
ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ: তোমায় নতুন ক’রে পাবো ব’লে
শংকর টুটু চ্যাটার্জি
সত্যি বলতে কি, ছোটোবেলায় তো অতশত বুঝতাম না। তখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যে পরিচয় শুরু তা প্রধানত তাঁর গান দিয়ে। বাজছে, শুনছি। এমনিতে গান হিসেবে, সুর হিসেবে তা হয়ত ভালোও লাগছে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তার বেশি কিছু না। খুব যে গানের কথাগুলো বুঝছি, উপলব্ধি করছি, এমন মোটেই না। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি। আরো বড় হচ্ছি। যত পড়াশুনার পরিধি বাড়ছে, বিশেষত সাহিত্যের ছাত্র হওয়ার সুবাদে একটা বোধ তৈরী হচ্ছে, ফলত গান শোনার একটা অভ্যেস তৈরী হচ্ছে। আর বুঝতে শিখছি, কোন গান শুনতে ভালো লাগছে আর কোন গান ততটা ভালো লাগছে না। তফাতটা নিজের কাছেই পরিস্কার হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথাগুলোর অর্থ ধরা দিচ্ছে মনে। দুই বয়সে শোনা “আজি দক্ষিণপবনে দোলা লাগিল বনে বনে” অথবা “তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার বাজাই আমি বাঁশি, গানে গানে গাঁথে বেড়াই প্রাণের কান্না হাসি”-র অর্থ দুভাবে ধরা দিচ্ছে। তো, এই তো হল শুরুর কথা।
এরপর স্বাভাবিক নিয়মেই জীবনের গতি নানা বাঁক নিচ্ছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নম্বর পাওয়ার আর পাস ফেলের চক্করে ইংরাজি সিলেবাস এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক পড়াশুনোয় খানিক হলেও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে প্রেম গেল ঘুচে। এরপর পেশাগত জীবনে প্রবেশ করছি, নেশাগত জীবনেও। নানারকম পেশা পেরিয়ে, হবি তো হ, শিক্ষক হলাম। তাও আবার ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্যের। এদিকে আবার, নানা নেশা পেরিয়ে মাথায় স্টিল ফটোগ্রাফির ভুত চাপল। এই চলছে। এরপর মনের তাড়নায় আর খানিক শিক্ষকতার প্রয়োজনেও আবার মাথা নত করে ফেরা সেই রবীন্দ্রনাথেই। কেননা, সে কথা আর কে না জানে, রবীন্দ্রনাথ ব্যতিরেকে বাঙালীর অন্তত বাঁচা অসম্ভব।
এইবার, বড় বয়সে যখন তাঁর কাছে ফিরে আসা, তখন দেখি এক নতুন রবীন্দ্রনাথ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর উচ্চতা অনেক অনেক উঁচুতে। তাতে পৌঁছনো ভীষণ কঠিন। এ কেবল ঐ গান শোনা আর টুক্ করে পাঠ্যসূচির রবি ঠাকুর পড়ার মত বালখিল্য কাজের কম্ম নয়। এতে সারা জীবনের সাধনা লাগে। সেই শুরু হল রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে থাকা, সচেতনে। অবচেতনেও। খুলে যেতে লাগল নতুন করে দেখার চোখ, মনের দুয়ার। তখন যা-ই পড়ি, তার অন্যরকম অর্থ খুঁজে পাই। আজকের দুনিয়ার, আজকের জীবনের সংযোগ, অনুষঙ্গ দেখতে পাই। বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথ কেন পুরোনো হন না। কেন তিনি চির আধুনিক। কেমন করে তিনি আজও আমাদের হাত ধরে নিয়ে চলেন। তাঁর গানে, তাঁর লেখায় কেমন করে তিনি দেখিয়ে চলেন, এমনকি আজকের এই অত্যাধুনিক জীবনেও বাঁচার পথ। ক্রমাগত যুগিয়ে চলেন জীবনপথ চলার পাথেয়। আমার কেবলই মনে হয়, মানুষের যত বয়স হয়, রবীন্দ্রনাথকে সে বয়সের সাথে সাথে নিত্যদিন নতুন নতুন রূপে আবিস্কার করতে থাকে।
জীবনস্মৃতি পড়ছি। আবার। পাঠকমাত্রেই জানেন শুরুতেই আছে, “স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা কিছু ঘটিতেছে তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড় করিয়া তোলে। সে আগের জিনিষকে পাছে ও পাছের জিনিষকে আগে সাজাইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজ ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।“ বলা বাহুল্য এই কথাগুলো আগেও বহুবার পড়েছি। কিন্তু যখন ছবি তুলছি এবং তা ফটোশপ নামক এক সফটওয়্যারে এডিট করছি, মানে ঐ খানিক এদিক ওদিক করছি, তখন এই লাইনগুলো নতুন অর্থে ধরা দিচ্ছে। ভাবছি, তাই তো! আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কী বাদ দিচ্ছি, কত কী রাখছি। কত বড়োকে ছোটো করছি, ছোটোকে বড় করিয়া তুলছিও তো বটে। আগের জিনিষকে পাছে ও পাছের জিনিষকে আগে সাজাইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছি না। মনে মনে হাসছিও খানিক। এর যে এহেন অর্থ হয়, এ বোধহয় একান্তই আমার ব্যক্তিগত পাগলামি।
আবার জীবনস্মৃতিতেই খানিক এগিয়েই পাচ্ছি, “…ছেলেদের অপরাধকে আমরা বড়োদের মাপকাঠিতে মাপিয়া থাকি, ভুলিয়া যাই যে, ছোটো ছেলেরা নির্ঝরের মতো বেগে চলে; সে জলে দোষ যদি স্পর্শ করে তবে হতাশ হইবার কারন নাই, কেননা সচলতার মধ্যে সকল দোষের সহজ প্রতিকার আছে…” স্কুলে যখন ছাত্রছাত্রীরা কোন দোষ করে, এমনকি বাড়িতে আমার নিজের ছেলেও—তখন মনে মনে রবীন্দ্রনাথ যেন আমার কানে বলতে থাকেন, সকল দোষের সহজ প্রতিকার আছে, আমি যেন ছেলেদের অপরাধকে বড়োদের মাপকাঠিতে না মাপি, হতাশ হইবার কারন নাই ।
আবার রবীন্দ্রনাথের গান বারেবারে শুনছি, কবিতা ফিরে পড়ছি এই বয়সে। সে সব গান আগে কেবল গান হিসেবেই শুনেছি, কবিতা রূপেই পড়েছি। হয়ত বা তার অন্য অর্থ জেনেছি, ভেবেছি। এখন সে গান, সে কবিতা যেন মনের ক্যানভাসে অন্য অর্থে, অন্য মূর্ত রূপে ফুটে উঠছে। কল্পনায় ছবি তৈরী হচ্ছে। তবে এমন নয় যে এ জিনিষ কেবল আমার সাথেই ঘটছে বা আমি করছি। বহুকাল আগেই Ansell Adams বলে গিয়েছিলেন, “You don’t make a photograph just with a camera. You bring to the act of photography all the pictures you have seen, the books you have read, the music you have heard, the people you have loved.” স্বাভাবিকভাবেই এখন সে সব গান কবিতার লাইন, এমনকি গদ্য বা প্রবন্ধেরও লাইন ক্যামেরার সাহায্যে ছবির জন্ম দিচ্ছে, ছবিতে অনূদিত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা বেশি বেশি করে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ যেন আমায় দিয়ে বহু ছবি তুলিয়ে নিচ্ছেন। ছবি তোলার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে আমার চোখের সামনে। স্কুলে পড়ার সময় যাতায়াত পথে এতকালের রোজ দেখা ইঁটভাটা অথবা ধান কাটা আজ ক্যামেরা হাতে অন্য অর্থ নিয়ে মনে পড়াচ্ছে ‘ওরা কাজ করে’ অথবা সাইকেল নিয়ে হুশ করে চিরকাল পেরিয়ে যাওয়া গ্রামের ভাঙা পরিত্যক্ত মন্দির দেখে মনে ছবি তৈরী হচ্ছে, “সন্ধ্যাগগনে ঘোষে না শঙ্খ তোমার আরতি বারতা, তব মন্দির স্থির গম্ভীর ভাঙা দেউলের দেবতা”। একটু একটু ক’রে গরম পড়ছে। কোনও এক শনিবারের দুপুর। হাফছুটি। ছেলেমেয়েদের হুটোপুটি। আমার মনে ছবির জন্ম দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথঃ “সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর পাঠশালা পলায়ন, ভাবিলাম হায়; আর কি কোথাও ফিরে পাব সে জীবন”। উদাহরণ অসংখ্য। আর আমার পুরুলিয়া তো সারা বছর সব ঋতুতেই ছবির মত সুন্দর। রবীন্দ্রনাথের ঋতু পর্যায়ের সকল সৃষ্টিই যেন মূর্ত হয় এখানে, এ এক মস্ত সুবিধা। মোদ্দা কথা হল রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি আর আমার একান্তই নিজের ভাবনা থেকে জন্ম নেওয়া আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে প্রায় একশ ছবির একটি অ্যালবামই আছে (Rabindranath Recreated)।
ঠিক কোন ক্লাসে পড়েছি মনে নেই। কিন্তু যখন কবি খলিল জিব্রান-এর “On Children” (১৯২৩) পড়ছি,
“Your children are not your children.
They are the sons and daughters of Life’s longing for itself…”
তখন ভাবছি, এই বিষয়ের কবিতা তো পড়েছি আগে রবি ঠাকুরের কাছে। সে কবেই ১৮৯৫ সালেই চৈতালী কাব্যগ্রন্থে “স্নেহগ্রাস” কবিতায় শেষ দুটো লাইনে শিখিয়েছেনঃ
“নিজের সে, বিশ্বের সে, বিশ্বদেবতার—
সন্তান নহে গো মাতঃ সম্পত্তি তোমার”।।
এভাবেই পাঠ্যসূচিতে টেনিসন-এর Crossing The Bar (১৮৮৯) পড়ছিঃ
Sunset and evening star
And one clear call for me!
আপন মনেই মনের ভেতর গুনগুন করে উঠছিঃ
অশ্রুনদীর সুদূর পারে ঘাট দেখা যায় তোমার দ্বারে
এরকম আরো কত আছে। উদাহরন দিলে এই লেখাকে ভারাক্রান্তই করা হবে কেবল। আমার মনের আঙিনায়, রোজকার যাপনে যেমন করে রবীন্দ্রনাথের বিচরণ, সব যদি লিখতে থাকি, এ লেখা বোধহয় সব সীমা অতিক্রম করে যাবে। পাঠকের কাছে তা বোধহয় খানিক বিরক্তির কারণও হবে। এ কেবল আমার নিজ মনের অনুভূতির বর্ণনা।
শেষ করি আমার নিজের সবচেয়ে প্রিয় রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির কথা বলে। আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের যা কিছু আমি পড়েছি, রক্তকরবী আমার প্রিয়তম। এত চিরকালীন, এত প্রাসঙ্গিক আর কোন লেখাকেই আমার মনে হয় না। রাষ্ট্র, শাসক, শাসকের অত্যাচারী রূপ, সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে পুতুল হয়ে ব্যবহৃত হতে হতে কোনমতে বেঁচে থাকা। এবং রাষ্ট্র অথবা শাসকের মানুষের রক্ত মাংস হাড় ঘামের ওপর দাঁড়িয়ে বিপুল ধনসম্পত্তির পাহাড়ের মালিক হয়ে ওঠা, এ জিনিষ কখনো পুরোনো হয় না। সমস্ত যুগে, সমস্ত কালে এ সত্য। এমনকি আজকের এই ২০২৪ এর ভারতবর্ষেও তা প্রযোজ্য। আজও আমার দেশেই রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলে নন্দিনী অথবা রঞ্জনকে কি মরতে হয় না? ঠিক এই একই কারনে সত্যজিতের ‘হীরক রাজার দেশ’-ও আজও সমান প্রাসঙ্গিক। সাধারন নাগরিক মানে সে শুধুই একটা সংখ্যা। সে সংখ্যা আধার কার্ডের হোক বা ভোটার কার্ডের। ১৯২৪ এর রক্তকরবীতে যারা ছিল অষ্ট আশি, ৬৯ঙ, পঁচানব্বই, অথবা তিনশো একুশ, আজ একশত বছর পর আমরা কেবল একটু কলেবরে বেড়ে বারোটি সংখ্যা হয়েছি। ফলে, এভাবেই, আজও জীবনের প্রতি পদে পদে রবীন্দ্রনাথ সাথে সাথে চলেছেন। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত।
এই গদ্যের বিষয়ের নাম যখন ব্যক্তিগত রবীন্দ্রনাথ, তবে একটি একান্তই ব্যক্তিগত অনুভুতি দিয়েই ইতি টানি। যেদিন বাবা চলে গেলেন। সৎকারে নিয়ে যাওয়া। বাবা ছিলেন উত্তম কুমারের ভক্ত। আমরা দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, সুন্দর পাঞ্জাবী ধুতি পরেছেন সারা জীবন। সে মানুষটিকেই সেদিন পরনের সমস্ত কাপড় সরিয়ে একটি সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে বাবার দেহ। মাঝে খুব অল্প সময়ের জন্য বাবার দেহে স্বাভাবিভাবেই কোনো কাপড় ছিল না। সে দৃশ্যের সাক্ষী শুধুমাত্র আমি। সব হয়ে যাবার পরের দিন চুপ করে বসে আছি। স্মৃতিতে কত কী ভেসে উঠছে। মনে পড়ছে বাবার শেষ সময়টুকু। হঠাৎই মনে পড়ল রক্তকরবী। আমি সেদিন যেন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম রবীন্দ্রনাথের একটা উক্তি। একদম নতুন অর্থ নিয়ে উন্মোচিত হলঃ “উলঙ্গের কোনো পরিচয় নেই, বানিয়ে তোলা কাপড়েই কেউ বা রাজা, কেউ বা ফকির।“