
গুলজা়রের কবিতা অনুবাদ-দীপায়ন ভট্টাচার্য
ভারতের অন্যতম বিশিষ্ট ও শক্তিশালী কবি এবং গীতিকার হিসেবে গুলজা়র সাহাবের নাম সকলেরই অতি পরিচিত। বহুমুখী ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন এবং দীর্ঘকাল যাবৎ সম্পৃক্ত থেকেছেন গল্প ও চিত্রনাট্য লিখন, চিত্র পরিচালনার কাজেও। রাহুল দেব বর্মণ এবং বিশাল ভরদ্বাজের সাথে জুটি বেঁধে সৃষ্ট তাঁর গানগুলো ইতিমধ্যেই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগের স্বীকৃত উৎস স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। প্রধানত উর্দুভিত্তিক সাহিত্যচর্চা করলেও হিন্দি ভাষার সাহিত্য ও গানরচনাতেও তাঁর অবদান অসামান্য। গুলজা়র সাহাবের কয়েকটি কবিতার অনুবাদ বাংলা কবিতাপ্রেমীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া হল। কবিতাগুলি নেওয়া হয়েছে মূলত পুখরাজ, রাত পশমিনে কি এবং Neglected Poems গ্রন্থগুলি থেকে।
১)
পুরোনো কবিতার কাছে গেলে
কখনো কখনো অ্যালার্জি হয়
কোনো পুরোনো ভাবনার ধুলো নাকে উড়ে এলে
হাঁচির উপক্রম হয় আর কয়েকদিন ধ’রে
সর্দি লেগে থাকে পুরোনো দিনের
পুরোনো এক ভাবনার দিন যেন মাদারির ঝুড়ি
আর রাত যেন তার ঢাকনা,
ঢাকনা খুলে নিজের উপহাস বের করল বাব্বান
আর গলি দিয়ে চলে গেল
ছোট ছিলাম যখন
মাদারিকে ভগবান মনে হতো
ভগবানকে এখন মাদারি মনে হয়
বড় হয়ে যখন তার উপহাস দেখি
কোনো কোনো কবিতা বের করলে
শুকনো কণা উড়তে থাকে
সেই কবিতা যা শুকিয়ে গেছে
কাগজে প’ড়ে থেকে থেকে
সেই কবিতা যা এইজন্য ছাপাতে দিইনি
যে লোকে চিনে ফেলবে তাকে
এখন ইচ্ছে হয় যে ছাপিয়ে দেখি
সে নিজেকে চিনতে পারে কি না
আমি শ্বাস নিই-
শ্বাসের মধ্যে যখন পুরোনো কবিতার
শুকনো কণাগুলো মিশে যেতে থাকে
আমি গন্ধ পাই সেই লেপগুলোর
যেগুলো গরমকালে রোদে দেওয়া হয়েছিল
যাতে এবার গায়ে দিলে
অতীতের ঘুমের কোনো আর্দ্রতা
তাতে না থেকে যায়
স্বপ্নের কোনো দাগ থাকলে পরিষ্কার হয়ে যায়
ভরপুর এক হাঁচি এসে থেমে যায় প্রতিবার
পুরোনো কবিতার কাছে গেলে
কখনো কখনো অ্যালার্জি হয়।
২)
এমনই মিছিল আমি দেখেছিলাম সাতচল্লিশেও,
এরা গ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটছে, নিজের দেশেই
আমরা আমাদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিলাম, দেশের উদ্দেশ্যে
আমাদের ‘শরণার্থী’ আখ্যা দিয়ে দেশ রেখে দিয়েছিল
আশ্রয় দিয়েছিল,
এদের নিজেদের রাষ্ট্রের চৌহদ্দিতেই থামিয়ে দিচ্ছে
আশ্রয় দিতে বিপদ আছে
আমাদের সামনে পিছনে,
তখনো এক খুনী সময় ছিল
যে ধর্ম জানতে চাইতো
আমাদের সামনে পিছনে
এখনো হাজির এক খুনী কাল
ধর্ম, নাম, জাত কোনোটাই জানতে চায় না-
মেরে ফেলে
ঈশ্বর জানেন, এই বিভাজন বড়
না ওই বিভাজন বড় ছিল।
৩)
এখন যেন মাঝে মাঝে ভুলে যাই আমি তোকে,
তোর মুখটাও ঝাপসা হয়ে আসছে মনছবিতে
বদলাতে শুরু করেছে সকাল-সন্ধ্যের সেই প্রত্যাশা,
যেখানে তোর সঙ্গে দেখা হওয়ার
এক অপেক্ষাও ছিল
তোর চিঠি যখনই আসতো, মনে পড়তো
তোর গলার সুরটাও
কণ্ঠস্বরকে কাগজে লাগিয়ে
পিন আটকে রাখতে চেয়েছিলাম
ঠিক যেমন প্রজাপতিকে কেউ নিজের অ্যালবামে
আটকে রাখে ডানাসমেত
একটু জোর দিয়ে তোর ‘ওই’ বলে ডাকা,
‘ওয়াও’ বলার সময় ঠোঁটদুটোর
নিটোল গোল হয়ে থেমে যাওয়া
অনেকদিন হয়ে গেল দেখা হয়নি,
না কোনো চিঠি এসেছে-
সত্যিই অনেকদিন কেটে গেছে,
তোর কণ্ঠের মুষলধারায় ভিজিনি আমি।
৪)
তোমার পেরিয়ে যাওয়া দিন লনে টাঙানো রয়েছে এখনো
না তা পুরোনো হয়েছে, না তার রঙ চটেছে
কোথাও কোনো সেলাই এখনো খুলে যায়নি
এলাচের একেবারে কাছে রাখা পাথরের উপর
খানিক দ্রুতই ছায়া প’ড়ে আসতে থাকে
আরো খানিকটা বেড়ে উঠেছে এই চারাগাছ
আমি একটু একটু গামলাটা সরাতে থাকি
ফকিরা এখানেই আমাকে কফি দিয়ে যায় এখনো
কাঠবেড়ালিদের ডেকে বিস্কুট খাওয়াই
কাঠবেড়ালিরা আমায় সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে
ওরা তোমার হাতের ছোঁয়া চেনে মনে হয়
কখনো সন্ধ্যের ছাদ থেকে যখন চিল নেমে আসে
ক্লান্ত হয়ে, কিছুক্ষণ লনে দাঁড়ানোর পর
মোসাম্বির সাদা গোলাপি চারাদের মধ্যে মিশে যেতে থাকে
ঠিক যেমন বরফের টুকরো গ’লে যায় হুইস্কির মধ্যে
আমি গলার থেকে দিনের স্কার্ফ খুলে রাখি
তোমার পেরিয়ে যাওয়া দিন গায়ে চাপিয়ে এখনো আমি
তোমার সুবাসে অনেকগুলো দিন কাটিয়ে দিই
তোমার পার ক’রে যাওয়া দিন…
৫)
সেই যে কবি ছিল, চুপচাপ থাকতো
বলা কথাগুলো যার ছিল স্খলিত,
কানে চোখ রেখে শুনতে পেতো
মূক নৈ:শব্দ্যের শব্দ!
জমা করতো চাঁদের ছায়া
আর ভেজা ভেজা আলোর বিন্দু,
শুকনো শুকনো রাতের পাতা
হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘষতে থাকতো
সময়ের এই গহন জঙ্গলে
কাঁচা-পাকা মুহূর্ত কুড়োতো,
হ্যাঁ সেই, সেই অবাক করা কবি
রাতে উঠে কনুইয়ে ভর ক’রে
চাঁদের চিবুকে চুমু খেত
চাঁদ থেকে প’ড়ে মরে গেছে সে
লোকে বলে, আত্মঘাতী হয়েছে।
অনুবাদ
দীপায়ন ভট্টাচার্য