
শাশ্বত বসুর কবিতা
নিলামী স্বর
ভেবেছিলাম নিলাম হব!
তোমার চোখের আকরিক শূন্যতায়।
একটা টোকায় যেখানে আশ্রয় নেয়,
দিশাহীন মেঘের দল, নীলাম্বরী বৃত্তের কিনারে।
মাথা কুটে মরে, আয়ুহীন নিরন্ন অশেষ।
তোমার ঠোঁটের মালভূমি উষরতায়,
প্লেটোনিক লাভ ক্রমশঃ ডিভাইন হয়ে উঠবে,
বদল করা ফ্ল্যাটের ঠিকানায়।
অক্ষর যখন অপরাধী, এক আঁজলা জল যখন
নিরম্বু উপবাসে কাটিয়ে দিচ্ছে, অস্ফুট সকালের
বাঁধা ধরা ঘন্টা-মিনিট-সেকেন্ড,
প্রতিটি রক্ত আর ঘামের বিন্দু যখন
ধৌত করে আমাদের ভালোবাসার বাসর,
তখন একটা ভ্রূণ কেন অবুঝ হাত পা চালায়
আমার গর্ভ থেকে গৰ্ভান্তরে, নিস্কলুষ পিতৃপরিচয়ের আহ্বানে?
আমার কপাল ফেঁটে ঝরে পড়া রক্তে,
ওর নাম দিই অগ্নীশ্বর!
ম্যানহোল
পৃথিবীর বুকে একটা গভীর ক্ষত!
খোলা ম্যানহোলের মত কৃষ্ণকায় গহ্বর।
ভাবি আমি একদিন, এই গর্তে পড়ে হারিয়ে যাবো।
কেউ আর খুঁজে পাবে না আমায়।
দিন ফুরোলে পরিচয়পত্র শূন্য হয়ে যায়।
ঘন্টায়-মিনিটে-সেকেন্ডে ভীষণ যুদ্ধ শুরু এখন।
ওরা সবাই ‘মৃত উৎসবের দিনে’
আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
তারপর যখন পেন্সিল হাতে ঘুমাতে যাই,
আমার অবনমনে কবিতারা এসে ভিড় করে।
‘হারিয়ে ফেলার কবিতা’। ওদের ভেতর থেকে
একটু একটু করে ‘আমি’কে খুঁজে বের করি।
আবার পায়ের পেশীতে টান ধরে, সাতপুরনো মেরুদন্ড বলে,
“একটু বোসো”। থিকথিক করা মানুষের বুকে,
আমি আবার ‘ম্যানহোল’ খুঁজে পাই।
হৈমন্তী
এক সন্ধ্যেয় আকাশ জোড়া,
বৃষ্টি নামে হিমের তোড়া।
রাতের শেষের কালচে পায়েস,
খেঁজুর রসে শিউলি আয়েস।
কিশোরীবেলার বিলীন আলো,
স্থবির চোখে মুখোশ কালো।
অসুখী চাঁদে রক্ত বাড়ে,
সর কুয়াশায় ঝিমিয়ে পড়ে।
কারা এত সাপ পুষেছে!
ঘুমের ভিতর ঘুম ঢুকেছে।
নিজের প্রেমে নিজেই পড়ি,
কামিনী মরে জড়িয়ে শাড়ি।
হেমন্তের এই মেয়েবেলাতে,
‘সা’ বাজলো সারেঙ্গীতে।
উড়িয়ে ঘুম, পুড়িয়ে ডানা,
ঋতু জাগে,
বায়ুরও তাই আসতে মানা।
গভীর রাতের সারিগান
অনেক রাত এখন!
কোজাগরী চাঁদটা উড়ে গেছে কোন অবেলায়।
বিশাল একটা প্যাঁচা মেপে নিচ্ছে,
কতগুলো উলঙ্গ সরীসৃপের ঠিকানা।
হলদেটে জ্যোৎস্নার হাত ধরে এখন হেটে যায়,
উলঙ্গ বুভুক্ষু পথিকের দল। ওঁদের ঘরে লক্ষ্মীর বড় অভাব!
ছন্নছাড়া শীতল রুটি আর বিশালাকার পূর্ণিমা এসে হাঁক দেয়,
“কারা চেয়ে আছ্ ওই কঙ্কালসার অস্থিমজ্জার দিকে?”
“কারা ডাক দিয়েছ সন্ধ্যে নামার আগে?”
উত্তর আসে না।
দ্রোহের মিছিল চলে উলম্বের ধারাপাতে।
দূরে ভেসে যায় নিভন্ত সুর, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা যেন।
একটা ক্ষীণ কন্ঠ আর একটা রোদ-জলহীন জেগে থাকার অপেক্ষায়,
চাপ চাপ অন্ধকার ফুটে আলো জাগছে তখন।
নববধূর সিঁদুরে পাগলামি খেলা করছে।
লক্ষ্মী-পূর্ণিমা-চাঁদনীরা পুরোনো কবিতার সম্মোহনে দময়ন্তী সাজে।
পানপাতা আর চাঁদমালার আড়ালে,
এপিটাফের ওঠানামায়, মারিজুয়ানার নির্ভুল স্বৈরাচার এর মাঝে,
উদাসীন মহাকাল গিলে ফেলে, লক্ষ্মীমন্ত ইউফোরিয়া আর নেশাতুর অর্কিড বন।