
পর্ণশবরীর কথকতা দ্বিতীয় পর্ব
প্রাপ্তি চক্রবর্তী
এক-একটা করে দিন গ্রীষ্মের দীর্ঘ আর নিশ্চুপ দুপুরের মতো পার হতে থাকে আর আমি নিজের নিত্য-নূতনতাকে বোঝার চেষ্টা করি। উপনিষদ সেই কবে বলে গেছিলেন, ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ নিজেকে জানো।
আমরা পরের আঙিনায় ক্রমাগত উঁকি দিতে দিতে বেলা পার করে ফেলি, নিজ-কে চেনার বিন্দু দূরে সরে যায় ক্রমে। বেলা শেষে ঘর অথবা পর কোনো জানাটাই এক আনা পরিমাণ যথার্থ হতে পারে না। অপরের হেঁশেলের গাল-গল্প, মৌরলা মাছ-ভাজা তেলের সুবাস কিংবা কার বাড়িতে আজ দুধে পোড়া লেগে তাদের দোর লক্ষ্য করে অমঙ্গল রওনা দিলে সেসবের প্রতি প্রবৃত্তিগত আগ্রহকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা ছিল আশৈশবকালের। নিজের চারিদিকে সামর্থ্য অনুযায়ী বই-খাতা-কল্পনার ঘেরাটোপ দিয়ে অপরের আঙিনা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি নিজ-কে। সময় বিশেষে তার কুফলও টের পেয়েছি ঠিক, কিন্তু এখন বুঝি সুফল আছে তার চাইতে ঢের বেশি৷ আমরা যে কিছুই না বুঝে, কিছুই না জেনে উপনিষদে শুধু একখান ধর্মের পতাকা গুঁজে তাকে বইয়ের তাক থেকে আলাদা করে ফেলেছি এ-ও আমাদের ঐ না জানারই ফল।
আমি নিজে কী চাই আর কী চাই না, কতটা চাই, কত বিন্দু বেশি হলে গ্লাসের জলটা উপচে পড়ে মেঝে ভাসাবে সেটুকু বোঝা প্রয়োজন। অথচ, ঐ! পরের ঘরের টান! আর এদিকে ঘরের মেঝে উপচে পড়া জলে ভেসে যায়… গড়াগড়ি খায় নিজের মন। অদৃশ্য ধুলিকণা আর জলে মিলেমিশে মনখানা মলিন মণ্ডে পরিণত হয়। যতক্ষণে টের পাই ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে ঢের। চোখের ওপর আঙুলের আড়ালটি এনে বেলা মাপতে গিয়ে দেখি সূর্য ঢ’লে পড়েছেন সেই কখন! আমিই খেয়াল না করে কাজের বদলে অপরের আয়োজনে হাপিত্যেশ করে গেছি।
বেলা পড়েছে। এখন অপরের কিংবা নিজের কর্ম, অন্ন, অবস্থা আর অবস্থান জানান দেওয়ার অথবা জেনে নেওয়ার জটিল বুননকৌশল ছেড়ে বরং নানান খাপছাড়া ভাবনা ট্রেনে-বাসে-ট্রামে সময় কিংবা অসময়ে আসলেও লিখে রাখার চেষ্টা করি। বুঝি নিজের মনকে বোঝার জন্য মনই প্রশ্নোত্তর পর্ব গড়ে তোলে। একক সংলাপের অভ্যেস তো আমার সেই কতকালের… এখন সেসব স্বীকার করে লিখে রাখা যাক, নিজেরই প্রয়োজনে, নিজেকেই জানার তাগিদে।
“আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।
বুদ্ধিংতু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।”

