
জীবনানন্দ ক্রোড়পত্র– সোমা দত্ত
নাটোরের বনলতা
১৯৪২ সালে এক পয়সা মূল্যের ১৬ পৃষ্ঠার একটি কাব্যগ্রন্থে বারোটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ কবির এক মিস্টিক নির্মাণ। বঙ্গসাহিত্যে ক্লাসিসিজম এবং রোমান্টিসিজম নিয়ে জীবননানন্দ অনেক কথা বলেছেন। তার নিজের সৃষ্টির ক্ষেত্র থেকে তৈরি হওয়া এই বনলতা সেনকে যদি ক্লাসিক রোমান্টিসিজম বলি, খুব কিছু ভুল হবে না। সেই প্রথম সংস্করণ থেকে বনলতা সেন বাস্তবায়িত কবিতা পাঠকের জীবনে। মূলত একটি ঠিকানা এবং পদবী যোগ করেই জীবনানন্দ হয়তো এই ম্যাজিক রোমান্টিসিজম তৈরি করেছিলেন বনলতা সেন কবিতায়।
জীবনানন্দের ডায়েরিতে এক সাংকেতিক নারীচরিত্রের উল্লেখ বেশ অবাক করে। সংকেতচিহ্নটি হল ইংরেজি ‘ওয়াই(Y)’। ভূমেন্দ্র গুহ-র লেখা থেকে জানা যায় এই ওয়াই ছিল জীবনানন্দ দাশের খুড়তুতো বোন বুলুর বান্ধবী। কবির এই মানসনন্দিনী সম্পর্কে বিস্তর কৌতূহল জন্মায়। যার ফলে তাকে দৃশ্যগত করার চেষ্টায় কবিতা থেকে বনলতা সেনকে অনেকবার ওয়াই এর মোড়কে রাখার প্রবণতা জন্মেছে। বনলতা ছাড়াও শেফালিকা, আকাশলীনা, সুরঞ্জনা, সুদর্শনা, সুচেতনা, অরুণিমা সান্যাল এবং আরও বহু কবিতা চরিত্র থাকা সত্ত্বেও যুগ কাল অতিক্রম করে বনলতাই যেন একটি পৃথক ডায়াসে দাঁড়িয়ে চিরকাল কবিতাকে একাই সঞ্চালনা করে চলেছেন।
জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে তার কবিজীবনের উন্মেষ এবং কবিতাকেন্দ্রিক নারীচরিত্রগুলিকে জীবিত করার অভ্যাস নানাবিধ চরিত্রের সঙ্গে বারবার তুলনা টেনেছে। বিস্তর আলোচনা এবং গবেষণার পরেও কবির কবিতাও গল্পের সমূহ নারীচরিত্রগুলি কোন বাস্তব চরিত্রের পটভূমির উপর নির্মিত সেকথা কবির ভাবজগতেই রয়ে গেছে। কিন্তু এইসব চরিত্রের উপর সর্বকালের সেরা চরিত্র হয়ে রয়ে গেছে বনলতা সেন। কেমন ছিলেন বনলতা সেন? কার মতো? কবি লিখে গেছেন ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’। কবি বলে গেছেন ‘শ্রাবস্তীর কারুকার্য’। এতো নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে পুরুষের চোখ এভাবেই নারীকে বর্ণনা করেছে। অথচ এক পৃথক আধুনিক সত্ত্বার নব্যনির্মাণে, আমরা যুগ কাল অতিক্রম করে বারেবারে খুঁজে গেছি সময়ের প্রতি স্তরে জেগে থাকা অমলিন বনলতাকে।
বোদল্যেয়ার বলেছিলেন, ‘An artist is an artist only by dint of his exquisite sense of beauty’ জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন নির্মাণ হয়তো এই কথাকেই প্রতিষ্ঠা করে।
যেহেতু জীবনানন্দের নারীচরিত্ররা প্রত্যেকেই আধুনিক তাই সমসাময়িক যেকোনো প্রোটোটাইপ চরিত্রকে উদাহরণ হিসেবে রাখা খুব সহজ নয়। এমনকি জীবনানন্দের নিজের তৈরি নারীচরিত্রগুলিকেও একটি যেকোনো নামের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না। যেমন বনলতা সেন কিছুতেই ‘বিভা’ বা উৎপলা হতে পারে না। বিভা এবং উৎপলার দৃপ্ত ভঙ্গিমার সঙ্গে যে অ্যারোগেন্ট আধুনিকতা রয়েছে তার সঙ্গে নাটোরের বনলতা সেনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।
‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন শম্ভু সাহা। দ্বিতীয় সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। দুটি সংস্করণের প্রকাশকালের মধ্যে ব্যবধান দশ বছরের। দ্বিতীয় প্রচ্ছদ জীবনানন্দের পছন্দ হয়নি এমন কথাই শোনা যায়।
গণেশ পাইন, যোগেন চৌধুরী এবং বিকাশ ভট্টাচার্যের আঁকা বনলতা সেন এর তিনটি ছবিতে তিনরকমভাবে বনলতা সেন ব্যক্ত হয়েছেন।
গণেশ পাইনের বনলতা অনেক বেশি বিমূর্ত। যে হৃদয় বিদারক অন্তর্জাল ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের নামকবিতায় জীবনানন্দ তৈরি করেছেন তার সঙ্গে যেন শিল্পী একাত্ম হয়েছেন এই ছবিতে। যোগেন চৌধুরীর আঁকা ছবিতে বনলতা সেনের মমতাময়ী শিক্ষিত সচেতন বাঙালি মহিলার রূপ ফুটে ওঠে। যার ভঙ্গিমা দৃপ্ত, মুখমন্ডল উত্থিত এবং দৃষ্টি স্পষ্ট এবং সাহসী। বিকাশ ভট্টাচার্যের আঁকা বনলতা সেন ছবিতে আবার আলো আঁধারীর প্রতিফলনে এক অলৌকিক আবেদনের প্রকাশ। এখানে শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বনলতা সেন এক অবাঙমনোসগোচর চলাচল।
আশ্চর্য এক চরিত্র বটে। বনলতা সেন নিয়ে জীবনানন্দ চিরকাল আচ্ছন্ন ছিলেন। এমন এক চরিত্র যা কাল্পনিক নয় অথচ বাস্তব কোনো চরিত্রের রূপায়নও নয়। তিনি নিজেই ডায়েরিতে লিখেছেন,
‘Frustration in Literature, Love, Herodias Daughters, বনলতা সেন, Imaginary Women, Bus Women and Life’
পাঠক হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে বনলতা সেনকে তাকে চিনেছিলাম তার উৎস নিছক এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। সেই ১৯৮৮ সালে টিউনিক আর লাল বেল্ট বেঁধে ইস্কুলের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় গিয়ে বড় ক্লাসের দিদিকে আবৃত্তি করতে শুনেছিলাম, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়’– জীবনানন্দ ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠলেন শৈশবের কার্নিশে। এরপরেই কিশোর বয়স প্রথম স্পর্শ করল বনলতা সেনকে। বনলতা সেন হয়ে উঠলেন আমাদের কৈশোর জীবনের কাল্ট। আমাদের মনশ্চারিণী সেই বনলতা সেন কেমন ছিলেন? কেমন ছিল তার অন্ধকার বিদিশার নিশাময় চুল আর শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মুখ? সুচিত্রা সেন ছাড়া আর কাউকে বসানো কঠিন। কিন্তু যে সুচিত্রা সেন ব্যক্তিপরিচয়ের খ্যাতিতে বন্দিত তাকে বনলতার নিভৃতি দিতে মন চায় না। চারিত্রিক নির্জনতা না থাকলে, অতিদূর সমুদ্রের নাবিক দিশা হারিয়ে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর সবুজ ঘাসের দেশের মতো তাকে দেখবে কীভাবে? সুতরাং বনলতার চরিত্র উঠে আসত বইয়ের ভিতর থেকে। বুদ্ধদেব গুহ-র তৈরি চরিত্র কুর্চি বনলতা হয়েছেন, আমাদের স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী উর্মিলতা বনলতা হয়েছে, আমার মায়ের অনুঢ়া বয়সের কাল্পনিক ছবিকে দেখেছি বনলতা সেন হয়ে উঠতে।
এই বনলতা সেন প্রসঙ্গেই একটি পুরোনো পত্রিকায় যশোধারা বাগচীর একটি লেখায় পেলাম,–
‘মধ্যবিত্ত শ্রেণীচেতনাসম্ভূত নারীপ্রতিমাগুলিকে এখানে সযত্নে কক্ষচ্যুত করেছেন জীবনানন্দ ‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ উল্লেখে। বাইবেল এবং রুশো বর্ণিত পুরুষের ‘সহায়ক’ (helpmeet) মূর্তির ছোঁওয়া এখানে নেই। বিপ্লবী চেতনার আয়নায় আমরা যেসব ‘intellectual beauty’-র সন্ধান পাই জীবনানন্দর কাব্যপ্রতিমা প্রায়শই সে ধরনের। হৃদয়াবেগ এবং ইতিহাসবোধের সমন্বয়ে এই নারীমূর্তি ভিন্নস্বাদের প্রিয়রূপ।’
এমন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল নারীচরিত্রগুলোর মধ্যেও একটি পৃথক ব্যারিকেডের ভিতরে গ্রেটা গার্বো হয়ে একটি মিথ তৈরি করেছেন বনলতা সেন। ‘বনলতা সেন’ কবিতার সঙ্গে এডগার অ্যালান পো–র ‘টু হেলেন’ কবিতার তুলনা করেছেন বহু বিদ্বজন। টু হেলেন কবিতায় এডগার অ্যালান পো লিখেছেন,
‘Lo! in yon brilliant window-niche
How statue-like I see thee stand!
The agate lamp within thy hand, Ah! Psyche from the regions which Are Holy Land!’
জীবনানন্দ লিখেছেন,
‘অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে
দেখেছি মণিকা আলো হাতে নিয়ে তুমি
সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু
দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়োেতর বেলাভূমি:’
এমন মিল হয়তো কবিমনের সমাপতনের সংঘটনের জন্যই সম্ভব।