
সেক্যুলারের সিকি-আধুলিতে এ তুফান ভারি পাড়ি দেওয়া সম্ভব?
সরোজ দরবার
সংবাদমাধ্যমের যে কর্মী উসুম-কুসুম জাতীয়তাবাদী নাট্য প্রাইম-টাইমস্থ করে থাকেন, তাঁর সংবিধানবিরোধী কাজের দায় তাঁরই। সকল আলোকপ্রাপ্ত সংবাদমাধ্যমকর্মীকে ফেসবুকে পোস্ট লিখে প্রমাণ করতে হয় না যে, তিনি এর সঙ্গে সহমত নন। যেমন পাশের বাড়ির মুসলমানকে প্রমাণ করার দরকার পড়ে না যে, তিনি পহেলগাঁও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নন। যেমন পাশের বাড়ির হিন্দুর প্রমাণ করার দরকার পড়ে না যে, সাধ্বী প্রজ্ঞার কৃতকর্মের দায় তাঁর নয়। এরকমটা স্বাভাবিক হলে ঝামেলা চুকে যেত। হয় যে না, তা নিয়েই শঙ্কা। দেখা যাচ্ছে, স্বাভাবিকতার যে সহজ চলন তা ক্রমে উপহাস হয়ে উঠছে। স্বভাবতই যাঁরা একের সঙ্গে দুই মিলিয়ে তিনকে দোষী ঠাহর করে ফেলছেন, তাঁদের একেবারে নাকচ করে দেওয়া যায় না। দিলে নিজেদের ইতিহাসের প্রতিই একচোখো হয়ে থেকে যেতে হয়। এই যে কাশ্মীরের হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেক্যুলার বিষয়টি একেবারে চোখের বালি হয়ে উঠল, তা তো অকস্মাৎ নয়। ঘা ফেটে পুঁজ বের হওয়াই ধর্ম। কখন যে ঘা-মুখ খুলে যাবে, কেউ জানে না। কাশ্মীর সেই মুহূর্ত। যেখানে সন্ত্রাসীদের টার্গেটই ছিল ধর্মহিংসা জাগিয়ে তোলা। শুধু সহ-নাগরিক হারানোর বেদনা মাত্র নয়; নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষ হারানোর ক্রোধ জাগানো। তা পুরোদস্তুর সফল। এবং এই বিন্দুতে এসে সেক্যুলার বেচারি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ধর্মহিংসা বাড়লে কোথায় তার ছায়ায় আশ্রয় নেওয়ার কথা, উলটে তো সেই চাঁদোয়া খুলে ফেলতেই চাইছে বহু মানুষ। এই অভূতপুর্ব পরিস্থিতিতে সেক্যুলার যায় কোথায়!
সেক্যুলারিজমের এই হোঁচট আসলে মধ্যবিত্তেরই শ্রেণি-সংকট। যাঁরা নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করছেন, এবং যাঁরা তাঁদের কাঠগড়ায় তুলছেন, দুই পক্ষের মানুষই মোটের উপর সুবিধাভোগী অবস্থান থেকেই কথা বলছেন। পরধর্মে সহিষ্ণুতা নিয়ে সন্দেহও ওই একই শ্রেণির অভ্যন্তরীণ সমস্যা। যে-বর্গ তথাকথিত শিক্ষিত, আধুনিক হওয়ার গৌরব চায়, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য চায়, সমাজের কর্তৃত্ব দাবি করে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হওয়ার অন্তত স্বপ্ন দেখে, সে-বর্গই পড়েছে এই অলাতচক্রে। আধুনিক হয়ে ওঠার ধারণার ভিতরই উপ্ত ছিল এই সমস্ত সম্ভাবনা। সে চক্রব্যূহ থেকে আজ আর বেরোনোর পথ জানা নেই। আলাদা ধর্মবিশ্বাসের মানুষ বহুকাল ধরেই পরস্পরের বিশ্বাসকে পৃথক জেনেই নিজের মতো করে বেঁচে থেকেছে। হিন্দু-মুসলমান ধর্মাবলম্বীর এ বহুকালের অর্জন। এবং মূলত এই অভিজ্ঞান আছে বলেই মানুষ আজও টিকে আছে। পৃথগন্ন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেশীরা যেভাবে পরস্পরের স্বাতন্ত্র্য, সম্মান বজায় রেখেই সহাবস্থানে থাকেন। এই অভ্যাস নতুন নয়। নতুন হল সেই আত্মপরিচয় যা বাঙালি খুঁজতে শুরু করেছিল উনিশ শতকে। সেখান থেকে সেক্যুলার শব্দটি তার সঙ্গে নতুন অর্থ নিয়ে যোগ দিল। শব্দটির অর্থ প্রসারিত হতে হতে নানা ভাবে নানা জনের কাছে ধরা দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রাদায়িক, রাষ্ট্রীয় জীবনের ধর্মের যোগ না থাকা, এবং অনেকের কাছেই এই ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল রাজনীতির ক্ষেত্রে- সেক্যুলারের এমন যাবতীয় ইন্টারপ্রিটেশনকে সামনে রেখেই রামকৃষ্ণ ভট্টচার্য বলবেন, “আসলে এইসব উলটো-পালটা কথা বলে ‘সেকিউলার’ শব্দটির ভুল ব্যবহার করা হচ্ছে- লোককেও ভুল বোঝানো হচ্ছে।” লাতিন ও পরে ফরাসি শব্দ থেকে চলে আসা সেক্যুলারের অর্থ-বিবর্তন ভেঙে তিনি দেখাচ্ছেন যে, তা প্রয়োগ হত ‘জগৎ-সংক্রান্ত’ কিছু বোঝাতে, যা পরলোক বিষয়ে নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অ-ধর্মীয় শিক্ষাও। উনিশ শতকে এসে তা আর একটি নতুন মতে স্থায়ী হল- ‘সেকিউলারিজম বলতে বোঝানো হল সেই মতবাদ যাতে নীতিবোধ শুধু মানবজাতির ইহজীবনের ভালো-থাকার ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে; ঈশ্বর বা পরকালে বিশ্বাস-সংক্রান্ত সব বিবেচনা তার থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই সঙ্গে আর-একটি মতও উনিশ শতক থেকে বেশ জোরদার হয়ে ওঠে। সেটি হলো: শিক্ষা, বিশেষ করে সরকারি খরচে শিক্ষাকে একেবারেই অ-ধর্মীয় হতে হবে।’ ঠিক এই অর্থে সেক্যুলারের ধারণা পেতে গেলে আমাদের দেখতে হবে বিদ্যাসাগরকে- ‘অ-ধর্মীয় শিক্ষাবিদ ও প্রকৃত অ-ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব’। এই অ-ধর্মীয় মানে তিনি যে আস্তিক হতে পারেন না, তা কিন্তু নয়। সেক্যুলারকে যে নিরীশ্বরবাদী হতেই হবে তার কোনও মানে নেই, সেক্যুলারিস্ট আন্দোলনের উদ্যোক্তা জর্জ হোলিওক-কে উদ্ধৃত করেই রামকৃষ্ণ ভট্টচার্য তাই সিদ্ধান্ত টানেন- ‘ঈশ্বরবাদী ও অন্যান্য মতবাদ-নিরপেক্ষ থাকাই তার আসল কথা’। এই হল সেক্যুলারের প্রেক্ষাপট। তবে, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ইত্যাদি যে যে অর্থ ‘সেক্যুলার’ অর্জন করেছে তা তো আর তার গায়ে কেউ বিনিমাগনায় ঝুলিয়ে দেয়নি। মানুষ নিজের ভাবনাতেই এই অর্থ পেয়েছে, ফলত, এহেন অর্থের যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় এবং হতে পারে, তাও অস্বীকার করা যায় না।
এখন, এই সেক্যুলারিজমের চর্চা ও রক্ষা নিয়ে যখন এত কথাবার্তা, তখন আশিস নন্দী গোটা একখানা প্রবন্ধের নামই রাখলেন ‘অ্যান অ্যান্টি সেকুলারিস্ট মেনিফেস্টো’। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিরোধী! দেখে খটকা লাগারই কথা। এই যে আধুনিক রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করল, এই ভেবে যে, ‘সমাজপ্রগতির অপরিহার্য শর্তগুলি’ প্রযুক্ত হলে ধর্মে অবিশ্বাসী বর্গ ভারি হবে, তার বিরোধিতা কোন যুক্তিতে! রাষ্ট্রিয় আধুনিকতার এ প্রস্তাব আসলে মন্দ নয়, তবে এর জন্য যে সহিষ্ণুতা দরকার, অন্তত ব্যক্তিক স্তরে, তা ‘তাদেরই আয়ত্তাধীন যারা কিছুটা পশ্চিমী শিক্ষায় শিক্ষিত এবং আধুনিকতা, বিশেষ করে রাজনীতির আধুনিক প্রকাশরীতির সঙ্গে পরিচিত।’ এ বড় ভালো কথা। তবে সবটা যে হয়ে উঠল, তা নয়। ভারতবর্ষের মতো বহু ধর্মের দেশে এই বর্গ ভারি হয়ে ওঠা বেশ মুশকিলের বিষয়। তা একেবারেই অকৃতকার্য বললে সত্যের অপলাপ, তবে তার সঙ্গেই ক্রমে দেখা দিতে শুরু করল এর জ্বরজ্বালা- ‘প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এখন সংস্কৃতিগুলির রাজনীতি সম্পর্কে পুরোপুরি অনুভূতিহীন। তার চোখে ধর্মবিশ্বাসীরা অপকৃষ্ট রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিবিশেষ, এবং তার ব্যাখ্যা অনুসারে, আমরা ক্রমশই এমন এক বিশ্বে প্রবেশ করছি যেখানে আধুনিকত্ব ছাড়া আর সমস্ত বিশ্বাস ক্রমশই ক্ষয়িত হচ্ছে।’ এই বেধে গেল গোলমাল। যে সংস্কার হওয়ার কথা ছিল তা যেন খাপছাড়া হয়ে উঠল দিনে দিনে। ফলত একদিকে আধুনিকত্বের রূপ, তার ক্ষমতা অর্জন। অন্যদিকে ধর্মের প্রকট রূপ। ফলস্বরূপ দেখা গেল দুটি জিনিস- এক, ‘গণতন্ত্রীকরণ ও রাজনীতিকরণ ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত করেনি, বরং সেগুলি ধর্মের বিধর্মিবিদ্বেষী ও গণতন্ত্রবিরোধী রূপগুলিকে নতুন ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে।’ এবং দুই, ‘ভারতীয় রাজনীতি এখন উভয়সংকটে: ধর্মের খারাপ দিকগুলো রাজনৈতিক অভিব্যক্তি পেয়েছে, কিন্তু তার শক্তির দিকগুলো রাজনৈতিক জীবন থেকে দুর্নীতি আর হিংসা দূর করার কাজে আর পাওয়া যায় না।’ এই যে উদ্ভূত পরিস্থিতি এর মধ্যেই আমরা নিজেদের দিব্যি দেখতে পাই। আধুনিকতার জোর এবং ক্ষেত্রবিশেষে গা-জোয়ারি আর ধর্মের ঐতিহ্যের মধ্যে সংঘাত আদতে যে চার ধরনের রাজনৈতিক অভিঘাত জাগিয়ে তুলেছে বলে মনে করেন আশিস নন্দী – প্রতীচ্য মানব, পাশ্চাত্যভাবাপন্ন নেটিভ, ধর্মীয় কট্টরপন্থী এবং প্রান্তীয় মানুষ – সেই অভিঘাত বহন করেই আমরা চলেছি। এবং আজ যে ঠোকাঠুকি লেগেছে, তা মূলত এই প্রথম তিন বর্গের মধ্যে। সেক্যুলার হিসাবে পরস্পরকে বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং নিজেদের অবস্থান চেনানোর দায় তাঁরাই অনুভব করছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই যে অন্য ধর্মকে প্রবল ঘৃণা করেন, এমন নয়। আবার নিজের ধর্মের গোঁড়ামিগুলোকে লালন করেন, তাও নয়। কিন্তু সনাতন আর আধুনিকের দ্বন্দ্ব আর সেই সূত্রে ইতিহাসের চলন তাঁদের এমন কবজা করে ফেলেছে যে, আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা প্রায় পরস্পরবিরোধী মতের স্থানাঙ্কে বাস করছেন। সাম্প্রদায়িক অশান্তির বেশিরভাগ উদাহরণ তাই এই বর্গ থেকেই।
অথচ সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না, এ আমাদের চেনা কথা। এমন নয় যে প্রতিবেশীর মধ্যে বিরোধ-ঝামেলা কস্মিনকালে ছিল না। ছিল, কারণ তা স্বাভাবিক। দুই বর্ণের মধ্যেও বিরোধ ঘটে, এবং সে ইতিহাস শুধু ভারতবর্ষে নয়, ইউরোপেও আছে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার যে সংগঠিত রূপ, তার চরিত্র প্রতিবেশীর বিরোধ থেকে অনেক আলাদা। ব্রিটিশ আমলে যখন এই চেহারার প্রকাশ দেখা গেল – যেখানে ধর্মান্ধতার সঙ্গে জোট বাঁধল রাজনীতি – তখন সঙ্গত প্রশ্নই উঠেছিল যে, দীর্ঘদিনের শত্রুভাব কি একদিনে বাঁধ ভাঙল! নাকি হিন্দু ও মুসলমান যে পরস্পরের শত্রু তা খুব সংগঠিত উপায়ে ভাবিয়ে তোলা হল! পরাধীন ভারতে সাম্প্রাদায়িক অশান্তি যে নতুন চরিত্র পেয়েছিল, তার ফল ফলেছিল পরবর্তী ইতিহাসে। সে আমাদের জানা কথা। এবং তার পরেও স্বাধীন দেশের সাম্প্রদায়িক অশান্তির কার্যকারণ সবই প্রায় নখদর্পণে। আজকের তথ্যপ্রতুল, ফ্যাক্ট চেকের সময় চোখ খোলা রাখলেই চাঁদের এপিঠ, ওপিঠ দুই-ই দেখা যায়। এর পরেও যে প্রশ্নের চড়কগাছে বাঁধা হয় সেক্যুলারকেই, তার কারণ তাই খতিয়ে দেখা জরুরি।
দেখা যাবে, উনিশ শতকের বাঙালি নতুন আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে যে সেক্যুলার-চর্চা শুরু হয়েছিল, পরবর্তীতে আধুনিক রাষ্ট্র যে অর্থে সেক্যুলারিজমের চর্চা করতে চাইল, তা ক্রমশ বদলে বদলে গিয়েছে। সে কারণেই আমরা নিজেদের মতো করে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুবাদ করে নিয়েছি। সেই জায়গা থেকে তৈরি হয়েছে নিজস্ব সেক্যুলারিজম। এবং এখানেই আমাদের ফিরে তাকানো জরুরি ‘প্রান্তীয়’ সমাজের দিকে। সাধারণ মানুষের সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকার ইতিবৃত্তে। সুরজিৎ দাশগুপ্ত ‘অবিকল ইতিহাস’ স্মরণ করিয়ে আমাদের একটা কথা মনে করিয়ে দেবেন, তা হল শাসক হিন্দু হোন বা মুসলমান, শ্রেণিগত ভাবে কে কেমন সুবিধা পেয়েছে- ‘মুসলমান সুলতানের শাসনাধীন অঞ্চলে শ্রমজীবী বা কৃষক-কারিগর শ্রেণীর মুসলিমরা পায়ের উপর পা তুলে আরামে থেকেছে আর হিন্দুরা খেটে খেটে মুখের রক্ত তুলেছে এমন নজির আছে কি? আবার হিন্দু রাজার অধীনে হিন্দু চাষাভুষোরা লাঠি ঘুরিয়েছে আর মুসলিমরা বুকে হেঁটে বেঁচেছে এমন দৃষ্টান্ত আছে কি? এমন নজির বা দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই। বরং দেখা গেছে যে অবস্থাপন্ন হিন্দু সমাজ মুসলিম শাসকের অধীনেও অবস্থাপন্নই থেকেছে এবং অবস্থাপন্ন মুসলিম সমাজও হিন্দু শাসকের অধীনে সমান সৌভাগ্যবানই থেকেছে। অর্থাৎ ধর্মীয় কারণে কোনও বিশেষ সমাজই নিজের নিজের শ্রেণীগত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়নি কিংবা শ্রেণীগত দুর্দশার থেকে মুক্তি পায়নি। সাম্প্রদায়িক বা পরধর্মদ্বেষী বলে যারা ভারতীয় ইতিহাসে কুখ্যাত হয়েছে তারাও অবস্থাবান পরধর্মীদেরকে বেগার গতর খাটায়নি অথবা দুর্দশাগ্রস্ত স্বধর্মীদের অবস্থা পালটে দেয়নি। সোজা বাংলায় ব্যাপারটা এই যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ভাগ্যবান শ্রেণী ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকের অধীনেও ভাগ্যবান শ্রেণী হিসেবেই থেকেছে ও শাসকের ধর্মাবলম্বী ভাগ্যহীন শ্রেণী কখনই রূপান্তরিত হয়নি ভাগ্যবান শ্রেণীতে- যেখানে ধর্মীয় কারণে শ্রেণিগত অবস্থার হেরফের হয়নি সেখানে ধর্মীয় উপকরণের তাৎপর্য নিঃসন্দেহে গৌণ।’ এই শ্রেণি-সুবিধা যাঁরা পেয়েছেন, বলা যায়, তাঁরাই পরবর্তীকালে নতুন আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়েছেন, আধুনিকতা চেয়েছেন, সেই সূত্রে সেক্যুলারিজমের চর্চা করেছেন, এবং তা কী কী রাজনৈতিক অভিঘাত থেকে আমাদের কোন অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে, তা-ও স্পষ্ট। আজকের সংকট তাই এই শ্রেণিরই। এর বিপ্রতীপে আছে সেই বিপুলসংখ্যক মানুষ, যাঁরা সেদিনও সুবিধা পান না, আজও পান না। তাঁরা লড়েছেন নিজেদের বাঁচার লড়াই, নিজেদের মতো করে। এবং সেইহেতু কবির মতোই নিজেদের বর্ম অর্জন করে নিয়েছেন।
এই প্রান্তীয় মানুষের বিশ্বাসের কাছে ফেরা এই জন্য জরুরি, কারণ, তাঁরা যে লড়াই লড়তে জানেন, সেই লড়াই শেখেনি এই তথাকথিত শিক্ষিত আধুনিক সুবিধাভোগী শ্রেণি। আশিস নন্দী বলেন, ‘এরা প্রান্তীয় শুধুমাত্র এই কারণেই যে কট্টরপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী উভয়পক্ষই এদের এই নামেই অভিহিত করে থাকে। এই বিশ্বাসীরা জানে কীভাবে কট্টরপন্থীদের সঙ্গে লড়াই চালাতে হয় এবং সেই সঙ্গে অন্য ধর্মের বা তার নিজের ধর্মেরও কট্টরপন্থীদের সহ্য করে বেঁচে থাকতে হয়। আধুনিক ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদী বা গুপ্ত-আধুনিক কট্টরপন্থী- এরা উভয়েই অন্য মতের কট্টরপন্থীদের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার কৌশলটা জানে; যেটা জানে না তা হল নিজেদের মতের কট্টরপন্থীদের সঙ্গে অন্য লড়াইটা। না ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, না কট্টরপন্থী- এদের কারোরই টিকে থাকার এই অন্য লড়াইটাকে প্রত্যক্ষ করার মতো সংবেদনশীলতা নেই। বিভিন্ন ধর্মমতের প্রান্তীয় বিশ্বাসীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে যা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে সেই প্রতিবেশীয় বন্ধন ও সুখেদুঃখে একসাথে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতার স্মৃতিকে লালন করার অবসর এদের কারোরই নেই।’
ঠিক এইখানে এসেই ঠেকে গিয়েছে সেক্যুলারের বর্তমান পানসি। ঠিক পাশের মানুষটি যিনি সেক্যুলারিজমে সন্দেহ প্রকাশ করে ফেলছেন, তাঁকে উপেক্ষা করা কোনও কাজের কথা নয়। বরং এই ঐতিহাসিকতার সূত্রেই দেখে নেওয়া জরুরি যে, কোন অভাববোধ থেকে, স্মৃতি-সত্তার কোন ব্যবধান থেকে তিনি এই অবস্থানে এসে উপনীত হয়েছেন। এবং সেক্ষেত্রে যাঁরা সেক্যুলার বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন ও দিতে ভালোবাসেন তাঁদের দায়িত্ব আরও বাড়ে বই কমে না। সংবিধানে থাকা বা না-থাকা নিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ; তবে যা জরুরি, তা হল ঘরে ও বাইরের লড়াইয়ের অবলম্বন। তা আলটপকা আসে না। আসে ইতিহাসের বিশ্লেষণ থেকেই। ফলত সাধারণের অভিজ্ঞতা এবং অর্জনের কাছে হাত না-পেতে উপায় নেই। আধুনিকতার সূত্রে পাওয়া সেক্যুলারিজমে ষোল আনা যে আর হাতে নেই, তা তো সাম্প্রতিক নানা বিতর্ক থেকে বোঝাই যাচ্ছে। সিকি-আধুলি যা মেলে, তাতে ভারি তুফান পাড়ি দেওয়াও প্রায় অসম্ভব। ফিরতে হবে তাই বড় ইতিহাসের কাছে, বহুকালের মানুষের বেঁচে থাকার অর্জন- প্রকৃত সামাজিক ইতিহাসের কাছে। প্রান্তীয় অভিজ্ঞানের কাছে জীবনরসদ ধার না নিলে আগামীর রাহাখরচ জোটানো যে মুশকিলই হবে, তা আজ না বুঝলে তুফান আরও বাড়বে বই কমবে না। আর সে দায় একজন সেক্যুলার মানুষেরই।
-০-
ঋণ:
১) ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ইস্তাহার, আশিস নন্দী (সেরিবান)
২) বাঙালির নতুন আত্মপরিচয়: সংস্কার থেকে স্বাধীনতা, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (অবভাস)
৩) ভারতবর্ষ ও ইসলাম, সুরজিৎ দাশগুপ্ত (ডি. এম.