
গ্যাং, গড এবং ফাদার
ভারতীয় সিনেমার ‘অপরাধ’
দিব্যেন্দু মজুমদার
গ্যাং, মাফিয়া, আন্ডারওয়ার্ল্ড—এই তিনটি শব্দ আধুনিক ভারতীয় সিনেমা তথা বিশ্বসিনেমার দর্শকচেতনায় এমনভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে এগুলি এখন একধরনের নান্দনিক উপভোগের বিষয় হয়ে উঠেছে। দর্শক যখন আন্ডারওয়ার্ল্ডের চরিত্র দেখে, মাফিয়া ডনের উত্থান-পতনের গল্প অনুসরণ করে, তখন সে কেবল একটি অপরাধজগতের কাহিনি উপভোগ করছে না, বরং একপ্রকার নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষার, দমনকৃত শক্তির, এবং প্রতিশোধমূলক ন্যায়ের প্রতিচ্ছবি নিজের মনের ভিতরে প্রতিফলিত হতে দেখছে। প্রশ্ন ওঠে—কেন এই সহিংসতা, অপরাধ, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষমতার লড়াই এবং রক্তপাত মানুষের মনকে এতটা টানে? কেন দর্শক মাফিয়া ডনকে ঘৃণা করার বদলে প্রায়শই তার প্রতি এক ধরনের অদ্ভুত সহানুভূতি বা শ্রদ্ধাবোধ অনুভব করে? এই আকর্ষণের পিছনে কেবল বিনোদন বা কৌতূহল কাজ করে না—এর অন্তর্গত একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক এবং সমাজতাত্ত্বিক কাঠামো আছে। মানুষের মনের ভিতরে সহিংসতার প্রতি আকর্ষণ কোনো নতুন বিষয় নয়। ফ্রয়েড তাঁর Civilization and Its Discontents–এ বলেছিলেন, সভ্যতার বিকাশ আসলে মানুষের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তিগুলিকে—বিশেষত আক্রমণ ও ধ্বংসের প্রবৃত্তিকে—দমন করার মধ্য দিয়েই গঠিত হয়। কিন্তু এই দমন কখনও সম্পূর্ণ হয় না; তা মানুষের অবচেতনে জমে থাকে এবং সময়সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মাধ্যমের মাধ্যমে তার মুক্তি ঘটে। সিনেমা, বিশেষত আন্ডারওয়ার্ল্ড বা গ্যাংভিত্তিক সিনেমা, সেই মুক্তির এক নান্দনিক রূপ। দর্শক যখন পর্দায় গ্যাংস্টারের হাতে হত্যা, রক্তপাত বা প্রতিশোধ দেখে, তখন সে নিজের অবচেতনের হিংস্র বাসনাকে এক নিরাপদ পরিসরে উপভোগ করতে পারে—সেই পরিসর যেখানে বাস্তবের আইন নেই, যেখানে নৈতিকতা আপেক্ষিক, এবং যেখানে ক্ষমতার চূড়ান্ত প্রকাশ সম্ভব। এখানেই স্যাডিজমের ধারণা প্রবেশ করে। স্যাডিজম মানে শুধু অন্যকে যন্ত্রণায় ফেলা নয়, বরং অন্যের যন্ত্রণা থেকে আত্মতৃপ্তি পাওয়া। সিনেমায় যখন গ্যাংস্টার তার শত্রুকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে, দর্শক সেই দৃশ্য থেকে ভয় পায়, কিন্তু একইসঙ্গে তীব্র এক রোমাঞ্চ অনুভব করে। কারণ, পর্দায় সে এমন এক কাজকে ঘটতে দেখে, যা তার নিজের জীবনে নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধতার লঙ্ঘনই দর্শকের কাছে এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। সমাজের নিয়ম, নৈতিকতার বদ্ধতা, ন্যায়বিচারের ধীরগতি—এই সবকিছুর বিপরীতে গ্যাং সিনেমা দেখায় তাত্ক্ষণিক বিচার, দ্রুত প্রতিশোধ, এবং একধরনের ‘বীরত্বপূর্ণ’ অপরাধবোধ। ভারতীয় দর্শকের প্রেক্ষাপটে এই আকর্ষণ আরও জটিল। কারণ, ভারতীয় সমাজ দীর্ঘকাল ধরে শ্রেণিবিন্যাস, সামাজিক অন্যায়, রাজনৈতিক দমন, ও দুর্নীতির ভার বহন করেছে। এই সমাজে ন্যায়বিচার প্রায়ই দূরলভ, এবং সাধারণ মানুষ বারবার ক্ষমতাবানদের হাতে শোষিত হয়। গ্যাংস্টার সিনেমায় সে দেখতে পায় এমন এক চরিত্র, যে সেই দমনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে—অবশ্যই তার নিজের স্বার্থে, কিন্তু সেই বিদ্রোহকে দর্শক দেখে প্রতিরোধ হিসেবে। সত্যা, গ্যাংস অব ওয়াসেপুর, কোম্পানি, সরকার, এমনকি ওমকারা—সব ছবিতেই দর্শক এক ‘আউটসাইডার’ নায়কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়, যে সমাজের বাইরে থেকেও সমাজের নিয়ম তৈরি করে। এই আন্ডারওয়ার্ল্ড নায়ক একদিকে আইনভঙ্গকারী, অন্যদিকে নিজের নিয়মের স্রষ্টা—যেন রবিন হুড ও ডন কর্লিওন একসঙ্গে। এই ‘অপরাধী নায়ক’-এর প্রতি আকর্ষণকে জর্জ বাতাই বা মিশেল ফুকোর মতো দার্শনিকরা ব্যাখ্যা করেছেন ক্ষমতা ও দমননীতির দৃষ্টিকোণ থেকে। ফুকো বলেছিলেন, ক্ষমতা সর্বত্র বিদ্যমান, এবং মানুষ তার প্রতিরোধকেও ক্ষমতার অংশ হিসেবে গড়ে তোলে। গ্যাংস্টার সিনেমায় নায়ক সেই প্রতিরোধের প্রতীক—সে রাষ্ট্র, আইন, সমাজ—সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, এবং সেই বিদ্রোহের মধ্যেই তার সত্তার স্বীকৃতি খোঁজে। দর্শক যখন তাকে দেখে, সে একপ্রকার ‘বিকল্প ন্যায়ের’ কল্পনা করে—যেখানে ন্যায়বিচার আদালতের নয়, বন্দুকের নল থেকে আসে। কিন্তু এই আনন্দ শুধুমাত্র প্রতিশোধের নয়, বরং পরিচয়েরও। আধুনিক নগরজীবনে মানুষ ক্রমশ নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। সে রাষ্ট্রের, কর্পোরেটের, পুঁজির, প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে বন্দি। গ্যাংস্টার সিনেমা সেই নিয়ন্ত্রণভঙ্গের প্রতীক। এখানে নায়ক নিজের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক—সে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়, ভুল করে, মরে, কিন্তু নিজের শর্তে বাঁচে। এই আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুভূতিই দর্শককে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। কারণ, বাস্তব জীবনে যে স্বাধীনতা তার নেই, তা পর্দায় সে দেখতে পায় অপরাধীর জীবনে। এই সিনেমাগুলিতে স্যাডিজমের পাশাপাশি একধরনের মেসোকিজমও কাজ করে। দর্শক শুধুমাত্র অন্যের যন্ত্রণায় নয়, নিজের ক্ষয় ও পতনেও আনন্দ পায়। অনেকসময় দর্শক গ্যাংস্টারের ধ্বংসের দৃশ্যেও একধরনের মুক্তি অনুভব করে—যেন সে নিজের অপরাধবোধ থেকে পরিশুদ্ধ হচ্ছে। গডফাদার–এর মাইকেল কর্লিওনের পতন বা সত্যা–র ভিজয় রাজের মৃত্যু, গ্যাংস অব ওয়াসেপুর–এর শ্রীনিবাস বা ফয়জল খান—তাদের মৃত্যু দর্শকের কাছে শাস্তি নয়, বরং পরিণতি—যেন নৈতিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার হচ্ছে। এই মিশ্র অনুভূতি, ভয় ও সহানুভূতির দ্বন্দ্ব, গ্যাং সিনেমাকে বিশেষ এক মানসিক স্তরে তুলে নিয়ে যায়। ভারতীয় দর্শকের আরেকটি প্রবণতা হল হিংসাকে বিনোদনের অংশ হিসেবে দেখা। বলিউড দীর্ঘকাল ধরে হিংসাকে নান্দনিক করে তুলেছে। ধীরগতির গুলি, রক্তের ছিটা, ভাঙা কাচ, উত্তেজনাপূর্ণ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক—সবকিছু একসঙ্গে মিলে ‘অপরাধ’-কে এক দৃশ্যগত আনন্দে রূপ দিয়েছে। এই নান্দনিকীকরণই স্যাডিজমের সাংস্কৃতিক রূপ। দর্শক এখানে সহিংসতার বাস্তবতা নয়, তার রূপক উপভোগ করে। রামগোপাল বর্মার সরকার বা কোম্পানি, অনুরাগ কাশ্যপের গ্যাংস অব ওয়াসেপুর, কিংবা বিশাল ভরদ্বাজের মকবুল—সব চলচ্চিত্রই এই দ্বৈততা ধরে রাখে। এখানে এক বিপজ্জনক পরিবর্তন ঘটে—অপরাধ ও ন্যায়বিচারের সীমারেখা মুছে যায়। দর্শক গ্যাংস্টারের প্রতি এমনভাবে সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে যে সে প্রায়ই রাষ্ট্রের বা সমাজের আইনকে প্রশ্ন করে না। এই জায়গায় সিনেমা দর্শকের নৈতিক চেতনায় পরিবর্তন আনে। সে বুঝতে শেখে, ক্ষমতা অর্জনের জন্য অপরাধ কখনও কখনও প্রয়োজনীয়, এমন ধারণা জন্ম নেয় তার মধ্যে। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এটি বিপজ্জনক, কারণ এটি ধীরে ধীরে নৈতিক উদাসীনতার জন্ম দেয়। তবু এই প্রবণতার ভিতরে একধরনের গভীর মানবিক সত্যও আছে। গ্যাংস্টার সিনেমা দর্শককে তার নিজের অন্ধকারের মুখোমুখি করে। সে নিজের হিংসা, দমন, ক্ষোভ, অন্যায়ের অনুভূতিকে স্বীকার করতে শেখে। এই স্বীকারোক্তিই একধরনের শুদ্ধিকরণ। সম্ভবত এই কারণেই গ্যাং সিনেমা কেবল হিংসা নয়, ট্র্যাজেডিরও গল্প। যেমন, মকবুল–এর বা হায়দার–এর চরিত্ররা নিজেদের অন্তর্গত অন্ধকারে হারিয়ে যায়। দর্শক তাদের সঙ্গে কাঁদে, কারণ সে জানে, এই অন্ধকার তার নিজের মধ্যেও আছে। গ্যাং এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রতি আকর্ষণ তাই কেবল স্যাডিজম নয়, বরং এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনের বহিঃপ্রকাশ। সমাজ যত বেশি নিয়ন্ত্রিত, যত বেশি শৃঙ্খলিত, তত বেশি মানুষ খোঁজে নিয়ন্ত্রণভঙ্গের গল্প। গ্যাং সিনেমা সেই ভঙ্গের কাব্য। দর্শক জানে এটি অপরাধ, কিন্তু তবু সে উপভোগ করে—কারণ এই উপভোগের মধ্যে দিয়ে সে নিজের দমনকৃত আকাঙ্ক্ষার সুরাহা করে। এই উপভোগের পিছনে যে স্যাডিজম কাজ করে, তা একদিকে বিপজ্জনক, অন্যদিকে মানবিক। বিপজ্জনক কারণ তা বাস্তব জীবনে সহিংসতার প্রতি উদাসীনতা তৈরি করে; মানবিক কারণ তা দর্শককে তার নিজের মনের অন্ধকার স্বীকার করতে বাধ্য করে। গ্যাং সিনেমা তাই কেবল অপরাধের গল্প নয়—এটি সভ্যতার দমনের ইতিহাসের পরিপূরক, যেখানে প্রতিবার দর্শক নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করে নিজের অবচেতনের মুক্তি অনুভব করে। এই কারণেই, গ্যাং এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের গল্প কখনও পুরোনো হয় না। সময় বদলায়, চরিত্র বদলায়, কিন্তু দর্শকের ভিতরে যে নিষিদ্ধ আকর্ষণ, হিংসার রোমাঞ্চ, এবং নৈতিকতার সীমা পরীক্ষা করার তাগিদ—তা চিরন্তন। সিনেমা কেবল সেই তাগিদকে এক নিরাপদ, দৃশ্যমান রূপ দেয়, যেখানে অপরাধী নায়ক হয়ে ওঠে আমাদের অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি, এবং দর্শক, তার সৃষ্টিকর্তা ও বিচারক—উভয়ই।
ভারতীয় সিনেমার সাম্প্রতিক দশকে যে এক নতুন ধারার বিস্তার ঘটেছে, তা একধরনের নৈতিক বিকৃতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে দুর্নীতি, সহিংসতা, মাফিয়া সংস্কৃতি ও পুরুষতান্ত্রিক শক্তির উদ্যাপন চলচ্চিত্রের ভাষার কেন্দ্রে চলে এসেছে। একসময় ভারতীয় সিনেমা সমাজের আয়না ছিল, যেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর শোনা যেত, যেখানে নায়ক মানে ছিল ন্যায়ের প্রতীক, আর অন্যায় মানে ছিল এক সামাজিক অন্ধকার। কিন্তু এখন নায়কের গায়ে রক্তের দাগ, হাতে বন্দুক, ঠোঁটে তামাকের ছাপ, চোখে দাম্ভিকতার চাহনি—এই চিত্রই যেন জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। আজকের দর্শক এমন চরিত্রে মুগ্ধ হয় যারা খুন করে, যারা মাদক চক্র চালায়, যারা ক্ষমতার দম্ভে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই পরিবর্তনের নেপথ্যে যেমন সমাজ-রাজনীতির বিকৃতি কাজ করছে, তেমনি চলচ্চিত্র শিল্প নিজেও তার পণ্যমূলক কাঠামোর মধ্যে নৈতিকতাকে বিক্রি করে দিচ্ছে।
এই প্রক্রিয়ার সূত্রপাত খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে নব্বইয়ের দশকের বলিউডে। অমিতাভ বচ্চনের পরবর্তী যুগে যখন নায়কের সংজ্ঞা ভেঙে পড়েছিল, তখন এক নতুন চেহারা দেখা দেয়—খলনায়ক নায়ক। সুবাস ঘাইয়ের খলনায়ক ছবিতে সঞ্জয় দত্তের চরিত্র বলিউডের নায়োকত্বে এক মৌলিক পরিবর্তন আনে। সে অপরাধী, তবু দর্শকের সহানুভূতি পায়, কারণ তার অপরাধ সামাজিক অবিচারের ফল। এই সূত্র পরে আরও পরিশীলিত রূপ নেয় ছবিগুলিতে যেমন সত্যা, কম্পানি, দেওয়ার, দাবাং, গ্যাংস অব ওয়াসেপুর বা সিংহম-এর মতো চলচ্চিত্রে। রামগোপাল ভার্মার সত্যা (১৯৯৮) আসলে ভারতের আন্ডারওয়ার্ল্ড রাজনীতিকে প্রথমবার বাস্তবতার ভাষায় তুলে ধরে। সেখানকার সহিংসতা, টাকার খেলা, অপরাধ আর পুলিশের যোগসাজশ এক শহরের বিবেকহীন জীবনের প্রতিরূপ হয়ে ওঠে। ভার্মা নিজে পরে কম্পানি বা সরকার -এর মতো ছবিতে দেখিয়েছেন কীভাবে রাজনীতি ও মাফিয়া একে অপরের ছায়া। এই ছবিগুলিতে দুর্নীতির ভাষা আর কৌশল এক ধরনের আধুনিক মিথে পরিণত হয়, যেখানে নায়ক ও খলনায়কের ভেদরেখা মুছে যায়।
দক্ষিণ ভারতের সিনেমা এই ভাষাকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। তামিল ছবিতে যেমন কাবালি বা কালা-তে রজনীকান্ত একদিকে শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি, অন্যদিকে সে নিজেই এক মাফিয়া সম্রাট। তার ন্যায়বোধ আর অপরাধবোধ মিশে যায় এক অনিশ্চিত চেতনায়, যেখানে শক্তিই একমাত্র সত্য। এই ছবিগুলিতে পরিচালক পাও রঞ্জিথ যেমন বর্ণবৈষম্য ও শ্রেণীসংগ্রামের ইঙ্গিত রেখেছেন, তবু ছবির বাণিজ্যিক গঠন সেটিকে শেষ পর্যন্ত নায়কতন্ত্র ও সহিংসতার গ্ল্যামারে ঢেকে ফেলে। অনুরূপভাবে ভিক্রম, ভিক্রম ভেধা, কাইথি, লোকেশ কানাগারাজ-এর পরিচালিত লিও—এই সমস্ত ছবিতে অপরাধ, হত্যা ও রক্তপাত এতটাই নান্দনিকভাবে সাজানো হয় যে তা একপ্রকার ভোগ্যবস্তু হয়ে ওঠে। দর্শক রক্তে মোড়া দৃশ্য দেখে তৃপ্ত হয়, যেন সমাজের অবদমিত হিংসাকে সিনেমা এক নিরাপদ মুক্তি দেয়। এই মাফিয়া-গ্ল্যামার আসলে আধুনিক পুঁজিবাদী সংস্কৃতির অনিবার্য ফসল, যেখানে অপরাধ আর ক্ষমতার মধ্যে কোনও নৈতিক পার্থক্য নেই।
মলয়ালম সিনেমা একসময় সমাজবোধ ও বাস্তবতার জন্য পরিচিত ছিল। আদুর গোপালকৃষ্ণণ বা শাজি এন করুণের ছবিতে মানুষের বেদনা, কৃষকের দুঃখ, সমাজের অন্যায়ের মুখ দেখা যেত। কিন্তু ২০১০-এর পরের মলয়ালম সিনেমায়ও ধীরে ধীরে এসেছে অপরাধের রোমান্স। বিগ বি, লুসিফার, এম্পুরান, আয়ালুম নজনুম থাম্মিল—এইসব ছবিতে মোহনলাল, মম্মুটি বা প্রিথ্বীরাজের মতো নায়কেরা একদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের বিরোধিতা করেন, কিন্তু অন্যদিকে নিজেরাই সেই দুর্নীতির নতুন রূপে পরিণত হন। নায়ক হয়ে ওঠে দেবতা, তার আইনই সত্য, তার বন্দুকই ন্যায়বিচার। দর্শক তাতে নৈতিক সংকট না পেয়ে এক ধরনের পৌরুষবোধের সন্তুষ্টি খোঁজে। ফলে সমাজে এক অদৃশ্য বার্তা ছড়িয়ে পড়ে—অন্যায়কে দমন করতে গেলে অন্যায়েরই আশ্রয় নিতে হয়। এই যুক্তিই সিনেমার নৈতিক বুননকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিয়েছে।
বাংলা সিনেমাও এই প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়। একসময় ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকেরা যে সমাজচেতনা ও শ্রেণিসংগ্রামকে সিনেমার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন, তা এখন প্রায় বিলুপ্ত। আধুনিক বাংলা সিনেমায় অপরাধ ও রাজনীতির মেলবন্ধন এখন বিনোদনের উপাদান। বুনো হাঁস, অগ্নিপথ, বস ২, চ্যাম্প বা চিনে বাদাম-এর মতো ছবিতে শহুরে পুরুষতান্ত্রিক দাপট ও গ্যাং কালচারের গ্ল্যামার ছড়িয়ে পড়েছে। এই ছবিগুলিতে নারীরা হয় নায়কের গ্ল্যামারের অংশ, নয়তো সহিংসতার শিকার। কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ড ও রাজনীতির আঁতাত এখানে একরকম পুরুষোচিত দম্ভের প্রতীক। দর্শক, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, এই দম্ভকেই অনুসরণ করতে শেখে।
মারাঠি, তেলুগু, কন্নড় ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সিনেমাও ধীরে ধীরে এই ভাষার প্রভাবে ঢুকে পড়ছে। কন্নড় সিনেমার কেজিএফ বা তেলুগু সিনেমার পুষ্পা আসলে ভারতের সমকালীন মিথের প্রতিরূপ, যেখানে কয়লা মাফিয়া বা কাঠ পাচারকারী নায়ক হয়ে ওঠে ‘লোকনায়ক’। এই লোকনায়ক দমনযন্ত্রের অংশ, কিন্তু একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। এই দ্বৈততা সিনেমার রাজনৈতিক পাঠকে জটিল করে তোলে। দর্শক বুঝতে পারে না সে কাকে অনুসরণ করছে—ন্যায়কে, না অন্যায়কে। কিন্তু ছবির ভিজ্যুয়াল ও সংগীতের উত্তেজনা তাকে ভাবতে দেয় না। তার সামনে পর্দায় উঠে আসে রক্ত, বন্দুক, সোনার স্তুপ, লোভ ও কামনা—যা একসঙ্গে মিলে একধরনের যৌথ আসক্তি তৈরি করে।
এই আন্ডারওয়ার্ল্ড বাস্তবতার সবচেয়ে বড় পরিণতি হলো, এখন দর্শক তাকে ভয় পায় না—সে তাকে উপভোগ করে। একসময় দেওয়ার বা সত্যা-তে মাফিয়া চরিত্ররা নৈতিক প্রশ্ন তুলত—এই সমাজ কি আমাদের অপরাধের জন্মদাতা নয়? কিন্তু এখনকার সিনেমায় সেই নৈতিক প্রশ্ন অনুপস্থিত। অপরাধ আর ন্যায় একসঙ্গে মিশে গেছে বিনোদনের পরিসরে। কেজিএফ-এর রকি ভাই, পুষ্পা-র পুষ্পরাজ, দাবাং-এর চুলবুল পাণ্ডে, সিংহম-এর বাজিরাও, কিংবা লুসিফার-এর স্টিফেন—সবাই একই আর্কিটাইপ: সমাজের বাইরের এক মসীহা, যার সহিংসতা ‘ন্যায়’-এর বিকল্প। দর্শক তার বন্দুকের গর্জনে উত্তেজিত হয়, তার সংলাপে উল্লাস করে, তার মৃত্যুতেও করতালি দেয়। সিনেমা এই সহিংসতাকে সমাজের বিনোদনে রূপান্তর করেছে—যেখানে রক্তপাত একপ্রকার থ্রিল, খুন একপ্রকার নাটক, আর অন্যায় একপ্রকার শিল্পের উপাদান।
এই জায়গাটিতে ভারতীয় সিনেমা ও পাশ্চাত্যের গ্যাংস্টার সিনেমার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। দ্য গডফাদার, গুডফেলাস, বা পাল্প ফিকশন—এই ছবিগুলিতে মাফিয়া জগতের নির্মমতা ও নৈতিক পতন শেষ পর্যন্ত আত্মবিনাশের দিকেই যায়। মারিও পুজো ও ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার গডফাদার-এ মাইকেল করলিওনের চোখে ক্ষমতার নির্মমতা এক দীর্ঘ ট্র্যাজেডি হয়ে ওঠে, যেখানে পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে নিজেই নৈতিক শূন্যতার প্রতীক হয়। মার্টিন স্করসেজের গুডফেলাস-এ হেনরি হিলের গল্প আসলে আমেরিকান স্বপ্নের পচন—যেখানে অপরাধ হলো উচ্চাকাঙ্ক্ষার অপর নাম। কোয়েন্টিন টারান্টিনোর পাল্প ফিকশন সহিংসতাকে শৈলীর পর্যায়ে নিয়ে গেলেও সেটি নৈতিক শূন্যতার ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে মৃত্যু ও হাস্য একসঙ্গে কাজ করে অস্তিত্ববাদী সঙ্কটের প্রতীকে। এই ছবিগুলি দর্শককে প্রশ্ন করে, আকৃষ্ট করে না; তারা সহিংসতার মাধ্যমে মানুষ ও সমাজের নৈতিক ক্ষয়কে প্রকাশ করে।
কিন্তু ভারতীয় সিনেমায় ঠিক উল্টোটি ঘটে। এখানে সহিংসতা আত্মসমালোচনার মাধ্যম নয়, বরং আত্মপ্রচারের উপাদান। এখানে বন্দুকধারী চরিত্র দর্শকের নায়ক হয়ে ওঠে, এবং সমাজের হিংসা এক সমবেত উল্লাসে রূপান্তরিত হয়। দর্শক, যার জীবন হয়তো অনিশ্চয়তায় ভরা, তার নিজস্ব ক্ষোভ, অভাব ও অপমানকে সিনেমা এই মাফিয়া নায়কতন্ত্রের মাধ্যমে মুক্তি দেয়। ফলত সহিংসতা এক ধরনের ক্যাথারসিস, যা সমাজের প্রতিবাদের জায়গাকে নিঃশেষ করে দেয়। এটি এক গভীর রাজনৈতিক সমস্যা—কারণ যে দর্শক পর্দায় সহিংসতা দেখে আনন্দ পায়, সে বাস্তব জীবনের অন্যায়কে আর প্রতিবাদযোগ্য বলে মনে করে না।
এইভাবে ভারতীয় সিনেমা আমাদের সহিংসতা-চেতনার এক সাংস্কৃতিক পাঠ্যবই তৈরি করছে, যেখানে বিনোদনের মোড়কে রাজনীতি, অপরাধ ও নৈতিক অবক্ষয় একে অপরের পরিপূরক। সিনেমা এখন আর সমাজকে প্রশ্ন করে না; সে বরং সমাজের অবচেতন আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে। দর্শক আর ন্যায়চেতনা চায় না—সে চায় তৃপ্তি, উত্তেজনা, দ্রুত প্রতিশোধ, এবং এক মসীহার বন্দুকের আওয়াজ।
ফলে ভারতীয় সিনেমা আজ আমাদের মানসিকতা ও সামাজিক কাঠামোর একটি নিষ্ঠুর প্রতিফলন—যেখানে ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা বিলুপ্ত, নৈতিক বিকৃতি পণ্যে পরিণত, এবং গ্যাংস্টার নায়ক সমাজের দেবতা। এই নায়কত্ব যত জনপ্রিয় হয়, সমাজ তত বেশি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সিনেমা তখন বিনোদন নয়, বরং এক অজান্তে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক প্রচার—যা আমাদের শেখায়, অন্যায়ও উপভোগ্য হতে পারে যদি তার চিত্রনাট্য সুন্দর হয়।
ভারতীয় সিনেমার সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন এক সময় এসেছে যখন হিংসা, ক্ষমতা, দুর্নীতি, মাফিয়া-সংস্কৃতি এবং অপরাধের নান্দনিকতাই একপ্রকার দর্শকের নৈতিক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। একসময় এই উপাদানগুলি চলচ্চিত্রে ছিল সমাজের গভীর অসুখ, রাজনৈতিক ভ্রষ্টতা বা শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিচ্ছবি হিসেবে—কিন্তু এখন সেগুলি অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছে বিনোদনের মূল চালিকা শক্তি। এই প্রবণতার সূচনা কিন্তু আকস্মিক নয়। এটি শুরু হয় অর্থনৈতিক উদারীকরণের সময় থেকে, যখন ভারতের সিনেমা ক্রমশ বাজারনির্ভর বিনোদন ব্যবস্থার অংশ হয়ে ওঠে। মাফিয়া, আন্ডারওয়ার্ল্ড, দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ বা রাজনীতিক—এরা তখন সিনেমায় কেবল নেতিবাচক চরিত্র নয়, বরং একধরনের “হিরো” হয়ে ওঠে। তাঁদের কৌশল, তাঁদের ঠান্ডা মাথার খুন, তাঁদের সাফল্য, তাঁদের বিলাসী জীবনযাপন—সবকিছুই দর্শকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই রূপান্তর একাধারে সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও রাজনৈতিক।
আশির দশকের শেষ দিকে এবং নব্বইয়ের দশকে যে বলিউড দর্শকের সামনে আসে, সেখানে গ্যাংস্টার চরিত্ররা হয়ে ওঠে একধরনের “ম্যাস কালচার আইকন”। মুম্বাই শহর, তার ঘিঞ্জি বস্তি, আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন, পুলিশি মিথস্ক্রিয়া, মাদক চোরাচালান—সবকিছুই নতুন ভারতীয় বাস্তবতার প্রতীক হিসেবে উঠে আসে। কিন্তু এই বাস্তবতা কোনও প্রতিবাদের ভাষা নয়, বরং এক ধরনের বিনোদনমূলক রোম্যান্টিসিজম। উদাহরণস্বরূপ, রমগোপাল ভার্মার সত্যা ছবিটি (১৯৯৮) — যা একদিকে ভারতীয় শহুরে অপরাধের শৈল্পিক বাস্তববাদকে নতুন মাত্রা দেয়, অন্যদিকে সেই অপরাধী জীবনকেও এমনভাবে দেখায় যেন তা ন্যায্য ও অনিবার্য। সত্যা ছবিতে ভূপেন হাজারিকার করুণ সুর “গঙ্গা বহে সাদে ছাপ্পান” শহরের নীচুতলার দমবন্ধ অস্তিত্বকে যেমন প্রকাশ করে, তেমনই এক অদ্ভুত মায়াবী মর্যাদা দেয় সেই নরকের অধিবাসীদের। ভার্মা সেই সময় এক নতুন চলচ্চিত্রভাষা তৈরি করেন—যেখানে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা, মলিন আলো, ভাঙা সংলাপ, আর হঠাৎ বিস্ফোরিত হিংসা একধরনের কাব্যিক রূপ নেয়। কিন্তু সেই কাব্য, সমাজের ন্যায়ের নয়; বরং এক নিঃসঙ্গ নৈতিক শূন্যতার।
ভার্মার পরবর্তী ছবিগুলিও যেমন কম্পানি, সরকার, ডি, সত্যা ২—সবকটিই একই নান্দনিক ধারা অবলম্বন করে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাস্তবতাকে সেখানে আর সমাজবিরোধী বলেই দেখা হয় না; বরং একধরনের পেশা বা বেঁচে থাকার কৌশল হিসেবে দেখানো হয়। সরকার ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের “সুবাষ নাগরে” চরিত্রটি এই নৈতিক অস্পষ্টতার প্রতীক—তিনি একদিকে রাজনীতির অপরাধজগৎকে প্রতিনিধিত্ব করেন, অন্যদিকে জনতার রক্ষাকর্তা হিসেবেও হাজির হন। দর্শক তাঁর অন্যায়েরও ন্যায় হিসেবে গ্রহণ করে। ভার্মা এই ভাবেই ভারতীয় মধ্যবিত্ত মানসিকতার সেই গোপন বাসনাকে রূপ দেয়, যা চায় শক্তি, প্রভাব, প্রতিশোধ—কিন্তু নিজের ভেতরে সেই অন্ধকারকে মুখে স্বীকার করতে চায় না।
এই প্রবণতা বলিউডের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ ভারতের তামিল এবং তেলুগু সিনেমায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের নায়ক ক্রমে পৌরাণিক শক্তির অবতার হয়ে ওঠেন। তামিল ছবিতে যেমন কাবালি বা কাইথি—এখানে অপরাধীও মুক্তিদাতা। মালয়ালম সিনেমায় কিছুটা ভিন্ন পথ দেখা গেলেও, সাম্প্রতিক সময়ের জোজি বা রাজারবাবু জাতীয় ছবিগুলিতে ক্ষমতা ও হিংসা একই সঙ্গে অনিবার্য নিয়তি হিসেবে হাজির। এই সিনেমাগুলি দেখায় যে নৈতিক দ্বন্দ্বের জায়গায় এসেছে বাস্তবিক বেঁচে থাকার মনোবিজ্ঞান। দর্শক সেখানে বিচারক নয়, দর্শক নিজেই অংশগ্রহণকারী।
তবে বলিউডে এই হিংসার নন্দনতত্ত্ব সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে। বিক্রম ভট্ট থেকে সঞ্জয় লীলা ভন্সালি, অনুরাগ কাশ্যপ থেকে তিগ্মাংশু ধুলিয়া—সবাই এই “ডার্ক বিউটি”-র ভাষা ব্যবহার করেছেন। অনুরাগ কাশ্যপের গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর হিংসাকে এমন রঙিন রূপ দেয় যে দর্শক হাসে, আনন্দ পায়, আর একইসঙ্গে ভয়ও পায়—যেন হত্যার অভিঘাতও বিনোদনের উপকরণ। এই সিনেমাগুলি একদিকে সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে, কিন্তু অন্যদিকে সেটিকে এমনভাবে প্যাকেজ করে যে তা হয়ে ওঠে বাজারের পণ্য। দর্শক জানে সে অপরাধ দেখছে, কিন্তু সেই অপরাধেরই দৃশ্য-ভাষা তাকে মুগ্ধ করে।
এই প্রেক্ষিতে, ভারতীয় সিনেমার রাজনৈতিক বোধের ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া স্পষ্ট। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক বা আদুর গোপালকৃষ্ণণের মতো নির্মাতারা সিনেমায় যে সমাজচেতনা, শ্রেণি-বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা আনতে চেয়েছিলেন, সেখানে রমগোপাল ভার্মা বা তাঁর উত্তরসূরিদের সিনেমা মূলত বাস্তবতার অর্থনৈতিক প্রতিরূপ তৈরি করে। ঘটক বা সেন যেখানে চেয়েছিলেন দর্শকের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করতে, প্রশ্ন জাগাতে, সেখানে ভার্মার সিনেমা দর্শকের অস্বস্তিকে বিনোদনে রূপান্তরিত করে। মৃণাল সেনের কলকাতা ৭১ বা পদাতিক যে প্রশ্ন তুলেছিল শোষণ ও ন্যায় নিয়ে, ভার্মার সত্যা বা কম্পানি সেখানে কেবল ক্ষমতার বাস্তবচিত্র তুলে ধরে, কিন্তু তা নিয়ে কোনও নৈতিক অবস্থান নেয় না।
এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সিনেমা এক নতুন নৈতিকতাহীনতার পর্যায়ে প্রবেশ করে, যেখানে দুর্নীতি ও অপরাধ হয়ে ওঠে সাফল্যের প্রতীক। মাফিয়া চরিত্ররা হয়ে ওঠে জনপ্রিয় সংস্কৃতির নায়ক, ঠিক যেমন আমেরিকায় গডফাদার বা গুডফেলাস ছবির চরিত্ররা একসময় হয়েছিল। কিন্তু পার্থক্য এখানেই যে গডফাদার বা গুডফেলাস—এই ছবিগুলি আমেরিকান সমাজের অন্তর্গত নৈতিক পতন ও পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতাকে উন্মোচিত করেছিল, সেখানে ভারতীয় সিনেমায় এই আন্ডারওয়ার্ল্ড বাস্তবতা প্রায়শই হয়ে ওঠে একধরনের গ্ল্যামার। মারিও পুজো বা মার্টিন স্করসিজের গ্যাংস্টারদের মধ্যে এক গভীর ট্র্যাজেডি ছিল—তাঁদের ক্ষমতা ও পতন একই মুদ্রার দুই পিঠ। কিন্তু বলিউডে সেই ট্র্যাজেডির জায়গা দখল করে নেয় রোম্যান্টিক উত্তেজনা।
ভার্মার কম্পানি ছবিতে মুস্তাফা চরিত্র যখন বলে “ব্যবসা আলাদা, সম্পর্ক আলাদা”—তখন সে কেবল আন্ডারওয়ার্ল্ডের যুক্তি দিচ্ছে না, বরং নতুন ভারতের কর্পোরেট পুঁজিবাদের ভাষা বলছে। অপরাধও তখন হয়ে যায় কর্পোরেট মডেল। এইভাবে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাস্তবতা কেবল সমাজের নয়, বাজারের প্রতীক। এখানে দর্শকও এক ভোক্তা, যে হিংসা ক্রয় করছে, আর নিজের অবদমিত আকাঙ্ক্ষাকে পর্দায় দেখে স্বস্তি পাচ্ছে।
এই প্রবণতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা প্যারালাল সিনেমা আজ প্রায় নিঃশেষ। শ্যাম বেনেগালের নিশান্ত, গোবিন্দ নিহালনির আক্রমণ, গৌতম ঘোষের পারে, আদুর গোপালকৃষ্ণণের এলিপ্পাথায়াম—এই সব ছবিতে অপরাধ ছিল অন্যায়ের ফল, সমাজ-অর্থনীতির বিশ্লেষণের বিষয়। কিন্তু এখনকার আন্ডারওয়ার্ল্ড ছবিতে অপরাধ হয়ে গেছে সাফল্যের রাস্তা। এমনকি বাংলা সিনেমাতেও এই প্রভাব স্পষ্ট। বাইশে শ্রাবণ বা দুর্গারহস্য জাতীয় থ্রিলারগুলোতেও খুন হয়ে ওঠে চূড়ান্ত বিনোদন।
ফলে প্রশ্ন জাগে—এই সিনেমাগুলির সাফল্য কি সমাজের ব্যর্থতার প্রতিফলন নয়? দর্শক যখন হিংসা দেখে আনন্দ পায়, তখন সে নিজের মধ্যে জমে থাকা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অবদমন ও পরাজয়কে ভুলে যেতে চায়। এই সিনেমাগুলি তাকে দেয় এক কল্পিত নিয়ন্ত্রণবোধ—যেখানে বন্দুকধারী ডন হয়ে ওঠে সেই নায়ক, যে রাষ্ট্রের ব্যর্থ জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। তাই বলা যায়, এই সিনেমাগুলি রাজনৈতিক, কিন্তু এক বিকৃত রাজনৈতিকতা-র প্রতিনিধি।
এখানেই ভারতীয় সিনেমা ও গডফাদার বা গুডফেলাস-এর পার্থক্য। সেখানকার হিংসা আত্মসমালোচনার উপকরণ, আর এখানকার হিংসা বিনোদনের অজুহাত। পাল্প ফিকশন বা আমেরিকান সাইকো-র মতো ছবিতে হিংসা ব্যবহৃত হয় সামাজিক নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিসেবে; কিন্তু বলিউডে তা হয়ে ওঠে উত্তেজক পণ্যের মতো। ভারতীয় সিনেমা, বিশেষ করে শহুরে মূলধারার নির্মাণে, আজ এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে অপরাধ ও দুর্নীতি কেবল বিষয় নয়, বরং বাজারের চাহিদা।
এইভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্র ধীরে ধীরে এক নৈতিক শূন্যতার নান্দনিকতায় প্রবেশ করেছে, যেখানে দর্শক ও চরিত্র উভয়েই ভোগবাদী, উভয়েই বাজারের অংশ। আন্ডারওয়ার্ল্ডের রক্তপাত, পুলিশের ভ্রষ্টতা, রাজনীতির অনৈতিকতা—সবই এক মহা রঙিন প্রদর্শনী। আর সেই প্রদর্শনীই আজকের বাস্তবতার সবচেয়ে নির্মম প্রতিচ্ছবি।
বিশাল ভরদ্বাজের সিনেমা ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক অনন্য দ্বন্দ্বের জায়গা তৈরি করে। তাঁর ছবিগুলি একদিকে অপরাধ, দুর্নীতি ও হিংসার প্রতিফলন—যেমনটা আমরা রামগোপাল ভার্মার শহুরে বাস্তববাদে দেখি—অন্যদিকে তাঁর সিনেমায় এই হিংসা হয়ে ওঠে একধরনের কাব্যিক ট্র্যাজেডি। তিনি অপরাধকে মহিমান্বিত করেন না, বরং তা মানুষের অন্তর্গত পতন, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, প্রেম ও নৈতিকতার সংঘাত হিসেবে দেখান। কিন্তু এখানেই ভরদ্বাজের জটিলতা—তিনি দর্শককে সৌন্দর্যের মায়ায় এমনভাবে টানেন যে সেই পতনও নন্দন হয়ে ওঠে।
ভরদ্বাজের মকবুল (২০০৩) বলিউডে শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডির পুনর্লিখনের সূচনা করে। ম্যাকবেথ-এর আখ্যানকে মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে বসিয়ে তিনি এমন এক দুনিয়া তৈরি করেন যেখানে ক্ষমতা, প্রেম ও নিয়তি একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে। “আববা” চরিত্রে পঙ্কজ কাপুর যেন দাউদের এক ছায়া, কিন্তু তাঁর ভেতরে আছে এক ধর্মীয় মর্যাদা—যেন রাজা ক্লডিওর মতো এক নিষ্ঠুর করুণা। মকবুল (ইরফান খান) এই ক্ষমতার জগতে এক সৎ অধীনস্থ, কিন্তু প্রেমের জন্য, ক্ষমতার লোভে এবং ভবিষ্যদ্বাণীর মায়ায় সে ধীরে ধীরে পতনের পথে হাঁটে। এই ছবির প্রতিটি দৃশ্য যেন ভারতীয় দুর্নীতি ও রাজনীতির এক প্রতীক—যেখানে অনুগতরাই একদিন বিশ্বাসঘাতক হয়, যেখানে ভালবাসাও ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার।
ভরদ্বাজ এই ছবিতে আন্ডারওয়ার্ল্ডকে শুধু বাস্তব হিসেবে নয়, একধরনের অভ্যন্তরীণ নরক হিসেবে দেখিয়েছেন। সেও পুলিশের চোখে অপরাধী, কিন্তু পরিচালকের চোখে সে মানুষ—ভুলের, ভালোবাসার, ভয় ও অপরাধবোধের মানুষ। মকবুল সেই জায়গা থেকেই ভারতীয় সিনেমায় এক নৈতিক গভীরতা আনে যা রামগোপাল ভার্মার বাস্তববাদের চেয়ে অনেক জটিল। এখানে হিংসা কেবল সমাজের নয়, মানুষের ভিতরের। এক দৃশ্যে মকবুল নিজের হাতে যখন রক্ত দেখে, তখন তা কোনও শত্রুর নয়, নিজের আত্মার।
এর পর আসে ওমকারা (২০০৬), যা ওথেলোর ভারতীয় অভিযোজন। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, কাস্ট ও গ্যাং-সংস্কৃতির সংঘাতের মধ্যে ভরদ্বাজ দেখান প্রেম, সন্দেহ ও পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ভয়াবহ রূপ। ওমকারা (অজয় দেবগন) এক স্থানীয় শক্তিধর নেতা, যিনি নিজের ক্ষমতা ও ভালোবাসার ভারে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায়। ভরদ্বাজ এখানে যে রাজনৈতিক পরিবেশ নির্মাণ করেন, তা যেন ভারতীয় গণতন্ত্রের এক অন্ধকার প্রতিবিম্ব—যেখানে রাজনীতি, অপরাধ, প্রেম ও হিংসা একে অপরের রক্তে মিশে গেছে।
লাঙ্গড়া ত্যাগী (সইফ আলি খান) চরিত্রটি কেবল ইয়ারগো নয়, বরং ভারতীয় মধ্যবিত্ত পুরুষের হীনমন্যতা ও অক্ষমতার প্রতীক। সে প্রেমে হারায়, ক্ষমতায় ব্যর্থ হয়, তাই ষড়যন্ত্রের মধ্যে খুঁজে নেয় আত্মপ্রমাণ। ভরদ্বাজের এই চরিত্রগুলি সমাজের বাইরের নয়, সমাজের ভেতরকার—যারা আমাদের দৈনন্দিন দুর্নীতি, ঈর্ষা ও হিংসাকে জীবন্ত করে তোলে। ওমকারা-র ভাষা, গান, সংলাপ সবই সেই লোকজ রাজনৈতিক পরিবেশকে ধারণ করে, কিন্তু সেই আঞ্চলিক বাস্তবতার ভেতরেই ভরদ্বাজ খুঁজে পান এক সার্বজনীন ট্র্যাজেডি।
ভরদ্বাজের সবচেয়ে রাজনৈতিক ছবি সম্ভবত হায়দার (২০১৪)। এখানে হ্যামলেট কাশ্মীরের প্রেক্ষাপটে স্থানান্তরিত হয়—এবং তার মধ্য দিয়ে ভরদ্বাজ দেখান রাষ্ট্র, পরিবার, ভালোবাসা ও প্রতিশোধের ভেতরকার জটিল রাজনীতি। কাশ্মীরের সামরিক দমননীতি, গায়েবি হওয়া, ভয়, সেনার নৈঃশব্দ্য—সব মিলিয়ে এই ছবিটি ভারতীয় মূলধারার সিনেমায় এক বিরল সাহসিকতার উদাহরণ। হায়দার (শাহিদ কাপুর) তার বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ক্রমে হারিয়ে ফেলে নিজের বোধ, নিজের অস্তিত্ব। এখানে রাষ্ট্র-নির্মিত হিংসা আর ব্যক্তিগত হিংসা একে অপরের প্রতিরূপ। ভরদ্বাজ কোনও পক্ষ নেন না, কিন্তু তাঁর ক্যামেরা দেখায় মানুষের দমন, ভয়, আর মিথ্যা দেশপ্রেমের বিভ্রম।
এই ছবির এক অনন্য মুহূর্ত হল যখন হায়দার “আজাদী” বলে চিৎকার করে—একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক স্লোগান এবং ব্যক্তিগত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ভরদ্বাজ এই ছবিতে যে সাহস দেখিয়েছেন, তা ভারতীয় মূলধারায় বিরল। তাঁর কাশ্মীর কোনও পর্যটনচিত্র নয়; তা মানুষের শোক ও নৈঃশব্দ্যের ভূমি। কিন্তু এখানেও, তাঁর নির্মাণের নান্দনিকতা দর্শককে এমনভাবে টানে যে সেই হিংসা, সেই যন্ত্রণা এক মুহূর্তে কবিতা হয়ে ওঠে।
হায়দার-এর পর ভরদ্বাজের সাত খুন মাফ (২০১১) এবং কামিনে (২০০৯) ভারতীয় সমাজের অন্য দুটি বাস্তবতা তুলে ধরে—একটিতে ব্যক্তিগত দুরাচার, অন্যটিতে সামাজিক বিভাজন। সাত খুন মাফ-এর সুশমিতা (প্রিয়াঙ্কা চোপড়া) চরিত্রটি যেমন আধুনিক নারীর বিকৃত মুক্তির রূপ, তেমনই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্তর্নিহিত হিংসার প্রতিবিম্ব। সে সাতজন স্বামীকে হত্যা করে—কিন্তু প্রত্যেকবার সেই হত্যা হয়ে ওঠে এক আত্মরক্ষা, এক স্বীকারোক্তি। এই সিনেমাটি যৌনতা, ভালোবাসা ও পাপের যে ত্রিভুজ তৈরি করে, তা ভারতীয় সংস্কৃতির গভীর লিঙ্গবিভাজনকেও উন্মোচন করে। ভরদ্বাজ নারীর হিংসাকেও একধরনের প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে দেখান, যা ভারতীয় মূলধারায় খুবই বিরল।
অন্যদিকে কামিনে শহুরে হিংসা, ভাই-বোনের সম্পর্ক ও ভাগ্যনির্ভর জীবনের কোলাজ। এখানে অপরাধী ও নির্দোষ, ধনী ও গরিব, প্রেমিক ও প্রতারক—সব চরিত্র একই সঙ্গে শিকার এবং অপরাধী। “দুনিয়া মেঁ কই কাই কামিনে হ্যায়”—এই সংলাপ যেন পুরো ভারতের সামাজিক মানচিত্রের প্রতিধ্বনি। ভরদ্বাজের সিনেমায় অপরাধ কোনও ব্যতিক্রম নয়, বরং সামাজিক নিয়ম।
তবে বিশাল ভরদ্বাজের সিনেমাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তাঁর সঙ্গীত ও দৃশ্যভাষা। তাঁর প্রতিটি ফ্রেমে, আলো-অন্ধকারের মিশ্রণ, সংলাপের নাটকীয়তা, এবং সঙ্গীতের বেদনা—সব কিছু মিলিয়ে হিংসা হয়ে ওঠে কবিতার মতো। এই কারণেই তাঁর সিনেমা দর্শককে একই সঙ্গে আকৃষ্ট করে ও অস্বস্তিতে ফেলে। তিনি যে পৃথিবী নির্মাণ করেন, সেখানে হিংসা কেবল হিংসা নয়, বরং মানবজীবনের অনিবার্য দ্বন্দ্ব।
তবে এই নান্দনিকতায় এক বিপদও আছে—যেমন রমগোপাল ভার্মার সিনেমায় বাস্তববাদ হিংসাকে মহিমান্বিত করেছিল, তেমন ভরদ্বাজের সিনেমায় হিংসা কখনও কখনও হয়ে ওঠে শিল্পের অলঙ্কার। দর্শক শেক্সপীয়রীয় আবেগে এতটাই ডুবে যায় যে তার মধ্যে থাকা রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকেত হয়তো উপেক্ষিত হয়। হায়দার-এর কাশ্মীর রাজনীতি কিংবা ওমকারা-র বর্ণভিত্তিক হিংসা—সবই কখনও কখনও ট্র্যাজেডির নন্দনতত্ত্বে বিলীন হয়ে যায়।
এই দিক থেকে বিশাল ভরদ্বাজ রমগোপাল ভার্মার বিপরীতে এক বুদ্ধিবৃত্তিক সিনেমা নির্মাণ করেন—কিন্তু তাঁদের দুজনের মধ্যেই এক অদ্ভুত সমান্তরালতা রয়েছে। ভার্মা যেখানে হিংসাকে রক্তের উত্তেজনা হিসেবে দেখান, ভরদ্বাজ সেখানে দেখান রক্তের কবিতা। কিন্তু উভয়ের সিনেমাই দর্শকের অবচেতন হিংসাকে প্রশ্রয় দেয়। ভার্মার দর্শক উত্তেজিত হয়, ভরদ্বাজের দর্শক মুগ্ধ হয়; অথচ দুজনেরই দর্শক একই মনের গহ্বর থেকে আসে।
এই অবস্থায় ভারতীয় সিনেমায় প্যারালাল রাজনৈতিক চেতনা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে। শ্যাম বেনেগাল বা মৃণাল সেনের সিনেমা যে দর্শককে প্রশ্ন করত, ভরদ্বাজ বা কাশ্যপের সিনেমা সেই দর্শককে চমকে দেয় কিন্তু জাগায় না। আজকের দর্শক সমাজের অপরাধ ও দুর্নীতিকে দেখেও নৈতিক ক্রোধ অনুভব করে না, বরং সেটিকে শিল্পের এক অনিবার্য উপাদান হিসেবে মেনে নেয়।
বিশাল ভরদ্বাজের চলচ্চিত্রতত্ত্ব এইভাবেই ভারতীয় সিনেমার এক দ্বান্দ্বিক জায়গায় দাঁড়িয়ে—যেখানে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও কাব্যিক চিত্রভাষা পরস্পর লিপ্ত। তিনি রমগোপাল ভার্মার মতো নগরের গলি থেকে, কিন্তু তার চেয়ে গভীরে গিয়ে মানবমনের গলি আবিষ্কার করেন। তবু তাঁর সিনেমাও এক ধরনের আত্মবিনোদন—যেখানে দর্শক নিজের অন্ধকারে আলো খোঁজে।
ফলে এই বিশাল ভরদ্বাজের সিনেমা শেষ পর্যন্ত এক প্রশ্ন রেখে যায়—ভারতীয় সিনেমা কি আজ আর সমাজের প্রতিবিম্ব, নাকি তার বিনোদনের আয়না? মাফিয়া, দুর্নীতি, হিংসা, প্রেম, রাজনীতি—সবই যদি শেষ পর্যন্ত নন্দন হয়ে ওঠে, তবে সেই সৌন্দর্যের আড়ালে আমরা কী হারাচ্ছি? সম্ভবত সেই নৈতিক সজাগতা, যা একদিন ভারতীয় প্যারালাল সিনেমাকে জীবন্ত করেছিল।
বিশাল ভরদ্বাজের চলচ্চিত্রজগৎ ভারতীয় মূলধারার ছবির ভেতরেও এক গভীর রাজনৈতিক, নৈতিক এবং ভাষাগত রূপান্তরের উদাহরণ। তাঁর সিনেমা বলিউডের ঝলমলে চিত্রভাষার ভেতর থেকে উঠে আসে, কিন্তু তা কখনওই কেবল বিনোদনের সীমায় থেমে থাকে না। বরং এই বিনোদনের কাঠামো ভেঙে, তার অন্তর্গত পচন, দুর্নীতি, নৈতিক অবক্ষয়, প্রেমের বিকার, সামাজিক সহিংসতা এবং ক্ষমতার অসাম্যকে এক তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গাত্মক ও সাহিত্যবোধে ভরা চলচ্চিত্রভাষায় অনুবাদ করেন তিনি। বিশাল ভরদ্বাজের ছবিগুলি একদিকে যেমন রামগোপাল বর্মার আন্ডারওয়ার্ল্ড বাস্তবতার ধারাকে অনুসরণ করে, তেমনি অপরদিকে প্যারালাল সিনেমার রাজনৈতিক বোধের সঙ্গেও এক নীরব সংলাপে প্রবেশ করে। তাঁর ভাষা মূলত সাহিত্যনির্ভর, কিন্তু তার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সমাজের এক অনবরত পরিবর্তনশীল, রক্তাক্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত চেহারা ফুটে ওঠে।
বিশালের চলচ্চিত্রজীবনের সূত্রপাত হয় সংগীত দিয়ে—তিনি প্রথমে সুরকার হিসেবে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন, পরে নিজের সুরের মধ্যেই গল্পের ছন্দ খুঁজে পান। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র মকবুল (২০০৩), শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ–এর ভারতীয় রূপান্তর, বলিউডে যেন এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এখানে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুনিয়া, মাফিয়া রাজনীতি এবং ক্ষমতার নির্মম খেলা মিলেমিশে তৈরি করেছে এক আধুনিক ট্র্যাজেডি। ‘মকবুল’–এর চরিত্ররা মুম্বইয়ের অপরাধজগতের প্রতিনিধি, কিন্তু তাদের অন্তরজগৎ অনেক গভীর—বিশাল যেন শেক্সপিয়রের রাজপুরুষদের পতনকাহিনিকে মাফিয়া সমাজের প্রেক্ষাপটে এনে রেখেছেন। মকবুলের মধ্যে রয়েছে ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষমতার নেশা এবং ভাগ্যের অনিবার্য পরিণতি। এই চলচ্চিত্রে দুর্নীতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়—এখানে নৈতিক দুর্নীতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নায়কের অন্তর্গত অন্ধকার, হিংসা এবং আত্মধ্বংসের প্রবণতা এক অদ্ভুত নান্দনিকতায় প্রকাশ পায়।
এরপর আসে ওমকারা (২০০৬), যা শেক্সপিয়রের ওথেলো–র আধুনিক ভারতীয় পুনর্নির্মাণ। উত্তরপ্রদেশের গ্রামীণ রাজনীতি, জাতপাতের জটিলতা, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং হিংস্র পুরুষ অহংকারের মধ্যে দিয়ে বিশাল দেখান কীভাবে ভারতীয় সমাজে ক্ষমতা ও প্রেমের দ্বন্দ্ব একে অপরকে ধ্বংস করে দেয়। ওমকারা চরিত্রটি একাধারে রাজনৈতিক গুন্ডা, আবার মানবিকভাবে ভঙ্গুর। লঙ্গড়া তৈমুর, অর্থাৎ ‘আইয়াগো’, এখানে হয়ে ওঠে ভারতীয় রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক—সে জানে কীভাবে বিশ্বাসকে অস্ত্র করে হত্যা করা যায়। বিশাল ভরদ্বাজের কৌশল হল এই ক্লাসিক ট্র্যাজেডিকে এমনভাবে রূপান্তরিত করা যাতে ভারতীয় দর্শক তা চিনতে পারে নিজের সমাজের আয়নায়। তাঁর ক্যামেরা ভাষা, সংলাপ, সংগীত—সবই স্থানীয় অথচ তার গভীর দার্শনিক তাৎপর্য আন্তর্জাতিক। এই চলচ্চিত্রে ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’র ভাষ্যটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দেশির প্রতি ওমকারার সন্দেহ ও ঈর্ষা আসলে সেই প্রাচীন সামাজিক অসুখের প্রতীক, যা নারীকে সম্পত্তি হিসেবে দেখে। এখানেই বিশালের সিনেমা রাজনৈতিক হয়ে ওঠে—কারণ সে প্রেম, ঈর্ষা, প্রতারণা ও সামাজিক কাঠামোর মধ্যে লুকোনো ক্ষমতার ভাষাকে নগ্ন করে দেয়।
হায়দার (২০১৪) বিশালের সবচেয়ে জটিল ও রাজনৈতিক কাজ। কাশ্মীরের অস্থির প্রেক্ষাপটে হ্যামলেট–এর গল্পকে পুনর্লিখন করে বিশাল ভরদ্বাজ এক অভূতপূর্ব চলচ্চিত্র তৈরি করেন। এটি কেবল শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডির ভারতীয় রূপান্তর নয়, বরং ভারতীয় রাষ্ট্রের নৃশংসতা, সেনা-রাজনীতি, নিখোঁজ মানুষ, রাষ্ট্রীয় দমননীতি এবং নাগরিক মানসিকতার ভেতরের গভীর দ্বন্দ্বের চিত্র। হায়দারের পিতা একজন চিকিৎসক, যিনি রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার শিকার হন। মা, গজনী ও হায়দারের সম্পর্ক জটিল এবং ধোঁয়াটে—এখানে প্রেম, নিষিদ্ধ আকর্ষণ, রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা সব একত্রে গলে যায়। হায়দার যখন ‘আজাদি’ শব্দটি উচ্চারণ করে, তখন তা শুধু কাশ্মীর নয়, বরং সমগ্র উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্রের সংকটের প্রতিধ্বনি। বিশাল এই ছবিতে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যকে কবিতার মতো ছন্দে রূপ দিয়েছেন—‘তোম নাহি সমঝে, হুম কেয়া চানতে হ্যায়… আজাদি।’ তাঁর ক্যামেরা বরফের মতো ঠান্ডা অথচ রক্তাক্ত। এ ছবিতে রাজনৈতিক দমন ও পারিবারিক বিশ্বাসঘাতকতা একই পরিমাপে কাজ করে।
বিশাল ভরদ্বাজের চলচ্চিত্রভাষা রামগোপাল বর্মার চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল ও আত্মসচেতন। রামগোপাল বর্মা যেমন আন্ডারওয়ার্ল্ডের হিংসাকে প্রায় নান্দনিক করে তোলেন, বিশাল সেখানে নৈতিক সংকটকে মুখ্য করেন। তাঁর হিংসা আত্মবিধ্বংসী, তার মধ্যে সৌন্দর্য নেই, বরং আছে বেদনাবোধ। উদাহরণস্বরূপ, কামিনী (২০০৯)–এ বিশাল দেখান দুই যমজ ভাইয়ের গল্প, যেখানে দুর্নীতি, স্বপ্ন, প্রেম ও নৈতিকতার সংঘর্ষ এক কাল্পনিক কিন্তু বাস্তবতার প্রতিফলন। এখানে মুম্বইয়ের গলি, অপরাধ, রাজনীতি, প্রেম—সব মিলেমিশে আছে এক অবাস্তব বাস্তবতা। ‘কামিনী’ দেখায় কীভাবে ভারতীয় সমাজে নৈতিকতা এক বিলাসে পরিণত হয়েছে।
তাঁর সাত খুন মাফ (২০১১)–এ নারী চরিত্র প্রথমবার কেন্দ্রস্থ হয়ে ওঠে। সুষ্মিতা, অর্থাৎ প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার চরিত্রটি সাতটি বিয়ের পর সাতজন স্বামীকে হত্যা করে—এই কাহিনি বিশাল ভরদ্বাজের নারীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রতীক। নারী এখানে শিকারও, আবার প্রতিশোধও। ভারতীয় সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা ও ক্ষমতার দ্বৈত মানদণ্ডের প্রতি এই ছবির তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ আছে। নারীকে ভালোবাসার নামে শোষণ করার যে মানসিকতা বলিউড দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণ করেছে, বিশাল সেটিকে উলটে দেন। প্রতিটি হত্যাই একপ্রকার আত্মরক্ষার প্রয়াস।
বিশালের সিনেমার সংগীত ও চিত্রভাষা তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যের সম্প্রসারণ। তাঁর প্রতিটি গান ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে এক অদ্ভুত অন্তঃসারশূন্যতার ছায়া—যেন সংগীতের ভেতর দিয়েও তিনি সমাজের পতনের শব্দ শুনতে পান। হায়দার–এর ‘আর্জি তো হ্যায়…’ বা ওমকারা–র ‘নমক ইশক কা’–এর মতো গানগুলি কেবল সংগীত নয়, সমাজের নৈতিক পচনের প্রতীক।
রামগোপাল বর্মার সত্যা, কোম্পানি, সরকার সিরিজ যেমন সরাসরি আন্ডারওয়ার্ল্ড রাজনীতিকে তুলে ধরে, বিশালের সিনেমা সেখানে পরোক্ষ—সে মাফিয়া সমাজের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির নৈতিক অবস্থানের প্রশ্ন তোলে। বিশালের ছবিগুলি সাহিত্যিক ও সিনেমাটিক—একইসঙ্গে কবিতার ও রাজনৈতিক। তাঁর চলচ্চিত্রজগত এমন এক ভারতীয় বাস্তবতার প্রতিফলন যেখানে দুর্নীতি ও নৈতিকতার সংঘর্ষে ব্যক্তি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, অথচ তবুও সে নিজের কণ্ঠস্বর খোঁজে।
বিশাল ভরদ্বাজের এই চলচ্চিত্রধারা আসলে প্যারালাল সিনেমার বংশধর, কিন্তু নতুন ভাষায়। যেখানে মৃণাল সেন, আদুর গোপালকৃষ্ণণ বা গোবিন্দ নিহালনি সমাজের সরাসরি বাস্তবতা তুলে ধরতেন, বিশাল সেই বাস্তবতার অন্তর্গত মনস্তাত্ত্বিক স্তর নিয়ে কাজ করেন। তিনি সাহিত্য, রাজনীতি ও মনস্তত্ত্বকে একত্রিত করে একটি নতুন ধরণের ‘সিনেমাটিক সমাজবিজ্ঞান’ রচনা করেন। তাঁর চলচ্চিত্রে দুর্নীতি কোনো বাইরের বিষয় নয়—এটি চরিত্রের মানসিক গঠনেই অন্তর্গত।
তাঁর চলচ্চিত্রগুলির সংলাপ, ক্যামেরার ব্যবহার, আলো ও ছায়ার বিন্যাস সবই সমাজের অবচেতনের অংশ। হায়দারের তুষারাবৃত প্রেক্ষাপট যেমন রাষ্ট্রীয় দমননীতির প্রতীক, তেমনি মকবুলের অন্ধকার গলিঘুঁজি হলো শহুরে দুর্নীতির অন্তঃস্থল। বিশাল ভরদ্বাজ দেখান, ভারতীয় সমাজে হিংসা ও দুর্নীতি আজ আর ব্যতিক্রম নয়, বরং নিত্যদিনের ভাষা।
এইভাবে বিশালের সিনেমা রামগোপাল বর্মার মতো বিনোদননির্ভর মাফিয়া-চেতনা থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়ায় এক রাজনৈতিক ও মানবিক ভাবনায়। তাঁর প্রতিটি ছবি প্রমাণ করে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের কাহিনি দিয়েও সমাজের অন্তর্গত নৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অসুস্থতা বিশ্লেষণ করা যায়। বিশাল ভরদ্বাজ তাই আধুনিক ভারতীয় সিনেমার এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নির্মাতা, যিনি বিনোদনের কাঠামোর ভেতর থেকেও এক গভীর আত্মবিশ্লেষণের আহ্বান জানান—যেখানে ক্ষমতা, দুর্নীতি, প্রেম, মৃত্যু, ও নৈতিকতার সব রেখা মিলেমিশে যায় এক শেক্সপিয়রীয় ভারতীয় বাস্তবতায়।

