
জীবন দিয়ে জানার শিক্ষা
রূপশ্রী ঘোষ
একজন শিক্ষক হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে জীবনের অভিজ্ঞতা ঠিক কী শেখায়? একজন শিক্ষকও চিরন্তন এক ছাত্র। সেই প্রেক্ষিত থেকেই এই লেখা।
শিক্ষা এবং শিক্ষক দুটো শব্দ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যিনি শিক্ষা দেন তিনিই শিক্ষক। তা বাচ্চা থেকে বুড়ো যে কেউ হতে পারেন। যিনি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখান তিনিই শিক্ষক। কেবলমাত্র ‘শিক্ষক’ নামের চাকরির পোস্টটা নয়। আমরা তো অনেকের থেকেই অনেককিছু শিখি। ভালো খারাপ যাই শিখি না কেন, যাঁর থেকে শিখি তিনিই শিক্ষক। জীবনে চলার পথে পড়াশুনো ছাড়াও নানান শিক্ষা হয়। ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাটাও শিখিয়ে দিতে হয়। কেবল নম্বর পাওয়াটা নয়। এখন যেমন শোনা যাচ্ছে আর জি করের ওই প্রাক্তন প্রিন্সিপাল নাকি ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলেন। ফার্স্ট বয় যখন, তখন তিনি ঝুড়ি ঝুড়ি নম্বর পেয়েছেন। কারণ তাঁর যুগে অমন টাকা দিয়ে নম্বর পেয়ে ডাক্তার হওয়া যেত বলে তো মনে হয় না। পড়াশুনোয় খুব ভালো না হলে জয়েন্ট এন্ট্রান্সই তো পাশ করা সম্ভব ছিল না। তো তিনি তাঁর যুগে নিশ্চয়ই এ সমস্ত গেট পার করেই ডাক্তার হয়েছেন। এত সব জানা সত্ত্বেও তিনি, ডাক্তারি শিক্ষার ভূমিকায় ক্ষমতা পেয়েই পুরো বদলে গেলেন। তাঁর নামে যা শোনা যাচ্ছে, ওখানে টাকা দিয়ে অনার্স পাওয়া যেত, টাকা দিয়ে পাশ করা যেত, টাকা দিয়ে আরো অনেককিছু। এটাই বর্তমানের হট কেক। তাহলে কি একজন ভালো ছাত্র বা ভালো শিক্ষক ক্ষমতা পেলে বদলে যেতে পারেন? ক্ষমতা তাঁকে অশিক্ষক বা অমানুষ করে দিতে পারে? এটা কিন্তু ভয়ের এবং ভাবার বিষয়। অর্থাৎ ক্ষমতার দোষ নাকি সেই ব্যক্তিটির? মানে যেকোনো মানুষই কি তাহলে ক্ষমতা পেয়ে এমন সুবর্ণ গোলক পাওয়ার মতো বদলে যেতে পারেন? তাহলে তো কাজের সদিচ্ছা থাকলেও গোলক হাতে নিতে ভয় পাবেন। খুব সচেতন ব্যক্তি তো তাহলে সবসময়ই ক্ষমতা নিতে এড়িয়ে যাবেন। এমন বহু মানুষ ক্ষমতা হাতে নিতে চান কেবল বস্তাপচা সিস্টেমের জগদ্দল পাথর বদলে দেওয়ার জন্য। যদি ক্ষমতা তাঁকে বদলে দেয় তাহলে তো ঘুণ ধরা নীতিতে ঘুণ আরও বাড়তে বাড়তে অবশেষে নীতিটাই শেষ হয়ে যাবে। শুভ উদ্দেশ্যও সফল হবে না।
এমন অনেক সময় মনে হতেই পারে যে, ক্ষমতাটাই যত নষ্টের গোড়া। কারণ আপানার চেনা মানুষকে নিমেষে বদলে যেতে দেখে এটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে আবার সবসময় ক্ষমতা নামক জড়পদার্থকে দায়ি করাটাও ঠিক নয়। চারপাশে সত্যিই এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা ক্ষমতা নিয়ে অনেক ভালো কাজ করেছেন। আবার এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা কেবল ক্ষমতাটা নিতে চান তার অপব্যবহার করবেন বলেই। তাঁদের নাম মানে পোস্টের নাম শিক্ষক, সচিব, ভাইস চ্যান্সেলর বা উচ্চপদস্থ যেকোনো পদেরই অধিকর্তা হতে পারেন। তাঁরা কী শিক্ষা দেন? ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও…’। উঁহু! মোটেই না। তাঁরা কেবল মনগড়া কিছু নিয়ম তৈরি করেন। ধরুন যে নিয়ম সরকারেরও অজানা। যদি সরকারি চাকরি হয়। কর্পোরেট নিয়ে এখানে কোনো কথা নেই। যতদূর জানি তাঁরা কাজের ব্যাপারে খুবই প্রফেশনাল। কাজ কাজ ভান সেখানে থাকে না। সেখানে ডিসিপ্লিনই সব। যে টাইমে কাজ বা মিটিং নির্ধারণ করা হয় সেই টাইমেই শুরু বা শেষ হয়। শেষ নির্ধারিত টাইম সামান্য অতিক্রম করলেও করতে পারে, কিন্তু শুরুর টাইম তো একেবারেই নয়। যাকগে সেসব কথা। সরকারি চাকরিতে যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তাঁরা কাউকেই পরোয়া করেন না। এটা বেশকিছু স্কুল, কলেজ, অফিসের চাকুরেদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানা। নিজেরা কিন্তু কোনো নিয়মের মধ্য দিয়েই যান না।
একই দুঃখ, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ নিয়ে। কিন্তু কে কাকে বলবে, আর কেই বা কার কথা শুনবে? সবই শিক্ষা। এগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া ছাড়া যেন আর কিছু করার নেই। সবারই কেমন একটা হাত পা বাঁধা। অসহায়। উপায় একটাই যেকোনো শিক্ষা থেকেই ভয় না পেয়ে রাত-দিনের দখল নেওয়া। তাতে যদি একটু হলেও কিছু উপকার হয়। কারণ এই সরকারি কর্মক্ষেত্রের ক্ষমতায় থাকা কর্মীরাই কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত হাজির না থেকেই কর্মক্ষেত্রে উন্নতির স্বপ্ন দেখেন। আর যেকোনো অনুষ্ঠানে মাইকের সামনে অমাইকভাবে উন্নতির ভাষণ দিয়ে যান।
তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে, ক্ষমতা মানে সবার উপর ছড়ি ঘোরানো, স্বৈরাচারী কথা বলা, সহকর্মীদের অপদস্থ ও অপমান করা, সহকর্মীদের সামনে ভালো ভালো কথা বলে তাদের পিছনেই আর একটু বড়ো ক্ষমতার কাছে মিথ্যে কথা নালিশ করা, বা মুহূর্তে ‘হয় কথাকে নয়’ করে দেওয়া। যেকোনো কর্মক্ষেত্রেই এটা সবাই বুঝতে পারেন। ক্ষমতার পিছনে তাঁকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করেন, তাঁর নামে বদনাম করেন, তিনি কতটা অপদার্থ তাও বোঝেন। কিন্তু সমস্বরে প্রতিবাদ করতে ভয় পান। কিন্তু কেউ যদি একা প্রতিবাদ করে তখনই মুশকিল হয়ে যায়। একটি প্রতিবাদী কন্ঠস্বর মানেই তো সর্বোপরি গুণ্ডা দিয়ে তাকে রেপ করিয়ে খুন করিয়ে দেওয়া বা খুন করিয়ে রেপ করিয়ে দেওয়া। এগুলো সবই কিন্তু শিক্ষা। আপনি সমাজ থেকেই শিখছেন। এই শিক্ষা ব্যাপারটা সাবজেকটিভ। আপনি এটা ভালো শিক্ষা হিসেবে নেবেন নাকি খারাপ সেটা আপনার ব্যাপার। যাঁরা এটা করেছেন তাঁরা তো উচিত শিক্ষা দিচ্ছি ভেবেই করেছেন। অতএব সমাজ থেকে আপনি এটাও শিখলেন।
এখন প্রশ্ন তাহলে কোনো একজন চেনা মানুষ, যাঁকে আপনি অন্যরকমভাবে চিনতেন তিনি ক্ষমতায় গিয়েই অমন বদলে যাচ্ছেন কেন? তাহলে কি এটা তাঁর জীবনের অবদমিত ইচ্ছা? যে, ইচ্ছা তিনি সারাজীবন অবদমন করে রাখেন এবং ক্ষমতার অপেক্ষায় থাকেন? ক্ষমতা পাচ্ছি না তাই, পেলেই প্রয়োগ করে দেব?
আজকাল ব্যক্তিস্বর প্রকাশেও ভয় পেতে হয় ক্ষমতার কাছে। কারোর কোথাও কোনো স্বাধীনতাই নেই। ধরুন একজন ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যে লেখালেখি করেন, তিনি তো তাঁর ভাবনাই লিখবেন। কিন্তু সেই ভাবনা যদি অপেক্ষাকৃত উচ্চপদের কারো বিরোধী হয়ে ওঠে, তবে তাকে আক্রমণ করা হবে, তার বই পুড়িয়ে দেওয়া হবে, তার লেখা বিভিন্ন কাগজে প্রকাশ করা বন্ধ করা হবে, তার পাঠকদেরও উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী আসবে। অর্থাৎ সেই লেখককে প্রায় একঘরে করে ফেলা হবে। তার চেয়েও বাড়াবাড়ি যদি কেউ করে, তবে তাকে কলবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশের মতো মেরে ফেলা হবে। ভারভারা রাওয়ের মতো অন্তরীন করে রাখা হবে। স্ট্যান স্বামীর মতো মেরে ফেলা হবে। এই একই কাজ হতে পারে আপনার কর্মক্ষেত্রে কিংবা আপনার বাসস্থানেও। চোখরাঙানি। এটিও একপ্রকার শিক্ষা। এ লেখা যদি কারোর আয়না হয়ে যায়, তাহলে আমার কী করার থাকে বলুন তো। এটা আমারও স্বর। অতএব এগুলোও শিক্ষা। পরিবেশের চারপাশ থেকেই পাচ্ছেন। অর্থাৎ আপনি প্রতিনিয়তই শিখছেন। এটাই নিয়ম। শেখার কোনো বয়স নেই। যখন খুশি, যার কাছ থেকে খুশিই শিখতে পারেন। প্রয়োগ করবেন কিনা ভেবে দেখবেন।
তবে এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে নম্বর পাইয়ে দেওয়া কি আজকের কথা? মনে হয় না তা নতুন। আমার মতো অনেকরই নম্বর পাইয়ে দেওয়ার নীতি নিয়ে কম-বেশি অভিজ্ঞতা আছে। আমি কলকাতার এক বহুল পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েছি। সেখানে শুরুতে এই নম্বর পাইয়ে দেওয়া ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারিনি। ছিল কিনা সে বিষয়েও মাথা ঘামাইনি। নতুন নতুন ভর্তি হয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রাজুয়েশন শেষ করে চলে গিয়েছিলাম। দু বছর পরে যখন এম এ পড়তে এলাম তখন দেখি চিত্রটাই বদলে গেছে। ওখানে এসেই নতুন একজন মাস্টারমশাইয়ের পড়ানোর ধরন খুব পছন্দ হয়েছিল। তিনি ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব এসব পড়াতেন। স্যারের কাছে ক্লাসের ফাঁকেও না বুঝতে পারা পড়া নিয়ে যেতাম, তিনি ডাউট ক্লিয়ার করে দিতেন। একজন মাস্টারমশাই ছিলেন তাঁর কাছে কোনো রেফারেন্স বইয়ের নাম জানতে গেলেও দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেন। আমি, আমার বন্ধুরা অনেকবার অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছি। তিনি খুব নামকরা টিচার। বেশ পরিচিত মুখ। তারপর ওই ভাষাতত্ত্বের মাস্টারমশাইয়ের কাছে জানতে পারলাম যে, এখন যদি তুমি পোষ্য কন্যা বা পোষ্য পুত্র বা পোষ্য অন্যকিছু হও তাহলে সহজেই সব সুবিধা পাবে। অতএব এটা এখনকার কথা না। এখন ধরনটা একটু বদলে টাকা পয়সা ও যৌনতা যোগ হয়ে গেছে। বলা যায় সেই অবদমিত মনোভাবের ধরন চেঞ্জ হয়েছে মাত্র। এখন এটাই সর্বত্র চলছে ‘লাইনে’ থাকো, নাহলে কিছুই হবে না। ওসব সততা, ভালো রেজাল্ট এসবের যুগ আর নেই। এসব শিক্ষকরাই বলে দেন। মানে যাঁরা শিক্ষক পদে নিযুক্ত।
তাহলে কাদের শিক্ষক বলব? এসব যাঁদের থেকে শিখছি নাকি যাঁদের থেকে জীবনেরও পাঠ নিচ্ছি তাঁদের? আমার ঠাকুমার থেকেও অনেক শিক্ষা পেয়েছি। তিনি কিন্তু গৃহবধূ ছিলেন। শিক্ষক নামের চাকরি তাঁর ছিল না। আমার জীবনে দেখা শিক্ষক বলতে যাঁদের ভাবি। প্রথম শিক্ষক আমার ঠাকুমা। জীবনে ভালোভাবে চলার সমস্ত পাঠ মনে হয় ঠাকুমার থেকেই পাওয়া। কতটা নিতে পেরেছি বা প্রয়োগ করি সেটা আলাদা কথা। কিন্তু তিনি তাঁর কাজটা প্রতিদিন করতেন। ঠিক ভোর পাঁচটা থেকেই শুরু হয়ে যেত নাতি নাতনিদের ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙানো। ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়াটাই শেষ কাজ না, তারপর বারান্দা জুড়ে একের পর এক বিছানা তোলার সময় একটার পর একটা ছড়া, প্রবাদ বলে যাওয়া। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, আমি যেন সারাদিন ভালো হয়ে চলি। আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে, সেই কাজ আমি যেন করি ভালো মনে’। ‘ পারিব না কথাটি বলিও না আর/ একবার না পারিলে…’। এরপর ‘কাজ সেরে বোসো/ শত্রু মেরে হাসো’। এভাবে চলতেই থাকত। ঠাকুমার বলা এই বাক্যগুলো সবই কেমন অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতাম। বাড়ির বা পাড়ার কেউ যদি কোনো কাজ বলত, কখনো বলতে পারতাম না যে, না, করে দেব না। কাজটা ঠিক করে দিতাম। কাজ বলতে এমনকিছু না, হয়তো দোকান থেকে তেলটা নুনটা এনে দেওয়া। বড়োদের পাকাচুল বেছে দেওয়া, পা টিপে দেওয়া বা আরও এই ধরনের ছুটকো ছাটকা কিছু। সবার কাছেই যেন ভালো হওয়ার একটা তাগিদ থাকত। ভয়ও থাকত। কথার অন্যথা করতে ভয়ই পেতাম। মাকে তো খুবই ভয় পেতাম। মায়ের বড়ো বড়ো চোখ সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াত। একটু লুকিয়ে তেঁতুলমাখা খাওয়াতেও মনে হত এই বুঝি মা দেখে ফেলল, তারপরেই শুরু হয়ে যাবে বকা বা মার। টিভি দেখার কথা তো ভাবতেই পারতাম না। প্রশ্রয় পেয়েছিলাম বাবার কাছে। বাবা কোনোদিন বকেছিলেন কিনা তাও মনে পড়ে না। আদরটাই বেশি পেতাম। কিন্তু তা বেশিদিন পাওয়ার সুযোগ হয়নি। খুব ছোটো বয়সেই…। যাহোক দাদারা চিরকাল বকাঝকা করেছে, ভালোওবেসেছে অত্যন্ত। কিন্তু সেসব বকায় স্নেহ মিশে থাকত। বকা মানে কিন্তু ওই ‘সবটাই তোর ভালোর জন্যই বকছি’ টাইপের। যেটা আমরা এখন অভিভাবকের ভূমিকায় সবাই করে থাকি। তবে সারাজীবন ভয় নানাভাবে শিক্ষা দিয়ে চলেছে। ছোটোবেলায় ভয় পেয়েছি, প্রাইভেট টিউটরের। একা পেলেই ঝামেলা করার চেষ্টা করত। বোনকে এবং আমাকেও। নিজের ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সাবধান হয়েছিলাম। বোনের ব্যাপারটা জানার পর তাকেও প্রটেক্ট করার জন্য তার পড়া শেষ না হওয়া অবধি বসে থেকে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। এই ঘটনা দাদাদের কোনোদিন বলিনি, সাহস হয়নি। বললে কী হবে বুঝতে পারতাম না বলে। সেও এক ভয়। বললে যদি পড়াটাই ছাড়িয়ে দেয়। তাই আর বলা হয়নি। কিন্তু এঁদের শিক্ষক বলা উচিত কিনা জানা নেই। এমন অনেক শিক্ষক নামের মানুষকে পরবর্তী জীবনে দেখেছি। আমার এক বন্ধু তার পিএইচডিটাই কমপ্লিট করতে পারল না। বা এমন আরও অনেক শিক্ষককে কাছ থেকে দেখেছি, বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি মেসেজ বা ফোনের মাধ্যমে তাঁদের কুপ্রস্তাব প্রকাশের কথা। ‘শিক্ষক’ নামের মানুষ আর প্রকৃত শিক্ষক দুটোর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ আছে। আমার হাইস্কুল জীবনের এক ইংরেজির শিক্ষককে দেখেছিলাম, এক স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়ে আমাদের স্কুলে এসেছিলেন, পরে আমাদের স্কুল থেকেও বিতাড়িত হতে হয়েছিল। আজ শিক্ষক দিবসে হয়তো সকলেই শুভেচ্ছা পাবেন। কিন্তু সবাই তা ডিজার্ভ করেন কিনা নিজেরাই বিচার করে নেবেন। যেমন আমার ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই একজন শিক্ষককে আমি খুব ভালো শিক্ষক হিসেবে জানতাম। কিন্তু কাল আমারই এক সহকর্মীর কাছে জানতে পারলাম তিনি শিক্ষক হিসেবে ভালো তো ননই এমনকি মানুষ হিসেবেও খুব খারাপ। এরকম আমাদের চেনা বহু মানুষ আছেন যাঁদেরকে আপনি হয়তো খুব ভালো শিক্ষক বা মানুষ হিসেবে চেনেন কিন্তু তাঁকে যাঁরা খুব কাছ থেকে চেনেন, তাঁদের কাছ থেকে সেই মানুষটা সম্পর্কে যখন তাঁর খারাপ দিকের পরিচয় পাবেন তখন আপনার ভাবনার উপর হতাশা জন্মাতে পারে। আপনার মনে হতে পারে, আপনি নিজেকে ঠিকমতো চেনার শিক্ষাটাই এখনও পাননি। নিজেকে চেনার শিক্ষাটাও অর্জন করতে হয়। যদিও ‘আপনাকে চেনা’ কখনই ফুরোয় না।
শিক্ষক অর্থাৎ জীবনে চলার পথে এমন কিছু মানুষ, যাঁদের থেকে সত্যিই কিছু শেখা যায়। যাঁদেরকে জীবনে আদর্শ ভাবা যায়। এমন মানুষ আমরা অনেকেই পেয়েছি। তাঁদের চিরকাল আমরা এমনিই মনে রাখব। ঘটা করে আলাদা একটা দিন শিক্ষক দিবস হিসেবে নয়। যাঁরা সত্যিই ভালো মানুষ তাঁরা সত্যিই ভালো শিক্ষক। শিক্ষক একটা চাকরির পোস্ট হতে পারে কিন্তু কোনো ভালো মানুষ তৈরি করতে পারেন না, তিনি নিজে যদি ভালো মানুষ না হন। তাই আগে দরকার ভালো মানুষ হওয়া। তাহলে বলা যায় একজন শিক্ষক আর একজন ভালো মানুষ একে অপরের পরিপূরক নয়। অনেক ভালো মানুষ আছেন যাঁরা শিক্ষক পদে চাকরি না করেও ভালো শিক্ষক। যাঁর থেকে ভালো কিছু শেখা যায়। আবার এমন অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা শিক্ষক পদে থেকেও খুব খারাপ মানুষ। শিক্ষা দেওয়া বা কীভাবে শেখানো যায় সেই পদ্ধতির ভালো খারাপের কথা এখানে হচ্ছে না। এখানে মানুষ আর শিক্ষক পদের কথাই তুলনীয়।
তবে আমি জীবনে অনেক ভালো ভালো শিক্ষক, বন্ধু এবং ভালো মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। তবুও বলব আমার জীবনের সব থেকে বড়ো শিক্ষক আমার জীবন নিজেই। জীবনের চলার পথ। যেখানে প্রাপ্তি হিসেবে আছে অসম্মান, অপমান, অপ্রাপ্তি, ঘৃণা, আঘাত, অবহেলা ইত্যাদি প্রভৃতি। তাবলে কী ভালোবাসা একেবারেই নেই? এটা অস্বীকার করলে তো সবই মিথ্যে হয়ে যায়। আছে, পর্যাপ্ত পরিমাণ ভালোবাসা, স্নেহ এবং শ্রদ্ধা। আজ সকাল থেকে বহু ছাত্রছাত্রী, বহু মানুষের থেকে শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা পেয়েছি। ভালো মন্দ মিশিয়েই জীবন। এই পাওয়াগুলো তো নাহলে সব মিথ্যে হয়ে যায়। শুভ হোক শিক্ষক দিবস। আমার সমস্ত শিক্ষক, শিক্ষক বন্ধু, সহকর্মী, জীবনের সকল স্তরেই যেখানে যার থেকে যতটুকু শিখেছি সেই সমস্ত শিক্ষকের জন্যই রইল আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।