অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘সাদা’ দ্বিতীয় পর্ব

অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘সাদা’ দ্বিতীয় পর্ব

পূর্বে প্রকাশিত– প্রথম পর্ব

নীল

দরজায় দাঁড়িয়ে নীলা দেখল, ঘুমন্ত সদ্যোজাতটির ওপরে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে সে। তার নীল রঙের শাড়ির আঁচল লুটিয়ে বিছানা ছুঁয়েছে। তার পায়ের ছটফটানি থেমে গেছে।
নিশ্চিন্ত ঘুমের ভিতর সদ্যোজাত ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। ঠিক ওপরে লাইম অরেঞ্জ ওড়নার ফাঁস থেকে তার নিজের দেহখানা মিঠে হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে। এই হাওয়াটা সে চেনে। মধ্যরাতের পর সমস্ত ফাঁকা অলিগলি জুড়ে, কানাগলির ভিতরে, মাঠঘাটের পাশ দিয়ে এই হাওয়া বয়ে যায়। যেকোনো ঋতুর মধ্যেই এই হাওয়া তার নিজস্ব গন্ধ নিয়ে বইতে থাকে। পৃথিবীর এক প্রান্তর থেকে আরেক প্রান্তরে ফিসফাস ডাকের মতো বয়ে যায় এই হাওয়া। খোলা জানালা, হাওয়াটা ঘরের ভিতর একটি ঘূর্ণি তৈরি করেছে। ফলে নীল শাড়ি জড়ানো তার শরীরটা সিলিং থেকে ঝোলানো পুতুলের মতো দুলছে। দরজায় দাঁড়িয়ে কলঘরের আলো নেভাতে ভুলে গেল নীলা।
নীল রং কোনোদিনই প্রিয় ছিল না নীলার। নীল রঙের দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বিবমিষা জাগত তার। প্রথমে সে জানত না, কোন রং তাকে মানায়। কোনোদিনই সে বুঝে ওঠেনি কোন রং তার প্রিয়। কিন্তু নীল রঙের স্মৃতি রয়েছে তার ভিতরে। রোদ্দুর আর অন্ধকার যে একত্রে হাত ধরাধরি করে চলতে পারে, সেদিনের আগে কোনোদিনও বোঝেনি নীলা।
এই পাহাড়ি শহরটা থেকে দূরে, একটি নদীর শহরে বেড়ে উঠছিল নীলা। নদীটাকে ভালবাসত সে। প্রতিদিন বিকেল ও সন্ধের ঠিক মাঝ বরাবর যে ওড়না রঙের আলো ওঠে, ঠিক তখন নদীটার কাছে গিয়ে দাঁড়াত। সেই বাহানা জোগানোর বয়সে একদিন বেলা দুটোর ভরা রোদ্দুরে, শীতের ব্যাডমিন্টনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তের যোগসূত্রের মাঝে একটি আশ্চর্য কথা জেনে ফেলেছিল নীলা। উঠোন জুড়ে তখন রোদ্দুরের আলপনা। তিনতলা স্কুলবাড়ির চার ধারের বারান্দায় সবুজ রঙের রিবন বাঁধা মেয়েরা ছুটে বেড়াচ্ছে। কেউ ফিসফিস করছে, কেউ লুটিয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে, কেউ মগ্ন খেলায়, কেউ আসন্ন প্রেমের উত্তেজনায় স্থির। বিরাট উঠোন জুড়ে ফেদার কর্ক উড়ে বেড়াচ্ছে। পালকের খেলনা, ডানা নেই তার। নীলার মনে হচ্ছিল, একের পর এক পালক ছিঁড়ে পড়তে পড়তে একদিন কর্কটা উড়তে শিখে যাবে। বশ মানবে না, ছাদের দিকে উড়ে যাবে, পুকুরের দিকে ঘুরপাক খাবে, এই বন্ধ দরজার হল্লাহাটির বাড়িটায় আর ফিরবে না। ঠিক এমন কলতানের মাঝে সঙ্গী দিদি, নবম শ্রেণী, ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিমায় ভ্রূ নাচিয়ে বলেছিল, “স্কুলের কঙ্কালটা দেখেছিস?”
দেখেনি নীলা। তখনও টিউনিক, তখনও সাদা কেডস, সবুজ রিবন বাঁধা বয়সে কঙ্কাল দেখার সুযোগ হয়নি। নিষিদ্ধ আনন্দে ভরে উঠেছিল নীলার মন। সে ভেবেছিল, এই আনন্দ পেতে তার সবচেয়ে ভাল কলমটা দিয়ে দেবে নবম শ্রেণীর দিদিকে। প্রতিজ্ঞা করেছিল, এই আনন্দ নিয়ে বাংলা খাতার শেষ প্রান্তে লিখে ফেলবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কবিতা।
যেদিন সত্যিই সুযোগ এল, সেদিনও রোদের দিন। শীত শেষ হয়ে আসছিল। শুকনো মামড়ি ওঠা ঠোঁটে হঠাৎ লাবণ্যের জোয়ার এসেছিল। কে যেন, কে যেন তাকে ভালবাসবার কথা বলবে বলে জাগৃতি সংঘ ক্লাবের মোড়ে রুলটানা পাতার চিঠি হাতে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিনই বেলা দুটোর ভরা রোদে জীববিদ্যার ল্যাবরেটরির একটি জানালার একটি পাল্লা খোলা পেয়ে ভিতরে চোখ রাখতে বলেছিল সেই নবম শ্রেণী। সাইকেলের সারির ভিতর, সেই সাজানো রোদের আলপনাকে একটুও না ভেঙে সবুজ গরাদের ভিতরে চোখ রেখেছিল নীলা। ওই যে দূরে, লম্বাটে হল ঘরের প্রায় শেষপ্রান্তে নীল পর্দায় ঘেরা একটি কঙ্কাল ঝুলছে। উঠোনে রোদের সোনালী ফলা চোখে মুখে বিঁধে চলেছে। ভিতরে আধো অন্ধকারে নীল রঙের মধ্যে একটি কঙ্কালের আভাস। এই মুহূর্তে নীলার মনে হল, সেই কঙ্কালের মতো নীল পর্দায় ঝুলে আছে সে। এই সদ্যোজাত কে, সে চেনে না।
একটি তীব্র জংলা গন্ধে ভরে উঠল ঘর। কড়া গন্ধটাকে মন কেমনের চিহ্ন ভাবে সে। জংলা পাতার গন্ধ নাকে যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসল নীলা। সকালবেলার রোদ্দুরে ভরে আছে সাদা ঘর। সামনেই বিরাট আয়নায় সাদা ইউনিফর্মে তৈরি হয়ে নিয়েছে অয়ন। বেরোবার আগে প্রিয় জংলা গন্ধ মাখছে সে। জানালার কার্নিশে বসে ডানা পরিষ্কার করছে রোজকার বাজপাখি। পূর্বমুখী ঘর ভরে আছে সকালবেলার ব্যস্ত শব্দে। স্বপ্নটা আবছা হয়ে গেল।
মেঝেয় পা দিয়ে নতুন ধুলো, নতুন ঠিকানার কথা মনে পড়ল। চোখের ভিতর ক্লান্তিভাব জোর করে হটিয়ে উঠে পড়ল নীলা। দুটো ঘরের মাঝে ছোট্ট প্যাসেজ ও কলঘর। প্যাসেজে একটি ছোট্ট বেসিনে সে আকাশি রঙের কৌটো সাজিয়েছে। সবটা সাজানো হয়ে ওঠেনি। পিচবোর্ডের বাক্স ভর্তি বই, বস্তা ভর্তি বাসন, আর বিয়েতে পাওয়া শখের ফুলদানি, ঝগড়ায় পরম অভিমানে ভেঙে ফেলা ছবিও কাচ মুক্ত হয়ে সেজে ওঠবার অপেক্ষায়। এখনও ঘর করা শুরু হয়নি। অয়নের ছুটি শেষ।
হাতমুখ ধুয়ে ইলেক্ট্রিক কেটলিতে চটপট চা বসিয়ে দিল নীলা। গতকাল সন্ধ্যায় স্টেশনের বাজার থেকে ওরা দুটো চেয়ার কিনে এনেছে। চেয়ার দুটো বয়ে আনবার সময় দু’জনের ভারি আনন্দ হয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট আসবাবে ভরে উঠছে ছোট্ট ঘর দুখানা। সাধু জোহনের গির্জার নীচে দাঁড়িয়ে চড়া রোদ-বৃষ্টির দিনে এমন দিনের প্রার্থনাই তো করেছিল নীলা। এখন অল্প দূরে নতুন চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে অয়ন। কিছু একটা ভাবছে। গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে আছে ওর চোখ। মায়া হল নীলার। নতুন অফিসে আজ প্রথম যাওয়া। বহু স্মৃতি ও ভবিষ্যতের ভাবনায় বাঙ্ময় হয়ে আছে অয়নের নীরব মুখ। চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে গেল নীলা। টেবিলে কাপটা রেখে বলল,
– ভয় পাচ্ছ?
– ঠিক ভয় নয়। চিন্তা।
– সঙ্গে ঈষৎ মন কেমন?
– দশ বছরের সম্পর্ক রে নীলা! এত সহজে ছেড়ে আসা যায়?
– পুরনো চেয়ার ছেড়ে না আসলে, নতুন চেয়ারের মান রাখবে কী করে?
– বলা সহজ। কত মুখ ভাসছে এখন! আজ কত নতুন মুখের সাথে দেখা হবে।
– ধীরে ধীরে আজকের নতুন মুখগুলি অভ্যেস হয়ে উঠবে আর পুরনো মুখেরা পিছনের সারিতে যেতে যেতে আবছা হয়ে উঠবে।
– ছেড়ে আসা যদি এতই সহজ হত রে…
অয়নের কথার ভিতর সামনের দিকের পশ্চিমমুখী লম্বাটে ঘরটার চারপাশে চোখ বোলাচ্ছে নীলা। শুধু আসবাবই বসেছে যৎসামান্য। গোছানো হয়নি তেমন কিছুই। ঘরটার সিংহভাগ ফাঁকা। হঠাৎ নিজের ছেড়ে আসা ঘরের জন্য বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল নীলার। তার কণ্ঠবিহীন, উপস্থিতিহীন সেই ঘরে এখন কীভাবে সকাল হয়েছে ভাবল। তারপর বলল,
– আমাকে দ্যাখ, ছেড়ে আসা কত সোজা!
আলো ছড়িয়ে হাসলো অয়ন। হালকা লাগছে। তলানির চা-টুকু সুদ্ধু কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল। অফিস ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে বলল,
– বেরোলাম তাহলে। সাবধানে থাকিস।
হাসলো নীলা। গালে উষ্ণ ছোঁয়ার প্রত্যাশা ছিল তার। কিন্তু আগেই হাট খোলা দরজাটা দিয়ে কালো সদরের দিকে এগিয়ে গেছে জংলা পাতার তীব্র গন্ধটা। দরজা বন্ধ করে নতুন ঘরটা দেখতে শুরু করল নীলা। ঘুরে ফিরে শুধু বাবার মুখ মনে পড়ছে। কেন কে জানে! ভাবতে ভাবতে আলুথালু চুল নিমেষে বেঁধে ফেলল সে। আজ সারাদিন সে ঘর গোছাবে। সঙ্গী বাজপাখিটা কার্নিশে ঠায় বসে। ঘর গোছাতে গোছাতে গোছাতে গোছাতে নীল রঙের পর্দা, নীল রঙের শাড়ি, আর নীল রঙের স্বপ্নটা ভুলে যাবে সে।

ক্রমশ….

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes