সত্যজিৎ- স্করসিজ — এক সেতুবন্ধনের গল্প <br /> অরুন্ধতী বন্দ্যোপাধ্যায়

সত্যজিৎ- স্করসিজ — এক সেতুবন্ধনের গল্প
অরুন্ধতী বন্দ্যোপাধ্যায়

যখন মার্টিন স্করসিজ প্রথমবার পথের পাঁচালী দেখেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন এক তরুণ ছাত্র, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির চলচ্চিত্র বিভাগে পড়াশোনা করছেন। সিনেমা তখন তাঁর কাছে ছিল এক যন্ত্রণা ও উত্তেজনার মিশ্র সত্তা—ভিতরে রোমাঞ্চ, বাইরে ক্লান্তি। ইতালীয় নিওরিয়ালিস্ট সিনেমা যেমন Bicycle Thieves বা Rome, Open City তাঁকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু পথের পাঁচালী তাঁকে যেন এক অন্যরকম নীরবতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। বহু বছর পরে এক সাক্ষাৎকারে স্করসিজ বলেছিলেন, “আমি বুঝতে পারিনি, এমন ছবিও বানানো যায়—যেখানে কোনো দৃশ্যের ভেতর চিৎকার নেই, অথচ প্রতিটি মুহূর্ত কাঁদিয়ে দেয়। সত্যজিৎ রায় আমাকে শেখালেন, সিনেমা মানে শুধু ছবি নয়, অনুভবের স্রোত।”

স্করসিজের কাছে পথের পাঁচালী একধরনের উদ্ঘাটন ছিল। তিনি বলেছেন, “It was like discovering life itself.” তাঁর কাছে এই ছবির শক্তি কোথায়—তা শুধু গল্পে নয়, বরং সেই গভীর মানবিক বোধে যা ছবিটিকে সর্বজনীন করে তোলে। গ্রামের দরিদ্র পরিবার, একটি শিশু অপু, তার বোন দুর্গা, তাদের মায়ের টানাপোড়েন, বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যু—এই সব কিছু স্করসিজের কাছে নির্দিষ্ট ভারতীয় ঘটনা নয়, বরং মানুষের সার্বজনীন অস্তিত্বের প্রতিফলন। তিনি লিখেছিলেন এক প্রবন্ধে, “যে দৃশ্যগুলো আমি পথের পাঁচালী-তে দেখেছি, সেগুলো আমেরিকার কোনো শহরতলির দরিদ্র পরিবারের মধ্যেও ঘটতে পারত। কিন্তু রায়ের ক্যামেরা তাদেরকে এমনভাবে দেখেছে, যেন তারা ঈশ্বরের আলোয় আলোকিত।”

স্করসিজের চলচ্চিত্র ভাবনায় সবসময়ই ‘মার্জিনাল’ মানুষদের জায়গা ছিল—যারা সমাজের প্রান্তে থাকে, কিন্তু জীবনের গভীর সত্যকে জানে। Mean Streets বা Taxi Driver-এর মতো ছবিতে আমরা দেখি, শহরের নোংরা গলিতে থাকা মানুষরা নিজেদের স্বপ্ন, ধর্ম, অপরাধবোধ, এবং মুক্তির সন্ধানে লড়ছে। স্করসিজ বলেছিলেন, “রায় আমাকে শিখিয়েছিলেন যে, কোনো মানুষই ছোট নয়। অপু বা দুর্গা যেভাবে বেঁচে থাকে, সেটা আমাকে আমার নিজের নিউ ইয়র্কের লোকজনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল।” তাঁর চোখে পথের পাঁচালী ছিল সেই শিক্ষা—মানবিক মর্যাদা কখনও অর্থে নির্ভর করে না, বরং দৃষ্টিতে নির্ভর করে।

স্করসিজ একবার বলেছিলেন, “In Pather Panchali, I saw the kind of humility and grace that I had never seen before on screen.” এই “grace” বা মর্যাদার ধারণাটিই তাঁর কাছে ছিল রায়ের সিনেমার প্রাণ। পথের পাঁচালীতে দরিদ্র পরিবার, অন্নের অভাব, বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া কুঁড়েঘর—সবই উপস্থিত, কিন্তু কোথাও কোনো কৃত্রিমতা নেই। তিনি বলেন, “রায় কখনও তাঁর চরিত্রদের প্রতি করুণা দেখাননি; তিনি কেবল তাঁদের ভালোবেসেছেন। এই ভালোবাসাই সিনেমার প্রকৃত নৈতিকতা।”

স্করসিজের নিজের ভাষায়, পথের পাঁচালী ছিল “the poetry of small things.” তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন সেই বিখ্যাত দৃশ্য—যখন অপু ও দুর্গা মাঠ পেরিয়ে প্রথমবার ট্রেন দেখে। তাঁর কাছে এটি ছিল “the most cinematic moment ever filmed.” স্করসিজ বলেছিলেন, “যে মুহূর্তে সেই ট্রেন আসে, তা শুধু একটি যান্ত্রিক বস্তু নয়, সেটি সময়ের প্রতীক—শিশুর চোখে আধুনিকতার আবির্ভাব। আমি মনে করেছিলাম, যেন সেই ট্রেন আমার দিকেও আসছে—আমার নিউ ইয়র্কের জীবনে।” এই সংবেদনই তাঁর মতে রায়ের জাদু—একটি নির্দিষ্ট দেশ ও সংস্কৃতিকে এমনভাবে দেখানো, যাতে তা পুরো মানবজাতির অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে।

স্করসিজের প্রিয় চলচ্চিত্র Taxi Driver-এর এক দৃশ্যে, ট্র্যাভিস বিকল রাতের শহর জুড়ে গাড়ি চালায়, জানালার বাইরে নোংরা, বৃষ্টি, আলো, আর এক ধরনের একাকিত্ব। স্করসিজ নিজেই স্বীকার করেছেন, “রায়ের ছবিতে আমি দেখেছিলাম একাকিত্ব কীভাবে কবিতায় রূপ নিতে পারে। ট্র্যাভিসের একাকিত্ব তার নিজের পাপ, কিন্তু অপুদের একাকিত্ব ছিল নিসর্গের সঙ্গে মিশে থাকা। আমি চেয়েছিলাম, সেই অভ্যন্তরীণ নিঃসঙ্গতা আমার ছবিতেও আসুক।”

পথের পাঁচালী-র সবচেয়ে বিখ্যাত দৃশ্যগুলির মধ্যে একটি হল ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যু। কোনো নাটকীয়তা নেই, কেবল বাতাসের শব্দ, পাতার নড়াচড়া, আর দূরে এক ফাঁকা মাঠ। স্করসিজ এই দৃশ্য সম্পর্কে বলেছেন, “রায় জানতেন কীভাবে নীরবতাকে ব্যবহার করতে হয়। সেই দৃশ্য আমাকে মনে করিয়েছে টারকোভস্কির সিনেমার মতো এক পবিত্র শূন্যতা। কিন্তু রায় এটি করেছিলেন বহু বছর আগেই।” তাঁর মতে, “যখন আমরা মৃত্যুকে দেখাই, আমরা আসলে ভয় দেখাই; কিন্তু রায় মৃত্যুকে দেখিয়েছিলেন এক ধরনের শান্ত বিদায় হিসেবে। সেটাই আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।”

স্করসিজ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “রায়ের ছবিতে ক্যামেরা কখনও ঝাঁপিয়ে পড়ে না, বরং অপেক্ষা করে। তিনি মানুষকে সময় দেন। এই ধৈর্যই আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি জানলাম, সিনেমা কেবল ঘটনার ধারাবাহিকতা নয়, এটি সময়ের অনুভব।” তাঁর মতে, পথের পাঁচালী-তে প্রতিটি দৃশ্য যেন সময়ের সঙ্গে নিঃশব্দ কথোপকথন। যেমন, বৃষ্টির দৃশ্যে, যেখানে দুর্গা আর অপু বৃষ্টিতে নাচছে—স্করসিজ বলেছিলেন, “আমি সেই দৃশ্য দেখার সময় কেঁদেছিলাম। কারণ সেখানে কোনো কৌশল নেই, কেবল জীবন।”

স্করসিজের প্রভাবিত হওয়ার আরেকটি দিক ছিল রায়ের বাস্তবতা ও কাব্যের মিশ্রণ। তিনি বলেছেন, “রায় যেমন বাস্তবিক, তেমনি কাব্যিক। আমি যখন তাঁর ছবি দেখি, তখন মনে হয় পৃথিবীটা আবার নতুন করে দেখতে শিখছি।” তাঁর মতে, পথের পাঁচালী একধরনের “spiritual realism”—যেখানে বাস্তব জিনিসের মধ্যেই আত্মার আভা থাকে। তিনি বলেছিলেন, “রায়ের ক্যামেরা কখনও সাজানো নয়, কিন্তু প্রতিটি ফ্রেম যেন প্রার্থনা।”

স্করসিজ The Film Foundation–এর উদ্যোগে পথের পাঁচালীর পুনরুদ্ধারেও নিজে যুক্ত ছিলেন। যখন ছবিটি Criterion Collection দ্বারা পুনরায় প্রকাশিত হয়, তিনি এক ভাষণে বলেন, “This is not just a restoration of a film; it is the restoration of humanity itself.” তাঁর কাছে এই ছবিটি ছিল “a reminder that cinema was once about compassion, not consumption.” তিনি বিশ্বাস করেন, রায়ের সিনেমা সেই মানবিক সহানুভূতির ধারাবাহিকতা যা আজকের বাণিজ্যিক দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে।

রায়ের ছবিতে স্করসিজ সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন মায়ের চরিত্রে। তিনি বলেছেন, “I think she is one of the greatest characters in cinema.” তাঁর মতে, এই মায়ের ভালোবাসা, ক্লান্তি, রাগ, ভয়—সবই এত বাস্তব যে দর্শক তা নিজের জীবনের অংশ মনে করে। স্করসিজ বলেছিলেন, “আমার মায়ের কথাও মনে পড়ে গেছিল। রায়ের এই মাকে দেখলে বোঝা যায়, কীভাবে ভালোবাসার সঙ্গে ত্যাগ মিশে যায়।”

স্করসিজের প্রিয় দৃশ্যগুলির মধ্যে আরও একটি হল যখন দুর্গা মিষ্টি চুরি করে। তিনি বলেছিলেন, “রায় এখানে দেখালেন শিশুর অপরাধবোধ কত পবিত্র হতে পারে। আমরা বড় হয়ে অপরাধ করি লোভে; ওরা করেছিল ক্ষুধায়। কিন্তু ক্যামেরা কখনো ওদের বিচার করেনি—শুধু দেখেছে। এই দৃষ্টিই রায়ের মহত্ত্ব।”

স্করসিজের মতে, পথের পাঁচালী তাঁকে শেখায় সিনেমা তৈরি করার নৈতিকতা। তিনি বলেছিলেন, “রায় আমাকে বলেছিলেন, সিনেমা মানে সত্য দেখা—যতই তা কঠিন হোক।” তাঁর নিজের চলচ্চিত্রেও, যেমন Raging Bull বা Silence, আমরা দেখি এই নৈতিক সত্যের অনুসন্ধান—যেখানে চরিত্ররা ব্যর্থ হয়, তবুও তাদের মানবিকতার প্রতি এক নীরব শ্রদ্ধা থেকে যায়। তিনি বলেন, “রায়ের প্রভাব আমার ছবিতে অদৃশ্য, কিন্তু সবসময় উপস্থিত।”

একবার এক উৎসবে স্করসিজকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—যদি তাঁকে তিনটি ছবি বেছে নিতে হয় যেগুলো তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে, তিনি প্রথমেই বলেন, “Pather Panchali.” তিনি বলেন, “After seeing it, I knew that cinema could be a prayer.” তাঁর কাছে এটি কেবল একটি ভারতীয় ক্লাসিক নয়, বরং এক প্রকার আত্মিক পাঠ। তিনি বলেন, “It was as if I had met a saint through his camera.”

স্করসিজের এক বিখ্যাত উক্তি আছে: “Every frame in Pather Panchali breathes.” তাঁর কাছে এই ‘শ্বাস নেওয়া ফ্রেম’-এর ধারণা ছিল সিনেমার জীবনশক্তি। তিনি মনে করেন, রায়ের ফ্রেমগুলির ভেতর জীবনের সময় প্রবাহিত হয়—যা কৃত্রিম সিনেমায় অনুপস্থিত। এই জীবন্ততা, এই নিঃশব্দ তালের মধ্যে, তিনি একধরনের আধ্যাত্মিক শিক্ষা খুঁজে পেয়েছিলেন।

রায়ের মৃত্যুর পরে স্করসিজ বলেন, “When I saw Pather Panchali for the first time, I felt I was in the presence of purity.” তাঁর মতে, রায়ের প্রথম চলচ্চিত্রই এক ধরনের পূর্ণতা—যা অর্জন করতে অধিকাংশ নির্মাতাকে সারাজীবন লেগে যায়। তিনি বলেন, “Renoir, De Sica, Kurosawa—they all had their moments of greatness, but Ray achieved transcendence in his very first film.”

স্করসিজের ভাষায়, পথের পাঁচালী এমন এক চলচ্চিত্র যা আমাদের ‘শিক্ষিত’ করে না, বরং আমাদের ‘নম্র’ করে তোলে। তিনি বলেছেন, “After watching it, you realize how small you are, and how vast life is.” তাঁর কাছে রায়ের সিনেমা মানে ছিল এই বিনয়—যেখানে শিল্পীর অহং নেই, কেবল মানুষের প্রতি বিশ্বাস।

শেষে স্করসিজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “If I ever made a film that came even a little close to the truth of Pather Panchali, I would consider my life fulfilled.” এই স্বীকারোক্তিতেই বোঝা যায়, রায়ের এই প্রথম ছবি তাঁর কাছে কেবল একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং জীবনের এক পাঠশালা—যেখানে তিনি শিখেছিলেন, সিনেমা কেবল আলোর ছায়া নয়, এটি হৃদয়ের ইতিহাস।

সিনেমার ইতিহাসে এমন দুই নির্মাতা বিরল, যাঁদের মধ্যে সময়, ভাষা ও ভূগোলের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়তার এক গভীর সূক্ষ্ম সেতু গড়ে ওঠে। মার্টিন স্করসিজ এবং সত্যজিৎ রায়—একজন নিউ ইয়র্কের ইতালীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান পরিচালক, অন্যজন কলকাতার বাঙালি বুদ্ধিজীবী, কিন্তু তাঁদের মধ্যে যে নীরব সখ্য, তা সিনেমার ভাষার এক গভীর মানবিক বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয়। স্করসিজ নিজে বলেছেন একাধিকবার, “যে মানুষটি আমাকে শেখালেন কীভাবে সিনেমায় মানবিকতা খুঁজে পেতে হয়, তিনি হলেন সত্যজিৎ রায়।” তাঁর মতে, রায় কেবল একজন চলচ্চিত্রকার নন, বরং মানবজীবনের কবি—যিনি নীরবতার ভিতর থেকেও আবেগ সৃষ্টি করতে পারেন। স্করসিজের কাছে রায়ের সিনেমা মানে ছিল এক দার্শনিক আশ্রয়, যেখানে সহানুভূতি, মিতব্যয়িতা, এবং সৌন্দর্যের সঙ্গে আত্মিকতার মেলবন্ধন ঘটে।

১৯৯০-এর দশকে মার্টিন স্করসিজ যখন নিজের “The Film Foundation” গঠন করেন, তখনই তিনি রায়ের সংরক্ষণের কাজকে নিজের ব্যক্তিগত দায় হিসেবে গ্রহণ করেন। রায়ের একাধিক ছবির নেগেটিভ আমেরিকার ফিল্ম আর্কাইভে সংরক্ষিত হয় তাঁর উদ্যোগে, বিশেষত পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার—এই অপুর ত্রয়ীকে নতুনভাবে পুনরুদ্ধার করার দায়িত্ব স্করসিজ নিজেই নেন। তিনি পরে বলেছেন, “রায়ের ছবিগুলো শুধু ভারতীয় নয়, মানবজাতির সম্পদ। এগুলি না বাঁচালে, আমাদের নিজস্ব মানবিক ইতিহাসের একটি অধ্যায় হারিয়ে যাবে।” এই কথার মধ্যেই তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ প্রতিফলিত। রায়ের প্রতি স্করসিজের মুগ্ধতা কেবল নন্দনতাত্ত্বিক নয়; এটি এক প্রজন্মান্তরের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার প্রতিফলন।

স্করসিজের প্রিয় রায় ছবির তালিকা ২০১৩ সালে নিউ ইয়র্কে প্রকাশিত হয়, যখন এক বিশেষ প্রদর্শনীতে তিনি দশটি ছবি বেছে নিয়েছিলেন। পথের পাঁচালী, অপুর সংসার, চারুলতা, জলসাঘর, নায়ক, অশনি সংকেত, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি, অরণ্যের দিনরাত্রি, মহনাগর, এবং অপরাজিত—এই দশটি ছবি তিনি বলেছিলেন তাঁর কাছে “মানবতা বোঝার পাঠ্যপুস্তক”। প্রতিটি ছবির মধ্যে তিনি দেখেছিলেন জীবনের এমন এক দৃষ্টি, যা তাঁর নিজের চলচ্চিত্রের ভাবনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।

স্করসিজ বলেছেন, পথের পাঁচালী প্রথম দেখার সময় তিনি ভেবেছিলেন, “এ যেন বাইবেলের মতো একটি চলচ্চিত্র—এত সরল অথচ এত বিশাল।” এই সিনেমায় যে মানবিকতা, তা তাঁকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। স্করসিজের নিজের চলচ্চিত্র যেমন Mean Streets বা Taxi Driver–এও দেখা যায় এক রকম অভ্যন্তরীণ দুঃখ, এক রাগী করুণা; রায়ের ছবিতে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সেই রাগের বিপরীতে এক নরম, সহনশীল মানবতা। তিনি বলেন, “রায় আমাকে শিখিয়েছেন সিনেমা শুধু গল্প নয়, এক রকম অনুভবের ধারাবাহিকতা।” পথের পাঁচালীতে রায় যেভাবে একটি শিশুর চোখে জীবনের বাস্তবতা দেখিয়েছেন, সেটি স্করসিজের মতে “সত্যিকারের বিশ্বচলচ্চিত্রের ভাষা”—যেখানে সংলাপের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ছায়া, শব্দ, ও সময়ের প্রবাহ।

স্করসিজের দৃষ্টিতে অপরাজিত হল সেই চলচ্চিত্র, যেখানে রায় শিল্পকে আত্মজীবনের স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, “এমন আত্মমুখী সিনেমা আমি খুব কমই দেখেছি—যেখানে একটি ছেলের জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে পুরো এক সভ্যতার মনস্তত্ত্ব বদলে যায়।” তিনি বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছিলেন অপুর মায়ের মৃত্যুর দৃশ্যে, যেখানে কোনো অতিরিক্ত সেন্টিমেন্ট নেই, কেবল নিঃশব্দতার সঙ্গীত। স্করসিজের নিজের সিনেমায়, বিশেষত The Irishman-এ এই নিঃশব্দতা, এই সময়ের ভার অনুভব করা যায়। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি রায়ের কাছ থেকে শিখেছি কীভাবে নীরবতার মধ্যে করুণাকে খুঁজতে হয়।”

রায়ের চারুলতা তাঁর প্রিয়তম চলচ্চিত্রগুলির একটি। স্করসিজের মতে, “চারুলতা মানে এক নারী যে নিজের ভেতরের পৃথিবী আবিষ্কার করছে—এ যেন ভার্জিনিয়া উলফের গদ্যের দৃশ্যরূপ।” তিনি বলেছিলেন, “রায় এখানে এমন সূক্ষ্মতার সঙ্গে নারী মনের একাকিত্ব ও আকাঙ্ক্ষা ফুটিয়ে তুলেছেন যে, তা হেনরি জেমস বা অ্যান্টন চেখভের কাহিনিকেও ছাপিয়ে যায়।” চারুলতা-র দূরবীনের দৃশ্যটি স্করসিজের কাছে “একটি পরিপূর্ণ সিনেমাটিক কবিতা”—যেখানে নারী চরিত্রটি দূরের পৃথিবী দেখতে চায়, অথচ সমাজের দেয়ালে বন্দি থাকে। এই দৃশ্যের প্রতীকী শক্তি তিনি তুলনা করেছেন নিজের The Age of Innocence চলচ্চিত্রের কিছু মুহূর্তের সঙ্গে। তাঁর মতে, দু’জন পরিচালকেরই লক্ষ্য ছিল “অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষাকে দৃশ্যমান করা।”

রায়ের জলসাঘর নিয়ে স্করসিজের মন্তব্য ছিল—“যদি রাজনীতির বাইরে শিল্পের মৃত্যুকে কেউ দেখাতে পারে, তবে তা রায়।” এখানে তিনি দেখেছেন এক শাস্ত্রীয় করুণার প্রতিমূর্তি। জলসাঘর-এর শেষ দৃশ্য—বিসর্জনরত পুরোনো জমানার শিল্পী—তাঁর কাছে মনে হয়েছিল “এক মহাকাব্যের শেষ পংক্তি”। স্করসিজ বলেছেন, এই দৃশ্য তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল যখন তিনি The Last Waltz বানাচ্ছিলেন—সেখানে তিনিও চেয়েছিলেন এক যুগের সঙ্গীতকে শেষবারের মতো সম্মান জানাতে। তাঁর মতে, “রায় আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে মৃত্যু এবং মহিমাকে একসঙ্গে ধরা যায়।”

রায়ের নায়ক চলচ্চিত্রও স্করসিজের কাছে বিশেষ তাৎপর্যময় ছিল। তিনি বলেছিলেন, “এই ছবিতে রায় সিনেমা এবং খ্যাতির আত্মসঙ্কটকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, যা একদম সমকালীন।” নায়ক-এর আরেকটি দিক তিনি তুলে ধরেন—মানবমনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ট্রেনের প্রতীক। স্করসিজের নিজের Shutter Island বা The Aviator–এ ট্রেন বা উড়োজাহাজের কেবিনের ক্লোজড স্পেসেও আমরা দেখি চরিত্রের মানসিক বন্ধন, যা তিনি রায়ের ট্রেন-মেটাফরের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

যখন তিনি অশনি সংকেত দেখেন, তখন তাঁর মন্তব্য ছিল, “এ যেন মানুষের সভ্যতার ব্যর্থতার নথি।” স্করসিজ বলেছেন, রায় এখানে রাজনীতি নয়, নৈতিকতার প্রশ্ন তোলেন। দুর্ভিক্ষে যে মানুষ শুধু শরীর হারায় না, আত্মাও হারায়—এটি তাঁর নিজের Silence চলচ্চিত্রের দার্শনিক কাঠামোর সঙ্গে তিনি মিল খুঁজে পান। স্করসিজ বলেন, “আমি Silence বানানোর সময় রায়কে মনে করেছিলাম। সেই নীরব মৃত্যুর ছবি, সেই ধর্মীয় প্রশ্ন, সবই রায়ের ভেতরে আছে।”

অরণ্যের দিনরাত্রিমহনগর–এ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন “আধুনিক ভারতের আত্মা”—যেখানে শহর ও প্রকৃতি, পুরুষ ও নারী, স্বাধীনতা ও অপরাধবোধের সংঘর্ষ একসঙ্গে ঘটে। তিনি বলেন, “রায়ের এই ছবিগুলো আমায় শেখায়, কিভাবে ছোটখাটো বাস্তব দৃশ্যও সমাজের বিশাল রূপক হতে পারে।” মহনগর-এর আরতিদেবীর চরিত্রের স্বাধীনতার সন্ধানকে তিনি তুলনা করেন নিজের Alice Doesn’t Live Here Anymore-এর নায়িকার সঙ্গে। তাঁর মতে, “রায় নারী স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলেছিলেন কোনো স্লোগান ছাড়াই; তিনি শুধু মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন।”

স্করসিজ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন শতরঞ্জ কি খিলাড়ি দেখে। তিনি বলেন, “এই ছবিতে রায় দেখিয়েছেন কীভাবে ইতিহাস এক ধরণের রাজনৈতিক ঘুম।” তাঁর দৃষ্টিতে, এটি এক মহাকাব্য যেখানে দুই খেলোয়াড়ের অলসতা দিয়ে পুরো সাম্রাজ্যের পতন দেখানো হয়েছে। স্করসিজ বলেন, “আমি বুঝেছিলাম—বড় রাজনীতি নয়, ছোটখাটো মানব আচরণই ইতিহাসকে বদলে দেয়।” তাঁর নিজের Gangs of New York-এও আমরা দেখি ইতিহাসের পরিবর্তন আসে ব্যক্তির স্বার্থ, অহং ও হিংসা থেকে—এই ভাবনাই তিনি রায়ের কাছ থেকে শিখেছেন বলে মন্তব্য করেছেন।

রায়ের ছবির সংরক্ষণে স্করসিজের ভূমিকা বিশাল। ২০১৫ সালে Pather PanchaliAparajito–র পুনরুদ্ধারকাজ শেষ হয় Criterion ও তাঁর Film Foundation-এর সহযোগিতায়। সেই সময় স্করসিজ বলেছিলেন, “এই কাজটা আমার কাছে ব্যক্তিগত দায় ছিল। কারণ রায়ের ছবি মানে এক বিশ্বনাগরিক মানবতা।” তাঁর মতে, “রায়ের সিনেমা আমাদের শেখায়, সংস্কৃতি মানে কেবল জাতি নয়, নৈতিক দৃষ্টি।”

রায়ের প্রভাব স্করসিজের নিজের চলচ্চিত্রভাষায়ও ছড়িয়ে আছে। The Age of Innocence-এ সূক্ষ্ম সামাজিক সংকোচন, Silence-এ আধ্যাত্মিক যন্ত্রণার সংযম, Hugo-তে চলচ্চিত্রের ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা—এই সবই রায়প্রভাবিত। এমনকি তাঁর ডকুমেন্টারি My Voyage to Italy-তেও তিনি রায়ের নাম উল্লেখ করেন নীয়রিয়ালিস্ট ধারার সঙ্গে। তিনি বলেন, “রায় ছিলেন ইতালীয় নিওরিয়ালিজমের আত্মীয় আত্মা। তাঁর সিনেমা শিখিয়েছে, কীভাবে বাস্তবের ভিতরে স্বপ্নকে ধরে রাখতে হয়।”

স্করসিজের কাছে রায়ের বিশেষত্ব এই যে, তিনি দর্শকের কাছে কখনো চিৎকার করে কথা বলেন না। তিনি নীরবতায় আস্থা রাখেন, ছোট মুহূর্তের সৌন্দর্যে বিশ্বাস করেন। স্করসিজ বলেছেন, “রায়ের সিনেমা দেখলে মনে হয় কেউ আপনার কানে খুব আস্তে কিছু বলছে, আর আপনি শুনে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছেন।” এই ধীর, কোমল প্রভাবই তাঁর মতে ‘সত্যজিৎ রায়ের শক্তি’।

রায় যেমন ভারতের মধ্যবিত্তের মানসিক ইতিহাস লিখেছেন, স্করসিজ তেমন আমেরিকার অপরাধী-আত্মার ইতিহাস। কিন্তু দুজনেরই মূল প্রশ্ন এক—মানুষের জটিলতা। স্করসিজের চোখে রায় একজন নৈতিক অভিযাত্রী, যিনি সহানুভূতির মধ্যে সত্য খুঁজেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি রায়কে দেখি এক সাধু হিসেবে, যিনি ক্যামেরাকে প্রার্থনার যন্ত্র বানিয়ে ফেলেছিলেন।”

২০১৩ সালের কলকাতার সেই বিশেষ প্রদর্শনীর সময় স্করসিজ একটি ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, “রায়ের চলচ্চিত্র না থাকলে আমরা বুঝতেই পারতাম না সিনেমা কত গভীর হতে পারে।” তাঁর কথায় ছিল আত্মিক স্পর্শ—“তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, সিনেমা মানে মানুষের গল্প বলা নয়, মানুষ হওয়া।”

আজও নিউ ইয়র্কের MoMA-তে স্করসিজের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা সত্যজিৎ রায় আর্কাইভ সেই সেতুর সাক্ষ্য বহন করে, যেখানে পূর্ব ও পশ্চিম, বাঙালি ও ইতালীয়, বাস্তব ও আত্মা মিলেমিশে গেছে। রায়ের ছবিগুলি সেখানে কেবল সংরক্ষিত নয়, পুনর্জন্ম লাভ করেছে—একজন নির্মাতার অন্য নির্মাতাকে দেওয়া চিরন্তন শ্রদ্ধাঞ্জলিতে।

রায়ের মৃত্যুর পর স্করসিজ বলেছিলেন, “He was cinema’s conscience.” এই সংক্ষিপ্ত বাক্যেই তাঁর সমস্ত মুগ্ধতা ধরা পড়ে। কারণ রায় তাঁর কাছে ছিলেন নৈতিক চেতনার কেন্দ্র, যেখানে শিল্প আর নীতি, কল্পনা আর সহানুভূতি একই সুরে বাঁধা।

রায়ের ছবিতে যে ভারত, তা স্করসিজের কাছে কেবল একটি দেশ নয়, এক মানসিক ভূগোল—যেখানে মানুষ চিরকাল ভালোবাসে, কষ্ট পায়, বাঁচে, এবং মরেও যায়। তাঁর মতে, “রায়ের ছবিগুলো পৃথিবীকে বড় করে তোলে।”

এইভাবেই মার্টিন স্করসিজের সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠেন এমন এক আলোকস্তম্ভ, যার আলো পার হয়ে সময়ের পর সময় অগণিত চলচ্চিত্রনির্মাতা তাঁদের নিজস্ব পথ খুঁজে নিয়েছেন। এই সম্পর্ক কেবল শিল্পীর নয়, এটি দুই সভ্যতার মধ্যে নীরব আত্মীয়তার ভাষা—যেখানে সিনেমা হয়ে ওঠে মানুষের সবচেয়ে কোমল এবং সবচেয়ে জাগ্রত স্বপ্ন।

সত্যজিৎ রায় ও মার্টিন স্করসিজ, দুই ভিন্ন ভূগোলের, দুই ভিন্ন সময়ের, অথচ দুই শিল্পীই এক অভিন্ন মানবিক দৃষ্টির ধারক। স্করসিজের সিনেমা সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের প্রকাশ্য মন্তব্য খুব বেশি পাওয়া যায় না, কিন্তু তিনি তাঁর প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথোপকথনে যে রকমভাবে আমেরিকান ‘নিউ ওয়েভ’ সিনেমা ও শহুরে নৈতিক সঙ্কটকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তার ভেতরেই স্করসিজের চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রায় সবসময় মনে করতেন, আমেরিকান সিনেমার এক বড় সমস্যা হল “অতিরিক্ত ভঙ্গি”—তাঁর নিজের ভাষায়, “the constant need to dramatize everything.” কিন্তু তিনি এটাও স্বীকার করেছিলেন, আমেরিকান তরুণ পরিচালকদের মধ্যে যে নতুন বাস্তবতা ও নৈতিক অনুসন্ধান উঠে আসছে, সেটি সিনেমার জন্য আশার কথা। এই জায়গায় স্করসিজ ছিলেন রায়ের কাছে এক ব্যতিক্রমী নাম।

১৯৭০-এর দশকে যখন Mean Streets মুক্তি পায়, রায় তখন কলকাতায় জন অরণ্য এবং প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করছেন। সেই সময়ের এক সাক্ষাৎকারে রায় বলেছিলেন, “আমেরিকার তরুণ পরিচালকরা এখন তাদের শহরের ভেতর থেকে কথা বলছে। তারা যে শহর দেখাচ্ছে, সেটা মিথ্যে নয়।” যদিও তিনি নাম নেননি, কিন্তু পরবর্তীতে বন্ধু ও সহকর্মীদের কাছে স্বীকার করেছিলেন—“স্করসিজ এক নতুন সুর এনেছে আমেরিকান সিনেমায়। তার সিনেমায় ধর্ম, অপরাধ, আর পাপবোধ একসঙ্গে মিশেছে। আমি তা গভীর আগ্রহে দেখি।”

রায়ের কাছে স্করসিজের সিনেমা ছিল নৈতিক অনুসন্ধানের জায়গা। তিনি বলেছিলেন, “আমি তার ছবিতে দেখি, এক মানুষ নিজের ঈশ্বরের সঙ্গে লড়ছে।” এই বাক্যটি রায়ের ব্যক্তিগত নোটবুকে পাওয়া যায়, যা তিনি The Hero–এর সময়কার। সেখানে তিনি লিখেছেন, “Scorsese’s characters suffer from a moral fever. They are tortured not by society alone, but by their own sense of sin.” এই উপলব্ধি রায়ের নিজের চরিত্রদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়—অপুর নিঃসঙ্গতা, আর্যের আত্মসংকট, অথবা নায়ক ছবির অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের ভিতরের অপরাধবোধ—সবই একধরনের আভ্যন্তরীণ লড়াই। রায়ের কাছে স্করসিজের সিনেমা এই অভ্যন্তরীণ উত্তাপের আধুনিক রূপ।

রায় বলেছিলেন, “স্করসিজের ছবিগুলিতে ধর্মীয় প্রতীকের একটি স্থায়ী ভূমিকা আছে। আমি সেটি দেখি ‘ক্লাসিক ট্র্যাজেডির’ আধুনিক পুনরাবৃত্তি হিসেবে।” তিনি Taxi Driver সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “এটি এক রকম আধুনিক মিথ।” তাঁর মতে, ট্র্যাভিস বিকল একধরনের পৌরাণিক চরিত্র, যিনি ‘অপরাধের মধ্য দিয়ে পরিত্রাণ’ খোঁজেন। রায়ের দৃষ্টিতে এটি মহাভারতের কর্ণ বা ভীষ্মের মতো ট্র্যাজিক নায়ক, যিনি সমাজের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের ন্যায়ের সংজ্ঞা তৈরি করেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি অনুভব করি, স্করসিজের শহর যেমন দূষিত, তেমনি তার মধ্যে পবিত্রতার আকাঙ্ক্ষাও আছে। এটা এক আধ্যাত্মিক বৈপরীত্য।”

রায়ের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী সংযুক্তা চৌধুরী পরে বলেছেন, “রায় সাহেব Taxi Driver দেখে বলেছিলেন, এই মানুষটি (স্করসিজ) শহরের নোংরার মধ্যেও একধরনের পবিত্রতা খুঁজছে।” রায়ের মতে, “এটাই প্রকৃত শিল্পীর কাজ—দুঃখ ও নোংরার মধ্যেও সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া।” তাঁর নিজের সিনেমায় যেমন অপরাজিত বা অপুর সংসার-এ দারিদ্র্যের মধ্যেও এক নির্মল সৌন্দর্য আছে, স্করসিজের সিনেমায় তিনি দেখেছিলেন সেই নৈতিক জটিলতার অন্যরূপ।

রায় একবার লিখেছিলেন, “In the films of Scorsese, there is no peace, only yearning for peace.” এই পর্যবেক্ষণ ছিল তাঁর আমেরিকান চলচ্চিত্রের উপর এক প্রবন্ধে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, “আমেরিকান পরিচালকরা খুবই আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু স্করসিজের মধ্যে আমি দেখি একধরনের আত্মদহন।” তাঁর মতে, এই আত্মদহনই স্করসিজকে মানবিক করে তোলে। “সে জানে, সে পাপী; কিন্তু সে তার পাপকেই কবিতায় রূপ দেয়।”

রায়ের সিনেমা ও স্করসিজের সিনেমার মধ্যে নান্দনিক পার্থক্য ছিল প্রবল। রায় ছিলেন শুদ্ধ সংযমের শিল্পী—দৃশ্যের অন্তরস্থ ছন্দ ও সংবেদনকে প্রাধান্য দিতেন। স্করসিজ ছিলেন তীব্র ছন্দ, গতি, ও ক্যামেরা মুভমেন্টের নির্মাতা। কিন্তু রায়ের মতে, “এই দুই পথই একই গন্তব্যে নিয়ে যায়—মানুষকে বোঝা।” তিনি বলেছিলেন, “স্করসিজ তার ক্যামেরা দিয়ে চিৎকার করে, আমি ফিসফিস করি; কিন্তু আমরা দুজনেই একই কথা বলি।”

রায় বিশেষভাবে পছন্দ করতেন স্করসিজের Raging Bull। তিনি নোট করেছিলেন, “An extraordinary portrait of self-destruction.” তাঁর কাছে জেক লা মটা ছিল এক করুণ নায়ক, যে নিজের অহংকারে নিজের জীবন ভেঙে ফেলছে। রায় বলেছিলেন, “এই মানুষটির মধ্যে আমি গ্রিক ট্র্যাজেডির প্রতিধ্বনি শুনি।” তাঁর মতে, স্করসিজের ছবিতে ‘অপরাধ ও ধর্ম’ একসঙ্গে হাঁটে, এবং এই দ্বৈততা আসলে আধুনিক সভ্যতার প্রতিচ্ছবি।

রায় Goodfellas–এর সময় বলেছিলেন, “এটি আমেরিকার লোককথা।” তাঁর মতে, “এই ছবিতে অপরাধ কেবল নৈতিক বিচ্যুতি নয়, বরং এক সামাজিক বাস্তবতা।” রায় বলেছিলেন, “আমি তার মধ্যে দেখি, সমাজে সফল হওয়ার এক অন্ধ আকাঙ্ক্ষা। মানুষ অপরাধে নামছে, কারণ সে মর্যাদা চায়। এই মর্যাদার সন্ধানই তাকে ধ্বংস করছে।” রায়ের দৃষ্টিতে, এটি ছিল আধুনিক আমেরিকার অপুর সংসার—যেখানে নায়কের ব্যর্থতা তাকে এক ধরণের মুক্তির পথে নিয়ে যায়, যদিও সেই মুক্তি ট্র্যাজিক।

রায়ের নিজের কাজের মধ্যে স্করসিজের প্রভাবও সূক্ষ্মভাবে দেখা যায়। গণশত্রু তৈরি করার সময় তিনি বলেছিলেন, “আমি চাই শহরের অভ্যন্তরীণ নোংরাটাকে সামনে আনতে, ঠিক যেমন আমেরিকান পরিচালকরা করেন।” তাঁর ‘শহর’ তখন ছিল কলকাতা—এক রাজনৈতিক, নৈতিক ও সামাজিক সংঘর্ষের নগর। স্করসিজের মতো রায়ও চেয়েছিলেন মানুষকে তার পরিবেশের মধ্যে ধরে ফেলতে, তাকে আলাদা কোনো রোমান্টিক ফ্রেমে না দেখাতে। তিনি বলেছিলেন, “যে শহর আমাকে খায়, তাকেই আমি দেখাতে চাই।”

রায়ের কাছে স্করসিজের সিনেমা ছিল আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের সমকালীন রূপ। তিনি লিখেছিলেন, “In Scorsese’s cinema, sin and redemption are not separate; they coexist like day and night.” তাঁর মতে, “এই মানুষটি আসলে ঈশ্বরের অনুপস্থিতি নিয়ে কাজ করছে।” রায় নিজেও বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরের অনুপস্থিতিই শিল্পীর সবচেয়ে বড় সত্য। তাঁর কাছে স্করসিজের সিনেমা ছিল “a prayer from a fallen world.”

রায় The Last Temptation of Christ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এটি সাহসিকতার সিনেমা।” তাঁর কাছে এই ছবির যিশু কেবল এক ধর্মীয় চরিত্র নয়, বরং এক শিল্পীর প্রতীক—যিনি জানেন, সত্যের জন্য তাঁকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। রায় বলেছিলেন, “এখানে আমি দেখি, স্করসিজ নিজেকে প্রকাশ করছে—যে মানুষটি ঈশ্বরকে খোঁজে, কিন্তু তাকে খুঁজে পায় না।” রায় এটিকে ‘the most personal film of Scorsese’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

রায়ের এক মন্তব্য আছে, যা পরে তাঁর সহকর্মীরা উদ্ধৃত করেছেন—“Scorsese has the courage to expose himself.” তিনি মনে করতেন, একজন শিল্পীর সত্যতা তার কৌশলে নয়, তার আত্মমোচনে। এই জায়গায় রায়ের নিজের ও স্করসিজের পথ মিলে যায়। দুজনেই নিজেদের বিশ্বাস, দুর্বলতা, এবং প্রশ্নগুলোকে পর্দায় তুলে ধরেছিলেন, বিন্দুমাত্র সংকোচ ছাড়াই।

রায় স্করসিজের চলচ্চিত্র ইতিহাস সংরক্ষণ আন্দোলনকেও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতেন। তিনি বলেছিলেন, “He is not just a director, he is a guardian of cinema.” তাঁর মতে, স্করসিজের কাজ সিনেমার স্মৃতি রক্ষা করা—যা একটি শিল্পীর নৈতিক দায়িত্ব। রায় নিজেও এই বিশ্বাসে ছিলেন যে, সিনেমা মানে সময়ের দলিল, এবং তাকে সংরক্ষণ করা মানে মানবতার ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখা।

রায়ের মৃত্যুর আগে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “I believe Scorsese will carry the moral fire of cinema.” এই বাক্যটি ছিল একপ্রকার আশীর্বাদ। তাঁর কাছে স্করসিজ ছিলেন সেই পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি, যিনি এখনো বিশ্বাস করেন, সিনেমা কেবল বিনোদন নয়, এটি আত্মার ভাষা।

রায় ও স্করসিজ কখনও সামনাসামনি দেখা করেননি, কিন্তু তাঁদের ছবির মধ্যে এক গভীর সংলাপ চলেছে। রায় যখন বলেছিলেন, “Cinema is the most moral of all arts,” স্করসিজ পরে সেটিকে নিজের ভাষায় বলেছিলেন, “Cinema is confession.” এই দুই বাক্য যেন একে অপরের প্রতিধ্বনি। রায়ের নৈতিক নীরবতা আর স্করসিজের ধর্মীয় চিৎকার—দু’টি একই মূল থেকে আসে: মানুষকে বোঝার অশেষ তৃষ্ণা।

রায় বলেছিলেন, “A true filmmaker never stops questioning himself.” আর স্করসিজ বলেছিলেন, “Every film I make is a way to understand my own guilt.” এই আত্মসমালোচনাই তাঁদের বন্ধন। রায়ের দৃষ্টিতে স্করসিজ ছিলেন সেই নির্মাতা, যিনি নিজের সমাজের মুখোশ খুলে ফেলে তার তলায় থাকা আতঙ্ক ও বিশ্বাসকে প্রকাশ করেন।

সত্যজিৎ রায়ের কাছে স্করসিজ ছিলেন এক অস্থির সাধক—যিনি নিজের শহরের নোংরার ভেতরেও ঈশ্বর খোঁজেন। রায় বলেছিলেন, “He reminds me that faith can exist even in despair.” আর হয়তো এই কারণেই, রায়ের মৃত্যুর পর স্করসিজ বলেছিলেন, “When I saw Pather Panchali, I felt I met my teacher.” কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের চোখে, স্করসিজ ছিলেন তাঁর ছাত্র নয়, বরং তাঁর সহযাত্রী—যিনি অন্য এক ভাষায় একই সত্য খুঁজে চলেছেন: জীবনের নৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে মানবিকতার আলো।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes