বেবী সাউ-এর গল্প

বেবী সাউ-এর গল্প

স্বয়ম্বরা

বিকেলবেলা। সকাল থেকে প্রচুর গরম। ভ্যাপসা গরম। ভেজা মাটির সঙ্গে সূর্যের তাপের দহরম মহরম চলছে। দু’টোয় মিলে যাচ্ছেতাই রকমের গরম উপহার দিচ্ছে আমাদের মতো বেচারা জীবকুলকে। কিন্তু দুপুর হতে না হতে প্রকৃতিদেবী একটু সদয় হলেন। এবং তিনি তার কালো মূর্তি ধারণ করে, রোদকে জখম করে বিরাট চুলের গোছা উড়িয়ে, রুদ্র রূপ ধরে নামলেন ঝরঝর বৃষ্টি হয়ে। ফলে, এই বিকেল মুহূর্তে শান্ত এবং স্নিগ্ধ। এদিক ওদিক ঝরা পাতা, রাস্তার ধুলো এবং বিজ্ঞানের দান পাতলা ব্যবহৃত ছেঁড়া পলিথিনগুলো সব উঠে এসেছে আস্তাকুঁড় থেকে আমাদের উঠোনে; তবুও আমরা গরম থেকে স্বস্তি পেয়ে বেশ প্রফুল্লচিত্তে গরম গরম বেগুনি খাওয়ার কথা আলোচনা করছিলাম।

আমি বসেছিলাম একটা ঝুলে পড়া আরাম কেদারায়। আমার মা, কাকীমা, বোন বসেছিল বাদাম স্তুপের কাছে। ফটফট শব্দ হচ্ছিল। চোখ বন্ধ করলেই, মনে হচ্ছিল দূরে কোথাও গোলাবর্ষণ চলছে। ছাড়ানো বাদামগুলি উলঙ্গ হয়ে একটা পাত্রে জমা হচ্ছিল। গাদাগাদি করে। বাবা বেলচা টাইপের একটা জিনিস নিয়ে ঝরা পাতাগুলো সরাচ্ছিলেন। আমার জেঠিমা ঘরের ভেতর থেকে এলেন, তিনি প্রথম বেগুনির কথা তুললেন এবং এই ঠান্ডা হাওয়ায় গরম গরম বেগুনি আমাদের কাছে এক লভ্য জিনিস হয়ে উঠতে আরম্ভ করল। হ্যাঁ… হ্যাঁ করে উঠল বেগুনির লোভ।

তখনই “হরে কৃষ্ণ…হরে কৃষ্ণ ” বলতে বলতে আমাদের উঠোনে আরেকজন আগন্তুক এসে দাঁড়ালেন এবং “… মা গো… কই?” বলে সম্বোধন করলেন। আমাদের বাড়িতে আমার ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর থেকে ‘মা’-এর আসন পাকাপোক্ত হয়েছে আমার জেঠিমার জন্য। তাই আমরা সামান্য নড়ে চড়ে বসলেও কেউ আর জায়গা পরিবর্তন করলাম না। শুধু জেঠিমা এক ঘটি জলের জন্য হন্তদন্ত হয়ে পড়লেন। “…বাবা ঠাকুর, বসুন গো…বসুন গো” বলে বাড়ি তোলপাড় করে তুললেন। বাবাঠাকুর এদিক ওদিক চেয়ে কোথাও বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ’ করতে লাগলেন। ততক্ষণেও জেঠিমা একটা বসতে দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে ঘর-বাইর করছেন। মা ঘোমটা একটু টেনে বাদামেই মনোনিবেশ করলেন আবার। বোন, কাকীমাও তাই।

সমস্যার সমাধান হিসেবে বাবা বেলচা ফেলে, একটা কাঠের চেয়ার এনে হাজির করলেন। চকচকে চেয়ার। এটা আমাদের বাইরের ঘরে থাকে। অতিথিদের গায়ের তেল লেগে লেগে মৃসণ চকচকে হয়ে উঠেছে। যদিও চেয়ারটি পরিস্কার ছিল, বাবা একবার হাত বুলিয়ে ধুলো ঝাড়ার ভান করে বললেন, “ঠাকুর মশাই, বসুন….”

—আয়ুষ্মান হও বাবা…জিতে রহো…

বলে ঠাকুরমশায় ওরফে বাবাঠাকুর বসলেন। তাঁর পা ভর্তি ধূলো। জুতোহীন। ফাটা পায়ের খাঁজে লাল ধুলো, কাদা, কাঠির ছোট টুকরো যে যার মতো জায়গা করে নিয়েছে। সাদা ধূতিটিও জীর্ণ এবং ময়লা। বাবা এসে নমস্কারের ভঙ্গি করলেন। জেঠিমা এসে একটা আধা-সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন। কেননা, মাটি ভেজা ছিল। শাড়িতে কাদা ময়লা লেগে যেত। তারপর লাইন ধরে মা, কাকীমা, বোন।

কিন্তু আমি আমার ঝুলে পড়া চেয়ার থেকে কিছুতেই নিজের শরীরটাকে বের করতে পারছিলাম না বলে চুপ থাকলাম। বোনকে ইশারায় ডাকলাম কিন্তু বোন সাড়া না দিতে এবং এত প্রণামের মাঝে আমার না-প্রণামটি ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক ভেবেই আমি চুপ করে গেলাম।

তিনি একটু ধাতস্থ হয়ে, এক ঘটি জলপান করে ঝড়ের বর্ণনা করতে আরম্ভ করলেন। কীভাবে আটকে পড়েছিলেন, কোথায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রেখেছিল এই বেহায়া ঝড়, কেমন নাজেহাল করল— সব একে একে বিস্তারিতভাবে বললেন। গল্পগুলো ইন্টারেস্টিং ছিল। কেননা, আমার মা, কাকীমা এবং বোনের হাত বাদাম থেকে সরে এসেছিল এবং আমার বাবাও ঝরা পাতা ছেড়ে এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। গল্প শেষ হলে আমার জেঠিমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

— একটু চা খাওয়া, মা…

চা-বিস্মৃত জেঠিমা লজ্জা পেয়ে ঘরের দিকে ছুটে গেলেন। বাইরে থেকে দেখলে ঘরটা অন্ধকার লাগছিল। সেই অন্ধকারের জেঠিমা হারিয়ে গেলেন। আমি আমার ঝুলে পড়া চেয়ার থেকে চা এবং বেগুনির দু’টোর অপেক্ষা করলাম।

সূর্য তখনও ডোবে নি। বরং কালবোশেখীর পরে তার রঙ আরও তীব্র এবং সুন্দর হয়েছে। কিন্তু তীক্ষ্ণ নয়। আমরা সেই রোদকে কনে দেখা রোদ বলি, সেরকম। এই রোদ শুধু কনেদের অর্থাৎ কুমারীদের চোখে মুখে পড়ে এক লজ্জাকরুণ আভা এনে দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না।

আমি আমার ঝুলে পড়া আরাম কেদারার থেকে ওঠে বসার চেষ্টা করলাম আরেকবার। কিন্তু সেটা এতটাই ঝুলে পড়েছিল যে, উঠার জন্য কারো সাহায্যের দরকার ছিল। আমি বোনের দিকে তাকালাম। তার চোখে, মুখে, গালে এবং খোলা চুলের ফাঁকে ফাঁকে সেই রোদ এসে পড়েছিল। বিকেলের রোদ। তার ফর্সা টুকটুকে মুখে এক আশ্চর্য ব্যাপার কাজ করছিল। বোন একমনে বাদামের বীজগুলো নাড়াচাড়া করছিল অন্যমনস্কভাবে। আরেকবার আমি তাকে ইশারায় ডাকতে চাইলাম কিন্তু তার আগেই বাবাঠাকুর বলে বসলেন—

— তোমার বড় মেয়েটি তো বেশ বাড়ন্ত হয়ে উঠল, যোগেন… বিয়ে-টিয়ের কথা ভাবছ নাকি?

আমি পরের বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেব। এবং যতদূর জানি বাল্যবিবাহ সরকার দ্বারা বারণ করা হয়েছে। তাও আমার নিশ্চিন্ত মন হঠাৎ করে চমকে উঠলো। আমি ভয় পেতে আরম্ভ করলাম। যদিও বাল্যবিবাহ রদ করতে রাজ্য সরকার কিছু আইন প্রনয়ণ করেছে এবং দেশের নাগরিক হিসেবে তা মানতে আমরা বাধ্য। সেদিন থেকে একটা নিশ্চয়তা কাজ করলেও আমি চমকে উঠেছিলাম। নিজেকে আড়ালে নিয়ে যেতে চাইলাম। লুকানোর জন্য।

কিন্তু তার আগেই বাবাঠাকুর ডাকতে শুরু করেছেন,
—এদিকে এসো তো মা, তোমার হাতটা দেখে দিই…

আমার মা কিছুটা বিজ্ঞানমনস্ক মহিলা ছিলেন। তিনি এই হাত-পাত দেখে ভাগ্য নির্ধারণের বিরোধী । কিন্তু সেদিন তার মধ্যেও ভবিষ্যৎ জানার এক আগ্রহ তৈরি হয়ে থাকবে, তাই তিনি চুপ ছিলেন। আমি সবার মুখগুলোর দিকে তাকালাম। কেউ যদি বারণ করে। কিন্তু অরণ্যে রোদন অবস্থায় আমাকে বাবাঠাকুরের দিকে, আমার ভবিষ্যতের হাতের রেখাগুলি নিয়ে এগিয়ে যেতে হলো। পা এখানে নিরুপায়। যদিও পায়ের দ্বারাই মানুষ সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় কিন্তু তার রেখা নেই বলে কেউ পাত্তা দেয় না, ভবিষ্যৎ বিচারের ক্ষেত্রে। হাত এখানে জিতে গেছে।

তিনি আমার হাত অনেকক্ষণ উলটে পালটে, টেনে দেখলেন এবং ঘোষণা করলেন,

— এই মেয়ে স্বয়ম্বরা হবে এবং যে পুরুষ নিজের থেকে এই মেয়ের প্রেমে পড়বে সে উন্মাদ হয়ে যাবে!

হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসলেও স্বয়ংবরা জিনিসটা বেশ রোমাঞ্চকর এবং আধুনিক। আমি বেশ খুশি হলাম। আমি ভবিষ্যৎ বাণীর প্রথম অংশটি মনে রেখে বাদবাকি অংশটি ফেলে দিলাম। কেননা, কে কী হচ্ছে সেসব নিয়ে আমার ভাবার এত সময় কিংবা ইচ্ছা কোনটাই নেই। কিন্তু আমাদের বাড়ির বাদবাকি সবার মুখগুলোয় সেদিন যেন কোনও অদৃশ্য পুরুষ কালি লেপে দিয়েছিল।

তারপর থেকে আমি নিজেকে স্বাধীন এবং মুক্ত ভাবতে আরম্ভ করলাম। কেননা, যতদিন পর্যন্ত আমি না চাইছি আমার বিয়ে দেবে এমন তাকত কারো নেই। তাছাড়া পুরুষদের এতদিনের যে দম্ভ তা এবার ভাঙা যাবে। ততদিনে চন্দ্রশেখর নামে একটা ছেলে স্কুলে, আমার বসার বেঞ্চে ‘সি প্লাস কে’ লিখে রেখেছে। সেটা দেখিয়ে ঠারেঠুরে আমার বান্ধবীরা বেশ রসালো কিছু ভাবতেও আরম্ভ করেছে। কিন্তু জমাতে পারছে না গল্পটা । আমি ঠিক করলাম, যেহেতু আমার ইচ্ছেতেই পুরুষরা চলবে এবং এটা বিধিনির্ধারিত, তাই আচ্ছা করে একদিন চন্দ্রশেখরকে জব্দ করতেই হবে। আমার আর ভয় কিসের!

জব্দ করার প্ল্যান ভাবতে ভাবতে আমি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু বিধাতা যার সাপোর্টার তাকে রাখবে কে! নিজে থেকে চন্দ্রশেখর জব্দ হয়ে গেল। তার শরীরে ‘মা’ দেখা দিলেন। আধুনিক ভাষায় যাকে বলা হয় চিকেন পক্স। দীর্ঘ দু’মাস স্কুলেই এলো না সে। এবং যখন এলো ততদিনে আমরা দশমশ্রেণীর হয়ে গেছি। সে বেচারা নবমেই থেকে গেল। এবং বাইরে থেকে ভর্তি হয়ে আসা এক পাতলা লিকলিকে ফর্সা মেয়ের প্রেমে পড়ে, অনেক অনেক গল্প কবিতা লিখতে আরম্ভ করল। সেসবের কিছু কিছু আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হচ্ছিল। প্রশংসা করছিল সবাই। আমার ভেতর তখন একটা চিনচিনে ব্যথা কুরে কুরে খাওয়া আরম্ভ করল। কেউ আমাকে চায়, ভালোবাসে অথচ আমি বাসি না এটার মধ্যে একটা অহং কাজ করে। বিশেষত মেয়েদের কাছে। কিন্তু প্রাক্তন প্রেমিক চোখের সামনে অন্য প্রেমিকাকে নিয়ে কবিতা গল্প লিখবে এবং সবাই তার প্রশংসা করবে এটা ভাবতেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এসবের পরেও আমি এতটা ভেঙে পড়িনি। কেননা, সামনেই পরীক্ষা। দীর্ঘ সিলেবাসের প্রতি মনোযোগী হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

কিন্তু মনের ভেতর থেকে এই খচখচানি কিছুতেই গেল না। আমি তখন বাবাঠাকুরের ভবিষ্যতবাণীর দ্বিতীয় অংশটা স্মরণ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এই অংশটি ভাবতাম যখন আমার চোখ মুখের অবস্থা পালটে যেত। এবং আমি নিজেই নিজেকে ভয় পেতাম। মনে হত আমার চুলগুলো শণবুড়ির মতো হয়ে যাচ্ছে। চোখগুলো টকটকে লাল। হিংসায় হিংসায় আমার নখগুলো ভরে উঠছে। কিন্তু তারপরেও আমি প্রতিদিন স্কুলে আসতাম এবং প্রথমেই লক্ষ্য করতাম চন্দ্রশেখর এসেছে কী না! একদিন দেখলাম আমাদের স্কুলের মাঠে শিশু-গাছটির নীচে সে একা বসে আছে। তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তার চোখ মুখ উদাস। চেয়ে আছে কিন্তু দেখছে না কিছুই। আমি অনেক ক্ষণ তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, আমাদের ক্লাসরুমের সামনে বারান্দা থেকে। নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম, তার মধ্যে পাগলের গুণগুলো প্রকট হচ্ছে কী না! কেননা, আমি কিছুতেই হেরে যাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারতাম না। যেখানে হস্তরেখা বলছে এই কথা। সেখানে একশ শতাংশের দিকেই আমি হাঁটতাম। আর বলাবাহুল্য সেখানে অগ্নিসংযোগ করেছিল বাবাঠাকুরের কথাগুলো। যাইহোক, ততদিনে আমাদের পরীক্ষা এসে গেছিল। পরীক্ষার পরে আমাদের অন্য স্কুলে ভর্তি হতে হল। ফলে, চন্দ্রশেখরকে নিয়ে ভাবার ভাবনায় ভাটা পড়ল। বিষয়টা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছিল। তাছাড়া নতুন স্কুলে নতুন নতুন সঙ্গী সাথী পেয়ে আমি বেশ আনন্দে ছিলাম। তুচ্ছ চন্দ্রশেখরের জায়গায় কত কত স্মার্ট ঝকঝকে চেহারার তরুণ। সদ্য উত্থিত গোঁফ এবং ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। বেশ রোমান্টিক রোমান্টিক চারপাশটি। একবছর কেটে গেছে। নরনারীর প্রেম সম্পর্কিত অনেক তথ্য আমাদের জ্ঞানের করায়ত্তে এসেছে। নিজেকে আজকাল বেশ লেডি লেডি ফিলও হয়।

আমাদের ছোট শহরে তেমন কোনো সাহিত্য বিষয়ক পত্র পত্রিকা বেরোয় না। তাই কবি, লেখকের সংখ্যাও বেশ কম। আমাদের বয়েসী কয়েকজন ন্যাকা ন্যাকা কবিতা টবিতা টাইপের কিছু লিখি। কবিতা ঠিক নয়। বেশিরভাগ রবীন্দ্রনাথ কিংবা মোহিতলাল মজুমদার থেকে কপি করা। কিন্তু সেবার গোস্বামী বাড়ির দুর্গা পুজোর পঁচাত্তর বছর পূর্তি। ঠিক হয়েছে একটা স্মরণিকা বের হবে। আমারও একটা কবিতা থাকছে সেখানে। তাই গর্বে আমার পা মাটি থেকে দু’ফুট উঁচুতে। যদিও কাল্পনিক ভাবে!

পুজো শেষ হয়ে গেছে। ছুটিও শেষ। আমরা হইহই রইরই করে আবার স্কুলে এলাম। আমার এক বান্ধবী সেই স্মরণিকাটি নিয়ে স্কুলে এসেছে। ক্লাসে ঢুকে দেখি, একটা গল্প নিয়ে তারা খুব আলোচনা করছে। পড়ে পড়ে অন্যদের শোনাচ্ছে। আমি উঁকি মেরে দেখলাম গল্পটির নাম ‘ব্যর্থ প্রেম’ লেখক চন্দ্রশেখর। আমি কাউকে কিছু না বলে গল্পটি শুনলাম। চেয়ে নিয়ে পড়লাম। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম গল্পটি আমাকে নিয়ে লেখা। কিছু জানি না ভাব করে, আমি লেখকের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তার পরিচয়, এখন কী করে। যে বান্ধবীটি গল্পটি পড়ছিল, জানাল— আমাদেরই বয়েসী কিন্তু নাইন ক্লাসে সে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। স্কুলে যায় না আর।

আমি আবার নিজেকে বেশ শক্তিশালী ভাবতে শুরু করলাম।

ততদিনে অনেক কিছু পালটে গেছে। প্রেম করাটাই একটা নিয়ম বহির্ভূত কাজ বলে ভাবতে শুরু করেছে দেশবাসী। আমাদের দেশের বিজ্ঞান সেন্টারগুলো অধ্যবসায়ের ফলে চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পেরেছে কিন্তু ছেলে মেয়েদের ভেতর প্রেম থাকা উচিত নাকি অনুচিত এ সম্পর্কে কোনো মত দিতে পারে নি। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে এক সার্কুলার জারি করে জানালেন, আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে, বিবাহের আগে প্রেম কিংবা বিবাহ বহির্ভূত প্রেম একদমই যায় না। আমাদের দেশ পবিত্র এবং সুন্দর। এখানে বিদেশীদের মতো প্রেমের স্বেচ্ছাচারিতা মানা হবে না। ফলত এক প্রকার নিষিদ্ধ হয়ে গেল প্রেম। গুরুজনেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

আর আমাদের ইউনিভার্সিটির দেওয়ালে, পার্কের বেঞ্চের পেছনে, লেকের ধার গুলিতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধরা গেলে দশহাজার টাকা জরিমানার পোস্টার ঝোলানো হলো। সেসব পোস্টারে কেউ কেউ আবার একটা শূন্য যোগ করে দিল। কোথাও কোথাও একটা শূন্য কেটে নেওয়া হল। কিন্তু পোস্টারগুলো উপড়ে ফেলার কথা কেউ ভাবল না। আমাদের বোঝানো হলো, চোদ্দ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস। শহরের মাঝখানে, জায়গার কম ছিল বলে একটা টেম্পোরারি শহীদ মঞ্চও সাজানো হল। সেদিন সবাই গোলাপ আর মোমবাতি কিনে শহীদদের স্মরণ করল। কেউ শহীদদের নাম জানত না সেভাবে। তাই শুধু চোখ বন্ধ করে থাকল একমিনিট।

আমাদের শহরে একটি পার্ক আছে। বিখ্যাত পার্ক। এবং প্রেমের জন্য প্রসিদ্ধ। একদিন দেখা গেল সেখানেও প্রেম-বিরুদ্ধ পোস্টার। তারপর পুলিশ মোতায়ন। প্রেমিক-প্রেমিকাদের দেখলেই বেধড়ক মার সঙ্গে পিতামাতাকে ফোন কল। থানা ছোটাছুটি। হোটেল রেস্টুরেন্ট কোথাও আর যাওয়ার জায়গাও নেই। সবখানে ‘আনম্যারেড কাপল নট অ্যালাউড’ টাঙানো। বলা ভালো শহর থেকে প্রেমভাবটাকে রাতারাতি উড়িয়ে দেওয়া হল। সবাই সবাইকে ভাই এবং বোনের চোখে দেখতে আরম্ভ করলো। চোরা চাউনি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল।

এরকম অবস্থায় আমার মাথা থেকেও ‘স্বয়ম্বরা’ শব্দটি গায়েব হয়ে গেল। কাজ নেই তো খই ভাজ প্রবাদের প্রচলন আছে। কিন্তু প্রেম নেই তো কী করা যায় একথা কোথাও লেখা নেই। যাইহোক, আমি প্রধানমন্ত্রীর কথা বিশ্বাস করে প্রেমের দিকে আর পা বাড়াই নি। কিন্তু কিছু করতে হবে ভেবে, ডিগ্রির পাহাড় জমিয়ে ফেললাম। বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এলে, স্বাধীনচেতা আমি উচ্চস্বরে ঘোষণা করতাম ‘কদাপি নহে’…

এত সবের মধ্য দিয়ে যেতে যেতেও আমি একবার ধপাস করে প্রেমে পড়লাম। এই প্রেমের শব্দ ছিল প্রচুর। সবাই সচকিত হয়ে উঠল। আমাদের এক জ্ঞাতি সম্পর্কে দিদিমা বারবার বলতেন ‘প্রেমেতে মজিলে মন/ কে বা হাড়ি, কে বা ডোম’। সেই প্রবাদবাক্য আমি সত্য করে ফেললাম। পড়লাম এক বিবাহিত পুরুষের প্রেমে। যদিও ‘বিবাহিত’ শব্দটি সমাজ জানত, কিন্তু সে মানে দীপ্তোজ্জ্বল মনে করত —যে সম্পর্কে প্রেম নেই সেখানে সমাজের চাপানো ‘বিবাহিত’ শব্দটি ইললিগাল। দীপ্তোজ্জ্বল পাতরের প্রতিটি কথাই এক একটা জ্বলন্ত শিখা। আমি তো ফিদা।

প্রধানমন্ত্রীর এই চাপানো নিয়মের বিরোধিতা করতে সে এসেছিল আমাদের সেই বিখ্যাত পার্কে। বক্তৃতা দিতে। জ্বালাময়ী বক্তৃতা। সেদিন আমাদের পার্কে কে না উঠে এসেছিলেন— মৈত্রেয়ী, গার্গী, দেবরাজ ইন্দ্র, লায়লা মজনু, প্রেম অবতার কৃষ্ণ, দ্রৌপদী, অর্জুন, সুভদ্রা, রোমিও, জুলিয়েট থেকে আজকের হাজার হাজার মানব মানবী। ভুরি ভুরি প্রেমের উদাহরণ শুনে আমাদের শহর দীপ্তোজ্জ্বলের প্রেমে পড়ল। আমিও বাদ নই। সবার চেয়ে আমি একটু বেশিই। স্বপনে, জাগরণে, ভ্রমে, বিভ্রমে সর্বদাই দীপ্ত দীপ্ত করতে লাগলাম। সে যেখানে যেখানে বক্তৃতা দিতে যেত, আমিও হাজির। আমার দুর্বলতার খবর দীপ্তোজ্জ্বলের কাছে কীভাবে পৌঁছেছিল জানি না। কিন্তু সেও যে আমার প্রতি দুর্বল, হাবে- ভাবে সেটা প্রকাশ হতে লাগল। এবং আমরা প্রধানমন্ত্রীর বিপক্ষে গিয়ে প্রেমে পড়লাম। সে আমাকে ভুরি ভুরি প্রেমগুরু ওশোর রিল পাঠাতে আরম্ভ করল। এবং বোঝাল বিবাহটাই আসলে ভুল, যদি কিছু সত্য থাকে এই দুনিয়ায় তবে তা প্রেম।

প্রেমই এক এবং অদ্বিতীয়ম। আমার মনের ভেতর প্রেম ভালো না বিবাহ ভালো এসব খচখচানির চাইতেও বেশি গুরুত্ব ছিল আমি দীপ্তোজ্জ্বলকে বেছেছি নাকি সে আমাকে? আমি চেয়েছি বলে সে আমার কাছে এসেছে না কি সে চেয়েছে বলে আমি? এসব আমাকে সারাদিন বিভ্রান্ত করত। আমি স্থির থাকতে পারতাম না। কিন্তু সম্পর্ক বেশ কিছুদূর গড়ালো। এবং আমাদের হোটেলের রুমের দরকার পড়ল, ততদিনে নিয়মও একটু পাল্টেছে। দীপ্তোজ্জ্বলের দীপ্তিময় ভাষণের ফলে প্রধানমন্ত্রীর নিয়ম কিছুটা হলেও পিছু হটেছে। পার্কগুলো হালকা উন্মুক্ত করা হয়েছে। তবে শুধু দিনের বেলায়। কেননা, পার্কগুলো শুধু বৃদ্ধ মানুষে ভরে যাচ্ছিল। ফলে মালী আর ঠিকঠাক ফুলগাছগুলোর যত্ন নিত না। জল দিতে ভুলে যাচ্ছিল সে। গোবর সারের বদলে সে একবার দিয়ে দিয়েছিল ইউরিয়া সার। এর জন্য তার কাছ থেকে জবাব চাইলে, জানাল, বৃদ্ধদের জন্য এর চেয়ে ভালো ফুলের দরকার নেই। সৌন্দর্যের কদর বুঝত। তাছাড়া, পুলিশের চাকরিতে বহুদিন নিয়োগ না হওয়ার ফলে পার্কগুলোয় আর পুলিশ মোতায়ন করা যাচ্ছিল না, এটাও একটা কারণ। কিন্তু রাত-বেলা নৈব নৈব চ। হোটেল ব্যবসায় লস হচ্ছিল বলে সেখানেও কিছুটা ছুট দেওয়া হয়েছে। আইডি কার্ড এবং অকারণে বেশি রুম ভাড়া নিয়ে আন-ম্যারেড ক্যাপলদের ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শহীদ দিবস তার যথাযোগ্য স্থানে আছে। ভ্যালেন্টাইন ডে-এর দাপট এখনো ফেরাতে পারে নি দীপ্তোজ্জ্বল।

আমরা মানে আমি কুন্তলিকা এবং দীপ্তোজ্জ্বল নিজ নিজ ফর্মে সাইন করে হোটেল বয়-গার্লদের ব্যঙ্গার্থক চোখের সামনে দিয়ে হোটেল-রুমে প্রবেশ করলাম। দু’জন বুভুক্ষু মানুষের মতো আমাদের আচরণ ছিল সেদিন। আচড় কামড় শেষ হচ্ছিল না যেন। প্রেমে পাগল না কামে পাগল এসব যুক্তির কাছে গিয়ে লাভ নেই। জীবনে প্রেম, মিলন এসব ন্যাচারাল। ফলে আমরা তাকে পবিত্র আখ্যা দিয়েছিলাম।

আজ এই এই বয়েসে লিখতে এসেও আমার চোখের সামনে সেসব দৃশ্য স্পষ্টতর হয়ে উঠছে এবং আমি কাঁপছি। শিহরণ খেলে খাচ্ছে। অস্পষ্ট দৃশ্যের ভেতর একটা দৃশ্য শুধু পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, যতবার দীপ্তোজ্জ্বল আমার ওপরে উঠে আসতে চাইত, আমি তাকে নীচে ফেলে দিতাম।

আর আমি ওপরে…

স্বয়ম্বরা কিনা…

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    Lopamudra Roychowdhury 3 months

    উফফফফ! এই কলমকে স্যালুট

  • comment-avatar
    Debasish Tewari 3 months

    খুব ভাল লাগল গল্পটি।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes