
মামাং দাইয়ের কবিতা অনুবাদ : শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়
ভারতীয় কবিতার একদম প্রথম সারির একজন কবি, মামাং দাই l অরুণাচল প্রদেশের এই কবির জন্ম ১৯৫৭ সালে, পাসিঘাটে l তিনি লেখেন ইংরেজি ভাষায় l তিনি অরুণাচল প্রদেশ থেকে মহিলাদের মধ্যে থেকে প্রথম ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও, শেষ অব্দি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন l কবিতার পাশাপাশি ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি সমান বিখ্যাত l সাহিত্য অকাদেমী পেয়েছেন ২০১৭ সালে l পেয়েছেন 'পদ্মশ্রী' সহ অন্যান্য নানা সম্মান l ২০২৩ সালে মুম্বাই লিটারেচার ফেস্টিভালে তিনি 'পোয়েট লরিয়েট' হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন l মামাং দাইয়ের কবিতা আমাদের নিয়ে যায় প্রকৃতি, ইতিহাস ও মানুষের ভেতরকার গভীর অনুভূতির জগতে। তাঁর কবিতায় উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়, নদী, অরণ্য ও সেখানকার মানুষের জীবন এক অনন্য সংবেদনশীল ভঙ্গিতে উঠে আসে। তিনি সময়, স্মৃতি ও অস্তিত্বের প্রশ্নকে প্রকৃতির রূপক দিয়ে প্রকাশ করেন। দাইয়ের কবিতা পড়তে পড়তে বোঝা যায়—ভাষা কেবল প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং একধরনের যাত্রা, যেখানে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিলেমিশে যায় সমষ্টিগত ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্গে। স্বচ্ছ, সহজ অথচ গভীর এক ভাষায় তিনি মানুষের ভেতরের আকুলতা, বিচ্ছেদ, মমতা ও জীবনের অনিত্যতাকে স্পষ্ট করে তুলেছেন। তাঁর কবিতা আধুনিক বাংলা পাঠকের কাছে তাই একইসঙ্গে আত্মীয় আর বিস্ময়কর মনে হয়।
সময়ের প্রলেপ
হ্যাঁ, আমি দেবতাদের বিশ্বাস করি,
বনের বিশ্বাস—ভাল আর মন্দের,
নদীর আত্মাদের,
ভোরের স্বপ্নজগতের ওপর।
আমি জানি, যেসব মুখের সঙ্গে দেখা হয়,
যেসব জীবন ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে,
সেসব চোখে আজও অতীত বেঁচে আছে—
যা জঙ্গলে কখনো হঠাৎ ভেসে ওঠে।
গাছের মগডালে স্বপ্ন দেখতে দেখতে
শিশুরা শোনে অচেনা গলার আওয়াজ
ফিসফিসিয়ে মারণ হাওয়া
সব কিছুর ভাগ্য লিখে দেয়।
একটা টুকরো ডাল, কিংবা একখণ্ড ফার্নপাতা
পূর্বাভাস দেয় নিয়তির।
পাহাড় জানে,
কীভাবে আমরা বুক চেপেছিলাম তার বুকে,
আমরাই রেখেছি ছায়াগুলো যেখানে আছে।
স্বপ্নের অবসরে আকাশের হাওয়া জানে—
পাথরের মাঠে কীভাবে আমরা ফুল ফুটিয়েছিলাম।
অচেতনেই সবুজ জেড নদী দিক পাল্টায়,
উৎসের রীতি মেনে আবার ফিরে আসে
কুয়াশা আর জলীয় বাষ্পের কাছে l
তার ঘুমন্ত কাঁধের উপর
গ্রীষ্মের গোপন হৃদয় নেমে আসে—
দেবতাদের আস্তানার ভেতর থেকে।
একটি গল্পের আশ্রয়ে
বৃষ্টি জানে
এক মানুষের জীবনও
একটি গানের দৈর্ঘ্যে মাপা যায়।
সময় নিজের প্রলেপ মেখে দেয়
ভাঙাচোরা স্মৃতির ওপর।
এই বদলানো আকাশ-পাতাল জুড়ে,
যাকে আমরা দিন-রাত্রি বলি—
নদী-নারী জানে,
সে যখন বাড়িয়ে আনে হাত
বিশ্বাসের উপকরণগুলো মিশে যায়
একটি নাম আর মুখের ভেতর।
এক এক করে আমরা ফের খুঁজে পাব
করুণা আর সৌন্দর্যের অলঙ্কার।
আমি তোমার দিকে তাকাই,
দেখি—বর্ষার নদী বইছে।
তোমার চোখে আজও জঙ্গলের ছায়া টিকে আছে।
কিছু কিছু জিনিস
চিরকাল পবিত্র।
প্রার্থনার পতাকা
ভেজা পাহাড়ি পথ,এই পথেই কেটেছে
আমাদের সময়,
সংশয় হয়—পার হতে পারব তো?
কেউ যেন আমার হৃদয়ে পুঁতে দিল
একখানা প্রার্থনার পতাকা।
সবুজ—জীবনের রং, হলুদ—মাটির,
সাদা—মেঘের, আর জুনিপারের ধূপের গন্ধ
মিশে গেল সেই নীলের সঙ্গে,
যে সমুদ্র একদিন এই ভূমির মালিক ছিল।
হয়তো একদিন ঝড় এসে ছিঁড়ে ফেলবে তাকে,
যখন সে থামিয়েছে বাতাসকে
হাজার বার।
গতকাল আমরা একে অন্যকে খুঁজে পেলাম,
যখন তারা বলল—অতীত শেষ হয়ে গেছে।
এখন আমরা ভেসে যাওয়া রঙিন দাগ,
উঁচুতে উড়ছি
পাহাড়ের বাঁধা পেরিয়ে।
নদী
নদীর ধারে বেশিক্ষণ থেকো না।
নদী এক খামখেয়ালি দেবতা।
কখনো হাতি, কখনো সিংহ,
আবার কেউ ডাকে ঘোড়া বলে।
এক গ্রীষ্মে আমরা ভেবেছিলাম
সে যেন এক ময়ূর—
হলুদ ধুলোর ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে,
যা আমাদের চোখে সোনার ঝিলিক ভরে দিচ্ছিল।
আমি দেখেছিলাম এক নারীকে,
শাপলার পুকুরে ভেসে আছে—
মেঘে মোড়া পাহাড়ের কুয়াশায়,
ফুলের রেণু ও লতাপাতার স্রোতে ভেসে।
আমি ভেবেছিলাম: নদীই আসলে সেই নারী,
একটি দেশ, একটি নাম,
সাদা স্রোতের ভেতর বন্দি সুরের টুকরো,
বা গোপন মানচিত্র বয়ে আনা এক খণ্ড কাগজ।
আকাশরেখাই তার জন্মভূমি—
অন্ধকার আর শিখরের মাঝখানে,
তৃষ্ণার এক গোপন উৎসে।
নদীর ধারে বেশিক্ষণ থেকো না।
সে এক ডুবে যাওয়া আত্মা,
সে তোমাকে হাত ধরে জলে টেনে নিতে পারে
এক শক্তিশালী দেবতা,
যে ঋতুগুলোকে বয়ে আনে আবার সরিয়েও দেয়।
চলতে থাকা নদী, থেমে থাকা নদী,
নদী-সমুদ্র, নদী-মহাসাগর,
আমাদের সব গ্রীষ্মের নদী—
যে জমা রাখে আমাদের জীবনের সমস্ত নুন l
মৃত্যুর হেঁটে আসা
মৃত্যু যখন হেঁটে কাছে চলে আসে,
আমাদের চোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে যায়,
যখন আমরা প্রিয়জনকে মাটিতে শুইয়ে দিই।
এই লবণ যেন জন্ম নেয়
এক মুঠো মাটি থেকে—
যেন এক বোলতার ক্রন্দন
নিজের সন্তানদের কবরের পাশে,
আর এক পাখির ব্যথাভরা গান
যার বাসা ভেঙে দিয়েছে ঝড়।
এ যেন চোখের জলেরই পথ—
যা বলা যায় না, সেই কথার ভাষা।
ভালোবাসা ঢেলে দিই সেই মাটিতে
যেখানে দেহ শান্ত হয়ে শোয়,
ঢেউয়ের মতো ভাঁজে মোড়া
ঘুমের গভীরে,বিশ্রামে।
আজ, কাল— সবই এক উজ্জ্বল মুহূর্তে গলে যায়,
এক ফোঁটা অশ্রুর মধ্যে ধরে রাখে
আমাদের সত্যের অবয়ব—
যে আমরা আসলে কারা।
আমাদের হৃদয় কখনও
পাথর দিয়ে গড়া ছিল না।
অনুবাদ : শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায়


