রতনের পাড়া  <br /> অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

রতনের পাড়া
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

একটি তীব্র ঘষাকাচের বাইরে ভোরবেলার বৃষ্টি নামলো আবার।

আমার সমগ্র চেতনা কাঙ্ক্ষিত সাম্যে ফেরেনি এখনও। আবছা চোখে আঁধার জমাট বাঁধার খেলা চলছে এখনও। দূরে মেঘ ডাকলো। ন্যাতানো কাঁথাকানি জুড়ে ঘন সবুজ ভাসছে। আমার আলো এবং অন্ধকার মিশে আমাকে ক্ষুদ্র করে তুলেছে। একটি তেলাপোকা সমান উচ্চতায় মাটি আঁকড়ে ধরে শুয়ে আছি। আমার বাম কানের ভিতরে একটি-দু’টি শব্দ বইছে। ডান কানের ভিতরে একটি-দু’টি স্পষ্ট ডাক ঘূর্ণিপাক খাইয়ে আমাকে জলের বিশালতায় আছড়ে ফেলছে। বহুদূরের বৃষ্টি-বিধ্বস্ত নীলকুঠি থেকে বিচ্ছেদ-গন্ধ ভাসছে বাতাসে।

ধীরে ধীরে আমার দেহ সমে ফিরল। উলাপুরে আমার প্রথম সকালে দীর্ঘ এক পৃথিবীর বৃষ্টি নেমে এল।

এই সাদা দেয়ালের দুনিয়া, সম্মুখে ঝুলে থাকা লাল জামা, এই সাড়ে পাঁচশ বর্গফুটের ভিতরে অনিচ্ছা-ভোরে টের পেলাম আমি মৃত। আমার হাতের রোমকূপগুলি একই রইল। নরম রোমের সাম্রাজ্য, কয়েকটি লাল বিজবিজে ফুসকুড়ি, বেখেয়ালি জড়ুল, আংটি, চুড়ি, যাবতীয় ঝনঝন অবিকৃত রইল। শুধু আমি টের পেলাম, আমি মৃত। ঘষাকাচের বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি নেমেছিল। মৃত শরীরটিকে উঠিয়ে বসালাম। এই ঘরে একটি ভাঙা নীলকুঠি আছে। পাথরে পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। স্তূপাকার এলোমেলো বাসনের ভিড়ে, একটি ভাঙা নীলকুঠি মুখ বাড়িয়ে রয়েছে। যেন সেটার অর্ধনিমীলিত জ্বলজ্বলে চোখ, যেন একটি স্বেচ্ছাধীন গাছ উঠে আসবার আশায় এখনও জেগে আছে। ঠাণ্ডা জলে হাত রেখে ভাঙা চিনামাটির টুকরো পাওয়া গেল। আমি বুঝে নিলাম অনুভূতিহীন এই আমার হাত, পা, রক্ত, মাংস, সব গেঁজিয়ে উঠবে একটু পরে।

ব্যাখ্যাহীন তারল্যে এগিয়ে চললাম মাটির জানালাটির দিকে। এই মাটির জানালাটি রেখেছি পূর্বদিকে। সেখানে ঘন সবুজ, বর্ষার খাল-বিল, এবং নৌকার যাতায়াত রাখা আছে সযত্নে। সেই সকালে বৃষ্টিতে কিছু বোঝা যায় না। কারও চলে যাবার রাস্তা এতটাই ঘোলাটে হয়ে ওঠে কি না, জানা ছিল না।

মহম্মদের চলে যাওয়া পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। ঘন জলের ধারার মধ্যে মহম্মদ তার নাও ভাসালো। পেটে খিদের বোধ নেই, জ্বালার বোধ নেই, সাড়ে পাঁচশ বর্গফুটের বন্দিনী তার রেখে যাওয়া খাতা, কাগজের মন্ড, পুরনো খবরের কাগজের স্তূপের মধ্যে রয়ে গেলাম। একদিন আগে টের পেলাম, আমি মরে গেছি।

মানুষের মৃত্যু হলে কোথায় যায়, জানি না। কিন্তু মৃত্যুর আগে তুচ্ছ মুহূর্ত তুলে রাখে চোখে, এমন একটি কথা বলেছিল মহম্মদ। সে নানান কথা জানত। চটকলের মাজারে যেদিন প্রথম আমাকে দেখেছিল, সেদিন কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে একটি সাদা খাতা বার করে করে বলেছিল, ‘তোকে নিয়ে লিখব। ’

আমাকে নিয়ে লিখবে! আমাকে নিয়ে লিখবে! ভাবনার মধ্যে রেল ইয়ার্ড ছাড়িয়ে আটটা চল্লিশের লোকাল চলে গেল। আমার দেহের ভিতর এক আশ্চর্য পুলক শুরু হল। মন্দিরে বলির জন্যে আসা কালো ছাগশিশুদের মতো মাথা দুলিয়ে চলল আমার ভিতরে কেউ। একটি জরিদার সন্ধেয় মহম্মদ এসেছিল, অচেনা আমাকে নিয়ে লিখবে কথা দিয়েছিল। সেদিন পাম্পস্টোভে রুটি সেঁকতে গিয়ে আমার অকিঞ্চিৎকর জীবনে একটি আগুনের হল্কা এসে লাগল। এরপরে মহম্মদ আমার চোখের সামনে একটি আশ্চর্য দুনিয়া খুলে দেবে।

বাবরি কাটা সাদা চুলের মধ্যে তার চোখদুটি ভারি জ্বলজ্বলে। যেন ভিতর পড়তে পারে। বাদাম রঙের জামা পরে, পরে জেনেছিলাম, খদ্দর। ওর চুলের ভিতর দিয়ে, কবিতার মধ্যে দিয়ে, নিরন্তর খোঁজের মধ্যে একটি রাস্তা আমার দিকেই এগিয়ে আসে, আমি নিশ্চিত ছিলাম। না এসে উপায় কী! ও যে আমায় নিয়ে লিখবে!

চটকলের সবুজ ঘরটায় একগাছি দড়িতে আমার স্কুলের শাড়ি ঝুলত। লাল পাড় সাদা শাড়ি। দু’টি লাল ফিতে। কয়েকটি বাংলা বই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল কবিতার ভিতরে। সিলেবাসের কবিতা শেষ হয়ে এলে মায়ের কথা ভাবতে বসতাম। মাকেও টেনে নিয়ে গিয়েছিল কেউ। কবিতা? মা’কে নিয়ে কখনো কেউ লেখেনি। বিজ্ঞাপনের পোস্টারও না। মায়েরা এমনি এমনি হারিয়ে যায়। যেন এমনই স্বাভাবিক, যেন এ তো হওয়ারই ছিল। বাবা লিখতে জানত না। নাম সই করে চটকলের মজুরি পেয়ে যেত ঠিক। এহেন ঘরে মহম্মদের লেখা ঢুকে পড়ল।

হরেক রকমের বিকেলবেলা নিয়ে একদিন ঢুকে পড়েছিলাম মহম্মদের বাড়িতে। উঁচু বাড়ি, ঠাণ্ডা ঘরগুলির ভিতর সারি সারি বইয়ের ভিতর একটি বইয়ের নাম “ওয়ার অ্যান্ড পিস”।

সাদা শাড়ির লাল পাড় মাটি থেকে উঁচু হল। লাল ফিতের মাথা সম উচ্চতায় উঠে এল। আমি বইটির কালো মলাট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। মহম্মদ বলেছিল, “ওটা আরেকটু বড়ো হলে পড়িস, আজ এটা নিয়ে যা। ”

লাল, হলুদ, সোনালি মিলিয়ে বেশ চকচকে মলাটের ভিতরের পাতায় আমার নাম লেখা ছিল। আমাদের সবুজ রঙের খুপরিতে, ত্রিপল ছাওয়া ছাদের তলায় সেই প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ ঢুকে এলেন। একা এসে অধিকার করলেন। মহম্মদ আমাকে নিয়ে লিখবে বলেছিল। সে আমাকে রবীন্দ্রনাথ চিনিয়েছিল।

খুব ছেলেবেলায়, খিদের জ্বালায় চিৎকার করলে, টলমল পায়ে বাসরাস্তায় ছুটে গেলে, মা একটি গল্প বলত। ভয়ের গল্প। একটি শিশু স্কুল ছুটির পরে কলঘরে যায়। এদিকে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, গরমের ছুটি পড়ে যায়। একমাস পরে স্কুল খুললে মরা শিশুর সন্ধান পাওয়া যায়। আদ্যপান্ত অযৌক্তিক একটি গল্প কোনোরকমে বলে ঘুমিয়ে পড়ত মা। যুক্তির বোধ না থাকা আমি পিঠের ভিতর ঠাণ্ডা স্রোত টের পেতাম। ভয়ের জগৎ চিনে নিতাম। বন্দি হবার ভয়টা ফিরে এসেছিল বই নিয়ে আসার পরে। যেন আর কোনোদিন মহম্মদের সাথে দেখা হবে না। আমাকে বন্দি করে চাবি ভুলে গেছে সে। এইই আমার ভবিতব্য। এদিকে ঘরে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। গল্পগুচ্ছ আমাকে একটি বিপজ্জনক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিল। বারংবার শেষ করে মহম্মদের সঙ্গে একটিবার দেখা হোক, চেয়েছিলাম।

আমার লাল পাড় শাড়ির রং পাল্টে গেল। বয়স বাড়ল, লাল পাড় গোলাপি হয়ে এল। সেদিন বেলা দুপুরে, পঁচিশে বৈশাখের কালবৈশাখীতে ভিজে স্কুল থেকে ফিরছিলাম। খানিক উদ্ভ্রান্তের মতো মহম্মদ এল। বলল, ‘তোকে নিয়ে লেখাটা, লিখব বলেছিলাম, তোকে নিয়ে লেখাটা আসছে রে মণি! লিখব! লিখব!”

“তোমার শঙ্খ ধূলায় পড়ে কেমন করে সইব

বাতাস আলো গেল মরে এ কি রে দুর্দৈব…”

আরেকটি পঁচিশে বৈশাখ এল। কলেজের আবৃত্তি সেরে, ওড়না দিয়ে কাঁধের খুলে যাওয়া সেলাই ঢেকে বিকেলবেলায় ফিরছিলাম। পথে মহম্মদের সঙ্গে দেখা হল। চোখ দুটো উদাস। দুপুরের মতো গভীর, নির্বাক, অপেক্ষারত। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “তোকে নিয়ে লেখাটা রে মণি… এইবার লিখব…!”

সাড়ে পাঁচশ বর্গফুটের ভিতরে সারাদিন লিখত মহম্মদ। ভোরবেলার দিকে উঠে লিখত। বৃষ্টি এলে লিখত। ঘন দুপুরবেলার রোদের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে লিখত। সংস্কৃত ও ইতিহাসে ডুবে থাকতাম আমি। আমাকে লেখায় ডুবে থাকত মহম্মদ।

একদিন ভোররাতে এমনধারা বৃষ্টি এল। সেইসব বৃষ্টির ভিতরে আমাকে নিয়ে লেখাটি শেষ হল। মহম্মদ ক্ষেপে উঠল। একটি উদ্ভ্রান্ত ও জয়ী মানুষ আমাকে জাগিয়ে তুলে পাথুরে মেঝেয় অস্থির পায়চারি করতে শুরু করল। জয়ের সঙ্গে বিষাদ আসে, এ আমি তার কাছেই শিখেছিলাম।

বাবরি কাটা সাদা চুল, খদ্দরের জামা, উদাস শিশু চোখের মানুষটিকে যে সাগরপাড়ের দুনিয়া টেনে নিয়ে যাবে, এ আমি আগেই জানতাম। মা’কেও এক সাগরপাড়ের দুনিয়া টেনে নিয়ে গিয়েছিল কোথায়! আমাকে নিয়ে লেখার ভিতরে মহম্মদের সাগরপাড়ের ডাক এল। বৃষ্টিতে সকালবেলার পথঘাট ধোঁয়াটে হয়ে এল। মহম্মদ বলল, ‘চলি রে মণি। ভাল থাকিস। পড়া ছাড়িস না। পৃথিবী বিরাট। এর মধ্যে নিজের জায়গা খুঁজে নিস। অস্থায়ী, তবু পাকাপোক্ত নিজস্ব জমি ছাড়িস না। ’

শরীরখানি মুচড়ে উঠল। সাড়ে পাঁচশ বর্গফুটের ভাড়ার মেঝেতে আস্ত একটি উলাপুর ভেসে এল।

এই সব হাঁড়িকুড়ির ভিতরে আস্ত একটি নীলকুঠি জেগে থাকে। ভুলে যাওয়া গল্পের মৃত শিশু জেগে থাকে। চারিদিকে জল থই থই জল থই থই। মাটির জানালার ধারে বসে থাকি। এগারো বছরের বালিকা উঠে আসে পাশে।

আর একটু পরে আমার আমার রক্ত মাংস গেঁজিয়ে উঠবে। মহম্মদ জানেনি এই উলাপুরের মৃত্যু সংবাদ। তবু তো রতন আসে। এগারো বছরের বালিকা আমাকে জাগিয়ে রাখে। বিপুল কাগজের স্তূপে আমি বসে থাকি। আমার পাশে রতন। দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে আমরা জড়িয়ে থাকি।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes