
সুপ্রভাত মেট্যা-র কবিতাগুচ্ছ
ঈশ্বর দর্শানো
আমার হাজার দুঃখ তখন
নুনজলে ভিজে ভিজে সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে ।
ভালবাসার ঋণ-ঘরে জমা হচ্ছে
আমার সহস্র দিনের পুরোনো কবিতা। বছর পরেও তোমাকে যে
একটু টুকে রাখব, এবং তা কোন ঘরে, সে ক্ষমতাও হলনা আমার আর।
আর ভরা গঙ্গার অবিরত দুঃখের ভিতর প্রেমের অক্ষর ক্ষুধা পান করতে করতে
কখন সত্যিকারের কবিতা হয়ে উঠব; না, তাও জানা নেই আমার। আমি
শুধু বিশ্বাসের আয়ু মাপতে গিয়ে দেখি, কয়েক সেকেন্ড আগেই নাকি সে মারা গেছে,
আমাদের আনন্দ ঠিকানায়। তবু উদাসী হাওয়া একদিন জানি
ঝড় হয়ে ছুটে বেড়াবে দুপুরের পথে। আর সেই ঝড়ের ঘর্মাক্ত দৌড় থেকে,
পরাজয় ছিলতে ছিলতে, একটি সরু সাফল্যের লাঠি বেরিয়ে আসলেই
সূচাগ্রের মতো আমিও একদিন জানি তোমাকে ঈশ্বর দেখাতে পারব।
স্বপ্ন ও ঈশ্বর
ফুলের বয়স পেয়ে সুন্দর ঝরে গেল যে কবিতা, অমর……
মাটির গভীর থেকে উপরে, আরও উপরে যে বেড়ে উঠছে গাছ,
সে মাটির সন্তান। বাম হাতের খেলায় ডান হাতের ফলন, না,
সে কখনওই সাফল্যের নয়। এইযে চালে জল দিয়ে যে উষ্ণতা কিংবা ভাতে
জল দেওয়ার শীতলতা, দুটোই আহার্যের;
তবু কি ভিন্ন ধর্মের নয়? ভিন্ন স্বাদের? কিংবা ভিন্ন ভিন্ন কোনও মানুষের?
আলোর দেখাদেখি মুখ তুলে চেয়ে আছে এখন আমার স্বপ্ন,
আমার ভোরের স্বপ্ন। যেভাবে হাওয়ার ভেতরে পাতা নড়ে ওঠার
প্রবাহ কবিতা, শব্দ উঠলেই ঝড় হয়; ঠিক সেইভাবে
এক-এক পংক্তি এগিয়ে যায় আমার জীবন। আর আমি
বিকেলের রৌদ্র হয়ে উঠি। কবিতার হাত ধরে ধানজমির
মাঠে হেলে পড়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখি, ক্রমশ মনে পড়ছে
আমার জন্মমাস তুলে ধরা আমার
কিশোরী মায়ের স্বপ্ন ও ঈশ্বর……
অশ্রুজ ইতিহাস
স্পর্শে বিভোর হয়ে আছো সকাল।
একটা রঙিন দৌড়ের স্বপ্ন ভেসে বেড়ায়।
কুটিরের গায়ে এসে ভোর লাগে।
সেই পত্রপুষ্প ভোরে শিশির অক্ষত রেখে উঠে আসে
পূবদিকের আলোর এক নতুন কবিতা।
অক্ষরে অক্ষরে জেগে ওঠে খুশি। পাতায় পাতায় নড়ে ওঠে সময়।
সেই সময়, বয়স তখন হালকা হাওয়ায় ভেসে যাওয়া
ধুলোবালির অলিখিত খেলনা ঘিরে
বালক বালিকার তুমুল লেনদেনে ঘটে যায়!
তড়িৎ খেলে যায় বুকে। প্রাণখুশির প্রথম এক শীর্ষ শিহরণ
কী যেন এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে ওঠে!
তারপর অন্ধকার, রহস্য…..
অন্ধকার আসলে নির্জনতা মেনে নেয় বলেই এত রহস্যের।
আলো থাকতে থাকতে তাই
এখনও অনেক মানুষ তুমি চিনে নিতে পারো।
স্থিত স্মৃতি, মানেই সে এক অশ্রুজ ইতিহাস।
সেই ইতিহাস নিয়ে বেঁচে থাকাটা কারুণ্যের হলেও,
এই সত্য, বর্তমান পেরিয়ে তোমাকে
ভবিষ্যতের একদিন অবশ্যই দিশা দেখাবে।
আপনাকে বলছি
যেকোনও গ্রামীণ আলোর কাছাকাছি
একটা সহজ মানুষ থাকলেই সবুজ হয়ে ওঠে মন।
আনন্দে ভরে যায় ঘর। সন্তান খুশির ছায়া পড়ে এসে বুকে।
এখন কঠিন সময়। হৃদয় থেকে মানবিক রস নিঙড়ে
শুকনো করে তুলছে হাওয়া। আমাদের কুটুম্ব লতিকায়
শ্যাওলা জড়িয়ে সম্পর্ক শেষ হয়ে আসছে ক্রমশ।
তবু দেখি মা তাঁর আঁচলের লবন সিক্ততায়
সংসারী কষ্টের ঘাম, না, কোনও দুঃখ নয়, এই ভেবে
স্নেহের সন্তান মুখে তিনি আজও
দুগ্ধবাৎসল্যের এক ইতিহাস লিখে চলেছেন!
ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠছে শহর এখন। হৃদয় ছাপিয়ে
শরীর বড় হয়ে উঠছে, লাবণ্যে, আরোগ্যে, চকচকে…..
খুলতে গিয়েও খুলতে পারলাম না, এমনই জানলার চারপাশে
তাকিয়ে থাকা নির্লজ্জের চোখ, নির্জনতা দেখবার জন্য
গোপনে ঘুর ঘুর করছে আমার। আমি কি ক্রমশ
ভারহীন, ধারহীন, শূন্যপ্রায় এক জীবন হয়ে পড়ছি?
হ্যাঁ, আপনি, আপনাকে বলছি।
শহরের বেড়ে ওঠা শিকড়ের নীচে মাটির রসদ জোগানো
মানুষের খবর কি কখনও নিয়েছেন আপনি?
আনন্দ ও মনখারাপ
কপালে ভীষণ আগুন খেলে গিয়ে এখন পুড়ে যাচ্ছে সুখ।
হারিয়ে যাওয়ার দুঃখ মনের খাতায় লেখা হচ্ছে আমার।
হৃদয় দিয়ে এই মুহূর্তে আর এক হৃদয়ের আলোকে ছিনিয়ে নিয়ে
এসে আমি ভাঙতে চাই বুকের ক্ষত অন্ধকার। হাওয়ায় উড়তে উড়তে
এমন একটা স্বপ্ন শূন্যতায় এখন ভেসে যাচ্ছে আমার চোখ,
যেখান থেকে আর কোনও কবিতাই আসছে না আমার।
বেশি দূরে চলে যাওয়া ভালবাসার মানুষটির মতোই
ফিকে হয়ে আসছে সব।
তবু প্রাত্যহিক রাত্রি কিছু লিখে যায় এখনও আনন্দ ও মনখারাপ আমার।
দুপুরের গাঢ়ত্বে স্পষ্ট হয় খিদে। তবে কি আমি পরাজিত তাই?
ব্যর্থতায় ব্যথিত বৃষ্টিরাশির এক কালো মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছি এ-আকাশ থেকে
অন্য আর এক আকাশ? না। উনি আমার ভেতর থেকে এসে খানিক মৃদু
হেসে বললেন: হেরে যাওয়া কোনও অপমানের অন্ধকার নয়;
যদি তাতে প্রাণপন উতরে যাওয়ার এক অনাবিল আগ্রহ না থাকে!
অক্ষর শিশুর নতুন কণা
তুমি হাসতে হাসতে অশ্রু বেয়ে নেমে আস আমার কবিতায়।
গ্রামের রাস্তায় তখন পায়ে পায়ে ধুলো জমে, সকাল বালকের।
পাড়ার মেয়েরা হলুদ রঙিন, নতুন হাওয়ায়,
ধান ক্ষেতের পাতায় পাতায়…..
দৌড় শুরু হয়।
বসে থাকার বিষয় আসলে কোনও আলোর হয় না;
নিশ্চিত অন্ধকারের। ভালো বলে যাকেই টানি, সেও হয়ে আসে
অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের দিকে ধুলোর আদর গন্ধে
একটা বৃষ্টি শরীর ছুটে যায় আমার। ভাঙা টালির ভেতর দিয়ে
বিবাহের চন্দ্র আলো এসে ঢুকে পড়ে।
আর তুমি সুন্দর বললেই সমস্ত পৃথিবী আমার স্বর্গ হয়ে ওঠে।
এই দুইহাত পেতে কবিতা চেয়েছি-
তুমি ধুলোর অশ্রু ভেবে অক্ষর শিশুর নতুন কনা
উড়িয়ে দিলে বৃষ্টির বাতাসে; যেখানে
স্বপ্নস্নাত আমার দুইচোখ, পংক্তিমালা, আর খুশি…….
তারাকথা
এখন বর্ষার গ্রামে বৃষ্টিরা নেমে আসছে মায়ের স্বভাবে।
কথা ভারি হয়ে আসছে নকল অন্ধকার।
হালকা হয়ে আসছে পথ।
এমন শ্রাবণদিনে শস্যসময় তবু আলো হয়ে ফোটে।
পাতা ভরে যায় শাখায়।
ফসল গন্ধে খুশির হাওয়া বয়ে যায় গ্রামে।
দ্যাখো গ্রীষ্মসময়,
মায়ের আঁচল শ্রমে দুঃখকালীন ঘাম এবং কষ্ট ফুটে ওঠে।
আর আমার প্রেমিকা-বয়স, সে শুধু হেরে যাওয়া রোজগার করে
রোজ, হাজার অশ্রুর বিনিময়ে।
এবং ক্ষুধার আগুনে রান্না করে, দুঃখদইপুরি।
বিকেল নামে, বোনের আদুরে বেলায় এখন ধুলোর রাস্তায়।
একটা হলুদ পাখি উড়ে যায়, শেষলগ্নে ভাইয়ের মন টুকে নিয়ে।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, নীরবতা।
তবু সেই অন্ধকারের শরীরে আলোর তারাকথা ভেসে ওঠে।
আমি দেখতে পাই, খাতা ও কলমের
দূরত্ব-সম্পর্কের আমার সমস্ত লেখা নিভে যাচ্ছে মৃদু!
অনুপম রূপ
রৌদ্র স্পর্শের ঠোঁট
উঠোনে চাদর গায়ে হলুদ মেয়েটির, নড়ে উঠছে।
শৈত্যসম্মেলনের হাওয়া বইছে মৃদু।
এ, ওর বালিকা স্বভাবের দিনগুলি ঘেঁটে দিয়ে
আলো নাইছে শরীর-
চমৎকার ফুটে উঠছে ফুল ও পাতায়।
লাবণ্য ঝরে পড়ছে নুন থেকে।
ডানার দুঃখভারে পথ চলছে সময়।
তবু কবিতা শোনাবার দিন
রাত্রি থেকে উঠে এসে বসে পড়েছে দাওয়ায়।
প্রেমিকাভালোশিশির পায়ে তার নরম ধুলো,
আর্দ্র হৃদয়, জলে টইটুম্বুর চোখ,
ঝাপসা কুয়াশা মাখা ঘন অরণ্যের দারুণ রহস্যের কাছে
ধ্যানমগ্নসন্ন্যাসীর সাহসী
অনুপম রূপ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মৃদু
মেঘের গভীরে ভয়ের আর্দ্রতায় বৃষ্টি ভিজে ফুটে উঠল সকাল।
এমন সকাল আমি কখনও ভাবিনি।
বজ্রগর্ভে ভরে উঠছে সুখ। বালক পাতায়
খেলে বেড়াচ্ছে আমার অমনস্ক সময়।
একটা অন্ধকারের জন্য আর একটা অন্ধকার এসে
বাঁসা বাঁধছে এখন আমার বুকের ভিতর।
আমি ক্রমশ অন্ধ হয়ে পড়ছি।
আলো ফুটিয়ে তোলে যে উন্মুক্ততা আমি তার কিছুই দেখতে পারছি না আর।
এখন, এই সময়ে, তোমাকে মনে করা
আমার এগিয়ে যাওয়ার খোরাক, ভেবেও,
আমি ভাবতে পারছি না কিছুই।
আমার চাওয়া-পাওয়া সব ধুয়ে যাচ্ছে অশ্রু সন্ধ্যার জলে।
উঠোনে, আনন্দদিনে, আমার এই অপার হৃদয়ে
যে ফুটে থাকত গ্রামীণ ধুলো ও কবিতা
তারাও আজ দেখি ফসলগামী সাফল্যের
অশেষ দুঃখ এবং কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে মৃদু……
দক্ষিণ দুয়ারে ভোর
তারপর বাতাসে ভোরের আলোয় মিহি উড়ে বেড়ায় রাত।
সকাল নামে। ভালো লেখার দিন ফুটে উঠে ধুলায়।
তারও পরে আলো আরও সুতীব্র হয়ে ওঠে, কবিতা।
দগ্ধাদগ্ধি হয়। বেড়ে ওঠে ক্ষুধা। হায় ক্ষুধা-
প্রেমিকাকে ব্যর্থতা দিয়েছ যতখানি তার চেয়েও বেশি,
ক্ষতে লবণ ছিটিয়ে জ্বলন বাড়িয়েছ আমার। আমি চুপ হয়ে থাকি তবু।
অবশেষে, তাপে-উত্তাপে দুপুর গড়িয়ে, গ্রামের বাউল বিকেলে গেরুয়া আলো
এসে দেখি সন্ন্যাসিনীর সন্ধ্যা যাত্রা দেখাবার জন্য প্রস্তুতি নেয়। স্বপ্ন দেখায় তারা;
যে স্বপ্ন চন্দ্র মেঘের ভেসে যাওয়ায় ওঠে এবং
যা কখনও বৃষ্টিতে ভিজে স্নানযাত্রার হতে পারে না, বলেছিলে তুমি।
তবুও আদিমতায় ফিরে আসে সময়, একসময়।
অন্ধকার নেমে আসে ফের। সভ্যতার ভারে, মানুষের হিংস্র
গোপনানুভবতার সাথে সাথে, সচেতন
নেতা-হাওয়া-মহোদয়ের ঘাড়ও এদিক ওদিক ঘুরে যায় তখন।
অসময়ে আয়ুর সংলাপ বার্তা আনে, যাওয়ার…..
তবু, হে আমার প্রার্থনা, তোমার নামে, যেন, যা-হয় প্রভু,
সোনা ফলে স্বপ্ন নামুক, আমার দক্ষিণ দুয়ারে ভোর।