যুক্তি, তক্কো এবং ঋত্বিক <br />  বেবী সাউ

যুক্তি, তক্কো এবং ঋত্বিক
বেবী সাউ

 

 

সাম্প্রতিক একটি বলিউড ছবিতে একটি বিখ্যাত সংলাপ হল, “ এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট, এন্টারটেনমেন্ট!” বিনোদন জগতের মূল কথা এটিই। উত্তর-ভুবনায়ন, যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন পুঁজি এবং উদারনীতির হাত ধরে আমাদের ঘরের মধ্যে এবং একাকী মুহূর্তগুলিকেও কিনে নিয়েছে, তার মূল কথা হল, এন্টারটেনমেন্ট। যার অর্থ ‘বিনোদন’ এবং যার মুখ্য উদ্দেশ্য মনোরঞ্জন করা। সিনেমা মূলত এই মনোরঞ্জন করার দর্শনের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভারতে তথা বাংলায় পাঁচ, ছয়, সাত-এর দশকে এমন কিছু মানুষ এসেছিলেন সিনেমার দুনিয়ায়, যাঁদের লক্ষ্য একটু অন্যরকম ছিল। সিনেমা তাঁদের কাছে শুধু মনোরঞ্জন ছিল না, ছিল একধরনের টেস্টামেন্ট। একটি বার্তা দেওয়ার বিষয় ছিল সিনেমায়। তাঁরা জানতেন পাঁচ-এর দশকের সময় থেকেই থিয়েটার নয়, সিনেমাই হয়ে উঠেছে মানুষের কাছে যাওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। আর এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক তথা সাংস্কৃতিক লড়াই করার কাজটিই করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। বিমল রায়, চেতন আনন্দ-এর পাশাপাশি সিনেমায় আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সমীহ জাগানোর মতো কাজ করলেন কয়েকজন, যাঁদের মধ্যে অন্যতম সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, আদুর গোপালকৃষ্ণন, মণি কাউল এবং অবশ্যই ঋত্বিক ঘটক। ঋত্বিক ঘটক সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যক্তিত্ব নিয়েই এলেন সিনেমার দুনিয়ায়।

এ বিষয়ে আমরা ভাবতে বসলে, দেখব, তাঁর সিনেমার ভাষা শুধুমাত্র সিনেমা নামক শিল্পমাধ্যমের প্রতি সৎ থাকার জন্যই ব্যবহৃত নয়। এর পিছনে রয়েছে ঋত্বিক ঘটকের গভীর রাজনৈতিক দর্শন। এই দর্শন অবশ্যই বামপন্থী ঘরানার, কিন্তু এমন এক বামপন্থার, যা প্রতি মুহূর্তে নিজেকে প্রশ্ন করার একধরনের সন্দর্ভ তৈরি করে। আমরা ঋত্বিকের ‘নাগরিক’ ছবি থেকেই দেখতে পাই তিনি আমাদের ভাবাতে চেষ্টা করছেন। ভাবাচ্ছেন। আমরা শুধুমাত্র একটি সিনেমা দেখে বিনোদনের জন্য সময় কাটিয়ে কিছুটা রিল্যাক্স করে ফিরে এসে নিজেদের কাজ করতে পারছি না। সিনেমা আমাদের মধ্যে তৈরি করছে একধরনের বোধ। এমন বোধ, যা বিপন্নতা তৈরি করে। যা আমাদের জীবনের যে নিত্য বহমান স্থির জলাশয়ের ‘ইনসিপিড’ অস্তিত্ব, তা থেকে মুক্ত করে। ঋত্বিকের সিনেমা আমাদের তথাকথিত সিনেমা দেখায় না। আমরা যে সিনেমা দেখছি, তা থেকে বরং তিনি আমাদের নিয়ে যান এমন এক জগতে, যা আমরা যাপন করছি। আর এই অনুভূতিমালার সৃজনে তিনি ব্যবহার করেন আদিম টোটেম, ট্যাবু এবং বিশ্বাসের নানান প্রতীক। তাই তাঁর ছবিতে দেশের বা বাংলার সমার্থক মাতৃপ্রতিমার আর্কিটাইপ বারবার ফিরে আসতে দেখি। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কিংবা ‘কোমল গান্ধার’ অথবা ‘সুবর্ণরেখা’ বা ‘মেঘে ঢাকা তারাআ’-তেও আমরা বুঝতে পারি ঋত্বিক নির্মিত একটি ফ্রেমও অরাজনৈতিক নয়। তিনি আমাদের বিপন্ন করছেন, ঠিক যেভাবে আমাদের বিপন্ন করেন জীবনানন্দ দাশ। যদিও, জীবনানন্দ দাশে যেভাবে দেখেছেন ‘ নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো’, সেভাবে নয়, ঋত্বিক নিজের মতো একধরনের তন্ত্র তৈরি করেন তাঁর সিনেমাগুলিতে। যে কারণে ঋত্বিক সিনেমানির্মাণের ভাষা অন্য সকলের সিনেমা নির্মাণের ভাষার চেয়ে পৃথক।

তিনি নিজেই বলেছিলেন, “ যদি কোন দিন সিনেমার চেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম আসে সেদিন সিনেমাকে লাথি মেরে সেখানে চলে  যাবো। আই ডোন্ট লাভ ফিল্ম..! ” এ কথা বলার একটাই কারণ। তিনি সিনেমার প্রেমে পড়েননি। তিনি কোনও শিল্পমাধ্যমেরই প্রেমে পড়েননি। তিনি শিল্পমাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিজের কথাগুলিকে বলার জন্য। আমরা সকলেই দেখেছি ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ সিনেমায় তৃতীয় ধারার বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত ছেলেগুলির সঙ্গে মূল প্রোটাগনিস্ট চরিত্র যা স্বয়ং ঋত্বিক ঘটক অভিনয় করেছিলেন, সেখানে কীভাবে তিনি একধরনের রাজনৈতিক সন্দর্ভই তৈরি করছেন। এমন একধরনের রাজনৈতিক সংলাপ আমরা পেয়েছি গোদারের ছবিতে, পেয়েছি মিগুয়েল দি লিটিনের ছবিতে। এই সিনেমাটি ঋত্বিকের রচিত একটি প্রবন্ধ বললেও ভুল হবে না মনে হয়। সেখানে মুখ্য চরিত্র ‘নীলকণ্ঠ’ ঋত্বিক ঘটকেরই যে অভিন্ন এক চরিত্র, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঋত্বিক বলছেন, ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো, যা পরবর্তী কালে আমাদের এই ভাষার এক চিরকালীন প্রবাদ হয়ে উঠবে। তিনি যুক্তি তক্কো গপ্পো ছবিতে শেষের দৃশ্যে বলেছিলেন, ভোরের আলোয় একবার সত্যের মুখ দেখতে চাই।

ঋত্বিক বেঁচে থাকেন আমাদের হৃদয়ে এভাবেই। তিনি আমাদের মনোরঞ্জন তো করেনই না, বরং তিনি আমাদের নিয়ত্ব অস্বস্তিতে ফেলে দেন। তিনি নিজে যে সত্যের মুখ দেখার চেষ্টা করেছেন তাঁর নির্মিত সিনেমাগুলির মাধ্যমে, সেই সত্য তিনি দর্শকদেরও দেখানোর চেষ্টা করেছেন তাঁর সিনেমাগুলির মাধ্যমে। ঋত্বিকের বড় হয়ে ওঠা অবিভক্ত বাংলায়, ঔপনিবেশিক ভারতে, তবে, ঔপনিবেশিক আধুনিকতার যে ছোঁয়া শহর কলকাতার গায়ে লেগেছিল, তা থেকে অনেক দূরে, ঐতিহ্য যেখানে স্থির হয়েছিল অনেক দিন ধরে,  সেই গ্রামীণ নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গে, প্রকৃতির কাছাকাছি, যেখানে সাম্রাজ্যের ও যন্ত্রসভ্যতার মুঠো থেকেছে আলগা, বরাবর। অবিভক্ত বাংলা তাঁর শিল্পবোধের প্রাণকেন্দ্রে রয়ে যাওয়ার মূল কারণ সম্ভবত তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিতে থেকে যাওয়া প্রাকৃতিক পরিসর। সাধারণভাবে, সৃষ্টিশীলতা, শিল্প ও অবিভক্ত বাংলার যৌথ স্মৃতির যোগাযোগের নিরিখেই তাঁর ছবিতে প্রাকৃতিক দৃশ্যের প্রাসঙ্গিকতা, তবে আমার মনে হয় প্রাকৃতিক দৃশ্য ক্ষমতাকে প্রশ্ন করবার ক্ষেত্রেও বাঙ্ময়তা অর্জন করেছে। আশিস রাজাধক্স দেখিয়েছিলেন ঋত্বিকের ছবি মিথকে ভেঙে ফেলার জন্য প্রযুক্ত হয়েছে। মিথ বলতে আশিস বুঝেছিলেন: এমন কিছু ধারণার সমাহার যা সময়ের মধ্যে দিয়ে প্রশ্নাতীত সত্যিতে রূপান্তরিত হয়েছে, এমন কিছু ছবি যা নির্দিষ্ট সংস্কৃতি পরিসরে সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে। ব্রেখট বলবেন এই মিথ প্রশ্নের মুখে পড়ে যখন আধিপত্যকারী দৃষ্টিকোণ ও আধিপত্যকারীর মধ্যে সম্পর্ক রচনায় নিয়োজিত হয় শিল্প। আমার মনে হয় প্রাকৃতিক দৃশ্যের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে ঋত্বিক তাঁর চলচ্চিত্রে জাতীয় উন্নতি ও প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নভাবে সভ্যতার অগ্রগতির যে মিথ ঔপনিবেশিকতা ও তৎপরবর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে নিহিত আছে, তাকে আক্রমণ করেছেন। পাশাপাশি সেই আক্রমণের নিশানা হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমান্ত, যান্ত্রিক সময়, এবং সেই সাথে ঔপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ শোষণের চলমানতার অনুষঙ্গে, শ্রেণি, লিঙ্গ, ও অন্য নানাবিধ বিভাজন রেখা, যা জাতিরাষ্ট্রের দেহে অদৃশ্যভাবে কার্যকর থাকে। ঋত্বিকের এই রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে রয়ে গেছে আমাদের নিজেদের মনের মধ্যে থাকা রাজনৈতিক প্রশ্ন। সুবর্ণরেখা ছবিতে বন্দরের ব্যবহার, সুবর্ণরেখা ছবিতে দাদা যেভাবে বোনকে হত্যা করে, সেই দৃশ্য এবং মেঘে ঢাকা তারায় ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’ যেন আমাদেরই আর্তি হয়ে ওঠে।

এই আর্তি ঋত্বিক পরবর্তী ছবিগুলিতে সিনেমাকরিয়েদের মধ্যে অনুপস্থিত। সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘জনঅরণ্য’, ‘ প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে এই আর্তি আছে।  আছে মৃণাল সেন-এর ‘ইন্টারভিউ’, ‘ ভুবন সোম’, ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিতে। কিন্তু এটা খুব উল্লেখযোগ্য, যে নয়ের দশকের শুরু থেকে বাংলা ছবিতে ধীরে ধীরে এই আর্তি এবং এই রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকল। এমনকি সিনেমার ভাষাতেও আর বাংলা ছবি আন্তর্জাতিক ছবি তো দূরর কথা, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ভাল ছবিগুলির পাশে দাঁড়াবার জায়গা পেল না। যে পণ্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঋত্বিকের লড়াই ছিল সিনেমার ভাষাতেই সিনেমার মাধ্যমে, সেই পণ্য সংস্কৃতির দ্বারাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে বাংলা সিনেমা। আজ আমরা ঋত্বিক ঘটকের ছবি দেখতে বসলে যে রাজনীতিকে দেখছি, যে রাজনৈতিক  সন্দর্ভকে প্রত্যক্ষ করি, তা আমরা বুঝতেই পারি না বাংলা সিনেমা দেখতে বসলে। এখনকার বাংলা ছবি দেখতে বসলে মনে হয় আমাদের বাস্তবতা খুব সুখী, আর নয় তো খুব পরাক্রমী। আমাদের মধ্যে যে একটা সুস্থ তর্ক আছে, যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে, সত্যের জন্য বা সত্যের বিভিন্ন রূপের জন্য যে সংগ্রাম আছে, যে মানসিক অস্থিরতা আছে, জীবনানন্দ কথিত যে বিপন্ন বিস্ময় আছে, তা এখনকার বাংলা ছবির মধ্যে একেবারেই অনুপস্থিত। বিপন্ন করার সংস্কৃতি তো নেই, এখন বাংলা সিনেমা ভাল বা খারাপ, তা বিচার্য হয়, কতটা ভাল ভাবে মধ্যবিত্তদের মনোরঞ্জনের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে এই সিনেমা। ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতেও ঋত্বিকের ভাবা এই রাজনৈতিক প্রশ্নগুলি অনুপস্থিত। বাস্তবতা এত ‘সুন্দর’ নয়। সত্য এত ‘পেলব’ নয়, এত সাজানো নয়।

ঋত্বিকের ছবি, ছবির ভাবনা এবং ছবির মাধ্যমে এক অন্তর্ঘাতের প্রসারণ আমরা বরং দেখতে পাই দেবেশ রায়ের উপন্যাসে, নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট, যুদ্ধ পরিস্থিতি কিংবা ফ্যাতাড়ু ও বোম্বাচাক-এর গল্পগুলির মধ্যে। মনে হয় আজকের যুগে এলে ঋত্বিক এই আন্তর্জাল মাধ্যমটাকেও ব্যবহার করতেন তাঁর রাজনৈতিক সন্দর্ভগুলিকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ঋত্বিক জানতেন, তাঁর ছবি ভাবায়, ভাবা প্র্যাকটিস করায়। ঋত্বিক ভীষণই সংক্রামক। অথচ, তিনি পূজ্য হয়ে গেলেন। কেউ না পারল তাঁকে গিলতে না হজম করতে।

ঋত্বিক ঘটক একা ছিলেন, একা আছেন এবং একাই লড়ছেন, এখনো।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes