
হৃদয়ের আলো
(হার্ট ল্যাম্প)
বানু মুশতাক
অনুবাদ: বেবী সাউ
কন্নড় ভাষার লেখিকা বানু মুশতাক। তাঁর প্রথম ইংরেজি অনুবাদ বই ‘হার্ট ল্যাম্প: সিলেক্টেড স্টোরিজ’ ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছে। অনুবাদক দীপা ভাস্তির ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত এই বইটিতে আছে ১২টি ছোটগল্প, যেখানে দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের জীবনসংগ্রাম, কষ্ট আর আত্মমর্যাদাবোধটিকে তুলে ধরা হয়েছে। বানুর গল্পে নারী শুধু নিপীড়িত নয়—প্রতিবাদী, সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী। সমাজের গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খলের ভেতর থেকেও নারীরা কীভাবে নিজেদের শক্তি খুঁজে পায়, সেটাই তার লেখার মূল বিষয়। এই গল্পটি দীপা ভাস্তির ইংরেজি 'হার্ট ল্যাম্প' থেকে নেওয়া।
নদীর জলে হালকা ডুবিয়ে দেখার মতো মেহরুন দরজার আধফাঁকা পাল্লা খুলেছে, ঠিক তখনই যেন ঘরটা থমকে গেল। সময়টা হঠাৎ ঘুম ভেঙে চমকে উঠল যেন। ড্রইংরুমে দেবদারু কাঠের খাটে আধশোয়া বাবা, আর পাশে বসে গম্ভীর স্বরে কথাবার্তা বলা বড় ভাই, দু’জনেই একসঙ্গে নীরব উদাস চোখে তাকাল তার দিকে।
ঘরের গুমোট বাতাস ভেদ করে শালিক পাখির মতো ছোট্ট রাবিয়া ছুটে এলো এবং ডানা ঝাপটে চেঁচামেচি করে বলল— ‘মেহরুন ফুপি এসেছে! মেহরুন ফুপি এসেছে!’ আর আমান ভাই, গালে ঝকঝকে শেভিং ফেনা, হাতে বুরুশ, দাঁড়িয়ে ড্রইংরুমে। চোখে এমন এক ঘোর বিস্ময়, যেন মৃত্যুর পরে কেউ জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে।
সবচেয়ে বড় ভাই আতিক, যার কণ্ঠে কুরআনের আয়াত এক একটা ঢেউয়ের মতো ওঠানামা করে। তিনিও এলেন। চোখে ঘোর বিস্ময়। সেরাগুলের আঁচল অজান্তেই কাঁধ থেকে খসে পড়ছে, তবু তাঁর যেন সেদিকে খেয়াল নেই। মা, যিনি একদিন এই মেয়েকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন, দিন-দুনিয়ার সব যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে বড় করে তুলেছিলেন, তাঁর হাতের তসবিহর পুঁতিগুলো থমকে গেছে। চোখে জিজ্ঞাসা, —এ কি স্বপ্ন? তুই কি সত্যিই ফিরেছিস?
কিন্তু তাঁর চোখে মুখে সেই চেনা স্নেহভরা ডাক নেই। গায়েব হয়ে গেছে যেন— ‘আয় মা, আয়।’
রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে রেহানা আর সাবিহা। তাদের চোখে ভয়, বিস্ময়, কৌতূহল— ঘটনাটি যেন বহু পুরনো কোনো কুয়াশাচ্ছন্ন একটা গল্প হঠাৎ চোখের সামনে ধরা দিয়েছে। রুটি তাওয়ার উপর পুড়ে যাচ্ছে, তবুও সেদিকে কারো মনে নেই। যেন সংসারের চাকাটা কিছুক্ষণের জন্য তার গতিতে ঘুরতে ভুলে গেছে। কেবল আতিফ ছিল না, এটাই স্বস্তি!
মেহরুনের মনে হলো, এই বাড়িটা তার পরিচিত, তবুও কোথায় যেন অচেনা! এই দেওয়াল, এই জানালা, এই দরজার হাতল, সব আছে, তবু নেই! কোথাও নেই! এই সেই মা, যিনি তার কপালে চুমু দিয়ে বলতেন— “তুই তো আমার চোখের মণি।” এই সেই বাবা, যার বুকের উপর উঠে সে বলত, —”আমার রাজত্ব শুরু এখান থেকে।’’ সেই ভাইয়েরা, তারা একসঙ্গে ইদে আনন্দ করত। সে কলেজে যাচ্ছে বলে লড়াই করত। আর আজ তারা যেন তাকে দেখেও দেখছে না। ভাবীদের চোখে এমন শীতলতা, যেন সে বহু দূরের কোনো গ্রহ থেকে হঠাৎ নেমে এসেছে কোনও প্রাণী। নিস্তব্ধতায় ঘরটা দাঁড়িয়ে রইল। বাতাস থেমে গেল এবং আলো নিঃশব্দে বদলে ফেলল তার রং।
মেহরুনের বুকের ভেতরটা যেন ভেঙে পড়ল। তার কোলে ন’মাসের শিশুকন্যাটি চিৎকার করে কেঁদে উঠতেই ঘরের সবাই হতবিহ্বল অবস্থা থেকে বেরিয়ে এলো যেন! খানিকটা সামলে নিয়ে বড় ভাই জিজ্ঞেস করলেন—‘ইনায়াত কোথায়?’
মেহরুন মাথা নিচু করে, যেন বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে এমনভাবে, ধরা গলায় বলল
—শহরে নেই।
—তবে কার সঙ্গে এসেছ?’
—একাই
—একাই?
চারদিক থেকে একসঙ্গে একটা বিস্ময়কর আওয়াজ উঠল। আর মেহরুন চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইল।
বড় ভাই আদেশ দিলেন, —ফারুক, ওকে ভেতরে নিয়ে যা।
আদেশ পাওয়ার পর, ভারী ও ক্লান্ত পায়ে মেহরুন ঘরে প্রবেশ করল। মনে হল কোনো আদালতের কাঠগড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে সে। শিশুকন্যাটি আবার কেঁদে উঠল। বোরখা সরিয়ে, নেকাব উঁচিয়ে, বাবার খাটের এক পাশে সামান্য কাত হয়ে বসে, শিশুটির মুখে দুধের স্তন চেপে ধরল মেহরুন। মুখ ধোয়ারও সময় পায়নি। পেটটা জ্বলছিল ক্ষুধায়, গত রাতের পর আর কিছু খাওয়া হয়নি তার। ঘরে শুধু মা, অন্য কোনো নারী এই বৈঠকে থাকতে পারবে না। বড় ভাই আবার প্রশ্ন করলেন,
—মেহর, কাউকে জানিয়ে এসেছিস?
—না।
—কেন? কেন বলিসনি কাউকে? মনে হচ্ছে, আমাদের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতেই চাস তুই। অবশ্য তার আর বাকি নেই।
মেহরুন খানিকটা ক্রোধের স্বরে বলল,
—কাকে জানাতাম? আছেটা কে সেখানে? এক সপ্তাহ হয়ে গেল, সে ফিরেও আসেনি, না জানিয়ে কোথায় চলে গেল! আমি চিঠি লিখেছিলাম তোমাদের, তোমরা তো কোনো জবাবই দাওনি। আমি মরেছি কী বেঁচেছি…খোঁজটুকু নাওনি… তোমাদের কিছু যায় আসে না!
—তুই চিঠিতে লিখেছিলি, তোর স্বামী নাকি কোনো এক নার্সের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। আমরা এটা কীভাবে বিশ্বাস করব?’
মেহরুন মুখ তুলল। চোখে একরাশ বিরক্তি!
—বিশ্বাস না হলে এসে খোঁজ নিতেন! যারা যারা ওদের একসঙ্গে দেখেছে, তাদের জিজ্ঞেস করতেন!
বড় ভাই খানিকটা চাপা স্বরে বললেন,
—আচ্ছা, যদি তাইও করতাম… ধরেও নিতাম। কিন্তু সে যদি বলত, হ্যাঁ, ঠিকই তো করেছি, তখন আমরা কী করতে পারি! মসজিদে দরখাস্ত দেব? সে বলবে, ভুল হয়েছে, মেয়েটাকে মুসলমান করে নিকাহ করে নেব। তখন সে তো তোর সতিন হয়ে যাবে। আর যদি তাকে আরও বকাঝকা করি, যদি সে সোজাসুজি বলে, আমি মেহরুনকে চাই না, তাকে তালাক দেব, তখন?
এবার মেহরুন কান্নায় ভেঙে পড়ল। শিশুটিকে অন্য স্তনে স্থানান্তর করে, বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে বোরখার নিচে থেকে সারাগো টেনে বের করল, চোখ-মুখ মুছল। ঘরের ভেতর মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো।
সে বলল। কথা, গলার স্বর যেন আগুনে পুড়ে গেছে,
—মানে, তোমরা কেউ কিছুই করতে পারবে না, তাই তো?
কেউ কোনো উত্তর দিল না। চুপ।
সে আবার শুরু করল,
— আমি তোমাদের হাতজোড় করে বারবার বলেছিলাম, আমাকে বিয়ে দিও না। শুনেছিলে? বলেছিলাম, বোরখা পরে কলেজে যাব, আগে পড়াশোনা শেষ করতে দাও। কান দিয়েছিলে? আমার অনেক সহপাঠী এখনও বিয়ে করেনি, অথচ আমাকে তো বিয়ে দিয়ে, বুড়িয়ে দিলে। পাঁচ পাঁচটা সন্তানের বোঝা কাঁধে চাপিয়ে দিলে। আর যার কাঁধে এই সংসার টানার কথা, সে আজ পথে পথে ঘুরছে। আমি নেই, আমার কোনো জীবন নেই। এক পুরুষ যখন এ রকম হারাম কাজ করে বেড়ায়, তোমরা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করতেও পারো না কেন?’
মা চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লেন, যেন দুঃখের ভার সহ্য করতে পারছেন না।
—‘হ্যাঁ আম্মা, আমারও আর সহ্য হয় না।’ কণ্ঠে তার বিষাদের বাষ্প।
— প্রথম প্রথম লোকে কিসসা-কাহিনি করত। কথা কানাকানি করত। তারপর যারা যারা নিজের চোখে দেখেছে, থিয়েটারে, হোটেলে ঢুকতে, তারা এসে আমাকে বলেছে। পরে পরে সে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে সরাসরি তার বাড়িতে যাওয়া শুরু করল। পাড়াপ্রতিবেশী যখন মুখ খুলল, কথা শোনাল, তখন সে বেঙ্গালুরু চলে গেল, হাজার হাজার টাকা খরচ করে সেই মেয়েটার বদলির ব্যবস্থা করল। আট দিন ধরে সে ওই মেয়ের সঙ্গে এক ঘরে আছে। আর কতদিন সহ্য করব বলো? আমি কীভাবে বাঁচব?’
মা শান্ত স্বরে বললেন, — ধৈর্য ধর, মা। ভালোবাসা দিয়ে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর।’
মেহরুন কাঁপা কণ্ঠে জবাব দিল, —আম্মা, আমারও তো একটা হৃদয় আছে, নাকি? আমারও তো অনুভূতি আছে! যে মানুষ আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে গেছে, তার প্রতি আমি কীভাবে ভালোবাসা দেখাব? স্বামী-সম্মান রাখব? ওকে দেখলেই আমার গা গুলিয়ে ওঠে। ভালোবাসা তো বহু দূরের কথা। তালাকের কথা ও বলুক আর না বলুক, আমি নিজেই তালাক আদায় করব। আমি আর সেই ঘরে ফিরব না।
মা কেঁপে উঠলেন, —মেহর, এসব কী বলছিস, মা? একটুখানি বেশি হয়ে গেল। সে তো পুরুষ, কাদায় পা ফেলেছে, ধুয়ে মুছে আবার ঘরে ফিরে আসবে। পুরুষের গায়ে কোনো দাগ চিরকাল থাকে না, মা।
মেহরুন উত্তর দেওয়ার আগেই আমান কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল,
—দেখছ, আমাদের সামনেই এ কেমনভাবে কথা বলছে! নিশ্চয়ই ওর সামনেও এভাবেই কথা বলেছে। তাই বোধহয় রাগ করে চলে গেছে।
একটু থেমে নরম স্বরে বলল,
—এই বাড়ির বউরা যদি এ রকম কথা বলে, তাহলে মানবে? তখন তো ভালো হবে, না?
মেহরুনের দুঃখ মুহূর্তেই রূপ নিয়ে নিল রাগে, তারপর হতাশায়, বিরক্তিতে। সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে বলল,
—অনেক ভালো কথা বলতে পারো, আন্না। আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক। সত্যি, আমিই খারাপ মেয়ে। এখন বুঝতে পারছি নিজের দোষ। আমি বোরখা ছাড়া কখনো বাইরে বের হইনি। সে আমাকে বলেছিল, বোরখা ছাড়ো, নাভির নিচে শাড়ি পরে হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াও। কিন্তু তোমরা তো আমাকে শিখিয়েছিলে মাথার উপর দিয়ে সারাগো টেনে শাড়ি ঢেকে রাখতে, আজও সেটা না থাকলে মনে হয় আমি নগ্ন।
তোমরা জন্ম থেকে আল্লার ভয় আমার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলে। আমি তার কথা মানিনি। সে যা চেয়েছে করতে পারিনি। তাই সে এমন একজনকে খুঁজে নিয়েছে, যে তার ইশারায় নাচবে। আর আজ তোমরা সবাই ভয় পাচ্ছ, যদি সে আমায় ছেড়ে দেয়, তাহলে আমি তোমাদের বোঝা হয়ে যাব। এই জন্যই বলছ, সব সহ্য করতে। কিন্তু এখন আর সম্ভব না। ওই জীবন্ত নরকে পুড়ে মরার চেয়ে আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথাও কামিনের কাজ করব। তোমাদের ওপর একটা কণাও বোঝা হয়ে থাকব না, এতটুকুও না…
মা ব্যথিত গলায় প্রতিবাদ করে বললেন, —ফলের বোঝা কখনও লতায় বোঝা হয়, মেহর? এই সব আজেবাজে কথা বলিস না।
বড় ভাই গম্ভীর স্বরে বলল, —আম্মা, ওকে নিয়ে ভেতরে যাও। কিছু খেতে দাও। আমরা দশ মিনিটের মধ্যে চিকমাগলুরের উদ্দেশে রওনা হব। বাস পেলে বাসে যাব, নাহলে ট্যাক্সি ভাড়া করব। ওর ইচ্ছেমতো নাচতে পারব না আমরা।
মেহরুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
— আমি তোমাদের ঘরে একফোঁটা জলও খাব না। আর আমি চিকমাগলুরও যাব না। জোর করে নিয়ে গেলে, কথা দিলাম, নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেব।’
বড় ভাই কঠোর হয়ে উঠল,
—এটা বাড়াবাড়ি, মেহর। যারা মরতে চায়, তারা মুখে ফিসফিস করে বেড়ায় না। যদি পরিবারের ইজ্জতের এতটুকু খেয়াল থাকত, তাহলে এখানে এসে কান্নাকাটি না করে আগেই চুপচাপ কাজ শেষ করে ফেলতিস। নারীর জীবন তো এমনই, মেহর, যে দুলিতে চড়ে আসে, সে দুলি থেকেই একদিন বিদায় নিতে হয়। তোর একটা মেয়ে আছে, স্কুলে পড়ে। তোর দুই বোন আছে, তাদের বিয়ের বয়স হয়েছে। তোর একটিমাত্র ভুলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। তুই বলছিস আমরা তোর আবেগের কথা শুনে, তোর স্বামীর সাথে ঝগড়া করবো? আমাদেরও তো সংসার আছে, স্ত্রী-সন্তান আছে। এখন চুপ করে ভেতরে যা, কিছু খেয়ে নে।
তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল
— আমান, তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সি ডেকে আন।
খানিকক্ষণ পরে মেহরুনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
—আর তুই মেহর! যদি তোর ছেলেমেয়েরা বা পাড়া-প্রতিবেশী কিছু জিজ্ঞেস করে, বলবি বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলি। কখন রওনা হয়েছিলি?
মেহরুন কিছু বলল না।
আমান বলে উঠল —এখন সাড়ে ন’টা বাজে। ও যখন এসেছে তখন ঠিক ৯টা। তিন ঘণ্টার রাস্তা। তাহলে সকাল ছ’টায় রওনা দিয়েছে।
বড় ভাই বলল— এখুনি বেরোলে, বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব।
মেহরুন নড়ল না। যেখানে বসেছিল, সেখানেই ঠায় বসে রইল। মা আর ছোট বোনেরা এসে এসে অনুনয় বিনয় করে বলল, —কিছু খা মা, একটু জল খা।’
কিন্তু সে মুখে একটুকরো খাবারও তুলল না, একফোঁটা জলও খেল না। ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল। মেহরুন কারও সঙ্গে কথা বলল না। শিশুকন্যাটিকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে, দুই বড় ভাইয়ের সঙ্গে চুপচাপ বাইরে বেরিয়ে এল। কাউকে বিদায়টুকু পর্যন্ত জানাল না। শুধু শেষ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাল।
যে বাড়িতে জন্মেছিল, বড় হয়েছিল, সেই ঘরটাকে শেষবারের মতো দেখল। চোখের কোণে অশ্রু। ভেতরে বাবা বুকে হাত চেপে ধরে কাশছিলেন। মা হু হু করে কাঁদছিলেন, কখনো মেয়ের দিকে তাকাচ্ছিলেন, কখনো স্বামীর দিকে। কখনো তার বাবাকে শুইয়ে দিচ্ছিলেন, কখনো বাতাস করছিলেন, আবার কখনো পানির ছিটা দিচ্ছিলেন। আর আপন মনে বিড়বিড় করে বলছিলেন,
—হে আল্লাহ, জীবনে যদি কোনো ভালো কাজ করে থাকি, আজ তার বিনিময়ে আমার মেয়ের জীবন ঠিক করে দাও।
আমান গাড়ির দরজা খুলে চোখের ইশারায় মেহরুনকে উঠতে বলল। মুখ স্পষ্ট অসন্তোষের চিহ্ন। মেহরুনের মনে পড়ছে— কতবার সে গর্ব করে বলেছিল, ‘আমার ভাইয়েরা আছে। তারা সিংহের মতো দাঁড়িয়ে আছে আমার কাছে। ইনায়াত যদি একচুল এদিক-ওদিক করে, ভাইয়েরা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে দেবে তাকে।
কিন্তু আজ সেই গর্ব মুছে গেছে। আর এখন বড়ভাইয়ের কথাগুলো তার কানে বাজছে — পরিবারের ইজ্জত বাঁচানোর বুদ্ধি যদি থাকত, তবে নিজেই আগুন দিয়ে শেষ করে ফেলতিস। এখানে এসে আমাদের মুখ পুড়াতিস না।
গাড়িতে উঠতে উঠতে সে আর পেছন ফিরে তাকাল না, না মায়ের দিকেও না। তিনি হয়ত জানালার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলেন! বোনদের দিকেও না, তারা হয়ত পর্দার আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। না বৌদিদের দিকে, যারা হয়তো ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু বোরখার নীচে চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিল তার মুখ। সে ঠোঁট কামড়ে, তার ছোট ছোট কান্নাগুলোকে চেপে বসে রইল। গাড়ি দ্রুত ছুটছিল। কেউ কথা বলছিল না। ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে বসেছিল আমান, পাড়া থেকে ডাকা ড্রাইভার। তার সামনে কি আর পারিবারিক গোপন কথা বলা যায়?
এই পথটা সবটাই ছিল নীরবতায় মোড়া। সে আসলে ছিল ইনায়াতের প্রেম আর ভোগের খেলায় এক টুকরো পাশা। পুরো ষোলো বছর ধরে ইনায়াত তাকে ভোগ করেছে। খেলেছে। আর তারপর, ষোলো বছর পর, ইনায়াত অপমান করেছে তার নারীসত্তাকে। বলেছিল— ‘শুয়ে থাকো মরার মতো। কী সুখ পেয়েছি তোমায় পেয়ে? পোশাক দিয়েছি, আহার দিয়েছি, আর আর কী দিইনি? এখন আমার সুখ যেখানে, আমি সেখানে। আমাকে কে আটকাবে?’
গাড়ি থামার আগে পর্যন্ত, সে কোনও গাছ দেখেনি, পথ দেখেনি, কিছুই অনুভব করেনি। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে এক অচেনা বাড়ি, বলে দেওয়া হল– এই যে!
একটি শুকনো মুখের তরুণী ছুটে আসে। বলে— ‘আম্মি! ফিরেছ! কত চিন্তা করছিলাম!’ তার কাছ থেকে শিশুকন্যাটিকে নিয়ে নেয়। বুকে আঁকড়ে ধরে এবং দৌড়ে ঘরে ঢুকে যায়। মেহরুন ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতর পা রাখে। বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আজ। ছোটরা স্কুলে গেছে। ষোলো বছরের সালমা, যে মায়ের দুঃখ বুকে নিয়ে বড় হয়েছে, আজ ঘরে সেই একমাত্র বড়। অভিভাবক। ভাইবোনদের স্কুলে পাঠিয়ে, অপেক্ষা করছিল মায়ের।
মাকে দেখেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মায়ের সঙ্গে মামাদের দেখে আশা জাগছে মনে। মামারা নিশ্চয়ই সেই অন্য নারীটিকে চুলের মুঠি ধরে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। সে হরিণছানার মতো ছুটে ছুটে বেড়ায়। মামাদের খাবার দেয়, চা ফুটায়। মেহরুন তার ঘরে শুয়ে ছিল। সালমা আসে, মায়ের মুখের অশ্রু মুছে দেয়। দু-চারবার গ্রাস তুলে দেয় মুখে। তারপর থালাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়। হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে আসে। সে দৌড়ে আবার ঘরে ঢোকে। —’আম্মি, আম্মি, আব্বা এসেছে।’
মেহরুন কিছুই শোনেনি যেন! আরও গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে। নিজেকে ঢুকিয়ে নেয় চাদরের ভেতর। মাথার শিরাগুলো টনটন করে। সালমা বাইরে বেরিয়ে যায়। মামারা চলে গেছে। পুরুষদের কথাবার্তা, হাসাহাসি, সালামের আওয়াজ ভেসে আসে বাইরে থেকে।
‘আরে ভাইয়া! কখন এলেন?’ —ইনায়াত জিজ্ঞেস করল।
‘এইতো, একটু আগে এলাম। তুমি কেমন আছ?’
‘আল্লাহর কৃপায় ভালো আছি, আর আপনাদের দোয়ায়।’
আমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এল: ‘কোথায় ছিলেন ইনায়াত ভাই?’
‘এই, এদিক-ওদিক কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে সারা দিন ঘরে বসে থাকা চলে নাকি? সালমা!’ সে ডাক দিল, ‘সালমা, আম্মি কোথায়? দেখো তো, কারা এসেছে। বলো, আম্মিকে বের হতে।’
ঘরের ভেতর থেকে কোনো সাড়া এল না। ‘কোথায় যে গেল,’ ইনায়াত বলল। ‘শিশুকে নিয়ে ভেতরে আছে বোধহয়। দাঁড়াও, আমি নিজেই দেখি।’ সে ভেতরে এসে সালমাকে দেখতে পেল। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কখন এল, এরা? আম্মি কোথায়?’ তার মনে সন্দেহের সরু সুতোর মতো কিছু একটুর জন্ম হলো। সালমা চালাকির সঙ্গে বলল, ‘মামারা তো এইমাত্র এসেছে। আম্মি এখনো ঘুমাচ্ছে।’
ইনায়াত হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ‘এখনো জাগেনি? কী হলো ওর?’ সে গিয়ে দাঁড়াল শোবার ঘরের দরজায়। মেহরুনের জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে থাকা দেখে, তার মুখে একটা তাচ্ছিল্য ভাব খেলে গেল। ঘৃণার। ওর একমাত্র পরিচয় , ও তার সন্তানের মা! কিন্তু তার দিকে তাকাতেও পারছে না আর… পা আর এগোল না ঘরের ভেতরে।
মেহরুন চোখ বন্ধ করে কল্পনা করছিল, কেমন দাঁড়িয়ে আছে সে দরজায়, তার জামাকাপড়ের গন্ধ, সিগারেটের দুর্গন্ধ, শরীরের ঘাম, বার্ধক্যের চিহ্ন, বড় বড় চোখ। যে পুরুষ তার স্নায়ুতে স্নায়ুতে ছাপ রেখে গেছে, সে আজ তার কাছে এক অচেনা মানুষ! সে শক্ত করে চাদর মুড়ে শুয়ে রইল, কেবল কানে এলো তার কণ্ঠস্বর,— সালমা, এখানে এসো। বল তোমার আম্মিকে, এই নাটক বন্ধ করতে! ভাইদের ডেকে এনে যদি আমাকে বোঝাতে চায়, তবে নিজের গলায় নিজে দড়ি দিচ্ছে! এক নিঃশ্বাসে, এক, দুই, তিনবার বলব— তারপর শেষ। গিয়ে বল তোমার আম্মিকে। তালাকের পর দেখব কেমন করে বোনদের আর মেয়েদের বিয়ে দেয় ওরা! বলো তাকে, তোমার মাকে, সবার সামনে সে দু’টো পরিবারেরই সম্মান ডোবাচ্ছে।’
— উঠুক, ভাইদের সালাম দিক, জিজ্ঞেস করুক , মুরগি না খাসি খাবে? দুপুর তো প্রায় হয়ে এল, রান্না শুরু করুক তাড়াতাড়ি!’
সালমা তখন আর কাছেও ছিল না, তবু ইনায়াত নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল যেন তাকে শোনাতে। ইনায়াত আর তার শ্যালকরা যেন কিছুই হয়নি এমন ভান করে আড্ডা চালাতে লাগল। কখনও কফির দামের কথা, কখনও কাশ্মীরের নির্বাচন, কখনও পাড়ার এক বৃদ্ধ দম্পতির হত্যার তদন্তের খবর, আবার কখনও মহল্লার মুসলিম মেয়েটির এক হিন্দু ছেলেকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ের গল্প, কথা চলতেই থাকল…
প্রেসার কুকারে সিটি বাজল। মিক্স ব্লেন্ডারে মসলা পিষল, ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে গেল ঘর। মুরগির মাংস আসতে লাগল টেবিলে, খাবার প্রস্তুত হয়ে গেল – মেহরুন রেঁধেছিল। আর সালমা ছোটাছুটি করে সবার সামনে খাবার পরিবেশন করছিল। মেহরুন একবারই বেরিয়েছিল রান্নাঘর থেকে, তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। পেটপুরে খাওয়ার পরে, মুখে তাম্বুল গুঁজে, ভাইয়েরা রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হলো। যাওয়ার আগে, আমান এসে দাঁড়াল রান্নাঘরের কাছে।
বলল — “বুদ্ধি খরচ করে সামলে নাও সব। আমি আবার আসব আগামী সপ্তাহে। দুই-চারদিন এমন করবে হয়ত, তারপর দেখো আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ওকে শুধরানোর দায়িত্ব নাও। অনেক মেয়েকেই তো কত দুঃখ সহ্য করতে হয় , নেশাখোর স্বামী, অত্যাচারী শাশুড়ি, ননদ। আল্লাকে শুকরিয়া করো, তেমন কিছুর মধ্যে তুমি পড়নি। স্বামী একটু দায়িত্বজ্ঞানহীন, ব্যস, আর কী? তোমাকেই বুঝে নিতে হবে।’’
ভাইয়েরা চলে গেল। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতেই ইনায়াতও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল, যেন কোনো বাধা নেই। সালমা চেয়ে রইল মায়ের দিকে। তার মামারা মাকে কোনো সান্ত্বনা দেয়নি, কোনো সাহায্য করেনি। সে মায়ের দুঃখের ঢেউয়ে কেঁপে উঠল!
বাবা ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় আম্মির চোখ পানিতে ভিজে গিয়েছিল। বাড়িতে যেন বিষাদের পর্দা নেমে এসেছে। স্কুল থেকে ভাইবোনেরা ফেরার পরেও তা সরল না। কিন্তু তারা সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করল। কারও হাতে ছিল নিজের নিজের কাজ, কারও মনে নিজ নিজ চিন্তা। বিকেলের আলো ফুরোতে শুরু করল, বাড়ির কোণে কোণে দীপ জ্বালানো হল।
কিন্তু মেহরুনের হৃদয়ের আলো তো অনেক আগেই নিভে গিয়েছিল। সে কাদের জন্য বাঁচবে? কার জন্য? কেন বাঁচবে?
ঘরের দেয়াল, ছাদ, থালা-বাসন, চুলা, খাট, হাঁড়ি-পাতিল, উঠোনের গোলাপগাছ, কেউ কোনো উত্তর দিতে পারল না।
মাঝে মাঝে তার চারপাশে যে জোড়া নিস্তেজ চোখ ঘুরে বেড়াত, পাহারা দিত, সেটাও সে ঠিক টের পেত না। সালমা চাইছিল বইয়ের ভেতর ডুবে থাকতে। সামনেই তার এসএসএলসি পরীক্ষা। কিন্তু এক অজানা ভয়, একটা মাত্রাতীত উদ্বেগ, অস্থিরতা তাকে তার মায়ের চারপাশে বেঁধে রাখত।
রাতের নিস্তব্ধ সময়ে, জমাট অন্ধকারের দিকে মেহরুন দিকে তাকিয়ে বসে থাকত। অন্ধকার যেন তেমনই কালো, যেমন তার জীবন। বাকি সন্তানেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু সালমা ড্রয়িংরুমে বসে পড়াশোনা করছে, কিন্তু তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মায়ের ঘরের দিকে, মায়ের দিকে।
মেহরুনের চোখে ঘুম আসছিল না। ভাবছিল, নিজের পিতৃগৃহের লড়াইগুলোও কি কিছু কম ছিল? ইনায়াতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার দ্বিতীয় বর্ষের বিকম পরীক্ষার ঠিক এক মাস আগে। সে চেয়েছিল পরীক্ষার পরে বিয়ে হোক। এমনিতেই বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না তার। সবার কাছে কেঁদে-কেঁদে পরীক্ষায় বসার অনুমতি চেয়েছিল, কিন্তু কারও কানে তার কথা পৌঁছায়নি। বিয়ের সপ্তাহখানেক পর, সাহস করে স্বামীর কাছে আবার বলেছিল। ইনায়াত হেসে উঠেছিল, আদরের নামে ডেকেছিল, ‘প্রাণ’, ‘প্রিয়তমা’, ‘আমার হৃদয়’। বলেছিল, ‘তুমি না থাকলে আমি কি বাঁচব?’ মেহরুন বিশ্বাস করেছিল, যদি সে না থাকে, ইনায়াত হয়তো সত্যিই বাঁচবে না!
তখন তার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠেছিল। স্বামীর ইচ্ছাই ছিল তার ইবাদত। স্বামীর প্রেমের আলোয় আলোকিত ছিল সেই হৃদয়। শ্বশুর-শাশুড়ি মৃত্যুবরণ করার পর, প্রায় এক বছর আগে, মেহরুন প্রথমবারের মতো স্বামীকে পুরোপুরি নিজের করে পেয়েছিল। কাজ কর্মের পরে ননদেরা স্বামীর ঘরে চলে গিয়েছিল, দেওররা নিজ নিজ গন্তব্যে। নিজের একটা সংসার, নিজের একটা ঘর, সেই বহু পুরোনো স্বপ্ন তখন সত্যি হয়ে উঠেছিল তার। কিন্তু সেই ঘর যখন পেল, ততদিনে তার মুখে ভাঁজ, হাতে ফুটে ওঠা শিরা, চোখের নিচে কালো ছায়া, পা ফেটে চৌচির, নখ ভেঙে-চিরে ময়লা জমা— এতদিন সে কিছুই টের পায়নি। চুল পাতলা হয়ে গিয়েছে। কোমলতার গন্ধ হারিয়ে গিয়েছে। আর সে ছিল সবকিছুর প্রতি উদাসীন!
হয়তো ইনায়াতও টের পেত না, যদি না তার অ্যাপেন্ডিক্সের অস্ত্রোপচার হত। আর যদি না হতো সেই নার্স, কম টাকায় খাটুনি খাটা, চোখে হাজারো স্বপ্নের ঝিলিক, সেই মেয়ে, যে হয়তো মাটিতে হাঁটত, আবার মনে হতো যেন বাতাসে ভাসে। চামড়ায় আলো, চোখে মধুরঙা টান, যেন চৌম্বক শক্তি। চুম্বকের মতো টেনে নেয়। ত্রিশের কাছাকাছি পৌঁছানো সেই নারী, যে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য, স্বপ্নপূরণের জন্য, সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিল, সবকিছু।
ইনায়াত কখনো তাকে ‘সিস্টার’ বলে ডাকেনি। প্রথম দিন থেকেই, হাসপাতালের প্রতিটি মুহূর্তে, সে সেই নার্সের নাম ধরে ডেকেছে। আর তার পর পরেই সে অপমান করতে শুরু করে সেই গর্ভকে, যা তাকে সন্তানের পিতা করেছিল! মেহরুনের ঝুলে পড়া শরীর, প্রসারিত পেট, সবকিছুর প্রতি কটাক্ষ করেছিল সে। যে শরীর সন্তানদের ক্ষুধা মেটাতে দান করেছিল মেহরুন, তার সেই আত্মাকেও নগ্ন করে দিয়েছিল ইনায়াত। একদিন ঠান্ডা গলায় বলে বসেছিল মেহরুনকে, ‘তুমি ঠিক আমার মায়ের মতো।’
আর সেই দিনই, সেই শব্দ, কথা ক’টিই মেহরুনকে জীবন্ত নিক্ষেপ করেছিল নরকে।
কতকিছু বদলে গিয়েছে এই কয়েক মাসে। নিজেরই ঘরে প্রতিটি খাবারের গ্রাস তার কাছে পাপ মনে হতো। নিজের ভিটেতে নিজেকে পরবাসী মনে হতো। অপমানের আগুনে পুড়ে যেতে যেতে, আর সহ্য করতে না পেরে যখন সে হাঁপিয়ে উঠেছিল, তখন নিজের পরিবারের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু সেদিন রাত আরও ঘন কালো হয়ে উঠছিল। মেহরুনের বুকের ভেতরেও জমাট বাঁধছিল ব্যথা। এমন নিঃসঙ্গতা সে কখনো অনুভব করেনি। আর কোনো চাওয়া ছিল না তার। সে ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে। কেউ ছিল না, যে এসে তার খোঁজ নেবে। তাকে বুঝবে। এমন কেউ ছিল না, যে ঠাট্টা করে বলবে কিছু, কিংবা জড়িয়ে ধরবে, ভালোবাসবে। যে করত, সে এখন অন্য কারও হয়ে গেছে!
জীবন যেন এক অনন্ত দুঃস্বপ্ন!
পেছনে একটা কিছু শব্দ হল! ভেঙে পড়া ছবির আওয়াজ। সে নড়ল না। সে জানত, একটা ফ্রেম ভেঙে গেছে, কাচ ছড়িয়ে পড়েছে, ছবি মেঝেতে লুটোচ্ছে। কিন্তু তবুও কোনো উৎসাহ ছিল না তার সেই ভাঙাচোরা ফ্রেমটিকে গোছানোর। সে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামল। বাচ্চাদের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখল এবং তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।
যখন সে চুপিচুপি ড্রয়িং রুমে ঢুকলো, দেখতে পেলো, সালমা পড়াশোনা করতে করতে টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে তার ঘুমন্ত মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। সে ভেবেছিল, তার সমস্ত অনুভূতিগুলো ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু সালমার দিকে তাকালেই তার ভেতরের ঢেউগুলো দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ফেলতে বাধ্য করল তাকে। সে তার মেয়েকে স্পর্শ করার তীব্র ইচ্ছাকে দমন করে, মনে মনে বলল, ”আমার মেয়ে, বেটা, তুমিই এই অনাথ শিশুদের মা হও।”
তার পা ধীরে ধীরে তাকে এগিয়ে নিয়ে গেল। দরজা খুলে সামনের উঠোনে পা রাখল সে। কয়েকটি গাছ উঠোনে লাগিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিল সেই গাছগুলোও যেন কাঁদছে। যেন মনে হচ্ছে, গাছগুলোও তার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত। সে ভেতরে ফিরে এসে দরজাটা পিছন থেকে বন্ধ করে দিল, রান্নাঘরে গেল, কেরোসিনের ক্যানটা তুলে নিল এবং ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়াল — নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে কোথায় থাকা উচিত তা যেন সে কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না! সে থমকে চারপাশটি চেয়ে দেখল!
ড্রয়িং রুমে ফিরে এল। আরেকবার তার ঘুমন্ত বাচ্চাদের দেখল।
কিন্তু সে সালমার দিকে ফিরে তাকালো না।
সে দ্রুত রান্নাঘরে গেল। দেশলাইয়ের বাক্সটা তুলে নিল এবং ডান হাতে শক্ত করে চেপে ধরে চুপচাপ সদর দরজার লক খুলে আবার উঠোনে পা রাখল। ঘন কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে নিশ্চিত হয়ে গেল— তার কেউ নেই, কেউ তাকে চায় না। নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিল। সে এক শক্তির কবলে তখন। যেন সে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। চারপাশে তাকাল, কিন্তু কোন শব্দ তার কাছে পৌঁছাল না, কোন স্পর্শ সে অনুভব করতে পারল না, কোন স্মৃতি অবশিষ্ট ছিল না, কোন সম্পর্ক তাকে বিদ্ধ করতে পারল না। সে যেন তার চেতনার উর্ধে অবস্থান করছিল।
কিন্তু ঘরের ভেতরে অনেক কিছুই ঘটছিল তখন। ঘুমন্ত শিশুটির ক্ষুধায় চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। সালমা ঘুম থেকে উঠে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ‘আম্মি, আম্মি’ বলে ডাকতে শুরু করে। তাড়াতাড়ি করে সে ঘর পেরিয়ে তার ভাইবোনেরা যেখানে ঘুমাচ্ছিল সেখানে যায় এবং তারপর বাড়ির চারপাশে তার মাকে খুঁজতে থাকে। সদর দরজা খোলা দেখে সে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। এবং উঠোনে, এমনকি সেই ঝাপসা অন্ধকারেও তার মাকে দেখতে পায়। সঙ্গে কেরোসিনের গন্ধ। চিন্তা না করেই সে শিশুটিকে কোলে নিয়ে এগিয়ে যায় এবং তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার মায়ের হাতে দেশলাইয়ের বাক্স! মেয়ে যখন মাকে জড়িয়ে ধরে, চেতনাবিলুপ্ত মা উদাসীনভাবে তার দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন সে অন্য কেউ, অন্য কারও জন্য অপেক্ষা করছে! সালমা শিশুটিকে মায়ের কাছে বসিয়ে দেয়!
তারপর সে মাটিতে লুটিয়ে বলে, ‘আম্মি! আম্মি! আমাদের ছেড়ে যেও না!’ সে তার মায়ের পা ধরে কাঁদতে থাকে।
সালমা কাঁদছিল। আর ছোট্ট শিশুটিও মাটিতে বসে কাঁদছিল। মেহরুন তাদের দিকে তাকাল। আর সে অদ্ভুত ভয়ংকর শক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল, যা তাকে ঘিরে ধরেছিল এবং তার হাত থেকে দেশলাইয়ের বাক্সটি পড়ে গেল। সালমা তখনও তার মায়ের পা ধরে রেখেছিল।
‘আম্মি,’ সে বলল, ‘ একজনকে হারিয়েছো বলেই তুমি আমাদের সবাইকে ওই মহিলার করুণার উপর, দয়ার ওপর ছুঁড়ে ফেলবে? তুমি আব্বার জন্য মরতে প্রস্তুত, কিন্তু আমাদের জন্য কি বেঁচে থাকা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়? তুমি কীভাবে আমাদের সবাইকে এতিম করতে পারো, আম্মি? আমরা তোমাকে চাই।’ কিন্তু সালমার কথাগুলোর চেয়েও বেশি সালমার জড়িয়ে ধরা তাকে বাস্তবে ফিরে আসতে সাহায্য করছিল।
সে কাঁদতে কাঁদতে শিশুটিকে কোলে তুলে নিল এবং সালমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। মেহরুনের মনে হল সালমা যেন তার বন্ধু। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, স্পর্শ করছে এবং বোঝাচ্ছে। মেহরুনের চোখ ভারী হয়ে উঠল, আর সে শুধু বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করো, বেটা’।
ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকার কেটে যাচ্ছিল।