
তামিল সিনেমা ও সাহিত্য
অদ্বৈত গোস্বামী
তামিল সাহিত্য ও তামিল সিনেমা একে অপরের ছায়া, প্রতিধ্বনি এবং রূপান্তর। দক্ষিণ ভারতের এই অঞ্চলে সাহিত্য শুধুমাত্র পাঠ্য বা কাব্য নয়, এটি মানুষের বেঁচে থাকার, আত্মমর্যাদার, প্রতিরোধের এবং সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রতীক। তামিল ভাষা বিশ্বের প্রাচীনতম জীবিত ভাষাগুলির একটি, আর সেই ভাষার সাহিত্য ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। সেই ঐতিহ্যের শিকড়ে রয়েছে সাংগম যুগের কবিতা—“আকনানুরু”, “পুরনানুরু”, “নট্ট্রিনাই”, “পথুপাট্টু”—যেখানে প্রেম, যুদ্ধ, প্রকৃতি, নীতি ও সমাজের ছন্দ মিলেমিশে এক মানবতাবাদী বিশ্বদৃষ্টি নির্মাণ করেছে। এই সাহিত্যই তামিল সংস্কৃতির ভিত, যার রক্তস্রোত আজও বইছে তামিল সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যে, সংলাপে ও গানে। তামিল সিনেমা জন্ম থেকেই সাহিত্যনির্ভর, কারণ তামিল সমাজে সাহিত্য নিজেই জীবনের ভাষা, রাজনীতির অস্ত্র এবং সংস্কৃতির মাপকাঠি।
প্রথম যুগের তামিল সিনেমা, অর্থাৎ ১৯৩০ থেকে ৫০-এর দশক, মূলত পৌরাণিক ও সাহিত্যিক উপাখ্যান থেকে গড়ে ওঠে। “হরিশচন্দ্র”, “আলিবাবা”, “চন্দ্রলেখা”, “মরুধা নায়াগী”, “রাজা হরিশচন্দ্র”—এইসব চলচ্চিত্রে পুরাণের কাহিনি, ধর্মীয় নীতি এবং কবিতার কল্পনা সিনেমার প্রাথমিক ভাষা তৈরি করে। এই সময়ে সাহিত্য ও নাট্যজগত একে অপরের পরিপূরক ছিল। তামিল নাট্যসাহিত্য, বিশেষত সি. এন. আন্নাদুরাই, এম. করুণানিধি, কবি রাজা প্রমুখ লেখকদের নাটক, তামিল সিনেমায় গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁদের নাটকগুলি সমাজসংস্কারের ভাষা, জাতপাতবিরোধী আন্দোলন এবং ড্রাভিডিয়ান চিন্তাধারার বাহক। সাহিত্যিক ভাষা তখন রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিল, আর সিনেমা তার প্রচারের মাধ্যম।
ড্রাভিডিয়ান আন্দোলন তামিল সিনেমার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে। আন্নাদুরাই ও করুণানিধির নাটক ও গল্পে যে সামাজিক বিপ্লবের আহ্বান ছিল—শূদ্রদের আত্মসম্মান, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা, তামিল ভাষার মর্যাদা রক্ষা—তা সিনেমায় প্রবলভাবে ধ্বনিত হয়। করুণানিধির চিত্রনাট্য “পরাশক্তি” (১৯৫২, পরিচালনা: কৃষ্ণান-পাঞ্জু, অভিনয়ে: শিবাজি গণেশন) তামিল সিনেমায় এক ঐতিহাসিক মোড় আনে। এই সিনেমা কেবল পারিবারিক নাটক নয়, এটি সাহিত্যিক রাজনৈতিক ইশতেহার—যেখানে সংলাপে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ব্যঙ্গ, ভাষায় তামিল জাতিসত্তার গর্ব, আর ভাবনায় সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদ। করুণানিধি নিজে ছিলেন সাহিত্যিক, তাঁর গদ্য ও সংলাপের মিশ্রণ তামিল সাহিত্যের নবজাগরণের অংশ হয়ে ওঠে। এই সিনেমার পর থেকে তামিল চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে সামাজিক মতাদর্শ প্রচারের প্রধান মাধ্যম।
এই সময়েই তামিল সাহিত্য নতুন দিক নেয়। সুব্রহ্মণিয়ন ভারতী (১৮৮২–১৯২১), যিনি আধুনিক তামিল কবিতার জনক, তাঁর কবিতায় যেমন নারী স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও ভাষার গৌরব প্রকাশ পায়, তেমনি তামিল সিনেমায় সেই বিষয়গুলি বারবার ফিরে আসে। ভারতীর কবিতায় “তামি দেমা” বা “পুন্ধানাই”–এর মতো চিত্রকল্প তামিল সিনেমার গানে সুর পায়। তিনি যেমন লিখেছিলেন—“আমরা সবাই মানুষ, ধর্ম বা জাত নয় আমাদের পরিচয়”—তেমনি এম. জি. রামচন্দ্রন (এমজিআর) অভিনীত সিনেমাগুলিতে সেই সাহিত্যিক মানবতাবাদ ও সামাজিক সমতার বাণী গর্জে ওঠে।
এমজিআর তামিল সিনেমার ইতিহাসে এক অনন্য চরিত্র। তিনি ছিলেন সাহিত্যপাঠক, নাট্যাভিনেতা এবং ড্রাভিডিয়ান রাজনীতির প্রতীক। তাঁর চলচ্চিত্র যেমন “অধ্যাপ্পান”, “নাডোডি মানান”, “এন আন্না”—সবই সাহিত্যিক ও নৈতিক রূপক। এইসব সিনেমায় এমজিআরকে দেখা যায় সাধারণ মানুষের নায়ক হিসেবে, যিনি দমননীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ান, দরিদ্রদের পাশে থাকেন, আর ভাষার গৌরব রক্ষা করেন। এমজিআরের সিনেমার গানগুলির গীতিকাররা যেমন বৈরামুথু বা কান্নদাসন, তাঁরা সকলেই সাহিত্যিক ভাষাকে চলচ্চিত্রে এনেছেন। কান্নদাসনের কবিতা যেমন হৃদয়ের অন্তরঙ্গ ভাষায় লেখা, তেমনি তাঁর গানে সাহিত্যিক ছন্দ ও দার্শনিক বোধের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
তামিল সাহিত্যের আধুনিক যুগে উপন্যাস ও ছোটগল্পের বিকাশ ঘটে ১৯৪০–৬০ দশকে। এই সময়ের সাহিত্য সামাজিক বাস্তবতা, নগরজীবনের একাকিত্ব, শ্রেণি ও জাতিগত বৈষম্য, নারী-পুরুষ সম্পর্কের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে। জয়কান্তন, পি. শিবকামি, ডি. জে. রাজারাজন, আঃ মাধবন, অ্যাম্বাই—এই লেখকরা নতুন তামিল সাহিত্যিক চেতনা নির্মাণ করেন। তাঁদের গল্পে দেখা যায় শহরের মধ্যবিত্ত মানুষের বিভ্রান্তি, সমাজের নৈতিক ভঙ্গুরতা, এবং ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সঙ্কট। এই সাহিত্যিক আবহ তামিল সিনেমার দ্বিতীয় নবজাগরণ ঘটায়।
এস. বালাচন্দ্র, কে. বালচন্দ্র, ভেত্রিমারন বা ভারতীরাজা—এই পরিচালকরা সাহিত্যিক বাস্তবতাকে সিনেমায় রূপ দেন। কে. বালচন্দ্রর “অভিনোত্রী”, “অরঙ্গর” বা “তাপ্পু থালঙ্গা”—সবই সমাজের মানসিক ও নৈতিক দ্বন্দ্বের গল্প, যা সরাসরি জয়কান্তনের সাহিত্যিক চরিত্রের সঙ্গে মেলে। জয়কান্তনের “সিলা নেরাঙ্গলিল সিলা মণিথারগল” (Some men in some times) গল্প থেকে তৈরি সিনেমাটি ১৯৭৭ সালে পরিচালনা করেন এ. ভি. রাজা। এটি প্রেম, সমাজ ও যৌন নৈতিকতার দ্বন্দ্ব নিয়ে একটি সাহসী সাহিত্যিক ব্যাখ্যা, যা তামিল সিনেমাকে বাস্তবতাবাদের নতুন স্তরে নিয়ে যায়।
তামিল সাহিত্য ও সিনেমার মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সেতু হল ইতিহাস ও জাতিগত স্মৃতি। কালকী কৃষ্ণমূর্তী এই ধারার প্রধান নাম। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস “পোন্নিয়িন সেলভান” (১৯৫০-এর দশক) চোল রাজবংশের রাজনীতি, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা ও যুদ্ধের এক মহাকাব্যিক কাহিনি। এটি তামিল পাঠকের কাছে জাতির ইতিহাসের গৌরবের প্রতীক। বহু দশক পরে মানি রত্নম এই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন। “পোন্নিয়িন সেলভান” (PS-I, PS-II) সিনেমায় কালকীর গদ্য যেন দৃশ্যের মাধ্যমে পুনর্জন্ম নেয়। মানি রত্নমের সিনেমায় ইতিহাস, রাজনীতি ও রোমান্স সাহিত্যিক ভাষায় কথা বলে; চরিত্রের সংলাপে থাকে কবিতার সুর, দৃশ্যে থাকে গদ্যের ভারসাম্য। এটি দেখায় কীভাবে সাহিত্য ও সিনেমা মিলে এক সাংস্কৃতিক কল্পনা নির্মাণ করতে পারে।
আধুনিক তামিল সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী নাম পেরুমল মুরুগান। তাঁর উপন্যাস “মাধোরুভাগন” (One Part Woman) ২০১০-এর দশকে তামিল সমাজে গভীর বিতর্ক সৃষ্টি করে। এই উপন্যাসে এক দম্পতির সন্তানহীনতার কষ্ট ও ধর্মীয় রীতির অমানবিকতা তুলে ধরা হয়েছে। সমাজের চাপ, নারীর দেহের উপরে পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ মুরুগান সাহসের সঙ্গে লিখেছেন, তা পরবর্তীকালে তামিল সিনেমার দিকনির্দেশ দিয়েছে। পা. রঞ্জিত, মারি সেলভারাজ, ভেত্রিমারন প্রমুখ পরিচালকেরা তাঁদের সিনেমায় একই প্রশ্ন তুলেছেন—জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও মর্যাদা সম্পর্কে সমাজের ভণ্ডামি ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন।
পা. রঞ্জিতের “কবালি” (২০১৬) বা “সারপট্টা পরম্বরাই” (২০২১), মারি সেলভারাজের “পারিয়ারুম পেরুমল” (২০১৮) বা “কর্ণন” (২০২১), ভেত্রিমারনের “আসুরন” (২০১৯)—সবই সাহিত্যিক সমাজবাস্তবতার সিনেমাটিক রূপ। “পারিয়ারুম পেরুমল” পেরুমল মুরুগানের সাহিত্যিক চেতনার উত্তরসূরি—জাতিভেদের বিরুদ্ধে এক নীরব কিন্তু তীব্র প্রতিবাদ। সিনেমায় যে সংলাপ, চিত্ররূপ ও মেটাফর ব্যবহার করা হয়েছে, তা সাহিত্যের উপমার মতোই শক্তিশালী। এরা সকলেই তামিল সাহিত্যের সামাজিক প্রতিরোধ ধারার চলচ্চিত্রিক রূপ।
তামিল সাহিত্যে নারী-স্বাধীনতা ও নারী-দৃষ্টিভঙ্গি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ। সালমা, অ্যাম্বাই, সুভা, ভি. গীতাঞ্জলি প্রমুখ লেখিকা তাঁদের সাহিত্যে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক রীতির বিরুদ্ধে নারীর আত্মপ্রকাশের ভাষা তৈরি করেছেন। সালমার “Irandaam Jaamangalin Kadhai” বা “Women, Dreaming” তামিল সাহিত্যে নারীদেহ, ধর্ম ও সামাজিক বিধিনিষেধের প্রশ্ন তোলে। এই সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক তামিল সিনেমায় প্রতিফলিত হয়েছে যেমন “আচ্চাম ইন্না মধামাইদা” বা “আরাচি”—যেখানে নারী শুধুমাত্র প্রেমের অবজেক্ট নয়, বরং নিজের সিদ্ধান্তের মালিক।
তামিল সাহিত্যে যেমন প্রকৃতি, নদী, পাহাড়, কৃষিজীবন ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে বহু রচনা হয়েছে, তেমনি সিনেমায়ও সেই মাটির গন্ধ থাকে। ভারতীরাজার সিনেমা, যেমন “মুথাল মারিয়াথাই” (১৯৮৫) বা “কারুটামপাট্টি”—সবই গ্রামীণ সাহিত্যিক কাহিনির চিত্ররূপ। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে তিনি সাহিত্যের মতোই কবিতার ছন্দে তুলে ধরেছেন। তামিল সিনেমা তাই শুধু শহুরে সমাজের গল্প নয়, এটি গ্রামীণ ও লোকজ সংস্কৃতিরও এক ধারক।
তামিল সাহিত্য ও সিনেমার সম্পর্কের আরেকটি দিক হল ভাষা। তামিল ভাষা নিজেই এক রাজনৈতিক সত্তা। ১৯৫০-৬০-এর দশকে “ভাষা আন্দোলন” তামিল সমাজে তীব্র প্রভাব ফেলে। তখন সিনেমা তামিল ভাষার মর্যাদা রক্ষার মঞ্চ হয়ে ওঠে। গান, সংলাপ, চলচ্চিত্রের নাম—সব কিছুতেই তামিল গর্বের ছাপ। সাহিত্যের কবিতা ও সিনেমার সংলাপ একত্রে তামিল জাতীয়তাবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। সাহিত্যিক বৈরামুথু, যিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রের গীতিকার, তাঁর লেখায় ভাষা, প্রেম, ইতিহাস, রাজনীতি ও মানবতাবাদ একত্রে গাঁথা। বৈরামুথুর গানে যেমন সাহিত্যিক ভাবগভীরতা, তেমনি সিনেমার জনপ্রিয় আবেদন। তিনি আধুনিক তামিল কবিতাকে সিনেমার গানের মাধ্যমে মানুষের মুখে এনে দিয়েছেন।
তামিল সিনেমা আজ আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত। “জাই ভীম”, “পসামপুরাণম”, “সারপট্টা পরম্বরাই” বা “আসুরন”—এইসব চলচ্চিত্রে যে মানবিক প্রতিবাদ, ভাষাগত গর্ব, এবং জাতিগত আত্মসম্মান প্রকাশ পেয়েছে, তা সরাসরি তামিল সাহিত্যিক পরম্পরার ফল। পেরুমল মুরুগান, সালমা, মাধবন, বৈরামুথু, জয়কান্তন—এই লেখকদের সাহিত্যিক ভাবধারা সিনেমার মজ্জায় প্রবেশ করেছে। আজকের তামিল সিনেমা বিশ্বে এক রাজনৈতিক শিল্পরূপ—যেখানে সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃশ্যমান প্রতিবাদ একাকার হয়ে যায়।
তামিল সাহিত্য কখনও নিছক নান্দনিকতা নয়, এটি সমাজের বিবেক। তামিল সিনেমাও সেই সাহিত্যিক বিবেকের প্রতিচ্ছবি। সাহিত্য যেমন মানুষের অন্তর অন্বেষণ করে, সিনেমা সেই অন্তরকে দৃশ্যমান করে তোলে। “পোন্নিয়িন সেলভান”-এর ঐতিহাসিক আবেগ, “মাধোরুভাগন”-এর সামাজিক প্রতিবাদ, “পরাশক্তি”-র রাজনৈতিক ভাষা, “পারিয়ারুম পেরুমল”-এর জাতিগত যন্ত্রণা—সবই একই স্রোতের সন্তান।
তামিল সিনেমা ও সাহিত্য একসঙ্গে তামিল জাতিসত্তার গল্প বলে—একটি ভাষা, একটি জনগোষ্ঠী, একটি সংস্কৃতির আত্মসম্মানের ইতিহাস। সাহিত্য থেকে সিনেমা শিখেছে গভীরতা, দর্শন ও অন্তর্জগতের অনুসন্ধান; সিনেমা সাহিত্যের মতোই সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে, মানুষের চেতনায় বিপ্লব এনেছে। তামিল ভাষা, সাহিত্য ও সিনেমা—এই ত্রিমূর্তি দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক চেতনার মেরুদণ্ড, যেখানে শব্দ ও দৃশ্য একে অপরের মধ্যে দ্রবীভূত হয়ে এক অবিচ্ছিন্ন শিল্পরূপ নির্মাণ করেছে।

