
কবি অর্থিতা মণ্ডলের “যে জন্ম বেজেছে ফকিরি এস্রাজে”
বেবী সাউ
যে জন্ম বেজেছে ফকিরি এস্রাজে/ অর্থিতা মণ্ডল /হাওয়াকল পাবলিশার্স / প্রচ্ছদ- বিতান চক্রবর্তী/ মূল্য - ২০০
অর্থিতা মণ্ডলের কাব্যগ্রন্থ “যে জন্ম বেজেছে ফকিরি এস্রাজে” হাওয়াকল প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত, একটি চার ফর্মার কাব্য সংকলন, যা বাংলা কবিতার জগতে একটি অনন্য সুর বহন করে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলি বাউল দর্শন, প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক সংযোগ, জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব এবং অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কবি যেন কবিতার ভাষা এখানে করে তুলেছেন সংগীতময়, চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ এবং দার্শনিক গভীরতায় পরিপূর্ণ, যা পাঠকের মনকে একই সঙ্গে আলোড়িত করে এবং নিস্তব্ধ করে রাখে। চুপচাপ বসিয়ে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
“যে জন্ম বেজেছে ফকিরি এস্রাজে” গ্রন্থটির মূল সুর সুফি দর্শনের। জীবনের সরলতা, বৈরাগ্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা এই কবিতাগুলির মূল সুর। কবি অর্থিতা মণ্ডল দেখিয়েছেন জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বকে। তিনি জীবনের গানকে, প্রেমকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন গভীর আত্মদর্শনের দিকে। তিনি তাঁর এই কবিতাগুলোয় প্রেম, শোক, এবং অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নগুলিকে একটি সূক্ষ্ম সুতোয় গেঁথেছেন। এই গ্রন্থের কবিতাগুলি শুধুমাত্র আবেগের প্রকাশ নয়, বরং একটি দার্শনিক যাত্রা, যেখানে পাঠককে জীবনের গভীরতম সত্যের মুখোমুখি হতে হয়।
এই কবিতাগুলো জীবনের ভঙ্গুরতা ও সংসারের পাতানো কাঠামোর উপর একটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকোণ স্থাপন করে। “ঈশ্বরী আকাশ এবার উন্মুক্ত হলেন, স্বচ্ছ জলের সামনে সমস্ত পোশাক খুলে ফেলতে অপূর্ব রেখার মতো ভেসে গেল পাতানো সংসার”—এই পঙ্ক্তিগুলি একটি মহাজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জীবনের অস্থায়িত্বকে তুলে ধরে। “হাওয়া আর হাওয়া, ঝোড়ো বাতাসের মধ্যেই ভেসে যাচ্ছে আমি তুমির কথকতা” পঙ্ক্তিতে সম্পর্কের ক্ষণস্থায়িত্ব এবং জীবনের অধরা স্বরূপ ফুটে ওঠে। কবিতাটি একটি মুক্তির গান, যেখানে সংসারের মায়া থেকে মুক্তির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে।
“জাল” কবিতাটি পৌরাণিক উপাদানের সঙ্গে আধুনিক জীবনের সরলতার এক অপূর্ব মিশ্রণ। সিগার্ডের ড্রাগনের হৃদয় খাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনে কবি ঈশ্বর ও ঈশ্বরীর প্রেমের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনের সৌন্দর্যকে (যেমন, “এক কাপ কফিই যথেষ্ট”) জুড়ে দিয়েছেন। “এক কাপ কফিই যথেষ্ট” এবং “ঈশ্বর ঈশ্বরীর প্রেম” এর মতো চিত্রকল্পে আধুনিক ও প্রাচীনের মধ্যে একটি সেতু তৈরি হয়। “ফুৎকারে” শব্দের মাধ্যমে কবি একটি অলীক সুতোর উল্লেখ করেছেন, যা জীবনের অস্থিরতা ও সৌন্দর্যকে ধরে রাখার প্রচেষ্টাকে বোঝায়। এই কবিতা পাঠককে একটি রহস্যময়, কিন্তু গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দিকে নিয়ে যায়।
তেমনি “সম্পদ” কবিতাটিও এক বৃদ্ধের জীবনের মধ্য দিয়ে বৈরাগ্য ও প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্কের কথা বলে। “দীর্ঘ দীর্ঘ এই গাছ, বৃদ্ধ বসে আছেন / কাপড়ের পুটুলিতে নিজস্ব সংসার/ কাপড়ের পুটুলিতে নিজস্ব সংসার/ অনির্দিষ্ট রাস্তা চলে গেছে, চোখের /ভেতর নিস্তব্ধ মায়া/ অরণ্যের থানে রেখেছে অভিমান, ফল মূল উপাচার।” পঙ্ক্তিগুলি একটি সরল জীবনের প্রতি ঝোঁক এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার কথা বলে। “নাক্ষত্রিক উপমহাদেশ” বা “স্রোতস্বিনী প্রেম” এর মতো চিত্রকল্প কবিতাটিকে একটি মহাজাগতিক মাত্রা দেয়। বৃদ্ধের বলিরেখায় কিংবদন্তীর ঘন জটলার উল্লেখ কবিতাটিকে একটি প্রাচীন জ্ঞানের স্তরে নিয়ে যায়, যেখানে জীবনের অভিজ্ঞতা ও প্রকৃতির সঙ্গে মিলন একটি কালাতীত সত্যে পরিণত হয়ে যায়।
আবার “সংসক্তি” কবিতাটি শোক ও কামনার মধ্য দিয়ে জীবনের অস্তিত্বগত দিকটির প্রশ্ন তুলে ধরে। “নিদারুণ শোক হেঁটে আসে দেখো / এ-এক বিস্মিত অভিশাপ” পঙ্ক্তিগুলি শোকের একটি পার্থিব ভৌতিক উপস্থিতি তৈরি করে। এখানে প্রত্ন গুহালিপি, লাল সুতো এবং অদ্ভুত দহনের মতো বিভিন্ন চিত্রকল্প ব্যবহার করে একটি অলীক সংসারের ধ্বংস এবং পুনর্জননের কথা বলেছেন কবি। কবিতাটি শোকের মধ্যেও একটি আশ্রয়ের দিকে নিয়ে যায় আমাদের।
প্রসঙ্গক্রমে আমরা যদি “অনামিকা” কবিতাটি পড়ি দেখতে পাব এক অন্য উপলব্ধি। এই কবিতাটি এই সংকলনের মধ্যে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ও বিষণ্ণ কবিতাগুলির একটি। “সমস্ত পাথর সাদা হয়ে গেছে, নিঃসঙ্গ চাঁদ শুষে নিল শোক” বা “শ্যাওলার ঘ্রাণ জীর্ণ মন্দির চুঁইয়ে নামে জল” এর মতো পঙ্ক্তি পাঠকের মনে এক গভীর শূন্যতার দিকে নিয়ে যায়। কবিতাটি প্রকৃতি, শোক এবং নিঃসঙ্গতার মধ্য দিয়ে যেমন নিয়ে যায় পাঠককে, তেমনি একটি নামহীন অস্তিত্বের সম্মুখীনও করে। “বাউলের ব্যাপ্ত হাহাকার” মিলেমিশে যায় বাউলের দর্শনের সঙ্গে। মাঠঘাট প্রান্তরের সীমানা ছাড়িয়ে মানব মনের সঙ্গে অক্ষরের গভীর সংযোগ ঘটিয়ে তোলে।
অর্থিতা মণ্ডলের কবিতার শক্তি তাঁর ভাষার সংগীতময়তা, ঘন চিত্রকল্প এবং দার্শনিক গভীরতায়। তাঁর কবিতাগুলি একই সঙ্গে আধুনিক ও প্রাচীন, স্থানীয় ও মহাজাগতিক। প্রকৃতির উপাদান—যেমন হাওয়া, গাছ, চাঁদ, শ্যাওলা—তাঁর কবিতায় একটি জীবন্ত চরিত্র হিসেবে উপস্থিত। পৌরাণিক উল্লেখ (যেমন, সিগার্ডের ড্রাগন) এবং আধুনিক জীবনের সরল উপাদান (যেমন, এক কাপ কফি) এর সমন্বয় তাঁর কবিতাকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
কবির চিত্রকল্প অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বহুস্তরীয়। যেমন, “নাক্ষত্রিক উপমহাদেশ” বা “অপূর্ব মৈথুন ভাস্কর্য” এর মতো চিত্রকল্প পাঠকের কল্পনাকে এক মহাজাগতিক পরিসরের দিকে নিয়ে যায়। তাঁর ভাষা সংগীতময় এবং প্রবাহমান, যা পড়তে গিয়ে মনে হয় যেন একটি এস্রাজের সুর বাজছে। এই সংগীতময়তা গ্রন্থের শিরোনামের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আগেই বলেছি, সুফি দর্শন এই কাব্যগ্রন্থের মূল প্রাণ। কবি বারবার সংসারের মায়া, বৈরাগ্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার কথা বলেছেন। তাঁর কবিতাগুলি শুধু আবেগের প্রকাশ নয়, বরং একটি দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন, যা পাঠককে জীবনের গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি করে।
গ্রন্থটির একটি সম্ভাব্য সীমাবদ্ধতা হল এর ঘন চিত্রকল্প এবং দার্শনিক গভীরতা, যা সাধারণ পাঠকের কাছে কিছুটা জটিল বা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। কবিতাগুলির ভাষা ও চিত্রকল্প এতটাই সমৃদ্ধ যে, এগুলি পড়তে গিয়ে পাঠককে ধীরে ধীরে গভীরে ডুব দিতে হবে। একাত্ম হতে হবে কবির ভাবনার সঙ্গে। যাঁরা হালকা বা সরল কবিতার প্রতি ঝুঁকেন, তাঁদের কাছে এই গ্রন্থটি কিছুটা চ্যালেঞ্জিং মনে হতে পারে। তবে যাঁরা কবিতার গভীরে ডুব দিতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য এটি একটি অমূল্য রত্ন।
“যে জন্ম বেজেছে ফকিরি এস্রাজে” একটি কাব্যগ্রন্থ এখানেই পাঠের দাবি রাখে। অর্থিতা মণ্ডলের কলমে ফকিরি দর্শন, প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক সংযোগ এবং জীবনের অস্তিত্বগত প্রশ্নগুলি একটি অপূর্ব সুরে বেজে উঠেছে। এই গ্রন্থ পাঠককে একই সঙ্গে জীবনের গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি করে এবং তাঁদের মনকে সৌন্দর্য ও শান্তিতে ভরিয়ে দেয়। বাংলা কবিতার প্রেমীদের জন্য এটি একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ, যা পড়ার পর দীর্ঘক্ষণ পাঠকের মনে একটি এস্রাজের সুর ধ্বনিত হতে থাকে।
এটি একটি এমন কাব্যগ্রন্থ যা ভাষা, চিত্রকল্প এবং দর্শনের সমন্বয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতার পথে অভিযাত্রী করে তোলে। কবিতার মধ্যে গভীর দর্শন ও সৌন্দর্যের সন্ধানী করে তোলে।