
আলোকের সাধনা (টমাস আলভা এডিসনের জীবন কাহিনি) হোমেন বরগোহাঞি মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
(৮)
টমাস চাকরি পেল, কিন্তু চাকরি বজায় রাখতে পারল না
টেলিগ্রাফ শেখার পরে টমাস খবরের কাগজে ফেরিওয়ালার কাজটা ছেড়ে দেবে বলে ভাবল। আসলে তার ‘উইকলি হেরাল্ড’নামের কাগজটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তার মন ভেঙে গিয়েছিল, খবরের কাগজের প্রতি তার মনে একটা বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছিল। সে এখন টেলিগ্রাফিস্টের চাকরি খুঁজতে শুরু করল। চাকরি পেতে তাকে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না। মাত্র ষোলো বছর বয়সে সে কানাডার গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রেলওয়েতে টেলিগ্রাফিস্টের চাকরি পেল।
কিন্তু চাকরিটা টমাস বেশি দিন ধরে রাখতে পারল না। প্রধানত দুটি কারণে তাকে চাকরি হারাতে হল। প্রথমত, টেলিগ্রাফিস্টের চাকরিটা এমন যে দিনের পর দিন যান্ত্রিকভাবে একই কাজ করে যেতে হয়; তার মধ্যে নিত্য নতুন উদ্ভাবন বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো অবকাশ থাকে না। কিন্তু টমাস চায় নিত্য নতুন কথা জানতে, পরীক্ষা করতে এবং আবিষ্কার করতে। টেলিগ্রাফিস্টের কাজের যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তিতে সেই সমস্ত করার কোনো সুবিধা ছিল না। ফলে চাকরিটাও তার কাছে খুব শীঘ্রই বিরক্তিদায়ক বলে মনে হতে লাগল।
দ্বিতীয়তঃ টমাস ছিল অত্যন্ত সৎ এবং কর্তব্য পরায়ণ মানুষ। ওপরওয়ালার অন্যায় আদেশ পালন করতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ওপরওয়ালাকে সন্তুষ্ট করার চেয়ে কর্তব্য পালনের দ্বারা নিজের বিবেককে সন্তুষ্ট করার ক্ষেত্রে সে বেশি জোর দিয়েছিল। ফলে একদিন টমাস তার নিজের ওপরওয়ালাকে ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট করে তুলল।
একদিন টমাস তার নিজের কাজে ব্যস্ত থাকার সময় একজন পিয়ন এসে তাকে এক টুকরো কাগজ দিল। কাগজটা পড়ে সে দেখল–ম্যাকডোনাল্ড নামের তার একজন ওপরওয়ালা অফিসার একটি জরুরি টেলিগ্রাম পাঠানোর জন্য টমাসকে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু টেলিগ্রামের কথাটা পড়ে টমাস অবাক হল, কারণ সেই কথার সঙ্গে রেলের কাজের কোনো সম্পর্ক ছিল না। রেলের টেলিগ্রাফের মাধ্যমে ম্যাকডোনাল্ড তার স্ত্রীকে একটি ব্যক্তিগত বার্তা পাঠাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে যে টেলিগ্রামটি পাঠানোর কাজে টমাস খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সেটা জনগণের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রেল লাইনের কোনো এক জায়গায় একটা ফিস প্লেট ঢিলা হয়ে খুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। টেলিগ্রাম করে ইঞ্জিন ড্রাইভারকে সতর্ক করে না দিলে বড়ো দুর্ঘটনা হওয়ার আশঙ্কা আছে। টমাস পিয়নটিকে স্পষ্টভাবে বলে দিল যে সেই জরুরি টেলিগ্রামটা পাঠানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে অন্য কারও টেলিগ্রাম পাঠাতে পারবে না।
পিয়ন কিছুক্ষণ পরে পুনরায় ফিরে এসে টমাসকে বলল যে ম্যাকডোনাল্ড টমাসকে তখনই তার অফিসে ডেকে পাঠিয়েছে। টমাসের বুঝতে বাকি রইল না যে ওপরওয়ালা তার ওপরে অসন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু তা বলে সে বিন্দুমাত্র ভয় পেল না। বরং পিয়নের মাধ্যমে সে ওপরওয়ালা অফিসারকে এই বলে খবর পাঠাল যে নিজের কাজ শেষ করার পরে সে অফিসারের সঙ্গে দেখা করবে।
সামান্য অধীনস্থ কর্মচারী একজনের এতটা স্পর্ধা! টমাস যখন ম্যাকডোনাল্ডের সঙ্গে দেখা করতে গেল তখন ম্যাকডোনাল্ড তাকে শুধু মারধর করতে বাকি রাখল। তর্জন গর্জন করে তিনি টমাসকে বললেন–’সামান্য একজন অধীনস্থ কর্মচারীর এতটা অবাধ্যতা আমি সহ্য করব না। এই মুহূর্তে আমি তোমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলাম।’
ম্যাকডোনাল্ডের কথা শুনে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে টমাস শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল–’আমার অপরাধ কোথায় সে কথা আমি জানতে পারি কি স্যার?’
ম্যাকডোনাল্ড আগের চেয়ে দ্বিগুন ক্রোধে বললেন–’অপরাধ? তুমি আমার আদেশ অমান্য করেছ; তুমি এই কথা ভুলে গেছ যে আমার আদেশ পালন করাটাই হল তোমার সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য। এর চেয়ে বড়ো অপরাধ আর কি হতে পারে?’
‘কিন্তু আমি ভেবেছিলাম যে কাজের জন্য আমাকে এখানে বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে সেই কাজ করাটাই আমার সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য।’–টমাস পুনরায় শান্তভাবে বলল। তারপর সে পুনরায় বলতে শুরু করল–’আপনি একবারও এ কথা চিন্তা করে দেখেননি যে কাউকে যদি চাকরি থেকে বরখাস্ত করতেই হয়, তাহলে আমাকে নয়, আপনাকেই বরখাস্ত করা উচিত। আসল অপরাধী কে? আমি আমার কর্তব্যে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে থাকার সময় আপনি রেলের টেলিগ্রাফের মাধ্যমে আপনার ব্যক্তিগত বার্তা পাঠানোর জন্য আমাকে আদেশ করে একটা বড়ো অপরাধ করেননি কি? চাকরি থেকে বিতাড়িত হতে হওয়ায় আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই, কারণ আপনার মতো অভদ্র এবং বিবেকহীন মানুষের অধীনে চাকরি করার করার চেয়ে বেকার থাকাটা অনেক ভালো।’