
উৎসর্গীকৃত কবিতাগুচ্ছ
রূপশ্রী ঘোষ
উৎসর্গ-মা
আমার মাথার পাশে বসে থাকা প্রতিটি প্রহর মানেই তুমি,
নরম স্বরে জাগিয়ে দেওয়া আমার প্রতিটি ভোর মানেই তুমি,
আমার তীব্র ক্ষিদের জ্বালা ঘুচিয়ে মনের প্রশান্তি মানেই তুমি,
কপালের ভেজা জলপট্টি থেকে গড়িয়ে পড়া জল মানেই তুমি,
আমার কাঁটাফোটা পায়ের ক্ষতে প্রলেপ লাগানো মানেই তুমি,
প্রতিটি রাতে মুখে বালিশ চেপে যে কান্না গোপনে বয়ে যায়
ডুকরে ওঠার আগে, সবার প্রথম বুঝে নাও কিন্তু সেই তুমিই।
১
দক্ষিণ হাওয়া এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,
ঠিক তোমার মতো
তুমিও যেভাবে ঘুম পাড়িয়েছো
গোটা শিশুজন্ম। ভোরের আলো এসে চোখ ছুঁয়ে দিলে
বুঝি, এও তোমারই মতো দেখানো একটা পথ, যেখানে
নদী বয়ে গেছে সরলরেখায়,
জ্যোৎস্না রাতে বাতাসে যখন
ভাতের গন্ধ ওড়ে, তখনো বুঝি, মা, এও তুমিই হবে,
আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে আছো, সন্তানস্নেহ পাবে বলে।
২
দুহাতে শিশুমুখ কোলে তুলে প্রতিটি চুম্বনে তুমি
ভুলে যাও, তোমার আকাশ বিদীর্ণ করা চিৎকার,
ভোরের আলোর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলো দোলনায়
শুয়ে থাকা দেয়ালা, অজুত স্বপ্ন চোখে নিয়ে তুমি
প্রতিদিন কাঠের উনুনে চড়িয়ে দাও ভাতের হাঁড়ি,
দুমুঠো শান্তি মুখে তুলে দিয়ে অপেক্ষায় থাকো রোজ
কবে তোমারই মতো আকাশ চিৎকার করে বলবে একদিন
রত্নগর্ভা তুমিই ছিলে, উড়ো চিঠি আসে, হেসে ওঠে মাটির উঠোন।
৩
আমি কি তোমারই প্রতিচ্ছবি? কোনো উত্তর
আসে না দেওয়ালে হেলান দেওয়া আয়না থেকে,
রত্নাকর হয়ে যখন আমার কোনো পাপ কাজের
দায়ভার চাপিয়ে দিতে চেয়েছি তোমার কাঁধে, তুমিও
অস্বীকার করেছ তোমার প্রসব যন্ত্রণা। অথচ তুমিই…
একদিন উইঢিপি সরিয়ে খুঁজে নিতে চেয়েছ নিজেকে
৪
বৌদ্ধ ভিক্ষুক নও তুমি, সামান্য মাধুকরীও তোমার
লক্ষ্য ছিল না কোনোদিন, কোনো জলকণার কাছে,
একা হাতে সামলে নিয়েছ অপ্রত্যাশিত ঝড়ের দাপট,
সভ্যতার গালে সপাটে কষিয়েছ চড়, বুঝিয়ে দিয়েছ
কীভাবে দাঁতে দাঁত চেপে আগলে রাখতে হয় প্রসব যন্ত্রণা
যে অঙ্কুর আজ উচ্চ শিরে, বসুন্ধরার বুকে নিয়েছে বৃক্ষ জন্ম,
সেও আসলে তোমারই গর্ভে লালন করা রক্তমাংসের পিণ্ড।
বৌদ্ধ ভিক্ষুক নও তুমি,
সামান্য মাধুকরীও তোমার লক্ষ্য ছিল না কোনোদিন।
****
৫
শিশু জন্ম দিতে দিতে ক্লান্ত হওনি কোনোদিন,
ভেবেছ অনেকবার, শেষ করে দেবে নিজেকে
যখনই তোমার চোখের সামনে ফুটে উঠেছে
চোখে কাপড় বাঁধা গান্ধারী মূর্তি, তখনই চুপ
হয়ে গেছ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের চোখ রাঙানিতে।
ভেবেছ অনেকবার বসুন্ধরা মায়ের কথা,
গাছপালা, নদী নালা, সবুজ ধানখেতের কথা,
আলো হাওয়া নিয়ে কত খুশি আজ ‘মা বসুন্ধরা’,
তুমিও নীরবে তাকিয়ে আছো সেই আলোর পথে।
****
৬
ঝরাফুলও একদিন কুঁড়ি জন্ম নিয়েছিল
পৃথিবীর বুকে। সেদিন ফুল গাছের মতোই
হেসে উঠেছিল, লতাপাতা, ঘাস, প্রজাপতি।
অজানা ঝড় এসে ধ্বংস লিখে দিয়ে গেল
রাত্রির বুকে। জেনো, প্রতিটি ধ্বংসের
পায়ের ছাপেই লেখা আছে প্রতিটি ‘মা জন্ম’।
৭
স্বপ্ন বুনতে বুনতে ধান দূর্বায় সাজাই নরম কলার ভেলা,
ছোট্ট তরী হয়ে নদীর বুকে, ঠিক ভেসে যাবে একদিন,
একলা হবে ঘাট, অপেক্ষার গায়ে ছেয়ে যাবে সবুজ শ্যাওলা,
জেটির গায়েও লাগবে রঙিন মরচে, অথৈ জলে নোঙর ফেলা হবে,
গুণতে গুণতে দিন ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই, জানি, দূর সমুদ্র
জাহাজ হয়ে ফিরবে তুমি, পালতোলা এক উঁচু মাস্তুল সঙ্গে নিয়ে।

