
হ্যাঁ, প্রিয়তম
অরুণাভ সরকার
দ্য কিং ইজ ডেড।
তবু নশ্বরতা ওঁকে গ্রাস করতে অক্ষম। বাংলা গদ্য-সাহিত্য অভিভাবকহীন হল–––– আবার। জীবনাবসান হল সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের। কিন্তু রয়ে গেল ওঁর সমগ্র-রাজত্ব। সন্দীপন কাজ করেছেন সেই ধূসর জগতে যেখানে যাওয়ার সাহস বা ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মাত্র কয়েকজন । আর ওঁর জগৎ ছিল ভাষার জগৎ–––– বিচিত্র অনুভূতি ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। কিন্তু কখনও হাঁটেননি নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে। হ্যাঁ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আমাদের দেখিয়েছেন একই লেখা কতবার, কত প্রেক্ষাপটে, কত পরিস্থিতিতে কত রকমভাবে লেখা যায় । যা ছিল ছোটগল্প – হয়ে গেল উপন্যাসের অংশ আবার কোন উপন্যাসের অংশ–––– ছোটগল্প । ওঁর ভাষার আদল, গদ্যের মনোলোক কবিতা-নির্ভর । সেখানে অকাতরে গ্রহণীয় দেশী-বিদেশী যেকোন কবি । আমাদের নাগরিক মননকে সন্দীপনের মতো আর কে-ই বা চিনেছিলেন–––– আমাদের যৌনতার মুহূর্তগুলোকে তার আনন্দ, উত্তেজনা, সঙ্কট ও বিষণ্নতাকে । সেই ১৯৬২ তেই গুডবাই ন্যারেটিভ। কাহিনিকে বলেছিলেন কাহিনি নির্ভরতা ত্যাগ করতে। বাংলা গদ্যের অস্থানে চুম্বনের স্বত্ব সন্দীপনের। কল্পকাহিনি থেকে সরে এলেও ওঁর গল্পের মূল ভিত্তি ছিল–––– সম্পর্ক । মানুষের সঙ্গে মানুষের । তথাকথিত কাব্যিকতা থেকে দূরে । কঠোর, রূঢ়, বাস্তব কিন্তু কাব্যময় ।আসলে এতদিন একজন জীবিত লেখক আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে দেখাচ্ছিলেন লেখালেখি কারে কয় । কীভাবে কতভাবে পাঠ করতে হয় । এমনকি এই তো সেদিন–––– স্বর্গের নির্জন উপকূলে–––– এরকম বাঁকবদল, বাংলা উপন্যাস আর কতবার দেখেছে। সন্দীপন নিখুঁত দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন ওঁর প্রত্যেকটি লেখার শিরোনাম। এর জন্য অকাতরে গ্রহণ করেছেন অন্যের লেখা, কবিতা, গান এমনকি অন্য উপন্যাসের নামও। তবে সবই আত্মস্থ করে জন্ম দিয়েছেন অন্য এক জাতকের । সন্দীপন ছিলেন মানবদরদী, রাজনীতি-সচেতন । থেকে গেল সন্দীপনের নিজস্ব বিদ্যালয় ওর ঘরানা। যদিও ঘরানা ভেঙে দেওয়াই ছিল ওঁর গেরিলা যুদ্ধের লক্ষ্য। হ্যাঁ, সন্দীপন বারবার যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এমনকি নিজের বিরুদ্ধেও। যতদিন বেঁচেছেন, ততদিন লিখেছেন। কারণ ওঁর জীবনই ছিল লেখালেখি। এবার আরও একবার আমরা পাঠ করি ওঁর লেখাগুলো। আর যা কিছু আজও আমাদের চোখে পড়েনি তা আলোকিত হোক। ওঁর অনশ্বর লেখালেখি বারবার স্পর্শ করুক আমাদের মুখ, চোখ –––– সমস্ত শরীর।
(সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসানের পরে আদম পত্রিকায় প্রকাশিত)