে কালী মন্দিরে? কৌশিকী অমাবস্যার স্পেশাল ভোগ আছে। দেরি হলে অসুবিধে নেই। বাড়িতে এনে রাখতে বলব’
কালীমন্দির শুনেই কেন যেন ফিরে তাকায় তূণীর। দেখে চন্দন কান এঁটো করা হাসি হেসে কিঞ্জলকিনির সিগারেট ধরিয়ে দিচ্ছে।
(ক্রমশ)
বেশ জমে গেছে।
Thanks a lot