
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পঞ্চদশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের পঞ্চদশ পর্ব।
১৫
‘জানেন স্যার, একবার পুলিশের গায়ে হাত দিয়েছিলাম! ভাবুন একবার! এমনিতে আমাকে দেখতে এই নেংটি ইঁদুরের মতো, ছোটখাটো চেহারা, বারোমাস অম্বলের রুগী। এই আপনাদের মতো পার্টিরা সকালে কত লুচি নিয়ে সাধাসাধি করে, আমার যে মুড়ি চিঁড়ে, সেই মুড়ি চিঁড়ে। দেখবেন দুপুরে রাতে মাছটা ডিমটা ভাতে মুছে নিয়ে খাই, ওই লাল লাল ঝোল ছুঁইই না, ডাল দিয়ে ভাত খাই। আর মাংস তো খাইই না মোটে, নমাসে ছমাসে একবার, তাও বউয়ের হাতের রান্না। সেই আমি একবার রেগে গেলে চিনতে পারবেন না। একদম অন্য মানুষ। ধারেকাছে কেউ যেতে পারবে না। হাত চালিয়ে দেব উল্টোপাল্টা। তাও আবার পুলিশকে। লোকে বলে বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে কত যে ঘা তার লেখাজোখা নেই, কথাটা যে হাড়ে হাড়ে সত্যি, নিজের লাইফে বুঝেছিলাম, বুঝলেন স্যার। একটা বছর লাইফ থেকে পুরো মাইনাস , ভাবুন গোটা একটা বছর! বাড়ির লোক কত খুঁজেছে, মা তো কেঁদে কেঁদে অন্ধ হবার জোগাড়। কত জায়গায় মানত করেছে। খবরই দিতে পারিনি তো, তাও ভাগ্যিস তখনো বিয়ে করিনি। বিয়ে করলে আর রক্ষে ছিল? বউয়েরা কেমন হয় জানেনই তো। একেবারে উস্তুম খুস্তুম করে ছাড়ত’
কেউ শুনছে নাকি আদৌ?
এসব ভাটের গল্প শুনতে বয়ে গেছে কারো। তবু পটা বলবেই গল্পটা। গাড়িটা খালি হয়ে এসেছে। দুটো ফেমিলি নেমে গেছে। শ্যামবাজার আর হাডকোর মোড়ে। এই লোকটাই শুধু নামতে বাকি। একা গেছিল, ফেমিলি নেয়নি সঙ্গে। কে জানে ফেমিলি আছে কিনা আদৌ। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলতে শোনেনি। বাচ্চাদের সঙ্গে অল্পসল্প যা, তবে ওদের মাঝে মাঝে টফি চকোলেট কিনে দিয়েছে, সেটা চোখে পড়েছে পটার। ওকেও দিয়েছে। সেসব পটার ব্যাগেই জমেছে। এবারে ট্রিপ শেষ করে ও ঠিক করেছে বাড়ি যাবে কদিনের ছুটি নিয়ে। তখন মেয়েকে দেবে চকোলেটগুলো, কত খুশি হবে মেয়ে। বাপের ওপর খুব টান তার। প্রায়ই নাকি কাঁদে রাতে ঘুমোতে গিয়ে, বায়না করে কলকাতায় তার কাছে এসে থাকবে। কিন্তু কোথায় রাখবে ওদের পটা? এত বছর কলকাতায় ঘষছে, অথচ নিজের বলতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি একটাও, করতে পারেনি সে। ভাবলে নিজের ওপর ধিক্কার জন্মে যায়।সত্যি তারা তিনজন কলকাতায় থাকলে কী ভালোই না হত। কাজের ফাঁকে সে বৌ মেয়েকে নিয়ে চিড়িয়খানা, নিকো পার্ক, ইকো পার্ক, জাদুঘর যেত, তার গাড়ি চড়ে ফেমিলি নিয়ে আরও যে যে জায়গায় ঘুরতে যায় লোকে, সেইসব জায়গাতেও যেত, দীঘা, মন্দারমণি, পুরী দার্জিলিং।
বাড়ি গেলেই মেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলবে ‘পাহাড় আর সাগর দেখাতে নিয়ে যাবে বাবা? কবে নিয়ে যাবে? আমার ভুগোল বইতে ছবি আছে, দেখবে? আমি কবিতাও জানি, শুনবে?’ এই বলে পটার সম্মতির অপেক্ষা না করে সে বলতে শুরু করে দ্যায়-
সবার আমি ছাত্র
কবি সুনির্মল বসু
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে;
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান
হই যেন ভাই মৌন-মহান্,
খোলা মাঠের উপদেশে—
দিল্-খোলা হই তাই রে।
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখালো হাসতে মেদুর,
মধুর কথা বলতে।
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর,—
অন্তর হোক রত্ন-আকর;
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে।
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষাণ দিল দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে
গান জাগালো আমার প্রাণে,
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।
বিশ্ব-জোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবের নতুন জিনিস,
শিখছি দিবারাত্র;
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়
পাঠ্য যে-সব পাতায় পাতায়,
শিখছি সে-সব কৌতূহলে
সন্দেহ নাই মাত্র॥
দেখেছ তো পাহাড় আমাদের মৌন মহান হতে শেখায়, মৌন মানে জানো তো? চুপ। মহান মানে কী বাবা, ভালো বুঝতে পারিনি। আর সাগর বলে তার মতো রত্ন আকর হতে। রত্ন আকর মানে অনেক দামিদামি পাথর আছে যেখানে, মা বলেছে আমাকে।মা বলেছে সমুদ্রের নিচে যেমন দামি দামি জিনিস আছে, আমাদের মনটা সেরকম দামি দামি জিনিসে ভরে ফেলতে হবে। সেইসব দামি জিনিস কিন্তু টাকা পয়সা গয়নাগাঁটি নয়, বুঝেছ, ও বাবা? তাহলে কী বল তো?’
মেয়ের পাকা পাকা কথায় অবাক হয়ে যায় পটা, চোখে জল আসে তার। সে এত সামান্য মানুষ, তার ঘরে এত রত্ন! আর আরও অবাক হয় সে, তার বৌ মনি, মনিয়ারার বাংলা জ্ঞান দেখে। সে নিজে তো ক অক্ষর গোমাংস, তার খুব চিন্তা ছিল মেয়েকে কী ভাবে পড়াবে। এত প্রাইভেট টিউশন দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। বিশেষ করে বাংলা কী করে শিখবে মেয়ে? মুসলমান মা, ওরা কি বাংলা জানবে আদৌ? এখন তাকে লজ্জা দ্যায় মনিয়ারার বাংলা জ্ঞান। তার ধারণা মনির মতো বাংলা তাদের গ্রামের স্কুলের হেড মাস্টারও জানে না।
বেশি লোকের সামনে পটা মুখ খোলে না একদম। তার পছন্দ একজন দুজন লোক, সে লোক তার পছন্দের হতে হবে আবার। এই লোকটাকে পটার পছন্দ হয়েছে। সারা টুরে একেই তার একমাত্র ভদ্রলোক মনে হয়েছে। বাকি দুটো পার্টি, যারা গেছিল, ছোটলোক টাইপ। স্বামী, স্ত্রী আর মেয়ে নিয়ে একটা ফেমিলি। আর একটায় স্বামী, স্ত্রী আর ছেলে। মেয়েছেলেগুলো জানলার ধারের সিট নিয়ে , বাচ্চাদের খাবারের ভাগ নিয়ে চেল্লামেল্লি করে গেল সারাক্ষণ। আর লোকদুটো ওঠা থেকে খিচখিচ করে গেল পটার কেন স্মার্ট ফোন নেই। গুগল ম্যাপ ছাড়া কী করে ড্রাইভার পাঠিয়েছে পরিমল সাহু?
লোকটা ফোনই করে বসল পরিমল সাহুকে, যাকে পটা ডাকে ছোড়দা বলে। আর সুবিমল সাহু হচ্ছে বড়দা। সাহু কার রেন্টালের এই দুই ভাই মালিক। ফিফটি ফিফটি। লোকটা পরিমল সাহুর ফোনে বার বার সুইচড অফ পাচ্ছিল। হাসি পেল পটার। শুক্রবার সারা সন্ধেই ছোড়দার ফোন সুইচড অফ থাকে। প্রতি শুক্রবার ও থাকে বউবাজারে রুমকির ফ্ল্যাটে। ছোটবউদি জানে, বলে বলে হাল্লাক হয়ে গেছে, ঘাঁটায় না আর। রুমকির ওখানে গিয়েই ফোন অফ করে দ্যায় ছোড়দা। তাই পাবেই না কেউ। বাড়ির সবাই, এমনকি বাচ্চারাও জানে এ কথা, আর ড্রাইভাররা জানবে না? পটা জানে, কিছু কিছু কথা কানে এলেও তা নিয়ে কৌতূহল দেখাতে নেই, যেখান থেকে পেটের ভাত আসে, সেখানে তো কখনোই নয়। তবে পটা চুপ করে থাকলেও ছোড়দা পারে না । সোমবার দেখা হলেই ছোড়দা তার সুখের কথা শোনাতে চাইবে পটাকে। কান বন্ধ করে থাকলেও ঢুকে যাবে সেসব কথা কানে।তুখোড় মেয়ে রুমকির গুণপনা শুনলে অন্য লোকের কী হত কে জানে, পটা কিন্তু ভেতরে ভেতরে দ মেরে যাবে। এমন দ যে বাড়ি ফিরে মনিকে দেখেও তার শরীর জাগবে না, বাড়ি ফেরাটাই পুরো মাটি হয়ে যাবে। তাই আজকাল ছোড়দাকে একটু এড়িয়ে যেতে চায় পটা, বিশেষ করে সপ্তার শুরুতে। বুঝতে পারে এতে ছোড়দা তার ওপর চটে যাচ্ছে। যেকোন দিন তাকে ছাড়িয়ে দিতে পারে। তার রংদার প্রেমকাহিনি না শোনার অপরাধে।
ফেমিলি নিয়ে যে লোকদুটো এসেছে, একটা ঢ্যাঙা, একটা হোঁতকা। ঢ্যাঙাটা ফোন রেখে একটা খিস্তি করে বলল ‘বোকাচোদা সুইচ অফ করে রেখেছে।’
অমনি ওর ছেলে বলে ‘বোকাচোদা কার নাম বাবা?
গাড়িতে হাসির রোল ওঠে। লোকটার বৌ, সবাই যাকে মাম্পি মাম্পি বলে ডাকছিল, হেব্বি ক্ষেপে যায় বরের ওপর। ‘কতবার বলেছি বাচ্চার সামনে মুখ খারাপ করবে না, এখন দেখো নিজে। এবার স্কুলে গিয়েও বলবে। গার্জেন কল হলে তুমি যাবে বলে দিচ্ছি’
অবস্থা আরও আয়ত্তের বাইরে চলে যায় যখন আরেকটা বাচ্চা, একই বয়সী মেয়ে, বলে ‘এই শাক্য, আমারও একটা বোকাচোদা আঙ্কল আছে, জানিস? বাবা খালি বলে এই বোকাচোদা, এই বোকাচোদা’
এটা চলতেই থাকল অনেকক্ষণ ধরে, যতক্ষণ না পেছনে চুপচাপ বসে থাকা একলা লোকটা ওদের রুমাল দিয়ে একটা ম্যাজিক দেখাতে শুরু করল। সেটা শুরু হবার পর সদ্য শেখা খারাপ কথাটা ভুলে গেল ওরা। তবে লাভের মধ্যে হল কি সারা রাস্তা ঢ্যাঙাটা আর মুখ খারাপ করেনি। পেঁচার মতো মুখ করে গুগল ম্যাপ খুলে বসে ছিল।
সেই গুগল, যাকে সবাই গাড়িতে গুগল জেঠু বলছিল, ভগায় জানে, কেন, তো দেখা গেল, মোটেই রাস্তা চেনে না। গড়পঞ্চকোট থেকে পুরুলিয়া যাবার সময় সন্ধে নেমে এল, তখনো গুগল দেখাচ্ছে আরও একশ কুড়ি কিলোমিটার। তখন গুগল ছেড়ে মোড়ের চায়ের দোকানে জিগ্যেস করা হল। সেখানে দোকানী ত বটেই, আরও কিছু মাতব্বর গোছের লোক, সবাই সমস্বরে বলল বাঁদিকের রাস্তা ধরতে। ওখান দিয়ে গেলে অযোধ্যা পাহাড় নাকি মাত্র আধা ঘণ্টা। অমনি গাড়ির মেয়েছলেগুলো চেঁচিয়ে উঠল ‘বাঁদিকেই চলো, বাঁদিকেই চলো। বাচ্চাগুলোর খিদে পেয়েছে, সেই কখন খেয়েছে। আমাদেরও কোমর ধরে গেল’
পটা বাঁদিকের রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখেছিল মোটামুটি চওড়া একটা রাস্তা, দুপাশে ধানক্ষেত। তারও বেশ লোভনীয় মনে হয়েছিল প্রথমে। জ্যামে পড়তে হবে না অন্তত। রাস্তাও তো বেশ চওড়া। গাড়িতে সবাই কলরবলর করছিল-
‘দারুণ সিনিক বিউটি দেখো। আর একটা কথা মানতেই হবে সত্যি কাজ হচ্ছে রাজ্য জুড়ে। আমি কিন্তু ভাই কোন পার্টি করি না, নিউট্রালি বলছি। আগে কী রাস্তা ছিল ভাবো।গাড়ি পুরো ড্যামেজ হয়ে যেত।’
পটারও মনে হয় আজকাল এগুলো। আগে এসব রাস্তায় আসতে হলে মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। কী খারাপ রাস্তা ছিল। এখন সিঁদুর পড়লে তুলে নেওয়া যাবে। আসলে আমাদের দেশের লোকগুলোই খারাপ। সরকার তো কত কিছু করে দিচ্ছে, রাখতে পারে না। এই রাস্তার ওপর ধান শুকোতে দেবে, পাকা পায়খানা করে দিলেও রাস্তায় হাগবে। পোঁদে হাওয়া না লাগলে সুখ হয় না হারামজাদাদের!
পটা বাঁদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে দিল। প্রথমে তো খুব ভালই লাগছিল। গোধূলির হলুদ আলো শূন্য ধানক্ষেতের ওপর এসে পড়েছে। বুকের মধ্যে ব্যথা জেগে ওঠার মতো রঙ সে আলোর। পটার মনির কথা মনে পড়ছিল। মনি আর পিংকি। মনিয়ারা থেকে মনি। ঘুটিয়ারিশরিফের আবদুল লতিফের পাঁচ মেয়ের সবার বড়। সোনারপুরে চাচাতো বোনের বিয়েতে এসেছিল, যে বিয়েতে পটা গেছিল রশিদের সুবাদে। রশিদ তার মতো সাউ কার রেন্টালে গাড়ি চালায় অনেক বছর। কোম্পানির সব ড্রাইভারের মধ্যে রশিদের সঙ্গেই ভাব বেশি পটার। সেই বিয়েতে এসে সর্বনাশ হয়ে গেল পটার। কী যে মায়া ছিল মনিয়ারার কালো চোখের তারায়। আটকা পড়ে গেল সে। এদিকে বাড়িতে সবাই তারা দীক্ষা নেওয়া, তার গলায় তুলসীবীজের মালা বারোমাস। কালীঘাটে বিয়ে করে সেই মনিয়ারাকে গ্রামের বাড়িতে তুলল পটা। কলকাতায় কোথায় রাখবে? এখানে সাউ রেন্টালের ড্রাইভারদের ঘরে চারজন মিলে থাকে সে। যা মাইনে দ্যায়, তাতে বস্তিতেও ঘর পাবে না, তাহলে তো ওকে বাবার বাড়িতেই ফেলে আসতে হয়। সেখানে একবারের বেশি আর যায়নি পটা। শ্বশুরবাড়িতে সবাই জানে সে মুসলমান, তার নাম রেজাউল। শ্বশুর খুব গরিব, ট্রেনে মনিহারি জিনিস ফেরি করে। তাই একটা মেয়ে নিজেই পার হয়ে যেতে বেঁচেছে।বিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। দুবেলা খেতে চোদ্দটা পেট। এক ছটাক জমি নেই। কুঁড়ের সামনে এক ফালি জায়গায় কটা পেঁপে, কুমড়ো, কাঁচা লঙ্কা গাছ, আর মুরগি পালে ছোট দুই বোন। কখনও ডিম বেশি পেলে আধখানা ডিমের ঝোল।গুচ্ছের পেঁয়াজ রসুন লঙ্কা দিয়ে রাঁধা। একরাত থেকেছিল পটা। তাকে জামাই আদর করে একটা মুরগি কাটা হয়েছিল। বেশ ভালো রান্না। খুব যত্ন করে নীল হলুদ ফুল পাতা আঁকা এনামেলের প্লেটে বেড়ে দেওয়া। তবু খেতে গিয়ে কেমন গা গুলোচ্ছিল। চোখে জল আসছিল বারবার। গলায় বেড় দেওয়া তুলসীবীজের মালা যেন গলায় চেপে বসছিল। শাশুড়ি আবার দুঃখ করে বলছিল, বাড়ির প্রথম জামাই, বড় জামাই , তাকে একটু গোস্ত খাওয়াতে পারলাম না গো। সেই আদরের আকুতিটুকু মাথায় করে নিলেও মনে মনে সে ভেবেছিল, ভাগ্যিস। তখন মনিয়ারা, তার বৌ মনি বুদ্ধি করে বলেছিল ‘ও তো মাংস খায় না। পেটে সহ্য হয় না। মুরগিটাই যা খায় মাঝে সাঝে’
সেই কয়েক ঘণ্টার শ্বশুরঘর দেখে বুঝে গেছিল পটা যে মেয়ের বিয়ে দেবার ক্ষমতা এদের হতই না। তাই বিয়ে নিয়ে কোন হুজ্জুত করেনি। করলে বিয়ের দিনই ধরা পড়ে যেত পটা, তাহলে ঐ রাতেই তাকে কেটে ফেলা হত নিশ্চিত।
তবে মনিকে পেয়ে সে কৃতজ্ঞ। কোন হিন্দু ঘরের মেয়ে এসেও শাশুড়ির এত সেবা করবে না। ও যা করে। মেয়েটাও কি ফুটফুটে হয়েছে তার। কিন্তু ওদের জন্যে একটু ভালো ঘরবাড়ি করে দিতে পারল না সে। দাদারা ঠকিয়ে বাড়ির সব থেকে খারাপ অংশ দিল।
পটা মাঝে মাঝে ভাবে যদি তার গ্রামেও ধরা পড়ে যায় যে সে মুসলমান বিয়ে করেছে। কী হতে পারে!মা মরে যাবে কি শুনলে? তার প্রাণের চেয়েও বেশি মা। তার মৃত্যুর জন্যে দায়ী হবে সে।
পটা আড়চোখে দেখল লোকটা কেমন আধো ঘুম আর আধো জেগে রয়েছে। এতক্ষণ সে একাই কথা বলে যাচ্ছে, মানুষ ভদ্রতা করেও তো একটা হু হাঁ করে। মেজাজ খিঁচড়ে গেল তার। আর অমনি সেই ভয় ভয় ভাবটা ফিরে এল। আজই সকালের কথা। সকালে চেক আউট করছিল লোকগুলো, ও তখন একবার বাথরুমে গেল । রাস্তায় আর চান্স নেই। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে থমকে দাঁড়াল। ফোন কোথা থেকে বাজছে? পকেট হাতড়ে দেখল নেই, মনে পড়ল বাথরুমে ফেলে এসেছে। ভাগ্যিস ফোনটা বাজল। নইলে তো ফেলেই যেত। আর ফেলে গেলে আর পেত না। চেক আউট করে চলে যাচ্ছে তো।
তাড়াতাড়ি ফিরে এসে দেখল বেসিনের ওপরের টুকিটাকি রাখার তাকে বাজছে তার ফোনটা, নম্বর দেখে তার হাতপা জমে গেল। আবার? আবার সেই নম্বর থেকে ফোন ? সেই নম্বর, সেই জীবন তো সে ফেলেই এসেছে ভেবেছিল।
(ক্রমশ)