ধারাবাহিক – ‘আমার তারা’ ময়ূরী মিত্র

ধারাবাহিক – ‘আমার তারা’ ময়ূরী মিত্র


কথা কয়

শিক্ষকরা অতিরিক্ত পুস্তকনির্ভর হয়ে পড়লে অনেক সময়ই দেখা যায় তাঁরা শিশুর “স্বাভাবিক বুদ্ধিজাত সঠিক” এবং স্বতঃস্ফূর্ত সত্যবোধ”কে অবলীলায় ভুল বলে দেন ৷ এর ফলে শিশুর মনের বহুমুখী বিকাশে যে কী বিপর্যয় ঘটতে পারে ! একবার বীরভূমের গ্রামাঞ্চলে একটি বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন শিশুদের স্কুল দেখতে গেছি । কর্তৃপক্ষ বললেন -আমাদের শিক্ষকরা সব জুয়েল জানেন তো ! সব কলকাতা থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েদের এনেছি ! এমনি নয় , ভালো রেজাল্ট করা ৷ চলুন আপনাকে ওরা কেমন ক্লাস নিচ্ছে দেখাই ৷ খানিকপরে বধির শিশুদের জন্য আমার একটি অনুষ্ঠান করার কথা ৷ তো গেলাম ক্লাস দেখতে ৷

একটি ক্লাসে শিক্ষক দাঁত বের করে ও হাহা হাহা চিৎকার করে ” হাসিমুখ ” বোঝাচ্ছেন ৷ একটি prose পড়াচ্ছিলেন ,তাতে হাসিমুখ শব্দটি ছিল ৷ আমিও দেখছি আর বাচ্চাগুলোও দেখছে ৷ হঠাৎ দেখি ,একটি বাচ্চা ঠোঁট বন্ধ করে হাসি চাপছে ৷ অথচ তার চোখ ভর্তি হাসি ৷ অর্থাৎ শিক্ষক যেভাবে মুখের পেশী টেনেমেনে প্রসারিত করছেন ,বাচ্চার মুখ তার উল্টো ৷ তার চোখের দুই বিন্দু হাসি ৷ বাকি মুখে কোনো কুঞ্চন নেই ৷ এ বাচ্চা আমার মতো বিচ্ছু !

শিক্ষক বললেন –এই দেখো ! আমি যেভাবে মুখটাকে করেছি ও হাহা হিহি হাসছি ,সে দুটো একসঙ্গে হলে তবে হাসিমুখ হবে ৷ আর দাঁতগুলো বের কর ! আচ্ছা আগে দাঁতগুলো গুনে নাও দেখি !
বাচ্চা কিছুতে তা তো করলই না ,উপরন্তু দূরে দাঁড়িয়ে শিক্ষকের ওই কায়দাকানুন দেখে মুখ টিপে হাসতে লাগল !

–কই হাসছ ? খোল ঠোঁট ! বার কর দাঁত !

বাচ্চা একটিও কাজ না করে দুটি আঙুল চোখের দুপাশে রাখলাম ৷

আমি বুঝলাম ,সে বলতে চাইছে চোখ দিয়েও মানুষ হাসে ৷ শিক্ষককে বুঝিয়ে বললামও ৷ শিশুর অন্তরভাষা বইয়ে লেখা থাকে না ৷ ও বুঝতে হয় ৷

এবার শিক্ষক আমার ওপরই গেলেন রেগে –!

–ম্যাডাম ওকে ঠিকটা বোঝাতে হবে ৷ বোঝাতে হবে চোখ দিয়ে মানুষ দেখে .. এই যে দেখো ..জানলা দিয়ে দেখো ….এই তো ..চোখ দিয়ে দেখছ …তাহলে আর চোখ দিয়ে হেসো না ..

বিচ্ছু বাচ্চা বাইরের বারান্দায় ছুটে গেল ৷ তারপর
হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল ৷ এবার কী করল জানেন !

নিজের হাতদুটো ঢেউয়ের মতো দোলাতে লাগল ৷ তারপর সেই দোদুল্যমান হাতের পাতা দুটো দুচোখের ওপর বসিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার উঁচু করে তুলে ধরল সূর্যের দিকে …এমন তার হাতের ভঙ্গি মনে হতে লাগল …আপনার হাসিমাখা চোখদুটো সে সূর্যের মুখে বসিয়ে দিচ্ছে ! সূর্য এবার সারাদিনমান হেসেই যাবে ৷

শিক্ষক তখনো সেই perception observation
বুঝিয়ে যাচ্ছেন আমাকে ৷

থোড়াই এসব বুঝব আমি !
আমার শিক্ষক জানলার ওপারে !

ক্লাস দেখে যখন বারান্দা দিয়ে যাচ্ছি দেখলাম এক কোণে ভাঙা খাঁচা ৷

–ওটা কী ?

–টিয়া ছিল ম্যাডাম ৷ সবকিছু practical দেখাই এদের ! পাখি কী খায় ..কীভাবে খেলে ..পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আনন্দ দেওয়া ..তারও একটা নির্দিষ্ট সময় রাখা দরকার ম্যাডাম ! আনন্দ fun ক্লাসেও নতুন কত কিছু শেখাতে পারি আমরা ! তাই না ম্যাডাম !

–খাঁচাটা ফেলে দেবেন ৷ হাসি শেখানোর শ্রম বাঁচবে ৷

আমার শিক্ষকের চক্ষুতারায় আলোর হরফ !
প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়সত্য ৷
অনুভূতি জীবধর্ম ৷
চাওয়া আপনার ৷

কাতলার দুগ্গা

ঠাকুমা বলতেন শ্রাবণ মাসে বর্ষা থামার পর যখন রোদ ওঠে তখন আসলে বায়ুদেব আকাশে কাঠকয়লার উনুন জ্বালে ৷ আজো ওমন ! সকালে কয়েক পশলা বৃষ্টি হবার পর আকাশ ফেটে পড়ল রোদে ৷ ঝাঁ ঝাঁ করছিল স্কুলের বাচ্চাগুলোর শরীর ৷
কাউকে কাউকে অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হয় তো ৷ কাতলা অবশ্য মাকে পিঠে নিয়ে বাবার স্কুটারে এল ৷ আসলে মাকে মা ভাবেই না কাতলা ৷ ড্যাবড্যাবে চোখে রোগাসোগা মা-টাকে খালি জরিপ করবে আর তারপর হাঁক মারবে —

ছোটো , ও ছোটো ..যাও আমার ক্লাস শুরু হবে এখন ৷ যাও বাইরে গিয়ে বোসো ! ওহ ! ছোটো আমার কেকটা দিয়ে যাও ৷ একটায় টিফিন খাব আমি !

মা গাইগুই করলে জব্বর ধমকে বলে – আন্টি বলেছে সবার সঙ্গে টিফিন খেলে আমার অনেক বন্ধু হবে ৷ বাড়িতেও আমাকে সবার সঙ্গে খেতে দেবে ছোটো ৷আন্টি ছোটোকে বলে দাও ৷ ও কিছু বোঝে না ৷

কাতলার পাকামিতে হাসি পেলেও ,মাকে কেন মা ডাকছে না এই নিয়ে চিন্তায় থাকতাম ৷ কারণ কাতলা স্পেশাল চাইল্ড ৷ স্পেশাল বা বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুকে সম্পর্ক বোঝাতে গেলে সম্পর্কিত ব্যক্তি এবং সম্পর্কের নাম সংযুক্ত বা সম্পৃক্ত করেই বোঝাতে হয় ৷ অর্থাৎ মাকে মা ডাকিয়ে ,তারপর বোঝাতে হবে মা আসলে কী ! সে কী কী করে বাচ্চার জন্য -ইত্যাদি ৷ স্বাভাবিক শিশুর এই সমস্যা থাকে না ৷ সে মাকে হাম্পটি ডাম্পটি , মুরগী মটন , যে নামেই ডাকুক না কেন ..সেই ব্যক্তি যে মা এবং মা যে তার সন্তানের জীবনে কী ভূমিকা নেয় , সব তার স্বভাবিক বোধশক্তি দিয়ে বুঝে যায় ৷ তখুনি না বুঝলেও কালক্রমে বোঝে ৷ বিশেষ শিশুদের কালক্রম বলে কিছু থাকে না ৷ এখন বোঝালে বোঝাও ,নাহলে ছাড়ো ! তার বোঝা বা তাকে বোঝানো অর্থাৎ সমাজের সঙ্গে expressive ও receptive understanding টাও একটি task এর মতো ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় ৷

মায়ের সঙ্গে কাতলার সম্পর্কে কিছুতেই এই bonding বা ঘনত্ব তৈরী করতে পারছিলাম না ৷

আজ ক্লাসে ঢোকার পর হঠাৎ কী কারণে বড়দি বললেন –এই কাতলার মাকে ডাকো তো ! কাতলা
তাঁর সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল ৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে Pre Class বাঁদরামির সিলেবাস শেষ করছিল আর কী ! বড়দির মুখে কাতলার মা শুনেই প্রাণপণ দৌড়ে গেল দরজায় ৷ সেখান থেকে চেঁচিয়ে বলল –এই
কাতলার মা ..কাতলার মা ..বড়দি ডাকছে আয় ৷

ওর মা ভেতরে এসে যখন বড়দির সঙ্গে কথা বলছেন ,দেখলাম কাতলা নিজের মনে ” কাতলার
কাতলার মা ” বলে বিড়বিড় করছে ! আমি ওর মায়ের দিকে আঙুল তুলে বললাম —

আছছা ও তো কাতলার মা ! তবে কাতলা ওর কে ?

কাতলা আমার ডাউন সিনড্রোম বাচ্চা ৷ সবসময় এদের মুখ ভর্তি হাসি ৷ ক্ষুদে ক্ষুদে দুটি চোখ বাঁইবাঁই করে ঘুরে চলেছে ৷ আমার প্রশ্ন শুনে চোখ ঢুলুঢুলু করে ফেললো কাতলা ৷ বুঝলাম এটা তার গভীর চিন্তার লক্ষণ ৷

সুপার লজিকে কাতলা তার উত্তর সাজালো !

-আমি কাতলা
-ও কাতলার মা
–তাহলে ইয়ে …আরে ..ওই তো ইয়ে …আমি মায়ের মেয়ে ..

আমার শেষ প্রশ্ন —
তাহলে ও কার মা ?
তোর না কাতলার ?

দেরী হয়নি উত্তর আসতে …

আমার …আমার মা ৷

দুটো নাগাদ ছুটি হল ৷
কাতলার বাবা স্কুটার নিয়ে এসেছেন ৷
শুনলাম , কাতলা বাবাকে বললো ..
আন্টি মা তৈরী করে দিয়েছে ৷

এসব শুনে শ্রাবণের রোদ বোধহয় কিছু সুখ পেল !
দেখলাম সে মোলায়েম হচ্ছে ..
কাতলার পরিবার ঘিরে একটি সুপুরি ছায়া গোলাকারে বাড়ছিল ৷

এবং শিশুভারত

ভালোবাসার পরিমান ঠিক কতটা হলে ভালোবাসাটা গোটা আমের মতো হয়ে যায় , কোনোকালেই বুঝে উঠতে পারি নি আমি ৷ বোঝার চেষ্টাটা যে ততোধিক বোকামি – তাও কি বুঝি ছাই ! ফলে কী হয় – কেউ আমায় ভালোবাসছে বুঝলে পরিমাণ হাতড়াতে লাগি ! প্রতিবারই ডাহা ফেল ৷ ছিটকে চলে যায় আমার সবে জন্মানো ভালোবাসা ৷ চলন্ত ট্রেনের জানলা থেকে যেমন পিছনে হাঁটে নদী , গাছ , পাহাড় ৷ দ্রুত – অতিদ্রুত ৷

একবার এক কালো মেয়ে এল আমার কাছে ৷ এক ঝাঁকা চুল – চুলের গোছ তার মাথাকে শরীরের থেকে বড় করে দিয়েছে ৷ নাদুস ভুঁড়ি ৷ তক্ষুনি তার নাম দিলাম গণেশ ৷

ভুঁড়ি চটকাব বলেই ঝপ করে টেনে নিলাম কোলে ৷ নানা কথার পর জিজ্ঞেস করলাম – বল কাকে সবচেয়ে ভালোবাসিস ?
নিশ্চিত ও পরিচ্ছন্ন উত্তর –
কাকে আবার ? – মাকে ৷

ভেতরের রোগটা ঝাঁকাচ্ছে আমায় ৷ অশ্বথথ গাছের মতো মেয়েটার অন্তর খুলে দেখার জেদ বাড়ছে ৷ বললাম —
কতটা ভালোবাসিস ?
ভালোবাসাকে নিক্তিতে মাপার সেই চেষ্টা !

গণেশ স্থির ৷
উত্তর দিলে — আমার দুনিয়ার চেয়ে একটু বেশি ৷

–আমি বললাম – তোর আবার দুনিয়া কী রে ?
গণেশ বললে — আমার দুনিয়া -এই আমার বই ,পেন্সিল, স্কুল ব্যাগ , ড্রইং খাতা ,মার বানানো পাস্তা , ওয়ার্ক এডুকেশনের তুলোর পাহাড় , স্কুলের খিচুড়ি মিল –!

থাম বাবা থাম ৷ আর কত ছড়াবি তোর দুনিয়াকে ?
এবার বল — কী দেখে বুঝিস , তোর মা তোকে ভালোবাসে ?

ওমা ! মার হাসি দেখে ,আমার ভালো রেজাল্টে মার আনন্দে ,আমার জন্য পাস্তা বানানোয় আর মার রাগে ৷

এই ভোঁদা মেয়ে — রেগে গেলে কি কেউ ভালোবাসতে পারে ?

গণেশের উত্তর – আমার মা যখন রেগে যায় আমার কোনো দুস্টু কাজে – রাগে টসটস করে মার চোখ ৷

আরে কী বোকা রে তুই ? রাগে আবার টসটস করে নাকি কারোর চোখ ? বল তোর বাঁদরামিতে কাঁদছিল তোর মা ৷

হাঁ করে নিজের শব্দের ভুল বোঝার চেষ্টা করছে গণেশ ৷ ভুঁড়ির ওপর চাপড় মারতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে — মায়ের অনুভব বর্ণনায় ঠিক কোথায় ভুলটা হল তার ৷

বুঝলাম, রাগ আর চোখের জলকে বেশ ভালো মতোই গুলিয়েছে আমার গণেশ ৷ এই গোলানোতে বেশ একটা ঝকঝকে সুখ ফুটছে তার মুখে চোখে ৷

সে সুখমুখ দেখে আমি তাকে দিলাম আমার মায়ের নিজের হাতে বানানো দু তিনরকম রঙ মেশানো একটি বাটি মোমবাতি ৷

মাঠ পেরিয়ে মায়ের সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছে গণেশ ৷ আঁধারে তার কালো রং আরো কালো ৷ হাতের তালুতে বসানো নানারং মোম ৷ জ্বালবে সে ৷

শিশু গণেশ কোনো না কোনোদিন নতুন অক্ষরে মহাভারত লিখবে ,যেখানে পঞ্চভূতের বউ দ্রৌপদীর যৌবন নিবেদিত হবে শিশুকে মানুষ করায় ৷ নেশারু লম্পট যুধিষ্ঠির যে মহাভারতে ধুলায় লুটপাটি খায় ——! কালো হাতের মোমের আলোয় সেই না লেখা ভারতকথা আমি আজো দেখেই চলি ! দেখেই চলি !

ঘন পল্লবে

আঁক সেই গাছ , যা তোমার আঁকতে ইচ্ছে করছে ৷ আঁকতে গিয়ে ” উচিত ” ভেব না ৷ আজকের ক্লাসরুমের সবথেকে ভালো আঁকিয়ে ছাত্রীটি যখন তার গাছে গোলাপী পাতা আঁকতে চাইল ,তখন মিষ্টি হেসে এমনটাই বললেন আঁকার শিক্ষক ৷ বয়সে , দৃষ্টিতে তরুণ এবং শিল্পবোধেও তরুণ এই শিক্ষক ৷ নতুবা শিক্ষক হয়ে ছাত্রছাত্রীকে উচিত অনুচিত ভাবতে কবে কোন শিক্ষকই বা নিষেধ করেছেন !

শিশুর ইচ্ছে অনুযায়ী গাছ গোলাপী পাতায় ভর্তি হয়ে গেল যখন , খুদে শিল্পী নিজেই নাক কুঁচকে বলল -ম্যাম , গোলাপীতে অরেঞ্জ দিয়ে দিই ? বললাম : কেন ? এখন কেন গোলাপীতে অরেঞ্জ দিয়ে পাতায় রঙের বদল আনতে চাইছিস ? নিজেই তো গাছ ভর্তি গোলাপী পাতা এঁকেছিস ! এখন ভালো লাগছে না তো ! অস্বাভাবিক লাগছে তো ?

তরুণ শিক্ষক হেসে বললেন : পাতার রঙ নয় ম্যাডাম ,ওর ইচ্ছের রঙ বদলে গেছে ! এখন গোলাপী কমলার মিশেল ওর কাছে সবথেকে পরিচিত রঙ ! এ রঙ এখন ওর সারা ভুবন জুড়ে ৷ আপনি একবার এখনকার আকাশটা দেখুন ম্যাডাম ! দেখুন সকালে যে আকাশে তীব্র হলুদ ছিল , এখন সেখানে নীল রোদ ৷ ক্লাসঘরের পূবের জানলা দিয়ে দেখলাম , শ্রাবণেই আকাশ শরতের
মতো হয়ে গেছে ৷ গাঢ় নীল আকাশে তুলোর বালিশ ৷ ঘরে জানলার শিকের ছায়া আর সে ছায়ার পাশে পাশে আয়তাকার স্নিগ্ধ রোদ ৷ সে রোদ বিকেল জানান দিচ্ছে ৷ আঁকার শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন : ক্ষণের বদলে , সকালের গাঢ়
হলুদ শাড়ির মতো রোদ এমন করে নীল হবে ভেবেছিলেন কি ! কী বলবেন এবার ! শ্রাবণে এই অকাল আশ্বিন আসা অসমীচীন ?

আমি ধীরে ধীরে চোখ নামলাম ছাত্রীর খাতায় …

খাতার সাদা পাতায় চোখের নীল লাগল কি !

শুধু দেখলাম –আশ্বিনের আকাশতলে বসন্তের
কৃষ্ণচুড়ো ৷

আরেক ছাত্রী তখন আম আঁকছে , আমের সারা গায়ে হলুদবাটা ৷

আমবউয়ের গায়েহলুদ হবে হয়ত ৷

এমন আম কোথায় হয় !

হয়ত পৃথিবীর কোনো একটি আম এমন আছে ৷ আপনি আমি কেউ জানি না ৷ যে এঁকেছে সেই তা
দেখেছে –আঁকার শিক্ষক বললেন ৷

কার যেন বড় বড় দুচোখ আমার চোখে ঢুকে যাচ্ছে ৷ আমি চোখের কোলের ঘাম মাখা কাজল দেখছি !

ও কার চোখ !
রঙের ৷
যে রঙ হওয়া উচিত নয় …
যে রঙ চোখকে দর্শন দেয় ..

বালকের ধূলাখেলা

আঙুলে তার পাখির কিচির ফুলের মিচির ৷ হ্যাঁ গো , যা বলছি তাই-ই ৷ আমাদের স্কুলের এক ছাত্রের অভ্যেস হল , পড়ার সময় উল্টোদিকে বসা দিদিমনিদের নাকের ডগায় গিয়ে একভাবে নিজের কোনো একটি হাত ঘুরিয়ে যাওয়া ৷ ছেলেটি অটিস্টিক ৷ এমনিতে খুব শান্ত মেধাবী ৷ গান গায় ৷ ছবি আঁকে ৷ সবই তার সবিশেষ চমৎকার ৷ শুধু ওই এক হাত নাচানোর বদামি ৷ যেদিন পড়ায় মন বসল সেদিন পড়া থেকে ওঠানোই যাবে না ৷ আর যেদিন অন্যমনস্ক হল তো গেল সব ! হাত ঘুরতে লাগল বনবন ৷ আমাদের চোখে মুখে লেগে যায় আর কী ! যদিও দীর্ঘদিন ধরে তার এই হাত ঘোরাবার অভ্যেসে অভ্যস্ত হয়ে গেছি ৷ সেও বোধহয় তাকে নিয়ে আমার রাগ বিরক্তিটা অভ্যেস করে নিয়েছে ৷ কতদিন পড়া ফেলে দু হাতের আঙুলগুলো আমার চশমার কাঁচে লাগিয়ে ইকরিমিকরি ছবি এঁকে যায় ৷ বইয়ের আড়ালে মুখ লুকিয়েছি রেগেমেগে ৷ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করেছি —

কী করছিস ? কেন করছিস ? তোর এ কাজের মানে বল ৷

হেসেছে ৷ এমনভাবে হেসেছে মনে হয়েছে , চশমায় নয় ,ছবি আঁকছে সে আমার চোখে ৷ আর আমি কেবল বুঝছি না বলেই খেপছি ৷
একদিন হাতের নখগুলোতে কাগজের টোপর পরিয়ে স্কুলে এল ৷কোনো কোনো কাগজের টুকরোকে আবার পুরো নখের সাইজে কেটে নখের ওপর আঠা দিয়ে আটকেছে ৷ ফলে নখগুলোকেই কাগজের নখ মনে হচ্ছে ৷ শুরু হল কাগজের নখে সজ্জিত আঙুল নাচানো ৷ আঙুল শুঁয়ো থেকে প্রজাপতি হয়ে যাচ্ছে ৷ আঙুল খেলাবার ভঙ্গিতেও পরিবর্তন এনেছে ৷ হাওয়া কেটে এগোচ্ছে টুপিওয়ালা নখ ৷ বেশী রাগি বলে আমিই তার খেলার টার্গেট ৷ মারতে উঠলাম ৷ ও আমায় যত খেপাচ্ছে ততই তার থেকে দূরে সরছি ,ঘুঁষি দেখাচ্ছি ! কী না করছি ! ক্লাসের বর্ষীয়ান শিক্ষিকা বললেন —

এ খেলার মানে নেই বটে ৷ তবে এ হল ওদের মনের খেলা ৷ কেবল আঙুলের নয় ৷ তুমি ভালো করে দেখো আগে ওর আঙুল খেলা ৷ বিরক্তি কমে আনন্দ আসবে আপনি ৷

সেদিন যেন নতুন এক মন নিয়ে দেখলাম আমার পুরনো খোকাটাকে ৷ রেগুলার বকা খেতে থাকা বাচ্চাটাকে আদরচোখে দেখলাম গো ! তখনো আঙুল খেলিয়ে যাচ্ছে সে ৷ কত বিচিত্র ভঙ্গি ! একটার সাথে অন্যটার কোনো মিলই নেই ৷ একবার টুপিআঙুল কানের পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল ৷ মনে হল কাক ঠোঙার জিলাবি নিয়ে আকাশে দৌড় মারল ৷ আবার দেখলাম , দুহাতের দশ দশটা আঙুল সমান্তরালে ওড়াতে ওড়াতে মাটিতে নামাল ৷ আরি বাপ ! এ যে দেখি দশ গাঙফড়িং টোপর পরে মাঠে নেমে বউ খুঁজছে !
এত মূর্তি তোর আঙুলে !
বকছি না বলে আহল্লাদে ছবি আঁকছিস বিনি তুলিতে !
পবনে গগনে ফোটাবি লক্ষ কোটি ছাঁচ !

বিশ্ব রূপবান

আমার মেজকাকার কাছে সম্প্রতি দুটি বাচ্চা ছেলে আসাযাওয়া করছে ৷ পাশের বাড়ির গৃহরক্ষকের দুই ছেলে ৷ দুই ভাই ৷

আমার মেজকাকা ইতিহাসের একনিষ্ঠ পণ্ডিত মানুষ ৷সারাদিন নিজের বই লেখার কাজ করেন ৷ তবু মাঝে মাঝে ছেলেপিলের গলা , তাদের গল্পগুজব না শুনলে তাঁর লেখায় মন বসে না ৷ তাই এই ভাইদুটো কেবল নিজের নিজের গলা শোনাবার জন্য এবং গলা দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেবার কাজে বাহাল হয়েছে ৷

বড় ভাইটি ভারী সোজা মানুষ ৷ দিনরাত কারণে অকারণে ছোটটাকে পেটায় , ঘন্টার পর ঘন্টা টিভি দেখে , মোবাইলে মানুষ মারার গেম খেলে আর তারপর মেজকাকার পাশের বিছানায় ভাইকে দিয়ে মশারি টাঙিয়ে ঘুমিয়ে পরে ৷কারণ পরের দিন ওই কাজগুলোই তাকে ধারাবাহিক ভাবে করে যেতে হবে ৷ পরীক্ষায় ফেলটা ধারাবাহিক না হলেও বেশি সংখ্যাতেই ঘটে ৷ পাশ অল্প অল্প ৷ পাশ হলেই মোবাইল খেলায় মানুষ মারা তার আরো বাড়ে ৷ আর এইসব করে করে খুব গম্ভীর আর স্বল্পবাক হয়ে গেছে সে ৷

ছোট ভাই কিন্তু ভারী চপল ৷ এক কথাফুলঝুরি ৷ অনর্গল দাদার সাথে , আমাদের সাথে বকে চলে , হাসেও ৷ পাখির একটা দানা খেতে যত সময় লাগে এতটুকু হাসি একেক বারে ৷ সন্ধের পুজোর টিংটং ঘন্টার মত মিষ্টি ঠেকে তার ওইটুকু হাসির আওয়াজ ৷ মারকুটি দাদাটাকে জড়িয়ে ঘুমোয় ৷ দাদার মার খেয়ে দাদার সাথে বসে ভাত ,ডাল আলুসিদ্ধ খায় ৷

একদিন –হঠাৎ ৷ দেখলাম দাদার মত করেই মার থেকে মোবাইল নিল কেঁদেকেটে ৷ তারপর অনেকক্ষণ খেলার পর মোবাইলটা ফেলে চুল মুঠো করে ধরে বসে রইল ৷ চোখে কেমন সহায়হীনের কাতরতা ৷ আরে !

আমার ভেতরের কালো কাকটা ঠোকরালো আমায় ৷ মনের ভূতপাখিটা বলল —যা ময়ূরা জিজ্ঞেস কর কেন এমন মাঝে মাঝেই করে বাচ্চাটা !

এমন করিস কেন রে তুই ? চুল মুঠো করে বসে থাকিস দুঃখবুড়োর মত করে ? কেন ? মা ,বাবা দাদা , টিভি , মোবাইল , চিকেন বিরিয়ানী সব এখানে ! তাও হঠাৎ করে চুপ হয়ে যাস কেন ?

আমাকে অবাক করে ছেলে বললে —
সব এখানে কিন্তু আসলটা আমাদের সুন্দরবনের গ্রামে ৷

বললাম —
আসল আবার কী ? এই তো মায়ের সাথে ঝামেলা করে মোবাইল নিলি ! আবার আসল কী ?

আনমনে ছেলে বলে —
সেখানে বড় মাঠের মধ্যে একটা স্কুল আমাদের ৷ অনেক ঘাস মাঠে ৷ ধপাস হয়ে গেলেও লাগে না ৷ সবাই একসাথে খেলি ৷ একসাথে পড়ি ৷ একইরকমভাবে পড়ি ৷
বুঝলাম — “একইরকম” শব্দটা সে আমদানি করেছে টিভিতে সাম্প্রতিক অনলাইন পড়ানোর পদ্ধতি দেখে ৷

পরশু তার ঠাকুরদা মারা গেছে ৷ সেই মৃত্যু তার মুক্তি এনে দিল ৷ দেখলাম –হাসতে হাসতে মুখে একটুকরো গেঞ্জি বেঁধে চলল মা বাবার সাথে ৷ মন খারাপ হচ্ছিল ৷ কাছে ডাকলাম ৷ অন্যান্য দিনের থেকে শান্ত ভাবে আমার কাছে এল ৷ বুঝলাম , পছন্দের গ্রামে যাবে বলে তার এই বাড়তি বাধ্যতা ৷ ভুল বললাম ৷ মনের জিনিস পেয়ে সেদিন মধুর এক সৌজন্য জন্মেছিল তার ৷ জুতো ফুতো খুলে তখনই এল আমার কাছে ৷ বললাম —

কোভিড চারদিকে ৷ মা বাবা ঘুরে আসুক ৷ তুই দাদার সাথে থাক আমাদের বাড়িতে ৷

কনফিডেন্ট উত্তর –
একসাথে খেললে , একসাথে সবাই মিলে পড়লে , একইরকম মিড ডে টিফিন খেলে কিছু হয় না ৷ আমি গ্রামেই যাব ৷ ওখানেই পড়ব ৷ আবার সেই ‘একইরকম ‘৷

চলে গেছে ৷ এখন স্কুল নেই তাও ৷ আসলে ওই একসঙ্গে বড়ো হওয়ার পূর্ণঘাসের জায়গাটাই তাকে এ শহরের জৌলুস ভুলিয়েছে ৷ তাই বাপ , মা , মায়ের হাতের চিকেন বিরিয়ানী , যে দাদাকে গলা জড়িয়ে ধরে রাখে সারারাত্তির –সব ফেলে চলেই গেছে সে ৷ তার অবশ্য বিশ্বাস , অততবড় মাঠের মধ্যে তার স্কুল নিশ্চয় বসবে যে কোনো দিন ৷ সেখানে তার অনেক বন্ধু ৷ তাদের তেজময় কণ্ঠ নিয়ত সরব করবে বন্ধ শিক্ষালয়ের ঘরদুয়োর ৷

নাহ ! এই নিশিতে সে নেই আমার ধারেপাশে ৷ ভোর উঠলেও থাকবে না ৷ কেবল রেখে গেছে দু শব্দ —সবাই মিলে ৷

ছুটি হলে আসিস একবার ৷ শোনাস দুশব্দে ছড়িয়ে থাকা তোর সুখগল্পটা ৷

সবুজ বিরাট মাঠ আর সবাই মিলের গল্পটা ৷

ডিসগাস্টিং কাউয়াটা অবশ্য চরকি কাটবে তখনো !

দ্যাখ না সুন্দরী ময়ূর — খুঁচিয়ে দ্যাখ না একবার –সে গল্পে ঝগড়া আছে কিনা !

থাকবে না –দেখিস !

তোকে দিলাম একটি নীলকণ্ঠ পাখির পালক ৷ যত্নে রাখিস —।

রঙ চকাচক পেত্নী আর ছানা

ঘ্যানঘ্যান করে মাথাটা আমার খারাপ করে দেয় বাচ্চাগুলো ৷
ডিপ শাড়ি পর –লিসপিস দাও লিপে –ওগো দিদিমণি ৷

অবশ্য এসব আমার কাছেই শিখেছে ওরা ৷ মাঝে মাঝে বই ফেলে লিপস্টিক নিয়ে ওদের ঠোঁট রাঙা করি ৷ ছেলে মেয়ে সবারই ৷ বাচ্চাবেলায় লিঙ্গভেদ করে মরি আমি ! তখন শিশুর চোখেও হৃদয় –৷ ভেদ করলে হৃদয়ের খেলাটি খেলবই বা কখন –খেলাবই বা কী করে ! প্রকৃতির এক এক উপাদানে বিরাজ করে নারী কিংবা পুরুষ ৷

সেবার শিক্ষক দিবস ৷ পরেছিলাম একটি ছাইরঙের শাড়ি ও একটি সাদা মুক্তমালা ৷ ব্যাস – ক্লাসে ঢুকলাম কি ত মুষড়ে গেল সব ! মনে হল – একঠোঙা ঝালমুড়ি আমার মিইয়ে গেল !

কেন আমি আজ এতো বিবর্ণ,কেন এতো সাদায় ঢেকেছি শরীর — এটা যে কতভাবে প্রশ্ন করে গেল বাচ্চাগুলো ! প্রশ্নে আমায় যত না জেরবার করে নিজেরা জর্জরিত হয় বেশি ৷ আসলে তাদের প্রশ্নে জিজ্ঞাসা কম – কষ্ট খুব ৷

কথা তো বলতে পারে না ওরা ৷ হাত পা নেড়ে, নাক চোখ ওপরনিচ ঘুরিয়ে – ফুরিয়ে বোঝাতে লাগল – আজ আমি ওদের নাপসন্দ ! এমনভাবে নাকের ডগায় হাত নাড়তে লাগল –মনে হচ্ছিল রংচটা একটি মরামাছ আমি ৷ আলো নিভছিল আমারও ৷ হাজার বেদনায়ও শিক্ষককে যে একটি কল্পবাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয় – সেদিন বুঝেছিলাম ৷

রঙে যে কী ঝোঁক বধির বাচ্চাদের ! ভাবতে পারেন ?– সাদা বলে tube লাইটে পড়তে চায় না ! বারবার চায় – ক্লাসঘরে জ্বলবে একটি বেশ বেশি পাওয়ারের বাল্ব | খাতায় বাল্বের উজ্জ্বল হলদে আলো ছিটকোবে — তবে তো আঁক কষে – ছবি এঁকে তৃপ্তি পাবে ৷

ক্লাস যখন শেষ হচ্ছে তখন দেখি –সবচেয়ে ছোটটা ড্রইং খাতা ভর্তি পাহাড় নদী তারা গাছ ক্ষেত খামার এঁকে চলেছে ৷ আঁকছে খাতায় কিন্তু রাগী গোল্লা চোখ আমার দিকে ৷ আমার রংহীনতায় চোখ তার ছানার টুকরো হয়ে ফুটছে যেন গরম চিনিরসে ৷ বেতাল রঙের ছবি আঁকাও চলছে রংপেন্সিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ৷ আকাশ লাল – গাছ বেগুনী –পাহাড়ে আবার হাঁসের ডিমের কুসুমরঙ লাগিয়ে দিচ্ছে ৷ ঘোরাবার চোটে মুটমুট ভেঙে যাচ্ছে পেন্সিলের শিস ৷ খেয়ালই নেই ৷ ভূমিক্ষেতের সবটুকু ছাইরঙ্গা ৷ যাহ বাবা ! আমার সাজহীনতায় ওপর তার রাগ – ছিটকোচ্ছে ড্রইং খাতায় !

এই রে ! গোটা ভুবন ছাইয়ে ভরলে শ্বাস নেব কোথায় ! দেখো কাণ্ড ! ওরে ওই ! ওইইইইই —ভুল রঙে তোর পাহাড় নদী ক্ষেত কিচ্ছুটি আলাদা করা যাচ্ছে না যে ! একটি ভুলের জগৎ এঁকে দিচ্ছিস খাতায় !

সেদিন রাগী খোকাটাকে কথা দিতে হয়েছিল –পরেরদিনই একটি গাঢ় হলুদ রঙের শাড়ি পরে আসব ৷ বাল্বের মতো আলো চলকাবে সে শাড়িতে ৷ কী নাম দেব শাড়িটার ? কোই বাত নহী ! ইয়ে মেরী বাল্বশাড়ি !

সেও কথা দিয়েছিল চোখ দিয়ে —দিদিমণি কাল কিন্তু ড্রইং খাতায় আঁকা হবে একটি খয়েরি গুঁড়ির গাছ আর তাতে অনেক কটা সবুজ পাতা ৷ সে গাছের তলে আমার বাল্বদিদিমনি !

পরের দিন ৷
দিদিমণির সর্ব অঙ্গে বাল্ববর্ণ ৷
আর
খোকার গাছের পাতায় পাতায় কত্ত যে হলুদ পাখি !
আমার পাখি সব করে রব !
শিশু প্রকৃতিকে ফিরিয়ে দিয়েছে তার নিজের রঙ ৷

আমি লিখি বর্ণগাথা ৷
গাঁথি শিশুর ফুলহার !

বোধিদ্রুম

লাভলি যেদিন প্রথম স্কুলে আসে সেদিনই সে একই উঠোনকে দুভাগ করে কুমীরডাঙা খেলা শুরু করেছিল ৷ এ খেলায় চিরকালই শিশুরা ডাঙা ও জল বোঝাতে ভূমির দুটো আলাদা স্তর ব্যবহার করে ৷ ডাঙা বোঝাতে সিঁড়ি বা উঁচু বারান্দা এবং তার ঠিক সামনের নীচু উঠোনে জলের কুমীর ৷ অবাক হয়ে দেখলাম –আমাদের স্কুলে উঠোন ও বারান্দা থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা কিছুতেই ভূমিকে উঁচু নিচু করতে রাজি হচ্ছে না ৷ স্কুলের একটি টবকে উঠোনের মাঝটিতে রেখে সে আমায় বলল –আন্টি টবের একদিক ডাঙা –অন্যদিকে জল ৷ জিজ্ঞেস করলাম — নীচের উঠোনকে নদী বানা ৷ সবাই ওটাই তো করে ৷ লাভলি নাক থেকে চশমাটা সামান্য তুলে বললে — আমি ডাউন সিনড্রোম বাচ্চা ৷ আমি অন্যরকম করি ৷ বুঝলাম –ডাউন সিনড্রোম কথাটি সে তার মা বা টিভির আলোচনা শুনে মুখস্থ করেছে এবং শব্দটিকে সে খুব আদর করে ডাকছে ৷ খেলতে গিয়েও সে নিজেই জলের কুমীর আর নিজেই ডাঙার মেয়ে ৷ তখনো বারবার বলেই
যাচ্ছে –ডাউন সিনড্রোম –কুমীর তুই একটা ডাউন সিনড্রোম ৷ ও ডাঙার মেয়ে –তুইও ডাউন সিনড্রোম ৷ চোখের সামনে নিজেকে তিনভাগে ভাগ করে নিল লাভলি — কুমীর , ডাঙার মেয়ে আর অরিজিনাল লাভলি ৷
দু দশ দিনের মধ্যে গোটা স্কুল ওলটপালট হয়ে গেল লাভলির জ্বালায় ৷ এর মধ্যে একটি দিনের কথা মনে দাগ রেখে গেছিল ৷
লাভলি ক্লাসে খেলছিল আরেকটি বাচ্চার সঙ্গে ৷ তুমুল বাঁদরামোর “মোমেন্ট এন্ড মুডে ” সহপাঠীকে নিয়ে দুম করে মাটিতে পড়ে গেল লাভলি ৷ পড়ে গিয়ে তার ঝাক্কাস চোখদুটো আরো ডাগর হয়ে উঠল ৷ মেঘভরা চোখদুটো একটু হাসলও। লাগল ৷ লাভলি এমনই ৷ যন্ত্রণায় , আনন্দে ফেস কাটিং সেম রেখে দেবে ৷ মিষ্টতায় বহর তার এমনই বেশি যে আপনি ধরতেই পারবেন না কোনটায় লাভলি লুব্ধ বেশি ? বা কোনটা লাভলির র কাছে লোভনীয় ? সুখ না দুখ ?
পড়ে গিয়ে নিজে এত ব্যাথা পেল ! তবু উঠে পড়ল ঝটপট ৷ যেন আঘাত ভোলার বিরাট তাড়া আছে তার ৷ ড্যাম স্মার্ট ভঙ্গিতে জাস্ট দুবার ছোট্ট হাতদুটো ঝাঁকাল ৷ দেখলে ভাববেন — সকালের প্রথম রোদ্দুরে ছাদের আলসের পায়রা নাচল ৷ আর তারপরই হেসে জড়িয়ে ধরল তার সহপাঠীকে — মানে যাকে নিয়ে সে পড়ে গেছিল ৷ নিজের ব্যাথা ভুলে বন্ধুকে কত কত আদর করে চলল লাভলি ৷ হাসল –তার চুল ঘেঁটে দিল ৷ নিজে নিজে গল্প বানিয়ে ভোলাল বন্ধুকে ৷ সবচেয়ে হতবাক হলাম যখন দেখলাম, লাভলীর আদর পেয়ে অন্য বাচ্চাটা কেমন আঁকড়ে ধরেছে তার বন্ধুকে ৷ একটুও কাঁদছে না ,একটুও চেঁচাচ্ছে না সেই অন্য হাইপার একটিভ বাচ্চাটা ৷ অনেকটা ক্ষণ দুজনে দুজনকে জড়িয়ে বসে রইল ৷ লাভলি আর লাভলি – সখা ৷
ক্লাসের অন্য বাচ্চারাও তখন খেলতে হাসতে লেগেছে ৷ লাভলিকে হারিয়ে দেবার নেশা জাগল ৷ “বকুনি বকুনি ” মুখ করে দুটোকে বসিয়ে দিলাম উঠোনের দুই থামে ৷ লাভলির বন্ধু উঁচুকে উঁচু ভেবে কাঁদতে লাগল ৷ লাভলি উঁচুকে মাটি ভেবে হাসল ৷ তারপর থামের ওপরের লতাকে জড়িয়ে নিয়ে বললে –আমি দুস্টু করেছি তো ৷ তাই মিস তোর ওপর বসিয়ে দিয়েছে রে থাম ৷ একটু পরেই আমাকে জলের কুমীর করে নিচে ছেড়ে দিবি রে থাম ! মিস জানে না তোর এখানেও গাছ ৷ দেখলাম –লাভলির হাতে মাটি লেগে ৷ বোধহয় সে থামের ওপরের মাটিটা খুঁড়েছিল ৷ ডাউন সিনড্রোমদের হাত পা ছোট হয় –থামের ওপর দুপা তুলে একদম আসনপিঁড়ি হয়ে ছিল লাভলি ৷ ভাগহীন মাটিতে বসেছিলএক ভাগ্যবতী ৷
গাছ তার যোগচিহ্ন –মাটির সঙ্গে মানুষের ৷ মাটির সঙ্গে মাটির ৷ যে কোনো দিন মাটির সঙ্গে মন মিশিয়ে কুমীর থেকে চারাগাছ হয়ে যাবে লাভলি ৷ সকালের প্রথম রদ্দুরে প্রাচীন বাড়ির আলসেতে শত পায়রা নাচবে ৷

তাই তো জেগে রই

সেবার বেশ শীত পড়েছে ৷ শীতের সঙ্গে মেঘের একটানা দ্রবণে চারদিকে কেমন এক শীতল – পিচ্ছিল ভাব ৷ রোদ উঠছিল না কদিন ধরেই -সঙ্গে পাখির পালকের মতো পলকা একটা হাওয়া ৷ শীতের দিনে মেঘের মিশেলে এমন চপল হাওয়া দিলে দেশ গাঁয়ের লোক বলত –ওহ আজ হাওয়া কী ” চালছে ” ! মানে হল গিয়ে আপনার হাওয়া চলছে ৷ এমন হাওয়া চলল , মানে গাঁ ঘরের ফচকে খুকিরা তিড়বিড় করে ছুটবে এর ওর বাড়ি — তাদের ফালতু কথার ফুলুরি নিয়ে ৷ গৃহস্থের আবশ্যক কম্ম যেটুকু না করলে নয় সেটুকুই করবে সেসব দিনে ৷

আমি যেদিনের কথা বলছি , সেদিনও হাওয়া ছুটন্ত তীর হয়ে আমার ও আমার বাচ্চাদের চামড়া ফাটাচ্ছিল ৷ তার মধ্যে একটি ছিল অটিস্টিক ৷ তাকে দেখলাম ,জগত সংসার ভুলে একবার হাত দুলিয়ে হাওয়া বোঝার চেষ্টা করছে –সঙ্গে সঙ্গেই আবার নিজের কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছে ৷ বাচ্চাটি একসময় ভাবুক হয়ে গেল ৷ তখন তার চোখ ভূমির ওপর বয়ে যাওয়া হাওয়া ছেড়ে আকাশের মেঘে ঘুরতে লাগল ৷ বুঝলাম -সাধারণভাবে একমনে থাকা বাচ্চাটা মেঘ ,হাওয়া ও নিজের ছোট্ট শরীরটার মধ্যে সংযোগ বোঝার চেষ্টা করছে ৷ একটা প্রাণের চেষ্টা ৷ একসময় বুঝতে না পেরে সে কেঁদে ফেলল ফুঁপিয়ে ৷ তখন আকাশে একটুকরো রোদ উঠছে ৷ ঠাণ্ডা আরো বাড়ছে ৷ বুঝলাম ,কথা দিয়ে এ বাচ্চাকে বোঝান যাবে না ৷ পাঠকদের বলে রাখি –Autistic বাচ্চা অন্যের ভাবনা নিজের ঘাড়ে চাপাতে একেবারেই চায় না ৷ চাপাতে গেলে বিরক্ত হয় ৷ এরা নিজে ভাবতে চায় ৷ ভাবনায় ডুবে থাকতেও পারে ৷

একটিও কথা না বলে তাকে আলতো করে ঠেলে দিলাম উঠোনের এমন একটি জায়গায় যেখানে শীতল হাওয়ার সঙ্গে সদ্য ওঠা রোদ এসে পড়েছে ৷

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে তোর যা ভালো লাগে খেল ৷ তবে খেলতে হবে এই জায়গায় দাঁড়িয়েই ৷ –যতদূর মনে পড়ছে এমন ধরণের কিছু কথা বলেছিলাম তাকে ৷

আমার কথা শুনে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে রইল সে ৷ মনে হল ,বনের মাঝে কোনো ঋষির ছেলে আকাশে পুষ্প ছুঁড়ছে তার চোখ দিয়ে ৷ মেঘ থেকে রোদ — প্রকৃতির এই অপরূপ পরিক্রমা এমনই গভীর ও উজ্জ্বল করে তুলছিল তাকে ৷ তার চোখে অক্ষর লেখা হচ্ছিল ৷ তবে মেঘ না রোদ কে সে অক্ষর তৈরী করছিল তা জানি না ৷

হঠাৎ পাখির মতো দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দৌড়োতে শুরু করল ৷ এত জোর ছিল সে দৌড়ে , স্কুলের গেটে দড়াম শব্দ অন্যদিনের চেয়ে অনেকগুণ বেশি হয়েছিল ৷ প্রথমবার বাঁকা হাতে গেট খুলতে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বার দড়াম করল ৷ এসব তাকে নিয়ে আমার ভালোবাসায় মেতে থাকার ভুল কিনা তা অবশ্য বলতে পারব না ৷

অনেকটা তফাতে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছি ,আকাশের পাখি দেশান্তরে যাওয়ার সময় যেমন পথ পরিবর্তন করে নিজের ডানা বাঁকিয়ে ঠিক সেভাবে নিজের সামান্য বেঢপ শরীরটাকে কাত করে সামনে পিছে ডাইনা বাঁয়ে নাচিয়ে যাচ্ছে সে ৷

এই শোন না ! তাকা আমার দিকে ? এমন করে নাচ্ছিস ক্যানো ? নাচবি যদি ক্যাসেট বাজাচ্ছি ! গানের সঙ্গে নাচ !

–নাচিনি তো ৷ আমি Bird হয়েছি ৷

— সে আবার কী রে? তুই তো তোর মায়ের বাচ্চা , আমারও বাচ্চা ৷ তুই পাখি হবি কী করে ?

— কী হাওয়া মিস কী হাওয়া ৷ ও মিস
হাওয়া আমায় পাখি করে দিল ৷

হাওয়া তখন তেমন না চললেও সে বাচ্চা নিজের পাতলা শরীরটাকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে আরো আরো হাওয়া কল্পনা করছে ৷আমি চুপ ৷ ছোট মানুষের সৃষ্টিকর্মকে বোধহয় সবচেয়ে মর্যাদা দিতে হয় ৷ কারণ তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিধেয় সে নিজেই জানে না ৷ তখন তার মন এতটাই স্ফূর্ত হয় ৷

আমাকে চুপ দেখে তার কথা বাড়ল –

দেখো না বাতাস কেমন নখ দিয়ে আমার লোমগুলো খুঁচিয়ে দিচ্ছে ! এই দেখো — ওহ –এই দেখো আমার লোমগুলোও পাখি হয়ে গেছে ৷ লোমও কি আকাশে উড়ে যাবে মিস ?

বোকা মুখ করে বললাম –আচ্ছা তাই ? তো হাওয়াটা কেমন বল দেখি ?

— কেমন আবার ! K F C এর প্লাস্টিক প্যাকেটের মতো ৷ একদম প্লাস্টিক হাওয়া ৷

— ধুর ! প্লাস্টিক আবার হাওয়া হয় নাকি ? আর K F C এর মুরগির ঠ্যাং কি হাওয়ায় ঘুরছে ? কই আমি দেখতে পাচ্ছি না তো ! শিগগির দেখা আমায় ৷

আরে হয় ! হয় গো ৷ এই দেখো না পিড়িং পিড়িং লাফ দিচ্ছি !

— কী আজে বাজে বলছিস ? প্লাস্টিক হাওয়া হঠাৎ পিড়িং পিড়িং হাওয়া হয়ে গেল ? ওমা ! তোর হাওয়া বুঝি মুরগি থেকে পিড়িং শাক হয়ে যায় ?

— ও মিস৷ প্লিজ প্লিজ ও মিস ৷ একটু শোনো ! মা যখন আমার গায়ে সেন্ট দেয় তখন সেন্টের শিশির মুখের স্প্রে স্প্রে হাওয়া ৷ এবার — এবার ঠিক বলেছি মিস ? বল না ?

দুপুর এল ৷ তবু তার হাওয়ার গল্প থামল না ৷

হাওয়ার বর্ণনায় তার সেই “রকম ” আর “মতো” গুলো পাকসাট দিতে লাগল স্কুলের গলিতে ৷
শুধু শিক্ষক বুঝতে পারছে না হাওয়া বইছে ৷ যদিও ছাত্রী তখনো উড়ছে ৷

অনুভূত না হলেও বাতাস থেকেই যায় ! জীবের শ্বাস অটুট রাখার জন্য !

১০

ভ্যানগগের Baby সোনা

বেশ কিছুদিন পর আমার পয়লা নম্বর বজ্জাত ছাত্রীটি আবার স্কুলে আসতে লেগেছে ৷ আমরা যেমন কোমরে আঁচল বেঁধে জলের বালতি টালতি বই – ঠিক সেইরকম করে প্যান্টুর মধ্যে স্কার্ট গুঁজে গিন্নিবান্নিদের মতো ক্লাসে ঢুকল ৷ বকলাম — কীভাবে স্কার্ট গুঁজেছিস ! খোল বদমাশ ৷

দশ বছরের পাকাটা বললে –কেন হিসুর জায়গা দেখা যাচ্ছে আন্টি ?আসলে আজ ভেবেছিলাম ক্লাসের ডেস্কগুলো ঝাড়ব ! এত ময়লা ডেস্কে কি আঁকাউঁকি হয় ! দেখলাম–হাতে চায়ের কেটলি ধরার একটা ন্যাকড়া নিয়ে পরিষ্কার ডেস্কগুলো মুছছে ৷ খানিক পরে কী মনে হল — বনবন করে পৃথিবীর মতো করে আমাকে পরিক্রমা শুরু করল ৷ বললে –আন্টি তুমি sun ৷ এইসব বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন শিশুকে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান – ক্লাসঘরে গোল এঁকে বিভিন্ন স্থানে ছাত্রছাত্রীদের দাঁড় করিয়ে বোঝাই ৷ এখন আমার শিক্ষণপদ্ধতি দিয়ে আমায় সূর্য বানিয়ে ফেলল ৷

স্কার্ট ঠিকঠাক করে আঁকতে দিলাম ফুল ৷ দুহাতের ওপর মুখ রেখে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল উডপেন্সিলের ফুলে ৷ তারপর পাঁচ পাপড়িতে পাঁচ রঙ দিল ৷ লাল , নীল সবুজ, হলুদ কমলা ৷ বললাম — পাঁচরঙের পাপড়ি কোন ফুলে দেখেছিস তুই ? বল -এক্ষুনি বল ৷ নাহলে ঝুঁটি খুলে দেব ৷ যেন খুব ভয় পেয়েছে এমনভাবে বলল — দেখিনি ৷ যদি দেখতাম —-!

মার খাবি কিন্তু ! যা দেখিসনি আঁকতে হবে না ৷

—ঠিক আছে ৷ এই যে এখন ক্লাসে তোমায় সূর্য বানিয়ে পৃথিবী হয়ে ঘুরলাম –সেই সূর্যই আঁকি আন্টি ?

–তার মানে ? আমাকে আঁকবি তুই ?

—দেখো না ৷ এক সেকেন্ড ওয়েট দাও ৷ দেখো কেমন আঁকি ৷

তার কথামতো ওয়েট দিতে লাগলাম ৷

আঁকলে হাফ হলুদ হাফ কমলা সূর্য ৷ আর সেই সূর্যের কাছেই আমি ভাতের হাঁড়ি চড়িয়েছি ৷ পাশে একটা স্কার্টপরা বেঁটে মেয়ে –সে নিজে ৷ মেয়েটার ঠোঁটদুটো নীল ৷ শিল্পকর্মেও সে তার জন্মকাল ভোলেনি ৷ অক্সিজেনের অভাবে সে যে Blue Baby হয়ে জন্মেছিল -আজো তার ঠোঁট দুটো সৈনিক নীল

ডাউন সিনড্রোমের জন্য সে যে বেঁটে –নিজেকে আঁকার সময় এইসব খুঁটিনাটি মনে রেখেছে ৷

ব্যাথা হল একটু ! বেশিটুকু অন্তরে রাখলাম ৷শুধু জিজ্ঞেস করলাম —

সূর্যের এত কাছে হাঁড়ি বসিয়েছিস কেন ? আমি তো পুড়ে মরব ৷

—-আন্টি গো আন্টি –অনেক ভাত অনেকের জন্য রাঁধতে হবে তোমায় ৷ তাই অনেক আগুন দরকার ৷ ভাত রান্না হলে বলো ৷ দুধ ঢালব –চিনি গুলব -পায়েস হবে ৷

–এভাবে পায়েস হয় বোকা মেয়ে !দেখেছিস কখনো ?

উত্তর –যদি হয়ে যায় !

কিছুতে হবে না দেখিস ৷ গরু , চিনির কল – ব্যাটা সব তোর আকাশে ?

উত্তর –তেজপাতাও ৷

বলতে বলতেই সূর্যের পাশে চিনির শিশি , গাধার মতো দেখতে গরু , ফিঙে পাখির লেজ ( বোধহয় তেজপাতা ) সব আঁকতে লেগেছে ৷ ছবিতে পায়েস রাঁধবে বলে স্কার্টটা আবার কোমরে গুঁজছে শাড়ির মতো ৷

নীল হলুদে মিলন

রাধের দোলায় কৃষ্ণ –

ছবি ছুটছে অনন্তে —

১১

দুলী ও একটি গান

কিছু মেঘে খুশী থাকে ৷ ফসলে যখন মেঘের গন্ধ ম ম করে -সে যে কত আনন্দ দেয় তা কি বোঝাতে পারি ! আজকের মেঘে তেমন হিল্লোল , তাতে মাঝে মাঝে রোদের ছিটে ৷ স্কুল শেষে বাচ্চারা রঙ খেলল আমাদের সঙ্গে ৷ সারা গায়ে লাল মেখে দোলদুলী যখন হয়রান ,তখনই বৃষ্টি এল ৷ এমনিতে ভারী শান্ত সে মেয়ে ৷ ডাউন সিনড্রোমের বাচ্চা তো ! দারুণ নাচ করে ৷ কখনো তাকে বলি দুলালী ৷ আর যখন এমনি এমনি হাঁটে তখনো শরীরে তার দোলনা ভাব ৷ তখন তাকে ডাকি –

ও দোলদুলী ৷ কোথায় গেলি ! আঙুলে খুব ব্যথা রে আমার !

আঙুলে হয়ত তেমন ব্যথা নেই ৷ তবুও মিছে বলি ৷ আর দোলদুলী তার সামান্য খসখসে আঙুলগুলো আমার আঙুলে জড়িয়ে নেয় ৷ আমার বায়নায় আঙুলগুলো মটকেও দেয় ৷ মটমট আওয়াজ ওঠে ৷ জাতিতে সুপুরি কাটার মতো ছোট্ট এক আওয়াজ ৷ আমি হাসি ৷ দুলী তো হেসে মরে ৷ আঙুল মটকানোর আওয়াজে ছাত্রী আর ম্যামের সম্পক্ক রোজ বাড়ে যে ৷

আজকেও বৃষ্টি নামল যেই , দোলদুলী দৌড়ে গেল বারান্দায় ৷ একজন অভিভাবক চেঁচালেন –বৃষ্টি নেমেছে রে! চ চ ৷ রঙ খেলা শেষ কর ৷ বাড়ি ফিরতে হবে ৷ ভিজে যাব ৷

শুনতে শুনতেই ঝগড়াটে হয়ে উঠল আমার দুলীর
হাসিমুখ ৷ এক্কেরে আমার কোলের কাছে চলে এল দোলদুলী ৷ দেখলাম – তার শরীর দুলছে কী এক অপূর্ব ছন্দে ৷ সে ছন্দের নাম জানি নে গো মা ৷
বারান্দা দিয়ে বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়েছে দোলদুলী ৷ লাল আবীর ভিজে আরো লাল ৷ আর নীল আবীরটা জলে গুলে হালকা সমুদ্রনীল ৷ বৃষ্টি এক এক রঙে এক একভাবে ক্রিয়া করে ৷ লালে জল কম , তাই সেটা থকথকে ,গাঢ় ৷ নীল রঙে বৃষ্টি লেগেছে বেশী ৷ তাই সেটা সমুদ্দুর ৷ যেন সমুদ্রভর্তি রক্তগোলাপ নাচে তা তা থৈ থৈ ৷

এখন নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দুলালী ৷
দুটো রঙের জলে মেশার তফাত সে বুঝল কিনা বলতে পারব না ৷ শুধু বলল –রঙগুলো বৃষ্টিতে ভেজাব ম্যাম ৷

আমি বললাম -কী করে ?

—সব কটা রঙ মেখে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ী যাব ৷ তবেই হয়ে যাবে ম্যাম ৷

বললাম -যা তবে !

দুলী একটু হাসলে ৷ যেমন হাসে সে ৷ শব্দ শোনা যায় না এত মৃদু ৷ তারপর বললে —

তার আগে বন্ধুদের রঙে রাঙাব ৷

—এই দোলদুলী ! বল –রঙ মাখাব ৷

–না ম্যাম ৷ রঙে রাঙাব ৷

শিশুর সঙ্গে মিছে ঝগড়ায় মস্ত আনন্দ ৷

ফের বললাম –বলছি না ” মাখাব “৷ বল -রঙ মাখাব ৷

–না ম্যাম রাঙাব ৷

–কোথা থেকে এ শব্দ পেলি রে দুলী ? আর শব্দটা যে ঠিক এমন বিশ্বাসী হলি কী করে !

দুলী গাইল দু কলি –৷
নাচলও খানিক –

— রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও
যাও গো এবার যাবার আগে ৷

সে কী তীব্র তার গান !
কী মিঠে তার low voice এর রবীন্দ্রনাথ !

[ একটি প্রবন্ধের অংশ হিসেবে মান্দাস , শ্রাবণ সংখ্যা ,২০২৪-এ প্রকাশিত ]

১২

গুঁজল সে সেই ফুল

কবে থেকে সবুজ একটা ফুল খুঁজছি ৷ পাতায় যদি লাগে লাল বেগুনির বাহার – তবে ধরাতলের এত এত সবুজের একটি টুকরো কেন জোটে না ফুলের ! বহুদিনের খোঁজের আজ জবাব এল ৷
ক্লাসে এল সপ্তাহের সাতদিনের পাঁচদিন নিখোঁজ থাকা ছেলেটা ৷এমনিতে বাঁদরের চূড়ান্ত ৷ বছরে চল্লিশ দিন রেগুলার আসে ক্লাসে ৷ বাকি সময়টা কখনো পান সিগারেট বিক্রি – কখনো পড়শীর লেটারবক্সের চিঠিপাটিগুলো বেমালুম অদলবদল করে দেয়া ৷
টিফিনবক্সে একগাদা লিটটি বানিয়ে – হঠাৎ করেই আমার কাছে হাজির সে ৷ অবশ্য টিফিনের আরো নানারকম ভ্যারাইটি তার আছে ৷ সোডা ওয়াটার , বেগুন সেদ্ধ ধনেপাতা দিয়ে , কাঁচা ডিমের রুটি ! আর পরীক্ষায় ? শুধু প্রথম প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর ৷
— বল ,শিকারি কোথায় থাকে ?
–শিকারি বনে থাকে মামী ৷
‘ ম্যাডাম ‘ শব্দটি কানে কম শোনার জন্য তার কাছে মামী হয়ে গেছে ৷ কিছু ভুল ‘ঠিক ‘ -এর চেয়েও সত্য হয় ৷ তার ওই ‘ মামী ‘ ডাকটা আমার কাছে তেমন এক সত্য -যাতে একফোঁটা মিথ্যে নেই ৷ তাই তার ‘মামী ‘ ডাকেই আমি হাসি –আমার রাগও হয় ওই ‘মামী’ ডাক শুনলে ৷ বিশেষত পড়াশুনো না করে যখন সে কেবল ‘ মামী ‘ ‘মামী বিউটি ‘ ইত্যাদি বলেই যায় ৷ এ ছাত্র কথা বলতে বা শুনতে পারে না ৷ শোনা বলা দুইয়েরই অভাবে জগতের কত সত্য কত মিথ্যে ধরতেও পারে না সে ৷ অথবা মিথ্যেকেই সত্যের মহানতা দিয়ে ফেলে –তার ভুল ঠিক ভাবনা মিলিয়ে ৷

আশ্চর্য জানেন –এত সব না পারা ও না পাওয়ার মাঝে সে কেবল মুখিয়ে ওঠে বন বাগান জঙ্গলে —- সবুজ খুঁজতে ৷ তাই হয়ত বনের প্রশ্নের সবসময় সঠিক উত্তর ৷
—বনে কী থাকে রে?
উত্তর – গাছ ৷ গাছ তো গাছ ৷

প্রতিবারই গাছই হয় তার উত্তর ৷ যেন এ বিশাল প্রাণিজগতের আর কিছুই থাকে না বনে ৷ যেদিন সে আসে – ক্লাসরুমের জানলাটা দেয় খুলে ৷ সে দড়াম আওয়াজে কখনো চমকেও ওঠে ময়ূরাবতী ৷ ঘাটের মড়া ময়ূর কোনোদিন মেরে মেরে পাট করে ফেলে দেয় সবুজখেকো ছেলেটাকে ৷ ভ্রূক্ষেপ থাকে না ছেলের ৷ সে তখন জানলায় মুণ্ডু লাগিয়ে এপাশে ওপাশে চারিপাশে খুঁজছে — শুধু খুঁজছে—৷ যেন তার এই খোঁজায় রোজ রোজ গজাবে নতুন সবুজ ৷
ক্লাসরুমের বাইরে একচিলতে উঠোন ৷ অযত্নে জমেছে কিছু তৃনরাশি ৷ ছেলেটা সেই অযতনকে বাঁচাতে চায় পরম মমতায় ৷ যে কটা দিন সে স্কুলে আসে – বেলা একটার মধ্যে বেরবার জন্য আনচান করে তার শরীর ৷ দুটো চড় সমেত ছুটি দেয়ার পর প্রায়ই দেখি– সে গিয়ে উঠোনের থেকে ঢিল ইট ইত্যাদি সব অসবুজকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে ৷ কী আক্রোশ ! এত জোর শব্দ করে সে জঞ্জাল ফেলছে – যার বাড়ি সে যদি ধারেপাশে থাকে তো শিউরে উঠবে ময়ূরাবতীর মতোই ৷ তার ড্রইং খাতা ভর্তি হয় সবুজ পাতায় – সবজে হলদে ঘাসে ৷

আজো ঐরকম আওয়াজে ঢিল ছুঁড়ছিল সে ৷ তার নাকের ডগায় জমা ঘাম,তার সিঙ্গারা চুলের হঠাৎ বেড়ালের গোঁফের মতো ফুলে ওঠা -সব দেখে মনে হচ্ছিল – এবার যেন সে মাটি খুঁড়ে বার করবে সবুজ ৷ কেবল আকাশতলের সবুজে আর তুষ্ট হবে না সবজে খোকন ৷
ঠিক তারই মতো করে ক্লাসঘরের জানলা দিয়ে মুণ্ডু ঢোকায় ময়ূরা ৷ ঠিক তারই মতো করে ৷
— ও ছেলে, দে, দে তো দেখি আমায় একটা সবুজ ফুল ৷
ভেবেছিলাম – কথা বুঝবে না আমার হাবা ছেলেটা ৷
— ওমা ,দেখি ঘাসগুলোকে গার্ডার বেঁধে একটি ফুল বানাচ্ছে সে ৷
সবুজ ছেলে গুঁজবে সবুজ ফুল — তার মামীর মাথাগরম মাথায় ৷
কথা বুঝল ৷
ব্যথাও যে– ৷
মার সাধ পুরিল ৷

[ এটি প্রথম The Doctor’s Dialouge -এর অন্তর্জালে – পরে এটি নতুন পাতা ও ভোরাই পত্রিকায় ছাপা হয় ৷ ]

১৩

প্রাণ হে

মূক বধির বাচ্চারা সবচেয়ে নিবিষ্ট হয় প্রানের জন্ম ও প্রাণীর বেড়ে ওঠায় ৷ সাধারণ শিশুদের থেকে এদের প্রাণীজগতে তন্ময় থাকাটা একটু বেশি ৷ একটু কেন অনেকটাই বেশি বা ধরে নিন মাত্রাছাড়া ৷
একবার হলো কি , ক্লাসরুমের টেবিলের তলায় একটি মেনি অনেক কটা বাচ্চা পাড়লো ৷ ক্লাস করাতে করাতে টেরই পাইনা কখন মেনি এসে বাচ্চাগুলোকে দুধ খাইয়ে যায় ৷ একদিন একটু দেরিতে ক্লাসে ঢুকে দেখি টেবিল ঘিরে বসে আছে আমার ছাত্ররা ৷ বধির মানবশিশু করে হাঁ করে মেনির দুধ খাওয়ানো দেখছে ৷ মেনির বাচ্চা দুধ খাওয়ার জন্য মুখ চুকচুক করে তো এগুলোর ঠোঁটও ফাঁক হয় ৷ সবচেয়ে মজার কথা, টেবিল ঘিরে বাচ্চাগুলো বসেছে ঠিক সেই অর্ডারে যে অর্ডারে আমি প্রতিদিন তাদের ক্লাসে বসাই ৷ আর ক্লাস নিচ্ছে মেনি ৷
বুঝি –বাচ্চাগুলো শুনতে পায় না বলেই বোধহয় বারবার ছটফট করে কিছু না কিছু শুনবে বলে ৷
মেনির ঘটনাটার পর থেকেই দেখছি ক্লাসের সবচেয়ে কুচিটা মাঝে সাঝেই আমার পেটে কান পেতে কী শুনছে ৷ বিব্রত হয়ে ওর মাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন — মেনিবিল্লির দুধ খাওয়ানো দেখে বাচ্চাটা বুঝেছে ঐরকমভাবেই পেটে ছিল ও ৷ তাই পছন্দসই কোনো মহিলা দেখলেই তার পেটে কান রেখে বাচ্চার ডাক শুনছে ৷ শব্দ নেই ৷ স্মৃতিও এদের দুবলা ৷ অতীতকে প্রকাশ করতে হিমসিম খায় কথাহীন শিশু ৷ এভাবেই হয়ত বুঝতে চায় পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে থাকা সেই আমিটাকে ৷
বিব্রত হই না আর আমি ৷ প্রশ্রয় দি ওর দুষ্কর্মকে ৷
সরস্বতী পুজোয় স্তন আমার উথালপাথাল ৷ আয় মুখ ডুবিয়ে দে ৷ এক গরীব বিদ্যাধরের গল্প বলি ৷ সে বড়ো কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছিল রে ৷ তাপ্পর সে বিদ্যে তাকে তুলে না রেখে সব্বাইকে দিয়ে দিয়েছিল ৷ যেমন তাঁর দর্প তেমনি করুণাঘন মন ৷ নাম তাঁর বিদ্যাসাগর ৷
শুনতে পাস না ?
কাঁদিস কেন বাছা ?

কান কাজ না করে যদি
মন দিয়ে শোন তবে !

১৪

নদী বইবে

অনেকদিন ধরে মায়ের অসুখের জন্য স্কুলে আসতে পারছে না আমাদের চাকবাদাম ৷ ক্লাসের দুর্দান্ত দূরন্ত এই ছেলেটির কথা লিখতে গিয়ে কেন যে আজ তার নাম চাকবাদাম দিলাম সে কারণ স্পষ্ট নয় নিজের কাছেও ৷ বোধহয় তার শ্যামল রঙ, জট পাকানো খাবলা চুল ও মিষ্ট চাউনির জন্য ৷ কানে profound loss চাকবাদামের ৷ অর্থাৎ 90 পার্সেন্টেরও বেশি শুনতে পায় না সে ৷ ফলে কথাও বলতে পারে না একদম। তার ক্ষেত্রে শোনা এবং বলা এই দুটোর আরো বেশি করে অভাব ঘটেছে ছোটবেলা থেকে সুচিকিৎসার অভাবে ৷ পয়সাকড়ি বেশি নেই বাবা মায়ের ৷ রোগ হলে সারতে দেরি হয় –বা সারে না ৷ তবে গরিব তো ! চট করে হারতে শেখেনি ৷ মরতেও না ৷ বেঁচে থাকে চাকবাদাম ও তার বাবা মা ও চার বোন ৷
বাঁচতে বাঁচতে বা বাঁচার ইচ্ছেকে বাঁচাতে বাঁচাতে কখন যেন অক্ষর আর শব্দে দারুণ লোভ জেগে যায় বাদামের ৷ অনেক পরে খুঁজে পেয়েছে তো স্কুল বই ! তাই হয়ত স্কুল ও বইয়ের ওপর চাক বাঁধা এক লোভ তার ৷ রোজ স্কুলে আসবে ও বই খুলে পড়াবার জন্য আমাদের পাগল করে দেবে ৷ অক্ষর ও শব্দ দেখে নিপুণ দৃষ্টিতে –চেনে নির্ভুল দর্শনে ৷ বই পেলে টুকরো বরফ হয়ে বসে থাকে বেঞ্চে ৷ বই সরালেই বরফ গলে যেন স্কুলে বন্যা আনে –এমনই দূরন্তপনা তার ৷
স্কুলে বসেই বুঝতে পারি –মায়ের অসুখের কারণে স্কুলে আসতে না পেরে এতদিনে নিশ্চয় নিজের মাথাটা খারাপ করছে চাকবাদাম ৷ অস্থির হয়ে অধ্যক্ষ ফোন করলেন ৷ ওপাশে চাকবাদাম ফোন ধরল ৷ এপাশ থেকে শুনলাম –হুইসিলের মতো তীব্র ধ্বনি বেরোচ্ছে তার মুখ থেকে ৷ বুঝলাম –ফোন স্ক্রিনের ওপর সে তার স্যারের নামের অক্ষরগুলো চিনে ছুট্টে এসে ফোন কানে নিয়েছে এবং তারপর কিছু শুনতে আর কিছু বলতে না পেরে সে আমার ক্লাসে শেখানো fricative sound করে চলেছে ৷ তার মা চান করতে গিয়েছিলেন ৷ মাকে ডেকে দেবার জন্যও ফোনটা রাখল না চাকবাদাম ৷ অন্তত পাঁচ মিনিট সে ফোন ধরে রইল ও ওই হুইসিল দিতে লাগল ৷ আমার বাদামচাকের হয়ত মনে হয়েছিল –ফোনে নিজের হুইসিল বন্ধ করলে যদি আমরা ফোন ছেড়ে দি –ফোন ছেড়ে দিলে যদি সে আবার স্কুলটা হারিয়ে ফেলে !
বাদাম –মাকে বলে দিয়েছি রে ৷ কাল তোকে স্কুলে আনবেন ৷ তোকে নতুন ধ্বনি শেখাব ৷
যে ধ্বনিতে মানুষ মানুষকে একদা চিনেছিল ৷

১৫

খোক্কসের কনফেশন

Differently Abled বা বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন বাচ্চাদের ক্লাস করি আমি ৷ মজা করেই করি ৷ বাচ্চারাও মজা পায় ৷ দুপক্ষে মজা করতে করতে ফুলমালার মতো প্রীতি জন্মায় ৷ ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরি যখন , তখন বিকেল হয় হয় ৷ আমার মনে হয়, চাঁদ তো উঠে গেছে ! অনেক চাঁদ আর চাঁদমালাটা দুলছে আমার বুকে৷ বুকে আর কাঁখে ৷

বুকের সম্পর্কে ভুল হয় সবচেয়ে বেশি ৷ সেদিন ভুল হল আমার ৷ বেশি ভালোবাসতে গিয়ে ভালোবাসার অনর্থক এক প্রকাশ ঘটালাম ৷ খুব খুব কষ্ট দিয়ে ফেললাম এক মেয়েকে ৷ স্প্যাস্টিক ৷ ৷ হাঁটাচলা একদম পারে না ৷ তবে জীবনকে বুঝতে পারে নিজের মতো করে ৷ এ বোঝা খানিকটা ! পূর্ণরূপে জীবন বুঝতে আমরা কে কবে পেরেছি !

আর দেখুন ,আমি কী মূর্খ ! এতকাল এই ধরনের বাচ্চাদের পড়িয়েও তাদের এই নিজের মতো করে বোঝাকে পাত্তাই দিলাম না ৷ যেহেতু আমাদের মতো করে বোঝাবার ক্ষমতা নেই , ধরেই নিলাম ,-এ ব্যাটা কিছু বোঝে না ৷ ফলে মেয়েটার সামনেই ওরই নিরাপত্তা নিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলাম ৷

খেয়াল করলাম না ,ও শুনছে ওকে নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার কথা ! ও দেখছে মা দিদিমণির একগাদা উদ্বেগ ৷ নিজের ভালোবাসার ঘোরে মাথায় রইল না ,এ মেয়ে ক্লাসে সবথেকে চিন্তা আদানপ্রদান করে আমার সঙ্গে ৷ মাথায় রইল না ,পড়াতে পড়াতে আমি যেমন ওকে বুঝি – ও বোঝে আমাকে ! ম্লান হতে থাকা মুখটির দিয়ে একবারও না তাকিয়ে ওর মাকে বললাম –
আগামী দিনে আপনারা চলে গেলে কে দেখবে ওকে? এখুনি চেনাজানা একটি হোম ঠিক করুন ৷

এখানেই কি শেষ হল আমার Over protective ভাবাবেগ ! আরো পরামর্শের ঝোঁকে সাজিয়ে ফেললাম এক বিপদজনক বেদনার আগাম বাক্যবন্ধ ৷ যা এই ধরণের অর্ধেক বোঝা শিশুর ( Specially Spastic ) মনে মুহূর্তে মারতে পারে রাক্ষুসে ঝাঁকুনি !

আপনার গয়নাগুলো বিক্রি করে fixed করে ফেলুন টাকাটা ৷ ও তো আর গয়না পরবে না ৷ টাকা থাকলে কাজে লাগবে ৷ আপনার বিয়ের দুটো বালা আছে বলছিলেন না ? ওগুলো আগে বেচে দিন –সোনার দাম উঠেছে তো এখন ৷

— মেয়েটির মাকে বলেই যাচ্ছি ! বলেই যাচ্ছি ! থামছি আর না !

হঠাৎ –!

কানের পাশে কে যেন গরম নিঃশ্বাস ফেলছে না !চমকে উঠি ৷ লম্বা পা বাড়িয়ে পিছন ঘষে ঘষেই কখন যেন আমার একদম কাছে চলে এসেছে মেয়েটি ৷ শুনতে শুনতে কেমন যেন শক্ত হয়ে উঠছে ৷ কাঠ শুকনো চোখ বড় বড় দুটো গোল্লা হয়ে উঠেছে ৷

জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগল হাত ৷

–এতো শক্ত কেন রে তোর হাত ! রোগা হাতের শিরাগুলো অব্দি ফুলে উঠেছে ! যেন এখনি একগাদা ফেটে রক্ত বেরোবে ! গয়নাহীন হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী দেখছিস কী এত !কী ইইই –!

–মন আর্তনাদ করছে ৷

চোখে তার জল নেই ৷ বেঁকে আছে ঘাড়খানি ৷ কী জানি ভাবতে লেগেছে সে ৷ এখন যদি দশটা ঘুষিও মারতে লাগি , অমনি করেই কি থেকে যাবে সে ! অচঞ্চল কঠিন এক পাথর ! অমনি মোচার মতো ঝুলবে তার পুরু ঠোঁট ! অনর্গল থুতুতে ভিজবে জিভ ! ক্রমাগত নির্বাক হতে লাগবে
মেয়েটা !

ঠিক করিনি সেদিন ৷ নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে নিরাপত্তার অভাবকেই ছড়িয়েছিলাম তার মধ্যে ৷ একটু একটু করে ৷ ঠিক যেমন দানের টাকায় গজানো ক্লাব ফের দান করে খাদ্যহীনকে ৷ এক পশলা ভিক্ষে ,সঙ্গে দানের বেদম উল্লাস ৷ পাশ আর ফেলের লিস্টির থেকেও গরম ভাপ দেয় খয়রাতের ফলাফল !

ঠিক ওমন ৷ আমি শালা ওমনই ফালতু হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন ৷ আমার করুণার ঢেউয়ে ভালোবাসা ভেসে যাচ্ছিল ৷ ওমা ! তাকে ঝপাং করে ধরি আগে ৷

মেয়ে — মেয়ে রে –থাক আমায় জড়িয়ে ৷ লাল চুড়ি ছাড়া শুধু দুটো হাতে ! এ যে আমার বিদ্যেধরের মালা গো ৷ আর ছিঁড়ি কখনো !

ক্ষমা করে দিবি ৷ ফটটাস ক্ষমা ৷

১৬

ফুল গড়েছে পথ

কদিন আগে স্কুল খুলেছে আমার ৷ দু তিন ছাত্র কোভিডে পিতৃহারা হয়েছে ৷ হারানোর দুঃখও ভুলেছে ৷ ভুলতে হয়েছে ৷ স্বাভাবিক হোক আর বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুই হোক গত দুবছরে হাতের কাছে বাপ কাকা মা বন্ধুর মৃত্যু দেখতে দশায় দুঃখ ভোলার অভ্যেস ভালোই তৈয়ার
করেছে ৷ প্রথমদিন খোলা স্কুলের দরজায় দাঁড়িয়ে কোভিডে ভোগা তেরো বছরের মেয়ে বলে উঠেছে–

ওমা এই স্কুলে কত ছোটবেলায় আসতাম গো মা ৷

বেচারী মহামারীতে কালের হিসেব ভুলেছে ৷ মাত্তর দুবছর আগের সময়টাকে সে মনে করছে কত্ত ছোটবেলা ৷ হাসতে হাসতে বললাম –
ওরে আজ কি তবে তোর বড়বেলা ?

কেউ আবার পথের গাছের ফুল দেখে উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে —
ও আন্টি এই দেখো পথফুল ৷ আচ্ছা আন্টি আগের স্কুলে এ ফুল ছিল ? এই গাছটা ছিল ? সে ব্যাটা আবার স্কুল গুলিয়েছে ৷ দুবছর বন্ধ ঘরে আটকা থেকে পুরোনো ক্লাসঘর তার কাছে নতুন হয়েছে ৷ গাছ ,গাছের ফুল , স্কুলের কাছে পুলিসকাকুদের পুকুর পার্ক সব সব লতুন হইয়া গিয়াছে ৷

এই সব ভাবতে ভাবতে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি বিকেলে ৷ সিঁথিতে চড়া সিঁদুর আর চওড়া লালপাড় শাড়ি পরা এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা পথ আটকালেন ৷ খপ করে আমার হাত ধরে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন –

আপনার স্কুল খুলে গিয়েছে ! বাঁচলাম ৷

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম —

আপনাকে তো কখনো দেখিনি ৷আমার স্কুলে আপনার কে পড়ে ?
একরাশ লজ্জা পেয়ে বললেন –
দূর দূর ! আমি লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করি ৷ আমার কে কোথায় স্কুলে পড়বে দিদি !

চুপ করে রইলাম ইচ্ছে করে ৷ বুঝতে পারছিলাম , বাঁধ না দিলে নদী আরো স্রোতস্বিনী হবে ৷ অতিমারীর জালে আটকানো মানুষ তখন সামনে যে দরজা পাচ্ছে তাকেই মুক্তির পথ মনে করছে !
তাই হল ! আমাকে চুপ দেখে এবার নিজেই গলগল করে বলতে লাগলেন —

দিদি বাচ্চাগুলো খুব কষ্টে ছিল ৷ আপনি নিশ্চয় ভাবছেন দিদি আমি কী করে বুঝলাম ? আসলে দিদি আমার শুধু একটা বর ছাড়া আর কেউ নেই ৷ তাই আমি যে সব বাড়ি কাজ করি সেই সব বাড়ির বাচ্চাদের নিজের নাতিপুতি ভাবি ৷ লকডাউনে দেখতাম বাচ্চাগুলো মুখ চুন করে আছে ৷ ঠাকুরের কাছে কত ডাকতাম দিদি ——-! দুবছর পরে আপনাকে দেখেও কত আনন্দ হচ্ছে আমার !
যখন রোজ দেখতাম তখন এত আপন লাগেনি ৷ ছাড়াছাড়ি পর এক হতে মনে হচ্ছে ,সব আমার নিজের লোক !

হাত দুটো ওঁর শক্ত করে ধরে ফেলেছি ৷ বিব্রত হয়ে বললেন —
যাই বাড়ি যাই ৷ আমার কাজ থেকে ফিরতে বিকেল হয়ে গেলেও বর না খেয়ে বসে থাকে ৷

ওরে ছেলে তুই ঠিক বলেছিলিস -পথে নতুন ফুল ফুটেছে !

ওরে মেয়ে তুইও মহা ঠিক ৷ দুবছর আগের তোর সে ছোটবেলা আজ যে স্বর্গবেলা !

ওরে বউ কাল সিঁদুরে কমলা আবির মেশাস ৷ মস্তকে তোর ভোরের আলো ! আমার এই বিশেষ শিশুর ছোট্ট স্কুলের খোলা দুয়োর তোকে নতুন শ্বাস দিক !

১৭

করে রব

কিশোরকাল থেকে বিষাদ এলে এলোমেলো থাকি ৷ থাকতে ভালোবাসি ৷ মা বলতেন —

রাক্ষস আজ বেনী গাঁথিস নি কেন ? হাতের হাড়গুলো কি আজ কটকটাচ্ছে তোর যে নাড়তে চাড়তেই মুশকিল !

আমি বলতাম–
আমার মন মরেছে মা ৷ তাই আজ no বেনী , no বিন্দি ৷ Only উমনো and ঝুমনো ৷

কারুণ্যের দিক ধরলে সবচেয়ে দামী তখন মৃত্যু ৷ তাই ওই সব বিশেষ দুঃখজমা দিনে নিজের কাতর মনটির নাম রেখেছিলাম মরামন ৷ সেটাকেই বাক্য করে বলতাম , আমার আজ মন মরেছে ৷ দুঃখ নিয়ে খানিক কায়দার শব্দজাল বোনা ! দুঃখকেই লঘু করা !

এ কদিন তেমনই চলছিল আমার ৷ কারণে অকারণে নিরন্তর দমে থাকছিল মন ৷ অপরপক্ষের কাছ হতে মন যে দাম চায় এবং অনবরত চেয়েই চলে , পাচ্ছিলাম না মোটেই ৷ তারই মাঝে এলো চুলে এক থাবড়া তেল ঘষে কখন চলে এসেছি স্কুলে ! আমার স্কুলের বাচ্চারা তো কথা বলতে পারে না ৷ কথা শুনতেও পায় না ৷ নিজের দুখকথা তাই কিছুই বলি না তাদের ৷ হয়ত আজো বলতে ইচ্ছে জাগেনি ! আমার সে যাতনা বধিরে কী শুনিবে কী বা বুঝিবে , মনের মাঝে এমনি এক চার ছ আনা অবজ্ঞার কাটাছেঁড়া চলছিল হয়ত ! কত পাপ তো পুঁতে চলি মনে , মনেরও অজ্ঞাতে ! এও হয়তো তেমনি !

ওমা ! ঘাড়ের কাছে সুড়সুড়ি লাগে যে ! দেখি কি , আমার এক কথা না কওয়া ছেলে ব্যাগ থেকে চিরুনি টেনে কখন আঁচড়াতে শুরু করেছে আমার চুল ! ছোট্ট মুঠিতে পুরো চুল টানতে না পেরে কেবল চুলের ডগা আঁচড়ে চলেছে ৷ কিছুতেই তার মনের মতো হচ্ছে না আমার সাজ ! তাকে তৃপ্তি দিতে পরিপাটি খোঁপায় কেশ সাজিয়ে নিয়েছি ! কোনোদিন করি না তো ! খোঁপা লটপট করতে লাগল ! আমার কোলে চড়ে মাথার পেছনটা একবার দেখে নিল ৷ ছেলে এবার আমার তৈয়ার করা খোঁপায় মারলো দু চাপড় ৷ নিটোল হলো মায়ের খোঁপা ৷

মায়ের কোলে খোকা হাসে ৷
আকাশপাখি ঝুঁকে দ্যাখে !
খুঁজে দে না দুধের বাটি !
খোকা যে আমার বুক চিনেছে ৷

১৮

পৃথিবী রে

বড় ফোঁটার বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পৃথিবী ফিরে যাচ্ছিল ৷ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল তার শরীর যা একসঙ্গে লম্বা ও ন্যুব্জ ৷ স্কুল যাচ্ছিল পৃথিবী ৷ আমারই স্কুলে পড়ে ৷ বৃষ্টির শব্দে জোরে ডাক দিয়ে থামাতে হল ৷ নাহলে ওমনিই ভিজে যাবে হুঁশ হারিয়ে ৷ ঠিক ধরেছি ! চশমার কাঁচ ভিজে থৈ থৈ ! জানি তো আমি , না থামালে পৃথিবী আমার থৈ থৈ কাচ চোখেই হেঁটে যেত ! জলভরা রাস্তায় পা হড়কাতো ৷ হড়কাতোই।
পৃথিবী ঐরকমই ৷ পৃথিবীর মতোই ৷ সব কিছু সহ্য করে বা কোনো কিছুই গ্রাহ্য করে না ৷ আমার পাশটিতে বসে ঘাড় নিচু করে একমনে পড়ে ৷ কিন্তু ওই ! মুখ দিয়ে এক পরমাণু শব্দ বের করতে পারবেন না আপনি ! কতদিন ওর শুকনো মুখটি দেখে জিজ্ঞেস করেছি –
আজ খাসনি পৃথিবী ?

উত্তর নেই ৷

—-কী রে মুখ তোল ! তাকা আমার দিকে ৷ বল ঠাকুমা আজ কী রাঁধল ?

নিচু চোখেই বললে —
ভাত আর আলুসেদ্ধ ৷

ঠাকুমা বড় যত্নে রান্না করে খাওয়ান পৃথিবীকে ৷ তবুও মাত্তর দুটো শব্দেই নিজের মুখ ও গহ্বরকে সীমায়িত করেছে এই সদ্য বাপহারা বালক ৷ কিংবা জিভের বেশি ব্যবহার কমাতে বেছে নিয়েছে দুটি সেরা ফসল –চাল আর আলু ৷ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ ৷

পৃথিবী জানে না ৷ আমি জানি পৃথিবীর বাপ মায়ের বিয়ের গল্প ৷ অতি মার্জিত ও শিক্ষিত যুবকের সঙ্গে এক বদ্ধ উন্মাদের বিবাহ ৷ কী ভাবছেন ! পৃথিবীর বাপ তার মাকে ভালোবাসতেন না ! মোটেই নয় ভাই ৷ প্রবঞ্চনা করে পাগলামি লুকিয়ে বিয়ে দেওয়া হলেও পৃথিবীর চিরভদ্র বাবা তার মাকে গোটা জীবন ধরে ভালোবাসার চেষ্টা করে গেছেন ৷ বারবার মাকে পৃথিবীর কাছে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করে গেছেন ৷ কিন্তু পৃথিবীর মা ছেলে জন্ম দিয়েই যেন আরো দয়াহীন হয়ে গেছেন স্বামী সন্তানের ওপর ৷ মামার বাড়িতে কাটিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর ৷ বাবার সঙ্গেই বেঁচেছে পৃথিবী ৷ বাবা মরে যাওয়ার পর কারোর সঙ্গেই না ৷

তবে কি একা বাঁচছে আমার পৃথিবী ! বাবা মারা যাওয়ার পর যখন অনেকখানি রোগা হয়ে ইস্কুলে এসেছিল , তাকে Self Sufficient হওয়ার পাঠ দিতে গিয়েছিলাম ৷

শোনা যায় না এমন গলায় পৃথিবী বলেছিল –

মাকে ফোন করেছিলাম ৷ মা বলেছে ,নিজের কাজ নিজে না পারলে কোনো একদিন বাস
রাস্তার মাঝে গিয়ে দাঁড়াতে ৷

আমার রাগ হয়েছিল ৷ পৃথিবী অবশ্য সেদিনই আমায় কথা দিয়েছিল এবার থেকে মায়ের খোঁজ বেশি বেশি করে নেবে ৷

বুঝি না বুঝি না ৷ বালক পৃথিবী বাঁচছে কিনা আমি সত্যিই বুঝতে পারি না ৷ যেমন করে বুঝতে পারি না এত পাপে ধরণী বেঁচে আছে কিনা ! রোজ দেখি, স্কুল খোলার অন্তত আধঘন্টা আগে চারদিকের গাছপালার মধুর ছায়াটুকু ছেড়ে পথের মাঝে কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবী ৷ দেখতে পেয়ে দ্রুত হেঁটে একহাতে স্কুলের তালা খুলছি আর অন্যহাতে ছেলের গরম চুলগুলো চটকাচ্ছি কী এক মায়ায় ! আহা কতক্ষণ রোদে ঝলকেছে গো আমার পৃথিবীর ঘাসপাতা ৷

আদর পেয়েও পৃথিবী অবিচল ৷ মায়াও নেই , হীনতাও নেই ৷ কেবল বড় করে শ্বাস ফেলে নিজের জীবন বোঝাচ্ছে ৷ গেট খুলতে খুলতেও ঘাড়ের কাছে পৃথিবীর শ্বাস ৷ গেট বন্ধ করার সময়ও বুকের কাছে পৃথিবী ৷

নাহ ! বৃষ্টি থামল না ৷ Rainy ছুটি নিয়ে চলে গেছে পৃথিবী ৷ আমি আজ তার সাথে ভিজলাম ৷ যাওয়ার আগে আমার কপালের জলে ভেজা সোয়েটের টিপ খুলে ফেলে দিয়ে গেছে ৷ কপাল আমার আরাম পেল ৷

সিক্ত পৃথিবী শস্য ফলাবে সবার জন্য ৷
ঐতেই তার বাঁচা ৷
তার নিজে নিজে নিজের হাত ধরা ৷

১৯

দণ্ডবৎ হই মা

এবড়োখেবড়ো মাটিতে বাঁচতে গেলে বোধহয় জীবনের গরিমাটা , নিয়ত বেঁচে ওঠার মহার্ঘ্য ভাবটুকু সবার আগে রক্ষে করতে হয় ৷ আর এটা আমি শিখি আমার বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুদের কাছে ৷ কখনো গোপন জল লুকোই ওদেরই বাঁচার মরীয়া চেষ্টা দেখে ৷ আমি তাই ওদের দিই আমার পছন্দসই নানা নাম ৷ আমার দেওয়া নামে কেউ বখতিয়ার ৷ কেউ খলিফা ৷ কেউ বা চাকবাদাম ৷ এক বন্ধু আমার এই পাগলামো দেখে বলেছিলেন –
আরে ! তোর ছাত্রছাত্রীরা জ্যান্ত জ্যান্ত মানুষ রে ৷ কল্পনামে ডেকে ডেকে তুই কি ওদের মিছেমানুষ বানিয়ে দিবি ! দেখিস না ওরা বাবা মায়ের দেওয়া নাম ভুলে তোর ওই মিছে ডাকে হাঁটে চলে ! ড্রইং খাতায় পাখি আঁখে ! তারপর তুই যখন বলিস আঁকা পাখিতে প্রাণ আছে তখন সেটাও কেমন বিশ্বাস করে !

সেদিন জোরগলায় বলেছিলাম —
ওরা মিছেমানুষ নয় রে ৷ ওরা আমার কল্পতারা ৷ রোজই ওরা কেউ না কেউ এসে আমার মনআকাশে আলো দিতেই থাকে ৷ মিছে ডাকে কি আর সত্য আহবান থাকে !

বন্ধুকে বলা এই কথাগুলো কোনোদিন ভুল প্রমাণিত হয় নি আমার নিজের কাছে ৷ এইসব শিশু ভুল হতে দেয়ইনি আমায় ৷ আজো বৃষ্টির মাঝে আমার সেই আকাশমনে আলো ছিটকোল ৷ স্কুল শেষেও মাঝারি বর্ষা চলছে ৷ প্রিয় ছাত্রী বখতিয়ার ওরফে বখা একটা প্লাস্টিক নুলিয়া টুপি করে মাথায় পরে নিয়েছে ৷ বখতিয়ার Multiple
disabled ৷ spasticity ভীষণ মাত্রায় ,সেইসঙ্গে চোখের সমস্যা ৷ মায়ের হাত ধরে হোঁচট খেতে খেতে চলছিল আজ ভেজা রাস্তা ধরে ৷ মায়া হল ৷ রিকশা ডাকলাম ৷ মাথা ঝাঁকিয়ে প্রত্যাখ্যান দিতে শুরু করল বখতিয়ার ৷ বললাম —

No পাকামি বখা ৷ মাকে নিয়ে রিকশায় ওঠ ৷ উত্তরে বখা মাথার নুলিয়া টুপিটা আরো ভালো করে নিজের সতেরো রকম ক্লিপ পরা মাথায় ঠেসে নিল ৷ রিকশায় উঠবে না সে ৷

—-কেন ? ভাড়া তো স্যার দিচ্ছেন ৷ তোর কী ! ওঠ শয়তান !

এতক্ষণ চুপ ছিল ৷এবার গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার করে উঠল –

আমি হাঁটতে পারি ৷ বাবা আমায় স্পেশাল বুটও কিনে দিয়েছে ৷ রেগুলার আমার মা ব্যায়াম করায় ওয়ান টু থ্রি করে ৷ দেখেছ আমার গায়ের জোর ৷

রোগা হাতের শিরা গুল্লি পাকাবার চেষ্টা করল বখা ৷

—ময়ূরীটা খালি পয়সা নষ্ট করে ৷ আমি পুরো পথ হাঁটব ৷ কেন তোমাদের পয়সা নষ্ট করব আমি ! মা তুমি যাবে কিনা !

বখার বকবক চলছে আর থইথই পথে বখার বুট থপথপ আওয়াজ শুরু করেছে ৷ পাছে রিকশায় তুলে দি ,তাই কি বড়ো বেশি জোরে দৌড়োবার চেষ্টা করছে বখা ! কিন্তু জলকাদায় হাঁটতে অত তাড়াতাড়ি হাঁটতে তোর যে খুব কষ্ট হবে রে বখা !

ভ্রূক্ষেপ নেই ৷ চলল সবার আগে ৷ পিছনে আমরা ৷
বৃষ্টির মাঝেই বৈকালিক আজান শুরু হল ৷ মনে হল , একটি আধা অক্ষম শিশুর সবল হয়ে ওঠার চেষ্টায় বিচলিত ভগবান হয়ত গান নিবেদন করলেন ৷

২০

কাঁদে না দজ্জাল

বহুদিন অনুপস্থিতির পর জলদি জলদিই মায়ের হাত ধরে স্কুল চলে এল দজ্জাল ৷ গেটে ঢোকার মুখে দেখি ,স্কুলের পাঁচিলে বসে মায়ের ফোন নিয়ে কার কাছে যেন তার স্কুলকর্মের ধারাবিবরনী দিচ্ছে ৷ তার মা বললেন ফোনে তার পিসি ৷ স্কুলে এসে পিসিকে ফোন করা চাইই ৷ আমি ঢুকতেই ফোনের ওপারে পিসিকে বলল —-
ওই ময়ূরী এল ৷ আজ পড়াশুনো গেল আমাদের ৷

বুঝুন —

ডাক্তারি মতে আমার দজ্জাল ” Blue Baby ” ৷ জন্মকালে অক্সিজেনের অভাবে ঠোঁট দুটো সেই যে নীল হয়ে গেছে তারপর সে দুটোতে নতুন রঙ ধরেনি ৷ চামড়ায় ফলেনি ধানের শিস ৷ তবু সে আসে ৷ ভালোবাসে ৷ ভালোবাসায় ৷

অন্যদিন এসেই শুরু করে দেয় ৷ একেবারে মৌলিক সব দজ্জালপনা ৷ প্রথমে সতীর্থদের টেবিলে চেপে লাগাতার ডান্স ৷ দাঁত কেলানো ৷ আমার কাছে উদোম মার খাওয়া ৷ তারপর আমারই কোলে চেপে বড়দের লম্বা লাইন টানা খাতায় এক থেকে পঞ্চাশ নির্ভুল লেখা ৷ এবং ফাইনালি টিফিনকৌটো খুলে আমায় হাফটিফিনের লোভ দেখিয়ে আমার থেকে ছুটি চাওয়া ৷

সেদিন কিন্তু এসে থেকে গুম হয়ে রইল ৷মাথা নিচু ৷ চুলের ঝুটির ডগাটাও মাটিমুখে ৷ অন্যদিন ছাদের দিকে মুখ থাকে ঝুঁটির ৷
– কী হয়েছে রে ?

নিরুত্তর ৷

–বজ্জাত বল শিগগির ৷ নইলে সুবহ সুবহ খুন হবি ৷

চুপ তো চুপ ৷

টিক্কিতে হাত বোলালাম ৷ টান পড়তে পারে ভেবে রিস্ক নিল না ৷একদৌড়ে মাকে ডেকে আনল ৷ মা বললেন —
তিনি সিঁড়ি থেকে পিছলে গিয়ে পা ভেঙেছিলেন ৷ তাই এতদিন আসতে পারেননি ৷ মা কিন্তু বলেননি মেয়ের পিছনে দৌড়োতে গিয়েই তাঁর এই হাল ৷

অথচ অবাক হয়ে দেখলাম –যতক্ষণ মা তাঁর পা ভাঙার বর্ণনা দিচ্ছেন বজ্জাত গম্ভীর ৷ মাঝে মাঝে উঠে গম্ভীরমুখেই মাইমে দেখাল কীভাবে পড়েছেন মা ! কোথায় কতখানি ব্যাথা জমে আছে মায়ের ! দুখানি ছোট্ট হাত দিয়ে নিজের পা ও কোমরে চাপড়ে চাপড়ে চলল তার মায়ের ধপাস হওয়ার এক্টিং ৷

স্কুল শুরুর ঘন্টা পড়ল ৷ মা চলে গেলেন বাইরে ,
যেখানে অভিভাবকরা বসেন ৷ ক্লাসরুমের দরজা বন্ধ করলাম ৷ বজ্জাতের আবার ঘর বারান্দা দৌড়ে দৌড়ে পড়ার অভ্যেস ৷ অতএব ছিটকিনি ৷ এক লাফে উঠল নীলমেয়ে ৷ দরজাটি ধরে বসে পড়ল মেঝেতে ৷ দুপা ছড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছে ৷ কী বলছে বুঝতে পারছি না ৷ জন্ম থেকেই পুরো বাক্য বলতে পারে না যে ! তবু সেদিন কোন অকুল পাথারে ছুটল যে তার সব কথা !

যত বলি —
মা তো দরজার ওপারেই বসে ৷ স্কুল ছুটি হলেই দেখতে পাবি ৷ তোকে কোলে কোলে বাড়িও নিয়ে যাবে মা –
সে তত বলে —
খোল দরজা খোল ৷ দেখিস না ? দরজা বন্ধ ৷ মা কই আমার ?.ও আন্টি খোল ৷ দরজা খুলে মা দে আমায় ৷

উফ ! দাঁড়া রে বাবা খুলছি ৷

বজ্জাতি হাসি খলখল
আমার মাগুর মাছ ছলবল ৷
নহি তোর দিদিমণি ৷
আমরা দুই বান্ধবী
ময়ূরী আর দজ্জালিনী ৷
যেদিন আটকা পড়ব দুয়ারে
খুলে দিস ভাই আমারে ৷

[ ভোরাই শিশুপত্রিকায় প্রকাশিত ]

২১

সঙ্গে কে কে যাবি আয়

শিশুর কল্পনা আর কল্পনা থেকে সৃজন কত দূর দূর ছুটে বেড়ায় -ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় – কী করে বোঝাই আপনাদের ! সেবার ড্রইং ক্লাসে একটি মেয়েকে আঁকতে দিলাম ঝুড়িতে বসানো সবুজ লাউ ৷ মানে তাকে ঝুড়িও আঁকতে হবে ,লাউও আঁকতে হবে ৷ ডাক্তারি মতে মেয়েটি ডাউনস সিনড্রোম এবং slow learner ৷ এ ধরনের বাচ্চাদের মস্তিষ্কে শব্দধারণ ক্ষমতা কম ৷ সেইহেতু স্মৃতিও কম। তাই রোজকার দেখা বস্তুগুলোকে আগে শেখাতে হয় এবং ছবি বা real object সামনে রেখেই শেখাতে হয় ৷ তাতে করে ওই বস্তুগুলো শিশুর মনে একটা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে ৷ শেখাটা আর সে ভোলে না ৷

গরমকাল চলছিল ৷ ঋতুর সাথে মিলিয়ে কিছু দরকারী সবজি শেখাব ঠিক করলাম ৷ বললাম –

দ্যাখ এখন তো গরম ! বাজারে এসময় লাউ ওঠে ৷ সবুজ সাদা mixed রঙের লাউ ৷ দেখছিস তো রোজ ? ওই আঁক ঝুড়ি ভর্তি করে – দোকানি যেমন করে থরে থরে সাজিয়ে রাখে ! আঁকার হাত তার বড়ো ভালো ৷ ঝুড়ি আঁকল ৷ ঝুড়ির মাঝে বসাল একটা বড় লাউ ৷ তখনো রঙ করেনি ৷

হঠাৎ দেখি লাউয়ের চারপাশের পেন্সিল টানা বাঁকগুলোকে আরো বেঁকিয়ে চুরিয়ে দিচ্ছে ৷ কান মূলব ভেবেও থামলাম ৷ দেখলাম সে লাউটাকে আস্তে আস্তে মেঘ করে দিচ্ছে ৷ জলও পড়ছে মেঘ দিয়ে টপটপ করে ৷

একসময় জল আঁকাও শেষ হল ৷ লাউ যখন পুরো মেঘ হয়ে গেছে ঠিক তখনই তলার ঝুড়িটা মুছতে লাগল রবার দিয়ে ৷ হাত চেপে ধরলাম ৷

– না একদম না ৷ কিছু মুছতে পারবি না ৷ ঝুড়িটাকেও ফিট কর মেঘের মানানসই করে ৷

এবার সে আঁকলে ঠিক তারই মতো দুই বেনীওয়ালা একটা মেয়ে আর বড় চুলওয়ালা একটা মাকে ৷ তারপর মায়ের মাথায় ছাতার মতো উল্টে এঁকে দিল ঝুড়িটা ৷ ঝুড়ির মাথায় কটা পেন্সিল ফুটকি ৷ শেষ বারিপাত ৷

ততক্ষণে সে মেয়ের কল্পনা আমায় পেয়েছে ৷ কল্পনা আর পাগলামিতে মাখামাখি হচ্ছে আমার আঙ্গুল ৷ ছবির মা ছবির মেয়ের হাতে বসাতে লাগলাম গোছা গোছা চুড়ি ৷

– দ্যাখ রে মেয়ে চুড়ি পরে তুই হলি আমার গ্রামের মেয়ে আর আমি তোর গ্রামের দিদিমণি ৷ এতক্ষণে তোর ঝুড়ি ঠিক ফিট হল ৷ হরিণবেগে চলব এবার ঝুড়ি মাথায় দিয়ে ৷

কী বৃষ্টি !কী বৃষ্টি ! ভিজে মরবি ! ধেয়ে চল মাঠ ধরে ! ওপারে শয়ে শয়ে দরজা ! খুলে যাচ্ছে – খুলে যাচ্ছে রে ! মত্ত বায়ু একদম দামামা ৷ চুলফুল উলুখাগড়া ৷
মা মেয়ে হাঁকে —
কৈ রে আমার চাঁদ সূর্য তারা
বৃষ্টি মেঘের ঠাণ্ডা ছায়া
সব কটা ছুট্টে এসে
মোদের শরীর ভর ৷

[ লেখাটি প্রথম কুলদা রায় সম্পাদিত গল্পপাঠ নামক অন্তর্জাল পত্রিকায় ও পরবর্তীতে অধ্যাপক অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘ ভোরাই ‘ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ৷]

২২

ইঁদুর কাটে কুটকুট

আমার একটি Mentally Challenged ছাত্র বড়ো ভালোবাসত মনীষীদের গল্প শুনতে ৷ অন্য পড়া তার অল্প বুদ্ধি দিয়ে মনে রাখতে না পারলেও রবীন্দ্রনাথ নজরুল কি গান্ধীর জীবনকথা পরম মমতায় সাজিয়ে রাখত স্মৃতিভাণ্ডারে ৷

যখনি জিজ্ঞেস করতাম গড়গড় করে বলত রবীন্দ্র- নজরুলের জীবনের খুঁটিনাটি ৷ কখনো বা তাঁদের ছড়া গান কবিতা ৷ কী না ! অবাক হতাম ৷

ক্লাসে ছোট ছোট সরল বাক্যে কোনো না কোনো মনীষীর জীবন আলেখ্য সাজিয়ে দিতাম তাকে ৷ এই ধরুন পাঁচ ছটি বাক্যের প্যারাগ্রাফ ৷ আশ্চর্য ! ছেলেটি প্রথম পাঁচটি বাক্যে অনায়াস থাকলেও প্রতিবারই হোঁচট খেত শেষ বাক্যে , যেখানে মনীষীর মৃত্যুর তারিখ লিখতাম ৷

কী রবীন্দ্রনাথ কী নজরুল ! যাঁর বেলাতেই হোক না কেন , মনীষীর মৃত্যুর দিন চক্ষে আসলেই কাঁপত ৷ যেন ভূতের ভয় লেগেছে ৷কাঁপতে কাঁপতে একেবারে ডেস্কের তলায় লুকোত ৷

ছেলেটি বেশ ডাকাবুকো ৷ হাঁকডাক দিয়ে ক্লাস জমাত খুশিয়ালি মেজাজে ৷ তাহলে ? কবেকার মনীষীর মৃত্যতে কেন এতো কাতর হয় একালের বাচ্চা !

আজ বুঝি ৷ Able বা কাবিল মানুষের চেয়ে ষাটগুণ দ্রুততায় এই ” Differently Abled ” শিশু বুঝি বুঝে ফেলছিল গান্ধী নেতাজির মৃত্যুতে দেশ ক্রমশ ছাইবে ভুতের দলে ! আছড়ে পড়বে প্রেত ৷ তার কটু বাস ! জলহীন ভুতমেঘে ভরবে আকাশ ৷ বিষসম জলে পৃথিবীর মোট খাদ্য খতম ৷

ওহ হো ! আজ হয়ত আমার স্মৃতিচারণে সেই দস্যি খোকা দুগুনা বিষম খাচ্ছে ৷ মানিয়ে নে ৷ চলমান ফোনের লেখাপড়ার সুবাস তোদের নাকে ঢুকবে না ,এ সত্য বুঝে নে ৷ অনলাইনের বাইরের লাইনে দাঁড়িয়েথাকাটা প্র্যাক্টিস তো কর !

পায়ে ব্যাথা করছে নারে ? আয় আমার কোলে একটু আয় ৷ চাপড় দিয়ে ঘুম আনি ৷ আচ্ছা একটা গল্প বলি ! শুনবি সেই গল্পটা ! ঈশপ বলে এক ক্রীতদাস সেই যে লিখেছিলেন –আরে সেই যে সেই গল্পটা – বেশ কটা বোকা পাখির মাঝে অচঞ্চল বসে এক জ্ঞানী প্যাঁচা। প্যাঁচার জ্ঞানে বিব্রত বাদবাকি সুন্দর পাখিগুলো ৷ জানিস গল্প বলে দাস ঈশপ হয়েছিলেন দার্শনিক। শুনবি তাঁর কথা ?

উফ ! পায়ে কুটুস করে কামড়াল ইঁদুর ৷

ইঁদুর বলল –ভাবিস না ৷ বাঁচবে অসুন্দর আর খুদেরাই ৷ তারাই পাবে অক্সিজেনের মোটা অংশ ৷ তারা যে বাতাস নিতে জানে ৷ কখনো বইয়ের পুরোনো পাতায় ৷ কখনো গাছের নতুনে ৷

নাহ ৷ বকবকানি শুনতে শুনতে আমার Patriot বাচ্চাটা ঘুমিয়েই গেল ৷ একটু নিন না ,ওর বেলাইনে খাড়া থাকা পায়ের তাপ !

২৩

হারিস না

বছর দশেক আগে স্কুলে শেষ এসেছিল মনিহার ৷ মনিহার খাতুন ৷ কথা বলতে পারে না ৷ কথা শুনতেও পায় না ৷ তবুও স্কুলের নিয়মমাফিক আসা ছাত্রছাত্রীদের লিস্টিতে সব্বার আগে মনিহার ৷ রাজারহাটের কোনো এক গ্রাম থেকে প্রায় দুতিন ঘন্টার জার্নি করে ঠিক দশটাতেই পৌঁছে যেত স্কুলে ৷ এক পা বড় আর এক পা ছোট মনিহারের ৷ তবু এক মিনিটও লেট নয় ৷ আর ওই এক মিনিট লেট না করার খেপামিতেই রাগ বড় তীব্র হয়ে উঠত তার ৷ হাঁফাতে দেখে কতদিন বলেছি –
ওরে দশ কুড়ি মিনিট লেট হলে কিচ্ছু হবে না কো ৷ নাহয় দশ মিনিট পরেই পড়া শুরু করবি ৷

শুনেটুনে রাগী চোখে চলে যেত ৷ পরের দিন আবার আসত ৷ সেই দশটায় সেই রাগী চোখে ৷ রাগ আর কান্না ছাড়া আর যে কিছু দিয়ে কিছু বোঝানো যায় ,তাইই ধরতে পারত না সে ৷ ধরতে চাইতও না ৷ অনুভবের জটিলতায় ঘুরে মরে অনুভবকে চিরতরে খোয়াতে রাজি ছিল না আমার মনিহার ৷

মাথা ভর্তি করে উকুন এল মনিহারের ৷ কিছুতে কাটবে না চুল ৷ উকুনে ঘা চুলকে সুখ নেয় মনিহার ৷
–ও মনিহার আয় ! আয় কাঁচি দিয়ে চুল কেটে দি ! দ্যাখ কত আরাম পাবি মাথায় ৷

কিল চড় দিয়ে দিদিমনিকে ঠাণ্ডা করে দেয় মনিহার ৷ একদিন স্কুলের অধ্যক্ষ বড় একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়ালেন মনিহারের সামনে ৷ এক মুহূর্তও নষ্ট না করে পিঁড়ি পেতে বসিয়ে দিলাম স্কুলের বাইরে ৷ ফটাফট উকুন সাফ হল মনিবেগমের ৷ রাগের চোটে মনিহার অধ্যক্ষকে ডেকে বসল – ,বাবা ৷ আমার মনির মুখের প্রথম মানেযুক্ত শব্দ ৷ এরপর থেকে ক্লাসে সামান্য বকলেই এক ছুট্টে বাবার কোলে ৷

পেটে প্রচণ্ডযন্ত্রনা নিয়ে বাবার মেয়ে ভর্তি তখন আর জি কর হাসপাতালে ৷ করছে ব্যাথা ! তাতেও কান্না নেই ৷ খটখটে চোখে ক্রোধ আর ক্রোধ ৷ রাগের বশে রোগা শরীরখানাকে না ছিঁড়ে কুটিকুটি করে , এই ভয়ে মনির বাবা ( অধ্যক্ষ অতনু ঘোষ ) ছুটলেন হাসপাতালে ৷ নরম চোখে বেগম মনি দেখলে তার বাবাকে ৷ বুকে ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে রইলেন অতনু ৷ সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়ে তবে মনির বাবার ছুটি মিলল ৷

সম্ভবত এর পর থেকেই স্কুলে আসা আস্তে আস্তে বন্ধ হয় মনিহারের ৷ অনেকদিন হয়ে গেল ৷ মাঝে মাঝে দেখি, নিশ্চুপ দুপুরে দশ বছরের পুরনো রেজিস্টারে হাত বোলাচ্ছেন অধ্যক্ষ ৷ রেজিস্ট্রারে লেখা নামটিতে রাগী মেয়ের মুখটা রয়ে আছে !

কতদিন খবর নিই নি আমার বেগমবাহারের ! কেমন আছে সে যুবতী? এখন তো সে ভরা পূর্ণিমা !

কেমনই বা আছে আমার জীর্ণ জন্মভূমি ? সে আমার মনিরও জন্মভূমি ! খবর নিতে ভুলে যাচ্ছি তারও !তারও !

আয় ফিরে রে মনিহার ৷
আমার বন্ধ মনে বসা গরীবের দরবার ৷
জন্মছোট পা তোর ৷
তবু হেঁটে চ —
দুয়োরের ওপারেই সব ৷

২৪
ছড়াঝুলি
ওমা সরস্বতী

তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা ৷ তখনো Differently Abled বাচ্চাদের special Education বা বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি দেশে ততো চালু হয়নি ৷ মানে থিওরি চালু হলেও সাধারণ মানুষের কাছে সেসব তত্ত্বজ্ঞান তেমন একটা পরিচিতি পায়নি ৷ বরঞ্চ special child জন্মালে বাবা মা তাকে স্বাভাবিক ভেবে নিয়ে কল্পরাজ্য তৈরি করে ফেলতেন ৷ নয় অতি স্বাভাবিক ভেবে নিজেদের তৃপ্ত করতেন নতুবা
অক্ষমস্য অক্ষম ভেবে শিশুটিকে লুকিয়ে ফেলতেন স্কুলহীন রাজ্যে ৷

দেশে যখন Special Education প্রসারের এমন হাল ঠিক সেই সময় এক বৃদ্ধ মানুষ লক্ষ্য করলেন তাঁর একমাত্র নাতনী স্বাভাবিক বাচ্চার মতো আচরণ করে না ৷ জন্মের মাস পাঁচেকের মধ্যেই ধরা পড়ল কাছে পিঠে শব্দ হলেও সে ফিরে তাকায় না ৷ হাত পা ঘাড় কিছুই তার পুরুষ্টু নয় ৷ দুপুরে নাতনি কোলে ছাদে বসে ঠাকুরদা দেখেন –সূর্যের আলোয়ও দূরের বস্তু দেখতে সে চোখ কুঁচকোয় ৷

সেই দিন থেকে Multiple Disabled নাতনীর সাথে অদ্ভুত এক খেলা শুরু করলেন ঠাকুরদা ৷ শব্দখেলা ৷ হাতের কাছে একটা দোলনা বানিয়ে তার ওপর বসালেন শিশুটিকে ৷ দোলনায় দোল খেতে খেতে শিশুর মনে মজা জন্মায় —৷
দোলদোল ছন্দ বলে —
এই তো আমি এসে গেছি রে !

আর তখন কী করেন ঠাকুরদা ? দুলতে থাকা শিশুর সামনে সারাদিন ধরে ছড়া বলে যান ৷ নাগাড়ে ছোটে সে ছড়ানদী ৷ এমনকি প্রতিদিন যে সমস্ত সাংসারিক কথা আমরা বলে থাকি বা ঘটনাচক্রে যা আমাদের বলতেই হয় , সবকিছুই ইচ্ছে করে দোলনায় বসা শিশুটিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে শুরু করলেন ৷

ধরুন বাড়ির কেউ সত্যি দোষ করেছে ৷ তাকে বকুনি দিতে হলেও শিশুটির সামনেই দিতেন ৷ শিশু শিখতে লাগল – কোনটাকে দোষ বলে , দোষ হলে কতটা রাগ করতে হয় এবং রাগ প্রকাশে কতটা চেঁচিয়ে ( Adequate Loudness ) শব্দ করতে হয় !

নিষ্ঠাবান শিক্ষক ঠাকুরদার নাতনি বড় হল ৷ শব্দ শিখল ৷ শব্দের ছন্দ শিখল ৷ সেই সঙ্গে শিখল কোথায় কোন শব্দ প্রয়োগ করতে হয় অর্থাৎ সমাজে শব্দপ্রয়োগের ন্যূনতম ঔচিত্যবোধ সে অর্জন করল ৷ সে যেমন কেউ দোষ করলে রাগের শব্দ বলতে শিখল আবার কেউ ভালো কাজ করলে কোন শব্দ দিয়ে তাকে প্রীত করতে হয় তাও শিখল ৷ আলাদা ঘরে রেখে নয় ,সবটাই ঠাকুরদা তাকে শেখালেন সমাজ ও সংসারের মাঝে ফেলে দিয়ে ৷

যে শিশু কোনোদিন স্কুলে যেতে পারবে না বা যাবার কথা চিন্তাও করতে পারে না কেউ তারও একটা স্কুল যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল ৷ এবার কী করবেন ঠাকুরদা ! প্রিয় নাতনী -যার high level spasticity তখন detected হয়ে গেছে, সে যাতে স্কুল যাওয়াটাকেই ধর্ম জ্ঞান করে তার জন্য ফেলে দেয়া রঙিন কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঠাকুরদা বানালেন স্কুলঝুলি ৷ তাতে ভরে দিলেন কিছু বই ৷ নাতনী ঐ স্কুল ঝুলি নিয়ে সারাদিন দাদুর কাছে বসে থাকে ৷ তার মধ্যে তৈরি হতে থাকে একটা বইভর্তি বাড়ি অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার উত্তেজনা —খুশি —একটা —একটা ইচ্ছে ৷ ভীষণ এবং তীব্র ইচ্ছে ৷

কোনো এক সকালে ঐ ঝুলিটি নিয়েই সে স্কুলে রওনা দেয় তার special বুটজোড়া পরে ৷ এক পা বড় এক পা সামান্য ছোট ৷ আজও সে আমাদের স্কুলে পড়ে চলেছে ৷ তিরিশ বছর বয়স হয়ে গেছে ! তবু তার স্কুলে আসার ইচ্ছেটাকে কেউ মারতে পারেনি ৷ যেদিন স্কুলে আসা হয় না চিৎকার করে ঝগড়া করে ৷ সে তো জানে স্কুলে না আসা বেঠিক কাজ এবং বেঠিক কাজে কীভাবে রাগ করতে হয় কিংবা কতটা রাগ করা উচিত ৷ আমি ক্লাসে ফাঁকি দিলে আজও কড়া গলায় ধমকে ওঠে ৷ আমি তখন খুকী হয়ে তার সঙ্গে খেলতে চাই ! সে রাগে ৷ ফিক করে হেসে দেয় ৷

ঝগড়া –ভাব , আমার সঙ্গে কোনটারই কি বিরাম আছে তার ! ঠাকুরদার ছড়া পাখি হয়ে তার ঠোঁটে বাসা বেঁধেছে চিরকালের মতো ৷

২৫

বরেনের বন্ধুরা

” জানো মাসী -আমার বাবার বেশী টাকা নেই ৷ এদিকে আমি আর আমার বোন তো ঘি দিয়ে ভাত খেতে ভালোবাসি ৷ ঘি ,আলুসিদ্ধ আর ভাত ৷ স্কুল থেকে ফিরে রোজ এই খাবারটা পেলে আমাদের ভালো লাগে ৷ মুখে কিছু বলি না ৷কেন কি -ঘিয়ের একটা দাম আছে তো ! কিন্তু বাবা কেমন করে জানি বুঝে যায় গো ! কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় ঠিক একটা ঘিয়ের শিশি নিয়ে ফেরে ৷ আমি আর বোন একটু –এই একটুখানি ঘি দিয়ে অনেক ভাত মাখি ৷ গন্ধেই খাওয়া হয়ে যায় ৷ বেশী করে ঘি ঢাললে তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় ! বাবা কী করে পারবে বল ! কাঠের টেবিল টুল বানিয়ে কত আর পায় ! তারপর আমরা দু ভাইবোন ! ” —-রিহার্সালে বসে একটানা কথা বলছিল বরেন ৷ ঘিয়ের লোভ আর বাবার জন্য মায়ায় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছিল ছেলেটা ৷ আর আমি আমাদের দলের সবথেকে বাচ্চা শিল্পীর আঙুল শুকছিলাম ৷ বরেন ক্লাস সেভেন ৷ বাবার সঙ্গে আমাদের থিয়েটারে এসেছে অভিনয় করবে বলে ৷ তার বাবা ছুতোর মিস্ত্রী ৷ ভালো অভিনয় করেন ৷ জীবিকার প্রয়োজনে অনেকদিন রিহার্সালে না আসতে পারলেও পার্ট ভোলেন না ৷ বাবার শিক্ষার জন্যই হয়ত বরেন নিজের হাতে নিজের পার্ট লেখে ৷ স্ক্রিপ্ট হাতে দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম -ছাপার অক্ষরে তার পছন্দ নয় ৷ পার্ট সে লিখে নেয় -বানান ভুল হচ্ছে বুঝতে পারলেই চুপিচুপি আমার ঠোঁটের ওপর কান পাতে ৷ বরেনের কান খুব নরম ৷ ঠোঁটে আমার সুড়সুড়ি লাগে ৷ আমি বরেনের কানে ঠিক বানান বলি ৷ বরেনের তেলমাখা ডানদিকে সিঁথি কাটা চুলে হাত বুলিয়ে দি ৷ নিজের হাতে বরেনের মাথার তেল আমি ইচ্ছে করে লাগাই ৷

কদিন যেতে না যেতে বরেনকে আমি অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতে শুরু করি ৷ পার্ট অভিনয় ছাড়াও বরেন তার বাবার সঙ্গে সেট বানানোর কাজেও হাত লাগায় ৷ পিসবোর্ড গোল করে কেটে রঙ দিয়ে পাথর তৈরী হয় নাটকে ৷ বরেন গোল পিসবোর্ড গড়িয়ে দেয় স্টেজে ৷ চেঁচিয়ে বলে –ও মাসি , এ যে হালকা ৷ গড়গড় গড়ায় ৷পাথর কি এত হালকা হয় মাসি ! এমন নিটোল গোল হয় ! চিত্রশিল্পী এসে থিয়েটারের পাথরে ফাইনাল টাচ দেন ৷ পিসবোর্ড এবড়োখেবড়ো করে দেন ৷ নির্দেশক আমাদের দেখান –হালকা পিসবোর্ডের পাথরকে কী করে ধরলে সত্যি পাথর প্রমাণ করা যায় ! বরেন দূরে দাঁড়িয়ে শূন্য হাতের পেশী ফোলায় ৷ পাহাড় কল্পনায় তার বোধহয় পিসবোর্ডের পাথরও আর লাগে না ৷ বরেনের কল্পনা মুক্ত পাখি ৷ তার মাধ্যম লাগে না ৷ শরীরের চারপাশের বাতাসে সে পাহাড় গড়ে ৷

সে একটি চাঁদ দেখার দৃশ্যে অভিনয় করে ৷ দাদুর মুখে চাঁদ আর চাঁদের ভাইয়ের গল্প শুনে নাতি ছুটছে চাঁদ দেখতে ৷ কিছু বলতে হল না বরেনকে ৷ আপনা থেকে সে চিবুক উঁচু করে রিহার্সাল রুমের টিউব ছাড়িয়ে কোথায় যে তার চোখ দুটো উড়িয়ে দেয় ! মঞ্চে বরেন শুধু নিশ্চুপ চাঁদ দেখবে আর চাঁদের গল্প বলে যাবেন অন্য অভিনেতা ৷ দেখলাম –মিছে চাঁদ দেখে বরেনের ঠোঁট কাঁপছে ! আছছা বাঁদর তো ! কে তোকে এত বিশ্বাস নিয়ে মঞ্চের স্পটলাইটকে চাঁদ ভাবতে বলেছে ! বুঝিস না তোর এ অন্তহীন বিশ্বাসে আমার গতজন্মের পাপ মনে পড়ে !

ভয় করে –আমার আজকাল ভীষণ ভয় করে বরেনের এই চাঁদ দেখে আত্মহারা হওয়ার অভিনয় দেখে ! খালি মনে হয় –বরেনের চোখ পাখি হয়ে যাবে ৷ তার ঘিয়ের গন্ধমাখা আঙুলগুলো পালক হয়ে ছড়িয়ে যাবে চরাচরে ! – যে আঙুলে তুলি তুলে সামান্যমাত্র টিফিন খেয়ে , বরেন গাছের পাতা আঁকে ৷ বরফপাহাড়ের গাছ ৷ সবুজ রঙে আঁকা পাতার মাঝে মাঝে থার্মোকল-বরফ ৷ যে নিবিষ্ট চোখে আমার বরেন সবুজ আর বরফের অনুপাত ঠিক করে , সেই চোখ কি এবার মঞ্চ ছেড়ে চলে যাবে সত্য কোনো পর্বতচুড়োয় !

একদিন এই দৃশ্য শেষ হওয়ামাত্র বরেন একছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে ৷ দলের বাকীরা কথায় ব্যস্ত ৷ আমি বরেনের পিছনে ৷ বেরিয়ে দেখি –মাঠের মধ্যে চাঁদের দিকে ঠিক ঐভাবে নিজেকে ভুলে তাকিয়ে আছে ! সেদিন পূর্ণিমার পরের , কি তার পরের দিন ছিল ৷ বরেন তাহলে চাঁদ দেখার অভিনয় করতে করতে সত্যি চাঁদকে মনে রেখেছিল ! সে জানত -আজ আকাশও তাকে অনেকখানি চাঁদ দেখাবে ৷

বরেনের চোখে সেদিন চাঁদ এসেছিল ৷
সে চাঁদ খুব ঠাণ্ডা ৷

না বরেন খুব বিপদজনক ৷
যে কোনোদিন সে আমার নাভী ছিঁড়ে পেটের মধ্যে ঢুকে পড়বে ৷
তারপর বারবার আমার কোলে জন্ম চাইবে ৷
তাতে আমার অখণ্ড সৌভাগ্য অর্জন হলেও শিল্পী বরেন ভ্রষ্ট হবে !

এ ছেলেকে আমি কিছুতে ভালোবাসব না ৷
তাকাবই না তোর দিকে ৷

২৬

আয়নায় পটের বিবি

একদা ভীষণ যৌবনে , অধীত বিদ্যেবুদ্ধির জোরে সেই যে চলিত সংস্কারগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম সে আজো চলছে আমার ৷ লোকের বিদ্রুপ উপহাস শুনেছি ৷ মাঝে মাঝে সাথীরা আমায় একা করে সরেও পড়েছেন ৷ তবু কেন যেন সংস্কারের কাছে মাথা নোয়াব না এবং নোয়াব না তো নোয়াবই না — নাছোড় জিদটা আমার রয়ে গিয়েছে ৷ আজ এই আধবুড়ি বয়সে যখন নিজের মতো চলায় নিজেই খেই হারাই , অস্বস্তি হয় ৷

ক বছর আগের ঘটনা ৷ আমার স্কুলের একটি বাচ্চা বড্ডো সাজতে ভালোবাসে ৷ মেয়েটি mentally challenged এবং open heart surgery এর রোগী ৷ তো হলো কি , একটা বিয়েবাড়ি গিয়ে নতুন বৌয়ের আলতা পরা পাদুটো দেখে টেখে মেয়ের ভারী সাধ হল ঐ রকম করে সাজবে ৷

স্কুলে গিয়ে দেখি জুতো মোজা খুলে আলতা পরা পায়ে এঘর ওঘর দৌড়চ্ছে ৷ স্কুলে আসার হুড়োতাড়াতে তার পায়ের লাল রেখাগুলো সামান্য ট্যারাবেঁকা হয়ে গিয়েছিল ৷ আমায় তো কোনোকালেই বাচ্চারা দিদিমণি ভাবে না ৷ ভাবে ওদেরই একটি ফাজিল বন্ধু ৷ তাই আমার কোলের ওপর চেপে বসে কানে কানে আলতা নিয়ে তার অশান্তির কথা বলল । কী ? – না তাকে আলতাটা পায়ে deep করে দিতে হবে ! হুকুম শুনে আমি , যে কিনা সারাজীবন সিঁদুর আলতার ধার ধারিনি–কী বলবো আপনাদের — ছুট্টে গিয়ে আলতা কিনে তার পা দুটোকে deep red { এই শব্দ দুটো তার ) করে দিলাম ৷ আর স্কুলে নাচের পোশাকের store থেকে একটি আধখানা লাল উর্নী ঠোঙা করে বসিয়ে দিলাম তার মাথায় ৷

না -না ৷ সাজসজ্জার ব্যাপারে আমার ওপর একচুলও ভরসা ছিল না সে মেয়ের ৷ তাই ভ্যানিটি ব্যাগে রাখা আমার হাত আয়নাটিতে চিল চোখে চাইল আলতাবিবি ৷ ততক্ষণে এই নামটিই তাকে দিয়ে দিয়েছি মনে মনে ৷ দেখি — উর্নী ঠোঙাটাকে মাথার খাপে খাপে সেট করতে ব্যস্ত হচ্ছে বিবিমেয়ে ৷ মুখ তার ছোট্ট ৷ আয়নাটা ছোট ৷ কখনো মুখ সরে যায় ৷ কখনো আয়নাটাই ফুরিয়ে যায় ৷ পড়ানো শিকেয় তুলে আয়না ধরে বসে রইলাম , যতক্ষণ না ঠোঙাটি ঘোমটা হয় ৷

সেদিন বাড়ি ফিরে ক্লাসরুমে ছাত্রীর পায়ে আলতা মাখামাখির ঘটনায় বড়ো অস্বস্তি হচ্ছিল ৷ আজ লিখতে বসে মনে হচ্ছে এ আমার অহংকার গো অহংকার ৷
কিছু আলতা সূর্যাস্ত রঙের হয় ৷
সে রঙে আমার বিবিমেয়ে যুবক হয় ৷

(ক্রমশ)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes