কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ১৫ <br /> রূপের বদল, বদলের রূপ  <br />রূপশ্রী ঘোষ

কিঞ্চিৎ পরচর্চা – ১৫
রূপের বদল, বদলের রূপ
রূপশ্রী ঘোষ

এ বছরের পুজো শেষ। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি কলকাতার স্কাইলাইনে দৈত্যের মতো এগিয়ে আসছে আবাসন। ঝরে পড়ে যাচ্ছে সবুজ। দেখছি উৎসবের আগে যন্ত্রণার উৎসব। তবু উৎসব থামেনি। ধর্ষণের উৎসব, খুনের উৎসবও থামেনি। বিচায় এসেছে? না। রাজনীতি - অরাজনীতি নিয়ে তর্ক জমেছে। আর কোথা থেকে যেন একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে শুধুই। মন,মানসিকতার বদল হয়নি। তথাকথিত অভিজাত মানুষগুলোর ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতিও ক্রমে প্রকট হয়ে উঠেছে। যেন সবাই সকলের সঙ্গে অভিনয় করছে, আড়চোখে তাকাচ্ছে। আর এই পটভূমিকাতেই মনে পড়ে আলব্যের কামুর সেই উক্তি- “We get into the habit of living before acquiring the habit of thinking.” — Albert Camus, (The Myth of Sisyphus)। শুভ বিজয়া। আবার এসো মা। আমরা নতুন হব না। তুমিই নতুন হয়ে এসো। লিখলেন রূপশ্রী ঘোষ

সময় এগিয়ে যায় বদলকে সঙ্গী করে। আমার এটুকু বয়সেই চোখের সামনে বদল দেখতে দেখতে সবই কেমন ইতিহাস মনে হয়। মাত্র পরের প্রজন্ম, তাদের কাছেই গল্প করতে হয় আগে বাড়িতে কী কী হত আর বাড়িটা কেমন ছিল। ঠিক যেমন জেঠু, জেঠিমা, ঠাকুমারা গল্প করতেন তাঁরা ঢেঁকিতে ধান কুটেছেন বলে। ধান কুটে চিঁড়ে করা আমাদের জেনারেশন কেউ দেখিনি, কিন্তু ঢেঁকিতে ভেজা চাল কুটে পিঠে বানাতে দেখেছি। কলকাতার কোনো এক পুজো মণ্ডপে ঢেঁকি বানিয়ে শো করা হয়েছে। দুই মহিলা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে একজন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে যাচ্ছেন আর একজন ঢেঁকির ডগার সামনে জাস্ট বসে। গর্তটায় যেটা ঢেঁকির গর বলা হয় তাতে কিছু চাল ঢালা আছে। আমি দুটো বাচ্চাকে ওই দৃশ্য দেখিয়ে বললাম, “এই দ্যাখ এটাকে ঢেঁকি বলে। এভাবে আগে চাল কোটা হত”। বলতে বলতেই আমার মনের মধ্যে চলতে লাগল, এত ঢিমে তালে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়া যায় না। তাতে অনেক পরিশ্রম মিশে থাকত। আর সবথেকে বেশি ঝুঁকি থাকে যিনি দ্রুত হাতের কায়দায় গরের চালগুলো উলটে পালটে দেন। আমি দিতে দেখেছি, মেজোমা, বড়োমা, উমাপিসি, গীতাকাকি এবং আরও অনেককেই। মেজোমা, বড়োমার কতবার শাঁখা ভেঙে গেছে, হাতের উপর পড়েছে ঢেঁকির মুখের লোহাটা। বাকি দুজন অল্প বয়স থেকেই বিধবা, তাই শাঁখার উপর নয়, হাতের উপর দিয়ে গেছে সে যন্ত্রণা। আমার কাছে এগুলো আজ সবই অতীত।
এখনো বাড়িতে পিঠে হলেও চাল মেশিনে কোটা হয়। যাহোক শহরের বাচ্চারা তাও এভাবে হলেও ঢেঁকির প্রতিচ্ছবি দেখছে। গুগলে সার্চ দিয়েও দেখে নেয় সবাই দরকার মতো। অতীত হয়েছে আরও অনেক জিনিস, যা এখনকার বাচ্চারা দেখতে পাচ্ছে না। ওই সার্চ দিয়েই দেখতে হবে দরকার মতো। আগে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে যেমন চোর ডাকাত এলে গ্রাম সজাগ করতে বন্দুক রাখা হত। ঘরে ঘরে ঝাঁপ কপাট থাকত ওই ডাকাতির ভয়ে। অ্যাসিড আর বল্লমও, রাখা হত বাচ্চাদের নাগালের বাইরে। বাচ্চারা যা দেখে বড়ো হয়েছে তা ধান চাষ, চাষের সামগ্রী, লাঙল জোয়াল, গোরুর গাড়ি, গোয়াল ভর্তি গোরু, তার মধ্যে গাই, বলদ, ষাঁড়, বাছুরের বিভাজন বুঝে নেওয়া। গুপি হাড়ি দাদু কীভাবে বাঁশ গাছ থেকে নতুন চ্যারাটি বানিয়ে ছাগলকে খাসি করত তাও চোখে দেখা। এঁড়ে বাছুর থেকে বলদ করা দেখাত না সবাইকে। বলদকে হেলেগোরু বলা হয় ওখানে। বকনা বাছুর হলে গৃহস্থ খুশি হত। একটা বিশাল বড়ো গোলাকার গর্ত করে তাতে জমানো হত গোরুর গোবর। মাটির ঘর নিকোনো আর ঘুঁটে দেওয়ার গোবরটুকু বাদ দিয়ে জমানো হত বাকিটা। সারাবছর জমিয়ে তৈরি হত গোবর সার। ওই সার কোদাল দিয়ে কেটে কেটে বস্তায় ভরে গোরুর গাড়ি করে দূরে মাঠে নিয়ে যেত জমিতে ছড়াতে। বর্ষার ঠিক আগে আগে। তারপর জমিতে লাঙল দেওয়া, মই দেওয়া, ধান বোনা, রোয়া, কাটা, ঝাড়া সবই জানত গ্রামের শিশু থেকে শুরু করে সমস্ত মানুষ। রাসায়নিক সারের মধ্যে ইউরিয়াটা ধবধবে সাদা চিনির মতো দেখতে। কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যাও করেছে অনেকে। গোরুর গাড়ি করে মাঠ থেকে ধান আনা, ছালায় করে আনা, গাদা দেওয়া, মেশিনে, আগরে ধান ঝাড়া সবই ছিল চেনা ছবি। কুলোর বাতাস দিয়ে ঘুরে ঘুরে ধান পরিষ্কার করে মরাইতে তোলাও। গাদার অলিঘুঁজিতে লুকোচুরি খেলা কে না জানে।
শহরের মানুষ গ্রামে গেলে তাকে ঠাট্টা করে বলা হত ধান গাছ থেকে তক্তা হয়। এখন গ্রামের ছেলেমেয়েদেরই হয়তো সেকথা বলতে হবে। ধানসিদ্ধ, মুড়িভাজা, চাল তৈরি সবই মেশিনে। ধান একেবারে নাকি জমিতেই কাটা হয়ে খড় থেকে আলাদা করে বাড়িতে আনা হয়। সে মেশিন দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি এখনো। ধান সিদ্ধ করার জন্য বড়ো বড়ো মাটির তিনপাকা, চারপাকা উনান, বড়ো বড়ো হাঁড়ি, কিংবা গুড় বা তেলের টিন, ধান ভিজানোর ডাবা, মুড়িভাজা খুলি, তার পদ্ধতি, নারকেল পাতার খুঁচি যা দিয়ে মুড়ি ভেজে খোলা থেকে তুলতে হয়-সেসব এরা গুগলে দেখতে পাবে। আমার কাছে এসব ঐতিহ্য। এদের প্রজন্মের জিনিস যেভাবে ঐতিহ্য হবে পরের প্রজন্মের কাছে তেমনই ব্যাপার। সবই উন্নয়ন, বদল হতে হতেই। যদি উন্নয়ন ভাবা হয়। আজ কলকাতা শহর সম্পর্কেও শোনা যায় ওখানে শিয়াল ডাকত, সেখানে শিয়াল ডাকত, ঘন ঝোপ জঙ্গল ছিল ওসব জায়গা। এখন এমন বড়ো বড়ো হাইরাইজ বিল্ডিং, শপিংমল, ফ্লাইওভার হয়েছে। উন্নত হয়েছে জায়গা। আগে কিছুই পাওয়া যেত না। এই উন্নয়ন ঘিরে কত থমথমে মুখ, কত কান্না, কত চোখের জল, কত বেদনা, সর্বোপরি কত দেহ মিশে আছে তার হিসেব দেখা যায় না। হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় আগে যেমন হু হু করে সবুজ খেত ছুটে আস এখন দানবের মতো ছুটে আসে হাইরাইজ। গ্রাম গ্রাস হতে হতে কারখানা, শপিংমল, হাইরাইজে তৈরি হয় শহর থেকে শহরতলি। আমরাই একটা নয় একাধিক ফ্ল্যাট চাই ভবিষ্যতের সঞ্চয় ভেবে। কিন্তু এত সবুজ মরে গেলে এরপর ভবিষ্যৎ খাবে কী? ইট, বালি, পাথর, চুন, সুরকি, টি এম টি বার খেয়ে তো আর পেট ভরানো যাবে না। মুণ্ডু থাকবে, খাবার থাকবে তো? উন্নয়নও চাই আমাদের। এঁদো গলি, মাটির রাস্তা, নোংরা পচা খড় ঘাঁটা জীবন চাই না। যেটুকু ধান বা চাল আজও চাষ হয় তাও চলে যায় মিলে। সেখান থেকে চাল কিনে নেওয়া হয়। ভাজা মুড়ি আসে মেশিনজাত হয়েই। তাও তো শহর আজ দূষণ কমানোর কথা ভেবে ইলেকট্রিক গাড়ির জোগান বাড়িয়েছে। সেটা ভালো দিক। কিন্তু এই কী ভালো আর কী খারাপ এই হিসেব নিরন্তর রাখতে হবে, ব্যালান্স তো করতেই হবে। যদিও এখনো কোথাও খাদ্যের জোগান কম নেই। কিন্তু একটা মহামারি এলেই কালোবাজারি ফুটে ওঠে। যার পয়সা নেই সে কিছুই স্টক করতে পারবে না। করোনা কিছুটা হলেও বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা কালোবাজারি বলতে বই পড়া জ্ঞানে আবদ্ধ ছিলাম। এখন তফাৎ বুঝি ওটা যে কালো রঙের বাজার নয় সেটার। যেসমস্ত জিনিস আজ ঝাঁ চকচকে দেখে উন্নয়ন বলে মনে হচ্ছে তা আসলে উন্নয়ন বলা চলে কিনা জানা নেই। তাতে যতটা না মিশে আছে গরিব মানুষের কান্না, তার থেকে অনেক বেশি মিশে আছে শ্বাসরুদ্ধ, দম চাপা চোখের জল। এই ভোক্তারা কেউ সুখী বলে মনে হয় না। সবই একটা দেখানো ব্যাপার নিয়ে চলে সবাই। যা ফেসবুক খুললেও বোঝা যায়। এই বদল দেখতে দেখতে কতরকমের বদল ইতিমধ্যেই দেখা হয়ে গেছে আমাদের। মন মানসিকতা, মূল্যবোধ থেকে শুরু করে বাহ্যিক রূপেরও।
দুর্গাপুজোর ভাসানেও কত বদল দেখি আজ। ছোটোবেলায় গ্রামে দেখা পুজোয় কোনো আড়ম্বড় ছিল না। করুণা মুচির ঢাক, কাঁসি আর নির্মল কাকার মাইক, এবাড়ি ওবাড়ি থেকে চেয়ে নেওয়া কাপড়েই সারা হত পুজো। অষ্টমী থেকে একটু ভিড় নবমী সামান্য, দশমীতে ঠাকুর নামিয়ে কয়েকজন কাকিমা, জেঠিমা বরণ করে দেওয়ার পরেই বেনে পুকুরে হয়ে যেত ভাসান। হয়তো জানাও যেত না। ধীরে ধীরে জাঁকজমক বেড়েছে পুজোর। প্যান্ডেল আর লাইটে। পোশাক পরিচ্ছদেও এসেছে ছাড়পত্র। দু একদিন কোথাও কোথাও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেও হতে পারে। শহরের মতো এখনো থিম পুজো শুরু হয়েছে কিনা জানা নেই। শহরে এসে থিম পুজো জেনেছি। তাকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতা, পুরষ্কারের লড়াই সবই দেখা হয়েছে। গ্রাম সেসব এখনো টিভিতেই দেখে। চালু করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তবে ভাসানে এসেছে জাঁকজমক। যদি ভাবা হয় সেভাবে। পুজোর আগে ব্যাঞ্জ বাজিয়ে মদ খেয়ে নাচে ছেলেরা, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চলে যায় যেখানে ঠাকুর হয়। একটু শিক্ষিত ভদ্র বাড়ির ছেলেরা গ্রামে ওটা করে না। একদিকে চলে ঠাকুর বরণ, বাড়ির মেয়ে বউ সবাই দেখতে যায় বিসর্জন। পাশাপাশি মাতালদের নাচ দেখাও চলে। শহরে কমপ্লেক্সগুলোয়, ক্লাবের পুজোর বা বাড়ির পুজোতেও ভাসানের দিনে সিঁদুর খেলা, ঠাকুর নিয়ে ঘোরা, ঢাকের তালে নাচ মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে চলে। এখানে কেউ মদ খায় না, সবাই ড্রিঙ্ক করে। তাতে মন না ভরলে আলাদা করে বিজয়া সম্মিলনী হয়। আসর বসে। গ্লাস যার যার নিজের। যা কিছু খরচ হিসেব করে ভাগ করে নেওয়া হয় মাথাপিছু। গ্রামের মেয়েরা এখনো ড্রিঙ্কসের গ্লাসে চুমুকটা দিতে শেখেনি। তবে নাচ আর সিঁদুর খেলাটা রপ্ত করে নিয়েছে। ফেসবুক রাঙা হয়ে ওঠে গ্রামের ছবিতেও। কোলাকুলি মণ্ডপের সামনে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম কম-বেশি শহর গ্রাম এখনো বজায় রেখেছে। তবে মিষ্টির হাঁড়ি হোয়াটসঅ্যাপেই আসে। ভাসান শেষে চর্চার ভাগিদার সেইসব মানুষগুলো, কে কতটা মদ খেয়েছে বা ড্রিঙ্ক করেছে। কে কেমন নেচেছে বা নাচতে পারে। ধুনুচি নাচ কে কেমন জানে। আগুন নিয়ে খেলা সবার পক্ষে তো সমানভাবে পারা সম্ভব নয়, তাই এটাও চর্চার বিষয়। এখানে গ্রাম শহরের মানসিকতার বদল কিন্তু ঘটেনি। ওখানেও যেমন সকালবেলা চায়ের আসরে আগেররাতের চর্চা চলে শহরেও কিন্তু সকালে কাজের চাপে সবাই বেরিয়ে গেলেও পরে আলাদা করে আসর বসিয়ে সমালোচনা চলে। কে কেমন নাচল, কাদের পুজো কেমন হল, কারা কারা পুরষ্কার পেল ইত্যাদি প্রভৃতির সঙ্গে উঠে আসে আন্দোলন, স্লোগান, বিচার চাইয়ের ঝাণ্ডা। এ নিয়েই জীবনযাত্রা। এ বছরের মতো পুজো শেষ। আবার হবে আসছে বছর ধ্বনিত হবে একটু পরে। কিন্তু বিচার সবাই চায়। পেন ডাউনও ঘোষণা হয়ে গেছে।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
403 Forbidden

403 Forbidden


nginx