
পর্ণশবরীর কথকতা ১০ প্রাপ্তি চক্রবর্তী
সামাজিক মাধ্যমে বন্ধুরা প্রায়শই জিজ্ঞেস করেন কেমন আছি। নিয়মিত উত্তর করতে পারি না৷ ভুলে যাই। ভুলে যাই ফোন করতে হত মাস্টারমশাইকে। লেখা দিতে হবে সম্পাদককে। আকাশ-বাতাস আর মানুষের ঘরবাড়ি একই বিস্ময়ে প্রতিদিন দেখতে দেখতে শুভক্ষণ পেরিয়ে যায় প্রতিবার।
কেমন থাকি আমি? বছরের সিংহভাগ সময়ে এ ঘরে ঘূর্ণাবর্ত চলে। উচ্চ অথবা নিম্নচাপে জর্জরিত থাকে মন। সবই আছে আমার। যা কিছু থাকলে স্বস্তি পাওয়া যেতে পারে, তবু মনে হয় সব ছেড়ে চলে যাই অশ্বত্থবৃক্ষ তলে। বৃদ্ধ সে বৃক্ষ দীর্ঘ-দীর্ঘকাল একইভাবে দণ্ডায়মান থেকে ইতিহাস লিখছেন নিজের বাকলে। নিজের লিঙ্গ-চেতনা ত্যাগ করে মুণ্ডিত মস্তকে সেই ইতিহাসমণ্ডিত ছায়ায় আশ্রয় নিতে চাই। এ পথ কঠিন। আরো কঠিন সব মনে রেখে সংসারযাপন। মানুষ ভুল বোঝে। সংসার ক্ষুদ্রার্থ নয়, সংসার বৃহদার্থ। তুমি, আমি আর সে-এর গণ্ডি পেরিয়ে তার দীর্ঘ জটিল এবং কুটিল শেকড় ছড়ায় দিগন্তরেখার ওপারে।
ঠাকুর বলে গেছেন সংসারে পাঁকাল মাছটির মতো থাকতে হয়। দীর্ঘসময় ধরে মায়ের গুনগুন ‘কথামৃত’ জন্মসূত্রে আমার কানে বাসা বেঁধে থাকে। পাঁকাল মাছ হওয়া যে কী কঠিন তা ঠাকুর জানতেন! সে-ই সাধনা। সংসারী মানুষের জন্য সেই সাধনা নির্দিষ্ট করে গেছেন। সকলে পারেন কি? সব মনে রাখব, সব প্রশ্নের উত্তর দেব, রাজনীতি-ধর্মনীতি-সমাজনীতি পালন করব, খাতায় লেখা দিনে মাস্টারমশাইকে ফোন করে কথার খেলাপ হওয়ার লজ্জা থেকে সামাজিক ‘আমি’কে ছায়া দিয়ে ঘিরে রাখব, আবার দিনের শেষের ক্ষণিক মৃত্যুশয্যায় সব ভুলে যাব। সব ত্যাগ করে যাব। ‘ত্যাগ’, এ যে কী বড় শব্দ! সব ছেড়ে একেবারে চলে যাওয়া তবু কিছু সহজ, কিন্তু প্রতিনিয়ত সব দিয়ে নিজেকে ঘিরে রেখে তার থেকে মনটা আলগোছে তুলে নেওয়া?
ঠাকুর যা মুখের কথায় বলেন, রবীন্দ্রনাথ তাকে সাহিত্যিক ভাষায় প্রতিসরিত শব্দে মুড়ে বলেন, মনের মধ্যে যে ইচ্ছেটা প্রবল তাকে ত্যাগ করতে পারাই হল স্বাধীনতা, প্রকৃত মুক্তি। কী কঠিন এ কাজ! অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে সুন্দর স্বর্ণালংকারে সজ্জিত হব আবার অনুষ্ঠান শেষে যার অলংকার তাকে নির্বিবাদে নিষ্কাম মনে ফিরিয়ে দেব, যেন কিছুক্ষণ আগের সুসজ্জিত আমি আসলে আমি নই, আর কেউ। এ কঠিন নয়?
আমরা হুড়মুড় করে ধর্ম আর সাহিত্য দুই-ই পড়তে থাকি। পরে পঠিত বিষয়কে নিয়ে ভাববার কথাটুকু ভুলি। কী ভাবব? যা পড়লাম, যা পড়েছি, যা দেখেছি সেসব ভাবব। সবই সাধনা। সাধনা, যা একদিনে, এককালে হয় না।
পাঁকের মধ্যে ঢুকতে হবে এ যেমন সত্য, তেমনি গায়ে পাঁকটি লাগানো চলবে না এ তার চাইতে অধিক সত্য। আমরা সত্যের একপিঠ দেখি। চাঁদের মতো সত্যের অপর পিঠটুকু দেখতে পাই না বলে তাকে অস্বীকার করি। স্বল্পবিদ্যা এটুকু বোঝে না তার অস্বীকারে সত্য মিথ্যা হয় নি কোনোকালেই।
যা সত্য তা চিরকালীন।