
ধারাবাহিক উপন্যাস ঋতায়তে (পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্ব ) রিনি গঙ্গোপাধ্যায়
আটের দশকের মফসসল শহরে বেড়ে উঠছিল একটি মেয়ে। ঋতি। এক অসুস্থ শৈশবে, ভিড়ের মধ্যেও নির্জনে তার বড়ো হয়ে ওঠা। একটু যত্ন, সামান্য ভালোবাসা না পাওয়া কাঙাল এই মেয়েটির বড়ো হয়ে ওঠা এই উপন্যাসের বিষয়। দমবদ্ধ এক পারিবারিক আবহে অদ্ভুত বৈপরীত্যে ভরা মেয়েটির জীবন, তার লড়াই! নারী হিসেবে, অসুন্দর হিসেবে, গরীব হিসেবে এই সমাজ মানসের সঙ্গে তার একার লড়াই। পাশে রয়েছে মা, নিরুপায়, অসহায়। তবু অদম্য জেদ ঋতিকে এগিয়ে দিয়েছে। যদিও এই উপন্যাস ঋতির ক্ষরণের ইতিহাস। তার নির্মল মন, তার নিখাদ ভালোবাসার ক্ষরণ। সমকাল, তার মনবদল, নববইয়ের বিচিত্র পট পরিবর্তন সবই ছুঁয়ে আছে এই উপন্যাসের শরীর! ঋতি কি শেষপর্যন্ত পৌঁছোতে পারবে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে! আজ প্রকাশিত হল উৎসব পরবর্তী দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্ব।
পঞ্চম পর্ব
৪১
সেদিন অনন্ত মিল থেকে এসেই সামনের ঘরের ভাড়াটে বৌটার ঘরে বেল বাজালো। ঋতি বা শ্রী অনন্তকে ঢুকতে দেখেনি। অনন্ত ওই বৌটার সঙ্গে খানিক কথা বলে তারপর তার নিজের ফ্ল্যাটের বেল বাজালো। ঋতি দরজা খুলেছে। দেখছে মমতা কাকিমা ওদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। শ্রী মমতাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, মমতা, কিছু বলবে?
না, এমনিই। মমতা কেমন টেনে টেনে বলে।
অনন্ত জুতো খুলে শ্রীর সামনে এসে বলে, তোমার পিসেমশাই একটা খবর পাঠিয়েছে।
শ্রী তাকিয়ে আছে।
ভাই অ্যাসিড খেয়েছে।
শ্রী প্রথমে বুঝতে পারেনি কথাটা। কী হয়েছে? কী বললে?
ভাই আজ ভোরবেলা অ্যাসিড খেয়েছে।
শ্রী অনন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে। সেখানে অবিশ্বাস যেন চুঁইয়ে পড়ছে। এই অসম্ভব ঘটনাটা ঘটল কি করে!
মমতা ততক্ষণে এই ফ্ল্যাটের ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। রাগেশ্রীদি তুমি চিন্তা করো না। হসপিটালে নিয়ে গেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
শ্রী আরো একপ্রস্ত অবাক হয়। মমতা জানল কী করে! অনন্ত বলেছে!
ওদিকে ঋতি খোলা দরজাটার সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। মামা আত্মহত্যা করেছে! সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না কথাগুলো। চোখদুটো তার আরো খানিকটা কালো দেখাচ্ছে।
এই তো কয়েকমাস আগে মামা এসেছিল এই ফ্ল্যাটে। তার জন্য চকোলেট নিয়ে এসেছিল। তখন বাবা বাড়িতে নেই। মা, মামা আর সে মিলে কত কথা হচ্ছিল। মামা যে কোনো বাচ্চার কড়ে আঙুলটা আদর করতে ভালোবাসে। ঋতির কড়ে আঙুলটা নিয়েও আদর করছিল। ঋতি হাসছিল। মামার গোঁফ রাখা নিয়ে কি কি মজা হয়েছিল সেসব বলছিল। তারপর বাবা ফিরতে মামা বাবার সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করছিল। অনন্তদা ভালো আছ?
ওই চলছে। বাবা গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল। তারপর তোমার চাকরি বাকরির কি অবস্থা? ছোটোকাকা কিছু ব্যবস্থা করতে পারল?
স্কুলটার অ্যাফিলিয়েশনের জন্য কেস চলছে। আর কয়েকমাসের মধ্যে বোধহয় মিটে যাবে।
হ্যাঁ, তোমাদের কাকা, দাদা আছে। তোমাদের আর চিন্তা কি! ঘরে বসে চাকরি হয়ে যাবে!
মামা বাবার এই খোঁচাটা বুঝে মাথা নিচু করে থাকল। কোনো কথা বলল না।
রাতে খাওয়ার সময় শ্রী সবাইকেই একসঙ্গে খেতে দিচ্ছে। এ বাড়িতে ডাইনিং টেবিল থাকলেও বেডরুমে টিভির সামনে যে ছোটো জায়গাটা রয়েছে ওখানে বসে টিভি দেখতে দেখতে খাওয়ার অভ্যেস আছে এদের। শ্রী ভেবেছিল, ভাই এসেছে। আজ সবাই মিলে টেবিলে বসেই খাওয়া হবে। কিন্তু অনন্ত ঋতিকে নিয়ে মেঝেতে খেতে বসে পড়ল। ভাই তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে এসে দেখে যে অনন্ত ঋতিকে নিয়ে খেতে বসে গেছে। ওখানে তো আর কারো বসার জায়গা নেই। ভাই ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে দেখে শ্রীর এতো মায়া হলো! আয় বাবু, আমি আর তুই টেবিলে বসে খাই।
পরদিন সকালে ৯/৯:৩০নাগাদ ভাই বেরিয়ে যাবে। শ্রীর মনের ভিতরটা কেমন খচখচ করছে। ভাইটার মনটা ভালো নেই। কেমন উল্টোপাল্টা কথা বলে। আর কি ভীষণ টেনশন করে। সাইকায়াট্রিস্ট দেখানো হচ্ছে। তবু তেমন তো কিছু উন্নতি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ও বলছিল, ওর কোন্ বন্ধু বলেছে, দেওয়ালের একটা বিন্দুর দিকে তাকিয়ে কনসেনট্রেট করলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ও সেটা করার চেষ্টা করে। কিন্তু বড্ডো কষ্ট হয়। মাথার ভিতর কেমন সব তোলপাড় হয়ে যেতে থাকে।
যেটা করতে কষ্ট হয়, সেটা আর করিস না বাবু।ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিস এ নিয়ে?
না রে। ডাক্তারবাবু তো যে ওষুধ দেয়, খালি ঘুম পায়। কেমন ঝিমুনি লাগে সবসময়। তারওপর পায়খানা এমন কষে যায় যে…
ডাক্তারকে বলিসনি। বললাম তো। তাও ওই ওষুধই খেতে দিল। জানিস দিদি, মেজ জামাইবাবু যায় তো, আর খালি বলে, তোমার কোনো মেয়েকে ভালো লাগলে ডাক্তারকে বলো! বারবার একই কথা বলে, জানিস তো!
শ্রী গম্ভীর হয়ে বলে তুই কিছু বলিস না কেন!
কি বলব,বল! আমার কারো সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে বলতে কিসের অসুবিধে? কিন্তু মেজ জামাইবাবু যেন কেমন সন্দেহ করে।
বাদ দে, জানিসই তো কেমন লোকজন সব! তুই ভালো আছিস বাবু! তোর মন ভালো আছে! আর ওসব উল্টোপাল্টা ভাবিস না তো!
খুব ভয় লাগে রে দিদি! ছোড়দি, টুয়া ওরা তো কেউ ভালো নেই! ওদের কি হবে। ছেলেদুটোকে নিয়ে ওরা কোথায় যাবে! তুইও তো ভালো নেই দিদি! তোকে কত পরিশ্রম করতে হয়!
তোকে এসব ভাবতে হবে না বাবু। তোর চাকরিটা পাকা হোক, আমরা তোর একটা বিয়ে দেব। তোর মনের মতো মেয়ের সঙ্গেই দেব দেখবি, তুই ভালো থাকবি!
ভাই একটু লজ্জা পেল! লজ্জা পেলেই ওর কানটা লাল হয়ে ওঠে। ফর্সা টুকটুকে মুখটায় একটা গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ে। কি যে তুই বলিস না দিদি!
ভাই চলে গেল। ও হয়তো হেঁটে একটু এগিয়েছে, রাগেশ্রীর ভিতরটা কেমন যেন আবার খচখচ করছে। আচ্ছা, ওর মনটা এতো অশান্ত হয়ে আছে! ওকে কি একবার বেলুড়মঠে নিয়ে গেলে ভালো হতো। ওখানে মহারাজদের সঙ্গে কথা বললে, ও কি একটু শান্তি পেত! ও তো রামকৃষ্ণ -বিবেকানন্দকে এতো মানে! ওদের বই পড়ে! ভাবতে ভাবতেই রাগেশ্রী ছুটে গেছে বারান্দায়। বাবুকে দেখা যাচ্ছে না। ধোপার ঘরের ছেলেটা সামনেই বসেছিল। ওকে ডেকে বলেছে, দেখ তো, আমার ভাই যাচ্ছে। ডাক তো!
ছেলেটা দৌড়ে গেলও। কিন্তু আর দেখতে পেল না।
শ্রী ভাবল কি জানি, বেলুড়মঠে নিয়ে গেলে কি ভালো হতো! বাবু থেকে গেছে দেখলে অনন্ত এসে আরো মেজাজ দেখাত। তাতে ভাইয়ের আরো কষ্টই হোত। তার থেকে ও চলে গেল, যাক!
সেই শেষ দেখা শ্রীর সঙ্গে ভাইয়ের। আর তারপর আজ এই খবর।
৪২
গত তিনদিন আগেই শ্রীর মা আর বাপী চোখের ডাক্তারের কাছে গেছেন। বাড়িতে অস্মি আছে। রান্না করছে। অস্মির ছেলে ওপরে ছোটো কাকার ছেলের সঙ্গে খেলছে। ভাই হঠাৎ রান্নাঘরে এসে হাজির। উদ্ভ্রান্ত লাগছে ওকে। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড ঘামছে। অস্মি বাবুকে দেখেই ভয় পেয়ে গেছে। কী হয়েছে তোর ভাই? এরম লাগছে কেন?
ছোড়দি বলে ডেকে ভাই রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পড়েছে।
অস্মি তাড়াতাড়ি সব ফেলে ওর কাছে দৌড়ে এসেছে। কী হয়েছে ভাই? এমন করছিস কেন? কী হয়েছে তোর?
অস্মির ডাকাডাকিতে ওপর থেকে ছোটো কাকিমা আর ওর ছেলেও নেমে এসেছে। সবাই মিলে প্রশ্ন করছে। ভাই কোনো উত্তর দিতে পারছে না। সকলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
কি মনে হতে ছোটোকাকিমার ছেলে রান্নাঘরের বাইরে এসে দেখে বারান্দার কিছুটা দূরে আম গাছে বিষ দেওয়ার শিশিটা উল্টে পড়ে আছে। বিষটা মাটিতে গড়াচ্ছে। ও সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে এসে বলে, বাবুদা তুই বিষ খেতে গেছিলি?
শুনে অস্মি চিৎকার করে উঠেছে। ভাই, কী করছিলি ভাই! তুই কি সব্বোনাশ করছিলি!
ভাই এবার মাথাটা নিচু করে কাঁদতে শুরু করেছে। আমি আর পারছিনা ছোড়দি। আমি আর বেঁচে থাকতে পারছিনা রে!
কেন এরকম বলছিস ভাই! কী হয়েছে তোর!
আমাকে ডাকছে রে। আমাকে কে যেন ডাকছে! তার কাছে যেতেই হবে!
কে ডাকছে? কী বলছিস ভাই! অস্মি আবার কাঁদতে শুরু করে।
এর মধ্যে বাপী -মা চলে আসায় ব্যাপারটা সামলে যায়। যদিও শ্রীর মা কান্নাকাটি করেছিলেন সেদিন। তুই কি আমাদের বাঁচতে দিবি না! তুই কী চাইছিস বাবু!
বাবু চুপ করে থাকে। তবে ও যে ঠিক নিজের মধ্যে নেই একথা বোঝা যায়!
বাপী বলতে থাকে, আর তো শেষ সুনানিটুকু বাকি। স্কুলের মামলাটা তো মিটে যাবে! তুই এখন এমন করছিস কেন!
শ্রীর মা বলেন, মামলাটা মিটে গেলেই আমরা তোর বিয়ে দেব। দেখিস বাবু সব ঠিক হয়ে যাবে!
এই ঘটনার তিনদিনের মাথায় ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সাইকেলটা বাইরে বের করছিল বাবু। বারান্দার কোণায় চোখে পড়ে যায় অ্যাসিডের বোতলটা। তারপর আর কিছু মনে নেই। কখন বোতলটা হাতে তুলে নিয়েছে, কখন জল খাওয়ার মতো করে পুরো বোতল গলায় ঢেলেছে কিচ্ছু মনে নেই। শুধু মনে আছে পড়ে যাচ্ছিল সাইকেলটা জোরে আওয়াজ করে পড়ে গেল। বাপী ছুটে আসছে। আর তার বমি হচ্ছে। দলা দলা রক্ত আর মাংস বেরোচ্ছে। প্রথমে খানিকটা ফ্রিজের ঠাণ্ডা জল খাইয়ে তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মালদা হসপিটালে।
শ্রী আর অনন্ত বিকেলের বাসে বেরিয়ে পরদিন ভোরবেলা পৌঁছলো মালদা। হসপিটালে পৌঁছে প্রথম ভাইকে দেখে একদমক কান্না উঠে আসছিল শ্রীর গলায়। কষ্ট করে পুরোটা গিলে নিল। ওর সামনে কাঁদলে চলবে না। ভাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। শ্রী ওর মাথায় হাত রাখতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।শ্রী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কী করলি বাবু? বলে কেঁদে উঠল।
ভাই ক্রমাগত রক্ত বমি করছে। গ্রাসনালীটা পুরো জ্বলে গেছে। লিভার মারাত্মক এফেক্টেড। প্যাংক্রিয়াস পুড়ে গেছে। শুধু হার্ট আর কিডনি ভালো আছে। দুদিন অবজারভেশনে রেখে ডাক্তার বললেন অপারেশন করতে হবে। কিন্তু মালদা হসপিটালে সেই ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই। কলকাতায় পিজিতে নিয়ে যেতে হবে। আমরা রেফার করে দিচ্ছি।
কিন্তু পিজিতে সিট না পাওয়া গেলে তখন কী হবে!
শ্রীর ছোটোকাকা বলল, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
ভাইকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসা হলো পিজিতে। শ্রী, অনন্ত, বাপী,মা, অস্মি, অস্মির ছেলে সবাই এসে উঠল অস্মির বাড়িতে। ওখান থেকেই হসপিটালে যাতায়াত করা হবে। শ্রী প্রতিদিন সকালে চলে যায়। বাবুকে রাখা হয়েছে টপফ্লোরে। বাবু একাই আছে ওখানে। আর কোনো পেশেন্ট নেই। সারাদিন শ্রী বাবুর কাছে থাকে। ভিজে টাওয়াল দিয়ে ওর গা মুছিয়ে দেয়। বাবুর গলার আওয়াজটা খ্যাসখ্যাসে হয়ে গেছে। ও শুধু বরফ খেতে চায়। কিন্তু বেশি বরফ খেলে চেস্ট ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। শ্রী তাই সবসময় দেয় না। বাবু কাকুতি মিনতি করতে থাকে। রক্ত বমি করলে শ্রীই ওর গলা ঘাড় মুছিয়ে দেয়। মাথার চুলে থোকা থোকা রক্ত জমে গেছে। মাথা ধুইয়ে সেগুলো পরিষ্কার করে দেয়। তখন বাবু সেই ছোটোবেলার মতো হাসে। ওকে দেখে শ্রীর চোখে জল উপচে পড়ে। বাবু তখন দিদির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কখনো নিজের খুব গরম লাগলে দিদিরও গরম লাগছে ভেবে ভিজে টাওয়ালটা দিদির মুখে বুলিয়ে দেয়। হাতটা বেশিক্ষণ উপরে তুলে রাখতে পারে না। আপনা থেকে যেন খসে যায়। অনন্ত বিকেলে দেখা করতে গিয়ে ভাইয়ের পা-টা গুলো দেখেছে। ভিতরের সব মাংস যেন গলে গিয়েছে। এই অবস্থায় ছেলেটা বেঁচে আছে কি করে সেটাই বিস্ময়। শ্রীর মা, অস্মি বিকেলবেলা এক-দুদিন দেখা করতে এসেছে। পরিপাটি করে সেজেগুজেই এসেছে। ওরা জানে বিপদ কেটে গেছে। সুস্থ হয়ে যাবে বাবু। শ্রী সারাদিন বাবুর কাছে থেকে বাবুর অবস্থা দেখেও একই কথা ভাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময় লাগলেও বাবু সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু অনন্ত, শ্রীর পিসেমশাই এরা জানে অবস্থা ভালো নয়। অবজারভেশনে রাখা আছে। অবস্থার উন্নতি হলে অপারেশনের কথা নিশ্চয়ই ভাবা হবে। যদি না ততদিনে হার্টফেল করে যায়! সেটার হাইচান্স আছে। আর অপারেশন করা যদি সম্ভব হয়ও শুধু বেঁচেই থাকবে। কিন্তু চিরকালের মতো ইনভ্যালিড হয়ে গেছে অলরেডি। এসব নানা সম্ভাবনার পরিকল্পনা খুব বেশিদিন করতে হলো না অবশ্য। ঠিক পনেরো দিনের মাথায় বাবু চিরতরে চোখ বুজল। শনিবারে জন্ম, শনিবারেই চলে গেল বাবু।অবস্থা আগেরদিন থেকেই খারাপ হচ্ছিল। হেঁচকি তুলছিল ক্রমাগত। শ্রী একটু একটু করে ঠাণ্ডা জল খাওয়াচ্ছিল। ওই অবস্থায় রেখেই রাতে চলে আসতে হয়েছিল। পরদিন সকালে সবাই মিলে যেতে বারণ করলো। বলল, এতোদিন তো টানছ। একটা দিন রেস্ট নাও। আমরা সামলে নেব। সেদিনই বিকেলে খবর এলো। শ্রীর কাকু হসপিটাল থেকে ফিরে এসে শ্রীর মার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, বাবু তো চলে যেতেই চেয়েছিল। ওকে যেতে দেওয়াই ভালো।
শ্রীর মা হঠাৎ মুখ ঝামটা দিয়ে উঠেছে। কি আবোল তাবোল বকছ!
ঠিকই বলছি বৌদি। বাবু আর নেই।
শ্রীর মা আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। হঠাৎ বিছানার ওপর পরে গেলেন।
গোটা বাড়ি জুড়ে যেখানে হাহাকারের রোল ওঠার কথা ছিল, সেখানে যেন পিন পড়লে শব্দ শোনা যাবে। গোটা বাড়ির মানুষগুলো যেন পাথর হয়ে গেছে। কেউ কাঁদছে না। সবাই চুপ।
ঋতি এতো ঘটনা কিছুই জানত না। অনন্ত খবর দিতেই বিশ্বদেব আর মাধুরী বেরিয়ে পড়েছিল অস্মির বাড়ির উদ্দেশে। ঋতি যেন আন্দাজ করছিল কি ঘটতে চলেছে। আগের দিন ওরা তিন বোন একসঙ্গে ঘুমোচ্ছিল। রুচি বোধহয় মাঝরাতে ঘরের ভিতর পায়চারি করছিল। রুচিরও মন মেজাজ ভালো নেই। রাজার সঙ্গে ঝগড়া চলছে! রুচি কাঁদছিল। তার মধ্যেই হঠাৎ ঋতি ঘুম থেকে উঠে রুচিকে ঘরের মাঝখানে দেখে চিৎকার করতে শুরু করে। বীভৎস ভয় পেয়েছিল ঋতি। চিৎকারে পাশে সান্যালদের পর্যন্ত ঘুম ভেঙে যায়। বিশ্বদেব পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এসে সামাল দেয়। তখনকার মতো ঋতির পিঠে হাত বুলিয়ে, ঋতিকে জল খাইয়ে শান্ত করা হয়। ঋতি ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল।
পরদিন সকালে কিন্তু ঋতিকে রীতিমতো জেরা শুরু করেছিল বিশ্বদেব । তুই কাল রাতে ওভাবে চিৎকার করলি কেন!
ঋতি চুপ।
উত্তর দিচ্ছিস না যে!
ঋতি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ভয় পেয়েছিল। সে কথা কি জ্যেঠু বোঝেনি। এর কি উত্তর দেবে সে!
তারপরই অনন্তর ফোনটা আসে। বিশ্বদেব, মাধুরী বেরিয়ে যায়।
খানিকক্ষণ পর রুচি ঋতিকে খবরটা দেয়। ঋতি বসে পড়ে মেঝেতে। ওর মাথার মধ্যে শুধু ঘুরছিল সেদিন বাবা মামাকে না নিয়েই খেতে বসে গেল!
৪৩
বডি পোস্টমর্টেম করা হলো। বাড়িতে যখন দেহ নিয়ে আসা হলো দুদিনের সমস্ত জমাট হাহাকার আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল। কে যে কাকে সামলাবে তার ঠিক নেই। অস্মি চিৎকার করে বলে উঠল, এই শয়তান জামাইগুলোর জন্য আমাদের ভাই চলে গেল!
সবাই স্তম্ভিত হয়ে একথা শুনল।শ্মশানে শ্রীর বাবা ছেলের মুখাগ্নি করলেন। অনন্ত বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। শ্রীর কাকু বলল হিন্দু শাস্ত্র মতে বাবা বেঁচে থাকলে বাবাই ছেলের মুখাগ্নি করে। শ্রীর বাপী ভেঙে চুরমার হয়ে গেছেন। তবু তাকে দিয়েই জোর করে সমস্ত কাজ করালো শ্রীর কাকু। সব দেখেশুনে অনন্তও আর চোখের জল ধরে রাখতে পারছিল না। দাদার কাছে ফিরে এসে অনন্ত পাগলের মতো কাঁদছিল। মাধুরী, রুচি, রুশি সবাই কাঁদছে। শুধু ঋতির চোখে জল নেই। ঋতি একদৃষ্টিতে বাবাকে দেখছে। তার চোখে তীব্র অবিশ্বাস ঝরে পড়ছে। এই প্রথম বাবাকে তার তীব্র বিশ্বাসঘাতক বলে মনে হচ্ছে। বাবার সঙ্গে তার এতোদিনের সমস্ত কথা মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে। যা-ই করে থাকুক মায়ের কাকু বা নিনান তার জন্য মামার সঙ্গে বাবা খারাপ ব্যবহার করল কেন! মামাকে এতো কষ্ট দিল কেন! মামা তো এমনিতেই যন্ত্রণার মধ্যে ছিল।এতো যন্ত্রণা যে অ্যাসিড খাওয়ার কষ্ট তার থেকে কম ছিল। শেষ করে ফেলল নিজেকে। তাকে সেদিনের ওই অপমানটা বাবা না করলেই তো পারত!
ওদিকে অস্মির বাড়িতে তখন অস্মির বর বাবুর মৃত্যুর কারণ নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু করেছে। একটা চিঠি বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বাবু পকেটে নিয়ে ঘুরছিল। সেটাই তার লেখা শেষ চিঠি। সেখানে সে তার মা-বাবা, দিদি- বোন সকলের কথা লিখে গেছে। সকলেই তার খুব প্রিয়জন। তাদের খারাপ থাকাটা সে মেনে নিতে পারছেনা। তার বাবা-মা দেবতার মতো মানুষ। অথচ অসহায়। সে তাদের জন্য কিছুই করতে পারছে না। সে নিজেকে অপদার্থ বলে মনে করেছে। তার কাউকে ভালো রাখার ক্ষমতা নেই। সে বরং নিজেই তার বাবা-মার ওপর সার্বিক ভাবে নির্ভরশীল।তার মৃত্যুর কারণ এগুলোই। ইঙ্গিতে সেকথাই বলে গেছে বাবু। অথচ অস্মির বর খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে বাবুর কোনো প্রেমিকা ছিল কি না! তার সঙ্গে বিচ্ছেদই এই মৃত্যুর কারণ ইত্যাদি ইত্যাদি।
শ্রী বলে ওঠে আমার বাবু প্রেম করার ছেলেই নয়। বাবা-মা ছাড়া ও আর কিছু বুঝত না।
অস্মির বর বলে, না না দিদি আপনি বুঝতে পারছেন না। এই বয়সের ছেলে প্রেম করবে তাতে তো অসুবিধে নেই। সেই কারণেই এই ঘটনা ঘটল কি না সেটাই জানার চেষ্টা করছি!
কেন করছ সেই চেষ্টা! মানুষটা চলে গেল সেটা বড়ো না কি তার মৃত্যুর কারণটা বড়ো!
না দিদি, কারণটা তো জানতে হবে!
না জানার প্রয়োজন নেই। বাবু প্রেমে ধাক্কা খেয়ে এই পদক্ষেপ নিলে সেটা কারো অজানা থাকত না। কোনো কিছু গোপন করার মতো বুদ্ধি ওর ছিল না। ছেলেটা শুধু হতাশায় চলে গেল। বলতে বলতে শ্রী কাঁদতে শুরু করল।
ওদিকে এমন একটা সন্দেহ রুচিও ঋতির মনে ঢোকাবার চেষ্টা করছিল। রুচি নাকি বাবু মামাকে কোনো একদিন একটা মেয়ের সঙ্গে দেখেছিল। ঋতি তাকিয়ে তাকিয়ে শোনে। ওর কানে কিছু ঢোকে না। ওর মাথায় একটাই কথা ঘুরতে থাকে। মামা তো যে কোনো কারণেই হোক ভালো ছিল না। বাবা সব জানত। তারপরও বাবা কেন খারাপ ব্যবহার করল! কেন খোঁচা মেরে কথা বলল! মামা কি নিদারুণ কষ্ট নিয়ে চলে গেল!
অপঘাতে মৃত্যু হওয়ায় তিনদিনের মাথায় কালীঘাটের মন্দিরে বাবুর শ্রাদ্ধ হলো। শ্রাদ্ধের পরেরদিন ঋতিকে নিয়ে অনন্ত অস্মির বাড়িতে গেল। শ্রী দেখল ঋতির ডান হাতে বিরাট বড়ো এক ফোস্কা। লাল হয়ে আছে চারপাশে। কী হয়েছে ঋতি?
দিদিভাই বড়া ভাজছিল । কড়াই থেকে উপচে তেল পড়ে গেছে।
ইস্… কবে হয়েছে এসব?
ঋতি মাথা নিচু করে বলে মামা যেদিন মারা গেল সেদিন।
শ্রী ঋতিকে কাছে টেনে নেয়। মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়ে। তবু ম্যাচিওরিটি এলোনা। এখনো বুঝলনা কারা ওকে ভালোবাসে আর কারা কষ্ট দেয়। এতো চুপচাপ মেয়েটা যে ওর মনের মধ্যে কি চলে কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। মার ওপর এতো বিরক্তি যে জ্যেঠুর বাড়ি গিয়ে পড়ে থাকে। সেখানে পড়াশোনাও ঠিক মতো হচ্ছে না! আর একবছরের মাথায় মাধ্যমিক! আচ্ছা, ও তো একটুও কাঁদছে না! মামার চলে যাওয়াটাকে ও কিভাবে দেখছে!
সেদিন ফেরার সময় বিধাননগর থেকে ট্রেনে উঠতে খুবই অসুবিধে হলো অনন্তর। সঙ্গে ঋতি ছিল। ঋতিকে ভিড় থেকে একটু বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে অনন্ত দুহাত দিয়ে ওকে গার্ড করে দাঁড়িয়েছিল। তারপর কোনোক্রমে বাড়ি ফিরে মাঝরাত থেকে অনন্তর হাতে যন্ত্রণা শুরু হলো। ঋতিকে ডাকতেই ঋতি বাবার হাতে গরম সেঁক করতে আরম্ভ করল। তাতে সাময়িক ব্যথা কমলেও সকাল থেকে ব্যথায় কাতরাতে শুরু করল অনন্ত। হাতটা একেবারেই তুলতে পারছে না। বিশ্বদেব খানিক বাধ্য হয়েই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার বললেন, হাতটা প্যারালাইসিস হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বদেব বাড়ি ফিরেই শ্রীকে ফোন করল। মেজ বৌ, অনেক তো হলো! আর কতদিন ওখানে পড়ে থাকবে! এখানে তোমার একটা সংসার আছে সেটা মনে আছে আশা করি!
শ্রী সবটা জানতে পেরে বাবা -মাকে অস্মির বাড়িতে রেখে পরদিনই বাড়ি ফিরল।
৪৪
শ্রী বাড়ি ফিরে ভাইয়ের জন্য শোক করার সময় পেল না। অনন্তকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হলো তাকে। অনন্ত ডান হাতটা একেবারেই নাড়তে পারছে না। হাতটা প্যারালাইসড হয়ে গেছে বলছে ডাক্তার। কিন্তু কী করে! কী এমন হলো যে অনন্তর ডান হাত প্যারালাইসড হয়ে যাবে! শ্রী ঠিক করল অন্য একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার। শ্রীদের ফ্ল্যাটেই একটি ফ্যামিলি থাকে। মা, ছেলে, ছেলের বৌ ও নাতি। লোকাল ছেলে। পাড়ায় খুবই পপুলার। শ্রী ওকেই গিয়ে ধরল। ছেলেটিকে সবাই ভালোবেসে চ্যাম্পিয়ন বলে ডাকে। চ্যাম্পিয়ন, তোমাদের ঘোষালদার অবস্থা তো দেখছই! আমি একজন ভালো ডাক্তারের খোঁজ করছি। তুমি কারো খোঁজ জান?
বৌদি, অর্থোপেডিক তো তুমি দেখিয়েছ। এখানে আরো একজন বড়ো অর্থপেডিক আছে। তাঁর কাছে যাওয়া যেতেই পারে। তবে তার আগে আমার এক বন্ধু আছে। তার কাছে দেখানো যেতে পারে!
ও, কে? অর্থোপেডিক?
না, ও হার্টের ডাক্তার। কিন্তু জেনারেল ফিজিশিয়ান তো বটে! একবার দেখাই যাক না!
আচ্ছা। তাহলে ঋতির বাবাকে নিয়ে আমি যাব?
না না, বৌদি। আমি পৃথ্বীকে বাড়িতে নিয়ে আসছি। ও আমার ছোটোবেলার বন্ধু। আমি বললে চলে আসবে।
কিছুক্ষণ পর চ্যাম্পিয়ন পৃথ্বী মুখার্জিকে নিয়ে ঢুকল। ছেলেটি খুবই ভদ্র। যত্ন করে অনন্তকে দেখে বলল, দাদা আপনার কিচ্ছু হয়নি। কোনো কারণে খানিকটা সময়ের জন্য আপনার হাতে ব্লাড সার্কুলেশন বন্ধ হয়ে গেছিল। তাই হাতটা নাড়াতে পারছেন না। আমি ওষুধ দিচ্ছি। কিন্তু কতগুলো এক্সারসাইজ দেখিয়ে দিচ্ছি। সেগুলো করুন। ঠিক হয়ে যাবেন।
ডাক্তারের কথা শুনে শ্রী একটু স্বস্তি পেলেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারল না। আগের ওষুধ বন্ধ করে অনন্তর নতুন ওষুধ, এক্সারসাইজ শুরু হলো। তিনদিনের মাথায় অনন্ত অল্প অল্প হাত নাড়তে শুরু করল। এক সপ্তাহের মাথায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠল। শ্রীর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
মা আর ফিরে যেতে চাইল না মালদায়। নিজের বাপের বাড়ি চাঁদগঞ্জে গিয়ে উঠল। শ্রীর দাদু বেশিরভাগ সম্পত্তিই শ্রীর ছোটো মাসিকে দিয়ে গেছেন। সেসব রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা নিজের গয়না বিক্রি করে শ্রীর মা-ই করেছিল। কিন্তু তারপরও কিছু জমিজমা আছে শ্রীর মায়ের। তাছাড়া বোনের ছেলেমেয়েরা আছে। মা মরা ছেলেমেয়েগুলোকে একদিন বুক দিয়ে আগলে ছিলেন শ্রীর মা। ওদের বিয়ের বন্দোবস্তও করেছিলেন। আজ ওদের ভরসাতেই বাপের বাড়ির ভিটেতে গিয়ে উঠলেন! শ্রীর বাবা একা মালদায় ফিরে গেলেন।
ভাই এভাবে চলে গেছে টুয়াকে বলা হয়নি। টুয়ার কোলে এখন সদ্য দুমাসের মেয়ে। এই অবস্থায় ওকে এসব কথা জানানো ঠিক হবে না বলেই বলা হয়নি। কিন্তু টুয়ার বর ওকে শেষপর্যন্ত সব জানাল। টুয়া বাবু -মার কাছে যাওয়ার জন্য খুবই আকুল হয়ে উঠল। কিন্তু ততদিনে তো ওঁরা কলকাতা ছেড়ে চলে গেছেন। অবশ্য বেশিদিন কলকাতার বাইরে থাকতে পারলেন না শ্রীর বাবা! একা,শোকে , দুঃখে, অনিয়মে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাধ্য হলেন কলকাতায় ফিরে ছোটোমেয়ের কাছে এসে উঠতে। এর মধ্যেই সেজ ভাই বাদে অন্য ভায়েরা একদিন শ্রীর বাবাকে ডেকে পাঠাল একটা হোটেলে। সেখানে বসে তারা তাদের বক্তব্য জানাল। মালদা বাড়ি খালি করে দিতে হবে। সামান্য টাকার বিনিময়ে বাড়ি ছোটো ভাইয়ের নামে লিখে দিতে হবে। শ্রী বাবা ভেঙে পড়লেন। তোদের আমি ছোটো থেকে মানুষ করেছি। পড়াশোনা করিয়েছি। বিয়ে দিয়েছি। আর তোরা আমার এই অসময়ে আমাকে এই কথা বলতে পারলি! তোদের কি বিবেক বলে কিছু নেই রে! শ্রীর বাবা কাঁদতে শুরু করলেন!
কিন্তু তাতে ভায়েদের মন গলল না। তাদের ভেতরে তখন পৈশাচিক উল্লাস! সম্পত্তির চেয়ে বড়ো আর কিচ্ছু নয়। এটাই তারা বিশ্বাস করে। শোকে তাপে অসুস্থ শ্রীর বাবাকে ছোটো জামাই দামি নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়ে দিল। সেখানে শ্রীর বাবার বোনম্যারোতে টিবির জার্ম পাওয়া গেল। ধনে প্রাণে শেষ হতে বসেছেন তিনি। এমন অবস্থায় শ্রী ঝাঁপিয়ে পড়ল। অতো দামি নার্সিংহোমে কিভাবে তুই ভর্তি করলি বাপীকে, টুয়া? বাপীর টাকাপয়সার অবস্থা তুই জানিস তো!
আসলে দিদি, অর্জুন বলল..
অর্জুন বলল, আর ওমনি তুই রাজি হয়ে গেলি!
টুয়া আমতা আমতা করে কি বলল বোঝা গেল না। শ্রী শুধু এটুকু বুঝল বাপী ওদের কাছে এসে উঠেছে বলে ওদের বাড়িতে অশান্তি আরো চরমে উঠেছে। বাচ্চা পেটে থাকতেই টুয়ার পেটে বারকয়েক লাথি মেরেছিল অর্জুন। এখন বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর মারধোর আরো বেড়েছে। শ্রীর টুয়ার ওপর রাগই হয় এখন! মেয়েটার বিলাস – ব্যসন এতোই পছন্দ যে আত্মসম্মানটুকু বিসর্জন দিতে রাজি। সেবার মালদায় শ্রী কত করে বোঝাল। তুই নার্সিং ট্রেনিংটা নে। কিন্তু কিছুতেই রাজি করানো গেল না। ফিরে তো এলোই। উপরন্তু আরো একটা বাচ্চা নিয়ে এমন ভাবে নিজেকে বেঁধে ফেলল যে আর বেরোবার পথ রইল না। এখন ছেলের ভরসায় থাকে। অর্জুন টুয়াকে পেটালে, ওইটুকু ছেলে বাপকে ব্যাট দিয়ে মারতে থাকে! অর্জুন তখন টুয়াকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু কী শিখছে সাত বছরের ছেলেটা! মেয়েটাই বা কী শিখবে! টুয়া একবার ভাবল না।
শ্রী শেষপর্যন্ত বাপীকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। কিন্তু তার আগে বাপীকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হলো। মেডিকেল কলেজে তো বেড পেতে ভীষণই সমস্যা হচ্ছিল।বাপীকে স্ট্রেচারেই ফেলে রেখেছিল। ভাগ্যিস দেবজ্যোতি ছিল! দেবজ্যোতি শ্রীর পিসতুতো বোনের স্বামী। পেশায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে। ও সব ব্যবস্থা করে দিল। কদিন ওখানে থেকে সুস্থ করে বাপীকে শ্রী নিজের কাছে নিয়ে গেল।
৪৫
রুচি শেষপর্যন্ত লুকিয়ে রেজিস্ট্রিটা করেই ফেলল। রাজার সঙ্গে তার সম্পর্ক এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে রাজাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। এদিকে রাজা তার ক্লাইন্টদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ বজায় রাখে। সেটা রুচি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এই নিয়ে দুজনের ঝগড়া হয়। সম্পর্ক ভেঙে যায় এমন অবস্থা হয়। হাল ধরে রাজার মা। রুচিকে বোঝায় পুরুষ মানুষ চিরকাল বারমুখো। একমাত্র বিয়ের বন্ধন তাদের শক্ত করে বেঁধে রাখতে পারে। রুচিকে বলে, তোর বাড়ি থেকে যত আপত্তি উঠছে রাজা তত অধৈর্য হয়ে পড়ছে। ও আসলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ফলে ও এমন করছে। আমি বলি কি, তোরা রেজিস্ট্রিটা করে ফেল। রুচি আঁৎকে ওঠে একথা শুনে। বাবাকে লুকিয়ে সে বিয়ে করে ফেলবে! এও কি সম্ভব! রুচি বাবার মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নেয়।
ঘোষাল বাড়িতে রুচির প্রেমের কথা এখন সবাই জানে। মা, কাকিমা, রুশি আর ঋতিকে তো রুচি নিজেই বলেছে। বিশ্বদেব আর অনন্ত নিজেদের মতো করে জেনেছে। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে কথা বলে না। বিশেষ করে বিশ্বদেবের সামনে এ বিষয়ে কথা বলতে সবাই ভয় পায়। সেদিন কিন্তু রুচি সরাসরি বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলল। বাবা, আমি আর রাজা সেটেল করতে চাই। বিশ্বদেব মেয়ের দিকে তাকালো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েটার গালে দুটো থাপ্পড় মেরে দেয়। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিল। সেটেল যে করতে চাইছে বৌকে খাওয়াবে পড়াবে কি? হরিমটর!
কেন বাবা! রাজা তো রোজগার করে! ওর কত ক্লায়েন্ট তুমি জানো!
হ্যাঁ, রোজগার করে! লোকঠকিয়ে! লোকের হাত দেখে, কুষ্টি বিচার করে! এই ছেলেকে বিয়ে করবে তুমি! বিশ্বদেব চিৎকার করে ফেলে!
ওটাকে অ্যাস্ট্রোলজি বলে বাবা! তার জন্য পড়াশোনা করতে হয়। আর তাছাড়া রাজার মধ্যে সেই পাওয়ার আছে। ওটা ঈশ্বরপ্রদত্ত। তুমি বুঝবেনা!
না, আমি তো বুঝবনা! আমার বোঝার দরকারও নেই! কিন্তু লোকে বলবে বি.ডি ঘোষালের জামাই রাস্তায় টিয়া পাখি নিয়ে বসে লোকের ভাগ্যগণনা করে এ আমি মেনে নিতে পারব না।
ঠিক আছে রাজা নিজেকে প্রমাণ করে দেখাবে! তাহলে তো তোমার আপত্তি নেই! ততদিন আমরা অপেক্ষা করে থাকব। এখন শুধু রেজিস্ট্রিটা করে নিতে চাইছি!
কেন রেজিস্ট্রি কেন! পাখি উড়ে যাবে নইলে!
রুচি এ কথার পর আর কথা বলতে পারে না। তার রুচিতে বাধে। শুধু মনে মনে ঠিক করে সে বাবাকে লুকিয়েই রেজিস্ট্রি করবে। এমনিতেই বাড়িতে কদিন কাকিমার ভাইয়ের সুইসাইড করা নিয়ে নানারকম চলছিল। রুচির দিকে কেউ তেমন খেয়াল করতে পারেনি। রুচি লুকিয়ে রেজিস্ট্রি সেরে রাখল। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। একটি অচেনা ফোন বিশ্বদেবকে সব জানিয়ে দিল। খবরটা শুনে বিশ্বদেব প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। রুচিকে জিজ্ঞেস করতেই রুচি সত্যিটা জানাল। রুচি আর অপেক্ষা করতে পারছে না। রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার পর থেকেই সে রাজার কাছে থাকার কি যেন একটা তাগিদ অনুভব করছে। এই দূরত্ব তাকে যেন গিলে খেতে আসছে। রাজার কাছে যাওয়ার জন্য প্রাণ ছটফট করছে তার। তাই খানিকটা ডেসপারেট হয়েই সে সত্যিটা স্বীকার করে ফেলল। বিশ্বদেব রুচির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বুকে তীব্র একটা ব্যথা অনুভব করল। অজ্ঞান হয়ে সে পড়েই যাচ্ছিল। মাধুরী এসে কোনোরকমে তাকে ধরে ফেলল। মাইল্ড অ্যাটেক। বিশ্বদেব বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবল, রুচিকে আর আটকাবে না। ওর ভাগ্য ও নিজে বুঝে নিক। বিজয়দেব যদিও বম্বে থেকে বলে পাঠিয়েছিল, ও মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দে দাদাভাই! বিশ্বদেব বাবা হয়ে সে কাজ করতে পারল না। রুচির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বাবু মারা যাওয়ার ঠিক এক বছরের মাথায় রুচি বিয়ে করল। আর তার সমস্ত দায়িত্ব নিতে হলো শ্রীকে। বিশ্বদেব শ্রীকে ডেকে বলল, তোমার বড়দিকে তো তুমি চেনো! কাজ করতেই শুধু পারে। আর কিছুই পারে না। ছেলের বাড়ির সঙ্গে কথাবার্তা এসব কিন্তু তোমাকে আমাকেই সামলাতে হবে।
ছেলের বাড়ির সঙ্গে অবশ্য কথা কিছুই ছিল না। দুপক্ষের কেউই একে অপরকে সহ্য করতে পারছে না। অথচ মনে বিষ চেপে রেখে মুখমিষ্টি বজায় রাখছে। বিয়ের তারিখ ঠিক হতেই রাজা নানারকম আবদার শুরু করল। তার দামি কোর্ট প্যান্ট চাই, ট্রিমার চাই আরো নানা কিছু। ওদিকে রাজার মা বলল, আলাদা করে আশীর্বাদের অনুষ্ঠান করতে হবে। আমাদের বাড়ির রেওয়াজ ছেলেকে সোনার চেন দিয়ে আশীর্বাদ করতে হয়। মেয়ের আশীর্বাদের দিন ওদের বাড়ি থেকে রূপোর একটা ভারি মুকুট এনে রুচির মাথায় পরিয়ে দেওয়া হলো। এটা না কি ওদের পারিবারিক ঐতিহ্য। সেই ভারি মুকুট দেখে পাড়ার লোকে হাসাহাসি করল। মৃত্যুঞ্জয় রুচিকে ডেকে বলল, আশীর্বাদ তো হয়ে গেছে। এবার মুকুটটা খুলে রাখ। মৃত্যুঞ্জয়ের কথাও রুচির আজকাল আর ভালো লাগছে না। রুচি সারাদিন মুকুট মাথায় ঘুরে বেড়ালো। আর ঋতি ও রুশি দুজনে দুজনকে জড়িয়ে শুধু কেঁদে গেল। পিছনের উঠোনে গিয়ে দুজনে কেবলই চোখ মুছতে লাগল। তাদের প্রাণের দিদিভাই চলে যাবে!
বিয়ের সময়টা শ্রী আর অনন্তকে পাগলের মতো পরিশ্রম করতে হলো। আত্মীয় স্বজনে বাড়ি ভর্তি। তাদের আদর আপ্যায়ন সবই করল শ্রী। আর অনন্তকে বাইরের কাজগুলো সামলাতে হলো। যদিও সমস্ত কিছুর মাথা হয়ে আছে বিশ্বদেব। চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছে। তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা গ্রাম থেকে এসেছে। তাদের সে সহ্য করতে পারে না। তার ধারণা এরা আধুনিক বাড়ি-ঘরদোর-বাথরুম ব্যবহার করতে পারে না। ফলে কোনো বাথরুমে কোমোটে সেনিটারি প্যাড ফেলে সিসটেন আটকে গেল। কোথাও দেওয়ালে তেলের দাগ মুছল। বিজয়দেবও এসব দেখে বেজায় বিরক্ত। এমনিতেই এই বিয়েতে তার মত ছিল না। তারওপর বৌদির বাপের বাড়ির লোকের এসব কাণ্ড দেখে সে মুখ বেজার করে রইল। তত্ত্ব সাজানোর সময় সে সামনে পেল টুয়া আর তার এক বছরের মেয়েকে। মেয়েটাকে অকারণে কাঁদিয়ে সে রাগ ওগলালো। ওদিকে বরযাত্রি বিয়ে বাড়িতে এসে নিন্দে-মন্দর বন্যা বইয়ে দিল। ব্যবস্থাপনা কিছুই তাদের পছন্দ হলো না। মশলার কৌটো থেকে ভাড়া বাড়ির বাথরুম সব নিয়েই তারা বিশ্বদেবকে অপমান করতে ছাড়ল না। বিশ্বদেব যত অপমানিত হতে থাকল তত চিৎকার করতে লাগল শ্রী আর ঋতির ওপর। ঋতি অকারণেই একবাড়ি লোকের সামনে বকুনি খেতে লাগল। শ্রীকে শুনতে হলো বাপের বাড়ির লোক দেখলে মাথার ঠিক থাকে না, তাই না! সদ্য যে তার ভাইয়ের মৃত্যু ঘটেছে এভাবে অপঘাতে সেকথা কারো মনে থাকল না। রুচির বিদায় হলো ঘোষাল বাড়ি থেকে। যাওয়ার সময় কনকাঞ্জলি দিতে অস্বীকার করে সে বাবা-মার ঋণ অপরিশোধ্য রেখে গেল। গোটা অনুষ্ঠানে এটুকুই বিপ্লব করল সে। অবশ্য তার সম্প্রদান করল মাধুরী। কোনো পুরুষের হাতে তার সম্প্রদান হবে না বলে বেঁকে বসেছিল রুচি। বৌভাতে গিয়েও বিয়ের অব্যবস্থা নিয়ে নানা কথা শোনালো রাজার মা ও মামা। সবাই মন খারাপ করেই ফিরে এলো। রুচির জীবন যে সুখের হবে না সেকথা যেন সবাই আন্দাজ করতে পারল। মাধুরীর বাড়ির লোককেও রুশি অপমান করে বসল একদিন। রুশির উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে এই ডামাডোলে। সে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে। সেই দুঃখ, দিদি চলে যাওয়ার দুঃখে সে তার মেসোদের মুখের ওপর টিভি বন্ধ করে দিল। তার মাসি মেসোরা বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে চার-পাঁচদিনের জন্য এসেছে। অবসর সময়ে বসে টিভি দেখছে। রুচির মনে হলো তার দুঃখ এরা কেউ বুঝছে না। এরা এতো ইনসেনসেটিভ। তাই সে টিভি বন্ধ করে তাদের অপমান করে বসল। সব মিলিয়ে রুচির বিয়ে এ বাড়িতে যেন আরো বড়ো ঝড়ের ইঙ্গিত নিয়ে এলো।
৪৬
শ্রীর মা সন্তান শোকের উপশম হবে ভেবে চাঁদগঞ্জে বাপের ভিটেয় গিয়ে উঠেছিলেন। সেখানে শ্রীর ছোটোমাসির দুই ছেলে – বৌ থাকে। শ্রীর মা এখানেই একটু শান্তি পাবেন ভেবেছিলেন। নিজের ছেলের তো আর বিয়ে দিতে পারলেন না! ছেলেটাই যে আর রইল না! বোনের ছেলেদের,বৌদের নিয়ে সে দুঃখে প্রলেপ পড়বে ভেবেছিলেন। কিন্তু হলো না। ওদের মনে হলো ওদের এই মাসি বোধহয় সারাজীবনের মতো ওদের ঘাড়ে পড়ল। ফলে মাসিকে নানাভাবে অসম্মান, অবহেলা করতে শুরু করল। বৌরা কেউ মাসির কথা শোনে না। মাসির কাছে ভালো ভালো রান্না শেখা তো দূর, কথাই বলে না। শ্রীর মা সেসব বুঝতে পারছিলেন। একবার চলে এসেছিলেন বড়ো মেয়ের কাছে। ভেবেছিলেন এখানে হয়তো একটু শান্তি পাবেন। কিন্তু এখানেও অনন্ত নানা অশান্তি শুরু করল। সর্বোপরি নাতনিটাও সর্বক্ষণ বলতে লাগল নিনানকে চলে যেতে বলো। আমার পড়াশোনার অসুবিধে হচ্ছে। শ্রী এসব সহ্য করতে পারেনা। মেয়েটাকে মারে। তাতে ঋতির জেদ আরো বেড়ে যায়। শ্রী বোঝে, এক কামরার ফ্ল্যাটে সারাক্ষণ টিভি চললে ঋতির পক্ষে পড়াশোনা করা মুশকিল। আবার মা ওই টিভিটুকু নিয়েই ভুলে থাকে। মাকে বারণ করাও যায় না। শ্রী কি করবে ভেবে পায় না! এমনিতেই এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই ওর পড়াশোনা একেবারেই হচ্ছে না। ক্লাস সিক্সে পড়তে তো অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষার সময় ঋতি অদ্ভুত একটা জেদ ধরে বসেছিল। বলেছিল, আমি তো সবসময় ভালো রেজাল্ট করেছি। তাই আমি এবার পরীক্ষা দেব না। তোমরা বড়দিকে গিয়ে বলো, আমাকে ক্লাসে তুলে দিতে। এমন অসম্ভব কথা কে কবে শুনেছে! এমন কথা ঋতির মাথায় এলোই বা কি করে! বলা বাহুল্য ঋতির কথা শোনা হয়নি। ঋতি পরীক্ষা দিতে বাধ্য হয় এবং কোনো পজিশনই পায়না। এইট, নাইন এভাবেই কেটেছে। নানারকম অশান্তি, কখনো শ্রীর মা-বাবাকে নিয়ে, কখনো রুচিকে নিয়ে ঋতিকে জর্জরিত করে রেখেছে। রুচি বিয়ের আগের দিন অবধি ঋতিকে নানা কিছু নিয়ে ভয় দেখিয়েছে। কখনো বলেছে তোকে পড়াবোনা, কখনো বলেছে তোকে সাজিয়ে দেব না। কখনো আবার ঋতির বন্ধুদের সামনেই ঋতিকে অপমান করেছে। শ্রী ঋতির কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে ইংরেজির একটা ব্যাচ খুলে দিয়েছিল রুচির জন্য। সেই ব্যাচেই পড়তে বসে বন্ধুদের সামনেই ঋতিকে নানা ভাবে অপমান করত রুচি। অঙ্কের একজন মাস্টার ঠিক করা হলো ঋতির জন্য। তিনি স্থানীয় একটি স্কুলের হেডমাস্টার। কিন্তু তিনি কেবল পাশ করার মতো কিছু অঙ্ক করিয়ে দেন। সম্পাদ্য, উপপাদ্য, ত্রিকোণমিতি কিছুই ঠিক করে করান না। অবজেক্টিভ অঙ্কগুলো প্র্যাকটিস করান না। ঋতির এমনিতেই অঙ্ক করতে ভালো লাগে না। খালি মনে হয় কেবল কতকগুলো ফর্মুলায় ফেলে একটা সমস্যার সমাধান বের করে আনা! এছাড়া নিজস্বতা বলতে তো আর কিছু নেই। বরং ঋতির ভালো লাগে একটি প্রজাপতির রোজনামচা লিখতে। ছুটির দিন সারা সকাল জুড়ে সে লেখে নদীর আত্মকথা। সব ফেলে কেমন ছুটে চলেছে। সব স্মৃতি, আনন্দ, দুঃখ আর বন্ধু… সব ছেড়ে কেবলই চলেছে আর চলেছে। ঋতিও যদি এমন করে চলে যেতে পারত! কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে বহু বহু দূরে… শুভলক্ষীর থেকে অনেক দূরে! আচ্ছা শুভলক্ষী তখন কি ঋতির কথা ভাবত! ঋতির জন্য মন কেমন করত তার! জীবনানন্দের রূপসী বাংলা পড়তে পড়তে ঋতির এমনটাই মনে হয়। ঋতি চলে গেলে এই যে তার পরিচিত সবকিছু… এ সবই কি ঘুঙুরের মতো কান্নার ঝঙ্কার দিয়ে উঠবে! ‘গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে’ দেয়া নেয়া সিনেমার এই গানটায় দুঃখ যেমন ঋঙ্কৃত হয়ে উঠেছে! এসব ভাবে ঋতি। আর তার চোখের তলার কালি গাল বেয়ে নেমে আসে। রুচির বিয়ের পর ঋতিকে একজন অন্য ইংরেজির মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে পাঠানো হলো। কিন্তু বয়স্ক ভদ্রলোক কেবলই ছাত্রদের বকাবকি করেন। ঋতি বকুনি খেয়ে চমকে চমকে ওঠে। কিছুতেই মাথায় ঢোকে না ওঁর পড়ানো। শেষে ঋতি জেদ করে ওই মাস্টারের কাছে যাওয়া বন্ধই করে দেয়। বাংলা, ইতিহাস, জীববিজ্ঞান, ভূগোল,লজিক যা কি না ঋতির অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট এগুলো তবু ভালো করে তৈরি করে ঋতি। অঙ্ক, ভৌতবিজ্ঞান আর ইংরেজি নিয়ে যে কি হবে শ্রী আর ভাবতে পারে না। মাঝে একবার অনন্তকে বলেছিল, ঋতিকে আরেকজন অঙ্কের মাস্টারের কাছে পাঠানোর কথা। অনন্ত এককথায় নাকচ করে দিয়েছে। সে টাকা দিতে পারবে না। শ্রীর আজকাল ঘুম হয় না ঠিক মতো। মেয়েটার সামনে মাধ্যমিক। কি হবে কে জানে! তবু রুচির বিয়ের পর থেকে ও বাড়িতে যাতায়াত ঋতির কমেছে। শ্রী এখন নিজের মতো করে মেয়েটাকে তবু পড়াতে পারে। কিন্তু এর মধ্যেই মা -বাপীকে নিয়ে ব্যারাকপুরেই বাড়ি ভাড়া করে দিতে হলো।সাধ্যের মধ্যে ভদ্র জায়গায় বাড়ি খুঁজে পেতে শ্রীকে প্রচুর ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখতে হলো। সবটাই হেঁটে হেঁটে। রিক্সা ভাড়ার পয়সা নেই।যদি বা বাড়ি পাওয়া গেল মালপত্র মালদা থেকে ব্যারাকপুরে এনে ভাড়া বাড়িতে গুছিয়ে দেওয়াটাই একটা চ্যালেঞ্জ। সবটা শ্রীকে একা একা করতে হলো। অনন্ত ঋতির কাছে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, দুয়োরের গোড়ায় শুয়োরের খোঁয়াড়। ঋতি শুনল। বাবাকে কিছুই বলল না। কিন্তু মনে মনে মামার কথা ভেবে চোখ জলে ভরে উঠল। এইসব ডামাডোলের মধ্যে ঋতির মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেল। প্রথমদিকের পরীক্ষাগুলো ভালোই হলো। শতভিষা ঋতির সঙ্গে পড়ে। ঋতির আগের বেঞ্চে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। শতভিষা সুযোগ মতো ইতিহাস, ভূগোল পরীক্ষায় নানা কিছু ঋতিকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছে । ঋতি বলে দিয়েছে। ঋতি মনে মনে আনন্দে আছে। আলটিমেটলি সে যা প্রিপারেশন নিয়েছে,আর যা প্রশ্ন এসেছে তার পরীক্ষা ভালো হচ্ছে। কিন্তু গন্ডগোল বাঁধল অঙ্ক পরীক্ষার দিন। ঋতি সম্পাদ্য, উপপাদ্য পারে না। কারণ শেখেইনি। দশ নম্বর এমনিই বাদ। বাকি অঙ্ক সব সে ঠিক মতো করেছে। অবজেক্টিভ করতে গিয়ে সে দেখল সেগুলোও কয়েকটা সে পারছে না। অবজেক্টিভের ক্ষেত্রে রাফ দেখা হয় না। সরাসরি উত্তর লিখলেই চলে। শেষমুহূর্তে তাই ঋতি শতভিষাকে দুটো অঙ্ক জিজ্ঞেস করে ফেলল। মনে মনে সে ভীষণই দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু এ কদিন শতভিষা তাকে জিজ্ঞেস করেছে। আজ এটুকু জিজ্ঞেস করলে কি খুব অন্যায় হবে! সাহসে ভর করে ঋতি দুটো অবজেক্টিভের উত্তর জিজ্ঞেস করেই ফেলল। তখন ঘণ্টা পড়ে গেছে। খাতা তুলছেন দিদিমণিরা। ঋতি ভেবেছিল চট করে উত্তর দুটো লিখে দেবে। কিন্তু শতভিষাকে জিজ্ঞেস করতে শতভিষা ঋতির মুখের দিকে একবার তাকালো কেবল। তারপর নিজের খাতা হাতে নিয়ে জমা দেওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। ঋতির মুখ ততক্ষণে কালো হয়ে গেছে। ঋতি আর একটা কথাও বলল না। খাতা জমা পড়ে গেল। কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকতা ও অপমান ঋতি হজম করতে পারছিল না। বাইরে এসে মাকে দেখে ঋতি পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করল। জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষার স্মৃতিই ঋতির মনে দগদগে ঘা হয়ে রয়ে গেল। ঋতি আসলে কিছুই ভোলে না। খুব ছোটোবেলার কথাও তার স্পষ্ট মনে আছে। সামান্য একটা ঘটনা; হয়তো সে ঘটনা কিছুটা অমূলক। তবু ঋতির মনে থেকে যায়।যেমন ছোটোবেলা একবার রিক্সা করে দাদুর বাড়ি যাওয়ার সময় মা ঋতিকে রিক্সায় বসিয়ে রেখে দোকানে মিষ্টি কিনতে গেছিল। দশ মিনিট হয়তো মার সময় লেগেছিল। কিন্তু ওই দশ মিনিটেই ঋতি খুব ভয় পেয়েছিল। তার মনে হয়েছিল রিক্সা কাকু তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে! আর ভয়টা মাথায় খেলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋতি রিক্সায় বসেই ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল অনন্তকাল মা মিষ্টি আনতে গেছে। আর ঋতি ক্রমশ ভয় পেতে পেতে তলিয়ে যাচ্ছে। অথচ মা বারণ করেছে বলে রিক্সা থেকে নেমে দৌড়ে মার কাছে যেতেও পারছেনা। হাঁসফাঁস করছে সে ভয়ে। এই ঘটনাটা মাঝে মাঝেই ঋতির স্বপ্নে আসে। ঋতি দেখে তার গলা থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। ঋতি আপ্রাণ চেষ্টা করছে মাকে ডাকতে কিন্তু কিছুতেই পারছে না। শতভিষার সেদিনের তাকানোটাও ঋতি ভুলতে পারছে না। ওই দৃষ্টির সামনে সে কুঁকড়ে যাচ্ছে! তার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে! অনুশোচনা হচ্ছে! সে যদি অঙ্কটা আরেকটু মন দিয়ে করত! তাহলে অন্য পরীক্ষাগুলোর মতো তার অঙ্ক পরীক্ষাও ভালো হতো! শতভিষাকে জিজ্ঞেস করার মতো অপরাধ করতে হতো না। আর শতভিষাও তাকে অপমান করার সুযোগ পেত না! ঋতিকে কুরে কুরে খাচ্ছিল এই ঘটনা!
৪৭
ঋতির পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই অনন্তর মিল বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ির পরিবেশ আবার থমথমে হয়ে উঠল। এদিকে ঋতির তিনমাস ছুটি। ওর বন্ধুরা সব বেড়াতে যাচ্ছে। তাদের অন্তত একমাস ছুটি। তারপর যারা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে সায়েন্স পড়বে তাদের প্রাইভেটে পড়াশোনা শুরু হয়ে যাবে। ঋতি সায়েন্স নেবে না। ক্লাস নাইন থেকেই সে বলতে শুরু করেছে সে সাহিত্য নিয়ে পড়বে। এই ছুটিতে সে তাই বাবাকে বলে কয়ে লোকাল লাইব্রেরির মেম্বারশিপ নিয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন লেখকদের বই নিয়ে এসে সে পড়তে শুরু করেছে। শীর্ষেন্দুর কিশোর উপন্যাসগুলো বিশেষ করে অদ্ভুতুড়ে সিরিজের লেখাগুলো পড়তে তার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে! আর লীলা মজুমদার কি মজার! আবার দুঃখেরও, কেমন মন কেমন করে ঝগড়ুর জন্য! কিন্তু সবসময় কি পড়তে ভালো লাগে! তার সব বন্ধুরা বেড়াতে যাচ্ছে, তারও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে! সেই কোন্ ছোটোবেলায় সে একবার বম্বেতে বিজুর বাড়ি গেছিল। তার ভালো লাগেনি। বিজুর তখন পেনের ব্যবসা। টাকাপয়সার অভাব! তাই তাদের বম্বে শহরটাই ঘোরা হয়নি! বাড়িতে থেকেই পনেরো দিন কাটিয়ে তারা কলকাতায় ফিরে এসেছিল। তারপর সে একবার গেছিল মালদায়। শ্রীর ছোটোকাকা কাকিমা তখন দার্জিলিং বেড়াতে যাবে ঠিক করেছে। ওদের বন্ধু তাদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সব মিলিয়ে বিরাট গ্রুপ। শ্রী সেবার একটু জেদ ধরেই বসেছিল অনন্তর কাছে। চলো, আমরাও দার্জিলিং যাই!
না, শ্রী, সেটা সম্ভব নয়। আমি অতো টাকা নিয়ে আসিনি।
বেশি টাকা তো লাগবে না! সবাই মিলে যাওয়া হচ্ছে! খরচ তো ভাগ হয়ে যাবে!
আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই।
আমার আছে।
জোর করেই শ্রী সেবার দার্জিলিং নিয়ে গেল অনন্ত আর ঋতিকে। অনন্ত এর আগে দার্জিলিং বেড়াতে এসেছে। ওর সবই দেখা। অনন্ত সেবার একটা অদ্ভুত কাণ্ড করেছিল। নিজে কোথাও যাবে না বলে হোটেলে বসে থাকল। ঋতিকে বলল, তুই মায়ের সঙ্গে যাবি না কি আমার সঙ্গে থাকবি?
ঋতি এককথায় বাবার সঙ্গে থাকতে রাজি হয়ে গেল। শ্রী একা ওই বিরাট দলটার সঙ্গে ঘুরতে বেরোলো। ঋতির দার্জিলিঙের কিছুই দেখা হলো না।
এই তার জীবনে বেড়াতে যাওয়ার ছোট্ট ইতিহাস! তাই মাধ্যমিকের পরের ছুটিতে তার বেড়াতে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে জাগল। কিন্তু উপায় নেই। অনন্তর পক্ষে ঋতিকে কোথাও নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
অস্মি এখন প্রত্যেক সপ্তাহে মা বাপীর কাছে আসে, থাকে মূলত ছেলেকে ঋতির কাছে পড়ানোর জন্য। ছেলেটা ক্লাস টু এ পড়ে। ইংলিশ মিডিয়াম। ঋতি কিন্তু ওকে দিব্যি পড়ায়। বিশেষত আর্টসের সাবজেক্টগুলো! ছেলেটা খুব গোঁয়ার! কিছুতেই ঠিক মতো পড়তে চায় না। ঋতি তবু ধৈর্য্য ধরে পড়ায়। অস্মি এসে সব শুনে বলল, দিদি, তোরা চলনা আমার বাড়িতে। ঋতিকে অন্তত কলকাতাটা ঘুরিয়ে দেখানো যাবে! ঋতির মেসো ঋতিকে এতো ভালোবাসে! আনন্দ করে সব দেখাবে। আয় না দিদি!
শ্রী সেইমতো রাজি হয়ে গেল। পরের সপ্তাহে তাহলে ঋতিকে নিয়ে একটু ঘোরা হবে। ঋতির মনটা একটু ভালো হবে!
কিন্তু অনন্ত মনে মনে প্রস্তুত হয়েই ছিল। যাওয়ার দিন সকাল থেকে সে শুরু করল অশান্তি। তার একটাই রাগ, আমার মিল বন্ধ। আমি এখানে ভেবে ভেবে মরছি! আর উনি যাচ্ছেন বোনের বাড়ি ফুর্তি করতে!
দেখতে দেখতে অশান্তি চায়ের কাপ ছুঁড়ে ভেঙে ফেলায় গিয়ে দাঁড়ালো! শ্রী তারপরও ঋতিকে নিয়ে বেরোতে গেছিল। অনন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়েই চিৎকার শুরু করল! শ্রী বাধ্য হলো ঋতিকে নিয়ে আবার ঘরে ঢুকে আসতে। খানিকপরে অনন্ত বেরিয়ে গেল। ঋতি পাড়ার বুথ থেকে অস্মিকে ফোন করল। মাসিমণি, আমরা যাচ্ছি না গো! বাবা আমাদের যেতে দেয়নি। বলতে বলতে ঋতির গলা ভারি হয়ে গেল। চোখ জলে ভরে উঠল। ঋতি তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিল।
এর কিছুদিন পরই ঋতির জন্মদিন। অনন্ত একটু মুরগির মাংস নিয়ে এলো। আর ঋতির হাতে ত্রিশ টাকা দিয়ে বলল, তুই যা ইচ্ছে কিনে নিস। ঋতি সন্ধেবেলা বেরিয়ে সাতাশ টাকা দিয়ে একটা পেন কিনল। তিন টাকা তার কাছে রয়েছে। দোকান থেকে সে সোজা জ্যেঠুর বাড়িতে এলো। সকলকে প্রণাম করে পেনটা দেখাল। অনন্ত বলল, বাকি তিন টাকা কি করলি!
আছে আমার কাছে।
দিয়ে দে আমাকে!
ঋতি অবাক হয়ে তাকালো বাবার দিকে। এই তিন টাকায় তিনটে লজেন্স কিনবে ভেবেছিল সে। বাবা তো তাকে পুরো টাকাটাই দিয়েছিল। এখন ফেরত নিচ্ছে কেন! যদিও এর একটা কথাও না বলে ঋতি তিন টাকা ফেরত দিয়ে দিল। গালটা তার একটু ভার হয়ে রইল। বাড়িতে ফিরে সে আবার বাবাকেই আনন্দ করে জানাতে গেল যে দাদু তাকে আশীর্বাদ করে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে। অনন্ত বলল, বেল পাকলে কাকের কি!
ঋতি একথার মানে বুঝল না। শুধু এটুকু বুঝল বাবা খুশি নয়! এভাবেই একরাশ মন খারাপ নিয়ে তার জন্মদিন কেটে গেল।
আসলে অনন্তর তার শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। মালদা থেকে এখানে ফিরে আসার পর থেকে ঋতি দাদু নিনানের হয়ে বাবার সঙ্গে তর্ক করে। অনন্তর মনে হয় ভালো ভালো খাইয়ে দাইয়ে আমার মেয়েটাকে হাত করে নিচ্ছে। শ্রীও এক একদিন রাতে বাপের বাড়ি থেকে খেয়ে আসে। মাই জোর করে খাইয়ে দেয়। শ্রী বাড়িতে এসে আর খায় না। অনন্ত এই নিয়ে অশান্তি করে। খাবারে জল ঢেলে উঠে যায়! অথচ তাকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে চাইলে সে উপস্থিত না হয়ে শ্রীর বাপী মাকে অসম্মান করে। কিন্তু খুব অদ্ভুত ভাবে শ্রীর মায়ের পাঠিয়ে দেওয়া খাবার সে বাড়িতে বসে যত্ন করে খায়। তখন আর ভালো খাবারের লোভটা সামলে উঠতে পারে না! অনন্ত প্রথম থেকে ভেবেছিল শ্রীর বাপী পুলিশে চাকরি করে; ঘুষের কারবার তো তার নিশ্চয়ই আছে। প্রচুর ব্ল্যাকমানি! বড়ো মেয়ের সংসার তিনিই চালিয়ে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি! শ্রীর বাপী তো তার একমাত্র ছেলের জন্যও ঘুষ দিতে চাননি! ছেলেটা মরে প্রমাণ করে গেল তার বাবা কতটা সৎ ছিল! যদিও এসব নিয়ে অনন্তর কোনো আদিখ্যেতা নেই। তার মনে শ্রীর বাবা আসলে আদ্যন্ত একটা বোকা লোক! সেই জন্যই জমি, বাড়ি, ছেলে সব হারালো! এমনকি বউটাও পুরোটা তার নয়! সেখানেও সেজ ভাই ভাগ বসিয়েছে!
রেজাল্ট বেরোনোর দিন অনন্ত যাবে স্কুলে রেজাল্ট দেখতে! এ বাড়িতে এটাই চল। অনন্ত না কি পয়া। অনন্ত রুচি, রুশি দুজনেরই মাধ্যমিকের রেজাল্ট দেখতে গিয়েছিল। দুজনেই ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। রুশির উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্টের দিন অনন্ত রুচির বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিল! ফলে রুশি একাই গেছিল। রুশি সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছিল। তারপর থেকেই একথা আরো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে অনন্ত অন্তত রেজাল্টের ব্যাপারে পয়া। কিন্তু ঋতির জন্য! বাবা হিসেবে অনন্ত ঋতির জন্য কতটা পয়া! আর ঋতিই বা তার বাবার জন্য কতটা লক্ষ্মী! এ বাড়িতে তো এসব মানা হয়! কে লক্ষ্মী! কে অলক্ষ্মী! বছরে চারবার এ বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়। দীপাবলির দিন অলক্ষ্মী বিদায় করা হয়! এই সমস্ত পুজোতেই রান্নাবান্নার দায়িত্ব সামলায় শ্রী। তবু আজও এ বাড়িতে তার অলক্ষ্মী তকমা ঘুচল না। তার বর কিছু করতে পারেনি জীবনে! সে দায় তার! আর দুই বউয়ের বরেরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছে, সেই জন্য তাদের বউরা লক্ষ্মী! এ সব মধ্যযুগীয় বর্বর মানসিকতা এ বাড়ির আনাচে কানাচে বাসা বেঁধে আছে। যাই হোক, ঋতি ১০ নম্বরের জন্য স্টার পেল না। ওর বন্ধুরা বেশিরভাগই স্টার পেয়েছে। শুভলক্ষ্মীও স্টার পেয়েছে। দিতি কিন্তু মাধ্যমিকে আর ফার্স্ট হতে পারল না। অন্য একটি মেয়ে ফার্স্ট হলো! শ্রীর মন খারাপ হয়ে গেল! মেয়েটার রেজাল্ট ওর দক্ষতা অনুযায়ী ভালো হবে না একথা শ্রী আগেই বুঝেছিল। অন্তত স্টার পেলে মান থাকত! এ বাড়িতে আর তো কিছু নেই! ঋতির পড়াশোনাটাই আছে। সেই দিয়েই এই ছোট্ট, স্যাঁতস্যাঁতে, খাটা পায়খানার গন্ধ আর ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া ফ্ল্যাটটার মান থাকে! ঋতি সেটুকুও রাখতে পারল না।
বন্ধুরা সবাই ঋতির থেকে বেশি পেয়েছে শুনে ঋতি আর স্কুলে গেল না। জ্যেঠুর বাড়িতে গিয়ে বম্মাকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, আমার রেজাল্ট কি খুব খারাপ হয়েছে বম্মা! দাদুর বাড়িতে গিয়েও দাদুকে তার বারবার একই জিজ্ঞাসা। আসলে উত্তরটা তার জানা। তবু যদি কেউ অন্য রকম কিছু বলে, তাই এতোবার জিজ্ঞাসা! মার্কশিট হাতে পেয়ে দেখা গেল ঋতির ইতিহাস, ভূগোল, বাংলা, ইংরেজি, জীববিজ্ঞান সব বিষয়ে ৭৫% নম্বর পেয়েছে। অঙ্ক আর ভৌত বিজ্ঞানে নম্বর কমে গেছে। মার্কশিট দেখে শ্রী বুঝল ঋতির অন্তত এই সাবজেক্টগুলোতে লেটার মার্ক্স পাওয়ার কথা ছিল। ৭৫ এ গিয়ে যে আটকে গেল তার কারণ তার হাতের লেখা। ছোটোবেলা ঋতির হাতের লেখা যত সুন্দর ছিল, বড়ো হওয়ার পর থেকে তত খারাপ হয়েছে। তাড়াতাড়ি লিখতে গিয়ে হাতের লেখা নষ্ট করে ফেলেছে ঋতি। এইজন্যই বাকি সাবজেক্টে ওর নম্বর কমে গেছে।
যাই হোক, ঋতি মোটামুটি ঠিক করেই রেখেছিল ও আর্টস নেবে। ভবিষ্যতে বাংলা নিয়েই পড়বে ঋতি। কাজেই ইতিহাস, দর্শন এসব বিষয় পাশাপাশি থাকলে ভালো। শ্রীর ইচ্ছে ঋতি অন্তত ভূগোল আর ইকনমিক্স নিক। ভবিষ্যতে ইকোনমিক্স নিয়ে পড়ার একটা সুযোগ থাকবে! কিন্তু ঋতি জানে অঙ্ক ছাড়া ইকোনমিক্স পড়ে লাভ নেই। আর অঙ্ক সে পাবে না। তার ভালোও লাগে না। অনন্তর এসব বিষয়ে জানাবোঝা তেমন নেই। এসব ব্যাপারে সে দাদার মেয়েদের বেশি ভরসা করে। রুচি আর রুশি কিন্তু এককথায় প্রায় সব সাবজেক্ট খারিজ করে দিল। দুই বোনে মিলে ঠোঁট বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে বলতে লাগল কোনো সাবজেক্টই ঋতি পড়তে পারবে না। বিশেষ করে ইংরেজি আর ইতিহাস তো নয়ই। কারণ এই দুটো সাবজেক্ট রুচি আর রুশি পড়ে। এইদুটোর মতো কঠিন সাবজেক্ট আর হয় না। আর ঋতি এতো কঠিন বিষয় পড়ে পাশই করতে পারবে না! অনন্তর এই প্রথম ওদের কথা শুনে খারাপ লাগল! ঋতি স্টার না পেলেও রুচি, রুশির তুলনায় অনেক ভালো রেজাল্ট করেছে। ঋতি ছোটো থেকেই এ বাড়ির সব মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনায় ভালো। তার সম্বন্ধে এই কথাগুলো অনন্ত নিতে পারছিল না। শ্রীর কথাও অনন্ত মেনে নিতে চাইছিল না। শ্রীর মেয়ের সম্পর্কে একটু বেশিই উচ্চ ধারণা। কি করবে তাহলে ঋতি। কি নিয়ে পড়াশোনা করলে ও ভালো কিছু করতে পারবে! শেষপর্যন্ত অনন্ত ঋতির কথাই শুনল। ঋতি বাবাকে বোঝাল ভবিষ্যতে সে বাংলা নিয়েই পড়বে। আর তার পাশাপাশি দর্শন, ইতিহাস, শিক্ষাবজ্ঞান এই বিষয়গুলো থাকলে ভালো। অনন্ত ঋতির প্রস্তাবেই রাজি হলো। শ্রী মনে মনে রাগ করল। কিন্তু তার কিছুই করার থাকল না।
৪৮
যতদিন যাচ্ছে রুচি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে সে কি ভুল করেছে! যে রাজাকে বিয়ে করার জন্য সে গোটা ঘোষাল বাড়ির বিরুদ্ধে গেল, তার বাবার বিরুদ্ধে গেল সেই রাজা তাকে ক্রমাগত ঠকিয়ে চলেছে। এ বাড়িতে এসে থেকে সে বুঝতে পেরেছে শুধু ক্লায়েন্টদের সঙ্গে নয়, রাজার সঙ্গে অন্যান্য আরো মেয়েদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। রাজার মা সবটাই জানত। ছেলের লাম্পট্যে মায়ের সায় আছে। কারণ ছেলে এই চরিত্র বৈশিষ্ট্য মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে। রাজার মায়ের বেশ কিছু পাতানো ভাই আছে। মুখে ভাই বললেও আসলে যে তাদের সঙ্গে রাজার মায়ের গোপন সম্পর্ক আছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না রুচির। এদের মধ্যে দুএকজন ডাক্তার রয়েছেন। বিশেষত হার্টের ডাক্তারের সামনে ওপেন আপ হতে কোনো অসুবিধেই হয় না রাজার মায়ের। এমনিতেই সে শাড়িটাকে এমন করে পরে যে তাকে ভদ্র বাড়ির মানুষ বলে মনেই হয় না। শাড়ির আঁচল যথাস্থানে না রাখাটাই তার স্টাইল। রুচির কেমন সন্দেহ হয় যে এসবের মধ্যে একটা লেনদেন চলে। নয়তো রাজার মায়ের হাতে এতো টাকা আসে কোথা থেকে! আরো একটি সমস্যা হলো রাজার মায়ের অধিকারবোধ যা সে একাকিত্বের মোড়কে পরিবেশন করে। রুচি আর রাজাকে একসঙ্গে ছেড়ে দিতে তার ঘোর আপত্তি। যখন তখন সে তাই ওদের ঘরে ঢুকে পড়ে। দরজা বন্ধ থাকলে তখনই তার রাজার সঙ্গে বিশেষ দরকার পড়ে যায়। এমনকি হানিমুনেও রাজা আর রুচির সঙ্গে সেও জুড়ে গিয়েছিল। এর থেকেই না কি বোঝা যায় সে কত আধুনিক! মাধুরীর মতো সেকেলে নয়।
রুচি এখন বিএড শেষ করে ডিসটেন্সে এম এ পড়ছে। কিন্তু পড়াশোনায় রুচির মন নেই। রাজার সঙ্গে নিত্যদিনের অশান্তি তাকে অন্যমনস্ক করে রেখেছে। বিশ্বদেব আবার চেষ্টা করছে রাজাকে ব্যবসায় লাগাতে। বিজুদের ব্যবসার পূর্বাঞ্চলীয় দিকটা এখন বিশ্বদেব দেখেন। রাজাও যদি সেখানে কাজ করে গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা নিতে পারে ভালো হয়! প্রায় দিনই তাই বিশ্বদেব সকাল সকাল চলে আসেন রুচির বাড়িতে। কিন্তু এসে দেখেন রাজা তখনো ঘুমোচ্ছে। রুচি তাকে ডেকে ডেকে রেডি করে। তারপর সে বিশ্বদেবের সামনে এসে বসলেও উসখুস করতে থাকে। বিশ্বদেব ব্যবসার কথা যা বলে সেসব নিয়ে হাসি তামাশা করে। কখনো বাঁকা বাঁকা কথা বলে। মোটকথা বিশ্বদেবের কথার যে কোনো গুরুত্বই নেই তার কাছে সেটা বুঝিয়ে দেয়। বিশ্বদেব বিরক্ত হয়। কিন্তু জামাই বলে কিছু বলতেও পারে না। তার আদরের বড়ো মেয়ে যে এখানে কত ভালো আছে সেই নিয়ে বিশ্বদেব সন্দিহান। বিয়ের এই কয়েক মাসের মধ্যেই রুচিকে কেমন বয়স্ক দেখতে লাগে। রুচির মাথা ভর্তি চুল যেন কমতে শুরু করেছে। রাজার মা প্রায়ই বলে ছেলের তো আমার বয়স অল্প। এখনো বেশ কয়েকবার বিয়ে দেওয়া যায়! এটা কি মজা করে বলা কথা! না কি অন্য কিছু! রুচির যে এ বাড়িতে একটুও যত্ন হয় না সেকথা বুঝতে বাকি থাকে না বিশ্বদেবের।
দিদিভাই ভালো নেই একথা ভালোই বোঝে রুশিও। প্রথম প্রথম রাজাকে ভালো মনেই মেনে নিয়েছিল রুশি। দাদাভাই বলে ডাকবে ঠিক করেছিল। ওর মুখে শুনে ঋতিও রাজাকে দাদাভাই বলাতে রাগই হয়েছিল রুশির। জামাইবাবুটা ওর। ঋতি কেন তাকে একই নামে ডাকবে! আমার আর দিদিভাইয়ের খুড়তুতো বোন বই তো নয়। দিদিভাই একদিন বলেছিল ঋতিকে কথাটা। শুনে ন্যাকা মেয়েটার কি কান্নাকাটি। রুশি তাই কিছুতেই দাদাভাই বলে ডাকতে দেয়নি রাজাকে। এমনকি বিশ্বদেবের বাড়ির দোতলার ঘরে রুশি আর রাজা একসঙ্গে বসে জগজিৎ সিং এর গজল শোনার সময়ও রুশি ঋতিকে এলাউ করে না। তুই কি করছিস এখানে! যা নিচে যা! সেই রুশিও কিন্তু দিদিভাইয়ের অবস্থা দেখে রাজাকে আর ভালোভাবে নিতে পারছে না।
শ্রীয়ের সঙ্গে রাজা বা ওর মায়ের সম্পর্ক ভালো নয়। ঋতিকেও রাজা ভালো মনে নিতে পারে না। বলে মহাতার্কিক! সে নাকি দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছে ওই মেয়ে ঘোষাল বাড়ির নাম ডোবাবে। শ্রী ভালোই বোঝে এসব রাজা কেন বলে! রুচিই তার কাছে কাকিমা আর ঋতির গল্প করেছে। আর সে গল্প যে খুব সুখকর নয়, তাও শ্রী বোঝে। রুচি যখন রাজাকে বিয়ে করার জন্য বাড়াবাড়ি করছে তখন একদিন বিশ্বদেব হতাশ হয়ে মেজ বৌয়ের সাহায্য চেয়েছিল। বলেছিল, মেজ বৌ, তুমি রুচিকে বোঝাও। শ্রী ডেকেছিল রুচিকে ফ্ল্যাটে। রুচি উত্তরে বলেছিল, আমার ব্রেন ওয়াশ করতে ডাকছ! অন্য কোনো দরকার থাকলে যেতে পারি। রাজাকে নিয়ে কোনো কথা শুনব না। এসব কথাও নিশ্চিত রুচি গল্প করেছে রাজার কাছে। সেই সঙ্গে আদি অনন্তকাল ধরে শ্রী যেকথা শুনে আসছে সেকথাও বলেছে। তার বাবার রোজগার এই বুধুর পরিবারের পেছনেই গেল। আর মা সংসারের জন্য খেটে খেটে মরল। মধুটা খেল কাকিমা আর ওই ন্যাকা মেয়েটা! শ্রী খেয়াল করে দেখেছে রাজা আর রাজার মা তাকে সহ্য করতে পারে না। বিয়ের সময় তত্ত্বে যে শাড়িটা শ্রীকে দিয়েছিল সেটা পরে কায়দা করে আবার চেয়ে নেয় রাজার মা। রুচিকে বলে, ভুল করে ওই শাড়িটা তোর মেজ কাকিমার নামে চলে গেছে। ওই দামি শাড়িটা আমি তোর মায়ের জন্য কিনেছিলাম। শোনা মাত্র বিশ্বদেব শ্রীর কাছ থেকে শাড়িটা চেয়ে পাঠিয়েছিল। শ্রী পাঠিয়ে দেয়। শুধু ভাবে, আচ্ছা মেয়ের শাশুড়ি যদি একথা বলেও থাকে তাও শাড়িটা চেয়ে নিতে হবে কেন! উপহার দিয়ে ফেরৎ নেওয়া যে অসভ্যতা সেটা এরা জানে না। এদের তো এতো শাড়ি। মেয়ের বিয়ে তে পড়বে বলে সকালে বিকেলে ঢাকাই শাড়ি এসেছে বাড়িতে। তাও একটা শাড়ির জন্য এদের এই হ্যাংলামো কেন! শ্রী তো কোনোদিনই এসব নিয়ে হিংসে করেনি কাউকে! যে যার ভাগ্যে পাচ্ছে! হিংসে করে কি হবে! তবু রুচির বিয়ের সময় শ্রীকে শাড়ি নিয়ে অনন্তর কাছে কম কথা শুনতে হয়নি। রুচির বিয়ের আগে থেকেই অনন্ত সমানে বলে যাচ্ছিল, দাদা বোধহয় তোমাকে আর ঋতিকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেবে! কিন্তু বিয়ের যখন আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি তখন বিশ্বদেব ঋতির জন্য পছন্দ করে একটা জামা কিনে এনে দিল বটে, কিন্তু তার দামটা অনন্তর কাছ থেকে চেয়ে নিল। শ্রীয়ের জন্য কিছুই এলো না। অনন্ত তখন বাধ্য হয়ে শ্রীকে একটা শাড়ি কিনে দেবে বলে দোকানে নিয়ে গেল। সবথেকে কমদামি একটা শাড়ি অনন্ত পছন্দ করেছিল। শ্রী বলে বিয়ে বাড়িতে ওই শাড়ি পরলে তোমার মান থাকবে! ওর থেকে আর একটু ভালো শাড়িই পছন্দ করেছিল শ্রী। অনন্ত তখনকার মতো কিনে দেয়। কিন্তু বাড়ি ফেরার রাস্তায় বলে তোমাদের তো আবার একটা শাড়ি একবারের বেশি অঙ্গে ওঠে না। শ্রীর খারাপ লেগেছিল কথাটা শুনে। জীবনে কটা শাড়ি অনন্ত কিনে দিয়েছে যে একটা শাড়ি একবারের বেশি দুবার না পরার বিলাসিতা দেখাবে শ্রী। এতোদিন তো বিয়ে বাড়িতে সে মোটামুটি একটা তাঁতের শাড়ি পরেই চালিয়ে দিত। এইবার প্রথম বাড়িতে বিয়ে লেগেছে বলে একটা শাড়ি কিনে দিয়ে অনন্ত এভাবে কথা শোনালো। শ্রী তখনই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, চলো শাড়িটা ফেরত দিয়ে আসি। অনন্ত এই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমতা আমতা করে বলে, আমি সেটা কখন বললাম! শ্রী শাড়ির প্যাকেট অনন্তর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, তোমার যা মনে হয় করো। ও শাড়ি আমি পরব না। অনন্ত এবার সত্যিই ঘাবড়ে যায়। বাড়িতে এসে অনেক অনুনয় বিনয়ের পর শ্রী শেষপর্যন্ত শাড়িটা পরতে রাজি হয়।
রুচির হঠাৎই শরীর খারাপ হলো। প্রথমে সবাই ভাবল রুচি বোধহয় প্রেগনেন্ট! কিন্তু ডাক্তার বলল, রুচির ওভারিতে একটা টিউমার হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। অপারেশনের দিন মাধুরী চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। তার চোখে জল। শ্রী বড়দিকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আর রাজার মা একনাগারে ওই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রুচির নিন্দে করে চলেছে। রাজার মায়ের অধিকারবোধে আঘাত হেনেছে রুচি। দরকার মতো দু একটা কথা বলেছে। রাজার সঙ্গে একা একা বেড়াতেও গেছিল একবার। তারপর থেকেই রাজার মা আর রুচিকে সহ্য করতে পারছে না। রুচি ভাজাভুজি বেশি খায়। রুচি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে ইত্যাদি নানা অভিযোগ করে চলেছে মাধুরীর কাছে। তার বক্তব্য, রাজা আর রুচি একই বয়সি। আমার ছেলে মুখে রক্ত তুলে রোজগার করে নিয়ে আসছে। আর আপনার মেয়ে বসে বসে সেই টাকা ধ্বংস করছে। এই যে হসপিটালের এতো খরচ! অপারেশনের খরচ! সবই তো আমার ছেলেকেই করতে হচ্ছে! রাজার মায়ের প্রচ্ছন্ন কথাটি হলো মেয়ের ট্রিটমেন্টের খরচ বড়লোক বাপ দিল না কেন! বিশ্বদেবকে একথা মাধুরী আগেই বলেছিল। কিন্তু বিশ্বদেব দেখছিলেন কি হয়! বড়ো মুখ করে মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছিল না ওরা! এখন তাহলে কি হলো! আজ তাই মাধুরীকে ক্রমাগত বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে কথা বলে চলেছে রাজার মা। আর মাধুরী কাঁদছে আর শ্রীর কাছে এসে বলে চলেছে দেখেছ তো কিরকম করে বলছে! বেশ কয়েকবার এমনটা হওয়ার পর শ্রী আর থাকতে পারল না। বলল, আপনি তো অনেকক্ষণ ধরে রুচির সম্পর্কে বলে চলেছেন। আমরা শুনছি। হ্যাঁ, আমাদের মেয়ের অনেক দোষ আছে। তা আপনারা তো সব জেনেশুনেই মেয়েকে নিজেদের কাছে নেওয়ার জন্য এতো জোড়াজুড়ি করলেন! তারপর কি হলো! এখন অভিযোগ ছাড়া আর ভালো কথা বেরোচ্ছে না। তা বলবেন, নিশ্চয়ই বলবেন। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে তো বলবেন!মেয়েটা অপারেশন টেবিলে। মা কাঁদছে। আর এর মাঝে আপনি রুচির নিন্দে করে চলেছেন! একেই বলে শিক্ষার অভাব!
যেন গরম তেলে সরষে পড়ল। যার যত বিরক্তিই থাক, এমন করে রাজার মায়ের সঙ্গে এ বাড়ির কেউ কথা বলেনি কখনো! শ্রী বলে ফেলল। শ্রীর আসলে নিজের কথা মনে হচ্ছিল। তার বাবা মায়ের যে প্রতিবাদ করা উচিত ছিল একদিন, আজ শ্রী সেটা আরেকটা মেয়ের জন্য করতে পারল! এর পরিণতি যাই হোক না কেন এই কথাগুলো বলা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
৪৯
ঋতি স্কুলে এলো একেবারে ইলেভেনে ভর্তি হওয়ার দিন। তার বন্ধুরা সবাই সায়েন্সের ভর্তির ঘরে লাইন দিয়েছে। সে আর্টসের ঘরের লাইনে দাঁড়িয়েছে। সাবজেক্ট বাছাই করে ফর্ম ফিলাপ করে দিতে হবে। ঋতি ওদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। ওরা যেন কেউ ঋতিকে দেখতেই পাচ্ছে না। একমাত্র দেবাদৃতা ঋতিকে দেখে হাসল। দেবাদৃতা শুভলক্ষ্মীদের বাড়িতে একই মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ত। শুভলক্ষ্মীর থেকে দেবাদৃতা পড়াশোনায় ভালো। রেজাল্টও ভালো করেছে। দেবাদৃতার বাবাও তেমন কিছু করে না। নেশা ভাঙ করে। দেবাদৃতার মা একজন ডাক্তারের চেম্বারে কম্পাউন্ডারের কাজ করে। লোকে বলে ওই ডাক্তারের সঙ্গে দেবাদৃতার মায়ের না কি গোপন কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু দেবাদৃতার মা খুবই স্নেহময়ী। ঋতি খুব পছন্দ করে এই কাকিমাকে। কিছুক্ষণ পর শুভলক্ষী কাঁদতে কাঁদতে অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।শুভলক্ষী সায়েন্স পাচ্ছে না। ওর সায়েন্স সাবজেক্টের টোটাল নাম্বার কম। শুভলক্ষীর মা শুভলক্ষীকে নিয়ে ছুটল স্কুলের সেক্রেটারির বাড়ি। সেক্রেটারির মেয়ে সম্প্রীতিও শুভলক্ষীদের সঙ্গেই পড়ে। ঋতি পরে জানল সম্প্রীতির বাবা বলে কয়ে শুভলক্ষীর সায়েন্স পড়ার ব্যবস্থা করেছে এই স্কুলে। যাই হোক ক্লাস শুরু হলো। ঋতির ক্লাসে অন্যান্য স্কুল থেকেও অনেক মেয়ে ভর্তি হয়েছে। ইতিমধ্যেই তারা ঋতির বন্ধু হয়ে উঠেছে। কিন্তু পুরোনো বন্ধুরা যারা ভূগোল, ইকনমিক্স ইত্যাদি নিয়েছে তারা যেন ঋতিকে আর চিনতেই পারে না। নিজেদের মধ্যে কথা বলে। ঋতি কথা বলতে এগোলে বলে, আমরা অন্য সাবজেক্ট নিয়ে কথা বলছি। তুই বুঝবি না। কখনো আবার তারা ঋতির সামনে দর্শন নিয়ে হাসাহাসি করে। যেহেতু ঋতি দর্শন নিয়েছে তাই তাকে ছোটো করার চেষ্টা। তারা বলে, তুই তো পড়িস, রামছাগলের দাড়ি আছে। রবীন্দ্রনাথের দাড়ি আছে। কাজেই… ঋতি এসব শোনে। বোঝে সে স্টার পায়নি বলে বন্ধুরা তাকে অপমান করছে প্রতিনিয়ত। এদের আর ঋতি বন্ধু বলে ভাবতে পারে না। তবে এসব অপমান দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে ঋতি নতুন করে পড়াশোনা শুরু করে। এবার খানিকটা অশান্তি করেই ঋতির জন্য প্রাইভেট টিউটরের ব্যবস্থা করে শ্রী। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তিন মাসের ছুটিতে ঋতিকে ইংরেজির একজন মাস্টারমশাইয়ের কাছে দেওয়া হয়েছিল। তিনি কেবলই বলতে লাগলেন, ইংরেজিটা ঋতি একেবারেই পারে না। কিছুই শেখেনি। শ্রী বুঝল, মাস্টারমশাই যদি নিজেই ছাত্রীকে নিয়ে এতোটা হতাশ হন তাহলে শেখাবেন কি! শ্রী ঋতির স্কুলের ইংরেজির দিদিমণির সঙ্গে যোগাযোগ করল। তাঁকে সব কথা খুলে বলল। ইংরেজি নিয়ে প্রথম থেকেই নানা অবহেলা হয়েছে। ঋতি কিছুতেই ইংরেজি পড়তে চায় না। ওকে একটু যত্ন করে ধরে শেখাতে হবে। ওর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। সব শুনে দিদিমণি বললেন, যে মেয়ে মাধ্যমিকে ইংরেজিতে ৭৫ পেয়েছে সে একেবারে কিছুই জানে না এটা হতে পারে না। আমি ওর দায়িত্ব নিলাম। আপনি চিন্তা করবেন না। শ্রী কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। দর্শন আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর শিক্ষাবিজ্ঞানের জন্য একজন দিদিমণি ঠিক করা হলো। মেয়েটি অন্য একটি স্কুলে পার্ট টাইম পড়ায়। আর বাড়িতে টিউশন করে। এই মেয়েটি ঋতিকে বিশেষ করে দর্শন পড়তে শেখালো। ইতিহাসের জন্যেও একজন দিদিমণি ঠিক হলো। মেয়েটি সদ্য বিয়ে হয়ে এসেছে ব্যারাকপুরে। বাপের বাড়িতে প্রচুর টিউশন করত। এখানে ঋতিকে দিয়ে আবার টিউশন পড়ানো শুরু করল। আর বাংলা পড়তে শুরু করল ঋতি মামার এক বন্ধুর কাছে। ছেলেটি রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের মাস্টার। খুব ভালো ছাত্র। পড়ায়ও তেমনি। প্রথমদিন শ্রীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবশ্য তার চোখ ছলছল করে উঠল। তার প্রিয় বন্ধু এমন অকালে চলে গেল। এই নিদারুণ অপচয় সে মেনে নিতে পারেনি আজও। ঋতি কিন্তু এই মামাকে পেয়ে ভারি খুশি হলো। মামা খুব ভালো পড়ায়। শ্রী এবারে একটা বুদ্ধি বের করল। একজন টিউটরের ফিজ পঁচিশ টাকা বাড়িয়ে বলল। এই পঁচিশ টাকা দিয়ে প্রত্যেক মাসে ঋতিকে প্যাড কিনে দেওয়া যাবে। ঋতিও এই ব্যবস্থায় খানিক হাফ ছেড়ে বাঁচল। সর্বোপরি এতোজন দিদিমণি, মাস্টারমশাই পেয়ে ঋতি আপ্লুত। নতুন উদ্যমে পড়াশোনা শুরু করল ঋতি। শ্রী রোজ সন্ধেবেলা করে মা বাপীর কাছে যায়। অনন্ত যায় দাদার বাড়ি। ঋতি একাই থাকে ফ্ল্যাটে। পড়াশোনা করে। দিদিমণিরা যা লিখিয়ে দেন তাতেই ঋতি সন্তুষ্ট হতে পারে না। লাইব্রেরি থেকে বই এনে নানা কিছু সংযোজন করে। সেগুলো আবার দিদিমণিদের দেখায়। দিদিরা খুশি হয়। ঋতি পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। এ বাড়িতে এসে থেকে তার গান বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম শ্রী রেওয়াজ করার জন্য জোরাজুরি করত। রেওয়াজ না করলে অনন্তর কাছে নালিশ করত। এই নিয়ে অনন্ত দু একদিন ঋতিকে চড় মেরেছে। ঋতির সেটা মনে গেঁথে গেছে। বাবা তাকে মারল! কিন্তু ঋতি কিছুতেই রেওয়াজ করবেনা। ঋতি রেওয়াজ করতে বসলেই সামনের ধোপাদের ঘরের নাতিটা ঋতিকে ভেঙাতে থাকে। শ্রী দুএকদিন বারণ করেছে। তখন আরো বেশি বেশি করেছে। ঋতি তাই গান গাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। তার মাথার মধ্যে এখন একটাই কথা ঘোরে। তাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তার সহপাঠীদের সব অপমানের জবাব দিতে হবে। শ্রী মেয়ের এই আগ্রহ দেখে আনন্দ পায়। মেয়েটাকে কাছে ডেকে পড়ানোর তার সময় নেই। ঋতি পড়া ধরতে দেয় মাঝে মাঝে। বাকি সময়টা সংসারের কাজ, সেলাই সব সামলে তাকে ছুটতে হয় মায়ের কাছে। মার বয়স হয়েছে। শোকে তাপে জর্জরিত; অসুস্থ। মাকে সাহায্য না করলেই নয়। শ্রী প্রায় দিনই ও বাড়িতে জামাকাপড় কাচে, রুটি করে, রান্নায় মাকে সাহায্য করে। কাজের লোক না এলে বাসন মাজা, ঘর মোছা সবই করে। আবার সময়মতো দৌড়ে বাড়ি ফেরে। অনন্ত মিল থেকে চলে আসবে। তাকে বাড়িতে না পেলে রাগারাগি করবে। সবই এভাবে চলছিল। কিন্তু ঋতি সেদিন মার কাছে একটা অদ্ভুত অভিযোগ করল। মা, বাবা আমাকে পড়তে দিচ্ছে না।
মানে?
মানে তুমি দাদুর বাড়ি চলে যাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই বাবা ফিরে আসে বাড়িতে। আর কথা বলতে শুরু করে।
তাই! কি এতো কথা বলে!
সেই পুরোনো কথা মা। আত্তা দাদুর কথা, লোহার ব্যবসার কথা, আত্তা দাদু আর নিনানকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলে! গোটা সন্ধেটা কথা বলে নষ্ট করে। আমাকে পড়তে দেয় না। আমি খাতা বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাও বাবা বোঝে না।
শ্রী বিরক্ত হয় একথা শুনে। বলে তুই একটা কাজ কর। আমার সঙ্গে সন্ধেবেলা করে দাদুর ওখানে চল। ওখানে তো দুটো ঘর। তুই একটা ঘরে বসে পড়াশোনা করবি। যাবি!
ঋতি রাজি হয়ে যায়। তারপর থেকে এমনটাই চলতে থাকে। ইলেভেন থেকে টুয়েলভে উঠতে ঋতি ওর স্ট্রিমে ফার্স্ট হয়।
৫০
শ্রীর এক দূরসম্পর্কের বোনের বিয়ে। তারা দুই বোন। বড়ো বোনের যখন বিয়ে হয় ঋতি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। ঋতির মনে আছে অনন্ত আর ঋতি মিলে বরের গাড়ি ফুল দিয়ে সাজিয়েছিল। তারপর কিন্তু আর এই নতুন মেসোর সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ হয়নি। এই বিয়ে বাড়িতে গিয়ে নতুন মেসোর সঙ্গে আলাপ হলো। প্রায় পুরো বিয়েটারই দায়িত্ব সামলাচ্ছে নতুন মেসো। আবার ছোট্টো একবছরের ছেলের স্নান খাওয়া সবেরই হিসেব রাখছে। তার নিজের স্ত্রীর প্রতিও তার সমস্ত কর্তব্য করছে। নতুন কনেও যে কোনো দরকারে জামাইবাবুকেই ডাকছে। ঋতির বেশ ভালো লাগছিল। হাসিমুখে সবটা সামলাচ্ছে মেসো। ঋতির মনে হচ্ছিল এই হচ্ছে আদর্শ পিতা, আদর্শ স্বামী। বিয়ে শেষ হলে সেদিনই অনন্তদের চলে আসার কথা। কিন্তু এই নতুন মেসোর অনুরোধে অনন্ত রাতটা কাটিয়ে দিতে রাজি হলো। রাতে অবশ্য বাসর জাগার কোনো ব্যাপার নেই। কারণ নতুন বর কনেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ভাড়া করা বিয়েবাড়িতে বিশেষ শোবার জায়গা নেই। ফলে ঋতি, অনন্ত, নতুন মেসোর মতো কয়েকজন সারারাত বসেই কাটিয়ে দিল। সেখানে নানারকম গল্প হলো, মজা হলো। পরিবারের মানুষদের নিয়ে পুরনো নানা মজার কথা এক একজন বলছিল। ঋতি আর অনন্ত ডুয়েটে অনেকগুলো গান গাইল। উপস্থিত সবাই খুব প্রশংসা করল। ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ নামে যে মিউজিক্যাল জার্নি দিয়ে ভারতের সব রাজ্যের ভাষা ও মানুষকে বেঁধে ফেলা হয়েছিল সেটা শুনে শুনে ঋতি পুরোটা মুখস্থ করে ফেলেছে। এমনকি অন্য রাজ্যের ভাষাগুলোও না বুঝে মুখস্থ হয়ে গেছে। অনন্ত বলাতে ঋতি ওই গানটাও গাইল। সবাই ঋতির মেমরি দেখে অবাক হয়ে গেছে। নতুন মেসো খুব প্রশংসা করল। তারপর ভোরবেলা যখন অনন্ত বাথরুমে গেছে বাকিরা এদিক ওদিক মেঝেতেই গড়িয়ে নিচ্ছে নতুন মেসো ঋতিকে নিজের ছোটোবেলার কথা বলছিল। কিভাবে পড়াশোনা করল, চাকরি পেল এসব নানা কথা। ঋতির খুব ভালো লাগছিল। মানুষ হিসেবে কত বড়ো মনের এই মেসো। সকলের উপকার করে। যে কোনো এমার্জেন্সিতে সবসময় পাশে থাকে, সাহায্য করে। ঋতির মনটা ভরে যাচ্ছিল। এমন মানুষ সে দেখেনি। পরদিন ফিরে আসার সময় তাই ঋতির খুব মনকেমন করছিল। সে গম্ভীর হয়ে গেছিল। আর নতুন মেসো তার পাশে দাঁড়িয়ে বলছিল, মন দিয়ে পড়াশোনা করার কথা। ঋতির মনে হলো এই মেসোর কাছে তাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। ভালো রেজাল্ট তাকে করতেই হবে। ইলেভেনের রেজাল্ট ভালো হওয়ার পর ঋতিই একদিন ধরে বসল বাবা – মাকে। নতুন মেসো মানে দীপঙ্কর মেসোদের একদিন নেমন্তন্ন করতে হবে। এই ছেলেটিকে অনন্ত খুব একটা পছন্দ করে না। কেমন যেন মিনমিনে। পুরুষ মানুষ অতো নিচু গলায় বিনয়ে অবনত হয়ে পড়লে অনন্তর কেমন খটকা লাগে। একটু বেশিই বিগলিত নয়! একটু বেশিই যেন ভালো। যা হোক, তবু অনন্ত রাজি হলো।
সেদিন সকাল থেকে ঋতি ওইটুকু ফ্ল্যাটেই সাজ সাজ রব তুলে ফেলল। পুরনো ফুলদানি বের করে তাতে নিজের টাকায় কেনা ফুল দিয়ে সাজালো। ঋতির দুজন ছাত্রী হয়েছে। সপ্তাহে চারদিন ঋতি সন্ধেবেলা দু ঘণ্টা করে তাদের পড়ায়। ঋতির সামনের ফ্ল্যাটে যে মমতা কাকিমা ভাড়া থাকত তারই দুই মেয়ে। ঋতি খুব যত্ন করে পড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বড়ো মেয়েটা টুকলিবাজ। ঋতির সামনেই নানারকম কায়দা করে টুকলি করে। ঋতি ধরে ফেলে বকুনি দিলে মমতা কাকিমার মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। আর ছোটোটা ভীষণ উদাসীন। মন দিয়ে কোনো কথা শোনেই না। সারাদিন ওর একটাই চিন্তা। মা রান্নাঘরে কী রান্না করছে! ভালো ভালো খাবে। পড়াশোনার বেলা শূন্য। তার ওপর আবার ঋতির পড়ানো নিয়ে ও বাড়ির কর্তা নানা কথা বলতে শুরু করেছে। ঋতি না কি ভুল ইংরেজি পড়িয়েছে। মমতা কাকিমা ঋতিকে বলায় ঋতি ডিকশনারি খুলে দেখিয়ে দিয়েছে যে সে আসলে সঠিকই পড়িয়েছে। তবু কাকু মন থেকে কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারছেন না। ঋতির বিরক্ত লাগে এইরকম বাচ্চাদের পড়াতে। সেও তো ছোটো ছিল। বাবা-মা যা পড়াত মন দিয়ে পড়ত। কখনো এরকম অসভ্যতা করেনি। যাই হোক, সেই টিউশনির টাকায় ঋতি ফুল কিনে এনে ফ্ল্যাট সাজালো। শ্রীও মোটামুটি জোগাড় যন্ত্র করে রান্নাবান্না করল। ওরা ১১টা নাগাদ এসে পড়লো। ঋতি এই মেসোকে মেসো বলে ডাকে না। আসলে মায়ের এই দুই পিসতুতো বোন এতোই ছোট যে ওদের ঋতি ছোটো থেকে দিদিই বলে এসেছে। তাই দীপঙ্করকে ও দীপঙ্করদা বলেই ডাকে। গল্প,হাসি, গান এসব নিয়ে দারুণ সময় কাটছিল। দুপুরে খাওয়া দাওয়া হয়ে যাওয়ার পর অনন্ত বলল ওকে বেরোতে হবে। রুচির শ্বশুরবাড়িতে আজ বিশ্বদেব আর অনন্ত যাবে। কিছু কথাবার্তা আছে। অনন্ত চলে গেলে শ্রী আর ওর বোন ডাইনিঙে বসেই গল্প করছিল। ঋতি, দীপঙ্কর আর ছোটো বাচ্চাটা ঘরে টিভি দেখছে, কথা বলছে। দীপঙ্কর খুব আস্তে আস্তে ঋতিকে নানা কিছু বোঝাচ্ছিল। পড়াশোনা,গান ভালো করে করার কথা বলছিল। ঋতির মধ্যে অনেক সম্ভাবনা আছে। ওকে অনেকদূর এগোতে হবে। এসব বলতে বলতে ঋতির মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। নিঝুম দুপুর। টিভিতে একটানা ক্রিকেটের কমেন্ট্রি চলছে। ও ঘর থেকে গুনগুন করে মায়েদের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। হলুদ রঙের পর্দায় শেষ বিকেলের ছায়া এসে পড়েছে। ঋতির কেমন যেন ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে দীপঙ্করদাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। ও যে কখন শুয়ে পড়েছে ও নিজেও জানে না। দীপঙ্করের হাত ঋতির শরীরে ঘোরাফেরা করছে। ঋতির ছোটো টিলার মতো বুকে, পেটের সমতলে, আরো নিচে হাত ছোঁয়াতেই ঋতি উঠে বসে পড়েছে। কিন্তু চোখ খুলতে পারছে না। দীপঙ্কর ওর ঈষৎ খোলা ঠোঁটে ঠোঁট লাগাতেই ঋতি ছিটকে উঠেছে। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঋতি দরজা খুলছে দেখে শ্রী বলে ওঠে, কোথায় যাচ্ছিস রে!
ঋতি কাঁপতে কাঁপতে কোনো রকমে বলে ছাদ থেকে জামাকাপড় নিয়ে আসছি।
প্রায় দৌড়ে ঋতি চারতলার ছাদে ওঠে। সারা শরীরটা ওর কাঁপছে। বমি উঠে আসছে। ছাদের ধারে নিচের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ঋতি। তার ভিতরে তোলপাড় চলছে। এই তবে তার আদর্শ স্বামী,আদর্শ পিতার স্বরূপ। মুগ্ধতার সুযোগ নিয়ে এই তবে তার সত্য। ঋতি ভাবতে পারছিল না। একটু আগে তার সঙ্গে যা যা ঘটেছে কিছুই সে ভাবতে পারছিল না। বেশ খানিকটা সময় একা কাটিয়ে কোনো রকমে ধাতস্থ হয়ে জামাকাপড় নিয়ে ঋতি নিচে নামে। শ্রী ওর মুখচোখ দেখেই বুঝেছে কিছু একটা হয়েছে। ঋতির চোখের তলাটা কালো। মুখটা শুকিয়ে ঝুলে গেছে। দীপঙ্কর আর ঋতি তো ও ঘরে খেলা দেখছিল, কথা বলছিল। তারপর কিছুটা সময় কারোরই গলার আওয়াজ পায়নি শ্রী। তারপরই ঋতি ছিটকে ছাদে চলে গেল। সারাদিন দীপঙ্কর এসেছে বলে যে উৎসাহ ঋতির চোখে মুখে ঝরে পড়ছিল তা উধাও হয়ে গেছে এখন। ঋতিকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কি এমন হলো! দীপঙ্কর এর মধ্যেই সুযোগ করে ঋতিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কিছু মনে করনি তো! ঋতি দীপঙ্করের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। ঋতির বমি পাচ্ছে। মনে হচ্ছে দীপঙ্করের গায়েই বোধহয় বমি করে ফেলবে! ও সরে এলো। একবারও ঋতির মনে হলো না এখনি চেঁচিয়ে সবকিছু মাকে বলে দেওয়া উচিত। কি বলবে ঋতি! দীপঙ্করদার সামনে সে শুয়ে পড়ল কেন! তার অতো ঘুম পাচ্ছিল কেন! এসবের কোনো ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। এরকম একটা অ্যালিগেশন এনে সে তো কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। বরং গোটা আত্মীয় মহলে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তাদের সম্মান নষ্ট হবে। ওই সম্মানটুকুই তো তাদের আছে। দীপঙ্কররা চলে গেল। যাওয়ার সময়ও ছোটো বাচ্চাটার হাত দিয়ে ঋতির গালে আদর করার চেষ্টা করল। ঋতি সরে গেল। ওরা চলে গেল। শ্রী ঋতির আচরণ দেখে সবই বুঝল। কিন্তু কিছুই বলল না। দীপঙ্কর নেমন্তন্ন খেতে এসে যে অন্যায় করে গেল তার কোনো ক্ষমা নেই। কিন্তু এ নিয়ে হইচই করলে ঋতির অসম্মান হবে। শ্রীর মনে হলো ঋতিকেই সামলানো দরকার। শ্রী আরো কড়া হয়ে ঋতির পড়াশোনা দেখতে লাগল। অন্যায়ের প্রতিকার সময়ে একদিন হবেই। কিন্তু ঋতির জীবনে এই জটিলতা ঘনিয়ে উঠলে ওর কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। ওর সামনে উচ্চমাধ্যমিক। ঋতিও যেন কেমন উন্মাদের মতো পড়াশোনা করতে লাগল। সব অপমানের জবাব তাকে দিতে হবে। পড়াশোনা করে সে এই নরকের কীটটার থেকে এতো উঁচুতে উঠে যাবে যে দীপঙ্কর চ্যাটার্জি আর কোনোদিন ওর নাগাল পাবে না। দূরের তারার মতো জ্বলজ্বল করবে ঋতি। কোনো মলিনতা, কোনো গ্লানি তাকে ছুঁতে পারবেনা।
ষষ্ঠ পর্ব
৫১
আজ ঋতির উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে। ঋতি ভীষণ টেনশন করছে। গম্ভীর হয়ে আছে। তার চোখের তলার কালি গাল বেয়ে নেমে এসেছে। চোখের পাশে, মুখের এখানে ওখানে গলায় ঋতির বড়ো ছোটো নানা মাপের আঁচিল হয়েছে। সেসব নিয়ে ঋতিকে প্রায়ই নানা কথা শুনতে হয়। শোনায় তার প্রিয়জনেরাই, যারা তাকে রোজ দেখছে। বিয়ে বাড়ি বা অনুষ্ঠান বাড়িতে যাওয়ার সময় তাদের যেন নতুন করে ঋতির চোখের তলার কালি, ঋতির মুখের আঁচিল এসব চোখে পড়ে যায়। এই তো কিছুদিন আগে টুয়ার ছেলের পৈতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় অনন্ত যেন নতুন করে আবিষ্কার করল ঋতিকে হালকা সবুজ রঙের জামাটা একদম মানাচ্ছে না। আরো কালো লাগছে। অথচ ঋতির ওই একটাই ভালো জামা। এই জামাটা সম্পূর্ণা দিয়েছিল ঋতিকে। তখন অনন্তর খুবই পছন্দ হয়েছিল। আজ বাস ধরার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ অনন্ত আবিষ্কার করল ঋতিকে এই জামাটা পড়ে কালো লাগছে। ঋতি সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা কুঁকড়ে গেল। মনে মনে ভাবল, কালোকে কালো লাগবে এটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু সেটা মুখের ওপর বলাটা অসভ্যতা। বাবা সেটাই করছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এমন অদ্ভুত আচরণ মাধুরীও অনেক সময় করে থাকে। কোনো নেমন্তন্ন বাড়িতে একঘর লোকের সামনে মাধুরী হঠাৎই চেঁচিয়ে বলে ওঠে, হ্যাঁ রে ঋতি তোর চোখদুটো ওরম কালো দেখাচ্ছে কেন রে! মুখে ওগুলো কি বেরিয়েছে? আঁচিল? ঋতি তখন নিজেকে কোথায় লুকোবে ঠিক করতে পারে না। পালিয়ে আসে। সে অসুন্দর, কালো। এই কথাটা সবার সামনে বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চায় এরা! জ্যেঠু-বম্মাকে একদিন সে বলেছিল তার রাতে ঘুম হয় না। বাবা – মার ঝগড়া সে নিতে পারে না। তাই বোধহয় তার চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। শুনে বিশ্বদেব আর মাধুরী খুব হেসেছে। হাসির কারণটা অবশ্য ঋতি বোঝেনি।
পরীক্ষার পর ঋতির প্রায় আড়াই মাস মতো ছুটি ছিল। যথারীতি অনন্তর মিল বন্ধ। অনন্ত মেশিনে সেলাই করছে আর দাদার বাড়ির ফাইফরমাশ খাটছে! বৌদিকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়াটাও তারই কাজ। বিশ্বদেব তার শ্বশুরবাড়িতে যতবার না গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি বার গেছে অনন্ত। ইরা সেখানে ছিল। তাই যাতায়াত ছিল অনন্তর। এমনকি মাধুরীর বাপের বাড়ির দিকের কোনো অনুষ্ঠানে অনন্ত আর মাধুরী যেত। আর কেউ নয়। একবার মাধুরীর এক বোনের শাশুড়ি মা বলেছিলেন, তোমরা দেওর বৌদি মিলে সব জায়গায় যাও। মেজ বৌটাকে সঙ্গে আনতে পার না! তারপরও কিন্তু অনন্ত আর মাধুরীই সব জায়গায় যায়। এমনকি দক্ষিণেশ্বরর মন্দিরেও তারা দেওর বৌদি মিলে যায়। শ্রীকে সঙ্গে নেয়না। এসব নিয়ে শ্রী আগে মন খারাপ করত। এখন অভ্যেস হয়ে গেছে! শুধু ভাবে এরা আবার তার মা কাকুকে নিয়ে নোংরা কথা বলে কোন মুখে!
ঋতি দেখল এই ছুটিটাতে শ্রীও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ঋতি তাই খানিক গল্পের বই পড়ে, খানিক টিভি দেখে সময় কাটাচ্ছিল। টিভিতে সিনেমা দেখতে ঋতির ভালো লাগে না। বরং আধুনিক হিন্দি সিনেমার গান শুনতে ভালো লাগে। একটু লাউড মিউজিক। তবু ভালো লাগে। ঋতি বিভিন্ন মিউজিক চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শোনে। অনন্ত এসব একেবারে পছন্দ করে না। অনন্তর মনে হয় ঋতি সারাদিন বসে বসে শুধু হিন্দি গান শোনে। কোথায় বাড়ির কাজ করবে! কাজ শিখবে মায়ের কাছে। তা না! হয় গল্পের বই মুখে করে বসে আছে, নয়তো গান চালিয়ে বসে আছে। শ্রী অনন্তকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে এই ছুটিটাতে ওর বন্ধুরা অনেকেই বেড়াতে গেছে। মাঝে মাঝে ওরা কারো না কারো বাড়িতে দেখা করে, খাওয়া দাওয়া করে। ঋতি যেতে পারে না টাকা নেই বলে।অস্মির ছেলেকে পড়িয়ে যে টাকাটুকু পায় প্যাড কিনতে, টুকিটাকি খরচ হয়েই যায়। আর তো কোনো টাকা নেই ওর কাছে। অনন্ত এসব শুনে মুখ বেঁকায়। মুখে নানারকম বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে। মেয়েটাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা ওর মনেও হয় না। নিজেরা জীবনে কত কষ্ট করেছে সেই কথাটাই মেয়ের সামনে বারবার বলে বোঝাতে চায় যে তবু তো তোমার মাথার ওপর ছাদ আছে। আমাদের তাও ছিল না। ঋতি বুঝতে পারে না, তার মাথার ওপর ছাদ থাকাটা কি তার অপরাধ? সে বেশি সুযোগ সুবিধে পাচ্ছে! না কি তারা জাঠতুতো, খুড়তুতো দিদিরা, ভাই এরা সব বিপুল অর্থৈশ্বর্যের মধ্যে বড়ো হচ্ছে আর একই পরিবারের মেয়ে হয়ে তার দুবেলা কোনোমতে দুটো ভাত জুটছে এটা তার অপরাধ! ঋতির আজকাল মনে হয়, এতোই যখন টাকা পয়সা নিয়ে অসুবিধে ছিল তখন আমার জন্ম দিয়েছিলে কেন! আমি না-ই যদি জন্মাতাম তাহলে তো আর আমার জন্য কোনো খরচ হতো না! আমি রাতে রুটি না খেয়ে ভাত খাই কেন এ নিয়ে অশান্তিও থাকত না। এর মধ্যেই বিশ্বদেব একদিন ঋতিকে ডেকে পাঠিয়ে যা তা বলল। ঋতি নাকি সারাদিন টিভি দেখে। কোন্ কোন্ মিউজিক চ্যানেল দেখে সেটাও বিশ্বদেব অবিকল বলে দিল।ঋতির বুঝতে বাকি থাকল না যে এসব কথা বাবাই জ্যেঠুকে বলেছে। ঋতি বাবার ওপর রাগ করে বাবার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিল। কিছুদিন পর বিশ্বদেব এ বাড়িতে এসে ঋতিকে আবার একপ্রস্ত বকাবকি করল বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করার জন্য। ঋতি কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে ক্ষমা চাইল। অনন্ত মুখটা পাথরের মতো করে বসে থাকল। ঋতির বাবার ওপর বিরক্তি আরো বাড়ল। ঋতি দেখেছে ও বাড়িতে রুশিদিদিকে কোনো কারণে বিশ্বদেব বকাবকি করলে রুশিদিদি বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। বিশ্বদেব পরদিন বড়ো এক প্যাকেট লজেন্স নিয়ে এসে মেয়ের মন ভালো করে দেয়। ঋতির বেলা কিন্তু এসব কিছুই ঘটল না। কেবলই বকুনি, কান্না আর ক্ষমা চাওয়া। ঋতির মনে হলো বাবা যদি তাকে বুঝত তাহলে বাবার প্রতি ভালোবাসা সম্মান তার থাকত। কিন্তু বাবা কি তার সঙ্গে সম্মানজনক কোনো আচরণ করে! জোর করে, গুরুজন বলে সম্মান আদায় করা সম্ভব আদৌ! তাতে ভয়ভক্তি থাকতে পারে। ভালোবাসা থাকে না। সম্ভ্রম থাকে না।
যা হোক এসব চলতে চলতেই ঋতির রেজাল্টের দিন উপস্থিত। রেজাল্ট এ বছর নির্দিষ্ট পোর্টাল থেকে সকাল ১০টার পর থেকে দেখা যাবে। ঋতি তৈরি হয়ে বসেছিল। দশটা বাজার আগেই বেরোবে। অনন্তর এর মধ্যে একবার শ্রীর সাথে একপ্রস্ত কথা কাটাকাটি হয়েছে। আচ্ছা শ্রী, তুমি কত আশা করছ?
শ্রী বলেছে ঋতি স্টার পাবে।
অনন্ত মুখে হুঁ করে আওয়াজ করে বলেছে একটু বেশিই ভাবছ না! পিওর আর্টসের সাবজেক্ট নিয়ে তোমার মেয়ে স্টার পাবে উচ্চমাধ্যমিকে!
শ্রী আর কোনো কথা বলেনি। ইতিমধ্যে বিশ্বদেব এসে হাজির। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি রেখে ঋতিকে নিয়ে মজা করে চলেছে। কি রে, ফার্স্ট ডিভিশন হবে তো!
ঋতি চুপ করে আছে। একটা কথাও বলছে না।
দশটা বাজার আগেই শ্রী মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কম্পিউটারে রেজাল্ট দেখে ঋতি হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল। সে স্টার পায়নি। সামান্য নম্বরের জন্য স্টার মিস হয়ে গেছে। শ্রী মনে মনে ভাবল হাতের লেখার জন্যই ঋতির নম্বর কমে গেল। ছোটোবেলা থেকে নির্দিষ্ট ছাঁচে হাতের লেখা শিখে এখন তাড়াতাড়ি লিখতে গেলে ঋতি আর সেই ছাঁচ বজায় রাখতে পারে না। কখনো পেঁচিয়ে, কখনো সোজা করে লিখতে গিয়ে ওর হাতের লেখা অনেকসময়ই পড়া যায় না। মেয়েটার নম্বর ওখানেই কমেছে। গোটা রাস্তাটা ঋতি কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছে। পাড়ায় সবাই মনে করেছে সে বোধহয় ফেল করেছে। অনন্ত কিন্তু ভিতরে ভিতরে মারাত্মক ছটফট করছিল। মেয়েকে কাঁদতে দেখে তার অস্থিরতা আরো বেড়েছে! অনন্ত ক্রমাগত ঋতিকে জিজ্ঞেস করে চলেছে তুই কত পেয়েছিস? নম্বরটা বল? কত পেয়েছিস? ঋতি অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে শেষপর্যন্ত নম্বরটা বলল। অনন্ত এবার কেঁদে ফেলেছে। ঋতি যে সত্যিই এতো ভালো রেজাল্ট করবে অনন্ত ভাবতে পারেনি। বিশ্বদেব নম্বর শুনে বলল, অনেক নম্বর পেয়েছিস তো! এতো কান্নার কি হলো! পাশের বাড়ির এক মহিলা ঋতির নম্বর শুনে ছুটে এসেছেন। তিনি ঋতিকে খুবই পছন্দ করেন। তিনি তো ঋতির প্রশংসা করেই চলেছেন। শুনতে শুনতে বিশ্বদেব বলল, আর বলবেন না। মাথায় উঠে যাবে! ভদ্রমহিলা বিশ্বদেবের মুখের ওপর জবাব দিলেন, এসব মেয়েরা এতোটাই ভালো যে হাজার প্রশংসাও ওদের জন্য যথেষ্ট নয়। এসব মেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে নিজেদের লক্ষ্য থেকে সরে আসবেনা কখনোই। স্কুলে গিয়ে জানা গেল পিওর আর্টসের ব্যাচে ঋতি স্কুলের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে। দিদিমণিরা ঋতিকে জড়িয়ে ধরল। শুভলক্ষী সায়েন্স নিয়েও তেমন নম্বর পায়নি। যারা ঋতিকে এতোদিন অপমান করে এসেছে তারা অনেকেই ঋতির থেকে কম নম্বর পেয়েছে।
৫২
এ বছর একটা অদ্ভুত নিয়ম শোনা গেল। এ বছর না কি এক একজন ছাত্র মাত্র তিনটে কলেজ থেকেই ফর্ম তুলতে পারবে! কলেজগুলো থেকে মার্কশিটের পিছনে স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেবে। ফলে চাইলেও কেউ তিনটে কলেজের বেশি জায়গা থেকে ফর্ম তুলতে পারবে না। বিশ্বদেব অনন্তকে বলল, কাছাকাছির মধ্যে একটা কলেজ থেকে ফর্ম তুলে রাখ। ওখানে ভর্তি করলে যাতায়াত ভাড়া বেশি লাগবে না। তাছাড়া এসব কলেজে পড়ার খরচ অনেক কম। কলকাতার যে কোনো কলেজে খরচ বেশি পড়বে। তুই সামলাতে পারবি না।
অনন্ত এই যুক্তিটা একেবারেই ফেলে দিতে পারল না। সত্যিই তো, অনেক টাকা দিয়ে কলকাতা কলেজে ভর্তি করা অনন্তর পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া ভালো করে পড়াশোনা করলে যে কোনো কলেজ থেকেই ভালো রেজাল্ট হতে পারে। এই তো রুশিও তো এখানকার কলেজেই পড়ছে!
শ্রী কিন্তু পুরো ব্যাপারটায় বেঁকে বসল। উত্তর কলকাতার একটি স্বনামধন্য কলেজ ও যাদবপুর থেকে ফর্ম তুলতেই হবে।
ওসব জায়গায় পড়ার খরচ জানো?
তুমি জানো?
না, জানিনা, তবে ওসব বড়োলোকদের জায়গা! ওখানে আমি পড়াতে পারব না।
আগে ঋতি সেসব জায়গায় চান্স তো পাক। তারপর না হয় ভেবো পড়াবে কি না!
শ্রী নানা জায়গা থেকে খবর নিয়ে দেখল যাদবপুর বা সরকারি কলেজে পড়ার খরচ অন্য সব জায়গার থেকে কম! শ্রী নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ঋতিকে সেই স্বনামধন্য কলেজ থেকে ফর্ম তুলে দিল। ওখানে ভর্তি হতে গেলে পরীক্ষা দিতে হয়। ঋতি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। তার চোখে তখন অনেক স্বপ্ন! সে এতো বড়ো কলেজে পড়বে! ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ! এতো বড়ো একটা ঐতিহ্যের অংশীদার সে হতে পারবে! নাঃ, মন দিয়ে পরীক্ষাটা তাকে দিতেই হবে। ওদিকে যাদবপুরের ফর্ম তুলতে গিয়ে হলো এক বিপত্তি। সেদিন আর শ্রী যেতে পারেনি। অনন্ত আর ঋতি ভোরবেলা বেরিয়েছে। সাউথের ট্রেনে তখন মারাত্মক ভিড়। অনন্ত ঋতিকে নিয়ে ভেন্ডারে উঠেছে কোনোরকমে। সেখানে কে যেন বমি করে রেখেছে। দেখেই ঋতির গা গুলিয়ে উঠেছে। কোনোরকমে সামলে সে দাঁড়িয়েছে। অনন্ত তাকে একনাগাড়ে বলে চলেছে, দেখেছিস তো এদিককার ট্রেনের অবস্থা? পারবি তো রোজ রোজ এভাবে যাতায়াত করতে! এতদূর যাওয়া আসা করে পড়াশোনার সময় পাবি তো! ঋতি বুঝতে পারছে বাবা খুব বিরক্ত। ঋতি জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা! সেদিন কোনোরকমে ফর্মটা তুলেই অনন্ত বাড়ি ফিরে এসেছে। অথচ ওদের কাছে ঋতির পাসপোর্ট সাইজ ছবি থেকে শুরু করে সমস্ত ডকুমেন্ট অ্যাটেস্টেড করা ছিল। ফর্মটা জমা দিয়েই চলে আসা যেত। অনন্ত সে পথই মারায়নি। ঋতি অতো বোঝেনি। একে সে শিয়ালদা স্টেশন দেখেই ভয় পেয়েছে। তারপর সাউথের ট্রেনের নোংরা দেখে তার খুব ঘেন্না হয়েছে। সবটা মিলিয়ে সে আর বাবাকে কিছু বলতে পারেনি। অনন্ত ফিরে এসেই ঘোষণা করেছে সে আর যাদবপুরের ফর্ম জমা দিতে যেতে পারবে না। যেতে হলে শ্রী যাক! এই টালবাহানার মধ্যেই অন্য কলেজটির পরীক্ষার দিন এসে পড়েছে। ঋতি ভয়ে ভয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। ভালোই লিখতে পেরেছে। শ্রী মেয়ের কাছে পরীক্ষার কথা শুনে যথেষ্ট আশাবাদী হয়ে পড়েছে যে ঋতির এখানে হয়ে যাবে! ঋতি এখানেই পড়বে। কিন্তু রেজাল্ট বেরোনোর দিন দেখা গেল ওখানে সিট কুড়িটি। আর ঋতির একুশ নম্বরে নাম আছে। ঋতি রেজাল্ট দেখে কেঁদে ফেলেছে। শ্রীর মুখটাও গম্ভীর হয়ে গেছে। শ্রী একবার চেষ্টা করল হেড অফ দা ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে দেখা করতে। এই ভদ্রলোক শ্রীর পূর্বপরিচিত। বিশ্বদেবের পাড়াতেই ইনি থাকেন। এঁর মেয়েও ব্যারাকপুর গার্লসে ঋতির সিনিয়র ছিল। শ্রী সটান তার কেবিনে গিয়ে উপস্থিত হলো। ভদ্রলোক শ্রীকে চিনতে পেরে বসালেন। অত্যন্ত অমায়িক সজ্জন ব্যক্তি। তিনি বললেন, মেয়ের তো খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছে। আমাদের কুড়িটা সিট ঠিকই। কিন্তু প্রথমদিকের অনেকেই পরে যাদবপুরে ট্রান্সফার হয়ে যায়। তখন সিট খালি হয়। একটা সিট খালি হলেই ঋতি সুযোগ পাবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই।
স্যার, সিট খালি হলো কি না আমরা কিভাবে জানতে পারব?
আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন না! এক পাড়াতেই তো থাকি! আমিই জানিয়ে দেব।
শ্রী অনেকটা আশা বুকে করে বাড়ি ফিরল। ঋতিও মাকে দেখে আর স্যারের সঙ্গে কথা বলার পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।
বিশ্বদেব সব শুনে অনন্তকে বুদ্ধি দিল, ওসব জায়গায় নানা পলিটিক্স কাজ করে। নেতা মন্ত্রীর ছেলেমেয়েরা চান্স পায়। তুই ঋতিকে এখানকার কলেজে ভর্তি করিয়ে দে। অনন্ত প্রায় জোর করেই ঋতিকে কাছের একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল। শ্রীর ইচ্ছে ছিল না। যাক গে, ওই স্বনামধন্য কলেজে হয়ে গেলে তো আর এতো টাকা লাগবে না। শ্রীই ঋতিকে ভর্তি করিয়ে দেবে। দিন দশ পর শ্রী ঋতিকে নিয়ে স্যারের বাড়ি পৌঁছোলো। স্যারের স্ত্রী হঠাৎই বলতে শুরু করলেন, আমার মেয়ের জন্য তো উনি ওঁর ডিপার্টমেন্টের ফর্মটুকুও তুলে আনতে পারেননি। আমার মেয়েকে অন্য কলেজে ভর্তি করেছিলাম। ওখানে ধরাকরা করে কিছু হবে না।
শ্রী একথা শুনে খুব অবাক হয়। বলে, আমি তো আমার মেয়েকে অন্যায্য ভাবে ভর্তি করাতে আসিনি। আমার মেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। মাত্র একজনের পিছনে আছে ও। কেউ যদি যাদবপুরে চলে যায় তাহলে তো সিট ফাঁকা হবে। সেখানে এমনিই ও ভর্তি হতে পারবে! ওর জন্য কারো সুপারিশ লাগবে না। স্যার বলেছিলেন বলে,আমি খোঁজ নিতে এসেছি কোনো ছাত্র ছেড়ে দিয়েছে কি না!
ভদ্রমহিলা তাও বলতে লাগলেন, না না, ওসব বলে কোনো লাভ নেই। ওঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।
শ্রী আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু হাল ছাড়ল না। বারদুয়েক তারপরও সে ওই কলেজে গেল। কিন্তু কোনো খবরই সে পেল না। ভর্তি সংক্রান্ত কোনো তথ্য অফিসের লোকেরাও দিতে চাইল না। ওদিকে ততদিনে যাদবপুরের ফর্ম জমা দেওয়ার তারিখও চলে গেছে। ফলে ঋতি বাধ্য হলো কাছের কলেজে ক্লাস শুরু করতে! কিন্তু এ তো ক্লাস নয়, গরুর গোয়াল! প্রচুর ছেলেমেয়ে একটা ঘরে ঠাসাঠাসি করে বসেছে। সবাই কথা বলছে। প্রথমদিন ক্লাসে একজন স্যার ঢুকলেন। তিনি এইচ ও ডি। বললেন, বাংলা নিয়ে পড়ে কি করবে! বিয়ের বাজারে দর বাড়াবে! শুনেই ঋতির কানে খট করে লেগেছে। সে তো ভালোবেসে বাংলা নিয়ে পড়তে এসেছে। একজন বাংলার প্রফেসর হয়ে এমন কথা বলছেন কি করে! এই কথা তো রীতিমতো অপমানজনক! পরের ক্লাসে এক ম্যাডাম এসে সাহিত্যের ইতিহাস পড়াতে শুরু করলেন। চর্যাপদ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পড়াতে পড়াতে বললেন, দেখো একই কথা এই দুই সাহিত্যেই রয়েছে। ‘আপনা মাঁসে হরিণা জগতের বৈরী’ একথা বলেছেন চর্যাকারেরা। আর বড়ু চণ্ডীদাস বলছেন, আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’। ঋতি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে, ম্যাম!
হ্যাঁ,বলো।
এটা তো আসলে উল্টো। মানে ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’ আছে চর্যাপদে। আর ‘আপনা মাংসে হরিণা জগতের বৈরী’ আছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে।
বাবা! তুমি তো দেখছি খুব পড়াশোনা করে এসেছে! কোন্ স্কুলে পড়তে? কত পেয়েছ উচ্চ মাধ্যমিকে?
ঋতি মাথাটা আরো সোজা রেখে বলে, ব্যারাকপুর গার্লস হাই স্কুলে পড়তাম। তিয়াত্তর শতাংশ নম্বর পেয়েছি।
ও আচ্ছা, অনেক নম্বর পেয়েছ দেখছি! সেই জন্যই সবজান্তা হয়ে উঠেছ! বোসো বোসো। যা পড়াচ্ছি মন দিয়ে শোনো। বলার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরা হেসে উঠেছে।
ঋতির ব্যাপারটা একদম ভালো লাগল না। ও বসে পড়ল তখনকার মতো। কিন্তু বাড়ি গিয়ে বই খুলে দেখল ও ঠিকটাই বলেছে। ম্যামই ভুল পড়াচ্ছিলেন।
পরদিন আরেক কাণ্ড। অন্য আরেকজন স্যার এসে শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ পড়াতে শুরু করেছেন। ঋতির এই উপন্যাসটা আগেই পড়া হয়ে গেছে। স্যার বসে বসে গল্পটা পড়াতে পড়াতে একজায়গায় চরিত্রগুলো নিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করলেন। তা শুনে আবার গোটা ক্লাস হাসছে। ঋতির বিরক্ত লাগল। এমন একটা উপন্যাস নিয়ে হাসাহাসি করাটা ওর একেবারেই পছন্দ হলো না। ঋতি পাশের মেয়েটাকে বলেই ফেলল, এসব কি বলছেন উনি! কি পড়াচ্ছেন এগুলো!
কেন কি খারাপ পড়াচ্ছেন! একটু হাসালেই দোষ!
ঋতি আর থাকতে না পেরে বলে ফেলল, আসলে ভালো পড়ানো কাকে বলে জানো না তো তাই এটাকে ভালো মনে হচ্ছে!
পাশের মেয়েটি তখন তার পাশের মেয়েটিকে বলল, ওর খুব অহংকার। ভালো নম্বর পেয়েছে কি না!
তবে সব স্যার, ম্যাডামই এমন নন। একজন আছেন এস এস স্যার। তিনি এই কলেজে পার্ট টাইম পড়ান। রোজ আসেন না। পি এইচ ডি করছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি যখন পড়ান ঋতি হাঁ করে শোনে। কী সাবলীল ভাবে বলে যান স্যার! কত কঠিন কথা কত সহজ করে বলেন! আর কত কি জানেন! পড়ার বাইরেও কত বিষয় নিয়ে কথা বলেন। ঋতি মুগ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু একমাত্র ইনি ছাড়া আর তো কেউই ঠিক মতো পড়াচ্ছেন না। উপরন্তু ক্লাসের বেশিরভাগ মেয়েরা এইচ ও ডির কাছে পড়তে ভর্তি হয়ে গেছে! তার কেবিনে বসে কেউ কেউ সন্ধে অবধি গল্প করে। ঋতির কানে সব খবরই আসে। ঋতির কেমন গা গুলিয়ে ওঠে। এই কলেজে, এই পরিবেশে সে তিন বছর পড়বে কি করে! ঋতি বাড়িতে গিয়ে মা -বাবাকে সব বলে, কাঁদে। শ্রী গম্ভীর হয়ে শোনে। আর অনন্ত বলে, একটু মানিয়ে নিতে শেখ। পৃথিবীর সব জায়গা তোমার ব্যারাকপুর গার্লস হবে না!
এসব শুনে ঋতি আরো কাঁদে। তার চোখদুটো কেমন অন্ধকারে ঢেকে গেছে মনে হয়। তার শরীরে যেন কোনো ক্ষমতাই নেই। তার কলেজ যেতে ইচ্ছে করে না। এর মধ্যে একদিন শ্রী আবার প্রেসিডেন্সির সেই স্যারের বাড়ি গেছিল। স্যার, ঋতি তো আপনার কলেজে চান্স পেল না। ওকে আপনি একটু আলাদা করে গাইড করে দেবেন! ওকে একটু দেখবেন স্যার। ওকে দেখিয়ে দিলে ও মন দিয়ে পড়াশোনা করবে!
হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই, বলে তিনি লম্বা একটা বইয়ের লিস্ট বানিয়ে দিলেন। এই বইগুলো কিনে পড়ো। দেখবে কোনো অসুবিধেই হচ্ছে না।
ঋতি লিস্টটা হাতে নিয়ে দেখল, সবই নোটস বুক। প্রশ্নোত্তরের বই! তবে যে স্কুলে দিদিরা বলত নোটস বই একদম পড়বে না। টেক্সট পড়ো। আর নিজে লেখো। সেইভাবেই তো ঋতি পরীক্ষা দিয়েছিল। নম্বরও পেয়েছে। অথচ ইনি তো বিশেষ একটি প্রকাশনার নোটস বই পড়তে দিচ্ছেন। ঋতি ইতিমধ্যেই লাইব্রেরি থেকে আর এস এস স্যারের কাছ থেকে কিছু ভালো বইয়ের সন্ধান পেয়েছে। সেসব নিয়ে দু এক কথা জিজ্ঞেস করতেই স্যার বললেন, ওসব কঠিন বই। এখনই পড়ার দরকার নেই। এখন এই বইগুলো পড়ো।
অনন্ত ঋতির মনের অবস্থা বুঝে ঋতিকে বইগুলো কিনে দিতে চাইল। কিন্তু ঋতি এস এস স্যারের সঙ্গে কথা বলে বুঝল এসব বই পড়ে কোনোরকমে পাস করা যায়। ভালো রেজাল্ট করা যায় না। সে ওই লিস্ট রেখে দিল।
এমন করেই চলছিল। এক মাস হতে চলল। ঋতি কলেজ যায় না। বাড়িতেও যে খুব পড়াশোনা করে তা নয়। অন্ধকার ঘরে একা একা বসে থাকে। বাবা মা কারো সঙ্গেই বিশেষ কথা বলে না।
সেদিন অস্মি এসেছে ওর ছেলেকে নিয়ে ঋতির কাছে পড়াতে। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই ঋতির চেহারা দেখে অস্মি আঁৎকে উঠেছে। কি হয়েছে তোর ঋতি! এরকম লাগছে কেন তোকে দেখতে! মাসিমণিকে দেখে ঋতির চোখেও জল চলে এসেছে। ঋতি মাসিমণিকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার আর পড়াশোনা হবে না মাসিমণি। এই কলেজে কিচ্ছু পড়াশোনা হয় না।
অস্মি প্রথমে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। তারপর ঋতির কাছে সব শুনে বলে, দাঁড়া, তোর মেসো তো ওর কলেজের কালচারাল টিমে আছে। ওকে দেখি বলে, ও যদি কিছু করতে পারে! তুই মেসোর কলেজে পড়বি!
ঋতি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নেড়েছে। মেসো ভালো কলেজ থেকেই বি এস সি পাশ করেছিল। ওই কলেজে পড়তে পারলে ভালোই হবে। অন্তত এই গরুর গোয়াল থেকে মুক্তি ঘটবে!
সেদিনও ঋতি কলেজ যায়নি। আগামীকাল তার কলেজে নবীনবরণ হবে। সেখানে না কি নানারকম ভাবে নতুন ছেলেমেয়েদের রাগিং করা হবে। তার প্রস্তুতি আজ থেকেই শুরু হয়ে গেছে। ফলে ক্লাস কিছুই হবে না। ইউনিয়নের ছেলেরা এসে শাসিয়ে গেছে। কাল সকলকেই কলেজে আসতে হবে। নইলে একমাস অ্যাটেন্ডেন্স পাবে না। ঋতি সবই শুনেছে। বাড়িতে এসে বলেছে এবং আজ কলেজ যায়নি। কালও যাবে না। অনন্ত এই নিয়ে ঋতিকে বকাবকি করছিল। তিন বছর পড়তে হবে ওখানে। দিনের পর দিন কলেজে না গেলে চলবে! একটু তো মানিয়ে নিতে হয়! রুশিও তো পড়ছে ওখানে। ও তো কই এতো অভিযোগ করে না! যত অসুবিধে হচ্ছে তোমার! এসবই চলছিল। এমন সময় হঠাৎ ঋতির মেজ মেসো এসে উপস্থিত। ঋতি মেজ মেসোকে দেখে খুশি হয়েছে। আবার ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড টেন্সড হয়ে পড়েছে। কি জানি! মেজ মেসো কি বলবে! যদি বলে ওর কলেজে ভর্তি করা সম্ভব হলো না! কি হবে তাহলে! ঋতির বুকের ভিতর যেন কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। অনন্ত আর শ্রী কিন্তু বুঝেছে নিশ্চয়ই ভালো কোনো খবর আছে! নইলে অস্মির বর নিজে আসত না।
অস্মির বর বেশ গুছিয়ে বসে হাসি হাসি মুখে বলতে আরম্ভ করল। সে তার কলেজের কালচারাল টিমে প্রাক্তনী হিসেবে আছে বলে গত বসন্তেই একটা নাটক করেছে। তাই অধ্যাপকরা অনেকেই ওকে চেনেন। সেই সূত্রেই সেক্রেটারি মারফত বাংলা বিভাগের প্রধানের সঙ্গে কথা বলে এসেছে ও। আগামীকাল ঋতিকে নিয়ে উনি যেতে বলেছেন।
শুনে ঋতি কেঁদে ফেলেছে। এই নরক থেকে সত্যিই তার মুক্তি ঘটতে পারে সে কল্পনাতেও আনতে পারেনি। অনন্ত, শ্রী সকলের চোখেই জল। মেয়েটা পড়াশোনা করতে পারছে না এ নিয়ে ওরা বাবা মা খুবই দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছে এই এক মাস। যাই হোক পরদিন ঋতিকে নিয়ে শ্রী আর অনন্ত যথাসময়ে চলে এলো সেই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খ্রিস্টান মিশনারী কলেজের সামনে। বিরাট বিল্ডিং, বড়ো বড়ো থাম, কাঠের সিঁড়ি, বিরাট বিরাট ক্লাসরুম দেখেই ঋতির মন ভালো হয়ে গেছে। অস্মির বরও এসে গেছে। সবাই মিলে যাওয়া হলো বাংলা বিভাগের হেড অফ দা ডিপার্টমেন্টের কাছে। তিনিও যেন অপেক্ষা করছিলেন। খুবই অমায়িক ভদ্রলোক। বললেন, বাংলা বিভাগে যারা ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে আপনার মেয়ের নম্বর সবচেয়ে বেশি। তবে এক মাস ক্লাস হয়ে গেছে। ওকে কিন্তু একটু দ্রুত এগোতে হবে। ঋতি ওঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। বললেন, ভালো রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু! ঋতি আস্তে করে মাথা নাড়ল।
৫৩
শুরু হলো ঋতির কলকাতায় নতুন কলেজে যাতায়াত। অনন্ত ঋতিকে ভালো করে ট্রেনের আপ-ডাউন বুঝিয়ে দিল। শিয়ালদায় নেমে কোন্ দিক দিয়ে বেরোতে হবে, কোন্ বাস ধরতে হবে তাও চিনিয়ে দিল। কিন্তু শিয়ালদা থেকে কলেজে পৌঁছনোর আরও একটা রুট আছে। সেই রুটে প্রথমে বাসে তারপর অটোতে যেতে হয়। খরচ বেশি। তাই অনন্ত এক বাসে যাতে চলে যাওয়া যায় সেই রুটটাই ঋতিকে দেখিয়ে দিল। কিন্তু সেই বাসটায় শিয়ালদা থেকে খুব ভিড় হয়। খানিকটা অনিয়মিতও বটে। যাই হোক, সকাল দশটা দশ থেকে ক্লাস। একবার ক্লাসে ঢুকে প্রফেসর পড়াতে শুরু করলে আর ঢুকতে দেওয়া হয় না। ঋতি তাই বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। লেট যেন না হয়! কিন্তু প্রথমদিন শিয়ালদা স্টেশনে নেমেই রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে! কোন্ দিকে গেলে যে কলেজে যাওয়ার বাসটা পাওয়া যাবে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এদিকে ঘড়িতে সময় এগিয়ে চলেছে! দশটা দশের মধ্যে পৌঁছতে না পারলে প্রথম দিন প্রথম ক্লাসটাই মিস হয়ে যাবে! এ তো কিছুতেই হতে পারে না। অনন্ত ঋতিকে বাস ভাড়া বাবদ পাঁচ টাকা দিয়েছে। আর ব্যাগে রেখে দেওয়ার জন্য পঞ্চাশ টাকা। খুব বিপদে পড়লে ওই পঞ্চাশ টাকায় হাত পড়বে! ঋতির মনে হলো প্রথম ক্লাসটা মিস হয়ে যাওয়ার মতো বিপদ আর কি হতে পারে! ঋতি ট্যাক্সি ধরল। কিন্তু তার মাথায় ঘুরছে ট্যাক্সি চালকরা অনেকে ভুল রাস্তায় নিয়ে গিয়ে বিপদে ফেলে! অনন্ত এসব ভয় ঋতির মাথায় ঢুকিয়েছে! ঋতি খানিকটা এগোয় আর ট্যাক্সি থামিয়ে পথচারীদের জিজ্ঞেস করে এই রাস্তা তার কলেজের দিকের কি না! কেউ বলতে পারে। কেউ পারে না! ঋতি তখন ঘামতে শুরু করেছে!
ট্যাক্সি চালক ভদ্রলোক ঋতির ব্যাপারটা বুঝে বললেন, ম্যাডাম আপনি বসুন। আমি আপনাকে আপনার কলেজে পৌঁছে দেব। কোনো ভয় নেই।
ঋতি তাও তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু না করেও উপায় নেই।
শেষপর্যন্ত ঋতি ঠিকমতো কলেজে পৌঁছলো। কলেজের গেটের সামনে পৌছে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর বুক থেকে। কিন্তু পঞ্চাশ টাকা শেষ। যাই হোক, ঋতির কলেজ জীবন শুরু হলো এবং তা তরতরিয়ে চলল। এই কলেজের প্রফেসররা ভীষণ স্ট্রিক্ট। কেউ কেউ তো স্কুলের মতো রেগুলার পড়া ধরেন। বিশেষ করে ভাষাতত্ত্বের ক্লাসে বৈশাখী ম্যাম আগের দিনের পড়া না পারলে খুবই বকাবকি করেন। সবাই ভয় পায় ওঁকে। সবাই বলতে মাত্র তিরিশ জন ছাত্র। বৈশাখী ম্যাম ক্লাসের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন! কে উত্তর বলবে? ঋতি দ্বিতীয় দিনই সাহস করে হাত তুলেছে। উত্তর দিয়েছে। ম্যাম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নতুন ভর্তি হয়েছ না?
হ্যাঁ ম্যাম।
আচ্ছা। ঠিক বলেছ। বসো।
ক্লাসের পর একে একে সবাই এসে ঋতির সঙ্গে পরিচয় করেছে। দু একজন অবশ্য আসেনি। তারা না কি এখানকার পুরনো ছাত্র। এই মিশনারী স্কুলেই পড়েছে। এখন কলেজে পড়ছে। একটি মেয়ে সে না কি এতোদিন উচ্চমাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী হায়েস্ট পজিশানে ছিল। ঋতি এসে পড়ায় তার পজিশন সেকেন্ড হয়ে গেছে। সে ঋতির সঙ্গে কথাই বলল না। কেউ কেউ আবার জিজ্ঞেস করল, কত টাকা ডোনেশন দিয়ে ভর্তি হতে হলো! কেউ কেউ বলল, কার রেফারেন্সে ভর্তি হলি? ঋতি সন্তর্পণে এসব কথা এড়িয়ে গেল। প্রেসিডেন্সির কথাও বলল না। একজন আবার বলল, এখানকার এক ম্যাডামের সঙ্গে ইউনিভার্সিটির খুব ভালো যোগাযোগ। তার কাছে পড়লে ভালো নম্বর পাওয়া যায়! তার কাছে ভর্তি হবি!
ঋতি সন্তর্পণে মাথা নাড়ল। ঋতি জানে, আলাদা করে টিউশন পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে নিজেই পড়বে!
বৈশাখী ম্যামের সঙ্গে ঋতির কদিনেই খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। যদিও ম্যাম খুবই গম্ভীর। একটুও হাসেন না। আর খুব কম কথা বলেন। তবু ম্যাম, ঋতিকে বিভিন্ন লাইব্রেরির খোঁজ দিলেন। বাসের রুট পর্যন্ত বলে দিলেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকার কথা বললেন। কলেজের লাইব্রেরির কার্ড ঋতি ইতিমধ্যেই করিয়ে নিয়েছে। ডিপার্টমেন্টাল লাইব্রেরি থেকে যাতে একটু বেশি বই পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করলেন ম্যাম। ঋতি বই তোলে। পাগলের মতো পড়ে। প্রয়োজনীয় অংশ জেরক্স করে নেয়। কলকাতার আরো একটি লাইব্রেরি মফসসলে বাড়ি বলে ঋতিকে বাড়িতে বই আনতে দিল না। সেখানেও ঋতি বই তুলে, পড়ে, প্রয়োজনীয় অংশ জেরক্স করে নিতে লাগল। এই জেরক্সের টাকা আসতে লাগল টুয়া আর অস্মির ছেলেদের পড়িয়ে। ঋতি কলেজ থেকেই সপ্তাহে একদিন করে টুয়ার বাড়ি চলে যায়। টুয়া ঋতিকে যত্ন করে খাওয়ায়। টুয়ার বাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে অনেকটা ভেতরে। ঋতি হাঁটতে হাঁটতে যায়। বৃষ্টি হলে এই রাস্তাটা পুরোটাই জলের তলায় চলে যায়। ঋতি ওই জলের মধ্যে হাঁটে। টুয়া তাই এক একদিন জোর করে রিক্সাভাড়া ধরিয়ে দেয়। ঋতি সংকোচ বোধ করে। তবু ছোটোমাসির জোরাজুরিতে নিতে হয়। অস্মির বাড়িতেও ঋতিকে মাঝে মাঝে যেতে হয়। অস্মির ছেলের পরীক্ষা থাকলে আগের দিন সারারাত ঋতিকে ওর ছেলেকে পড়াতে হয়। তাতে ছেলের রেজাল্ট ভালো হবে। ঋতি এমন অদ্ভুত পদ্ধতিতে পড়ালেখা করাতে চায় না। বিরক্ত হয়। অস্মি তখন বলে, আয় আমার বাড়িতে। ফুলকো ফুলকো লুচি খাওয়াব। যত চাই তত। বলে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এমন ইঙ্গিত করে যে ঋতির মনে হয় সে কি খেতে পায়না! যে খাওয়ার লোভে কারো বাড়ি যেতে হবে। সে আরো বেঁকে বসে।
তখন শ্রী আর অনন্ত মিলে তাকে বলে, তুমি যে এই কলেজে পড়তে পারছ সেটা ওদের জন্য। তুমি যত ভালো রেজাল্টই করো না কেন মেজ মেসোর যোগাযোগ ছাড়া তুমি এখানে ভর্তি হতে পারতে না। কাজেই এইটুকু তোমাকে ওদের জন্য করতেই হবে। ঋতি বুঝতে পারে, সে আসলে বাধ্য। এই কাজটা তাকে করতেই হবে। তা সে যতই অসুস্থ হোক! পিরিয়ডের সময় তার যতই পেটে ব্যথা হোক! অস্মিদের বাড়ি যত নোংরা হোক! সমস্ত অসুস্থতা ও অসুবিধে উপেক্ষা করে ঋতিকে যেতেই হবে। যেহেতু ঋতি তাদের বদান্যতা গ্রহণ করেছে। আর গিয়ে কি করতে হবে! সারা বছর সে যা পড়িয়েছে সেসবই আবার পড়াতে হবে! ছেলে বুঝবে কি বুঝবে না সেটা বড়ো কথা নয়! অস্মিকে পুরোটা বুঝতে হবে! ঋতির মনে হয় এতো পড়াশোনা যদি নিজের ছোটোবেলায় করত মাসিমণির আজ এই অবস্থা হতো না!
সেদিন গোলপার্কে এসেছে ঋতি। বৈশাখী ম্যাম যেভাবে বলেছেন সেভাবেই প্রথম কদিন ও যাতায়াত করেছিল। তারপর নিজেই আবিষ্কার করেছে গোলপার্ক থেকে হেঁটে বালিগঞ্জ স্টেশন পৌঁছে যাওয়া যায়। তারপর ওখান থেকে ট্রেন ধরে নিলে বাসভাড়াটা বাঁচে। ঋতি ফেরার সময়টা ওভাবেই ফেরে! গড়িয়াহাটের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসতে হয়। কত জিনিস বিক্রি হয়। ঋতি প্রায় কোনোদিকেই তাকায় না। তার তো কেনার উপায় নেই! শুধু শুধু দেখে মন খারাপ করে কি হবে! কলেজে রেগুলার পরে আসার মতো জামাও তার ছিল না। কয়েকটা জামা কিনে দিতেই হবে। অনন্তকে এসব বলে লাভ নেই। শ্রী সম্পূর্ণাকে বলেছিল, তোদের ওখানে তো সস্তায় পাওয়া যায়! তুই দুটো চুড়িদারের পিস পাঠাতে পারবি! আমি তো কলকাতার কিছুই চিনি না। মেয়েটার দুটো জামা না হলেই নয় রে! কিন্তু টাকা নিতে হবে। টাকা না নিতে চাইলে কিন্তু খুব মুশকিল হবে! সম্পূর্ণা ওর ভাইয়ের হাত দিয়ে দুটো জামার পিস পাঠিয়েছে। সেগুলো বিশ্বদেবের বাড়িতে আনা হয়েছে! বিশ্বদেব অনন্তর মাথায় ঢোকালো এই জামার টাকা সম্পূর্ণা কখনোই নেবে না!
অনন্ত বাড়িতে এসে শ্রীকে যা তা বলতে আরম্ভ করল! রুশিও তো আছে। কই তুমি তো রুশির জন্য আনালেনা!
রুশির তো কম নেই মেজছেলে। ওর বাবাই তো ওকে ভরিয়ে রেখেছে। ঋতির কলেজে পরে যাওয়ার মতো জামা নেই। ওকে তো দুটো কিনে দিতেই হবে!
এই টাকাটা যদি সম্পূর্ণা না নেয় তবে খুব খারাপ হবে শ্রী আমি বলে রাখলাম।
ঠিক আছে। দেখাই যাক।
সম্পূর্ণা পরদিন পাশের বাড়িতে ফোন করে জানাল, মেজদি, তুই জামার দরুণ টাকাটা দাদার হাতে দিয়ে রাখিস। আমি যখন যাব তখন নিয়ে নেব। শ্রী বিকেলেই গিয়ে টাকাটা বিশ্বদেবের হাতে দিয়ে এলো। এ নিয়ে আর কোনো কথা কেউ বলল না।
সেই দুটোর চুড়িদারের ওড়নাগুলোও বেশ বড়ো বড়ো। ঋতি ওড়নাগুলো দিয়েও চুড়িদার বানিয়ে নিল। তার চারটে জামা হয়ে গেল। ফুটপাত থেকে শ্রী ওকে একটা সাদা আর একটা কালো ওড়না কিনে দিল।
সেদিন গোলপার্কের লাইব্রেরিতে ঋতি বইয়ের রিকুইজিশন দিয়ে আরো অন্য বইয়ের খোঁজ চালাচ্ছে। এমন সময় টের পেল তার হঠাৎ পেটে ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে পিরিয়ড হয়ে যাবে! কি হবে এবার! ঋতির কাছে তো টাকাও নেই যে এখনি একটা প্যাডের প্যাকেট কিনে নেবে ওষুধের দোকান থেকে। তারওপর কয়েকটা বইয়ের কিছু পাতা আজ তাকে জেরক্স করতে দিতেই হবে। নইলে দেরি হয়ে যাবে। ঋতি বাথরুমে গিয়ে দেখল সত্যি তার পিরিয়ড হয়ে গেছে। পেটে ব্যথা করছে। কিন্তু কিছুতেই সে ফিরে যাবে না। সে চুপ করে চেয়ারে বসে থাকল। বই এলে প্রয়োজনীয় অংশ জেরক্স করতে দিয়ে বেরোবে। আবার বালিগঞ্জ অবধি হাঁটতে হবে। ঋতি চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিল। তাও কোনোরকমে টলতে টলতে স্টেশনে পৌঁছলো।ট্রেনে উঠে আর বসল না। ব্যাগটাকে কোলের কাছে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। খানিকক্ষণ বাদে দেখে জামার সামনের অংশটা লাল হয়ে উঠেছে। শিয়ালদায় নেমে ঋতি দৌড়তে আরম্ভ করেছে। কোনোরকমে একটা ট্রেনে উঠে উল্টোদিকের দরজার কোণায় দাঁড়িয়েছে। সে ব্যাগটা দিয়ে নানাভাবে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে। পারছে না। প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছে। জামা প্যান্ট সব লাল হয়ে গেছে। সবাই ঘুরে ঘুরে ঋতিকে দেখছে! কেউ কেউ হাসছে। ঋতি ট্রেনের বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। কাজের মাসি, সব্জি বিক্রি করে যে মাসিরা তারা বিরক্ত। তাদের বসার জায়গায় ঋতি দাঁড়িয়ে আছে। ঋতি কোনোদিকে তাকাচ্ছে না। ব্যারাকপুর স্টেশনে নেমেও ঋতি দৌড়তে আরম্ভ করেছে। অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে তার। তবু থামছে না। একেবারে বাড়ি গিয়ে বেল বাজাতে অনন্ত দরজা খুলেছে।
মা নেই?
না।
সরো, আমি বাথরুমে যাব।
অনন্ত তাকিয়ে দেখল ঋতির অবস্থা। কিছুই যেন বুঝল না।
ঋতির তখন মনে হচ্ছে সে এবার পড়ে যাবে। বাথরুম গিয়ে খানিকক্ষণ মেঝেতেই বসে থাকল ঋতি। তার হাত পা কাঁপছে ঠকঠক করে।
খানিক বাদে শ্রী এলো বাড়িতে, ঋতি ফিরেছে?
হ্যাঁ, বাথরুমে গেছে। বোধহয় পায়খানা পেয়েছে!
শ্রী ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি প্রথমে। বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও ঋতি যখন বেরোচ্ছে না, শ্রী দরজায় ধাক্কা মারল।
ঋতি দরজা খুলে দিয়েছে মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে।
শ্রী ঋতিকে দেখেই বুঝেছে কিছু একটা হয়েছে। ঋতি তখন পাগলের মতো কাঁদছে।
অনন্ত তখন উঠে এসেছে। দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে!
শ্রী তাকে আর কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না।
৫৪
সেদিন প্রায় রাত সাড়ে নটার সময় শ্রী আর ঋতি বাড়ি ফিরেছে। বেল বাজিয়ে ওরা বাইরে অপেক্ষা করছিল। অনন্ত বাথরুমে। এমন সময় ওদের উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে গেল! একজন মাঝারি মাপের ছেলে কলাপসেবল গেটে তালা দেবে বলে দরজা খুলেছে। শ্রী ওদিকে তাকিয়ে হাসছে দেখে ঋতিও তাকিয়েছে।
এই ফিরলেন?
হ্যাঁ গো। মেয়ের পরীক্ষা ছিল। তারপর বোনের বাড়ি হয়ে ফিরলাম।
ও, কোন্ কলেজ? এবার প্রশ্নটা ঋতির দিকে তাকিয়ে।
ঋতি কলেজের নাম বলল।
আচ্ছা। কী বিষয়?
বাংলা।
বাহ্ বাহ্!
ঋতি এই প্রথম কাউকে বাহবা দিতে শুনল বাংলা নিয়ে অনার্স পড়ছে শুনে। ঋতি খুশি হলো।
এখন পরীক্ষা?
ইন্টারনাল টেস্ট।
ও, তোমাদের কলেজে এসব হয়, তাই না! খুব ভালো। ততক্ষণে অনন্ত দরজা খুলে দিয়েছে। শ্রী বলল, ঠিক আছে, স্নেহময়!
হ্যাঁ কাকিমা। বন্ধ করলাম।
ঋতি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই শ্রী খুব হাসল। ঋতি মাকে অতো হাসতে দেখে অবাক হয়ে গেছে! কী হয়েছে মা? হাসছ কেন?
জানিসতো তোকে বলা হয়নি। দুদিন আগে এই ছেলেটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ও আর ওর এক বন্ধু এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছে। দুদিন আগে মালপত্র এসেছে। জলের ব্যবস্থা ছিল না। তাই জল চাইতে এসেছিল।
ও, তা তুমি এখন হাসছ কেন?
আরে শোন, ও দুদিন আগে আমাকে বউদি বলছিল। গতকালও বউদি বলেই কথা বলেছে।
এখন কাকিমা বলল না!
হ্যাঁ সেটাই তো বলছি। যেই তোকে দেখেছে ওমনি কাকিমা বলতে শুরু করেছে! বলে শ্রী খুব হাসছে।
ঋতিও মার সঙ্গে হাসতে আরম্ভ করেছে।
পরদিন ঋতির কলেজে ছুটি ছিল। সারাদিন ঋতি মার সঙ্গে কথা বলে কাটিয়েছে। কলেজটা ওর ভীষণ ভালো লেগেছে।
শ্রী মন দিয়ে ঋতির কথা শুনছে। বোঝার চেষ্টা করছে কলেজটা ভালো লাগছে কেন! কোনো বিশেষ বন্ধু টন্ধু…
ঋতি মায়ের এসব ভাবনা জানে না। সে মনের আনন্দে কথা বলছে। ব্যারাকপুরের কলেজটায় তার অভিজ্ঞতা আর এই নতুন কলেজে তার অভিজ্ঞতা দুইয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য! এখানে নিয়মিত পড়াশোনা হয়।
লীলাদির মেয়ে কিন্তু এই কলেজে পড়ে এমন কিছু রেজাল্ট করতে পারেনি ঋতি।
হ্যাঁ, মা জানি। আমাদের কলেজটা কিরকম বলতো মা, যে পড়তে চাইবে সে অনেক সুযোগ পাবে। আবার যে আড্ডা মেরে, ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাতে চাইবে সে তাও পারবে। কোনটা তুমি করবে, সেটা তোমার ওপর।
হ্যাঁ ঋতি, ভালো করে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে হবে। দেখছ তো, আমি পড়াশোনা করতে পারলাম না বলে আজ কেমন আছি!
ঋতি মায়ের ছোটোবেলার কথা এখন অনেকটাই জানে। কেন মায়ের পড়াশোনা হলো না সেসব গল্প জানে। তবে মা তাকে কোনোদিনই কিছু বলতে চায়নি। একদিন মাধুরী, মানে ঋতির বম্মা কথায় কথায় বলে ফেলেছিল। ঋতি প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল। ঠাকুমা এরকম ব্যবহার করত মায়ের সঙ্গে! মা ঠিকমতো খেতেও পায়নি! এসব শুনে ঋতির খুব কষ্ট হয়েছিল। মা’র ওপর অভিমানও হয়েছিল। মা তো তাকে কোনোদিন এসব বলেনি! মার কাছে জানতে চাওয়ায় মা তখনও বলতে চায়নি। বলেছিল, এসব বড়দের কথায় তোমার থাকার দরকার নেই। কিন্তু ঋতি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে করে মার কাছ থেকে জেনেছে। মা’র ওপর ঠিক কতটা অত্যাচার হয়েছে এ বাড়িতে! ঋতি তাই মনে মনে ঠিক করেছে, পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ঋতি মার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। বাবার রোজগার নেই। সেই নিয়ে নিত্যদিনের অশান্তি তো সেও ভোগ করেছে। এখনও করছে। এসব থেকে মা বাবাকে মুক্তি দেবে সে। ঋতি মনে মনে এসব ভাবে। কাউকে কিছু বলে না। মা তাকে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে বলে। কখনো কোনোদিন নিজের সম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ করতে মা নিষেধ করে। আর বাবা তাকে বলে, আমি যা পারিনি, তাই করে দেখাতে হবে। তুই হবি আমার বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত প্রশ্নের জবাব! ঋতি এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে উত্তেজিত হয়ে গেছিল। বেশি উত্তেজিত হলে ঋতি আর কথা বলতে পারে না। চুপ করে যায়। মনের ভেতরে বাবা মায়ের কথাগুলো আলোড়ন তোলে। বাইরেটা শান্ত থাকে। শুধু ঋতির চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বড়ো বড়ো মায়াবী অথচ নিবিড় ও গভীর চোখদুটো দেখে তখন ঋতিকে সমীহ করতে ইচ্ছে করে! ওর স্কুলের এক দিদিমণি একবার শ্রীকে বলেছিল, অনেক মেয়ের মধ্যেও ঋতি ঠিক আলাদা করে নজরে পড়ে। ওর চোখদুটো খুব গভীর! শ্রী ঋতিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে এসব ভাবছিল। এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল! ঋতি চমকে উঠল। যেন গভীর সাধনায় মগ্ন ছিল। উঠে এসে দরজা খুলে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে স্নেহময়।
স্নেহময় একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। খাওয়ার জল নেবে।
ঋতি বলল, দিন, আমি বোতলটা ভরে দিচ্ছি।
স্নেহময় বলল, কাকিমা, আপনি খাওয়ার জল কোথা থেকে নেন?
আমাদের ছাদে মিউনিসিপ্যালিটির জলের একটা কল আছে। ওখান থেকেই জল নিয়ে আসি।
ছাদ থেকে মানে, চারতলার ছাদ থেকে?
হ্যাঁ গো।
সে কি!
তাছাড়া আর উপায় কি বলো!
স্নেহময় আরো খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এ বাবা! আপনি এতো কষ্ট করে জল আনেন। আর আমি তো রোজই…
তাতে কী হয়েছে! তুমি তো নতুন এখানে। জানবে কী করে!
ঋতি স্নেহময়ের হাতে বোতলটা ধরিয়ে দেয়। অনন্ত ইতিমধ্যে দাদার বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। স্নেহময়ের সঙ্গে অনন্তরও পরিচয় হয়েছে। সামান্য কথার পর স্নেহময় চলে যাচ্ছিল। অনন্তই বলল, আরে কোথায় যাচ্ছ! একটু চা খেয়ে যাও।
না না,কাকু, ঠিক আছে।
আরে বসো বসো। তুমি খেলে আমারও আরেকবার হয়। নয়তো মাঝে মাঝে ভুলেই যাই এ বাড়িতে চায়ের পাট আছে।
শ্রীর মনটা আজ ভালো আছে। এই ছেলেটিকে শ্রীর ভালো লেগেছে। গালগুলো ফুলো ফুলো, কালোকুলো একটা ছেলে। অথচ শিক্ষিত, মার্জিত। ঠিক যেন ভাইয়ের মতো! শ্রী হাসতে হাসতে বলে উঠল, তোমার কাকু ওরম বলে। বেরোবার সময় এক কাপ খেয়ে গেছে। এখন আবার। তাও বদনাম করছে।
অনন্ত বলে, আরে সে তো সেই কখন খেয়েছি। ও দিয়ে কি হবে!
স্নেহময় এসব শুনে হাসছে। ঋতিও হাসছে। ঋতির মনে হচ্ছে এ বাড়িতে এতো নির্মল হাসি এই প্রথম। এমন করে আগে কখনো হাসাই হয়নি ঋতির। এই স্যাঁতসেঁতে একতলার ঘুপচি ফ্ল্যাটটায় ঋতি শুধু ঝগড়া দেখেছে। তার হঠাৎই মনে পড়ে গেল, বাবা ঝগড়া করে বেরিয়ে গেল। মা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ঋতি একা। সে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ছুটে এসে মায়ের মুখে চোখে জল দিচ্ছে। মাকে ডাকছে, কাঁদছে ঋতি। স্নেহময়ের কথায় তার ভাবনাটা সরে গেল। স্নেহময় কী যেন জিজ্ঞেস করছে। ঋতি শুনতে পাচ্ছে না। সে শুধু দেখছে বাবা মাকে। ওদের কোনোদিন যৌথভাবে এমন হাসতে দেখেনি ঋতি। স্নেহময় নানা কথা বলছে, হাসছে। ঋতির মনে হচ্ছে স্নেহময়দা জাদু জানে। এক নিমেষে বাড়ির পরিবেশটা কেমন হালকা করে দিল। ঋতি স্নেহময়কেও দেখছে। শীতের রাত নিঝুম হয়ে নামছে। তবু যেন কেমন ওম হয়ে আছে ঘরের ভিতরটা! কেমন যেন আলো আলো…
৫৫
স্নেহময় কল্যাণীতে থাকে। এম.এস.সি পাশ করে ডব্লু. বি.সি.এস পরীক্ষা দিয়ে গ্রেড এ তে চাকরি পেয়েছে। ওর পোস্টিং কলকাতায়। কল্যাণী থেকে কলকাতায় অনেকেই যাতায়াত করে। স্নেহময় বাবা, মা, বোনকে ছেড়ে কেন ব্যারাকপুরে এসে আছে সে নিয়ে অবশ্য ঋতি মাথা ঘামায়নি। তবে ঋতি এর মধ্যে জেনে ফেলেছে স্নেহময় প্রতিদিন কোন্ ট্রেনে করে অফিসে যায় আর কোন্ ট্রেনে করে ফেরে। ঋতিও ওই ট্রেনে করেই কলেজ যায়। রোজ কলেজে যাওয়ার সময় ঋতির মনে কেমন একটা যেন আনন্দ হয়। স্নেহময়দাও এই ট্রেনে করেই যাচ্ছে; ভাবতেই একঝলক দমকা হাওয়া এসে ঋতির একমাথা কোঁকড়ানো চুল এলোমেলো করে দেয়। স্টেশনের পাশেই একটা শিমূল গাছ আছে। ঋতি এর আগেও দেখেছে বছরের একটা বিশেষ সময়ে ওর খয়েরি ডালে বড়ো বড়ো লাল ফুল ফুটে আছে।যদিও এর আগে কোনোদিন মন দিয়ে দেখা হয়নি। এখন স্টেশনে আসার রাস্তাটার অনেক দূর থেকে ঋতি গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর ফুলগুলো অদ্ভুত। বড়ো সহজ অথচ বড়ো গভীর! আর ঠিক সেইসময়ই মাতাল করা সেই হাওয়াটা। অল্প অল্প ঘাম গায়ে ওই হাওয়াটা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা! স্টেশন থেকে একটু এগিয়ে এসেই একটা ফুলের দোকান। ঋতি আজকাল টিউশনির টাকায় অল্পস্বল্প ফুল কেনে। ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলে তাদের ওই স্যাঁতসেঁতে ঘরটা যেন নরম রোদেলা দুপুরের কমলালেবুর মতো রঙিন হয়ে ওঠে। সন্ধেবেলা স্নেহময়দা এসে ফুল দেখে খুশি হয়। ঋতির যে তখন কী আনন্দ হয়! কলেজ থেকে ফিরে ঋতি জাঁক করে চাউমিন বানাতে বসে। স্নেহময়দা খেয়ে খুবই প্রশংসা করে। ঋতির মনটা ফুলে ভরা গাছের মতো দুলে ওঠে। রোজই স্নেহময়দাকে বলবে ভেবেও ঋতি একটা কথা বলতে পারেনি। সেদিন স্নেহময় আর ঋতি বাইরের ঘরে বসে ঋতির বাংলার সিলেবাস, ঋতির তৈরি নোট এসব নিয়ে আলোচনা করছিল। স্নেহময় সাহিত্য পড়তে ভালোবাসে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্নেহময়ের প্রিয় কবি। তাছাড়া শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামীর লেখা নিয়ে কথা বলতে স্নেহময় ভালোবাসে। ঋতি এসব পড়ছে এখন অল্প অল্প। ঋতি বসে বসে স্নেহময়ের কথা শোনে। সেদিন কথায় কথায় বেরিয়ে এলো স্নেহময় কবিতা লেখে। ঋতি আবদার করে বসল, তোমার কবিতা একটা শোনাও। স্নেহময় একটু লজ্জা লজ্জা মুখে ঋতিকে কবিতাটা শোনাচ্ছে। ওর চোখ নিচু। আর ঋতি তাকিয়ে আছে অন্যদিকে। স্নেহময়দা একটা বিচ্ছেদের কবিতা লিখেছে। শুনতে শুনতে ঋতির বুকটা ভারি হয়ে উঠছে। স্নেহময়ের সেই বেদনার স্বর যেন ঋতির ভিতরে কোথায় আমরণ ভিজিয়ে দিচ্ছে! ঋতি তন্ময় হয়ে শুনছে। কবিতাটা শেষ হওয়ার পর ঋতির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। স্নেহময় ঋতির দিকে তাকিয়ে আছে। স্নেহময়ের চোখ দুটো যেন রাঙা হয়ে উঠেছে। ঋতি স্নেহময়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈষৎ লালচে স্নেহময়ের চোখ। ঝিরিঝিরি পল্লবে ঘেরা। আর কী মায়াময়! যেন গভীর কোনো দুঃখ ওই চোখে জমিয়ে রাখা আছে। সামান্য স্নেহে ঝরে পড়বে ফোঁটায় ফোঁটায়। ঋতি নিষ্পলক তাকিয়ে আছে স্নেহময়ের চোখের দিকে। তার শরীরটা ভারি হয়ে উঠেছে। রোমকূপগুলো যেন জাগছে! স্নেহময়ও তাকিয়ে আছে ঋতির দিকে। অদ্ভুত আবিষ্ট হয়ে আছে ওর দৃষ্টি। এই মুহূর্তে ঋতির মুখে একটা আলো যেন ফুটে আছে। স্নেহময়ই আবেশটা ভেঙে দিল। উঠি রে…
ঋতি মুহূর্তে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। কতক্ষণ এভাবে যে ও তাকিয়েছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা প্রত্যয় টের পাচ্ছে ঋতি। এতোদিন যা অধরা ছিল ঋতি যেন এবার তার ছোঁয়া পাচ্ছে। ঋতি যেন নিজের কাছে নিজেই স্বীকার করছে তার মনের কথা। স্নেহময় ততক্ষণে উঠে পড়েছে। ঋতি হঠাৎই বলে উঠল, কাল সকালে বেরোবার সময় ডেকো।
স্নেহময় একবার ঘুরে তাকাল।
পরদিন সকালে বারান্দা থেকে স্নেহময় ডাক দিল, রুতু, যাবি?
ঋতি এতোক্ষণ ছটফট করছিল ভিতরে ভিতরে। আসলে কাল রাত থেকেই ঋতি অস্থির হয়ে আছে। ঘুম আসেনি তার। সকালের এই ডাকটার জন্য সে একটা গোটা রাত জেগে কাটিয়ে দিয়েছে। তারপর স্নেহময় ডাকল এমন মিষ্টি করে! রুতু বলে অনন্ত মাঝে মাঝে ঋতিকে ডাকে! স্নেহময়ের মুখে সে ডাক যেন আরো মধুর লাগছে!
গোটা রাস্তাটা স্নেহময় যত্ন করে ঋতিকে নিয়ে গেল। রাস্তা পার হওয়ার সময় প্রায় ঋতির হাত ধরে ফেলছিল স্নেহময়। রাস্তায় কোথায় নোংরা আছে, কোথায় এবড়ো খেবড়ো আছে! চেনা রাস্তাই নতুন লাগছে ঋতির। ট্রেনে অবশ্য একসঙ্গে যাওয়ার সুযোগ নেই। জেনারেলে প্রচণ্ড ভিড়। ঋতি নিজে থেকেই লেডিসে গিয়ে উঠল। শিয়ালদা নেমে ভিড়টা একটু আল্গা হতেই ঋতি দেখল স্নেহময় দাঁড়িয়ে আছে। ঋতিকে টাটা করে তবে সে রওনা দিল। ঋতি তখন আর হাঁটছে না, উড়ছে! এতো আনন্দ হচ্ছে ঋতির। সে যেন বুঝতে পারছে স্নেহময়দার চোখে ভাষা! ওখানে ঋতির জন্য বিশেষ একটি কথা অপেক্ষা করে আছে। ঋতি ঠিক করল আজ সে ফিরবেও স্নেহময়দার সঙ্গে। কলেজ শেষ করে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে ঋতি ঠিক সময়ে স্টেশনে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু এতো মানুষের মাঝে স্নেহময়দাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল! ঋতি তাও ইতস্তত খোঁজাখুঁজি করে শেষে লেডিসেই উঠে পড়ল। ব্যারাকপুরে নেমে নিশ্চয়ই দেখা হয়ে যাবে। পুরো ট্রেনের পথটা হাজারো কথার মাঝে ঋতির কানে যেন ভাসছে স্নেহময়ের গলার স্বর। ঋতি আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। ব্যারাকপুর স্টেশনে নেমেও স্নেহময়ের দেখা নেই। ঋতি একটু আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দিয়ে লোকজন হেঁটে যাচ্ছে। আড়চোখে অনেকেই ঋতিকে দেখছে। স্নেহময়ও দূর থেকে ঋতিকে দেখে চলে যাচ্ছিল। ঋতিই ডাকল, স্নেহময়দা?
আরে, তুই!
আমি এই ট্রেনেই ফিরলাম। তুমি আসছ দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।
স্নেহময় জানে ঋতি তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। যদিও মুখে সে কিছুই বলল না।
হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই মাতাল সমীরণ। ঋতির কাঁধের চুলগুলো অল্প দুলছে। ঋতি বকবক করতে করতে চলেছে। একসময় হঠাৎ জিজ্ঞেস করে ফেলল, স্নেহময়দা, তুমি প্রেম করো।
স্নেহময় একটু থেমে উত্তর দিল, নাহ্।
ঋতি আর কিছু বলল না। তার উড়তে ইচ্ছে করছে!
সেদিনও ঋতি আর স্নেহময় একসঙ্গেই স্টেশনে এসেছে। ট্রেনের গণ্ডগোল হয়েছে। স্টেশনে মারাত্মক ভিড়। পরপর ট্রেন ক্যানসেল করা হচ্ছে। যে ট্রেনগুলো আসছে তাতেই লোকে ঠেলেঠুলে উঠে পড়ছে। সকলেরই তাড়া আছে। শুধু স্নেহময় আর ঋতির যেন কোনো তাড়া নেই।ওরা দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় ট্রেনগুলো এক একটা আসছে আর চলে যাচ্ছে। ওরা ওঠার চেষ্টাও করছে না। কেবল দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। শেষে একটা স্পেশাল ট্রেন অ্যানাউন্স করল। ততক্ষণে স্টেশন চত্বর ফাঁকা হয়ে এসেছে। স্নেহময় আর ঋতি কথা বলেই চলেছে। সবই আবোলতাবোল কথা। তবু কথা বলতে ভালো লাগছে ওদের দুজনেরই। স্পেশাল ট্রেনের কথা শুনে স্নেহময় বলল, চল আজ আমার সঙ্গে জেনারেলে যাবি?
ঋতি এক কথায় রাজি।
একটা ফাঁকা কম্পার্টমেন্টে ওরা দুজনে পাশাপাশি বসল। হু হু করে জানলা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে। ঋতির চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। স্নেহময়ের হাতের সঙ্গে ঋতির হাতটা মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঋতি ভিতরে ভিতরে শিহরিত হচ্ছে। শেষে শিয়ালদায় নেমে ঋতি টাটা করতে যাবে এমন সময় স্নেহময় হঠাৎই ঋতির কাঁধটা ধরে বলে উঠেছে, হ্যাপি বার্থডে রুতু!
ঋতি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে স্নেহময়ের দিকে। কিন্তু ঋতিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে স্নেহময় টাটা করে এগিয়ে গেলো! ঋতির কি পা দুটো আটকে গেছে!
৫৬
রুশি ইতিহাসে অনার্স পাশ করে বি.সি. এসের পড়াশোনা শুরু করেছে। একটা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছে। সঙ্গে কম্পিউটার শিখছে। তার ইচ্ছে সে অফিসার রাঙ্কে চাকরি করবে। বিশ্বদেব বিজয়দেবের নতুন কোম্পানিতে শেয়ার হোল্ডার হতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু কোম্পানির ইস্টার্ন জোনের কাজটা এখন বিশ্বদেব দেখছে। ব্যারাকপুরেই তার অফিস। রুশি মাঝে মাঝে সেই অফিসে গিয়ে বাবার চেয়ারে বসে। বিশ্বদেব একদিন গর্ব করে শ্রীকে বলেছিল, বুঝলে মেজো বৌ, রুশি কারো আন্ডারে চাকরি করবে না। ওর মেজাজটাই বস্ হওয়ার মতো। শ্রী একথার মধ্যে যে অহংকার রয়েছে সেটা টের পেয়েছিল। কিন্তু অহংকার যে কী নিয়ে তা বুঝে উঠতে পারেনি। রুশি উচ্চ মাধ্যমিক ও অনার্সে অত্যন্ত খারাপ রেজাল্ট করেছে। অনার্সে তার পঞ্চাশ শতাংশ নম্বরও আসেনি। এক ফাঁকিবাজ ইতিহাসের মাস্টারমশাইয়ের পাল্লায় সে পড়েছিল। ভদ্রলোক নিজে জিনিয়াস। কিন্তু প্রচণ্ড তাস খেলার নেশা। ফলে ঠিক মতো পড়ান না। শ্রী কতবার রুশিকে বলেছিল, তুই যেমন ওঁর কাছে পড়ছিস পড়। কিন্তু আরেকজন মাস্টার রাখ। যে তোকে পরীক্ষার জন্য তৈরি করবে। উনি তো অর্ধেক দিন পড়ানই না। রুশি বলেছে, কাকিমা, তুমি ঠিক বুঝবে না উনি কতখানি জ্ঞানী মানুষ। উনি থাকতে আর কারো কাছে পড়ার আমার দরকার নেই। ফলে অনার্সের রেজাল্ট খারাপ হলো রুশির। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সে এম এ তে চান্স পেল না। এখন বি সি এস নিয়ে মেতেছে। কিন্তু সঙ্গে একজন বন্ধু জুটিয়েছে। বিশ্বদেবের চেয়েও বড়োলোক বাবার একমাত্র মেয়ে। সারাদিন তার সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। তার বাড়িতে পড়াশোনা করতে যায়। কিন্তু ফিরে এসে যা বলে তাতে বোঝা যায় পড়াশোনা ওখানে কিছুই হয় না। আড্ডা হয়। ওদিকে বিশ্বদেব রুচির ঘটনার পর ছোটো মেয়েকে নিয়ে ভীষণ ইনসিকিওরড হয়ে পড়েছে। বাড়ি ফিরতে সামান্য দেরি হলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে। সব মিলিয়ে যেটা দাঁড়ায় তা হলো রুচির পড়াশোনা হচ্ছে না।
স্নেহময়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর, ওর পড়াশোনা সম্পর্কে একটা আইডিয়া হওয়ার পর একদিন শ্রী স্নেহময়ের কাছে কথাটা পারল। আমার ভাসুরের মেয়ে, রুশি ডব্লুউ বি সি এসের জন্য চেষ্টা করছে বুঝলে তো স্নেহময়। কিন্তু ঠিক মতো গাইডেন্স পাচ্ছে না। তুমি একটু যদি ওকে গাইড করে দাও খুব ভালো হয়।
স্নেহময় এককথায় রাজি। ঠিক হলো স্নেহময় সপ্তাহে দুদিন করে রুশিকে পড়াবে।
বিশ্বদেব বেশ কদিন ধরেই বুধুর কাছে এই ছেলেটির কথা শুনছিল। ছেলেটি যদি রুশিকে পড়ায় খারাপ কি! ভালো পরিবার, ভালো চাকরি। রুশির তো বিয়ে দিতে হবে। ঘরে বসে ভালো পাত্র পেলে ভালোই তো! রুশি দেখতে ভালো। গায়ের রঙ ফর্সা। চোখগুলো একটু যা ছোটো ছোটো। কিন্তু মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল পিঠ অবধি নেমেছে। সবথেকে বড়ো কথা রুশি আর পাঁচজন মেয়েদের থেকে বেশ খানিকটা লম্বা! ফিগারটাও চোখে লাগার মতো। রুশি জানে যে সে সুন্দরী। ফলে সে বেশ ফিটিংসের ওপর জামা পরে। তাকে দেখে একেবারে তাক লেগে যায়।
রুশি প্রথমদিন পড়তে এলে স্নেহময়ের অবশ্য এসব কিছুই চোখে পড়ল না। রুশির সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলে স্নেহময় বুঝতে পারল মেয়েটি বড়োলোক বাপের অহংকারী মেয়ে। অথচ অহংকার করার মতো কিছুই প্রায় নেই। রুশির নাক উঁচু ভাবটা স্নেহময়ের কাছে লুকনো থাকল না। স্নেহময় ভাবল, রুতুও তো একই বাড়ির মেয়ে। রুতু এর থেকে পড়াশোনায় অনেকটাই এগিয়ে। সেটা ওর সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়। অথচ রুতু কতো হাম্বল! স্নেহময় অনন্তর কাছে শুনে বড়ো ভাইয়ের অবস্থার কথা যা বুঝেছে তাতে দুই ভাইয়ের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে বিষয়টা সে মেলাতে পারল।
শুরু হলো স্নেহময়ের কাছে রুশির পড়াশোনা। কয়েকদিন পড়তে না পড়তেই স্নেহময় বুঝল রুশির দ্বারা বি সি এস হওয়া মুশকিল। রুশি অঙ্ক,বিজ্ঞানে খুবই দুর্বল। ইংরেজিটাও তেমন কিছু ভালো নয়। ফলে প্রচুর খাটতে হবে। কিন্তু এই বিপুল পরিশ্রম কতটা রুশি করতে পারবে সন্দেহ আছে স্নেহময়ের। তবু স্নেহময় যত্ন করে রুশিকে পড়াতে লাগল। বাড়ির কাজ, পড়া ধরা সবই চলতে লাগল। কিন্তু রুশির মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দিল। রুশি অনেকদিন আঁকা শিখেছে। হঠাৎই সে নানা ছবি এঁকে স্নেহময়কে দেখাতে শুরু করল। মাঝে মাঝেই পড়া হয়ে গেলে বুধুর অনুরোধে স্নেহময়কে গান শোনাতে শুরু করল। স্নেহময় প্রশংসা করত সেসবের। ঋতিও ছবি আঁকতে পারে। তার আঁকা দুটো ছবি এ বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো আছে। কিন্তু সেকথা ঋতি কখনো বলেনি স্নেহময়দাকে। আসলে রুশি ভালো ছবি আঁকে বলে বিশ্বদেব রুশির আঁকা ছবিগুলো বাঁধিয়ে রাখে। ঋতিরও শখ হয়েছিল যে তার ছবিও তার বাবা বাঁধিয়ে রাখবে। মাধ্যমিক পরীক্ষার পরের ছুটিতে সে একটা বড়ো ক্যানভাসে ছবি আঁকবে ঠিক করেছিল। কিন্তু তার কাছে জলরঙ, তুলি বা মোমরঙ কিছুই নেই। সেই কোন্ ছোটোবেলায় এক বছরের জন্য তার আঁকা শেখা। ওসব তখনও যে খুব বেশি জুটেছে এমন নয়। রুশির জন্য সবচেয়ে বড়ো মোমরঙের সেটটা এলে ঋতির জন্য আসত সবথেকে ছোটো সেটটা। ঋতি ভালো আঁকতে পারে না এই ছিল যুক্তি। যাই হোক, ঋতি ঠিক করল রঙ, তুলি নাই বা থাকল সে পেন্সিল স্কেচ করবে। দুটো ঘোড়া দৌড়চ্ছে এমন অবস্থায় তাদের মুখের ক্লোজআপ ছবি এঁকেছিল ঋতি। সেটা এতোটাই নিখুঁত হয়েছিল যে অনন্ত পর্যন্ত অবাক হয়ে গেছিল। ছবিটা অনন্ত যত্ন করে বাঁধিয়ে দিয়েছিল। তারপর উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনার চাপে আর ছবি আঁকা হয়নি। কিন্তু পরীক্ষার পর হাতে কিছুটা সময় পেয়ে ঋতি আবার আঁকতে বসেছিল। এঁকেছিল দুটো ঘুমন্ত চোখের স্বপ্ন। এবার কিন্তু ঋতি নিজের টাকায় রঙ তুলি কিনে কালো আর্ট পেপারে ছবিটা এঁকেছিল। সকলেরই ছবিটা ভালো লেগেছিল। ঋতি তাই অনন্তকে বলেছিল, বাবা, এই ছবিটা বাঁধিয়ে দেবে না?
অনন্তর তখন মিল বন্ধ। অনন্ত বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তুমি যা আঁকবে তাই বাঁধিয়ে দিতে হবে না কি!
ঋতি আর কোনো কথা বলেনি। কিন্তু মনে মনে খুব অভিমান করেছিল বাবার ওপর। শ্রী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ছবিটা নিজের টাকায় বাঁধিয়ে নিয়ে এসে দেওয়ালে টাঙিয়ে ছিল। কিন্তু তাতেও ঋতির অভিমান ভাঙানো যায়নি। ঋতি যে আঁকতে পারে নিজের চেষ্টায় সেটাই ঋতি আর কারো কাছে কখনো স্বীকার করেনি।
স্নেহময় একদিন নিজেই আবিষ্কার করে নিয়েছিল ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ঋতির আঁকা ছবি। যারপরনাই অবাক হয়েছিল স্নেহময়। রুতু এতো ভালো ছবি আঁকে। অথচ কোনোদিন বলেনি। রুশি এতো ছবি এঁকে এনে দেখালেও রুতু একেবারে চুপ করে থেকেছে এ ব্যাপারে। স্নেহময় খেয়াল করেছে অনন্ত বা শ্রী কখনো রুতুর প্রশংসায় একটা কথাও বলেনা। রুতু নিজে তো বলেই না। নিজেদের আড়াল করে রেখেই যেন ওরা আরাম পায়। অসম্ভব প্রচার বিমুখ এই মানুষগুলো। রুশি গান শোনালেও রুতুর গলায় গান শোনা হয়নি কখনো স্নেহময়ের।যেন রুতু গান গাইতেই পারে না। স্নেহময় আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। যবে থেকে রুশি পড়তে এসেছে তবে থেকেই যেন রুতু একটু নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে আঁকা, গান এসব ব্যাপারে রুতু একেবারেই মুখ খোলে না। অনন্তও দাদার মেয়েকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজের মেয়ের কথা যেন ভুলেই গেছে। অথচ স্নেহময় কখনো সখনো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শুনেছে রুতু বাড়িতে একা একা গান গাইছে। কোনো জড়তা নেই ওর গলায়। খালি গলায় গান গাইছে কিন্তু মনে হচ্ছে যেন ভেতর অবধি স্পর্শ করছে সেই গান! তবু স্নেহময়কে কোনোদিনই গান শোনায়নি রুতু। নিজেকে এমন করে গুটিয়ে নিচ্ছে কেন রুতু! প্রশ্নটা স্নেহময়ের কাছে অধরাই থেকে যায়।
৫৭
সেদিন বাড়িতে কেউ নেই। অনন্ত গেছে দাদার বাড়ি। শ্রী গেছে বাপের বাড়ি। ঋতি একাই বাড়িতে ছিল। এভাবে একা থাকাটা ওর অভ্যেস হয়ে গেছে।সেই উচ্চ মাধ্যমিকের সময় থেকেই ঋতি সন্ধেবেলা একাই থাকে।সপ্তাহে তিন চারদিন তো এমন ঘটেই থাকে। আজ শুক্রবার। শুক্রবার স্নেহময় অফিস থেকে সোজা বাড়িতে চলে যায়। আবার সোমবার অফিস থেকে ব্যারাকপুরে ফেরে। শুক্রবার এলেই ঋতির মন খারাপ করে। দুদিন স্নেহময়দার সঙ্গে দেখা হবে না। আজও তেমনি একটা দিন। ঋতির মন খারাপ করছিল। কিন্তু সামনেই তার কলেজের ইন্টার্নাল পরীক্ষা। সে তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করছিল।স্নেহময়দাকে ভালো রেজাল্ট করে দেখাতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার এতো একা লাগছে যে মনে হচ্ছে কেউ যদি তাকে একটু বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিত! ঋতি মাধ্যমিকের পর থেকেই এতোটা একা হয়ে গেছিল যে সে মনে মনে একটি কল্পিত চরিত্র তৈরি করে একা একা কথা বলত। ঋতি কল্পনা করত অতনু তাকে ভালোবাসে। অতনু তাকে আদর করে। আর যখন ঋতির খুব মন খারাপ করে বা ঋতি কোনো আঘাত পায়, বা ঋতির বাবা-মার মধ্যে অশান্তি চলে ঋতি কল্পনা করত অতনু তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করছে রুতু! কী হয়েছে! ঋতি তার উত্তরে অঝোরে কাঁদত। অতনু যেন কেমন করে সব বুঝে নিয়ে ঋতিকে নানা কিছু বোঝাত। তারপর ঋতিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে পাগলের মতো আদর করত। ঋতি এতোটাই আবিষ্ট হয়ে পড়ত যে সে নিজেই নিজেকে আদর করতে শুরু করত। তারপর যতক্ষণে প্রচণ্ড কাঁপুনি দিয়ে তার চটক ভাঙত ততক্ষণে অতনু নেই হয়ে গেছে! ঋতির সব কল্পনা ভেঙে গেছে। ঋতি তখন প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করত। প্রত্যেকবার মাস্টার্বেশনের পর ঋতির এই অপরাধবোধ কাজ করে। তার মনে হয় সে এমনই এক গর্হিত কাজ করে ফেলেছে যে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। আর কোয়েনসিডেন্টালি সেদিনই হয়তো অনন্ত আর শ্রীর মধ্যে আরো অশান্তি বাড়ল। ঋতি ক্রমশ নিজেকে দুষতে থাকত তখন। স্নেহময়দা আসার পর থেকে বেশ কয়েকমাস অতনুর কথা মনেও পড়েনি ঋতির। এমনকি এই কল্পনাকে পাগলামি ভেবে ঋতি মনে মনে হেসেছে। কিন্তু আজ হঠাৎই যেন অতনুর কথা মনে পড়ে গেল।ঋতি আসলে পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক হয়ে স্নেহময়ের কথা ভাবছিল। স্নেহময়দা তাকে ভালোবাসে একথা এখন ঋতি বিশ্বাস করে। একদিন যখন স্নেহময়দা তাকে কাছে টেনে নেবে তখন কি হবে ভেবেই ঋতি শিহরিত হচ্ছিল। এই মুহূর্তে ঋতির ভীষণ আদর পেতে ইচ্ছে করছে। সে চোখের সামনে স্নেহময়কে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু চোখ বুজলেই মুখটা হারিয়ে যাচ্ছে। ঋতি চোখ বুজেই স্নেহময়ের কথা আপ্রাণ মনে করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আসছে না। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তার মাথায় অতনু নামটা দেখা দিল আবার।ঋতি আর তখন নিজেকে সামলাতে পারছে না। অতনু নামটার মধ্যেই ডুবে গেল সে। এই মুহূর্তে সে স্নেহময়কে চেনেনা। স্নেহময় বলে তার জীবনে যেন কেউ নেই। অতনু তাকে যেন জড়িয়ে জাপ্টে পাগল করে তুলেছে। সে শিহরিত হচ্ছে। ঘরে আলো জ্বলছে। পাশেই রাস্তা। ওপাশে ধোপাদের বাড়ি থেকে কথার আওয়াজ আসছে। কিন্তু ঋতি কিছুই দেখছে না, ভাবছে না, শুনছে না। ঋতির সারা শরীর ভারি হয়ে উঠেছে। নিজেকে যেন সে বইতে পারছে না আর। বিছানায় শুয়ে নিজেকে পুরোপুরি অতনুর হাতে সমর্পণ করে দিলেই যেন সে শান্ত হতে পারে।
অনেকক্ষণ পর ঋতির যখন হুঁস ফিরল সে দেখল সে প্রায় নগ্ন। জানলার পর্দাগুলো অল্প অল্প হাওয়ায় দুলছে। মুহূর্তের মধ্যে ঋতি নিজেকে গুছিয়ে নিল। তার মন এখন শান্ত। অনেকগুলো দিন পর সে যেন তার আকাঙ্ক্ষাকে ছুঁয়ে এলো। কিন্তু আবারও তার মনখারাপ করছে। এই অপরাধের শাস্তি তাকে পেতেই হবে। কি জানি কি হয়! এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠল। ঋতি অবাক হলো। বাবা মা কারোরই এতো তাড়াতাড়ি ফেরার কথা নয়। কে এলো এখন? ঋতি একটু সময় নিয়ে আইহোল দিয়ে দেখল স্নেহময় দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলেছে সে। একইসঙ্গে যারপরনাই অবাক ও আনন্দিত সে। তুমি? বাড়ি যাওনি?
না রে আগামীকাল স্পেশাল ট্রেনিং আছে।
ওমা! কাল বলোনি তো! আমি ভাবছি তুমি বাড়ি চলে গেছ।
তুই জানতিস না। আমি কাকিমাকে কাল বলেছিলাম তো!
ঋতি অবাক হয়ে বলল, না তো! মা তো কিছু বলেনি!
যাই হোক ঋতি বলল, দাঁড়াও চা করি।
স্নেহময় রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছে, কাকু কাকিমা নেই রে?
না গো। বাবা জ্যেঠুর বাড়ি। মা দাদুর বাড়ি।
ও। তুই কী করছিলি?
ঋতি একটু গলা নামিয়ে বলল, ওই পড়ছিলাম।
এমা! আমি বিরক্ত করলাম তো!
আরে না না!
চা হয়ে যেতে ওরা গুছিয়ে বসল। ঋতি কথা বলে চলেছে। স্নেহময়দার সামনে ঋতির কথা যেন ফুরোয় না। তারওপর আবার ঋতি আজ বাড়িতে একা। একটু আগের মন খারাপ এখন উধাও হয়ে গেছে। কিন্তু ঋতি খেয়াল করল আজ যেন স্নেহময়দা একটু অন্যমনস্ক। যেন তাকিয়ে আছে ঋতির দিকে অথচ দৃষ্টি অনেক দূরের। ঋতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। স্নেহময়দার যে মন খারাপ ঋতির বুঝতে সময় লাগল না। ঋতি জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে স্নেহময়দা? তোমার মন খারাপ?
কই! না তো।
আজ বাড়ি ফিরতে পারনি বলে মন কেমন করছে?
স্নেহময় হালকা হেসে বলল, না রে।
ঋতি আর কিছু বলল না।
ঋতির কথার বেগ যেন ঝপ করে কমে গেল। দেখল স্নেহময় আর তার মুখের দিকে দেখছে না। মাথা নিচু করে বসে আছে।
ঋতি এবার চুপ করে গেল। প্রথমে খানিকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে শেষে স্নেহময়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। স্নেহময় আস্তে করে ঋতির হাতটা দুহাতে ধরে বলল, রুতু, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। তোকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। অনেক বড়ো হতে হবে। তারপর ঋতির দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল।
ঋতি এই হাসির মানে বুঝল না। স্নেহময়দার কেন মন খারাপ তারও কোনো তল সে খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু স্নেহময়দা তাকে ভালো রেজাল্ট করতে বলছে, বড়ো হতে বলছে এটা ঋতির মাথায় গেঁথে গেল। স্নেহময় তখনও ঋতির হাতটা ধরে রেখেছে। এমন সয়য় আবার বেল বেজে উঠল। শ্রী ফিরেছে। স্নেহময়কে এ বাড়িতে দেখে শ্রী একবার ঋতির দিকে তাকাল। তারপর ঘরে চলে গেল।
ঋতি বুঝল মা বিরক্ত হয়েছে। স্নেহময়দা আর আমি একা একা ছিলাম। তাই হয়তো মা… কিন্তু মা যে স্নেহময়দাকে এতো ভালোবাসে! তবে!
স্নেহময় বলল, রুতু, আমি আসি রে।
ঋতি মায়ের ভয়ে স্নেহময়কে আর বসতে বলতে পারল না। স্নেহময় দরজা অবধি এগিয়ে গিয়ে আবার ঋতির দিকে পিছন ফিরে তাকানোতে ঋতি শুধু গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারল, কিছু বলবে স্নেহময়দা?
স্নেহময়ের বুক থেকে একটা ছোটো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মুখে বলল, নাহ্।
স্নেহময় চলে যেতেই ঋতি ঘরে মায়ের কাছে গেছে। শ্রীর মুখটা থমথম করছে। বলল, ও কখন এসেছে?
এই তো একটু আগে।
আমি আর তোমার বাবা নেই তুমি বলোনি।
স্নেহময়দাই তো জিজ্ঞেস করল।
তারপরও একা বাড়িতে তুমি ওর সঙ্গে বসে গল্প করছিলে! পরে আসতে বলতে পারনি!
ঋতি তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। তার মুখটা ছোটো হয়ে গেছে। সে জানে আজ একটা খারাপ পরিস্থিতি হতে চলেছে। তাকে আজ শাস্তি পেতেই হবে।
ঋতি, তোমার সামনে পরীক্ষা। দিনের পর দিন তুমি ওই ছেলেটার সঙ্গে গোটা সন্ধেটা বসে গল্প করো। অফিস থেকে ফিরে ওর কোনো কাজ না থাকতেই পারে। ও আড্ডা মারতে এখানে চলে আসতেই পারে। তাই বলে তুমি কেন তোমার সময়টা নষ্ট করছ?
মা আমি তো লাইব্রেরিতে বসে পড়ি।
ও, ওই পড়াটাই তাহলে যথেষ্ট! একে বাংলা নিয়ে পড়ছ! চাকরি -বাকরি কি পাবে না পাবে সে তুমিই জানো! তারওপর যদি রেজাল্টও খারাপ হয়! সারাজীবনে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে না।
মা আমি তো পড়ছিলাম। স্নেহময়দা আধঘণ্টাও থাকেনি।
তোমার সঙ্গে ওর এতো কিসের গল্প ঋতি? আমাদের টাকা পয়সা নেই। কিন্তু সম্মানটুকু আছে। সেটাও নষ্ট করতে চাইছ তুমি! দিদিভাইকে দেখেও তোমার শিক্ষা হয়নি!
ঋতি আর কথা বাড়ালো না। সে জানে সে এমন কিছুই করেনি যে তাকে এসব কথা শুনতে হবে। আর দিদিভাইয়ের বর তো লেখাপড়াই করেনি। তাও দিদিভাইয়ের তাকেই পছন্দ হলো। স্নেহময়দা কত শিক্ষিত। দিদিভাইয়ের বরের মতো লোফার নয়।
মার বকুনি খেয়ে তাই ঋতির মন খারাপ হলোনা। সে জানে তার রেফারেন্স বই দেখা আপাতত কমপ্লিট। সমস্ত নোটস সে পয়েন্ট আউট করে রেখেছে। ফলে পড়া তার মোটামুটি রেডি আছে। এখন রিভিশন চলছে। তাই এসব নিয়ে মায়ের চিন্তা অমূলক। মা সেটা নিজেও জানে। আসলে স্নেহময়দার এ বাড়িতে আসাটা বাবা ঠিক পছন্দ করছে না। ঋতি শুনেছে ভিতরের ঘর থেকে, বাবা মাকে বলছে ছেলেটা এলেই ঋতি কেমন ওর কোলের কাছে গিয়ে বসে খেয়াল করেছ! সারাটা সন্ধে ওর সঙ্গে কথা বলে চলেছে। আমি বাইরের ঘরে থাকলেও ও ঠিক ভিতরে ঋতির সঙ্গে কথা বলতে চলে যায়! এতো সাহস পায় কোথা থেকে! তোমার মেয়েই ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। একসঙ্গে ট্রেনে যাচ্ছে, আসছে। রোজ লাইব্রেরিতে কাজ থাকে! আমাকে বোকা পেয়েছে! সেদিন দেখলে, ভিড় ট্রেনে এসেছে বলে মাইনের খামটা কেমন বের করে দেখালো আমাদের! ওখানেই ও ওর জাতটার পরিচয় দিয়ে দিয়েছে। এসব শুনে ঋতির খুব মন খারাপ হয়েছিল। সে আর স্নেহময় তো কোনো দোষ করেনি। ভালোবাসাটা কি অন্যায়!
তবে এই বিষয়ের থেকেও অন্য একটি বিষয় ঋতিকে বেশি ভাবাচ্ছে। স্নেহময়দার আজ মন খারাপ ছিল। বেশি কথা বলছিল না। তবু ঋতির বারবার মনে হয়েছে স্নেহময়দা যেন ঋতিকে কিছু বলতে চায়! সে খুব আনন্দের কথা নয় হয়তো! হয়তো কোনো দুঃখের কথা; কোনো গোপন যন্ত্রণার কথা! স্নেহময়দাকে দেখে ঋতির বারবার মনে হচ্ছিল স্নেহময়দার মাথাটা নিজের কোলের মধ্যে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে! এটুকু স্পর্শেই যেন স্নেহময়দা কেঁদে উঠবে! ওর ভিতরে যেন গভীর কোনো আঘাত ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ঋতির খুব আফসোস হচ্ছিল, মা ওই সময় না এলে স্নেহময়দা হয়তো কিছু বলত! হয়তো যে কথা এই কয়েক মাসে মনে মনে ঘনিয়ে উঠেছে তা আরো স্পষ্ট হতো। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। স্নেহময়দা সব কথা বুকের মধ্যে চেপে রেখেই চলে গেল। ঋতির মনে হলো এখুনি একবার যদি স্নেহময়দার কাছে যেতে পারত সে!
৫৮
ছ’মাস কোথা দিয়ে যে কেটে গেল ঋতি টের পেল না। এর মধ্যে ইন্টার্নাল পরীক্ষায় ঋতি ওদের ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হয়েছে। ফলে অনন্ত আর শ্রীর ঋতিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা আরো খানিকটা তরান্বিত হয়েছে। স্নেহময় খুব খুশি ঋতির রেজাল্ট দেখে। রেজাল্ট বেরোনোর পর থেকে ঋতির দায়িত্ব যেন আরো বেড়ে গেছে। মন দিয়ে পড়াশোনা করে তাকে শিক্ষকতার চাকরি পেতে হবে। ঋতির খুব ইচ্ছে যদি ব্যারাকপুর গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষক হিসেবে সে যোগ দিতে পারে! সবাইকে সে দেখিয়ে দেবে! যারা তাকে তুচ্ছ ভেবেছে, অপমান করেছে, গায়ের রঙ, অসৌন্দর্য নিয়ে খোঁটা দিয়েছে তাদের! সেও পারে। কিন্তু এসব ভাবনার মধ্যে স্নেহময়ের ট্রান্সফারের অর্ডার এলো। ওকে চলে যেতে হবে আলিপুরদুয়ার। স্নেহময়ের ছোটোবেলাটা কেটেছে জলপাইগুড়িতে। উত্তরবঙ্গকে সে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সেখানে যেতে হবে বলে স্নেহময় একরকম স্বস্তিই পেয়েছে। ট্রান্সফার তাদের চাকরির বৈশিষ্ট্য। এই নিয়ে মনখারাপ করে লাভ নেই। তবু যাওয়ার আগে থেকেই শ্রীর বাড়িতে যেন বিষাদের ছায়া নেমে এলো। ইতিমধ্যে একদিন বিশ্বদেব স্নেহময় আর ঋতিকে ডেকে খাওয়ালো। বিশ্বদেব পিয়ারলেসে নানারকম লোকজনের সঙ্গে মিশেছে। ইয়ং ছেলে সকলকেই তার নিজের গ্রুপের সাবর্ডিনেট মনে হয়। স্নেহময়কেও সে ভাই বলে সম্বোধন করে বসল। স্নেহময় একবার ঋতির দিকে তাকিয়ে নিল। মাধুরী বেশ যত্ন করে খাওয়ালো স্নেহময়কে। ফেরার সময় ঋতি আর স্নেহময় একসঙ্গেই হেঁটে ফিরল। রাত তখন প্রায় এগারোটা বাজছে। রাস্তাঘাট শুনশান। কিন্তু তা নিয়ে স্নেহময়ের কোনো জড়তা নেই। ঋতির ভয় ভয় করছে! কিন্তু ভালোও লাগছে! স্নেহময়দা চলে যাবে। তবে সেটা এই মুহূর্তে ঋতিকে কোনো কষ্ট দিচ্ছে না। ঋতি যেন কেমন করে বুঝেছে স্নেহময়দার সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে। আর তারপর… তারপরের কথা ভাবতে গেলেই ঋতির বুক থেকে একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস বেরিয়ে আসে! ঋতি যেন জানে সব কিছু। তার ভবিষ্যৎ যেন তার চোখের সামনে! কোনো কুয়াশা নেই সেখানে। ঋতি এম এ পড়বে। তারপর গুছিয়ে সংসার করবে স্নেহময়ের সঙ্গে। স্নেহময়ের পছন্দের খাবারগুলো সব স্নেহময়ের মায়ের কাছ থেকে শিখে নিয়ে রান্না করে খাওয়াবে। স্নেহময় অফিসে চলে গেলে সারাদিন কাজকম্ম সেরে নিয়ে একটা বই হাতে বারান্দায় বসবে স্নেহময়ের অপেক্ষায়। তারপর ও বাড়ি ফিরলে হাসি হাসি মুখে দরজা খুলে দেবে! আরে তাহলে ঋতির চাকরি করার কী হবে! তাই তো! ঋতি তো শিক্ষক হতে চায়! তাহলে! ঋতি চিন্তায় পড়ে যায়! তারপর অনেক ভেবে সে বোঝে, স্নেহময়ের সঙ্গে মন দিয়ে সংসারটা করতেই সে বেশি ভালোবাসবে! স্নেহময় হাসি হাসি মুখে এতো এতো বাজার করে আনবে! আর ঋতি সেসব দেখে বেজায় রাগের ভান করবে! স্নেহময় তখন লজ্জা লজ্জা মুখে মাথা চুলকোবে। আর ঋতি বাজারগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে রাঁধতে বসবে! এরকম দৃশ্য নিজের বাড়িতে ঋতি কোনোদিন দেখেনি। বাবা বাজার করে কেমন রাগ দেখিয়ে মাছের প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলত বেসিনে! মাকে বলত, এনাও, তোমার বেশি করে মাছ এনে দিয়েছি! সব জিনিসের খুব দাম! তাই বাবা রাগ দেখাতো মায়ের ওপর, তার ওপর! আর তিনদিনের বাজারে সারা সপ্তাহ চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিত। মা যে কি করে শনিবার পর্যন্ত খাবার মুখে তুলে দিত সেটাই আশ্চর্য! স্নেহময়ের বাড়িতে এমনটা হয় না। স্নেহময় গল্প করে, ওর বাবা বেশি বেশি বাজার করে আনে। আর মা রেগে যায়! শুনে ঋতি অবাক হয়। স্নেহময়ের বাড়িটাকে মনে হয় সব পেয়েছির দেশ!
যেদিন চলে গেল স্নেহময় সেদিন এ বাড়িতে শ্রী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ভাই চলে যাওয়ার পর এই ছেলেটিকে সে এতো আপন করে নিয়েছিল! ছেলেটিও ভীষণ আদর কাড়া! শ্রী ওর চলে যাওয়াটা যেন মেনে নিতে পারছিল না। ঋতি কাঁদেনি। ঋতির আনন্দ হচ্ছিল বরং। এই চলে যাওয়া সাময়িক। আরো নিবিড় করে পাওয়ার জন্যই এই সামান্য বিচ্ছেদ। এইসব ভাবছিল ঋতি। আগের দিন সন্ধেবেলা তাদের বাড়িতে একটা ছোট্টো গানের আসর বসেছিল। অনন্ত, রুশি সবাই গান গাইছিল। ঋতিও গাইল। বাবার কাছে শেখা একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত – ‘আমার পরাণ যাহা চায়’। গানের প্রথম দুলাইন তার মাথার মধ্যে কেবল খেলা করছে। বাকি গানের কথাগুলো সে যেন বুঝতেই পারছে না। সেসব নিয়ে মাথাও ঘামাচ্ছে না। প্রথম দু লাইনেই তার সমস্ত সমর্পণ যেন লুটিয়ে পড়ছে। গানটা শেষ হতেই স্নেহময় বলে উঠল, তুই গানটা কর রুতু! তোর কিন্তু হবে! ঋতির কানে সেকথা ঢুকল কি না বোঝা গেল না। ঋতি তাকিয়ে আছে স্নেহময়দার চোখের দিকে। মনে হচ্ছে এই গানের পরেই স্নেহময়দার হাতের আঙুলটা যদি একবার ছোঁয়া যেত। কিন্তু সে তো সম্ভব নয়! তাই ঋতি তাকিয়ে আছে স্নেহময়দার চোখের দিকে সরাসরি। চোখ দিয়ে ছুঁয়ে নিচ্ছে স্নেহময়দার ঈষৎ লালচে অদ্ভুত মায়াভরা চোখ! ঝিরঝিরে পলক! স্নেহময় কথা বলতে বলতে ঋতির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে মাথাটা নামিয়ে নিল। ঋতিও অন্যদিকে তাকিয়ে দেখলো বাবা তাদের দেখছে। ঋতি সংকুচিত হয়ে উঠে গেল ওখান থেকে। ঋতিদের ফ্ল্যাটবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় স্নেহময়ের চোখ ছলছল করছিল। স্নেহময় চলে গেল। বলে গেল আসছি।
একটু পরে শ্রী বাপের বাড়িতে গেল। অনন্তও নেই। ঋতির চারপাশটা হঠাৎই কেমন খালি হয়ে গেল। ঋতি বারান্দা থেকে দেখল স্নেহময়ের ঘরের দরজা বন্ধ। বারান্দাটা ফাঁকা। একটা শালিক পাখি বারান্দায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। আকাশের বুকে যেন জল জমে কালো হয়ে উঠেছে। ঝমঝমিয়ে নামল বলে। সব যেন মুছে যাবে এমন বিষাদ নামবে! ঋতি আকাশের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল! একফোঁটা দুফোঁটা ঝরতে আরম্ভ করল। আকাশ ভেঙে বিষাদজল ভিজিয়ে দিচ্ছে ঋতির ছোট্ট বুক। সমস্ত আকাঙ্ক্ষা ভিজে মাটির মতো গলে যাচ্ছে। ঘোলাটে স্রোতে ঋতির সমস্ত চেতনা যেন লোপ পেয়ে যাবে। এখনই একবার স্নেহময়দার সামনে দাঁড়াতে না পারলে ঋতি মরে যাবে। কিন্তু স্নেহময় কোথায়! সে তো কতদূর চলে গেছে! আরো আরো দূরে চলে যাচ্ছে! স্নেহময় তো নেই! কোত্থাও নেই! কোনোদিন ছিল! ঋতি স্বপ্ন দেখছিল না তো! ভয় করছে তার! ভীষণ ভয় করছে! নিবিড় করে পাওয়ার জন্য এই যে বিচ্ছেদ এর মেয়াদ কতদিন! যদি মেয়াদ না ফুরোয়! যদি সময় শেষ হয়ে যায় তবুও দেখা না হয়! ঋতি কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার ভেতরে সে আর যেন কোনো আশা খুঁজে পাচ্ছে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে এই শেষ দেখা! ঋতি কাঁদছে। তাদের স্যাঁতসেঁতে ড্যাম্পঅলা ছককাটা মেঝেতে পড়ে ঋতি কাঁদছে!
৫৯
ঋতির সমস্ত আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে স্নেহময় পরের সপ্তাহেই এলো। ঋতি স্নেহময়দাকে দেখে এতো অবাক হয়েছে যে হাসতেও পারছেনা। বিশ্বদেব যোগাযোগ করেছিল স্নেহময়ের সঙ্গে। স্নেহময় যতদিন না আলিপুরদুয়ারে চলে যাচ্ছে সপ্তাহে একদিন করে এসে যেন রুশিকে পড়ায়। স্নেহময় রাজি হয়েছে। ট্রেন থেকে নেমে বিশ্বদেবের বাড়িতে গিয়ে রুশিকে পড়িয়ে তারপর সোজা চলে এসেছে ঋতির কাছে। রুশিও সঙ্গে এসেছে। ঋতির চোখে আরেকটু হলেই জল এসে যেত। কোনোরকমে সামলালো ঋতি। হাসি, আড্ডায় তাদের ঘুপচি ফ্ল্যাট একেবারে গমগম করে উঠল। বাইরে অল্প বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মা বাড়িতে পেঁয়াজি ভাজছে স্নেহময়দার জন্য। বাবাও খুশি। ঋতির মনে হচ্ছিল সে বোকার মতো এ’কদিন মনমরা হয়ে ঘুরছিল। স্নেহময়দা তো তাকে বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে যে স্নেহময়দা তার জন্যই এ বাড়িতে আসছে। তাকে একবারটি দেখার জন্য। কথা বলে কিছু বোঝানোর মানুষ তো সে নয়। এভাবেই বুঝে নিতে হবে তার কথা! ঋতি সব বুঝেছে স্নেহময়দা! আর সে ভয় পাবে না। অজানা আশঙ্কায় ভুগবে না। ভালোবাসবে তোমাকে! পাগলের মতো ভালোবাসবে। ফেরার সময় দেখা গেল রুশি ছাতা আনেনি। স্নেহময়ের ছাতাই তার ভরসা। ঋতিদের বাড়িতে একটাই ছাতা। সেটা দেওয়া সম্ভব নয়। আর রুশিও একেবারেই সেটা নিতে চাইছে না। স্নেহময়দার সঙ্গে এক ছাতায় দুজনেই অর্ধেক ভিজতে ভিজতে চলে গেল। ঋতি দাঁড়িয়ে দেখছিল ওদের চলে যাওয়া। দৃশ্যটা তার মনে একটা ছবি এঁকে দিল। অন্ধকার ঘরে বসে বারবার দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগল। ঠিক কি কারণে আবারো ঋতির মনখারাপ করছে ঋতি বুঝতে পারছে না। কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত মনখারাপ! একে কি মনখারাপ বলে! না কি অভিমান! ঋতি জানে না। কিন্তু অভিমানই বা কেন! সেও ঋতি ঠিক বুঝতে পারছে না। এক সপ্তাহ ঋতি প্রায় ছটফট করে কাটালো। মনে হচ্ছিল পরের বুধবার কবে আসবে! কবে আবার স্নেহময়দাকে দেখতে পাব! মঙ্গলবার অবধি কোনোরকমে কাটিয়ে দিলেও বুধবার আর কাটতে চাইছে না। ঋতি কলেজে গিয়ে আগেই সামনের ফোনের বুথে ঢুকল। নাম্বার ডায়াল করে এক্সটেনশন পেরিয়ে স্নেহময়দার গলার স্বর। ঋতি আর কথা বলতে পারছে না। কোনোরকমে হ্যালো বলতেই ওপাশে স্নেহময় চিনতে পেরেছে রুতুর গলার স্বর।
হ্যাঁ, বল?
ঋতি কোনোরকমে বলে, আজ আসবে তো? তার গলা কেঁপে যায়।
হ্যাঁ, আসবো তো।
আচ্ছা।
ঋতি আর কোনো কথা বলে না। সময়ও শেষ। আবার কথা বলতে হলে আরো একটাকা লাগবে। ঋতির কাছে নেই। ঋতি তাই ওটুকু শুনেই ফোন রেখে দেয়। কিন্তু এই কথাটুকুর আনন্দ ঋতি নিতে পারে না। স্নেহময়দা যেন কত কাছে ছিল। ঋতির কানে ঠোঁট লাগিয়ে স্নেহময়দা বলল, আসবো তো! ঋতির কানে বাজছে স্নেহময়দার কণ্ঠস্বর। এই নৈকট্য এই প্রথম। ঋতি কলেজে ক্লাস করতে করতে দেখল তার জ্বর এসেছে। আজ আর লাইব্রেরি যাওয়া হলো না। ঋতি বাড়ি ফিরে এলো। আজও বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। জোলো হাওয়ায় ঘরের পর্দা উড়ছে। ঋতি কোনোরকমে একটা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। তার মনে হচ্ছে কখন সন্ধে হবে!
স্নেহময় ঢুকেই ঋতির খোঁজ করেছে। ঋতি ঘরে শুয়ে আছে শুনে যারপরনাই অবাক হয়ে ঘরে ঢুকে এসেছে। ঋতি হাত বের করে রেখেছিল চাদরের বাইরে। স্নেহময় এসেই ঋতির আঙুলে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে আদর করে বলছে, কি রে রুতু! দুপুরেও তো ভালো ছিলি!
রুশি পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছে স্নেহময় আর ঋতিকে। স্নেহময় খেয়ালও করছে না। রুতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর কথা বলছে। ঋতি রুশিকে দেখতে পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসেছে। রুশির মুখটা কঠিন হয়ে আছে। কিন্তু পলক ফেলতেই রুশি হেসে হালকা করে নিচ্ছে পরিবেশটা। ঋতির ভয় ভয় করছে রুশিদিদি আবার সবাইকে বলে দেবে না তো! স্নেহময়ের এসব চিন্তাই নেই। স্নেহময় কথা বলে চলেছে। রুতু, কাকু, কাকিমা সবার সঙ্গে তার অনেক কথা আছে।
কিন্তু সময় যে কিভাবে শেষ হয়ে যায় তা কি আর কেউ বলতে পারে। এই আছে, এই নেই। স্নেহময়ের সময়ও ফুরিয়ে এলো। দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল। স্নেহময় আলিপুরদুয়ার চলে গেল। বলে গেল আসবে। ঋতির স্নেহময়ের প্রতি ভরসা, বিশ্বাস অনেকটাই বেড়েছে। ঋতি জানে স্নেহময়দা আসবেই। ঋতি পড়াশোনায় মন দিল।
স্নেহময় আবার এলো পুজোর পর; দ্বাদশীর দিন। আজ আর সে রুশিকে পড়াতে যায়নি। সকালবেলা সোজাসুজি ঋতিদের ফ্ল্যাটেই এসেছে। হাতে মিষ্টির বাক্স। ঋতি বাথরুমে স্নান করতে করতে টের পেয়েছে স্নেহময়দা এসেছে। এমনিতেই ঋতি স্নানের সময় গলা খুলে গান গায়। আজ তার আরও বেশি করে গান গাইতে ইচ্ছে করছে। ঋতি গান ধরল, ‘একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন জলে… সহসা কে এলে গো…’ বাথরুম থেকে বেরিয়েই ঋতি তাকালো স্নেহময়ের দিকে। স্নেহময় হাসছে ওকে দেখে। স্নেহময়দার চুল গুলো বড়ো হয়ে গেছে। মাথাটা বড়ো লাগছে। চোখদুটো আরো যেন মায়াময় হয়ে উঠেছে। ঋতি চোখ নামিয়ে নিল। তারপর তো প্রচুর গল্প, হাসি, আনন্দ। এর মাঝেই বিশ্বদেব ও বিজয়দেব এসে হাজির। স্নেহময় যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের প্রণাম করল। বিশ্বদেব স্নেহময়ের সঙ্গে প্রায় কথাই বলল না। ঋতি কিন্তু এতো কিছু লক্ষ করছে না। শুধু স্নেহময়দার অস্বস্তিটা টের পাচ্ছে। জ্যেঠু আর ছোটোকাকুর সামনে ঋতি নিজেও খুব একটা স্বাভাবিক থাকতে পারে না। ওর মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। একটু চুপচাপ, সংকুচিত হয়ে থাকে। যাই হোক, ওরা চলে যাওয়ার পর স্নেহময় স্নানে গেল। আর ঠিক তখনই ঋতি টের পেল স্নেহময়ের গায়ের অদ্ভুত মাদকতাভরা একটি গন্ধ। স্নেহময় অল্প ঘেমে গেছিল। তারই এমন অদ্ভুত গন্ধ! এর আগে স্নেহময়দার পারফিউমের গন্ধ অনেকবারই ঋতি পেয়েছে! কিন্তু তাতে এমন ঘোরলাগা অবশ আবেশ ছিল না। ঋতির মনে হচ্ছে এখনই যদি স্নেহময়দার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যেত! আঁকড়ে জাপ্টে জড়িয়ে নেওয়া যেত। ঋতির মুখে লাল আভা খেলা করছে! ঋতি লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু শিরশিরে একটা ভাবনাকে মন থেকে সরাতে পারছে না। বিকেল বিকেল স্নেহময় বেরিয়ে পড়ল। ঋতি ওকে গলির মুখটা অবধি এগিয়ে দিয়ে এলো। স্নেহময় একটু করে এগোয় আর বলে আমি আবার সামনের মাসে এলেই দেখা করে যাব। ঋতি করুণ মুখে তাকিয়ে আছে স্নেহময়ের দিকে। স্নেহময় আবার একটু এগিয়ে বলল, আমি এলে তুই ঠিক জানতে পারবি। আমি আসব। ঋতি তাকিয়েই আছে স্নেহময়ের দিকে। স্নেহময় আবার এক পা এগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আসব। ঋতি এবার হাতটা নাড়ল ওর দিকে তাকিয়ে। স্নেহময়ও হাত নাড়ছে। এগোতে এগোতে যতদূর দেখা যায় স্নেহময় হাত নাড়ছে। ঋতির মনে হচ্ছে স্নেহময়দাকে জোরে ডেকে উঠে ওর কাছে দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। শুধু একটাই কথা ঋতির বারবার মনে হচ্ছে, স্নেহময়দা, তুমি আমাকে ভুলে যাবে না তো! আমি তবে মরে যাব স্নেহময়দা! আমি আর বাঁচবো না। কিন্তু ঋতির পা সরছে না। পা দুটো যেন আটকে গেছে। স্নেহময় এগিয়ে গেছে অনেকটা। ঋতির তো স্নেহময়দাকে কিছু বলাই হলো না! ঋতির ছোট্ট বুকটা ক্রমশ পাথরের মতো ভারি হয়ে উঠছে। দমবন্ধ লাগছে ঋতির। মনে হচ্ছে এই আকাশ বাতাস এই শেষ বিকেলের রাঙা আলোকে শুনিয়ে সে চিৎকার করে বলে, স্নেহময়দা, আমি তোমাকে ভালোবাসি! সমস্ত বিশ্বময় একথা ছড়িয়ে যাক। ধ্বনি, প্রতিধ্বনি হয়ে সমস্ত গাছেদের পাতায় পাতায় হিল্লোল তুলুক এই একটি কথা। ঋতির জীবনের সবচেয়ে গোপন অথচ সবচেয়ে সত্য যে কথা! ঋতি অনেকক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। তার যেন মনে হচ্ছে স্নেহময়দা বারবার ঘুরে ঘুরে বলছে, আমি আসব। আমি আসব। ঋতি ওই মুহূর্ত, ওই দৃশ্য ছেড়ে কোথাও আর কখনো যেতে পারবে না। ঋতি এখানে এভাবেই স্নেহময়দার জন্য অপেক্ষা করবে।
৬০
দেখতে দেখতে নতুন বছর এসে পড়ল। অক্টোবরে চলে যাওয়ার পর থেকে স্নেহময় এই দুমাসে আর কোনো যোগাযোগ করেনি। ঋতি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। এই বুঝি বাবা জ্যেঠুর বাড়ি থেকে এসে বলে যে, স্নেহময় ফোন করেছিল। আসবে বলেছে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি এই দু মাসে। ঋতি অপেক্ষা করছে ঠিকই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে একদিন জ্যেঠুর বাড়ির ছাদে বসে রুশির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। স্নেহময়দা নিজের সম্পর্কে খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করে – একথাই রুশি ঋতিকে বোঝাচ্ছিল। ঋতি হাঁ করে শুনছিল। রুশি না কি স্নেহময়দাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন মেয়ে পছন্দ? স্নেহময়দা বলেছে, সেন্সেবেল ও সেন্সেটিভ মানুষ পছন্দ।
আর যদি তেমন না হয়?
তা হলে সেখানে কোনো সম্পর্ক হবে না।
আর তুমি সিদ্ধান্ত নিলেও তোমাকে যদি মেয়েটির পছন্দ না হয়?
স্নেহময় না কি এই প্রশ্নের উত্তরে খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছে। তারপর হেসেছে।
ঋতি এসব শুনে ভাবল স্নেহময়দাকে এসব কথা রুশিদিদি জিজ্ঞেস করেছে! স্নেহময়দা সহজ ভাবে মেশে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে এভাবে জিজ্ঞেস করা কি উচিত!
ঋতি চুপ করে আছে দেখে রুশি বলল, তুই অবশ্য এভাবে কখনো স্নেহময়দাকে নিয়ে ভাবিসনি। দাদা বলেই মনে করেছিস সবসময়। আমার সঙ্গে নানারকম কথা হয়, তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম।
ঋতি এমনিতেই ভিতরে ভিতরে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। স্নেহময়দার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। ওর বাড়ির নম্বরটা ঋতির কাছে আছে। কিন্তু হঠাৎ করে বাড়িতে ফোন করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। স্নেহময়দা বাড়িতে ঋতির কথা আদৌ কিছু বলেছে কি না ঋতি জানে না। যদি বলেও থাকে স্নেহময়দার বাড়ির লোক আদৌ ঋতিকে পছন্দ করেছে কি না তাও জানে না ঋতি। তাই সাহস করে ফোন করতে পারছে না। কিন্তু রুশির মুখে ‘দাদা বলেই ভেবেছিস’ শুনে ঋতি হঠাৎই ভিতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করল। বলে উঠল, কেন, ‘দাদা’ বলেই ভাবতে হবে কেন! ‘দাদা’ ছাড়া অন্য কিছু কি ভাবা অন্যায়?
রুশির মুখে একটা অদ্ভুত হাসি দেখা দিল। ফাঁদে পড়ে যাওয়া বাঘকে দেখে শিকারী যেমন হাসে ঠিক তেমনই মনে হলো ঋতির। ঋতি বুঝল রুশি দিদি বোধহয় কিছু আন্দাজ করেছিল। কনফার্ম হওয়ার জন্যই এসব কথা বলে ঋতির পেট থেকে কথা বার করতে চাইছিল। কিন্তু ঋতি এতে সামান্যও বিচলিত হলো না। একদিন না একদিন তো সবাই জানতে পারবেই। আর স্নেহময়দা যদি তাকে ভালোবেসে থাকে তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদের দুজনকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে না।
বছরের শেষটা এই অদ্ভুত টানাপোড়েনের মধ্যে কাটল। ঋতি জানে, তার স্নেহময়দা তাকে ভালোবাসে। কিন্তু তারপর! তারপরের কোনো কিছু নিয়েই ঋতি সাহস করে আর ভাবতে পারছে না। ভিতর থেকে যেন কিরকম একটা দুশ্চিন্তা ঠেলে উঠছে। কেন যে এতো ভাবনা হচ্ছে তাও ঋতি বুঝতে পারছে না। খাটে বসে বসে ঋতির চোখ পড়ে যায় ছোট্ট ঠাকুরের সিংহাসনটার দিকে। ভিতর থেকে একটা আকুতি বেরিয়ে আসে। ঋতির মনে পড়ে যায় মা দীর্ঘদিন সন্তোষীমার উপোস করত। শুক্রবার নিরামিষ খেত। টক খেত না। তারপর যেদিন ব্রত উদযাপন করল সেদিন পুজো করতে করতে মা খুব কাঁদছিল। তখন সদ্য মামা মারা গেছে। ঋতি ভেবেছিল মা ওই জন্য কাঁদছে। কিন্তু অনন্ত বুঝেছিল শ্রীর মনস্কামনা পূরণ হয়নি। শ্রী আসলে ভাইয়ের জন্য ব্রত করেছিল। অনন্ত পরে ঋতিকে বলেছিল, শালা আমার সংসারে থেকে আমারই খরচায় ভাইয়ের জন্য ব্রত পালন হলো! ভালো রে ভালো! ঋতি অবাক হয়ে দেখছিল বাবাকে। কার জন্য পুজো করল মা, সে নিয়েও বাবার এতো হিংসে। এতো ইনসিকিউরিটি বাবার কেন! মা তো জ্যেঠুর শাড়ির ব্যবসা থেকে উলের সেলাই সবটাই করেছে এই সংসারটার জন্য। ঋতির প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য। বাবা তো একটা প্যাডের প্যাকেটও কোনোদিন ঋতিকে কিনে দেয়নি। অসুখে বিসুখে বাবা ডাক্তার দেখাতে চায় না। ওষুধের দোকান থেকে বলে ওষুধ নিয়ে আসে। বাড়াবাড়ি হলে মাই তো ডাক্তার দেখায়। এই প্রয়োজনগুলোকে বাবা কখনো গুরুত্বই দেয়নি। তারপর মা যদি মামার জন্য পুজো করেই থাকে তাতে আপত্তি কেন! ঋতির বুকটা ভারি হয়ে উঠল। ঋতি সিদ্ধান্ত নিল, এইসব চিন্তা থেকে বেরোতে হবে। পড়াশোনা করতে হবে। স্নেহময়দা ঠিক আসবে। হয়তো কোনো অসুবিধে হয়েছে। তাই স্নেহময়দা যোগাযোগ করতে পারছে না। কিন্তু ঋতি জানে, ঋতি বিশ্বাস করে স্নেহময়দা আসবেই। যাই হোক, ঋতি সিদ্ধান্ত নিল, কাল সকালে উঠে ঋতি লাইব্রেরি চলে যাবে। কাল বছরের প্রথম দিন। পড়াশোনা দিয়ে শুরু করবে বছরটা। এ বছর তার পার্ট ওয়ানের পরীক্ষা। তাকে ফার্স্ট ক্লাস পেতে হবে। কিন্তু পরদিন সকাল দশটায় লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে ঋতি জানল আজ লাইব্রেরি বন্ধ। আজ কল্পতরু উৎসব। বছরের প্রথম দিন। তাই বন্ধ। ঋতির মন খারাপ করছিল। বছরের শুরুটা এমন করে হলো! এ বছরটা তার ভালো যাবে তো!
(ক্রমশ)

