নারী শরীরের অব্যক্ত কথা  <br />সোনালী চন্দ

নারী শরীরের অব্যক্ত কথা
সোনালী চন্দ

শরীর ও মন- এই দুই পরিসর একে অপরের সাথে বিভিন্ন ভাবনা চিন্তার এক বিশাল ভান্ডারে প্রসারিত। শরীর যখন কর্ম, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সমস্ত ক্ষেত্রকে ছাপিয়ে আত্মা আর মন দেহতত্বের সাথে একাকার হয়ে ওঠে, তখন আসলে মনই সেই শরীরবাসার এক বিশেষ অঙ্গ হয়ে ওঠে। মন ও শরীরের সম্পর্ক নিয়ে একটু পিছিয়ে দার্শনিক তত্ত্ব পড়লে আমরা বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দার্শনিকদের ব্যাখ্যা জানতে পারি।

যেমন- সাইকোফিজিকাল অদ্বৈতবাদের মতে- মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য একই সত্বার অংশ। এই তত্ত্বের অনুসারী দের মতে, মন ও শরীর দুটি ভিন্ন সত্বা নয়, বরং একই ঘটনার দুটি ভিন্ন দিক বা প্রকাশ।

মনের টানে কখনও কখনও মানুষ আর সামাজিক মায়ার ঘেরাটোপে শান্তি খুঁজে না পেয়ে মনের টানেই দেহকে ছেড়েছেন অসীম অথবা কোনও আধ্যাত্মিক উত্তরণের পথে।
আবার কেউ এই শরীরেই খুঁজে পেয়েছেন তাঁর অভীষ্ট মহাশক্তিকে। যেভাবেই দেখা যাক না কেন, সব ক্ষেত্রেই শরীরের আসল ধারক হয়ে উঠেছে মন, মনন আর চিন্তন।

সেই তত্বকে ভিত্তি করে যুগের পর যুগ ধরে আমাদের ই গ্রামীণ সমাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই শরীরকে খাদ্যের যোগান দিয়ে যে কৃষক সমাজ স্থিতিশীল রেখে চলেছে, মনের তাগিদ সেখানেও আছে।
যে মৌ পালক সমাজ সযত্নে মৌ পালন করে ফুলের পরাগ মিলন ঘটিয়ে চলেছে, আমরা সেই কৃষক অথবা মৌ পালক সমাজের ব্যক্তিগত চিন্তা, পরিকল্পনার কাঠামো, মনের তাগিদে চিন্তা ভাবনা প্রসারিত করে আরও উন্নত ফলনের স্বপ্ন দেখে চলেছে, আমরা কতটুকুই বা তাঁদের মনের অথবা শরীরের খোঁজ রাখতে পারি।
গ্রামীণ সমাজের প্রত্যেক ক্ষেত্রে কৃষি থেকে শুরু করে তাঁত বোনা, রান্নাঘর থেকে আঁতুড়ঘর সামলানো, সব্জির ফলন থেকে সন্তানের জন্ম, একই সাথে নিজের শরীরে আরও এক শরীর ধারণের পাশাপাশি মন এবং চিন্তার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে পৌরাণিক দেব দেবীদের বিভিন্ন পরবে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়ায় নারী শরীর এবং মনের সঙ্গে পুরুষের ও ভূমিকা উজ্জ্বল। যদিও সেক্ষেত্রে অবশ্যই স্বীকৃতির সম্মানের প্রশ্ন আসে।

আজ এমন একজন স্বাধীন গবেষকের এই গ্রামীণ নারীদের শরীর, মন এবং সৃষ্টির গবেষণাধর্মী বই এর আলোচনা করব যাঁর গবেষণা থেকে উঠে এসেছে এমন অজানা সব তথ্য যা আমরা বাংলার বাসিন্দা হয়েও আমাদের কাছে এখনও অজানা; অবশ্যই এ আমাদের লজ্জা নয়, আমাদের অক্ষমতা, আমরা সেই গ্রামীণ সমাজের নারীদের সৃষ্টির সংগ্রাম কে জানার চেষ্টা করিনি।
গবেষক, লেখিকা চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়-এর গবেষণাধর্মী বই ‘ শরীর কথায় মেয়েরা ‘ সম্পর্কে লেখার ধৃষ্টতা মার্জনীয় কারণ এই বইয়ের গভীর গবেষণার প্রতিটা জেলার, গ্রামের, সম্প্রদায়ের, জাতির আলাদা আলাদা সৃষ্টির সেই সৃজনকে এত ক্ষুদ্র পরিসরে কতটা আলোকপাত করতে পারবো আমি নিজেও জানিনা। কারণ এই বইটা পড়তে আমার কমপক্ষে সাড়ে সাত মাস লেগেছে যার প্রতিটা ছত্রে নতুন নতুন আশ্চর্য সব সৃষ্টির কথা গানের তথা স্থানীয় ভাষায় ছড়া এবং গানের কলি এই বইয়ের মাধুর্য তাকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে।

কিছু আলোচনায় আসার আগে আমার আনত শ্রদ্ধা চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় দিদিকে যাঁর প্রতিভা সম্পর্কে আমায় আগে একটু আলোকপাত করতে হবে। পেশায় ইংরাজি সাহিত্যের শিক্ষিকা
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষা শুধু নয়, বরং বাংলার এবং বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার প্রতি তাঁর মনের টান অনুভব করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছর, পড়ে থেকেছেন এমন সমস্ত গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মধ্যে, এমন সমস্ত জেলায়, যেখান থেকে থাকতে থাকতে সেখানকার যাপন ,সংস্কৃতি, বিশেষত নারীদের সংগ্রামের এবং সৃষ্টির কথা একের পর এক তাদের নিজস্ব ভাষার এবং সুরের গানের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

পাঠক তথা এই প্রতিক্রিয়া যাঁরা পড়ছেন, আশাকরি তাঁরা বুঝতে পারছেন , কত গভীর অনুরাগ, এই কাজের প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসা এবং মনের তাগিদ না থাকলে এমন একজন ইংরাজির শিক্ষিকার গবেষণার পরিধি সুদুর জলপাইগুড়ির গ্রামীণ সংস্কৃতি, আবার বাংলাদেশের ফরিদপুর, রংপুর, আবার আমাদের রাজেন্দ্র কোচবিহার, আসামের শিলচর, করিমগঞ্জের গ্রামীণ নারীদের জীবনের আখ্যান অনায়াসে তাঁর লেখায় এবং গানে তিনি তুলে এনেছেন সেখানকার স্থানীয় নারীদের সুর, লয়, ছন্দ ও ভাষায়!

মুর্শিদাবাদ থেকে মালদা, কোচবিহার থেকে করিমগঞ্জ, গোয়ালপাড়া থেকে ময়মনসিংহ , সুন্দরবন থেকে ফরিদপুর…আমি এখানে তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রের ব্যাপ্তি জানালাম।
বলতে দ্বিধা নেই যে আমি যখন তাঁর ‘এক নারী শরীরে আরও একটা প্রাণ ধারণ করার প্রক্রিয়া থেকে মাতৃজঠরে জলাধারে পুরুষের প্রবেশকে ‘ডুব দেওয়ার’ বলে উল্লেখ করেছেন পূর্বনারীরা ‘ আমার মনে হয়েছে এত পড়াশুনো আমার বুঝি সবই বৃথা যদি আমি এই তথ্য পড়তে পড়তে না জানতাম।
মূর্খামি নয়, সম্পূর্ণভাবে বলা যেতে পারে অজ্ঞতা। আমার মত হয়ত অনেকেই এই তথ্য জানেন না, অথবা জানেন। কিন্ত লেখিকার এই বই ‘ শরীর কথায় মেয়েরা’ তে তিনি তথ্য সহকারে যখন সেই সমস্ত গানের আলোচনা করেছেন যা দেশ, স্থান, জেলা, গ্রাম অনুসারে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গানে উঠে এসেছে, আজ আমরা এই বই না পড়লে জানতে পারতাম না।

যত আশ্চর্য লেগেছে তাঁর গ্রামীণ মেয়েদের যাপন ধারা বিভিন্ন সুর, ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরা , তেমনই তাঁর পুরাণ কথার দেব দেবীদের নিয়ে সুদুর বিস্তৃত আলোচনায় উঠে এসেছে আসামের মা কামাখ্যার উপাখ্যান। আমরা সকলেই দেবীর ঋতুমতী হওয়ার কথা জানি। লেখিকা লিখছেন-” কিন্ত পাঁচদিনের মাথায় দেবী চণ্ডীরও যে ‘ রঙ্গতে মন ‘ যায় বা শয়ন কক্ষে যে ‘রঙ্গমন্দির ‘ এবং সঙ্গম-প্রক্রিয়াকে যে ” ধৈর্য ধামাইল খেলা” বলে মনে করেন মেয়েরা, এ ব্যাখ্যা বোধহয় ততটা পরিচিত নয় ‘
সত্যিই তো পরিচিত নয়ই।
তিনি এক এক করে বিভিন্ন এই ধরনের গ্রামের, রাজ্যের, জেলার, দেশের মেয়েদের যাপনের কথা আলোচনা করতে গিয়ে পুরাণ তথা স্বয়ং দেবী শরীরই যে মূলত মেয়েদের শরীরী অংশ, তা বারবার ব্যাখ্যার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন তথ্যের মাধ্যমে।

যেমন তিনি লিখছেন-
‘ গর্ভে জন্মক্ষণের উল্লেখ পেলেও বাকি থেকে যায় ধীরে ধীরে শরীরের পূর্ণাঙ্গরূপ পাওয়া। সেখানে পুরোটাই কল্পনার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিলনা পূর্ব নারীদের।

যেমন আরও এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করছেন-‘ সুন্দরবনের মেয়েদের গর্ভকালীন সময়ে কখনও জোটে আদর-যত্ন আর অভিজ্ঞাদের পরামর্শ ।
হাঁটাচলা করবি বিটি, তোর ভাল হবে রে—
ই-ঘরে উ-ঘরে যাই, ধরবি চালের বাতা রে—‘
( সুন্দরবন)

আবার এটাও উল্লেখ করছেন একই সাথে যে’
পাশাপাশি ভারী কাজে নিষেধ করেন, ‘ কাষ্ঠে না দেয় পাড়া ‘
কিন্ত অবহেলা, উদাসীনতা বা অত্যাচারও যে কখনও হয় না, এমনটাও নয়- প্রসঙ্গক্রমে তিনি লিখছেন- ‘ উত্তর দিনাজপুরের গানে শুনি–
” ফেনি *( বধূটি) ডা যে হইছে আলসের পুয়াতি
তুলিয়া সে খাইছে গে বিরার জালি
বালা না পড়িছে সুরু বেতের বাড়ি
কবুল সে যাইছে গে খাইচু গোটা চারি’

অর্থাৎ— ক্ষুধার্ত বধূটি শশার জালি খাওয়াতে, জোটে সরু বেতের মার
এই উদাসীনতা যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে তার মহাকাব্যিক উদাহরণ কে গ্রামীণ নারী ভোলেন না–

তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে
‘ মুনির তপুবনে রইল সীতা গর্ভবাসে
কান্দন সীতা অঝর নয়নে
দারুণ বিধাতা ছিল, রাজঘরে জন্ম দিল
কর্মদুষে আইনু বনবাসে ‘( শিলচর, আসাম)
অর্থাৎ, কার দোষে যে সীতার বনবাস হয়েছিল, তার প্রকৃত সত্য জানতে কারও বাকি নেই ”

এমন ভাবে নারী শরীরের সময় এবং মনের সঙ্গে প্রতিটা পর্বে পর্বে বিভিন্ন গোষ্ঠীর, জেলার, রাজ্যের, গ্রামে, জেলার এক একরকম সুর, ছন্দ ও ভাষায় গান এবং ছড়া বাঁধার এই চলনে আকৃষ্ট হয়ে নিজের মনের তাগিদে বহু বছর ধরে মাসের পর মাস, এমনকি বছর পর্যন্ত অকাতরে, অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি একরকম তপস্যা করে গেছেন।

আজ তার কঠোর সেই পরিশ্রমের দুরন্ত ফসল আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে প্রকাশক ‘ তবুও প্রয়াস ‘, যাদের এই বইয়ের প্রুফ থেকে প্রচ্ছদ, বাঁধাই থেকে প্রকাশকের ঘরে সজ্জিত হওয়ার পেছনে অনেক ঘুমহীন রাতের পরিশ্রম আছে।

আন্তরিক অভিনন্দন লেখিকাকে, তাঁর এমন অভিনব এক বিষয়ে গবেষণার কাজের জন্য। অভিনন্দন প্রাপ্য ‘তবুও প্রয়াস’ এরও যাদের নিষ্ঠা ও নিপূণতার সাথে সহযোগিতার জন্য আজ এই বই আমাদের সামনে!

সোনালী চন্দ
গবেষক- (ইংরাজি ভাষাতত্ব) ইংলিশ অ্যান্ড ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজেস
ইউনিভার্সিটি , হায়দরাবাদ।

প্রকাশক- তবুও প্রয়াস প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি , ২০২৪

প্রচ্ছদ- সুপ্রসন্ন কুন্ডু
মূল্য- ৫৫০ টাকা
ISBN- 978-93 -87743-86-1

ঠিকানা- ১৯/২ , রাধানাথ মল্লিক লেন
কলকাতা- ৭০০০১২

যোগাযোগ- ৮৬৪১৯৩৭৩৫৬, ৯৮৩৬৯২৯৫৮০
ই-মেল- tobuoproyasprokashoni@gmail.com

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes