
লিখি আয়ু লিখি গান
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
না বাঁচাবে আমায় যদি মারবে কেন তবে?
কিসের তরে এই আয়োজন এমন কলরবে?।অগ্নিবাণে তূণ যে ভরা, চরণভরে কাঁপে ধরা,
জীবনদাতা মেতেছ যে মরণ-মহোৎসবে ॥
বক্ষ আমার এমন ক’রে বিদীর্ণ যে করো
উৎস যদি না বাহিরায় হবে কেমনতরো?
এই-যে আমার ব্যথার খনি জোগাবে ওই মুকুট-মণি–
মরণদুখে জাগাবে মোর জীবনবল্লভে ॥
ছোটবেলায় মহাবিস্ময়ে এই গানটির দিকে চেয়ে থাকতাম।আজও থাকি তাই। তবে বিস্মিত হওয়ার কারণটা আলাদা আলাদা। তখন, গীতবিতান সবে আমার ছুটিযাপনের সঙ্গী হয়েছে,উঠোন থেকে তিন ধাপে উঠে যাওয়া সিঁড়ির মাঝেরটিতে বসে আমি চাঁপাফুলরঙা মলাট উল্টে গানগুলো পড়ছি,এই গান আমার কাছে দুরূহ এক ধাঁধার মতো লাগবে।প্রথম লাইনটার পর আর আমি এগোতে পারি না।না বাঁচানো এবং মারা,সমার্থকই তো! তবে? তবে রবিঠাকুর এমন গোলমেলেভাবে গান শুরু করলেন কেন। এছাড়াও সুচিত্রা মিত্রের গলায় ইপি রেকর্ডে এ গান বাজত আমাদের বাড়িতে, গলার সেই আকুতি বুঝতে পারতাম না। কিন্তু মোহাবিষ্টের মতো শুনতাম গান।
সে যা হোক, অনেকদিন যাবৎ এ গান আমাকে ধন্দে রেখেছিল। তারপর বড় হচ্ছি। মিশনারী স্কুলে পড়ার সুবাদে খ্রীষ্টের অনেক সমাচার আমার হৃদয়গোচর হচ্ছে। জানতে পারছি পানিশমেন্ট, স্যাক্রিফাইস এগুলো আমাদের মনের মলিনতা ধুয়ে দেয়। ঈশ্বর কিংবা সেই অতিন্দ্রিয় শক্তিকে অন্তত কিছুটা অনু্ভব করা যাবে তখন।
তারপর রবীন্দ্রনাথ পড়ছি।সে-পাঠ ততটা নিবিড় কিনা বলতে পারব না। কিন্তু কোথাও যেন অন্ধকার কেটে আলো আসছে।গানটি আরও একবার পড়ার অব্যবহিত আগেই শান্তিনিকেতন পড়লাম। মনে হল গানে প্রতি লাইনের রহস্যময়তা জড়ো হতে হতে শেষলাইনে এসে রূপ নিল।
মরণদুখে জাগাবে মোর জীবন বল্লভে
সারাজীবনের অকিঞ্চিৎকর মৃত্যুসম শোক, অপমান, পরাজয় ও অসহায়তা সব নিবেদিত হল এক অদৃশ্যের চরণে। জীবন, অন্তত,পূর্ণের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছোল।
জপমন্ত্রের মতো গানখানি তার নিহিত অর্থ ও সুরসম্ভারে আবার অবাক করে রাখল আমাকে।

