অজন্তা রায় আচার্য-র কবিতা

আরোগ্য নিকেতন
কেমন অনায়াসে টাঙিয়ে দিচ্ছ তোমাদের কুৎসিত কাম,
যে তারা খসে গেছে তার উত্তাপে
হৃদয় টগবগ জ্বলছে
শত শত চোখ ভেজাভাব শুকিয়ে নিয়ে
দৃঢ় করেছে আগুন
এবার আর মোমবাতির নম্রতা নয়
আধখাওয়া মৃতদেহ মেপে মেপে ভারী হয়ে গেছে পাল্লা
উদ্বৃত্ত মৃতদেহ মহাভারত সৃষ্টি করেছে
মহাভারতের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অযুত-নিযুত মানুষ
পড়, পড়ে নাও এই সংশয়-হীন চোখের ভাষা
আরোগ্য নিকেতনে-
সেমিনার রুম কলঙ্ক নিয়ে বসে আছে
নিজেকে পাঁকমুক্ত করার আশায়
তীব্র জনরব, নারী সমুদ্রের প্রবল গর্জন…
তোমার আসন কেঁপে কেঁপে উঠছে
এখনও কি অন্ধ হয়ে থাকবে! ধৃতরাষ্ট্রের মত শত পুত্র আগলে
তোমার মিড়ে মিড়ে
জনহীন উপত্যকা
ফুলহীন পাতাহীন মাংসাশী গাছের জঙ্গল
ধারাল জিভ
বাতাস নিজেকে কচলে কচলে প্রবাহিত
সময়ের প্রসব ঘরে পড়ে আছে গর্ভপাতের ফুল
কবে যেন লাল রঙের মধ্যে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল,
স্বপ্নের খোলসের মধ্যে কোথায় যেন তুমি হারিয়ে গেলে
আর আমি
তোমার মিড়ে মিড়ে চোস্ত
পোশাক খুলে
স্তন যোনি অতিক্রম করে উঠে দাঁড়িয়েছি ।
মনসা
সানকিতে রোদ বেড়ে দিয়েছে
হাপুস-হুপুস চেটে খাচ্ছে রোদের ঝোল
শালুকপাতা-মেয়ে, রোদ-চিকণ শরীর তার
ঢেউটিনে জল গড়িয়ে যায়…
পোয়াতি পেট দেখে মহাজন হা হা করে উঠলে
গুহার মধ্যে থেকে বের করে আনে কন্যা ভ্রূণ
জারিয়ে রাখে রোদের নিচে বালির মধ্যে
মা মনসা ভর করেছে তাকে
মেয়ে দুইহাতে দুই গোখরোর গলা চিপে বিষ পান করে
লেজ ধরে বনবন ঘোরায়
তার আগুন গোলা চোখ
খড়িওঠা হাত
গালের উঁচু হনু
রুখা ঝুরো চুল
রগ জাগা পা
হাড় বের করা পায়ের পাতা,
রাতের বেলা রোদ জ্বলে শরীর জুড়ে
শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মেয়ের পায়ে ফুল দিই ।
ভিক্ষাপাত্র
তোর ভরা ঘরে অবিরত চলছে প্রবাহ
একটুও কি খালি হয়ে বসতে পারিস না
চারিদিকে ঘিরে আছে অনিত্য বাতাস
সময়ের ভাঙাগড়া
ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে পট
বিকারে বিকারে-ই দিন চলে যায়
বুঝি আর পাওয়া হল না
সব যোগের যোগফল হয়েই শুধু রইল শরীর
আসল যোগ আর হল না
দেহজুড়ে জেগে আছে ভিক্ষাপাত্র
শ্রাবণ ছুঁতে পারিনি
দৃশ্যাতীত তুমি মেলে ধরেছ নিজেকে
জমেছে নীলের ধূসর
কী এক রহস্য তান
তোমার নর্তিত মূর্চ্ছনা
কে তুমি আমাকে বাজাও
দৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে গেঁথে দাও প্রেমফুল
তোমার অস্থির ছায়া
খুঁজি তোমাকে, যেভাবে জলে খুঁজি চাঁদ
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় ধারা
একদিন তোমার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে
দেখলাম সব পথ বন্ধ হয়ে আসছে
একটা গোটা মেঘ, শ্রাবণ ছুঁতে পারেনি
তার আগেই হুড়মুড় করে এত জল আসে কোথা থেকে
নুনের পুতুল
কেমন সব কিছু ভুল হয়ে গেল
আর রাখবে না পা ভুলের ঘরে
যেন সব কিছু নিজের হাতে
নৌকা নির্দিষ্ট, বাঁধাই ছিল
কোনও এক ভুলের ভর-দুপুরে
গো অ্যাজ ইউ লাইক
সেজেছিল সে নুনের পুতুল
নিমেষে জানাজানি হল
তারপরে মুঠোয় মুঠোয় গলে জল।
পরাজয়
কালো বিড়াল চেটে খাচ্ছে রাতের মুখ
আকাশের কালো ছাদ থেকে বাদুরেরা রহস্যময় ঝুলন বেঁধেছে
কুকুরের তীব্র চিৎকারে রাত-গভীর খান খান হয়ে যাচ্ছে
তাদের কে পরাজিত করে রাত দখল করতে চাইছে –
এক ধূর্ত নিষ্ঠুর হিংস্র দ্বিপদ শ্রেণি
রাতের বুকে তাদের ভারী পা’এর হল্লা
লকলকে দৃষ্টির নখে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে রাত্রির শরীর
দাঁত দিয়ে ফালা ফালা করছে যোনি, জন্মদ্বার
জয়ের উল্লাসের বিভ্রমে লেখা হছে তাদের পরাজয়ের ইতিহাস।