
মনোজগতে রবীন্দ্র থেরাপি
সোনালী ঘোষ
“বন্ধু রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণপ্রাতে’’
আসলে মানুষ একা একটি নিঃসঙ্গ প্রাণী।সমাজবদ্ধ ভাবে বাস করলেও তার মনজগৎ চিন্তনে সর্বত্র সে একা। এটা থেকে সে বাঁচতে খানিক সময় বন্ধু চায়।প্রকৃত অর্থে মানুষ পথিক মাত্র “তার পথ চলাতেই আনন্দ।” ক্ষণিকের সময় সে পাশে কিছু মানুষ পায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ডেস্টিনেশনে পৌঁছানো মাত্র বিচ্ছেদ অনিবার্য।এই বিচ্ছেদ মানব মনে দুঃখের ধারাপাত ঘটায়। এই দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পেতে সে সময়ের কাছে হাত পাতে । সময়ের সাথে সাথে সব ক্ষত উপশম হয়। কোন মানুষ এই অনুভূতির জগৎকে চিকিৎসা করতে পারে বলে অন্তত আমার জানা নেই।
এই ধুলোমাটি ভরা পৃথিবী। এই পৃথিবীর নিজস্ব একটি নিয়ম আছে। জন্মানোর পর থেকে আমরা সেই নিয়মের অধীন হয়ে থাকি, আমরা চাই বা না চাই জাগতিক ঘটনাবলী আমাদের জীবন নিয়ে খেলা করে, খানিক কেড়ে নেয় খানিক ফেরৎ দেয়।তাই আমরা কি বলতে পারি না আমাদের বন্ধু, আমাদের চিরসখা হল সময় ,সেই আমাদের অন্তর দেবতা। দেবতা প্রসঙ্গ এলে মনে হয় তাকে অর্চনার কথা, যাকে প্রকৃতি বলে ডাকি সেই তো অর্চনা করে যাবতীয় সময় তার ই শরণাগত হই।
জীবনের তত্ত্বগত দিক আধ্যাত্মিক দিক এসবের বিশ্লেষণ প্রাচীন মুনিঋষিরা দিয়েছেন তবে সেসবে ডোবার ক্ষমতা সকলের নেই। তার থেকে সহজ সরল সাবলীল ভাবে যে দেবতা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান যার জ্যোতির্ময় ছটা আমাদের নিরাময় দেয় তিনিই তো প্রাণের ঠাকুর।
“জগতে ঋতু পরিবর্তনের সর্বপ্রধান কাজ প্রেম জাগানো, ফুল ফোটানো…”(কেকাধ্বনি, বিচিত্র প্রবন্ধ), এসব হল সময়ের উপকরণ, নিজের অজান্তে অন্দর মহলে টেনে নিয়ে আসি । এই যে প্রেমের কথা তিনি বলছেন, সত্যি জীবনে বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হল প্রেম। তবে সেই প্রেম যে কেবল মানুষের সাথে তা কিন্তু নয় একথা রবীন্দ্রনাথ বারেবারে বলেছেন।
আমরা দেখেছি সাজাদপুর শিলাইদহ কতখানি সমৃদ্ধ করেছে তার লেখক সত্ত্বাকে। আবার দেখেছি পদ্মায় নৌকভ্রমণকালীন সময়ে তার মনজগৎ কী ভাবে আন্দোলিত হত। একটু গূঢ়ভাবে নিবিষ্টতা আনলেই বোঝা যাবে আমাদের অন্তরলোক ঐ প্রকৃতি ও ঋতুচক্র দ্বারা প্রভাবিত। আসলে জীবন চক্র আর ঋতু চক্র এই দুয়ের সংমিশ্রণে প্রবাহিত হয় মানব জীবন মন। আর রবীন্দ্রনাথ বারবারই এই দুটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আমরা আধুনিক মানুষ মনের যত্ন নিতে পারি না, অথচ আশ্চর্য এই মন ছাড়া জগৎ সংসার একটা এ.আই. হয়ে থাকবে।
জীবন আসলে অনুভূতির সমাহার। সেই অনুভূতির দোলায় মানুষ আসল মানুষ হয়ে ওঠে। বর্তমান মানুষ বড় কর্মমুখী, আপাত সুখে সে খুশি হয় অথচ মনের ভেতর বাসা বাঁধে দুরারোগ্য ব্যাধি।
মহাকবি বাল্মীকি , কালিদাস, বৈষ্ণবপদকর্তাগণ সকলেই ঋতুর প্রাধান্যকে শিরোধার্য করেছেন, সেই ধারার অনন্ত পথের সন্ধান রবীন্দ্রনাথের লেখার ভিতর।প্রতিটি ঋতুর একটি স্বভাব বৈশিষ্ট আছে, আছে রহস্য আছে ব্যঞ্জনা তাকে ধরতে পারে কজন। আমাদের অনন্তকাল প্রবাহিত হয়ে যায়, মনের খেয়াল রাখতে পারি না। মনের ভেতর যে অমৃত কুম্ভ আছে তাকে মন্থন প্রয়োজন আমাদের আজীবন কালে ক্ষয় হয়ে যায় মনন, মেধা।মনে হয় কোথায় গেলে পাব।রবীন্দ্রনাথ এসকলের ধারক বাহক। তিনি এই মন্থন পদ্ধতিতে সিদ্ধহস্ত।তাই বারেবারে ডুবে গেছেন কালিদাস বাল্মীকির কাব্য সাহিত্যে তুলে এনেছেন রত্নরাজি, গড়েছেন মনিহার। মনিহার পরিহিত হয়ে তিনি সাগ্নিক পুরুষে পরিণত।
সব ঋতু বিভিন্ন ভাবে রহস্য আনলেও বর্ষার যে একটা আলাদা মাদকতা আছে একথা একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন যখন কালিদাস লেখেন
“আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্টসানুং
বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদৰ্শ॥”
বর্ষার প্রথম জলে মন কুল খুঁজে পায় না সে সময় বোধকরি রবিঠাকুরের হাত ধরতেই হয়-
“কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে
কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত করে।”
এই মেঘদূত ছাড়া বর্ষা প্রিয় মন যেন তৃপ্ত হয় না আবার রবীন্দ্রনাথ ছাড়া যেন সে পথ অতিক্রম দুর্গম হয়ে ওঠে।
আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমনি করে গাও গো, আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করে চাও গো—’’
সত্যিই নিজের ভেতর বাসা বাধা চেতনার বুদবুদগুলো কেমন শূন্য পথে উড়ে যায়। ভাষা হারিয়ে যায় অথচ কত কথা বলার ছিল। নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে হয় । ছাদ বারন্দায় নিভৃত কোনটিতে।এই বাস্তব জীবন কেমন সব মিথ্যে হয়ে যায়, মিথ্যে হয়ে যাই আমি নিজেও মনে হয় “পোস্টমাস্টার” এর সেই চিরসত্য লাইন “এ পৃথিবীতে কে কাহার”। এপ্রকৃতি তো জগৎ সংসারে নতুন নয় আবহমান ধরে চলে আসছে তবু তা আজ ও মানুষকে মোহিত করে এক ই রকম করে। এক ই রকম করে বিস্মৃতির আড়ালে নিয়ে যায়, কখনো বৈরাগ্য বোধের জন্ম দেয় কখনো কখনো প্রেম সত্ত্বার জাগরণ ঘটায়। এই প্রকৃতির রূপের হদিশ সকলে পায় না। কেউ পায় তার গভীর অধ্যাবসায় কেউ পায় গুরুবলে। যেমনটি চর্যাপদের পদকর্তারা বলে ছিলেন “গুরু পুচ্ছিঅ জান” সেই গুরুবাণী বলে-
“আষাঢ়ের মেঘ প্রতি বৎসর ই যখন আসে তখনই নতুনত্বের রসাক্রান্ত ও পুরাতনত্বে পুঞ্জীভূত হইয়া আসে…মেঘদূতের মেঘ প্রতি বৎসর চির নতুন চির পুরাতন হইয়া দেখা দেয়।কালিদাস উজ্জ্বয়িনীর প্রাসাদ শিখর হইতে যে আষাঢ়ের মেঘ দেখিয়াছিলেন, আমরাও সেই মেঘ দেখিয়াছি , ইতিমধ্যে পরিবর্তনমান মানুষের ইতিহাস তাকে স্পর্শ করে নাই…ইহাতে বর্ষার সমস্ত অন্তর্বেদন নিত্যকালের জন্য লিখিত হইয়া গেছে।”(নববর্ষা, বিচিত্রপ্রবন্ধ)
আমাদের জীবনের বর্ষার ধারাভাষ্যকার হিসেবে তিনি বিরাজমান। মনে হয় তিনিও আধুনিক জীবনে মেঘদূতের কামনা করেছেন
“মেঘলা দিনে’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন—‘আজ মেঘলা দিনের সকালে শুনতে পাচ্ছি, সেই ভিতরের কথাটা কেবলই বন্ধ দরজার শিকল নাড়ছে। ভাবছি, কী করি। কে আছে যার ডাকে কাজের বেড়া ডিঙিয়ে এখনই আমার বাণী সুরের প্রদীপ হাতে বিশ্বের অভিসারে বেরিয়ে পড়বে।’ এখানে কি নিজেদের অন্তর্জগত প্লাবিত হয় না।
যেখানে নিজেকে চিনতে অথবা বহির্জগত ও অন্তর্জগত প্রবল ভাবে দ্বন্দ্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তল খুঁজে পাওয়া যায় না ঠিক তখন
হৃদয়টি রবীন্দ্রনাথের সম্মুখে মেলে ধরলেই জটিল সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
তিনি লেখেন, ‘কেবল অতীত বর্তমান নহে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অতলস্পর্শ বিরহ। আমরা যাহার সহিত মিলিত হইতে চাহি সে আপনার মানসসরোবরের অগমতীরে বাস করিতেছে; সেখানে কেবল কল্পনাকে পাঠানো যায়, সেখানে সশরীরে উপনীত হইবার কোনো পথ নাই।’ চির প্রণম্য তিনিই।