
চিন্তার দূষণ এবং হে বঙ্গ ইত্যাদি প্রভৃতি
সব্যসাচী মজুমদার
এ কথা তো আর লুকবার নেই যে, উত্তর উনবিংশ শতাব্দী বাংলা ভাষায় কোনও তাত্ত্বিক আন্দোলন সম্পন্ন হতে পারেনি, যে শিল্প অভিমুখী আন্দোলন একটি আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। না এ কথা লুকবার নয়। বলতে চাইছি, বাংলা ভাষায় একটা সুররিয়ালিস্টিক কিংবা কিউবিস্ট কিংবা পোস্ট মর্ডানিস্ট, নিদেনপক্ষে কমিউনিস্ট চিন্তাও উদগত হতে পারেনি। যা হয়েছে, তা, ইউরোপ আগত আন্দোলনের অনুরণন — এ কথা বললে কি খুব আপত্তিজনক হতে পারে !
বুঝতে পারছি, ইতিমধ্যেই তর্ক শুরু হয়ে গেছে আপনার ভেতর। নস্যাৎ করতে চাইছেন ওপরের কথাগুলোকে। নস্যাৎ হোক আমিও চাই। কিন্তু, নস্যাৎ হতে পারছে না যে যে কারণে, সে প্রসঙ্গে প্রবেশের আগে কিছু ভূমিকার প্রয়োজন।
আবার, অনেকেই ভাবছেন, তত্ত্বের কি প্রয়োজন রয়েছে ? রয়েছে। একটি ধারাকে একটি স্বভাবে নিরুপিত করলে ধারাটি স্থায়িত্ব পায়। তার রূপ পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়। নচেৎ ধূসরতার অস্পষ্টতা তাকে ঢেকে দেয়।
মধ্যযুগের বাংলা কবিতা কেন শুধু, যদি চর্যাপদকে বাংলার প্রাচীনতম লিখিত উদাহরণ বলে ধরে নিই আপাতত, আমরা স্পষ্ট লক্ষ করতে পারছি যে, সবকটি সাহিত্যগত উদাহরণই জন্ম নিচ্ছে কোনও না কোনও আন্দোলন থেকে। কিরকম আন্দোলন ? অবশ্যই ধর্ম কেন্দ্রিক আন্দোলন এবং অবশ্যই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। যদিও এখন দেশপ্রেমের বায়ু প্রবল। কিন্তু, এটুকু তো নিশ্চিত যে, এই প্রবন্ধের পাঠক ‘দেশ’ আর ‘রাষ্ট্র’ ধারণার ফারাক জানেন। জানেন বলেই আমরা বলতে পারছি যে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে… না বলে বলা ভাল রাষ্ট্রের সমান্তরালে আরেকটি বিকল্প সমাজ ধারণার চর্চা থেকেই এই আন্দোলনগুলির জন্ম। ক্ষমতা দখলের প্রেষণা থেকে নয়। কিরকম ! এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি যে, চর্যাপদ বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া ধারা থেকে জন্ম নিল। যে ধারা চেয়েছিল শাসক হিসেবে অবতীর্ণ হিন্দু ধর্মের সমান্তরালে একটি উদার ধর্মাচরণের রাজনীতিকে। কেন উদার? এই কারণে যে, শাসকের হাতে সবচেয়ে বেশি উত্যক্ত হয় গরীব মানুষের দল। এখন এই শ্রমনির্ভর মানুষের ধর্ম বোধ ও চেতনা সবসময় সরল মার্গ সন্ধান করে। স্বভাবতই শ্রমক্লান্ত জীবনে ধর্মের জটিলতা প্রাসঙ্গিকতা পায় না। ফলত রাষ্ট্রের অবদমিত মানুষগুলোকে তাদের জীবনের কথা বলার জন্য, একটি বিকল্পের সন্ধানে ব্রতী করার জন্য অবশ্যই উদার ধারণার প্রয়োজন ছিল — এ কথা বলাই বাহুল্য। এবং একই সঙ্গে আমরা এও লক্ষ করছি যে, চর্যাপদ একটি স্থানিক বা মানচিত্র নির্ভর রাজনীতির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠলেও তার উত্তরণ ঘটেছিল প্রথমাবধি। অর্থাৎ, চর্যাপদের শ্লোকগুলি নিঃসন্দেহে সামাজিক উচ্চাবচতা, শোষণ ইত্যাদি সম্পর্কে কথা বলতে বলতে জানিয়ে দিতে পেরেছিল ‘অপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ কিংবা ‘কাআ তরুবর পঞ্চবী ডাল …’ । উদাহরণ ব্যবহারের লোভ সামলেও কেবল মনে করে নিতে চাইছি, চর্যাপদ একটি সাময়িক সমান্তরাল রাজনৈতিক ধারা হলেও বিস্তৃত হয়েছে একটি সময় নিরপেক্ষ দর্শনে। এবং এ কথাও বলা বাহুল্য যে, চর্যাপদ তার নিরপেক্ষ সমান্তরাল চিন্তার কারণেই আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছেও টেক্সট হয়ে উঠতে পেরেছে।
এরপর পাশার দান পাল্টে গেল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলতে চাইছি না, কিন্তু মনে করে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। যদি খুব সরলীকরণে আমরা ধরে নিই মধ্যযুগের প্রথম লিখিত উদাহরণ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, তাহলে আমাদের চিন্তা একটি অবয়ব পায় ( সরল ও অর্বাচীন অবয়বই বটে) শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একান্ত ভাবেই তৎকালীন যুগাবয়বের প্রতি বড়ু চন্ডীদাসের দৃষ্টিভঙ্গির ফল। মহাজনেরা একে অবক্ষয়ের চিত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও, এই আলোচক বিষয়টিকে একটি নির্দিষ্ট বিবর্তন হিসেবে দেখতে চাইছে। অবক্ষয় নয়, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। বড়ুর প্রায় সমকালে মনসার পালা জন্ম নিচ্ছে হরি দত্তের হাতে। অতঃপর মঙ্গলকাব্যের যুগ, চৈতন্য আগমন ও ঐশ্বর্য সঞ্চার। আমরা দেখতে পারছি যে, মঙ্গলকাব্য গড়ে উঠছে সে সময়ের শাসক মুসলমান শ্রেণির সমাজভঙ্গিমার সমান্তরালে। হিন্দু চিন্তকেরা গড়ে তুলতে লাগলেন সমান্তরাল সহজিয়া ধারা। মঙ্গলকাব্য বা অনুবাদ গুলি আমাদের তো সেই ইঙ্গিতই দেয়। এমনকি তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণির দেবতাদের বৈদিক দেবতাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ‘হিন্দু ঐক্য’- এর কথা বলা হয়েছিল তখনই। এখনও হয়। হয় মানেই ওই ঐক্যটি ইউটোপিয়া। কোনওদিনই ঘটবার নয়। দ্বিতীয়ত, নতুন কোনও আন্দোলন গড়ে ওঠেনি বলেই সেই মধ্যযুগের আহ্বান এখনও ফিরে আসছে। ধর্মের আহ্বান। আবার প্রসঙ্গে ফেরা যাক, চৈতন্য এলেন। সে সময় শাসকের দুটো মুখ। একটি মুখ মৌলবী তন্ত্র এবং একটি অবশ্যই ব্রাহ্মণ্য তন্ত্র। এই দুই ধারার সমান্তরালে চৈতন্য শুরু করলেন সম্ভবত মধ্যযুগের বাংলার শেষ চিন্তার আন্দোলন। যা একই সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট মানচিত্রের মানুষের জীবনধারাকে প্রভাবিত করল ও আন্তর্জাতিক চিন্তা জগতে একটি সুনিশ্চিত ও দীর্ঘ প্রভাব বিস্তার করল। শাক্ত ধারা অবশ্যই চেষ্টা করেছিল কিন্তু, কালী মেনস্ট্রিম দেবতা হয়ে যাওয়ায় খুব বেশি রাষ্ট্রের সমান্তরাল চিন্তা হয়ে উঠতে পারেনি সম্ভবত। কিংবা যদি কেবল রামপ্রসাদ সেনকেই আমরা এই পর্বে সাব্যস্ত করি , তবে অবশ্যই রাষ্ট্রের সমকালীন রূপকে নির্ণয় ও তার সমান্তরাল হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের সহায়তা ব্যতিত বেঁচে থাকা কবি করেছিলেন।
এবার শুরু হল ইংরেজি শাসকের যুগ। বলা ভাল বহুবিধ বৈদেশিক শাসকের যুগ। সে সময় কি চিন্তার দ্বন্দ্ব ঘটেনি ? অবশ্যই ঘটেছে। না ঘটলে আমরা ঈশ্বর গুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা কালীপ্রসন্ন সিংহকে পেতাম না। কিন্তু, আমরা যেখানে লক্ষ করতে চাইছি যে, এই সময়ের সমস্ত চিন্তার যেসব স্পর্শ বাঙালির চিন্তাকে উত্তেজিত করেছিল, তার একটিও বঙ্গজ নয়। ইউরোপ ও ইংল্যান্ড আগত। কিন্তু, তার বাইরে কি কিছু ঘটেনি ! এ কথা বলার স্পর্ধা কৈ! অবশ্যই ত্রৈলোক্যনাথ, অবনীন্দ্রনাথকে মনে করতে পারছি আমরা রবীন্দ্রনাথের ওই তীব্র সময়াতীত উপস্থিতি সত্ত্বেও। কিন্তু যদি আমরা নগর অতিক্রম করে দৃষ্টি বিস্তৃত করি, লালন ফকিরের পূর্ণ অবয়ব ফুটে ওঠে। চৈতন্যের পর সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন লালন সাঁই। সন্দেহাতীত ভাবে। শিল্পে ও চিন্তায় এই শূন্যতার দর্শন অভিঘাত তৈরি করেছে। শুধু তাই নয় একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রচুর মানুষের জীবন যাপনকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এবং এক্ষেত্রেও লক্ষ করতে পারছি যে, ধর্ম লালনের সহায়তা করেছিল। কিন্তু, কোন ধর্ম? রাষ্ট্রের ধর্মকে দখল করে স্বজন পোষণে নিয়োজিত ধর্ম? নাকি সমান্তরাল আরেকটি নতুন ধর্ম অবকাশ মানুষের কাছে পেশ করার বাসনা ধর্ম? দাবি করছি না বাউল চিন্তার জন্মদাতা লালন ফকির। কিন্তু, এ দাবি তো আমাদের সকলেরই যে , লালন শাহের কারণেই প্রায় অজ্ঞাত সমান্তরাল ধর্মটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হয়ে উঠতে পেরেছিল। এবং লালন ফকির তাকে বহু বিন্যস্ত ও বিবর্তিত করে তুলেছিলেন।
এবার যদি রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে প্রবেশ করি, তবে, এ কথা আমরা মেনে নিচ্ছি, যে, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং একটি আন্দোলন। তাঁর চিন্তার ধারা বহুস্তরিক ও ব্যপ্ত। কখনই মানচিত্র তাঁর রচনার চিহ্ন হয়ে উঠতে পারেনি। আমরা যদি ‘সার্থক জনম মা গো ‘ রচনাটিকে স্মরণ করি, দেখব, কী প্রবল ভারতীয় হয়েও রচনাটি অনায়াসে পৃথিবীর যে কোনও মানুষের গান হয়ে গিয়েছে। এরকম বহু উদাহরণ আমরা সকলেই জানি। এবং এখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ধারা বাঙালির ক্ষেত্রে কেবল নয়, বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা হিসেবে সমানভাবে প্রভাব বিস্তারকারী। রবীন্দ্রনাথ এখনও ভাবান, তর্ক তৈরি করেন। কখনও কখনও হয়ে ওঠেন অলঙ্ঘনীয়। কিন্তু, যে অর্থে চৈতন্য বা লালন সমাজের বৃহত্তর অংশে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন, তা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেননা, চৈতন্যকে বা লালনকে সাহায্য করেছিল ধর্ম। তবুও বঙ্গভঙ্গের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রপ্রভা যথেষ্টই সাধারণ জনমানসে পৌঁছে গিয়েছিল। মধ্যযুগের ধর্মের ভূমিকা নিল সামাজিক চিন্তাগুলি। এবং তারাও ধর্ম হয়ে উঠল অচীরেই। ফ্যাসিবাদ কিংবা ন্যাশনালিজম অথবা কমিউনিজম ধর্ম হয়ে উঠতে শুরু করল। মোটামুটিভাবে উনবিংশের মাঝামাঝি থেকে তথাকথিত রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডাগুলি চিন্তার বাহক হয়ে উঠতে শুরু করল। চিন্তার প্রেক্ষিতটি বদলে গেল। ফলত রবীন্দ্রনাথকে বঙ্গভঙ্গের রাজনীতি অনেকটাই প্রান্তিক মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছিল — এ কথা কী অস্বীকার করা যায় ? এখনও অনেকেই গাঁ গঞ্জে পঁচিশ বৈশাখে বাড়ির চিনা মাটির, কিংবা মাটির রবীন্দ্র মূর্তিকে ভোর বেলা উঠে দুটো নয়নতারা, একটা গন্ধরাজে সাজায়। সাজিয়ে ধূপ জ্বালে, গান করে কবিতা বলে প্রণাম করে। আমার ভাবতে ভাল লাগে এই তো জয়দেব, চণ্ডীদাস, লালনের পর বাঙালির একমাত্র রবীন্দ্রনাথ আছেন, যিনি কবি হয়েও ঈশ্বর হয়ে গেছেন। আর সকলের জীবনেই একটা ‘ইশ্বর’ থাকা ভাল।
উনবিংশ শতাব্দী থেকে যদি ‘আধুনিক যুগ’-এর সূচনা ধরে নিই তবে, এ কথা আমাদের স্বীকার করতে অস্বস্তি হবে কি , রবীন্দ্রনাথের পর এরকম সামগ্রিক চিন্তার আন্দোলন বাংলায় আর হয়নি। নজরুল কিংবা জীবনানন্দ এতটা সর্বাতিশায়ী নন। কিন্তু, তারপর যদি ভাবি কল্লোলের কথা এবং তৎসূত্রে বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কথা, দেখব, তিনজনেই কবিতার ক্ষেত্রে যে চিন্তার আন্দোলন তৈরি করেছিলেন তা, নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠককেই স্পর্শক্ষম ছিল। এবং তাঁদের পুরোটাই ইউরোপিয় চিন্তার সংস্পর্শজাত ছিল। কখনই মৌলিকতার স্বীকৃতি আদায় করতে পারে না।
বিমল করের নতুন ছোটগল্প আন্দোলন কিংবা নিম অথবা শ্রুতি আন্দোলন — এগুলিও মৌলিক চিন্তা জাত নয়। ইউরোপীয় বিভিন্ন আন্দোলনের প্রভাববশত নির্মীত। শ্রুতি তো আরও পুরোনো চিহ্নবাদী আন্দোলনের অনুকরণ অনেকটাই। হাংরি আন্দোলনকেও একই অভিযোগে দুষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাবনা ও তাকে কেন্দ্র করে বিবিধ সম্ভাবনা নির্মাণ সম্ভব হল না বিট আন্দোলন অনুসারী হাংরির পক্ষেও। তার কিছু কারণ এই রচনার জন্য জরুরি, প্রথমত : এমন একটি মুক্তির চিন্তাকে কেন্দ্র করে এগোতে চেয়েছিলেন হাংরিরা , যা নব্বই দশকের পর আর প্রাসঙ্গিক রইল না। যৌনতা ও প্রান্তিক চিন্তার মুক্তির দাবি বহুকাল আগে, অন্তত বিগত শতকের তিরিশের দশকেই সফল করে দেখিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহিত্য। এ দেশেও নব্বই দশক থেকেই সামাজিক ভাবেও আর প্রাসঙ্গিক রইল না হাংরির দাবি। দ্বিতীয়ত, যেটা শুরু হল আন্দোলনের পেটেন্ট নিয়ে লড়াই। খেউড়ে, তর্জায় ও পুনরুচ্চারণে মনোনিবেশ হাংরি আন্দোলনকে অনেকটাই ধূসর করে দিল।
রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে প্রভাববিস্তার করেছিল আমাদের জনজীবনে ও সামাজিক জীবনে, তা হল কমিউনিজম। বিশেষত মার্ক্স দর্শিত কমিউনিজম। উনিশশো পঁচিশ সালকে যদি এই চিন্তার আগমন সূচক হিসেবে চিহ্নিত করি, তবে, আমরা সকলেই জানি এই দর্শন বাংলা তথা ভারতের মেধা ও ভাবনার ক্ষেত্রে অনিবার্য অভিঘাত তৈরি করেছে। এখনও করছে। কিন্তু, এই আন্দোলন বা চিন্তার প্ররোচনার দিকে যদি আমাদের দৃষ্টি – ক্ষেত্র প্রসারিত করি, দেখতে পাব ইউরোপ বাহিত মার্ক্সের দর্শনই আমাদের কমিউনিজম ভাবনার একমাত্র অবলম্বন, অন্ধ অবলম্বন হয়ে দাঁড়াল। আমরা আমাদের প্রতিবেশের মতো করে কমিউনিজমকে ভাবতে পারলাম না হয়তো। আমরা রাশিয়া বা চীন কিংবা লাতিন আমেরিকা নিদেন ভিয়েতনামকেও অনুকরণ করলাম কিন্তু নিজেদের মানচিত্রের মতো করে ভাবতে পারলাম না। সম্ভবত এ কারণেই মার্ক্স দর্শিত কমিউনিজমও আমাদের নিজস্ব চিন্তার আন্দোলন হয়ে উঠল না, উঠতই না। বলা ভাল, কমিউনিজমকেও আমরা নিজেদের মতো করে দেখতে শিখলাম না। শিখলাম অনুকরণের মাধ্যম হিসেবে।
তাহলে, এ কথা কি বলাটা খুব অবাঞ্ছিত হয়ে যায়, যে, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষায় ও মানচিত্রে কোনও চিন্তার আন্দোলন তৈরি হতে পারেনি , যা মানুষের যৌথ চিন্তা ও অবস্থানকে বিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে !
কেন ? এই প্রশ্নটাই এখন বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ভাবলে প্রথমেই যে অবয়বটি চোখের সামনে ফুটে ওঠে তা হল হাংরি জেনারেশন। ব্যক্তিগত অসূয়া, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, হাংরির পিতৃত্বের দাবি — এসব কিছু এত বড় হয়ে উঠল যে আন্দোলন আর বিবর্তনের দিকেই এগল না। ব্যক্তিগত অসূয়াকে এমন পর্যায়ে এই জেনারেশন নিয়ে গিয়েছিল যে ঐতিহাসিক সত্যকে স্বীকার করতেও দ্বিধা জন্মেছিল। আমরা জানি, শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পাদিত ‘ক্ষুধার্ত’ সংকলনে উৎপলকুমার বসুর ঠাঁই হয়নি। ঠিক, উৎপলকুমারের রচনার সঙ্গে হাংরি প্রোপাগান্ডার খুব বেশি মিল নেই। তবুও এটাও তথ্য যে, হাংরি আন্দোলনের শুরুতে যাঁরা এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে উপদ্রুত হয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম উৎপলকুমার বসু। যা হোক, হাংরি আন্দোলনকে অভিযুক্ত করার উদ্দেশ্যে এ রচনা নয়। এবং স্বভাবগুলোকে দোষ হিসেবে চিহ্নিত করেও দিতে চাইছি না। কেবল বলতে চাইছি, এগুলো ঘটেছিল। ঘটেছিল এও যে হাংরি আন্দোলনের প্রোপাগান্ডা নিজেকে খুব বেশি বিবর্তনের দিকেও নিয়ে যায়নি। ভাঙেনি নিজেকে। যে স্পর্ধায় রবীন্দ্রনাথ কিংবা পিট সিগার ভাঙেন নিজেকে শেষ বয়সে দাঁড়িয়েও। সেভাবে নিজেকে ভাঙার সাহস তো সুবিমল মিশ্র বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় দেখাতে পারেননি। ব্যকরণ তৈরি করে তাকে ভাঙার সাহস খুব কম জনই অবশ্য দেখাতে পেরেছেন বাংলার ইতিহাসে। অধিকাংশই তো নিজের তৈরি শৈলীর হাতে বন্দী হয়ে যাওয়ার ইতিহাস।
হাংরি ও তৎপরবর্তী সময়ের বিবিধ আন্দোলন প্রচেষ্টার দিকে যদি তাকাই, তবে একটা কথা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এরা কেউই সর্বাতিশায়ী, আন্তর্জাতিক চিন্তা হয়ে উঠতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে কয়েকটি স্বভাবকে এ ক্ষেত্রে চুম্বক আকারে বলার চেষ্টা করা যাক,
১) ক্ষমতা দখলের রাজনীতির ভেতরে প্রবেশ করার প্রবণতা ।
২) বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগের অভাব। ( বিশ্বভারতীর গড়ে ওঠাকে একটি বিকল্প প্রতিষ্ঠান তৈরির ইতিহাস বলেই ধরে নিচ্ছি)
৩) ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বোধ নামক ইউটোপিয়ার কবলে একক ‘ব্যক্তি’র উত্থানে বিশ্বাস ।
৪) পারস্পরিক বিদ্বেষ এবং ওই ক্ষমতা দখলের প্রবণতা থেকেই তা জাত ।
৫) অর্থনৈতিক কারণ :
ক. বাংলা ভাষার সাহিত্যকে অন্তত ভারতবর্ষে বিক্রি করার বাজারটা ছোট।ফলত একবার যে শৈলীতে লেখক সাফল্য পান, তাকে সহজে ভাঙতে চান না ।
খ. বিকল্প সাহিত্য জগৎ ব্যবসা গড়ে তুলতে পারেনি। ব্যবসা সম্পর্কে বাঙালির বিভ্রান্ত দৃষ্টির কারণেই হয়তো। বিকল্প সাহিত্যও নিজেকে ভাঙতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে সম্ভবত এ কারণেই।
গ . গণবন্টনের উচ্চাবচতা লেখক বা চিন্তককে ঝুঁকি নিতে দ্বিধাগ্রস্ত করেছে।
৬ ) স্থানিক রাজনীতির কোন্দলে অতি ব্যস্ত হয়ে পড়া।
৭) অনুকরণের প্রাবল্য, প্রশ্ন করার ক্ষমতাকে অবদমন। নিজেকে প্রশ্ন করার ক্ষমতা বলতে চাইছি।
৮) আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে নিয়ত পরিচিত হয়েও স্থানিক সমস্যাকে অধিক গুরুত্ব দান এবং সমস্যাকে ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক উদাহরণের সঙ্গে মিলিয়ে না দেখার প্রবণতা।
৯) গোষ্ঠী চেতনার শক্তিশালী হয়ে ওঠা। এই গোষ্ঠী চেতনাকে জাতীয়তাবাদ কিংবা পার্টিজান প্রবণতা হিসেবেও পড়া যায়।
১০) জাতিগত অস্মিতায় ভোগা। বাংলার চিন্তা ও শিল্পকে শ্রেষ্ঠ ভাববার কুঅভ্যাস। মনে রাখার দরকার রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে হিন্দি সাহিত্যে গোটা একটা ছায়াবাদী আন্দোলন গড়ে উঠল। আর তারপর জাতীয় ক্ষেত্রে সিনেমার গান আর বিকল্প সিনেমা ছাড়া কোনও ক্ষেত্রেই প্রভাব রাখতে পারেনি। আন্দোলন গড়ে তোলা দূরে থাক। বাংলা সিনেমার দিকে তাকালেই অবস্থাটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। ঋত্বিক ঘটকের ভাবনা সুফলা করেছে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সিনেমাকে। সত্যজিৎ, মৃণালের প্রভাব সম্পর্কে বলাটা আমার স্পর্ধা। কিন্তু বাংলা সিনেমায় এঁদের উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা কি পাচ্ছি ?
আরও প্রমূখ কারণ থাকতেই পারে। এক্ষেত্রে এই আলোচকের এটুকুই মনে হচ্ছে। আর এই পরিস্থিতির সামগ্রিক ফলাফল চিন্তার দৈন্য। দৈন্য একারণেই বলতে চাইছি যে, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা পৃথিবীর মানুষকে নতুন কোনও চিন্তা উপহার দিতে পারেনি — এই তথ্যের ওপর নির্ভর করে।
অবশ্য এ আলোচনার সমান্তরালে আরেকটি আলোচনা উঠে আসে সর্বদা। চিন্তার, তত্ত্বের আন্দোলন কি খুব প্রয়োজন? সামাজিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হলেও শিল্পের ক্ষেত্রে সে যে অনিবার্য শর্ত তা তো নয়। কিন্তু, এও তথ্য যে বাউলকেও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার জন্য ব্যকরণ তৈরি করতে হয়েছিল। তাকে ভাঙতেও হয়েছিল। এই গড়া ভাঙার খেলা তো চলেই। ফলে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই সময়ের সঙ্গে বাজি ধরতে হলে তাকে গড়তে হবে। এবং গড়তে হবে এ কারণেই তাকে পূনর্নির্মাণের দিকে নিয়ে যেতে হবে। এই সরলীকরণ ব্যতিত এভাবেও দেখা যায়, চিন্তাকে রক্ষা করা যায় তত্ত্বের আন্দোলনের মাধ্যমেই। এর ফলে বোধহয় সেও সক্ষম হয় সমান্তরাল আরেকটি চিন্তার, বিবর্তিত আরেকটি ধারণার অন্যতম উপাদানে পরিণত হতে।
এরপরও যদি আপনি প্রশ্ন করেন, তারপরও বাংলা কবিতা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি কবিতা মাধ্যম কেন? আন্দোলন ছাড়াই সম্ভব হয়েছে। খুব ভাল কথা , একটু যদি বিশদে সমীক্ষা করি বাঙালি লেখক হিসেবে লালন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের পর ঠিক কতজনকে চেনেন আন্তর্জাতিক পাঠক তার একটা মানচিত্র পাওয়া যেতে পারে। সম্ভবত খুব সুখকর ফল হবে না। আমরা প্রত্যেকেই অনুমান করে নিতে পারি সম্ভবত। জানি না আমাদের অনুমান মিলবে কিনা। কিন্তু, সমীক্ষা করে এই আলোচনার ধারণাকে ভুল হিসেবে প্রমাণিত করা যেতেই পারে।
যদি এতক্ষণ সমস্যা হিসেবে চিন্তার আন্দোলনহীনতাকে চিহ্নিত করতে চাই, তবে সুরাহা হিসেবে কি ভাবতে চাইছি ? কিছুই না। আন্তর্জাতিক বাঙালির পুনরুত্থান। যে জানে ক্ষমতা দখলের, ভোটের রাজনীতির পরেও পৃথিবীতে আরও খানিকটা রাজনীতির পরিসর রয়ে গেছে।পেশির নয়, টাকার নয় কেবল চিন্তার রাজনীতি।
খুব ভালো লাগলো
অনেক ধন্যবাদ